কুন্তলা বন্দ্যোপাধ্যায়
কলাপাড়ার মুখোপাধ্যায়দের বাড়ির গৃহিণীর চতুর্থ গর্ভের বেলা পাঁজি দেখে কুলপুরোহিত বলেছিলেন, শ্রাবণ মাসের সংক্রান্তির অষ্টম প্রহরে যখন অনুরাধা নক্ষত্র তুলা লগ্নে প্রবেশ করবে; ক্ষেত্র, হোরা ইত্যাদি বর্গেরা যথাক্রমে পুণ্য অবস্থান ধারণ করবে; তখন যদি গৃহিণী প্রসব করেন, তবে জাতক একটা কেউকেটা না হয়ে যায় না।
দেখ না দেখ, সংক্রান্তির সন্ধে থেকে গৃহিণীর প্রসববেদনা উঠল। বাড়িশুদ্ধু লোক বরণডালা সাজিয়ে, শঙ্খ ঠোঁটে ছুঁইয়ে রেডি হয়ে বসল। থুত্থুড়ে ধাইমা আঁতুড়ে ঢুকে দোর দিলেন।
সন্ধে থেকেই জোরে হাওয়া দিচ্ছিল, অষ্টম প্রহরে রাত পা দিতে না দিতে ঝড় শুরু হল। হাওয়ার ঝাপটে কুলদেবতার মন্দিরের ঘণ্টা পাগলের মতো দুলে উঠল, গোয়ালে গরুরা ভয়ে হাম্বা ডেকে উঠল, সেই গোলযোগ ছাপিয়ে আঁতুড়ঘর থেকে গৃহিণীর প্রাণান্তকর চিৎকার বাড়িশুদ্ধ লোকের ঘাড়ের রোঁয়া খাড়া করে দিতে লাগল। অভিজ্ঞ ধাইমার কপালে ঘাম ফুটল। এমন সময় একটি শেষ চিৎকার দিয়ে গৃহিণী চুপ করলেন। রক্ত শ্লেষ্মা মাখামাখি ছোট মাংসপিণ্ডটার দু’পায়ের ফাঁকে প্রদীপ ধরে ধাইমা ঘাবড়ে গেলেন, ‘বিষ্টুপুরুত কী বলেছিল, জাতক না জাতিকা?’ তারপর প্রদীপ তুলে মুখের কাছে নিয়ে যেতেই ধাইমার বুকের রক্ত ছলাৎ করে উঠল, মুখে আঁচল চেপে ধাইমা কোনওক্রমে চিৎকার রোধ করলেন। কালো চুলে ঢাকা গোল মাথা থেকে দুটো চকচকে চোখ ধাইমার দিয়ে সটান চেয়ে আছে।
পঞ্চাশ বছরের অভিজ্ঞতায় সব রকম বাচ্চা দেখেছেন ধাইমা, জ্যান্ত বাচ্চা, মরা বাচ্চা, আগে পা বার করা বাচ্চা, এমনকি আজকাল পীরপুরের মেলায় যে দুইমুণ্ডু একধড় মেয়েকে দেখতে লাইন পড়ে, তাদের প্রসবও ধাইমার হাতেই হয়েছিল, কিন্তু সেদিনের আগে তিনি কোনও শিশুকে চোখ খুলে জন্মাতে দেখেননি। তার ওপর সে চোখে অমন ঠাণ্ডা দৃষ্টি! নিজেকে সামলে, ধাইমা বাচ্চাকে তুলে দিলেন মুখার্জিগিন্নির বুকে। গিন্নি এর আগে তিনটে ছেলের জন্ম দিয়েছেন, একটি মেয়ের গোপন সাধ ছিল তাঁর। মেয়েকে বুকে নিয়ে তার মুখের দিকে তাকিয়ে একই সাথে হেসে এবং কেঁদে, একটি ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে তিনি চোখ বুজলেন।
শিশুটি ছোট্ট মুখ কোঁচকাল। চোখের পাতা বন্ধ হল, লাল মুখ আরও লাল হয়ে উঠল। ধাইমা বুক বাঁধলেন, এবার বুঝি মেয়ে কাঁদবে।
ছোট প্রজাপতির ডানার মতো ঠোঁটদুটো অল্প ফাঁক করে জীবনের প্রথম হাই তুলল মেয়ে।
*****
বংশ, শান্তি, নাড়ুর পর নবজাতকের নাম ননীগোপাল ঠিক করা ছিল, বদলে ননীবালা রাখা হল। বাড়ির দাসী হরিমতী ননীবালাকে বুকে তুলে নিল। মুখার্জিমশাই ভাবলেন স্ত্রী আবার মেয়ের মধ্য দিয়ে সংসারে ফিরে এসেছেন। ঝি চাকরেরা, যারা আড়ালে আবডালে ননীবালার মা মরা সাত দাদাকে কানমলা, চড়চাপাটি দিয়ে শাসন করত, তারা ননীবালাকে মাথায় করে রাখত। একদণ্ড চোখের আড়াল হতে দিত না। বাড়ির রাঁধুনি, যে গৃহিণী মারা যাওয়ার পর থেকে সাত ছেলেকে ইলিশের ল্যাজা আর কইয়ের মুড়ো খাইয়ে মানুষ করছিল, অবলীলায় নিজের পাত থেকে গাদাপেটি ননীবালার পাতে তুলে দিত।
ননীবালাকে এড়িয়ে চলত শুধু বাড়ির গরুগুলো। পাছে মশা কামড়ে মোমের অঙ্গে দাগ ফেলে, ননীবালার গোয়ালে যাওয়া নিষেধ ছিল, কিন্তু দুষ্টু ননীবালা রাখালের পিছু পিছু কখনও কখনও গোয়ালে ঢুকে পড়ত। রাখালের হাত থেকে ধুনুচি নিয়ে ধুনো দিত গোয়ালের আনাচেকানাচে। গরুগুলো সিঁটিয়ে থাকত, একটিবার হাম্বা করত না কেউ। পাড়ার ভুলো কুকুর, তিনদিন না খেয়ে থাকলেও, ননীবালার হাত থেকে ভাত খেত না। হাজার “তু তু” অগ্রাহ্য করে দূরে বসে কুঁইকুঁই করত।
