Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

অবিভক্ত সিপিআই নেতৃত্বের সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত পার্টির প্রতিষ্ঠা ১৯২৫ সালে

শঙ্কর রায়

 

History is a slaughter House.

–Georg Wilhelm Friedrich Hegel

আবার চলে গেল আরেকটা ২৬ ডিসেম্বর।

আজ থেকে ৯৫ বছর আগে এই দিনে কানপুরে এক সম্মেলন থেকে ঘোষিত হয়েছিল ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি প্রতিষ্ঠার কথা।

শেষ দিনে (২৮ ডিসেম্বর) ১৬ জন সদস্যবিশিষ্ট কার্যনির্বাহী সমিতি গঠিত হয়, যাতে ছিলেন সম্মেলনের সভাপতি সিঙ্গারাভেলু চেট্টিয়ার, মৌলানা হসরৎ মোহানি, মুজফফর আহমদ, সচ্চিদানন্দ বিষ্ণু ঘাটে, জে পি বাগেরহাট্টা, সত্যভক্ত (সম্মেলনের আহ্বায়ক), কে এম যোগলেকার, আর এস নিম্বকার প্রভৃতি। যুগ্ম সম্পাদক নির্বাচিত হন ঘাটে ও আরও ১৫টি সদস্যপদ খালি রাখা হয়, কারণ অনেকে আসতে পারেননি।

যেমন শ্রীপাদ অমৃত ডাঙ্গে, যিনি কানপুর কমিউনিস্ট ষড়যন্ত্র মামলায় তখনও বন্দি (যদিও মুজফফর  আহমদের সমমেয়াদি কারাদণ্ডের রায় হলেও যক্ষ্ণা রোগী হওয়ার কারণে আগে ছাড়া পেয়েছিলেন) সেই সম্মেলন থেকে ‘ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির ভবিষ্যৎ কর্মসূচি (Future Programme of Indian Communist Party)- ছমাস আগে লেখা। এটি প্রণয়ন করেছিলেন, যিনি চেয়েছিলেন পার্টির নাম হোক ‘ইন্ডিয়ান কমিউনিস্ট পার্টি’, আর তাঁর অভিমত ছিল এই যে পার্টির সাথে কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিকে (কমিন্টার্ন) সম্পর্ক হোক ‘মৈত্রী ও পারস্পরিক সহানুভূতির’ অর্থাৎ অধীন নয়। এ নিয়ে তুমুল বিতর্ক হয়, ও শেষ অবধি, তাঁর মত গৃহীত হয়নি। পার্টির নাম হয় ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি অর্থাৎ সিপিআই। সম্মেলনের পরে জাতীয় স্বাধীনতা সংগ্রাম সত্যভক্ত নতুন পার্টির সাথে সম্পর্ক ত্যাগ করে। নতুন পার্টিকে কমিন্টার্ন-এর অন্তর্গত হিসেবে পরিগণিত হবার সিদ্ধান্ত হয়। সেই সময় কমিন্টার্ন-স্বীকৃত পার্টিগুলিকে এক একটি সেকশ্যন বলা হত, যা কমিন্টার্ন-এর অবলুপ্তি (১৯৪৫) পর্যন্ত বহাল ছিল।

