Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

রামায়ণ পরিক্রমা: মহাকাব্য ও তার পরিণতি

কণিষ্ক চৌধুরী

 



শিক্ষক, প্রাবন্ধিক, সমাজবিজ্ঞানের উৎসাহী ছাত্র ও গবেষক

 

 

 

ভারতের মতো ইউরোপ এশিয়ার বিভিন্ন দেশগুলিতে যুগ যুগ ধরে মহাকাব্যগুলি সাহিত্যের দুনিয়াকে সমৃদ্ধ করেছে। ভারতে যেমন রামায়ণ-মহাভারত, তেমনি মেসোপটেমিয়ার গিলগামেশ, গ্রিসের ইলিয়াড-ওডিসি, স্পেনের এলসিড, জার্মানির নিবেলুঙ্গেনলায়েড ইত্যাদি। ইউরোপীয় মহাকাব্য ও পৌরাণিক কাহিনিগুলি পাঠক ও শ্রোতাকে অনাবিল আনন্দ দেয়। কাহিনির অসামঞ্জস্য ও ফাঁকগুলি পূরণ হয় পাঠক-শ্রোতার কল্পনা দিয়ে। চলে নির্মাণ-পুনর্নির্মাণের খেলা। কিন্তু এ খেলার রসাস্বাদন কর্মটি যখনই সাহিত্যের অন্দরমহল ছেড়ে রাজনীতির প্রাঙ্গনে এসে দাপাদাপি করে তখন তা আর যাই হোক মানুষের নির্মল পিপাসার জল হতে পারে না। একথা বলার অর্থ এটা নয় যে, সাহিত্য বহির্জগতের, বিশেষ করে রাজনীতি ও অর্থনীতি নিরপেক্ষ। বরং লেখকদের সামাজিক, রাজনৈতিক ও মতাদর্শগত অবস্থানই তাঁদের রচিত সাহিত্যকর্মগুলির চরিত্র নির্ধারণ করে দেয়।

এখানে উত্থাপিত সমস্যাটি অন্য। ইউরোপের মহাকাব্য ও পৌরাণিক কাহিনিগুলি আধুনিক পাঠকের কাছে প্রাচীন বা মধ্যযুগীয় সাহিত্যের নিদর্শন মাত্র, বর্তমান সমাজ ও সভ্যতায় অনুসরণযোগ্য আদর্শ নয়। ভারতের ছবিটা কিন্তু ভিন্ন। রামায়ণ মহাভারত শুধু সাহিত্য নয়, ধর্মগ্রন্থও বটে। সাম্প্রতিককালে হিন্দুত্ববাদীদের হাতে পড়ে এটি রাজনৈতিক শিক্ষা ও আদর্শের গ্রন্থেও পরিণত হয়েছে। ছিল বিড়াল হয়ে গেল রুমাল। ছিল মহাকাব্য, হল ধর্মগ্রন্থ— আর অন্তিমে রাজনৈতিক গ্রন্থ। সামনে চলে এল রামরাজত্বের ধারণা, অবতার রাম ও তার আদর্শ শাসনের তত্ত্ব। কীভাবে মহাকাব্য, পৌরাণিক গল্প ও রূপকথা রাজনীতির অঙ্গনে ব্যবহৃত হতে পারে, ‘বর্তমান সময়’ হল তার অনন্য উদাহরণ। কর্পোরেট দুনিয়ার সঙ্গে সম্পর্কের গল্পটিও কম চিত্তাকর্ষক নয়।

 

রামায়ণ পরিক্রমা প্রধান সমস্যা হল কোন রামায়ণের কথা এখানে বলা হচ্ছে? প্রচারের কল্যাণে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ বোধহয় বাল্মীকি রচিত রামায়ণের কথাই ভাববেন। দেশের শাসকবর্গও সম্ভবত এটাই চান। এই চাওয়াটির সঙ্গে শাসক রাজনীতির সাংস্কৃতিক সম্পর্কটি গভীর। কারণ শাসক মাত্রই তার স্বার্থের পরিপূরক সংস্কৃতির প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা করতে চায়। এই সাংস্কৃতিক আধিপত্যের সঙ্গে একমাত্রিক সাহিত্যের ঘনিষ্ঠতা সবসময়েই বর্তমান। ফলে রামায়ণের লেখক হিসেবে বাল্মীকির নাম যেমন সর্বত্র প্রচারিত হয় সাবেকি পদ্ধতিতে, তেমনি প্রযুক্তিবিদ্যার সার্বিক প্রয়োগে আধুনিক অনাধুনিক সমাজের সকল স্তরের মানুষকে প্রভাবিত করার চেষ্টা চলে। এই লক্ষ্যেই দূরদর্শনে রামানন্দ সাগরের রামায়ণ প্রদর্শনের আয়োজন। ১৯৮০র দশকের শেষভাগে আধুনিক প্রযুক্তির সাহায্যে রামায়ণ প্রদর্শন ও তাকে ঘিরে যে উন্মত্ততার আবির্ভাব ঘটেছিল, তা বর্বরদের বাবরি মসজিদ ভাঙার ঘটনা থেকে বিচ্ছিন্ন কোনও ঘটনা নয়। এটি ছিল একমাত্রিক সাংস্কৃতিক আধিপত্য প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনায় একটি অন্যতম প্রধান অংশবিশেষ।