*****
সাল তারিখ মনে রাখার চল ছিল না তখন, যেটা সবার মনে ছিল সেটা হল সে বছর ভয়ানক গরম পড়েছিল। গ্রামের কিনারা দিয়ে বইত আঁধারমাণিক নদী, গরমের দুপুরে গ্রামের বাচ্চারা সারা দুপুর হুটোপুটি করতে যেত নদীতে। ননীবালার দাদা আর বন্ধুরাও যেত, সারা দুপুর জলে আছাড়িপিছাড়ি করে আঙুলের ডগার চামড়া কুঁচকে বাড়ি আসত।
সেদিনও হুটোপাটি চলছিল। হরেরাম মাঝি সকাল থেকে তিনচারটে পারাপার করে মাঝনদীতে বসে জিরোচ্ছিল, ভীষণ গরম। জলে বিলি কাটার মতো হাওয়াটুকুও বইছে না। হরেরাম গামছা দিয়ে পিঠ মুছছিল আর গুনগুন করে গাইছিল, “আগে জানলে তোর ভাঙা নৌকায় চড়তাম না…”
এমন সময় নৌকা দুলে উঠল। ঢেউ নয়, যেন জ্যান্ত একটা মাছ, ঘাই দিল নৌকার নিচে। হরেরামের গান থেমে গেল। আবার ঘাই। কত বড় মাছ? দেখতে দেখতে দুলুনি বেড়ে উঠল। এবার মাছটা যেন আছড়াচ্ছে। শুধু হরেরামের নৌকো নয়, গোটা নদীর জল দেখতে দেখতে ফুলে উঠল। নৌকোর পাটাতন কোনওমতে আঁকড়ে হরেরাম দেখল পাড়ের নারকেলবন নিথর, এদিকে নদী যেন পাগল হয়ে উঠেছে। ঠিক তক্ষুণি চিৎকারটা শুনতে পেল হরেরাম। কোনওমতে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল, পাগলা ঢেউয়ের মধ্যে কতগুলো ছোট ছোট মাথা নারকেলের খোলার মতো দুলছে, কতগুলো হাত আকাশের দিকে তোলা। নৌকো ছেড়ে লাফ দিয়ে জলে পড়ল হরেরাম, “ভয় নেই, ভয় নেই” বলে প্রাণপণে সাঁতরাতে লাগল ঘূর্ণির দিকে।
নদীর ধারে চড়ায় সারি সারি শোয়ানো চাদর ঢাকা সাতটা দেহ, ছ’টা ছোট, প্রান্তেরটা প্রাপ্তবয়স্ক দৈর্ঘ্যের। হরেরাম মাঝি। এ দৃশ্য গ্রামের লোকেদের স্মৃতিতে গেঁথে গেল। ঠিক এই দৃশ্যটা না হলেও, অন্য আরেকটা দৃশ্য ননীবালার দুঃস্বপ্নে হানা দিয়েছিল বহুদিন। ঢেউ, ঢেউয়ের মধ্যে ভাসন্ত কতগুলো হাত। অথচ ননীবালার সে দৃশ্য দেখার কথাই ছিল না। পুকুরে যাওয়া বারণ ছিল ননীবালার। ননীবালা চান করত চানঘরে, দাসী জল তুলে রাখত, গরমে কুয়োর ঠাণ্ডা জল, শীতে রোদে রাখা তপ্ত জল।
সেই অভিশপ্ত দিনেও চানঘরে ননীবালার জল তোলা ছিল, কিন্তু দাসী আনমনা ছিল, সেই ফাঁকে খিড়কির দরজা দিয়ে বেরিয়ে ননীবালা সোজা হাজির হয়েছিল নদীর ঘাটে। মাঝনদীতে নৌকো দুলছিল, মাঝির গান ভেসে আসছিল হাওয়ায়, বটের ঝুরিতে দোল খেয়ে ওর বন্ধুরা ঝপাং ঝপাং পড়ছিল জলে। ননীবালার ভীষণ ইচ্ছে হল ও-ও নামে। পেছল সিঁড়ি দিয়ে পা টিপে টিপে নেমে ননীবালা পায়ের পাতা ডোবাল জলে।
আর তক্ষুণি দুলুনিটা শুরু হল। ননীবালা ভয় পেল, তবু ঝুঁকে পড়ে হাত দিল জলে।
নদীটা যেন পাগল হয়ে গেল ভয়ে। প্রবল ঘূর্ণি, উঁচু উঁচু ঢেউ। ঢেউয়ের মধ্যে হাত। উঠছে আর নামছে।
চরে শোওয়ানো মৃতদেহের সারির মধ্যে দুজন ছিল ছিল ননীবালার দুই ভাই। শোকে বিহ্বল হয়ে মুখার্জিমশাই মেয়েকে আরও আঁকড়ে ধরলেন।
*****
কিন্তু আঁকড়ে থাকা যায় না। মেয়েরা পৃথিবীতে আসেই পর হওয়ার জন্য।
ননীবালার সাত, থুড়ি, পাঁচ দাদা পড়াশোনায়, খেলাধুলোয়, কর্তব্যবোধে, দায়িত্বপরায়ণতায়, আশেপাশের সাত গ্রামের মধ্যে নামকরা ছিল। কিন্তু ননীবালার মেঘের মতো চুল, দিঘির মতো চোখ আর জ্বাল দেওয়া খাঁটি দুধের মতো গায়ের রঙের কথা জানত আশেপাশের সতেরোটা গ্রামের লোক।