তবে অধুনা শুধু বাম রাজনীতি-বিশেষজ্ঞ সাংবাদিক হিসেবে পরিচিতদের (যাদের অধিকাংশ এই লেখকের বন্ধু/বন্ধুস্থানীয়) মনে করেন যে সিপিআই-এর প্রতিষ্ঠা তাসখন্দে ১৯২০ সালে ১৭ অক্টোবর, যা ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্ক্সবাদী) এবং তার সর্বাপেক্ষা শ্রদ্ধেয় নেতা মুজফফর আহমেদ দাবি করেছিলেন (তাসখন্দে ২৪ জন প্রবাসী বিপ্লবীকে নিয়ে পার্টি গঠিত হয়। তাঁদের মধ্যে সাতজনকে কর্মসমিতিতে নেওয়া হয়েছিল, তাঁরা হলেন মানবেন্দ্রনাথ রায়, ইভলিন ট্রেন্ট রায়, অবনী মুখার্জি, রোজা ফিটিংগভ, মহম্মদ আলী, মহম্মদ শফিক সিদ্দিকী, এম ভয়ঙ্কর প্রতিবাদী আচার্য।)। ‘অধুনা’ শব্দটি লিখেছি এজন্য যে অবিভক্ত সিপিআই-এর এ সম্পর্কে সিদ্ধান্ত (আর তা সর্বসম্মত) কী ছিল এই সাংবাদিকেদের তা নিয়ে তেমন উৎসাহ বা কৌতূহল প্রায় নেই। কারও কারও আদৌ কৌতূহল নেই। অন্তত চোখে পড়েনি। এরা কি ১৯৬০ দশকে সিপিআই মুখপত্র ‘নিউ এজ’ সাপ্তাহিক নাড়াচাড়া করতেন? জানি না, তবে আমার তেমন মনে হচ্ছে না। কারণ পড়লে কখনওই এমন প্রত্যয়িত হতেন না, যে সিপিআই ১৯২০ সালে প্রতিষ্ঠিত, সেই ধারণার দিকেই পাল্লা ভারী। কিন্তু যেটা বিস্ময়কর তা এই যে অ্যাকাডেমিকদের মধ্যেও অনেকের বিশ্বাস ও অভিমত তাসখন্দেই সিপিআই-এর পত্তন। ঘাটে ‘নিউ এজ’-এ এ নিয়ে ১৯৬৬-র ৩০ অগাস্ট সংখ্যায় মুজফফর আহমদের (অর্থাৎ সিপিআই-এমের) দাবি খণ্ডন করে লেখেন যে ১৯৫৯ সালে পার্টির সর্বোচ্চ নেতৃত্বের (যার মধ্যে ছিলেন সিপিআই-এমএর প্রথম নির্বাচিত পলিটব্যুরোর অন্যতম সদস্য ম্যাকিনেনি বাসবপুন্নাইয়া ও বালচন্দ্র ত্রম্বক রনদিভে) সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত অনুসারে ইন্দোনেশিয়ার কমিউনিস্ট পার্টির (পারতাই কমিউনিস ইন্দোনেশিয়া বা পিকেআই)ইংরেজি মুখপত্র ‘রিভ্যু অফ ইন্দোনেশিয়া’র সম্পাদককে জানান যে সিপিআই ১৯২৫ সালে ডিসেম্বরে কানপুরে এক সম্মেলনে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। সিপিআই-এর পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য পরিষদ ২০১৫ সালে ‘ভারতীয় কমিউনিস্ট আন্দোলনের সূচনাপর্ব (লেখক ভানুদেব দত্ত, পার্টি শিক্ষা বিভাগের দায়িত্বে) নামে একটি পুস্তিকা প্রকাশ করে। তাতেও এই তথ্য ছিল। পার্টি দৈনিকে এ নিয়ে একটি সমালোচনাও প্রকাশিত হয়েছিল। সেটাও এদের চোখে পড়ল না?

হাতে এল বাসু আচার্যের ‘কুড়ি না পঁচিশ?’ বইটা। বাসু সিপিআই বা সিপি আই (এম) কোন দলের সদস্য নয়। সে সিপিআই (এম-এল)-এর একটি গোষ্ঠীর সদস্য ও তার কৃষক-খেতমজুরদের গণসংগঠনের সক্রিয় কর্মী। অবিভক্ত সিপিআই-এর নেতা, বুদ্ধিজীবী ও তত্ত্ববিদদের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ও তাঁদের নিয়ে লিখেছে, লিখছে। এটা তার বিরল গুণ। এটা বাসুর লেখা বইগুলোর প্রধান বৈশিষ্ট্য (কিছু কিছু আবার বাংলা প্রকাশনায় একেবারে আনকোরা)। এ বইতেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। যেমন কমিন্টার্নের দ্বিতীয় কংগ্রেসে (১৯২০) লেনিনের জাতীয় ও ঔপনিবেশিক থিসিসের বিকল্প মানবেন্দ্রনাথ রায়ের সাপ্লিমেন্টারি থিসিসের ফোটোস্ট্যাট কপি। লেনিন তার একটা অংশ নিয়েছিলেন, বেশিরভাগটাই বাদ দিয়েছিলেন। লেনিনের থিসিসের সাথে সেই অংশ কংগ্রেসে গৃহীত হয়েছিল।

এ বইটিতে ঘাটের লেখা থেকে প্রাসঙ্গিক অংশ উদ্ধৃত করা হয়েছে, যা প্রামাণ্য। “The Communist Party of India was founded in the month of December in the year 1925. Even before that there were individual communists and communist groups working in different centres in the country. But it was in December 1925 at a meeting of representatives of these various groups of communists in the country held at Kanpur that the Communist Party of India was formed.” (SV Ghate: ‘CPM Distorts History about formation of CP of India’- New Age, Aug 20, 1970, p 4).

পার্টির কেন্দ্রীয় সম্পাদকমণ্ডলীর এক সভায় গৃহীত সিদ্ধান্ত অনুসারে রণদিভে যে চিঠি ইন্দোনেশিয়ার পার্টির পত্রিকা সম্পাদককে লিখেছিলেন, এ উদ্ধৃতি তা থেকে। ভানুদেববাবু লিখেছেন, ‘১৯৫৯ সালের ১৯ অগাস্ট এ ব্যাপারে এক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিল। পরের দিন অর্থাৎ ২০ অগাস্ট কেন্দ্রীয় সম্পাদকমন্ডলী সেটি ইন্দোনেশিয়ার পার্টিকে জানায়। কেন্দ্রীয় সম্পাদকমণ্ডলীতে ছিলেন অজয় ঘোষ, বি টি রণদিভে, পি সি যোশী, এম বাসবপুন্নিয়া, জেড এ আমেদ, এস এ ডাঙ্গে ও এ কে গোপালন। ভানুদেববাবু আমাকে জানিয়েছেন যে সভার মিনিটস লিখেছিলেন বাসবপুন্নিয়া। কানপুর সম্মেলনের পরে কাজী নজরুল ইসলাম-সম্পাদিত ‘লাঙল’ পত্রিকায় ১৪ জানুয়ারী ১৯২৬ সংখ্যায় ‘ভারতীয় প্রথম কমিউনিস্ট কনফারেন্স’ শিরোনামে একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়, যাতে বলা হয়

