Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

এ সফর সুফিয়ানা

চিত্র সৌজন্য: সৈয়দ মহম্মদ কাশিম

অরুণপ্রকাশ রায়

 

পূর্ব প্রকাশিতের পর

দ্বিতীয় পর্ব

‘সব সখিয়ান মা চুনার মোরি মইলি দেখ হাসে নরনারী, অব কে বাহার চুনার মোরি রং দে রাখ লে লাজ হামারি নিজাম পিয়া’। জাফর হুসেন বদায়ুনি বড় ভাল গাইতেন এই গানটি। চলে গিয়েছেন ১৯৯৮-তে। ফরিদ আয়াজসাব-এর বাবা (উনি বাবা বলেই ডাকতেন বাবাকে) মুনশি রাজিউদ্দিন একদিন নিজামুদ্দিন দরগায় বসে তাঁর পরম বন্ধু জাফরের কাঁধে হাত রেখে কাওয়ালি শুনছিলেন, এবং এই গানখানিই গাইছিলেন এক তরুণ কাওয়াল। জাফরসাব জিজ্ঞেস করলেন, “রাজি, ইয়ে নয়া কবুতর কৌন হ্যায়?” মুনশিজি সস্নেহে একটা বিচ্ছিরি গালি (সে কালে মানুষ মুখখারাপও করত আদর করে) দিয়ে বললেন, “আবে, …… তেরা ভাতিজা হ্যায়!”

মন্ত্রমুগ্ধ জাফরসাব বিড়বিড় করতে করতে আধময়লা কুর্তার জেব থেকে একটি মলিন পঞ্চাশ টাকার নোট বের করে তরুণটির হারমোনিয়ামের ওপর রাখলেন। নোটটি আজও আছে ফরিদসাবের কাছে, ওঁর করাচির বাড়িতে। অনেকেই জানেন না, জাফরসাব চাইলে রামপুর সহস্বান ঘরানার বহু উস্তাদ গওয়াইয়াকে শুইয়ে দিতে পারতেন শুধু গলার মিষ্টত্ব দিয়ে। কিন্তু, বড়ই নিরীহ মানুষ ছিলেন জাফরসাব। ইনায়েত খান-এর উত্তরসূরিদের মধ্যে ওঁর নাম না নিলে ভারী গুস্তাকি হবে। জাফরসাবের বড় ভাইপো ওয়াজাহাতও অপূর্ব গাইতেন, বিশেষ করে খুসরো-র ‘কাহে কো বিয়াহি বিদেশ’ এবং ‘এ রি সখি মোরে খোয়াজা ঘর আয়ে’। কিন্তু চলে গেলেন বড় অল্প বয়েসে। হার্ট সার্জারির পর অনতিবিলম্বে স্টেজে ফিরে আসতে চেয়েছিলেন। ঈশ্বরের মার— ফিরে আসার সেই অনুষ্ঠানে গান গাইতে গাইতে ঢলে পড়েন স্টেজের ওপরেই। উস্তাদ নিসার হুসেইন খাঁ-র ঘরানার এই দু’জনের কথা উল্লেখ করা ভীষণ জরুরি, কারণ ভারতীয় সংস্কৃতির সুযোগ্য প্রতিনিধি হিসেবে এঁদের প্রায়ই বিদেশে নিয়ে যাওয়া হত, মঞ্চে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হত হিন্দুস্তানি ক্লাসিকাল কাওয়ালির ‘বেহতর ফনকার’ বলে। সম্মান মিলত ঠিকই, কিন্তু পয়সাকড়ি বিশেষ পেতেন না এঁরা। দানিশ বদায়ুনি-র নামে ইউটিউবে খুঁজে দেখলে এ ঘরানার কিছু চমৎকার গান পেয়ে যাওয়া যায়। এঁদের তিনজনেরই একটা ছোট্ট লিস্প ছিল দন্ত্য স-এর ওপর, সে যে কী অসাধারণ লাগত শুনতে, কী বলব! সুফি কত্থকশিল্পী মঞ্জরী চতুর্বেদী এই পরিবারের জন্য অনেক করেছেন তাঁর সুফি ফাউন্ডেশন-এর তরফে, অনুষ্ঠান আয়োজন করে, দেশবিদেশের নানা জায়গায় এই ঘরানার কাওয়ালিকে লোকপ্রিয় করে তুলে।

বছর দু’য়েক আগে একবার নিজামুদ্দিন দরগায় দেখা হয়েছিল ‘গাল্‌ফ পোস্ট’-এর সিনিয়র সাংবাদিক মেহের মুর্শেদ-এর সঙ্গে। মেহের কলকাতার ছেলে, ‘সং অফ দরবেশ’ বইটির লেখক হিসেবেও যথেষ্ট সুখ্যাতি অর্জন করেছেন। গোটাকতক অতি কাঁচা কাওয়াল মিলে ‘রকস্টার’ ফিলিমের ‘কুন্ ফায়া কুন্’ গাইছিল দরগার মেঝেতে বসে, সঙ্গে চলছিল বেদম বেতালা ঢোলের সঙ্গত। কয়েক সারি পেছনে বসে চুপচাপ শুনছিলেন কাওয়াল চাঁদ নিজামি। আমি আশাহত মেহেরের কানে কানে বললাম, “ভাল গান শুনবে?” মেহের মাথা নেড়ে সম্মতি জানাতেই আমি হামাগুড়ি দিয়ে কার্পেটের এক কোণে বসে থাকা চাঁদ নিজামি সাহেবের কানে ফিসফিস করে বললাম, “দেখুন, এ অনাচার আর ধর্মে সইছে না, নিন, আপনি হারমোনিয়াম টেনে নিয়ে ঠিকঠাক গোটাকতক কালাম শোনান দিকি।” চাঁদসাব স্মিতমুখে এ অধমের অনুরোধ রাখতে পরবর্তী দেড় ঘন্টা ধরে একের পর এক আমির খুসরো-র কালাম গাইতে থাকলেন, মেহের আর আমি মুগ্ধতায় বাক্যহারা হয়ে বসে রইলাম!

https://www.4numberplatform.com/wp-content/uploads/2021/01/Audio-Clip-1.mp3?_=1

দরগার খাদিম পিরজাদা আলতমাশ নিজামি পরে বলেছিলেন, “অরুণভাই, বহোত খুশনসিবি হ্যায় আপকি— ইয়ে ভিআইপি পারফরম্যান্স থা, চাঁদমিয়াঁ কো অ্যায়সে গাতে হুয়ে কভি নহি সুনা ম্যায়নে।” সত্যিই সেদিন মনে হয়েছিল অসময়ে বসন্ত নেমে এসেছে আউলিয়ার দরবারে।

আর একবার ফরিদসাব এসেছেন দিল্লিতে। ছতরপুরের কোনও এক বাগানবাড়িতে গাইবেন। ঠিকানা জানেন না, কারণ, উদ্যোক্তারা বলেছেন, নিজেরা গাড়ি পাঠিয়ে নিয়ে যাবেন এবং ফেরত দিয়ে যাবেন তাঁর চাঁদনি চকের তস্য গলির ভিতরে চিতলি কাবারের কোনও এক অখ্যাতনামা রশিদ গেস্ট হাউস-এ। বহুকষ্টে এক উদ্যোক্তার ফোন নম্বর জোগাড় করে পৌঁছলাম সেই বাগানবাড়িতে। অমিত গুপ্তা নামে এক বিখ্যাত ব্যবসায়ীর বাড়িতে অনুষ্ঠান, কোনও এক ফাউন্ডেশনের স্পনসরশিপে। ব্যাকস্টেজে গিয়ে দেখি ফরিদসাবের মেজাজ সপ্তমে! কী ব্যাপার! একটু খোঁচাতেই আসল কারণ বেরিয়ে পড়ল। নিতান্ত ব্যাজার মুখে জানালেন, ওঁর পানের স্টক ফুরিয়ে গিয়েছে, আর উদ্যোক্তারা নাকি হাতজোড় করে জানিয়েছেন, পাঁচ কিলোমিটারের মধ্যে কোনও পানের দোকান নেই!

কী কেলেঙ্কারি! ফরিদ আয়াজ গাইতে বসবেন পানের ডিবে ছাড়া! আমি পত্রপাঠ চুপি-চুপি গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম, ছতরপুর মন্দিরের কাছে একটা দোকান থেকে একশোবিশ জর্দা-ঠাসা একডজন পান বানিয়ে শালপাতায় মুড়ে নিয়ে ফিরে এলাম। ততক্ষণে স্টেজ নিয়ে নিয়েছেন ফরিদসাব। হারমোনিয়ামের মিঠে সুর ছড়িয়ে পড়ছে চারপাশে। স্টেজের পেছনে একটি বিশ-পঁচিশ বছরের মেয়ের মস্ত পোর্ট্রেট। বড় অসময়ে চলে গিয়েছে সে, নিজের প্রিয়জনদের ফেলে রেখে। জানতে পারলাম, অসময়ে চলে যাওয়া সেই মেয়েটির মা-ই এই মেহফিলের প্রধান উদ্যোক্তা। মেয়েটির স্মৃতি বোধহয় স্পর্শ করেছিল ফরিদসাবকেও। সেদিন কোথায় পড়ে রইল আমির খুসরো-র পরিচিত সব রচনা— সামনে বিছানো কার্পেটে বসে শুনলাম ফরিদসাব তাঁর স্বভাবসিদ্ধ বুলন্দ আওয়াজের বদলে অত্যন্ত নিচু গলায় ধরেছেন একটি পঞ্জাবি শায়রি,