বন্ধুত্বের ডাল থেকে ততদিনে ছেলেরা একে একে ঝরে গেছে, ননীবালার মেয়েবন্ধুরা সবাই ব্রতট্রত পালন করা শুরু করেছে। উপোস করে থেকে, পুকুরে ডুব দিয়ে, ভেজা চুলে, ঘটে জল ভরে ছড়া কাটতে কাটতে যায়, গাছ পুঁতে, জল ঢেলে ভক্তিপূর্ণ মনে, ভালো স্বামীর বর চায়। দেখেশুনে ননীবালার ভয়ানক শখ হল ও-ও করে এ সব। খুব উৎসাহ করে ব্রতচারিণীদের দলে নাম লেখাল ননীবালা, কিন্তু বিশেষ সুবিধে হল না।
একে তো ননীবালার উপোস করতে কষ্ট হত, দুই, ননীবালার পোঁতা একটি গাছও বাঁচত না। চলার সময় ঘটি চলকে অর্ধেক জল পড়ে যেত। ব্রতের ছড়া বলতে ভুল হত বার বার। বন্ধুরা প্রকাশ্যে ননীবালাকে সান্ত্বনা দিল, বলল, “কী আর করবি ভাই, সবার কপালে তো সব থাকে না,” আড়ালে বলাবলি করল, ননীবালার বিবাহসম্ভাবনায় নিশ্চয় মারাত্মক গোলযোগ আছে। মেয়েদের আলোচনা গেল বড়দের কানে, তাঁরা মুখার্জিমশাইকে উপদেশ দিলেন পুরুতকে ডেকে কুষ্ঠী পরীক্ষা করে উপযুক্ত প্রতিকারের ব্যবস্থা করতে। ব্রতের সিজন শেষে হলে ননীবালা শহরে মামাবাড়ি বেড়াতে গেল। এক বিকেলে মামাবাড়ির জানালার শিক ধরে উদাস মুখে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে, কপালের পাশ থেকে নেমে আসা চুল আঙুলে পেঁচাচ্ছিল ননীবালা, আর “আমি বনফুল গো” গুনগুনাচ্ছিল, আর ঠিক সেই সময় ফর্সা, কাটা কাটা নাকচোখমুখ, ব্যাকব্রাশ করা মাথাভরা কালো চুলওয়ালা এক সুবেশ যুবক ওই জানালার নিচ দিয়ে যাচ্ছিল।
ছেলেটির নাম শ্রীমান অমিয়সুন্দর চট্টোপাধ্যায়, সদ্য মেডেল পেয়ে ল পাস দিয়েছে। ঠাকুরদা ছিলেন রায়বাহাদুর, বাবা হাইকোর্টের জজ। অমিয়সুন্দর বাপের এক সন্তান। গ্রামে জমিজমা খেতখামার আছে, রিটায়ার করার পর জজসাহেব গ্রামে গিয়ে থাকেন, শহরের বাড়িতে অমিয়সুন্দর দাসদাসী নিয়ে একা থাকে।
এক রবিবার বাড়ি বয়ে এসে জজসাহেব মুখার্জিমশাইকে জানালেন, “আপনার মেয়েটিকে দেখে থেকে আমার ছেলের নাওয়া-খাওয়া মাথায় উঠেছে। মেয়েটিক আমাকে পুত্রবধূ করে নিয়ে যেতে দিন। আরে না না, দেওয়া-থোওয়ার প্রশ্নই নেই, ছেলে আধুনিকতার মন্ত্র কানে বেঁধেছে, পণ করেছে বিনাপণে বিয়ে করার।”
লগ্ন দেখে ধুমধাম করে ননীবালা অমিয়সুন্দরের বিয়ে হল। গ্রামশুদ্ধু লোককে কাঁদিয়ে ননীবালা স্বামীর সঙ্গে শহর পাড়ি দিল।
পরের বছর আবার যখন ব্রতের সিজন এল, দু একজন মেয়ে “ব্রত করে কী হবে, ননীর তো ব্রত না করেই কেমন কপাল খুলল”, যুক্তি দেওয়ার চেষ্টা করেছিল। তাদের “ডেঁপো মেয়ে” বলে ধমকে দেওয়া হল।
*****
শহরের শান্ত, মহার্ঘ্য পাড়ায় অমিয়সুন্দর আর ননীবালা ঝুটঝামেলাহীন সংসার পাতল। বা বলা উচিত অমিয়সুন্দর সংসার পেতেই রেখেছিল, ননীবালা গিয়ে রাণীর আসনে বসল। ও সব পাড়ায় পড়শিরা আদবকায়দা মেনে চলত, ননীবালার গ্রামের মতো জানালা থেকে জানালায় চেঁচিয়ে “কী রাঁধলে কী খেলে” এই সব ব্যক্তিগত প্রশ্ন করত না। সে সব খবরাখবর চালাচালি করার জন্য অন্য রাস্তা ছিল। ননীবালা অমিয়সুন্দরের সংসারের ঠিকে ঝি নৃত্যকালী পাড়ায় খবর দিল, অমিয়সুন্দর নাকি রোজ ঘুম থেকে উঠে চা করে, ডিম ভেজে বউকে ডেকে তুলে খাওয়ায়, খেতে খেতে দুজনে ঠাট্টাতামাশা করে, তারপর নিজেই নিজের জামাকাপড় বার করে পরে, বউয়ের কপালে চুমু খেয়ে কোর্টে বেরিয়ে যায়। বাড়ির পাশেই কোর্ট, কাজেই দুপুরবেলা বাড়ি এসে রাঁধুনির রাঁধা ভাত নিজে খায়, ভাত বেড়ে বউকে খাওয়ায়। কোর্টে ফেরত যাওয়ার আগে পর্দা টেনে ঘর ছায়া ছায়া করে ননীবালাকে শোওয়ায়, খাওয়ার পর একটু না গড়ালে ননীবালার নাকি ভয়ানক মাথা ধরে। বিকেলে ফিরে জলখাবার খেয়ে গাড়ি চড়ে খানিকক্ষণ শহরের অলিগলি মাঠময়দান ভ্রমণ, বাড়ি ফিরে খাওয়াদাওয়া করে ঘুমোতে যাওয়া।
