Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

বৈধতার অবৈধতার চোরাবালি

রুমা মোদক

 

করিমুন্নেছা খালা মারা গেছেন। অতি স্বাভাবিক প্রত্যাশিত ঘটনা। বয়স তার পঁচাত্তর পার হয়ে গেছে বৈশাখে। হাই ব্লাড প্রেসার ব্লাড সুগার এবং এতদসংক্রান্ত জটিলতায় গেল বছর তিনবার হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন আর তিনবার রিলিজ হয়েছেন। প্রতিবারই ডাক্তার নিরাশ করে বাড়ি নিয়ে যেতে বলেছেন। কিন্তু বাড়ি ফিরে খালা দিব্যি উঠে দাঁড়িয়েছেন। হেঁটেছেন, ভালোমন্দ খেতে চেয়েছেন এবং আবার ছেলেমেয়েদের পুন পুন নিষেধ সত্ত্বেও পুরানো পেশায় ফিরে গেছেন।

এই করিমুন্নেছা খালার পা দুটো আবার ভয়াবহ ফুলে ফুটকা মাছের পেটের মতো হয়ে গেলে তিনি যখন আর হাঁটতে পারেন না, ঠিকমতো লোকজনও চিনতে পারেন না, আবোল তাবোল, উল্টো-পাল্টা এবং বেশি বকছেন তখন মেয়েদের দুজন আমেরিকা থেকে এবং একজন দুবাই থেকে দিনে পাঁচবার করে ফোন দিয়ে একমাত্র ভাই আসিফকে পাগল প্রায় করে তুলল তাঁকে পুনরায় এবং দ্রুত হাসপাতালে ভর্তি করার তাগাদায়। বেচারা আসিফ, পুরানো ব্যাংক ছেড়ে এই বছর খানেক মাত্র নতুন ব্যাংকে যোগ দিয়েছে। এরই মধ্যে মায়ের অসুস্থতার কথা বলে আর কতই বা ছুটি নেয়া যায়? শেষবার ছুটি নেয়ার সময় জিএম স্যার যেভাবে সন্দেহের চোখে তাকিয়েছিলেন, বিব্রতই লাগছিল তার। মাস তিনেক পার হতে না হতেই আবার ছুটি। কিভাবে যে দাঁড়ায় জিএম স্যারের সামনে, তবু যেতে হবে। বোনদের নির্দেশ। মায়ের জন্য বোনেরা চাইবার আগে খরচ পাঠায়, এবং প্রয়োজনের চেয়ে বেশিই পাঠায়। এ টাকায় নিশ্চিন্তে নির্ভাবনায় মায়ের চিকিৎসা শেষ করেও নিজের বেশ কিছু খরচের যোগান হয়, কখনও কখনও বা উদ্বৃত্তও থাকে। এই বোনদের বিরাগভাজন হওয়া যাবে না কিছুতেই। যেভাবেই হোক ছুটি ম্যানেজ করে মাকে হাসপাতালে ভর্তি করাতে যেতেই হবে।