এই সম্মিলন প্রস্তাব করিতেছে যে ভারতীয় শ্রমিক ও কৃষকগণের মক্তির জন্য একটি দল গঠিত হোক। এই দল ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টি (Communist Party of India) নামে অভিহিত হইবে।‘ (‘কুড়ি না পঁচিশ?’ পরিশিষ্ট ৫) পরের সংখ্যায় (২১জানুয়ারী ১৯২৬) মুজফফর আহমদ-লিখিত একটি আবেদন প্রকাশিত হয়, যাতে বলা হয়, “সকলেই জানেন ডিসেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহে ভারতীয় কমিউনিস্টদের প্রথম সম্মেলন হয়েছিল।কলিকাতায় কার্যালয় স্থাপন করা ও বাংলাদেশে পার্টি গঠন করার ভার আমার ওপরে দেওয়া হয়েছে। বাংলায় যারা কমিউনিস্ট আছেন, তাঁরা সমবেত হয়ে পার্টি গঠন করেন, এই সনির্বন্ধ অনুরোধ তাঁদের আমি জানাচ্ছি।

(‘কুড়ি না পঁচিশ?’ পৃ- ৬৪)

এ থেকে স্পষ্ট যে মুজফফর আহমদ নিজে কানপুর সম্মেলন মেনে নিয়েছিলেন। সেই ব্যক্তিই সিপিআই (এম) গঠনের পরে লেখেন, “কানপুরের কমিউনিস্ট কনফারেন্সকে আমি এক লজ্জাজনক ব্যাপার বলে মনে করি” (ঐ পৃ ৬৩)। বাসু লিখেছেন (সব তথ্যের ভিত্তিতে) যে মুজফফর আহমদ  ১৯৫৯-এর শেষ দিক থেকেই পার্টির প্রতিষ্ঠাবর্ষ নিয়ে অন্য ধারণা প্রচার করতে থাকেন। কখনও বলেছেন ১৯২০-র নভেম্বরে, কখনও ১৯২১-এ প্রবাসে সিপিআই প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। কিন্তু পার্টি নেতৃত্বকে তাঁর ধারণা জানাননি, যদিও তিনি সর্বস্তরে শ্রদ্ধার্হ ছিলেন, জাতীয় পরিষদের সদস্যও ছিলেন। বাসুর অভিমত “১৯২০কে পার্টির জন্মসন হিসাবে চিহ্নিত করতে যাঁরা চাননি, তাঁরা চাননি কেন না তাসখন্দের সিপিআই কোনও সংগঠিত পার্টি ছিল না। তার না ছিল কোনও কেন্দ্রীয় কমিটি, না ছিল গঠনতন্ত্র। এহেন অবস্থায় যদি তৎকালীন সিপিআই নেতৃত্ব তাকে নিজের রাজনৈতিক-সাংগঠনিক পূর্বসূরী হিসাবে ঘোষণা করত তাহলে একই সঙ্গে মান্যতা দিতে হত বার্লিন কমিউনিস্ট গ্রুপ যা ১৯২০ সালে সিপিআই-এর ঢের আগে গড়ে উঠেছিল।” এ বক্তব্য প্রণিধানযোগ্য।

মানবেন্দ্রনাথ রায়ের দাবি, তাসখন্দের পার্টিকে কমিন্টার্ন স্বীকৃতি দিয়েছিল এবং ‘সেকশ্যন’ মর্যাদা দিয়েছিল। মুজফফর আহমদও তা উল্লেখ করে দাবি করেছেন যে ১৭ অক্টোবর ১৯২০ই পার্টির প্রতিষ্ঠা দিবস। কিন্তু কমিন্টার্ন তাসখন্দের পার্টিকে ‘সেকশ্যন’ মর্যাদা দিয়েছে, তার কোনও প্রমান দাখিল করতে পারেনি। এ সম্পর্কে, বার্লিন গ্রুপ সম্পর্কে পরে আলোকপাত করার ইচ্ছে আছে।

অনেক মৌলিক প্রশ্নে গভীর পার্থক্য সত্বেও মার্ক্স নিজেকে আজীবন যাঁর শিষ্য মনে করতেন, সেই মহাজ্ঞানী হেগেল বলেছিলেন, ‘ইতিহাস এক কসাইখানা।’ কাউকে রেয়াত করে না ইতিহাস। আজকে যা সত্য, কাল তা নস্যাৎ হতে পারে। কিন্তু তার একটা প্রক্রিয়া-পদ্ধতি আছে। এক এক দিন মহন্তের মত যদৃচ্ছা নিদান দিয়ে ইতিহাস বিকৃত করা যায়, ইতিহাস রচনা হয় না।