নৃত্যকালীর গল্প শুনে কেউ কেউ ননীবালাকে হিংসে করল, কেউ কেউ ননীবালার নিন্দে করল, আর সকলেই মেনে নিল, অমিয়সুন্দরের হাত পা নাক চোখ মুখ সব মানুষের মতো হলেও আসলে সে একটি জলজ্যান্ত ভেড়া।
কিছুদিন বাদে অমিয়সুন্দরের এক বন্ধু বিলেত থেকে ডাক্তারি পাশ করে ফিরল। বাড়িতে ঘন ঘন তার যাতায়াত শুরু হল। শোনা গেল অমিয়সুন্দরের বুকে নাকি আজকাল একটা চিনচিনে ব্যথা হয় মাঝেমাঝে। ক’দিন পর চিনচিনে বুকব্যথার সঙ্গে সঙ্গে একটা ঘুষঘুষে কাশি দেখা দিল। অমিয়সুন্দরের ওজন হুড়মুড়িয়ে কমতে লাগল, মাথার চুল ছ’মাসে অর্ধেক হয়ে গেল। সাতাশ বছরের অমিয়সুন্দরের সঙ্গে ড্রয়িংরুমে ঝোলানো সাতাত্তর বছরের গালতোবড়ানো রায়বাহাদুর ঠাকুরদার আশ্চর্য মিল প্রকট হয়ে উঠল।
“তবু কি মানুষটার বিশ্রাম আছে?”
চোখ ঘুরিয়ে, হাত দুলিয়ে পাশের বাড়ির মেঝেতে বসে বলল নৃত্যকালী। অমিয়সুন্দরের স্ত্রী-সেবা নাকি এই অবস্থাতেও অব্যাহত। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত স্ত্রীর প্রতিটি ন্যায্যঅন্যায্য লঘুগুরু সব বায়নাক্কা মেটানোর অভ্যেসে অমিয়সুন্দরের বর্তমান শারীরিক পরিস্থিতি কোনও রকম টোল খাওয়াতে পারেনি।
“আর জুটেছে ওই এক ডাক্তার মিনসে।” নৃত্যকালীর নথ সবেগে দুলল। “কোথায় বন্ধুর রোগ সারাবে, না সারাদিন এসে বউঠানের মাথাব্যথা নিয়েই অস্থির।”
শ্রোতাদের মধ্যে মুচকি হাসির ঢেউ খেলে গেল।
ব্যাপারটা যদিও অচিরেই আর হাসির রইল না। একদিন সকালে নৃত্যকালী বাড়িতে ঢুকে অবাক হয়ে গেল। অন্যদিন এই সময় ওপরের ঘর থেকে রেডিওর গান এবং হাসাহাসি খুনসুটির শব্দ ভেসে আসে, আজ শ্মশানের স্তব্ধতা। রান্নাঘরে গিয়ে দেখল অমিয়সুন্দর রান্নাঘরের মেঝেয় নিথর, হাতের আঙুল তখনও ছুঁয়ে আছে ননীবালার ব্রেকফাস্টের ট্রে, ডিমসেদ্ধ গড়াগড়ি যাচ্ছে, ধপধপে চায়ের বাসনকোসন চুরমার ছত্রাকার। নৃত্যকালী চিৎকার করতে করতে দোতলায় ছুটে গেল, “ওগো দিদিমণি, তোমার কী সর্বনাশ হল দেখ গো।” ননীবালা পালঙ্কে শুয়ে ভোরের স্বপ্ন দেখছিল, সুখস্বপ্নই সম্ভবত, কারণ ঠোঁটের কোণে তখনও চিলতে হাসি লেগে, নৃত্যকালীর চিৎকারে ধড়মড় করে উঠে বসল। বেশিক্ষণের জন্য নয়, নৃত্যকালীর মুখে গোটা ঘটনাটা শুনতে না শুনতেই ননীবালা আবার চেতনা হারিয়ে পালঙ্কে এলিয়ে পড়ল।
সবাই ভেবেছিল শ্রাদ্ধশান্তি শেষ হলে ননীবালা গ্রামে ফিরে যাবে। কিন্তু ননীবালা ফিরল না। উকিল এসে জানিয়ে গিয়েছিলেন, এই বাড়িখানার তো বটেই, মারা যাওয়ার ক’দিন আগেই অমিয়সুন্দর নিজের নামে দশ লক্ষ টাকার জীবনবীমা করিয়েছে, তার সম্পূর্ণ স্বত্বাভোগী ননীবালা দেবী।
স্বামী মারা যাওয়ার পরের অন্তত মাসখানেক ননীবালা শোকে বিছানা ছেড়ে উঠতে পারল না। নৃত্যকালী বকল, বোঝাল, ভোলাল, কিছুতেই কাজ দিল না। এমন সময় একদিন বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ানো একটি ভাড়াগাড়ি থেকে একটি মোটাসোটা বিধবা নেমে ননীবালার বাড়ির কড়া নাড়ল।
এই সেই কলাপাড়ার হরিমতী, মা মরার পর যে ননীবালাকে সন্তানস্নেহে মানুষ করেছিল।
ননীবালা শুয়ে ছিল। হরিমতীকে দেখে বলল, “এসেছিস হরি? এত দেরি করলি কেন?”