রান্নাঘর এবং বাথরুম লাগোয়া ঠাণ্ডা শীতল ঘরটাতে মেয়েটার মা যখন মেয়েটাকে নিয়ে প্রবেশ করে, তখন সন্ধ্যা উত্তীর্ণ প্রায়। মা-মেয়ে দুজনের মুখ থমথমে। দীর্ঘ দিনের অভিজ্ঞতা করিমুন্নেছা খালার। চেহারা-সুরত দেখেই তিনি কেস আঁচ করে ফেলেন। এক্ষেত্রেও তাঁর বিবেচনা নির্ভুল হয়। মেয়ের বয়স পোশাকে কিংবা চামড়ায় জেল্লায় সাক্ষ্য দেয়া আর্থিক অবস্থার ছাপ তিনি ঠিক সনাক্ত করতে পারেন। এরকম কেসের ক্ষেত্রে তিনি নিজেও খুব বিরক্ত বোধ করেন কিন্তু উপায় থাকে না। এই সামাজিক চাপ, মানুষের অসহায়ত্ব তিনি অস্বীকার করতে পারেন না। অস্বীকার করতে পারেন না বয়সের ধর্ম আর সময়ের দাবী। লোকের নানা কানকথা, আলোচনা সমালোচনা, বদনাম তোয়াক্কা না করে তিনি অবৈধ কাজটি করেন। যদিও গোপন থাকে না, কিন্তু গোপন রাখতে তার চেষ্টার ত্রুটি থাকে না। তাঁর সামান্য হাতের কারিশমায় যদি একটা মেয়ে একটা  পরিবার সামাজিক নানা অপাবাদ আর কলঙ্ক থেকে মুক্তি পায় এতে তো পরোক্ষে সমাজের উপকারই করা হয়। রহিমা বুয়াকে গরম পানি বসাতে বলে তিনি রান্নাঘরের আড়ালে শীতল প্রকোষ্ঠটিতে প্রবেশ করেন। মূলত এই কাজটির জন্য ঘরটি তৈরি তার। বাড়িতে আসা বাইরের মানুষের চোখেই পড়ে না। রান্নাঘরের পিছনে এমন একটা চিলেকোঠা প্রয়োজনীয় উপকরণে সুসজ্জিত আছে। নির্বিকার মুখে ঘরটিতে ঢুকে তিনি মেয়ের মায়ের কাছে জানতে চান– মাইয়া কিসে পড়ে?

ফোন করে মৃত্যুসংবাদ দেয়ার ঘন্টাখানেক পার হতে না হতেই রহিমা বুয়া আবার ফোন দেয়– আব্বাজান তাড়াতাড়ি আইয়েন, পাড়ার লোকজন আইসা ভইরা গেছে, কয় পুলিশ ডাকবো। কান্নায় ভেঙ্গে পড়া কণ্ঠে মিলিয়ে মিশিয়ে তারপর কী বলে আর ভালো বুঝতে পারে না আসিফ। বাড়িতে অনেক লোকজনের হৈ চৈ শোনা যাচ্ছে। উৎকণ্ঠায় পরপর কয়েকবার ফোন দেয় রহিমা বুয়ার ফোনে। কিন্তু সে আর ফোন ধরে না। ভিতরে ভিতরে দুশ্চিন্তা তার হৃৎপিণ্ডের গাতি দ্রুত করে, গলা শুকিয়ে তোলে বারবার।

মা নেই খবরটা যে কোনও মানুষের জন্য খুব বেদনার হলেও আসিফ শোনার পর তৎক্ষনাৎ যে শ্বাসটি ফেলেছিল তাতে দীর্ঘশ্বাসের সাথে ছিল কিছুটা স্বস্তিও। শেষ পর্যন্ত মা চলে গেলেন। বয়স, শারীরিক অবস্থা সবই জানান দিচ্ছিল তাঁর দ্রুততর চলে যাবার আগাম বার্তা, মানসিক প্রস্তুতিও ছিল। তবু তো মা। আজীবন শ্রমে-ঘামে তাদের চার ভাইবোনকে বড় এবং  প্রতিষ্ঠিত করে তোলা মা। তবে পূর্বপ্রস্তুতি, বারবার রোগী টানা আর ছুটি নেয়ার বিড়ম্বনা থেকে একেবারে বেঁচে যাবার স্বস্তিটা দীর্ঘশ্বাসটিকে ঘুব বেশিদূর আগাতে দেয় না। এখন এগুলো বিবেচনার সময় নয়। দ্রুত জিএম স্যারকে ফোন দিয়ে খরবটা জানিয়ে স্ত্রী-পুত্রকে নিয়ে রওয়ানা হবার প্রস্তুতি নিচ্ছিল সে। এমন সময় পুনরায় রহিমা বুয়ার ফোন তাকে কিছুটা নয়, অতিরিক্ত উদ্বিগ্ন করে তোলে বিশেষত যখন পুলিশের প্রসঙ্গ ওঠে। স্বাভাবিক বয়সে স্বাভাবিক মৃত্যুই তার মায়ের। তবে থানা-পুলিশ লোকজনের হৈ চৈ কেন?