একটু চোখ-কান খোলা রাখলেই দেখা যাবে রামায়ণ একটা নয়, বহু। প্রায় শ দুয়েক রামায়ণের সন্ধান মিলবে শুধু ভারতে না, ভারতের বাইরেও। এদের সব রচনাকারদের নাম খুঁজে পাওয়াটা আজ খুবই কঠিন। হয়তো পাওয়াও যাবে না। বাল্মীকি রচিত রামায়ণের পূর্বেও রামের গল্প ভারতের মানুষের জানা ছিল। বাল্মীকির পরেও আরও বহুজন রামায়ণ লিখেছেন— আপন মনের মাধুরী মিশিয়ে। গল্পের পটভূমি, চরিত্র, ঘটনাক্রম, নৈতিক মূল্যবোধ, সামাজিক শিক্ষা সবদিক থেকেই রামায়ণগুলির মধ্যে রয়েছে অজস্র ভিন্নতা। শাসক ও হিন্দুধর্মের স্বঘোষিত রক্ষকেরা এই বিভিন্নতাকে, এই বৈচিত্রকে অস্বীকার করে। অথচ ভারতীয় সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যে এই বিভিন্নতা একটি প্রতিষ্ঠিত বাস্তবতা। এই বাস্তবতাকেই স্বনিয়োজিত ধর্মের অভিভাবক আরএসএস, বিজেপি, বিশ্ব হিন্দু পরিষদ, শিবসেনা ও সদৃশ সংগঠনগুলি গায়ের জোরে দমন করতে উদ্যোগী। রামায়ণের অন্য আখ্যানগুলি যখনই মঞ্চস্থ করার প্রচেষ্টা হয়েছে, তখনই সেই সাংস্কৃতিক কর্মীদের উপর নেমে এসেছে হিন্দুত্ববাদী আক্রমণ। এদের লক্ষ্য এক ধরনের একশৈলজ সমাজ সংস্কৃতি নির্মাণ। (Thapar; 2014 : 219)।

হিন্দুত্ববাদীদের এই ধরনের আক্রমণ কেবল ভারত ভূখণ্ডেই নয়, ইওরোপেও ঘটতে দেখা গেছে। ১২ নভেম্বর ২০০৩-এ অধ্যাপক ওয়েন্ডি ডনিগর লন্ডন শহরে আয়োজিত এক আলোচনাসভায় রক্ষণশীলদের দ্বারা আক্রান্ত হন। আলোচনা চলাকালীনই তাঁকে একজন ডিম ছুড়ে মারে। এই ডিম নিক্ষেপকারীর ক্রোধের কারণ হল ডনিগর উল্লেখিত লক্ষণ সম্পর্কিত সীতার উক্তি (Doniger; 2011 : 14)। সীতার চমকপ্রদ বক্তব্যটি পরিপ্রেক্ষিত সহ এখানে দেওয়া হল।

এটি বাল্মীকি রামায়ণের অরণ্য কাণ্ডের ঘটনা। মারীচ নামে জনৈক রাক্ষস রাবণের আদেশমতো স্বর্ণমৃগ সেজে সীতাকে প্রলুব্ধ করে। সীতা রামকে সেই সোনার হরিণটিকে ধরে আনতে অনুরোধ করলে, রাম স্বর্ণমৃগ শিকারে বেরিয়ে পড়ে। রামের তীরে মারীচের মৃত্যু হয়। মৃত্যুর আগে মারীচ সীতা ও লক্ষণ-এর নাম করে চিৎকার করে ওঠে। সে আর্তরব শুনে সীতার মনে হয় যে রাম জঙ্গলের মধ্যে বিপদে পড়েছে। তখন সীতা লক্ষণকে সেখানে যাওয়ার জন্য অনুরোধ করে। কিন্তু লক্ষণ তাতে রাজি না হওয়ায় সীতা লক্ষণের ওপর রেগে গিয়ে বলে:

তুমি এইরূপ অবস্থাতেও রামের সন্নিহিত হইলে না, তুমি একজন তাহার মিত্ররূপী শত্রু। তুমি আমাকে পাইবার জন্য তাহার মৃত্যু কামনা করিতেছ। আমার নিশ্চয় বোধ হইতেছে যে, তুমি কেবল আমারই লোভে তাহার নিকট গমন করিলে না। তোমার ভ্রাতৃস্নেহ কিছুমাত্র নাই। তাহার বিপদ তোমার অভীষ্ট হইতেছে। এই কারণে তুমি তাহার অদর্শনেও বিশ্বস্ত মনে রহিয়াছ।

(ভট্টাচার্য্য, হেমচন্দ্র; ১৯৭৮ : ৩৮৬)

লক্ষণ সীতাকে নানাভাবে বোঝাতে চেষ্টা করল যে, এসব মারীচের মায়া। সীতাকে রক্ষার যে দায়িত্ব রাম তাকে দিয়েছে, তাকে অমান্য করা ঠিক হবে না। লক্ষণের এসব কথা শুনে সীতা আরও রেগে গেল এবং লক্ষণকে লক্ষ করে বলল:

নৃশংস! কুলাধম! তুই অতি কুকার্য করিতেছিস। বোধহয় রামের বিপদ তোর বিশেষ প্রীতিকর হইবে, তন্নিমিত্ত তুই তাহার সঙ্কট দেখিয়া ঐরূপ কহিতেছিস। তোর দ্বারা যে পাপ অনুষ্ঠিত হইবে, ইহা নিতান্ত বিচিত্র নহে। তুই কপট, ক্রূর ও জ্ঞাতিশত্রু! দুষ্ট! এখানে তুই ভরতের নিয়োগে বা স্বয়ংপ্রচ্ছন্নভাবেই হউক, আমার জন্য একাকী রামের অনুসরণ করিতেছিস। কিন্তু তোদের মনোরথ কখনও সফল হইবার নহে।