হরিমতী চোখে আঁচল চাপল। মস্ত পালঙ্কে ননীবালার ক্ষীণ দেহ যেন পাখী, দু’চোখের কোল সন্ধের মতো কালো।
কাপড় ছেড়ে, হাতে মুখে জল দিয়ে হরিমতী রান্নাঘরে ঢুকল। নৃত্যকালীকে কড়া গলায় বলল, “তুমি কেমন চাকর, মনিবের যত্ন নাও না? আমি না এলে তো মেয়েটা মরে যেত।”
নৃত্যকালী বলল, “আমি কী করব, সাধলেও খায় না, জামাকাপড় পালটাতে বললে কথা শোনে না।”
হরিমতী বলল, “বুঝেছি বুঝেছি, এবার দেখিয়ে দাও সব কোথায় আছে।”
দুটি সুগন্ধী গোবিন্দভোগ চাল ফুটিয়ে, বেশি করে ঘি আর অল্প করে কড়াইশুঁটি দিয়ে, পোলাও রাঁধল হরিমতী। কচি বেগুন চার ফালি করে কেটে বোঁটাশুদ্ধু মুচমুচে করে ভাজল। তারপর থালায় সাজিয়ে ননীবালার পাশে এসে বসে বলল, “কই হাঁ কর তো দেখি?” ননীবালার চোখ ছলছল করে উঠল। হরিমতীর কাছে ননীবালা স্বীকার করল, নৃত্যকালীর রান্না তার মুখে রোচে না।
নৃত্যকালীকে ছাড়িয়ে দিল হরিমতী। সংসারের সমস্ত দায়িত্ব নিল নিজের কাঁধে। রান্নাবান্না, সেলাইফোঁড়াই, ঘরদোর পরিষ্কার, বাগানের দেখাশুনো, দোকানবাজার। একদিন ধোপার বাড়ি থেকে আসা কাপড়ের শক্ত মাড়ে ননীবালা ব্যথা পেল। হরিমতী ব্যথার জায়গায় হাত বুলিয়ে বলল, “ষাট ষাট, এবার থেকে আমিই কাচব তোমার কাপড়। দেখবে, আর কোনওদিন ব্যথা লাগবে না।”
ননীবালা চোখের জল মুছে হরিমতীর গলা জড়িয়ে ধরল। “তুই না থাকলে আমার কী হত হরি?”
দিন পনেরোর মধ্যে ননীবালার চেহারায় বলার মতো পরিবর্তন দেখা গেল। প্রথমেই চোখের নিচের কালি মুছে গেল। তারপর ক’দিনের অর্ধাহারে গালের লালিমায় যেটুকু রাহু লেগেছিল, তাও সরে গিয়ে পুরোনো আভা আবার ফিরে এল। বহুদিন বাদে ননীবালা আবার ছাদে উঠল যখন, আশেপাশের বাড়ির ওস্তাদ ঘুড়িওয়ালারা এমন চমকে গেল যে তাদের ঘুড়িটুড়ি সব কেটেকুটে গেল। ননীবালা আনমনে গুনগুনিয়ে ছাদে হাঁটতে লাগল আর কাটা ঘুড়িরা হাওয়ায় দুলতে দুলতে আকাশ থেকে নেমে আসতে লাগল ননীবালার উদ্দেশে।
বাড়ির আরেকটি সদস্যের চেহারায়ও পরিবর্তন আসছিল, কিন্তু কাটা ঘুড়ি কিংবা ঘুড়ির মালিকদের চোখে সে সব পড়ছিল না। সেটা খেয়াল করেছিল নৃত্যকালী। চাকরি যাওয়াতে অন্য কেউ হয়তো মুষড়ে পড়ত, কিন্তু নৃত্যকালী সে বান্দা নয়। পাড়ায় নৃত্যকালী বলে বেড়াত, “চাকরি গেছে ভালোই হয়েছে। প্রাণে বেঁচেছি।” বলত, “ও মেয়ে সোজা নয়, সোয়ামীকে খেয়েছে, নির্ঘাত ডাইনি।” ননীবালার বেশিরভাগ পড়শিই আলোকপ্রাপ্ত ছিলেন, এ ধরণের কথা হেসে ওড়াতেন।
সকালবেলা দুমদাম করে পা ফেলে নৃত্যকালী ঠিকে কাজে যেত, যেতে আসতে হরিমতীর সঙ্গে তার দেখা হত। বাজারে ছুটছে, কিংবা গোয়ালার বাড়ি থেকে ফিরছে। নৃত্য হরিকে দেখলেই ভাঁটার মতো চোখ পাকাত, হরি বাইরে ভাব দেখাত ‘ডোন্ট কেয়ার’, কিন্তু ভেতরে ভেতরে ভয়ে কুঁকড়ে যেত। একদিন ভীষণ রোদে বাজার করে ফেরার পথে গাছের ছায়া দেখে বাজারের ভারি ব্যাগ মাটিতে নামিয়ে রেখে হরি জিরোচ্ছে, এমন সময় নৃত্য এসে কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়াল।
“চেহারাটা দেখেছ নিজের?”
হরি তেরিয়া হয়ে বলার চেষ্টা করল, “কেন কী হয়েছে চেহারার?” কিন্তু গলা দিয়ে হাঁপানি ছাড়া কিছু বেরোল না। তাছাড়া বললে মিথ্যাচারও হত। গত ক’মাসে হরির কোমর আগের থেকে অন্তত পনেরো ডিগ্রি বেঁকে গেছে, অবিরাম হাঁফ ধরে, ভাতের হাঁড়ি নামাতে গেলে হাত থরথর করে কাঁপে।
নৃত্য বলল, “কুটোটি ভেঙে দুটো করে? না সব তোমার ঘাড়ে?”