এই ঘরখানা করিমুন্নেছা খালা তুলেছেন ছেলে মেয়েদের লুকিয়ে। ছেলে মেয়েরা জেনে ভীষণই রাগ করেছে। সত্যিই তো তাঁর এখন এ বয়সে এসব আর করা কেন? মেয়ে তিনটাই সুপাত্রস্থ হয়েছে। ছেলে-মেয়ে নিয়ে সুখের সংসার করছে, তাও দেশে নয় দেশের বাইরে। মাকে তিনতলা দালান বানিয়ে দিয়েছে। ঘর ভর্তি মেয়ে-জামাই নাতি-নাতনিদের প্যান্ট-শার্ট পরা সুখী ছবি দেখে পাড়া-পড়শিদের চোখে টাটায়। নিজেদের ভাগ্যের সাথে তুলনা করে প্রকাশ্যে স্বীকার না করলেও আড়ালে আক্ষেপের অন্ত থাকে না তাদের। নিজেরা স্বামী অনুরাগী প্রশংসিত সুগৃহিনী হওয়া সত্ত্বেও তাদের ছেলেমেয়েরা ততটা সুখী নয়। কারও মেয়ে স্বামী পরিত্যক্তা, কারও বা ছেলে তাদের খোঁজই নেয় না। আর এই করিমুন্নেছা খালা কিনা অকাল বৈধব্য নিয়ে বাড়ি বাড়ি ঘুরে ধাইগিরি করে ছেলেমেয়ে এমন মানুষের মতো মানুষ বানিয়ে ফেলল? একমাত্র ছেলেটাও তারা শোনে ঢাকা শহরে নিজের গাড়ি করে অফিস করে। করিমুন্নেছা খালা, গ্রামে যাকে সবাই এই একনামে চেনে, ছেলেও ডাকে খালা, বুড়োও ডাকে খালা, খালা শব্দটি তাঁর নামের সাথে নামবাচক বিশেষ্য হয়েই জুড়ে গেছে, সম্পর্কের ইতিবৃত্ত মুছে। এই বাড়ি বাড়ি ঘুরে পোয়াতী বউদের বৈধ ছেলে-মেয়ে বিয়ানোর কাজ করে সন্তান-সুখে বর্তমান যাপনের কারণ সম্পর্কে তারা নানাবিধ সিদ্ধান্তে পৌঁছায়। কেউ বলে নিয়তি, কেউ বা বলে মাইনষের দোয়া। মাইনষের উপকার ছাড়া তো করেন নাই সারাজীবন। কেউ বা বলে বুড়া বয়সে না-জায়েজ কাম শুরু করছেন। এই পাপের বোঝা রাখবেন কই, শেষ পরিণতি দেইখেন। শেষ পর্যন্ত কোনও আলোচনা সিদ্ধান্তে পৌঁছায় না।

গাড়ি কাঁচপ্রু ব্রিজ পার হতে না হতেই তিন বোনের ক্রমাগত ফোনের পর ফোনে অতিষ্ঠ লাগে আসিফের। ছেলেটা গাড়িতে ওঠার পর ক্রমাগত বমি করছে, স্ত্রী বিরক্ত হয়ে বিড়বিড় করছে ‘মরবার আর টাইম পেল না, এই রাতে।” রাত তখন বেশি নয়। নয়টা। বাসায় থাকলে স্ত্রী ডুবে থাকে জী বাংলার সিরিয়ালে, ছেলে টিউটর আর সে নিজে ফেসবুকে। ঘুমোতে ঘুমোতে মধ্যরাত। মধ্যরাতের পরে। তবু বউটা বিরক্ত। এইসময়ের ছেলে বউরা শ্বাশুড়ির বেঁচে থাকলেও বিরক্ত হয় মরে গেলেও বিরক্ত হয়। কিন্তু এখন এ বিরক্তির দিক নজর দেবার সময় তার নেই। বোনদের ফোনের পর ফোনে, এলাকার মুরুব্বীদের ফোনে সে উদভ্রান্ত বোধ করে। ঘটনা কী ঘটেছে কারও বক্তব্যেই স্পষ্ট বোঝা যায় না। রহিমা বুয়া আর ফোনই ধরে না। বোনরা আর মুরুব্বীদের কথায় যেটুকু বুঝতে পেরেছে তা হল স্বাভাবিক মৃত্যুর জন্য সবার সব প্রস্তুতিকে মিথ্যে করে দিয়ে তার মায়ের অস্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে। নতুন অফিসে ঘন ঘন ছুটি নেয়ার বিব্রতকর পরিস্থিতি থেকে মুক্তি পাবার স্বস্তি আর মায়ের মৃত্যুর শোক কিংবা তাঁকে মাটি দেয়ার আনুষ্ঠানিকতা ইত্যাদি ভাবার অবকাশ গাড়িতেই নেয়ার কথা ভেবে রেখেছিল সে। কিন্তু পরিস্থিতি পুরোই উল্টো উৎকণ্ঠায় রূপ নিয়েছে। সত্যিকার অর্থে কী ঘটেছে; কিভাবে থানা পুলিশ সামলাবে, আসলেই থানা-পুলিশ হবার মতো কিছু ঘটেছে কিনা ইত্যাদি অনাকাঙ্খিত দুর্ভাবনা পুরো রাস্তাটা অস্থির করে রাখে তাকে।