(পূর্বোক্ত ৩৮৭)

সীতার প্রত্যুত্তরে লক্ষণ যা বলল, তা-ও কম চিত্তাকর্ষক নয়:

অনুচিত কথা প্রয়োগ করা স্ত্রীলোকের পক্ষে নিতান্ত বিস্ময়ের নহে; উহাদের স্বভাব যে এইরূপ, ইহা সর্বত্র প্রায়ই দৃষ্ট হইয়া থাকে। উহারা অত্যন্ত চপল, ধর্মত্যাগী ও ক্রূর, এবং উহাদের প্রভাবেই গৃহবিচ্ছেদ উপস্থিত হয়। যাহা হউক, তোমার এই কঠোর কথা কিছুতে আমার সহ্য হইতেছে না। উহা কর্ণমধ্যে তপ্ত নারাচাস্ত্রের ন্যায় একান্ত ক্লেশকর হইতেছে। বনদেবতারা সাক্ষী, আমি তোমায় ন্যায্যই কহিতেছিলাম, কিন্তু তুমি আমার প্রতি যারপরনাই কটূক্তি করিলে। দেবি! তুমি যখন আমাকে এইরূপ আশঙ্কা করিতেছ, তোমায় ধিক! মৃত্যু একান্তই তোমার সন্নিহিত হইয়াছে।

(পূর্বোক্ত : ৩৮৭)

বাল্মীকি রামায়ণের সঙ্গে যার কোনও আলাপ পরিচয় নেই, তার পক্ষে সীতা ও লক্ষণের এই বাক্যালাপ শুনে চমকে ওঠাটাই স্বাভাবিক। মনে হতেই পারে এ তো প্রাকৃতজনদের মতো কথাবার্তা; এরা কীভাবে অনুসরণযোগ্য আদর্শ হবে? ডনিগর বাল্মীকি রামায়ণ থেকে এইসব অংশ উদ্ধৃত করায় ভক্তিবাদীরা যে যারপরনাই চটে যাবেন এবং ডিম ছুড়বেন— একথা বলাই বাহুল্য। ভালো কথা এটাই যে, তাঁর হেনস্থা এর বেশি কিছু হয়নি। তাঁকে অন্তত নরেন্দ্র দাভোলকার, অধ্যাপক কালবুর্গির মতো গুলি খেতে হয়নি, বা রাজীব হায়দার ও স্যামুয়েল প্যটির মত হিংস্র ধর্মোন্মাদদের হাতে হত হতে হয়নি।

প্রসঙ্গত বলা দরকার যে, ছোটবেলা থেকে শুনে আসা লক্ষণের গণ্ডি কেটে দেওয়ার গল্পটি কিন্তু বাল্মীকি রামায়ণে নেই। থাকলে হেমচন্দ্র ভট্টাচার্য (১৯৭৮) এবং রাজশেখর বসু (১৩৯৬ বাংলা) অবশ্যই ঘটনাটির উল্লেখ করতে ভুলতেন না। প্রকৃতপক্ষে এই ঘটনাটি পরবর্তীকালের লেখকদের সংযোজন। গণ্ডি দেওয়ার গল্পটি সম্ভবত কৃত্তিবাসই প্রথম সংযোজন করেন। (কৃত্তিবাস; ১৯৭৪ : ১৩১)। সকল লেখকই নিজস্ব কল্পনা দিয়ে রামায়ণ রচনা করেছেন। এখানেই রামায়ণের বিশেষত্ব, বৈচিত্র ও অনন্যতা। এখানেই তার সৌরভের উৎসস্থল। এই নানা রামায়ণের মালাকে বোঝার জন্য আমাদের দেখে নিতে হবে প্রাক-বাল্মীকি রামকথাকে। মহাকাব্যের সৌরভের উৎসমুখ রয়েছে এই রামকথার বিবর্তনের মধ্যেও।

 

বাল্মীকি রামায়ণ সর্বজন পরিচিত। বাল্মীকির পরিচয় আদি কবি হিসেবে। তাঁর রচনায় পূর্বেও রামের কথা ‘রামকথা’ ভারতে প্রচলিত ছিল। দীনেশচন্দ্র সেন বাল্মীকি রামায়ণের তিনটি উৎসের কথা বলেছেন: (ক) দশরথ জাতক; (খ) মহান ও অভিজাত ব্রাহ্মণ নায়ক রাবণ সম্বন্ধে দক্ষিণ ভারতীয় কাহিনিবৃন্দ; এবং (গ) ভারতবর্ষে একদা প্রচলিত বানরপূজা সম্পর্কিত আখ্যানসমূহ। (Sen, D.C.; 1920 : 3,7)। যে ‘দশরথ জাতক’-এর কথা এখানে উল্লেখ করা হয়েছে, তার উৎস হিসেবে পাওয়া যাবে সমসময়ের প্রচলিত নানা লোককথা/লোকগল্প। এখানে একটি বিষয় লক্ষ করার মতো। লোককথায়/লোকগল্পে রামকথা থাকলেও বাল্মীকি-পূর্ব ব্রাহ্মণ্য সাহিত্যে রামের কোনও উল্লেখ পাওয়া যায় না। বিজয়চন্দ্র মজুমদার লিখেছেন:

রাম এবং তাঁহার ভ্রাতৃবর্গের নাম, অথবা দশরথের নাম কোনও প্রাচীন সাহিত্যে পাওয়া যায় না। এই নামগুলি বৈদিক সাহিত্যেও নাই, সূত্রাদি গ্রন্থে নাই, পাণিনি ব্যাকরণে নাই অথবা ১৫০ খৃ: পূর্বের মহাভাষ্যে নাই। নামগুলি নাই। রামায়ণ ত্রেতাযুগের ঘটনা, নবাভিমানী রামচন্দ্র হিন্দুজাতির আদর্শ এবং পূজ্য। অথচ খৃ: পূ: দ্বিতীয় শতাব্দী পর্যন্ত কোনও হিন্দু সাহিত্যে তাঁহার উল্লেখ নাই। প্রাচীন সাহিত্যে সীতা আছেন, কিন্তু তিনি অন্যের পত্নী। পরাশর গৃহসূত্রের সীতা, ইন্দ্রের পত্নী; কৃষ্ণ যজুর্বেদের সীতা সাবিত্রীর দুহিতা এবং সোমের পত্নী।

(মজুমদার; ২০১৫ : ৩০)

একারণেই বোধহয় রামায়ণ সৃষ্টির ইতিহাস নাড়াচাড়া করতে গেলে বারংবার হোঁচট খেতে হয়। এতদিনের (শুধু) বিশ্বাস করা ধারণাগুলি নাড়া খেয়ে যায়। রামায়ণের উৎস খুঁজতে খুঁজতে পৌঁছে যেতে হয় প্রাচীন ভারতের সমাজ, রাজনীতি, অর্থনীতি ও সংস্কৃতির জগতে। সেই সমাজের সামাজিক বাস্তবতাকে ভিত্তি করে গড়ে উঠেছিল নানা লোকশ্রুতি, লোকগাথা, লোককাহিনি। ব্রাহ্মণ্য সাহিত্যের মধ্যে রামকথা না থাকলেও তার আদিরূপটির সন্ধান মিলবে এই লোককথার/কাহিনির মধ্যে। রবীন্দ্রনাথ অন্তত সে কথাই বলেছেন তাঁর ‘সাহিত্য সৃষ্টি’ (সাহিত্য) নামক প্রবন্ধে:

দেশের সাধারণ লোকের মধ্যে প্রথমে কতগুলি ভাব টুকরা টুকরা কাব্য হইয়া চারিদিকে ঝাঁক বাঁধিয়া বেড়ায়। তারপরে একজন কবি সেই টুকরা কাব্যগুলিকে একটা বড় কাব্যের সূত্রে এক করিয়া একটা বড়ো পিণ্ড করিয়া তোলেন। হরপার্বতীর কত কথা যা কোনো পুরাণে নাই, রামসীতার কত কাহিনী যা মূল রামায়ণে পাওয়া যায় না, গ্রামের গায়ক-কথকের মুখে মুখে পল্লীর আঙিনায় ভাঙা ছন্দ ও গ্রাম্যভাষার বাহনে কত কাল ধরিয়ে ফিরিয়া বেড়াইয়াছে। এমন সময় কোনো রাজসভার কবি যখন, কুটিরের প্রাঙ্গনে নহে, কোনো বৃহৎ বিশিষ্ট সভায় গান গাহিবার জন্য আহূত হইয়াছেন, তখন সেই গ্রাম্য কথাগুলিকে আত্মসাৎ করিয়া লইয়া মার্জিত ছন্দে গম্ভীর ভাষায় বড়ো করিয়া দাঁড় করাইয়া দিয়াছেন।

(ঠাকুর; ১৪০২ বাংলা; ৪ : ৬৫৯)

এই সূত্রায়ণের ভিত্তিতেই রবীন্দ্রনাথ মন্তব্য করেছেন:

রামায়ণ রচিত হইবার পূর্বে রাম-চরিত সম্বন্ধে যে সমস্ত আদিম পুরাণকথা দেশের জনসাধারণের মধ্যে প্রচলিত ছিল এখন তাহাদিগকে আর খুঁজিয়া পাওয়া যায় না। কিন্তু তাহাদেরই মধ্যে রামায়ণের একটা পূর্বসূচনা দেশময় ছড়াইয়া ছিল, তাহাতে কোনো সন্দেহ নাই।

(পূর্বোক্ত : ৬৬১)

রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে সহমত প্রকাশ করে ভাষাচার্য সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ও মনে করেন যে রামকাহিনি একশৈলজ নয়; বহুকাল ধরেই লোককথার কাহিনিরেণুর মধ্যে তা মিশে ছিল। খ্রিস্টপূর্ব ৫০০-তে লিখিত ‘দশরথ জাতক’ এইরকম লোককথার একটি প্রকাশ। এগুলিই হল রামায়ণের ‘বীজ’ গল্প। (Chatterjee; 2009 : 242)। পল্লব সেনগুপ্তের পর্যবেক্ষণটি এখানে তাৎপর্যপূর্ণ। “বহুকাল ধরে প্রচলিত বেশ কিছু লোককথার কাহিনীরেণুর অন্তর্গত বিভিন্ন অভিপ্রায়কে (মোটিফ অর্থে) এর মধ্যে (রামায়ণের মধ্যে) মিশ্রিত হতে দেখা গেছে। এই মিশ্রণেরই রূপান্বিত পরিণতি হল রামায়ণ। বাল্মীকি-রামায়ণের পূর্বেই এই কাহিনি প্রচলিত ছিল খ্রিস্টপূর্ব ৪র্থ শতক থেকে খ্রিস্টীয় ১২শ শতক অবধি, আদি রামায়ণ বলে যা এখন প্রচলিত, তার কলেবরের পরিবৃদ্ধি ঘটেছে” (সেনগুপ্ত, ১৯৯৯ : ৯০)। প্রবোধচন্দ্র সেনও মনে করেন রামায়ণের আদি উৎস হল জনশ্রুতি (সেন, প্রবোধচন্দ্র, ১৯৭৮ : ৮)। ঐতিহাসিক রোমিলা থাপার রামায়ণের বিবর্তনের নানা স্তরের কথা উল্লেখ করে আঞ্চলিক প্রভাবের দিকটির উপর আলোকপাত করেছেন (Thapar, 1982 : 221)। ভিনটারনিৎস-এর মতে রামকাহিনি লোকগান ও গাথার মধ্যে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল, বাল্মীকি সেগুলিকে একত্র করে একটি ঐক্যবদ্ধ রূপে প্রকাশ করেন (Winternitz, 1978 : Vol-I, Part-II : 417)। হেমচন্দ্র রায়চৌধুরীও বাল্মীকি-পূর্ব রামকথার উপস্থিতি যে ছিল— তা স্বীকার করে নিয়েছেন (Roychoudhury, 1989 : 24)।

বাল্মীকি-রামায়ণের পূর্বেও যে রামকথা সমাজে প্রচলিত ছিল (যদিও সেগুলি ব্রাহ্মণ্য সাহিত্যের মধ্যে নয়) তার একটি গুরুত্বপূর্ণ সূত্র পাওয়া যাবে ওই গ্রন্থটির মধ্যেই। একেবারে শুরুতেই। বালকাণ্ডের প্রথম সর্গতে বাল্মীকি নারদকে জিজ্ঞাসা করেছেন:

দেবর্ষে! এক্ষণে এই পৃথিবীতে কোন ব্যক্তি গুণবান, বিদ্বান, মহাবল, পরাক্রান্ত, মহাত্মা, ধর্মপরায়ণ, সত্যবাদী, কৃতজ্ঞ, দৃঢ়ব্রত ও সচ্চরিত্র আছেন? কোন ব্যক্তি সকল প্রাণীর হিতসাধন করিয়া থাকেন? কোন ব্যক্তি লোকব্যবহার কুশল, অদ্বিতীয়, সুচতুর ও প্রিয়দর্শন? কোন ব্যক্তিই বা রোষ ও অসূয়ার বশবর্তী নহেন? রণস্থলে জাতক্রোধ হইলে কাহাকে দেখিয়া দেবতারাও ভীত হন? হে তপোধন! এইরূপ গুণসম্পন্ন মনুষ্য কে আছেন তাহা আপনিই বিলক্ষণ জানেন। এক্ষণে বলুন, ইহা শ্রবণ করিতে আমার একান্ত কৌতূহল উপস্থিত হইয়াছে।

(ভট্টাচার্য, হেমচন্দ্র; ১৯৭৮ : ১৭)

নারদ বাল্মীকির কথার উত্তরে বলেন:

তাপস! তুমি যে-সমস্ত গুণের কথা উল্লেখ করিলে তৎসমুদয় সামান্য মনুষ্যে নিতান্ত সুলভ নহে। যাহাই হউক, এই রূপ গুণবান মনুষ্য এই পৃথিবীতে কে আছেন, এক্ষণে আমি তাহা স্মরণ করিয়া কহিতেছি, শ্রবণ কর।

(পূর্বোক্ত)

এইভাবে নারদ ইক্ষ্বাকুবংশীয় রাজা রামের গল্প শুরু করলেন। স্পষ্টতই বাল্মীকির রামায়ণ রচনার পূর্বেই রামকথা সমাজে প্রচলিত ছিল, আর সে কথাই নারদ বাল্মীকিকে বলেন। বাল্মীকি তা প্রকাশ করেন তাঁর মহাকাব্যে। আদিতে ‘বাল্মীকি রামায়ণ’-এ ছিল ৬০০০ শ্লোক, পরে তা বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়ায় ১২০০০-এ এবং গুপ্তযুগে তা আরও বেড়ে দাঁড়ায় ২৪০০০ শ্লোকে।

ভারততাত্ত্বিক সুকুমারী ভট্টাচার্য রামায়ণের বিবর্তন প্রসঙ্গে একটি সংক্ষিপ্ত কিন্তু চমৎকার বর্ণনা দিয়েছেন:

… খ্রীষ্টপূর্ব তৃতীয় বা দ্বিতীয় শতকের কাছাকাছি এর (রামায়ণ-এর) রচনার সূত্রপাত এবং খ্রীষ্টীয় দ্বিতীয়-তৃতীয় (কারও কারও মতে চতুর্থের প্রথমাংশে) শতকে এ রচনা তার বর্তমান কলেবর লাভ করে। সম্ভবত খ্রীষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে কাহিনীর বিভিন্ন অংশ অবলম্বনে নানা স্থানে কিছু কিছু গাথা রচিত হয়ে থাকে। খ্রীষ্টপূর্ব তৃতীয় বা দ্বিতীয় শতকে কিছু কিছু গাথা পরস্পর-সম্পৃক্ত হয়ে রামায়ণের কাণ্ডগুলির আংশিক কাঠামো প্রস্তুত করে। খ্রীষ্টপূর্ব দ্বিতীয় শতকের বাল্মীকি বা কোনও মহাকবি এগুলোকে সংহত রূপ দেন। তারই শ’খানেক বছরের মধ্যে অর্থাৎ খ্রীষ্টপূর্ব প্রথম শতকের শেষদিক থেকে খ্রীষ্টীয় প্রথম শতকের মধ্যে মূল রামায়ণ অর্থাৎ অযোধ্যা থেকে লঙ্কাকাণ্ড পর্যন্ত গ্রন্থটি বর্ণনা ও অলঙ্কারে সমৃদ্ধ হয়ে ওঠে। এর পর এর সঙ্গে যুক্ত হয় প্রথম ব্রাহ্মণ্য বা ভার্গব প্রক্ষেপ অর্থাৎ আদিকাণ্ডের প্রথমার্ধ ও উত্তরকাণ্ড, যা সমাপ্ত হয় খ্রীষ্টীয় দ্বিতীয় শতকে। পরের প্রক্ষেপ সম্ভবত দ্বিতীয় শতকে এবং হয়ত চতুর্থের শুরুতে এর শেষতম প্রক্ষেপ।

(ভট্টাচার্য, সুকুমারী; ২০০২ : ৫)

লোকসমাজ, লোকশ্রুতি, লোককাহিনি থেকে বিকশিত হওয়ার কারণে রামায়ণের মধ্যে রয়ে গেছে সেইসব সমাজ ও সময়ের স্মৃতিচিহ্ন। অতীতকে যেমন পুরোপুরি মুছে ফেলা যায় না, তা কোনও না কোনওভাবে পরবর্তী পর্বের উপর ছাপ রেখে যায়, তাই রামায়ণের মধ্যে নানা ঘটনা, রূপক, প্রতীক ইত্যাদি পাঠককে প্রাচীন সমাজের স্মৃতি ফিরিয়ে দেয়। আর সেইসব প্রত্নকথার মধ্যে অতীত সম্পর্কে নানা ইঙ্গিত পাওয়া যায়, যা দিয়ে হয়ত অতীতের নির্মাণ সহজ হয়। সময়ের ধূলা সরালেই নজরে পড়বে সেই প্রাচীন সমাজের ছবিটিও। প্রাচীন সমাজ ও সংস্কৃতি কেমন ছিল তা বোঝবার প্রয়োজনেই আদি উৎস থেকে ভার্গব প্রক্ষেপের সময়কালটিকে আরও একবার দেখে নেওয়া দরকার।

 

রামায়ণ প্রসঙ্গে অবশ্যম্ভাবীভাবেই জাতকের রামায়ণের কথা এসে যায়। প্রাক-বাল্মীকি পর্বেই প্রাচীন বৌদ্ধ সাহিত্যে রামকথার সন্ধান মেলে। বৌদ্ধ জাতক গ্রন্থগুলি লিপিবদ্ধ হয় খ্রিস্টপূর্ব ৫০০ শতাব্দীতে। এই জাতক গ্রন্থে রামকথার যে পরিচয় পাওয়া যায় সংক্ষিপ্ত আকারে তা এখানে দেওয়া হল:

বারাণসী নগরে দশরথ নামে এক রাজা বাস করতেন। তাঁর প্রধান মহিষীর গর্ভে রামপণ্ডিত ও লক্ষণকুমার নামে দুই পুত্র ও সীতাদেবী নামে এক কন্যা জন্মগ্রহণ করেন। প্রধান মহিষীর মৃত্যু হলে রাজা তাঁর ১৬ হাজার মহিষীর মধ্যে একজনকে প্রধান মহিষী পদে উন্নীত করেন।  কিছুকাল পরে এই রানির গর্ভে ভরতকুমারের জন্ম হয়৷ একবার দশরথ ভরতকুমারের মাকে বর দিতে ইচ্ছা প্রকাশ করেন। তার জেরে ভরতকুমারের মা ভরতকুমারকে রাজ্য দিতে হবে বলে দাবি করে। দশরথ তখন রামপণ্ডিত ও লক্ষ্মণকুমারের বিপদের সম্ভাবনা বুঝে তাদের দূরে সরে যেতে পরামর্শ দেন এবং বলেন যে, তারা যেন ১২ বছর পরে তাঁর মৃত্যু হল্রে দেশে ফিরে রাজ্যের অধিকার নেয়। ফলে রাম লক্ষ্মণ ও সীতা হিমালয়ের অরণ্যপ্রদেশে চলে যায়। এই ঘটনার ৯ বছর বাদে হঠাৎই দশরথের মৃত্যু হয়। তখন রামকে সিংহাসনে বসানোর লক্ষ্যে ভরত তার সঙ্গে দেখা করে। রাম কিন্তু ১২ বছর পূর্ণ হওয়ার আগে দেশে ফিরতে রাজি হয় না। সে ভরতকে তার চটিজুতো সিংহাসনে রেখে রাজ্যশাসনের অনুমতি দেয়। তখন লক্ষ্মণ ও সীতাকে নিয়ে ভরত বারাণসীতে ফিরে আসে। তিন বছর পর রাম ফিরে এসে সিংহাসনে আরোহণ করে এবং সীতা হয় তার প্রধান মহিষী।

(সেন, সুকুমার; ১৪১৭ বাংলা : ৩৪-৩৬)