হরি ধাতস্থ হয়ে বলল, “আহা, ওইটুকু মেয়ে।”
“ওইটুকু!” নৃত্য গোল চোখ আরও গোল করল। “ওই বয়সে আমার চারটে ছেলে হয়ে দুটো মরে গিয়েছিল।”
হরি বলল, “আমার একটুও কষ্ট হয় না।”
নৃত্য বলল, “তা আর হবে কেন, তেনারা ঘাড়ে চাপলে ও রকম হয়। কষ্টাকষ্ট, দুখসুখ, ভালোমন্দ সব গুলিয়ে যায়।”
হরির ব্যাগটা তুলে নিয়ে হাঁটতে শুরু করল নৃত্যকালী। বাড়ির সামনে এসে হরি নৃত্যকে ভয়ে ভয়ে বলল, “দুটো নাড়ু খেয়ে যাবে নাকি? কালই বানিয়েছি।”
নৃত্য বলল, “বয়ে গেছে আমার নাড়ু খেতে। যার জন্য বানিয়েছ তাকে খাওয়াও গে।” ফিরে যাওয়ার আগে ঘাড় ঘুরিয়ে বলে গেল, “সোয়ামীকে খেয়েছে, এবার তোমাকে খাওয়ার পালা, মিলিয়ে নিও আমার কথা।”
ডাক্তার কিন্তু আসত বাড়িতে নিয়মিত। ননীবালার মাথাব্যথাটা কিছুতেই সারছিল না। তাছাড়া পালঙ্কে আধশোয়া হয়ে হরিমতীর হাতের সুখাদ্য খেতে খেতে জানালার বাইরে আকাশের দিকে তাকিয়ে মাঝেমাঝে ননীবালার দীর্ঘশ্বাস পড়ত। অমিয়সুন্দরের ডাক্তার বন্ধু নিয়মিত চেক আপ করতে আসতেন। কণ্ঠার সামান্য নিচে স্টেথোস্কোপ ঠেকিয়ে ননীবালার হৃদপিণ্ডের আওয়াজ শুনতেন, ফর্সা গলায় সরু সোনার চেন, নিঃশ্বাসপ্রশ্বাসের সঙ্গে সঙ্গে কণ্ঠার ওঠানামা দেখতেন, ডাক্তারের গলা শুকিয়ে কাঠ হত, রক্তচাপ বিপজ্জনক রকম বৃদ্ধি পেত। রুগী দেখে, রুগীর সঙ্গে হাসি মশকরা করে, চা জলখাবার খেয়ে, আবার আসার প্রতিশ্রুতি দিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার সময় রান্নাঘর থেকে হরিমতী দৌড়ে এসে হাঁপাতে হাঁপাতে জিজ্ঞাসা করত, “কেমন দেখলেন ডাক্তারবাবু? ননীর কী হয়েছে?”
ডাক্তার মোটা গলায় হরিমতীকে বলতেন, “নার্ভস বোঝো? নার্ভস?” হরিমতী ভীতচক্ষে মাথা নাড়ত, এত শক্ত অসুখের নাম সে কেন, তার চোদ্দপুরুষ শোনেনি। “ভালো করে ওঁর দেখাশোনা করবে, খেয়াল রাখবে যেন উনি পূর্ণ বিশ্রাম পান।” বলে ডাক্তার বুটের শব্দ তুলে বেরিয়ে যেতেন, হরিমতী দ্বিগুণ উদ্যমে সংসারে ঝাঁপিয়ে পড়ত।
*****
একদিন রাতে নৃত্যকালীর দরজায় দুমদুম কিল পড়ল। মাথার পাশে রাখা দা-খানা মুঠো করে ধরে নৃত্যকালী চেঁচাল, “কে রে অলপ্পেয়ে মিনসে?”
উত্তরে হাঁপরের মতো শব্দ এল।
দা মুঠো করে দরজা খুলতেই নৃত্যকালীর গায়ের ওপর টলে পড়ল হরিমতী।
জলটল খেয়ে কোনও মতে জানাল ননীবালার অসহ্য মাথা ধরেছে, বাড়ির ফোন খারাপ, সে যাচ্ছে ডাক্তার ডাকতে। নৃত্যকালী যদি একটু ননীবালাকে পাহারা দেয়। রুগী মানুষ।
হরিমতীকে টানতে টানতে বাড়িতে ফেরত নিয়ে গেল নৃত্যকালী। ধমক দিয়ে বিছানায় শুইয়ে নিজে ডাক্তার ডাকতে গেল। ননীবালার বাড়িতে যেতে হবে শুনে কালক্ষেপ না করে বাক্সপ্যাঁটরা নিয়ে ডাক্তার দৌড়ে এলেন। দোতলায় ননীবালার ঘরের দিকে ধাবিত হতে যাবেন, নৃত্যকালী সিঁড়ি আটকে দাঁড়াল।
“ওদিকে নয়, এদিকে।”
সিঁড়ির তলায় হরিমতীর ঘুপচি ঘরের চিলতে বিছানায় অচৈতন্য হরিমতীর কবজি তুলে ধরে ডাক্তার কয়েক মুহূর্ত থমকে রইলেন। তারপর নৃত্যকালীর দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়লেন। টু লেট।
*****
পরদিন জানালার পর্দা দিয়ে আসা সূর্যের নরম আলো আর কিচকিচ পাখির ডাকে ননীবালা চোখ মেলল এবং চমকে গেল।
বিছানার পাশে একটা চেয়ারে নৃত্যকালী টানটান বসে আছে।
ননীবালা বলল, “হ-হরি ক-কোথায়? ঘুম থেকে ওঠেনি এখনও?”