করিমুন্নেছা খালা এসব ব্যাপারে নিরাসক্তিই দেখায় বরাবর। তাঁর কাজ ছেলে/মেয়ে বিয়ানো। রান্নাঘর লাগোয়া একচালায় বাড়তি যে ব্যবস্থাটুকু, তা একবার বিশেষ এক চাপে পড়ে। তিন তিনটা কন্যাসন্তান আর একটা নাবালক পুত্রসন্তান রেখে স্বামী হেফাজত আলী হঠাৎ করে মরে গেলে তার মাথায় যখন আকাশ ভেঙ্গে পড়ে, তখন ভাঙ্গা আকাশ মাথায় তিনি নিজে ভেঙ্গে পড়েননি। নানা জনের নানা টিপ্পনী বিরূপ প্রতিক্রিয়া উপেক্ষা করে কমিউনিটি হাসপাতালে ধাত্রী ট্রেনিং নিয়ে শুরু করেছিলেন পেশাগত কাজ। দীর্ঘ ২০ বছরে শহরে জন্ম নেয়া অর্ধেক ছেলে-মেয়ের জন্ম তাঁর হাতে। একা হাতেই শক্ত করে ধরেছেন নিজ কন্যা-পুত্রদের হালও। বিগড়ে যেতে দেননি। ফলশ্রুতিতে শেষ জীবনে তিনি পেয়েছেন নিরিবিলি নির্ঝঞ্ঝাট জীবন। এর মাঝে একবার আমেরিকা ঘুরে এসেছেন, মন টিকেনি বলে মাল্টিপল ভিসা থাকা সত্ত্বেও ছয়মাসেই ফিরে এসেছেন।

যে সময়ে ঘরে চাল কেনা হলে ডাল কেনা হত না, বড় মেয়েকে জামা কিনে দিলে ছোট মেয়ের স্কুলের বেতনে টান পড়ত তখনও তিনি এই অনৈতিক-অবৈধ কাজটি করেননি। দূর-দূরান্ত গিয়ে নির্বিঘ্নেœ ডেলিভারি করিয়ে কারও বংশের প্রদীপ পুত্র কিংবা কারও বিষণ্ণ কোলে কন্যাসন্তান তুলে দিয়েছেন। কখনও পারিশ্রমিকের সাথে কড়কড়ে একটা নতুন শাড়ি নিয়ে ঘরে ফিরেছেন। মিষ্টির বাক্সও হাতে থাকত কোনও কোনও দিন। অভাবের সংসারের চেহারাটা বদলে যেত সেদিন। সে এক দীর্ঘ সংগ্রামের কাহিনী। কিন্তু সেই দুর্বিষহ সংগ্রামেও চালাঘর তুলে অবৈধ গর্ভপাতের ব্যবস্থা করতে রাজি হননি তিনি বাড়তি রোজগার হবে জেনেও।