রামায়ণ চর্চাকারীদের মধ্যে এই ‘দশরথ জাতক’ সম্বন্ধে একটি ঘোরতর মতভেদ রয়েছে। কেউ কেউ মনে করেন যে, বাল্মীকি রামায়ণ দশরথ জাতকের পূর্ববর্তী। বৌদ্ধরা রামকাহিনিকে ইচ্ছাকৃতভাবে বিকৃত করে এই জাতকের গল্পে রামকথাকে ঢুকিয়ে দিয়েছে। দশরথ জাতক সম্বন্ধে ব্রাহ্মণ্যবাদীদের সমালোচনা ও ক্রোধের মূল কারণ হল— রাম ও সীতাকে ভাই ও বোন হিসেবে দেখানো এবং তাদের মধ্যে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন। এর সঙ্গে রয়েছে বাল্মীকি রামায়ণের প্রাচীনত্ব হারানোর আশঙ্কা। ভারতে প্রাচীনত্বের একটি পৃথক মূল্য আছে, যা পাশ্চাত্যের ভাবধারার সঙ্গে মেলে না। ভারতে যে জিনিসটা যত প্রাচীন, তা ততটাই বৈধ, মূল্যবান ও মহিমাপূর্ণ। এটা অনেকটা ইউরোপীয় সুরার প্রাচীনত্বের মতো— যত পুরনো, তত ভালো, তত দামী।

সমালোচকদের মতে ‘দশরথ জাতক’-এ বাল্মীকি রামায়ণের সাত-আটশত বৎসর পরে ওই কাহিনির একটি বিকৃত রূপ উপস্থাপনের চেষ্টা হয়েছিল। (সরকার, ড. দীনেশচন্দ্র; ১৩৮৯ বাংলা : ২ : ১২৫)।  আরও বেশ কিছু ক্ষেত্রে একই ধরনের সমালোচনা দেখা যায়। (দ্রষ্টব্য: Pusalker; 1993 : Vol- II, করণ, ২০১২)। বিজয়চন্দ্র মজুমদারের লেখায় এইসব সমালোচনার উত্তর পাওয়া যায়:

এই গল্পে [দশরথ জাতক] ভ্রাতা-ভগ্নীর বিবাহ দেখিয়া, কেহ কেহ বলিতে চাহেন, যে হিন্দুদিগকে জব্দ করিবার জন্য বৌদ্ধরা এই উপাখ্যানে রামকে অপমান করিয়াছিল। একথা স্বীকার করিয়া পারা যায় না। প্রথমতঃ হিন্দুদিগের মধ্যে ঐ সময়ের মধ্যে রামায়ণ কথা প্রচলিত বা পূজিত হয় নাই৷ দ্বিতীয়তঃ, বুদ্ধদেব যখন একজন শোকসন্তপ্ত শিষ্যকে সান্ত্বনা দিবার জন্য গভীরভাবে একটি আদর্শ জ্ঞানীর কথা বলিতেছিলেন, তখন অন্যকে পরিহাস করার কথা আদৌ অনুমিত হইতে পারে না৷ অপিচ, বৌদ্ধরা যখন এই রামচন্দ্রকে বুদ্ধের এক পূর্ব অবতার বলিয়াছেন, তখন পরিহাসের কথা তোলা বিড়ম্বনামাত্র। তৃতীয়তঃ, শাক্যদিগের মধ্যে পুরাকালে ভ্রাতা-ভগ্নীতে বিবাহ চলিত বলিয়া প্রমাণ পাওয়া যায়৷ এরূপ স্থলে ইহাই স্বীকার করা সঙ্গত, যে  রামায়ণের গল্পের মূল, প্রথমতঃ শাক্যদিগের মধ্যে এইরূপই ছিল এবং পরে উহা পরিবর্তিত ও পরিবর্ধিত হইয়া নূতন রামায়ণের সৃষ্টি হইয়াছে।

(মজুমদার, বিজয়চন্দ্র; ২০১৫ : ৩১)

ভাই-বোনের বিয়ে সংক্রান্ত তথ্য অন্যান্য বৌদ্ধ সাহিত্যের মধ্যেও পাওয়া যাবে। অতুল সুর বৌদ্ধ উৎস (সূত্তনিপাত ৪২০, অম্বতথ সূত্ত ১/১৬ এবং কুণাল জাতক ৫৩৬) থেকে এই জাতীয় ঘটনার উল্লেখ করেছেন।

ক.

… রাজা ওক্ককের (ঈক্ষ্বাকুর) প্রধানা মহিষীর গর্ভে পাঁচ ছেলে ও চার মেয়ে জন্মগ্রহণ করে। ওই প্রধানা মহিষীর মৃত্যুর পরে রাজা এক যুবতীকে বিবাহ করেন। এই রানীর যখন এক পুত্র হয়, তখন তিনি রাজাকে বলেন যে তাঁর ছেলেকেই রাজা করতে হবে। রাজা তাঁর প্রথম মহিষীর পাঁচ পুত্র ও চার মেয়েকে হিমালয়ের পাদদেশে নির্বাসিত করেন৷ সেখানে কপিল মুনির সঙ্গে তাদের দেখা হয়। কপিল মুনি তাদের সেখানে একটি নগর স্থাপন করে বসবাস করতে বলেন। এই নগরের নামই কপিলাবস্তু হয়। ভ্রাতাদের মধ্যে জ্যেষ্ঠ অকৃতদার রইল। আর বাকি চার ভাই চার বোনকে বিবাহ করল। এই কাহিনীটা ‘মহাবস্তু’তে একটু অন্যভাবে দেওয়া আছে। সেখানে রাজার দ্বিতীয়া স্ত্রীকে রক্ষিতা বলা হয়েছে।

(সুর; ১৯৯৮ : ৩৫)

খ.