নৃত্যকালী বলল, “হরি আর কোনওদিনও উঠবে না।”
সব শুনে ননীবালা খানিকক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর ক্ষীণস্বরে বলল, “তাহলে এখন আমাকে চা করে দেবে কে? চা না খেলে আমার ভয়ানক…”
নৃত্যকালী বলল, “মাথা ধরে, জানি। তার একটা সহজ সমাধান আছে। সিঁড়ি বেয়ে নিচে যাও, রান্নাঘরে ঢুকে চা বানিয়ে খাও।”
ননীবালা ওর দিঘির মতো চোখ মেলে নৃত্যকালীর দিকে তাকিয়ে রইল। যেন কথাগুলো বাংলা ভাষায় বলা হয়নি।
“কিন্তু আমি তো কোনওদিন চা করে খাইনি।”
নৃত্যকালী নিজেকে অতি কষ্টে সামলে নিয়ে বলল, “এবার থেকে খেতে হবে। হরিমতী মরে গেছে। তুমি মেরেছ। যেমন তোমার স্বামীকে মেরেছ। এবার থেকে কেউ তোমাকে চা করে দেবে না। নিজে নিজের চা করবে। বাড়ির সব কাজ করবে।”
ননীবালা একদৃষ্টে তাকিয়ে রইল নৃত্যকালীর দিকে। রাগ না, দুঃখ না, ননীবালার দু’চোখে ঠিক কী ছিল ঠাহর করতে পারল না নৃত্যকালী। নৃত্যকালীর বুক কাঁপছিল কিন্তু হরিমতীর মৃত্যু ওকে এত দাগা দিয়েছিল, ও ঠিক করেছিল, এই কথাগুলো ননীবালাকে না বলে আজ ও থামবে না। আরও বলত হয়তো, এমন সময় ডাক্তার ঘরে ঢুকে এল। ননীবালার মুখ দেখে কিছু আন্দাজ করল বোধহয়, নৃত্যকালীকে ধমকে ঘর থেকে বার করে দিল। নৃত্যকালীর ওপর নির্ঘাত ভর হয়েছিল সেদিন, বেরোনোর আগে ডাক্তারকে বলে গেল, “এবার তোমার পালা। সাবধানে থেকো, ডাক্তারবাবু।”
নৃত্যকালীর কথা ফলতে লাগল ঠিক এক বছর। ততদিনে সবাই কমবেশি নিশ্চিত হয়ে গেছে যে ডাক্তার ননীবালাকে বিয়ে করতে চায়। প্রায় রোজ বিকেলেই প্র্যাকটিসের পর ডাক্তারকে ননীবালার সঙ্গে ছাদে দেখা যেত, খোলা ছাদের গাড়ি চেপে দুজনে নিয়মিত বেড়াতে বেরোত। পড়শিরা যখন নিশ্চিত হয়ে গেছে যে অতি শিগগিরি একটা সুখবর আসতে চলেছে, এমন সময় দূর শহরের রোগী দেখে ফেরার পথে ঝড়জলের রাতে হেডলাইটের সরলরেখায় আচমকা এসে পড়া একটি কুকুরছানাকে বাঁচাতে গিয়ে ডাক্তারের গাড়ি উল্টে পড়ে গেল নয়ানজুলিতে।
হরিমতীর মৃত্যুর পর থেকেই লোকের মনে একটা কাঁটা বিঁধতে শুরু করেছিল, ডাক্তারের মৃত্যুর পর অস্বস্তিটা আর এড়ানো গেল না। একজন শক্তপোক্ত কিন্তু শত হলেও বয়স্ক মহিলার মৃত্যুকে যদি বা স্বাভাবিক বলে মেনে নেওয়া যায়, তিরিশ না পেরোনো দুটি সুস্থসবল জোয়ান পুরুষের মৃত্যুর সঙ্গে নাম জড়িয়ে পড়ায় ননীবালার ভাবমূর্তি পড়শিদের চোখে ভালোরকম ক্ষতিগ্রস্ত হল। এরপর জন্মলগ্নে মা এবং তার পরে দুই দাদার মৃত্যুর খবর পল্লবিত হয়ে কানে এল সবার। মনে পড়ল নৃত্যকালীর সাবধানবাণী।
মজার কথা, নৃত্যকালী কিন্তু ননীবালার বিরুদ্ধে আর একটি কথাও বলত না। মাঝে মাঝে রাতে একা ঘরে শুয়ে শুয়ে মাথার ভেতর কতগুলো ছবি সারি সারি ভেসে যেত। রান্নাঘরের মেঝেতে ডিমসেদ্ধ আর ধপধপে চায়নাবোনের টুকরোর মধ্যে অচেতন অমিয়সুন্দর, আর বিছানার ওপর ভাঙাচোরা হাক্লান্ত হরিমতী। রোদচিকচিকে সকালের আলোয় একজোড়া চোখ। চোখের কথা মনে পড়লে নৃত্যকালীর সারা গা শিউরে উঠত।
হরিমতী আর ডাক্তার মরে যাওয়ার পর ননীবালার বন্ধু রইল না কেউ। ননীবালা একা একা আগাছাভর্তি বাগানে ঘুরত, ছাদে পায়চারি করত। কিন্তু কোনও কাটাঘুড়ি তার পায়ের কাছে লুটিয়ে পড়ত না। অবশেষে একদিন নিজে নিজেই দোকানে গেল ননীবালা। রোদে চোখে ধাঁধা লাগল, অপরিচিত দোকানদারের সঙ্গে কথোপকথন করতে সংকোচে জিভ জড়াল। দোকানদার চোখ এড়িয়ে বিরক্ত মুখে জিনিসপত্র দিত, ননীবালাকে কোনও রিকশাওয়ালা বাড়ি নিয়ে যেতে চাইত না, রোদ্দুরে বাজারের ব্যাগ টানতে টানতে ননীবালা ফিরত বাড়ি, এমন সময় একদিন নৃত্যকালীর সঙ্গে তার রাস্তায় দেখা হয়ে গেল।
ননীবালার চোখে পরিচয়ের ছায়া ফুটল। নৃত্যকালীরই বরং সময় লাগল খানিক। এ কী চেহারা হয়েছে ননীবালার? চুলে জট, গাল রক্তশূন্য। নৃত্যকালীর মগজ বলল পালাও, পা দুটো ননীবালার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। ননীবালার হাত থেকে ব্যাগটা নিয়ে কোনও কথা না বলে বাড়ির দিকে হাঁটতে শুরু করল নৃত্যকালী, পেছন পেছন ধুঁকতে ধুঁকতে ননীবালা। গোটা রাস্তা “ভূত আমার পুত/পেত্নী আমার ঝি/রাম লক্ষণ বুকে আছেন/করবে আমার কী?” বিড়বিড় করতে করতে ননীবালাকে বাড়ির গেট পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে পেছন ফিরে দৌড়োল নৃত্যকালী। ননীবালা হাত তুলেছিল কিছু বলার জন্য, শোনার অপেক্ষা না করেই।
একদিন দোতলার বারান্দায় বসা বন্ধ হল ননীবালার। একদিন, দু’দিন, তিনদিন চেয়ারটা খালি পড়ে রইল। কেউ কেউ বলল, অনেকে বিশ্বাসও করল, চেয়ারটা নাকি নিজে নিজেই দোলে। নৃত্যকালী শুধু ভাবল, “তবে কি মাথা ধরল আবার?”