কিন্তু পৌর মেয়র সাহেবের স্ত্রী যেদিন শহর থেকে নাক মুখ ঢেকে তার নাবালিকা মেয়েটিকে নিয়ে এসে বলতে গেলে হাতে পায়ে ধরে পড়ল; করিমুন্নেছা খালা আর উপায় খুঁজে পেলেন না। শহরের ক্লিনিকে নিয়ে গেলে পুরো শহরে ঢি ঢি পড়ে যাবে…। করিমুন্নেছা খালা সকল নৈতিক অনৈতিক বোধ বিসর্জন দিয়ে পরিবারটিকে বাঁচিয়ে দিয়েছেন এক বিরাট সামাজিক অপবাদের হাত থেকে। তারপর কীভাবে যেন খালার এ ব্যাপারে বিশেষ দক্ষতার কথা একান ওকান হয়ে ছড়িয়ে গেল আর এরকম কেসের আগমন বাড়তেই থাকল। পরে বাধ্য হয়ে এই গোপন প্রকোষ্ঠটি তৈরি করে নিলেন তিনি। বিবাহিত নারীরা আসে একটার পিঠে আরেকটা অনাকাঙ্খিত গর্ভের আগাম দুর্দশা আর সংকটের কথা ভেবে। কোনও বিবাহিতা আসে স্বামীর তখনও কর্মসংস্থান ভালো হয়নি, অনাগত সন্তানের ভরণপোষণ কঠিন হবে ভেবে। কিন্তু করিমুন্নেছার খুব কষ্ট হত নাবলিকা অবিবাহিতা মেয়েগুলোর জন্য। সাময়িক আনন্দের মোহে নিজের জীবন আর পরিবারকে কী ভীষণ বিপন্নতার মুখেই না ঠেলে দেয় তারা।

বাড়িতে ঢুকেই পুলিশের দলটির সাথে দেখা হয় আসিফের। তিন চারজনের একটি দল, উঠানে চেয়ারে বসে চা পান করে সময়ক্ষেপন করছিল আসিফের আগমনের অপেক্ষাতেই। ঘরে ঢুকে মায়ের মৃতদেহটা দেখে দুফোটা অশ্রু ফেলবার ফুসরত মেলে না তার। চেয়ার নিয়ে বসতে হয় পুলিশ দলের সামনে। ওসি সাহেব নিজে এসেছেন। বৃদ্ধার মৃতদেহ দেখে তারাও দ্বিধাগ্রস্ত এই বয়সের একজন নারীর দেহ কাঁটাছেড়া করবেন কিনা। ছেলের জন্যই অপেক্ষা। ছেলে যদি বাদী হয়ে মামলা করে তো কোনও কথা নেই। কিন্তু ছেলে ভাবুক এই বয়সের মাকে নিয়ে এই টানা হেঁচড়া, কাটা ছেড়া করবে কিনা। আসিফ তখনও জানে না ঘটনাটা কী ঘটেছিল। পাড়ার মুরুব্বী কজন, মাথা নেড়ে নানারকম ভীতিকর আশংকার কথা ব্যক্ত করে মামলা করার পক্ষেই রায় দেয়। কিন্তু ঘটনাটা আসলে কী না জেনে আসিফ তো সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। নেয়া উচিতও হবে না, মতামত দেয় ওসি সাহেবও। আসলে আপনার মায়ের একটা সুনাম আছে শহরে। একনামে চেনে সবাই। ঘটনা সবিস্তার জানে একমাত্র রহিমা বুয়া। কাজেই রহিমা বুয়াকে ডাকা হোক, আদ্যোপান্ত শোনা হোক ঘটনা কী।

মেয়েটির মাকে জিজ্ঞাস করে করিমুন্নেছা খালা, কুলাঙ্গারটা কেডা? সচরাচর এমন আগ্রহ দেখায় না সে, যে কাজে আসছে, সে কাজটা করে দেয় সুনিপুণভাবে, মেয়েটিকে নিরাপদ ঝুঁকিমুক্ত রেখে, কোথাও কোনও ভুল হয়নি আজ পর্যন্ত। কিন্তু আজ মেয়েটিকে দেখে কী হয় তার, সব জানতে মন চায়। এই অসুস্থ শরীরে না করে দিলে ঝামেলা চুকে যেত, যা খুশি হোক মেয়েটার গতি। কিন্তু তিনি পারলেন না। কাজটি করে দেবেন বলে শুধু মনস্থির করলেন না, খুব জানবার ইচ্ছে হল কেন এই বয়সের মেয়েগুলো এমন মিথ্যে মোহের ফাঁদে পড়ে জীবন বিপন্ন করে।