মা পিউ দে ঘর উলি ভুলি ধিয়া ইক দিন সাঁওরে ঘর জানা,
জেড়ে আয়ব উয়ুব মেরে মা না কাজ্যে আগ্গে সাস ভি কাজ্যে তে মায় জানা।
আজ পিয়া মোরে অঙ্গনে মে আয়ে,
মায় চরণ পকড় কর ঝুক রইয়াঁ

https://www.4numberplatform.com/wp-content/uploads/2021/01/Audio-Clip-Farid-Ayaaz.mp3?_=2

তুফায়েল নিয়াজির গলায় এ গান আগে শুনেছি, কিন্তু সেদিন আমি এই পোড়া চোখেও স্পষ্ট দেখেছিলাম আধো-অন্ধকারে ক্যানভাসের অভিমানিনী মেয়েটির মুখে একটি আলগা হাসি ফুটে উঠেছিল, মাইরি বলছি। পরে আমার পাশে বসে থাকা সহধর্মিনীও এ জিনিসটা আমাকে খুব নিচু গলায় জিজ্ঞেস করেছিলেন, আমি মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলেছিলাম। চারপাশের হাওয়া যখন একটু ভারী হয়ে উঠেছে, অনেক শ্রোতারই চোখের কোণে জল, ফরিদসাব পরিস্থিতি হালকা করার জন্য হেসে চোখ টিপলেন আমাকে, হাতের মুদ্রায় জানতে চাইলেন পানের খবর। আমি আমার শালপাতার ঠোঙাটা দু’বার তুলে ধরে দেখিয়ে স্টেজের ধারে বসে থাকা ওঁর ছোট ছেলে তহসিনকে ধরিয়ে দিলাম, উনি স্টেজ থেকে একটা চমৎকার কুর্নিশ করলেন আমাকে। মন ভাল হয়ে গেল।

আর একটি গল্প শুনিয়ে এই পর্ব শেষ করব। তখন আমি গুড়গাওঁতে থাকি। এক শনিবার বিকেলে দেখি, আমার ফোনে একটা অচেনা নম্বর থেকে বারবার ফোন আসছে। তুলে দেখি, অভ্রান্ত ফরিদ আয়াজের গলা। কী ব্যাপার? জানতে পারলাম, আমার বাড়ির খুব কাছেই কোনও এক শিল্পপতির বাড়িতে ওঁর প্রাইভেট মেহফিল রয়েছে সেই সন্ধ্যায়। এইটুকু বলে, কাকে একটা ফোনটা ধরিয়ে দিলেন। অত্যন্ত পরিশীলিত একটি গলা (গলা না-বলে কণ্ঠ বলাই ভাল) আমাকে সেই সন্ধের জন্য বিনম্রভাবে নেমন্তন্ন করলেন, গান শোনা ও ডিনার খাওয়ার জন্য। সঙ্গে সেই কণ্ঠ এও জানালেন, শিগগিরই মেহফিলের ঠিকানা এসএমএস করে দেওয়া হবে আমাকে। বুঝুন কাণ্ড! এ তো হাতে চাঁদ পাওয়ার সমান! গোটাকতক কাজ ছিল, ঝটপট সেরে নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম সন্ধে সাতটা নাগাদ। পৌঁছে দেখি, এলাহি ব্যাপার। একেবারে চাঁদের হাট বসে গিয়েছে সেই বিশাল বাংলোয়। সব অভ্যাগতরাই প্রচণ্ড সুসজ্জিত, দামি পারফিউমের গন্ধে বেসমেন্টের মিনি অডিটোরিয়ামের প্রতিটি কোণ ম ম করছে। এক অতীব সুন্দরী মধ্যবয়সিনী (আমারই মতো বয়েস) আমাকে নিয়ে গিয়ে হাজির করলেন একটি ঘরে। তাকিয়ে দেখি, একটি উইং চেয়ারে বসে আছেন ফরিদসাব, চোখদু’টি বোজা।

আমার গলা শুনে তড়াক করে লাফিয়ে উঠে জড়িয়ে ধরলেন আমাকে, আর আশপাশে তাকাতে লাগলেন, জানতে চাইলেন আমার বৌ-মেয়ে কোথায়, তারা আসেনি কেন? ততক্ষণে মহিলা আঁচ করে নিয়েছেন ঠিক কী ঘটেছে, আমাকে দিয়ে বাড়িতে ফোন করিয়ে, বাকি দু’জনকে আনিয়ে নিলেন পরের আধঘন্টার মধ্যে। ফরিদসাবের চোখে খুশির জল— দু’পাশে হাজির তাঁর মেয়ে ও নাতনি তুহিনা আর আরশি (আমার বৌ-মেয়েকে উনি বেটি অওর নোয়াসি বলেই সবাইকে পরিচয় দিয়ে থাকেন)।

খানিকক্ষণের মধ্যেই স্টেজ নিলেন ফরিদসাব, আরশি ধরে-ধরে ওঁকে নিয়ে গিয়ে স্টেজে বসিয়ে দিয়ে এল। ফরিদসাবের রক্তে চিনির পরিমাণ যথেষ্ট বেশি, পায়ে প্রায় কোনও সাড় পান না। জুতো পায়ে গলিয়ে হাতে ধরে দেখতে হয়, সত্যিই ঠিক করে পরেছেন কিনা। কিছু খাওয়ার আগে পেটে ইনসুলিন ইঞ্জেকশন নিয়ে নেন নিজেই। পরনে সেই খালি গায়ে সনাতন জোব্বা, নিম্নাঙ্গে কেবল একটি লুঙ্গি। লুঙ্গির ওপরে একটি চামড়ার বেল্ট বাঁধেন কোমরে, যাতে উঠতে-বসতে সুবিধা হয়। সেদিন যেহেতু শ্রোতাদের হাতে হুইস্কির গেলাস ছিল, তাই গাইছিলেন একের পর এক কমার্শিয়াল কাওয়ালি, ‘দমাদম মস্ত কলন্দর’, ‘ছাপ তিলক’, ‘মেরা পিয়া ঘর আয়া’, ‘তেরে ইশ্‌ক নাচায় কর থাইয়া থাইয়া’ ইত্যাদি। আমি আর তুহিনা একেবারে পেছনের সারিতে বসে চুপি-চুপি রাম-এ কোলা মিশিয়ে খাচ্ছিলাম, কারণ, ফরিদসাব গৃহকর্ত্রীকে বলে দিয়েছিলেন, “যে অরুণ আর ওর বৌকে মদ অফার করবে তাদের আমি প্রচণ্ড পেটাব।”

ঘন্টা দুই পরে প্রোগ্রাম শেষ করে আমরা চারজনে একসঙ্গে ডিনার সারছি বিরিয়ানি আর বোটি কাবাব দিয়ে, তুহিনা বলল, “ফরিদসাব, আজ মেরা ঘর চলিয়ে, কাল শাম আপকি হাজরি হ্যায় দরগাহ শরিফ মে, ম্যায় ড্রাইভ করকে ছোড় দুঙ্গি।” এককথায় রাজি হয়ে গেলেন তিনি, শিশুর মতো দুই চোখে খুশি টলটল করে উঠল। পাশে বসা একজন সোশ্যালাইট মহিলা আমায় দেখিয়ে প্রশ্ন করলেন, “পিরসাব, ইয়ে হজরত কৌন হ্যায়।” তুরন্ত উত্তর এল, “অরুণ মেরা শাগির্দ হ্যায়, আউর হজরত নিজামুদ্দিন আউলিয়া কে মুরিদ।” তারপরেই আমার দিকে তাকিয়ে একগাল হাসি, আর আমার তো লজ্জায় মাটিতে মিশে যাওয়ার জোগাড়।

তারপরের কাহিনি খুব সংক্ষিপ্ত। চটপট খাওয়া শেষ করে, মুখ মুছে, একটি পান গালে গুঁজে, আমার অল্টো-র পেছনের সিটে জাঁকিয়ে বসলেন ফরিদসাব… “বিটিয়া কে ঘর যা রহা হুঁ”…

 

(ক্রমশ)


লেখার ভেতরের ছবি লেখকের সৌজন্যে