চেয়ার খালি পড়ে থাকার সাত দিনের দিন সারাদিন গুমোট করার পর সন্ধে থেকে ঝড় শুরু হল। আক্ষরিক এবং লাক্ষণিক, সব রকমের ঝড়ই নৃত্যকালী অনেক দেখেছে জীবনে, কিন্তু এ ঝড় যেন তাদের সবার থেকে আলাদা। বুকের ভেতর গিয়ে ধাক্কা দেয়, সমস্ত চেতনা ধরে ঝাঁকুনি মারে। জানালা দরজা এঁটে দরমার দেওয়ালে প্রদীপের শিখার লম্বা ছায়ার দিকে নির্নিমেষ চেয়ে নৃত্যকালী বসে রইল। ঝড় আছড়াতে লাগল বন্ধ জানালাদরজার ওপর।
অনেক, অনেক রাতে আওয়াজটা কানে এল নৃত্যকালীর। পুরোনো রেডিওর ঘরঘর। ঘরঘরানির মাঝে মাঝে আবছা সুর… “আমি বনফুল গো”… নৃত্যকালীর চোখের সামনে শিখার ছায়া দুলছে তালে তালে। রাস্তা দিয়ে একটা মোটরগাড়ি যাচ্ছে। এত রাতে? এই বর্ষায়? না যাচ্ছে না, থেমে গেছে নৃত্যর দরজার সামনে। ছলাৎ। ছলাৎ। ছলাৎ। কেউ হেঁটে আসছে নৃত্যকালীর ঘরের দিকে।
এবার আরেকটা শব্দ শুরু হল। অনেক স্পষ্ট, অনেক কাছে। দরজার ঠিক বাইরেই।
অনেক দূর থেকে দৌড়ে এসে যেন বুক ফেটে যাচ্ছে কারও। হাঁ করে শ্বাস টানছে কেউ।
দুম দুম দুম। দরজায় বাড়ি পড়ল।
দা-টার কথা মনে পড়ল না নৃত্যকালীর। দরজা খুলে দাঁড়াল। অর্ধেক খোলা দরজা দিয়ে আবছা আলো এসে পড়েছে হরিমতীর মুখের ওপর। চোখ ফেটে বেরিয়ে আসছে, বুক ওঠানামা করছে হাপরের মতো।
“শিগ…শিগ…”
“কীসের তাড়া?”
হরিমতী কোনওমতে হাত তুলে পেছনের দিকে দেখাল। মেঘ ফাঁক হয়ে আবছা আলো এসে পড়েছে নৃত্যকালীর বাড়ির সামনে। কতগুলো লোক নিশ্চল দাঁড়িয়ে আছে। দরদরিয়ে জল পড়ছে সর্বাঙ্গ বেয়ে, হুঁশ নেই। একটা লম্বামতো লোকের হাতে ধরা একটা ট্রে। মেঘছেঁড়া রশ্মির আঘাতে চকচক করছে তার হাতে ধরা ট্রে-র ওপর পোর্সিলিনের পেয়ালাপিরিচ। আরেকটা লোক, এর হাতে একটা কালো ব্যাগ। গলা থেকে ঝুলছে একটা মালার মতো, জিনিসটার নাম কিছুতেই মনে করতে পারল না নৃত্যকালী, বুকে চেপে ধরে আওয়াজ শোনা যায়। আর এদের পেছনে, রাস্তার ওপর একটা ছাদ খোলা গাড়িতে বসে আছে অপরূপ রূপসী এক নারী। দিঘির মতো চোখ। মেঘের মতো চুল। নৃত্যকালীর দিকে তাকিয়ে আছে সে, দু’চোখে না রাগ, না দুঃখ, না কিছু।
হরিমতীর তাড়ায় নৃত্যকালীর সম্বিত ফিরল। “হ্যাঁ হ্যাঁ, আসছি।” দরজাটা টেনে বৃষ্টির মধ্যে বেরিয়ে এল নৃত্যকালী।
এক রাতে ননীবালা আর নৃত্যকালীর একসঙ্গে মরে যাওয়ায় পাড়ার লোকেরা একটুও আশ্চর্য হল না। সমাপতন তো কতই ঘটে।
(Mary E. Wilkins Freeman-এর Luella Miller ছোটগল্পের ছায়া অবলম্বনে)