মেয়েটির মা জানালেন করিমুন্নেছা খালার হাতেই জন্ম মেয়েটির। তারপর যা বলে তাতে আঁৎকে উঠলেন করিমুন্নেছা খালা, প্রেমের ফাঁদে ফেলে কেবল গর্ভবতী করেই ঘটনা শেষ করেনি, মোবাইলে ভিডিও করেছে। আর ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দেবে বলে ভয়ও দেখাচ্ছে।

এ কেমন যুগ আসল? করিমুন্নেছা খালার বিস্ময় যেন বিস্মিত হতেও ভুলে যায়। এই ছেলেগুলো এই মেয়েগুলোর বেশিরভাগেরই জন্ম তাঁর হাতে। এরা এতো নীচে নামতে পারে, নিজের হাতের ক্যারিশমাকে অপরাধী মনে হয় তাঁর। মনে হয় ওগুলোরে আঁতুড়ে মেরে আসলে বেশ হত। মেয়েটাকে নির্বিঘ্নেœ নিরাপদ করে দিয়ে তিনি বলেন, কাল সকালেই ছেলেটার বাসায় যাবেন তিনি, আতুড়ে যে কাজ করেননি নিষ্পাপ শিশুর সাথে, আজ সময়ের আশকারাতে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠা এই অমানুষকে শায়েস্তা করবেন তিনি।

সকাল সকাল অসুস্থ শরীর, ফুলে ওঠা পা আর অনিয়মিত উর্দ্ধশ্বাস নিয়ে রহিমা বুয়াকে রিক্সা ডাকতে বলেন তিনি। রহিমা বুয়ার নিষেধ পাত্তাই দেন না। তার ঠিক মনে পড়ে যায় এই ছেলে মাত্র সেদিন তার হাতে ক্যাঁ… ক্যাঁ… করে কেঁদেছিল। ঠিক মেয়েটি তেমন কেঁদেছিল। দুজনের কান্নার সুরে কোনও পার্থক্য ছিল না। আর আজ কিনা একজন হিংস্র খাদক হয়ে খাদ্যের রসদ বানায় তাঁরই অন্য সন্তানকে। হাঁফাতে হাঁফাতে রিক্সায় চড়েন তিনি। আর তার ঘণ্টাখানেক পর ঐ ছেলের বাসা থেকেই উদ্ধার হয়েছে তাঁর মৃতদেহ। পাড়ার কেউ একজন মোবাইলে খবর পেয়ে মৃতদেহ ধরাধরি করে বাড়িতে নিয়ে এলেও সন্দেহ ঘনীভূত হয়েছে। ডালপালা মেলে হত্যার ধারণা শিকড়ে দাঁড়িয়ে সিদ্ধান্ত হিসাবেই প্রতিষ্ঠা পেয়েছে।

বৃত্তান্ত শুনে আসিফ উঠে আসে। দাঁড়ায় মায়ের মৃতদেহের পাশে। অসুস্থ মাকে হাসপাতালে টানা হেঁচড়ার ঝক্কি থেকে মুক্তি পাওয়ায় স্বস্তি আর বোনদের টাকার জন্য উদগ্র অপেক্ষা, বউয়ের বিরক্তি চারপাশ থেকে দুহাতে গলা টিপে ধরে, তার দম বন্ধ হয়ে আসে। রহিমা বুয়া চোখ মুছতে মুছতে পাশে এসে দাঁড়ায়। আঁচলে মুখটা চেপে আশপাশ ভালো করে দেখে নিয়ে বলে, আব্বাজান কইছিলেন কামডা হইয়া গেলে, পোলারে সৌদি পাডাইবার লাইগ্যা আমারে দুইলাখ টেহা দিবায়।