… শাক্যরা ছিল পাঁচ বোন ও চার ভাই। এই কাহিনী অনুযায়ী জ্যেষ্ঠা ভগিনীকে তারা মাতৃরূপে বরণ করে, আর চার ভাই চার বোনকে বিবাহ করে। জ্যেষ্ঠা পরে কুষ্ঠব্যাধিগ্রস্তা হয় এবং তাকে বনমধ্যে এক গর্তের মধ্যে ফেলে দিয়ে আসা হয়। একদিন সে ব্যাঘ্রকর্তৃক আক্রান্ত হলে বারাণসীর রাজা রাম এসে তাকে উদ্ধার করে। রামও কুষ্ঠরোগাক্রান্ত হয়ে বনে নির্বাসিত হয়েছিল, কিন্তু পরে সে নিজেকে নিরাময় করে। সে নিরাময় করার উপায় জানত এবং তার দ্বারা ওই মেয়েটিকে সম্পূর্ণ রোগমুক্ত করে। তারপর তাঁদের দুজনের মধ্যে বিবাহ হয় এবং তাদের যে সন্তান হয়, তাদের কপিলাবস্তু নগরে তাদের মাতুলকন্যাদের বিবাহ করবার জন্য পাঠিয়ে দেওয়া হয়।

(পূর্বোক্ত)

গ.

বৌদ্ধ সাহিত্যের (বুদ্ধ ঘোষের ‘পরমথজ্যোতিকা’, ক্ষুদ্ধকপথ পৃ. ১৫৮-৬০) এক কাহিনী অনুযায়ী বারাণসীর রাজার প্রধানা মহিষী একখণ্ড মাংসপিণ্ড প্রসব করেন। তিনি ওই মাংসপিণ্ডটিকে একটি পেটিকায় করে নদীতে ভাসিয়ে দেন। ওটা যখন ভেসে যাচ্ছিল, তখন একজন মুনি ওটাকে তুলে সংরক্ষণ করেন। পরে ওই মাংসপিণ্ড থেকে একটি ছেলে ও একটি মেয়ে উৎপন্ন হয়। তাদের নাম লিচ্ছবী দেওয়া হয়। এদের দুজনের মধ্যে বিবাহ হয়, এবং এরা বৈশালী রাজ্য স্থাপন করে।

(পূর্বোক্ত)

এছাড়াও যম-যমী সূক্তে [১০/১০] ভাইবোনের সম্পর্কের কথা বলা আছে (ভট্টাচার্য, সুকুমারী; ১৪১৭ বাংলা : ২৯)। ক্ষিতিমোহন সেন এই বিষয়ে কয়েকটি সম্পর্কের উল্লেখ করেছেন।

ক. লাঢ়রাজ সিংহবাহু তাঁর ভগ্নীকে বিবাহ করেন।
খ. অজাতশত্রুর স্ত্রী বজিরা ছিলেন তাঁর মামাতো বোন।
গ. আনন্দের স্ত্রী উৎপলবর্ণা ছিলেন তাঁর পিসতুতো বোন।
ঘ. মগধের এক গৃহপতি তাঁর মামাতো বোন সুজাতাকে বিয়ে করেন।
ঙ. পুণ্ডকাভর-পত্নী সুবন্নপালী ছিলেন মামাতো বোন।
চ. লঙ্কার রাজকন্যা চিত্তার বিয়ে হয় তাঁর মামাতো ভাই-এর সঙ্গে।
ছ. কুন্তী ছিলেন বসুদেবের বোন। অর্থাৎ সুভদ্রার পিতা বসুদেব অর্জুনের মামা। অর্জুন মামাতো বোনকে বিয়ে করেন৷
জ. রুক্মীনীকে কৃষ্ণ বিয়ে করেন। রুক্মীনী ছিলেন কৃষ্ণের মামা ভীষ্মকের কন্যা।

(সেন, ক্ষিতিমোহন; ২০০৩ : ১৩)

এইসব তথ্যের উল্লেখ করা হল এই কারণেই যে সেই সময় ভাইবোনের বিয়ের প্রচলন ছিল এবং সমাজে তা অস্বীকৃত হত না। ফলে দশরথ জাতকের আখ্যানে কোনও অসঙ্গতি না থাকার সম্ভাবনাই বেশি। বরং সে সময়ে সমাজে প্রচলিত একটি সম্পর্কের ইঙ্গিত এখানে পাওয়া যায়।

বৌদ্ধ দশরথ জাতককে বাল্মীকির রামায়ণের পূর্ববর্তী ধরে নেওয়ার ক্ষেত্রে ব্রাহ্মণ্যবাদীদের আরও একটি সমস্যা আছে। ভার্গব প্রক্ষেপ সহ সাত কাণ্ড রামায়ণে রামকে বিষ্ণুর অবতার হিসেবে দেখানো হয়। কিন্তু দশরথ জাতক-এর রাম একান্তরূপেই মানুষ। ব্রাহ্মণ্য আধিপত্য প্রতিষ্ঠার স্বাভাবিক পরিণতিতেই রামের ওপর দেবত্ব আরোপ করা হয়েছে। এটি ঘটেছে ভার্গব প্রক্ষেপের ফলেই। আর সেই কারণেই নানা দিক থেকে বহু জটিলতা ও অসামঞ্জস্যের আবির্ভাব ঘটেছে।

 

গ্রন্থপঞ্জি:

English Books: