Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

ফ্যাসিবাদের দৌরাত্ম্য বন্ধ করতে শ্রেণি-অবস্থানভিত্তিক মতামত স্পষ্ট করতে হবে

প্রবুদ্ধ ঘোষ

 


সাহিত্য গবেষক, দাবা-প্রশিক্ষক

 

 

 

ভারতে সংসদীয় নির্বাচন ভারি মজার জিনিস! নির্বাচনের ব্যান্ড বেজে উঠলেই, ‘জাগো রে জাগো’ বলে চায়ের কোম্পানি বিজ্ঞাপন দেয় আর, রাজনৈতিক দলগুলো প্রতিশ্রুতি। শাসকদল যে ভিলেন তা বলাই বাহুল্য; কিন্তু, মজার ব্যাপার এটাই যে, অন্যান্য সংসদীয় দলগুলো তখন পবিত্রতার পরাকাষ্ঠা হয়ে যায়! যারা ছিল আগের শাসক, এখন দাঁতনখহীন কুচুটে, তারাও কণ্ঠী গলায় ঘোরে এবং তিরিশ বা চৌত্রিশ ঘরের মালা জপ করে। এমনকি, কেন্দ্রে যে দলটা ক্ষমতায় থেকে উঠতে বসতে জনগণের খিস্তি খাচ্ছে, তারাও রাজ্যে রাজ্যে বিড়ালতপস্বী সেজে ভোট চায়। অথবা, রাজ্যকে উচ্ছন্নে পাঠিয়েছে যে দলটা, তারা কেন্দ্রের ক্ষমতা পেতে একহাত জিভ বের করে লালা ফেলে। এই সব মিলিয়েই সার্কাস জমে ওঠে। মুশকিল হয়েছে একটাই, জনগণ কখনও এই সার্কাসের রিং মাস্টার হতে পারেনি; বরং অধুনা ইন্ডিয়ায় কর্পোরেট সংস্থা আর হাতেগোনা কিছু বিলিওনেয়ার রিং মাস্টার হয়ে উঠেছে।

আমরা কি জানতুম না, যে ভারতবর্ষ স্ক্যামের দেশ, দুর্নীতির দেশ? আমরা কি জানতুম না সঞ্চয়িতা বিনিয়োগ দুর্নীতি থেকে সারদা থেকে চোক্সি-মোদি থেকে হাজারো দুর্নীতিতে পেশাগত রাজনীতিকরা জড়িয়ে পড়েছে ও অপরাধীকে নিরাপদ পলায়নপথ দিয়েছে? রাজনীতি থেকে ‘রাজা’ অনেক আগেই মুছে গেছে, আর নীতিটুকুও যে গায়েব, সেটাও কি আমরা জানতুম না? বাংলায় ১৯৪৭ সালের ক্ষমতা হস্তান্তরের পর যতগুলি দল ক্ষমতায় থেকেছে, তাদের প্রত্যেকে গণহত্যা ও ব্যক্তিহত্যায় একে অপরকে পাল্লা দিয়েছে। শুধুমাত্র ১৯৭০-৭৭ সালে পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতাসীন কংগ্রেস সিআরপি-মিলিটারি-পুলিশের সঙ্গে মিলে দ্রোহী নকশালদের যত খুন অথবা গুমখুন করেছে, তা নিয়ে অ্যাকাডেমিক পেপার আর তথ্যসঙ্কলন এখনও শেষ হয়নি। ১৯৭৭ থেকে ২০০৯ সালের মধ্যে মোট রাজনৈতিক হত্যা ৫৫,৪০৮টি[1]। তৃণমূল জমানায় ২০১১ আর ২০১৩ সালে সমস্ত দেশের মধ্যে রাজনৈতিক হত্যায় শীর্ষস্থানে ছিল পশ্চিমবঙ্গ[2]। আর, আরএসএস-বিজেপি ধর্মাফিম-বর্ণাফিমের নেশায় মানুষকে বুঁদ করিয়ে খুন-ধর্ষণ-মবলিঞ্চিংকে সামাজিক স্বীকৃতি দিয়ে দিয়েছে প্রায়। দলগুলি আপাতভাবে ‘উন্নয়নের’ খুড়োর কল ঝুলিয়ে নির্বিত্ত ও নিম্নবর্গকে আরও শোষণ করেছে। তাহলে বারবার আমরা কেন বিস্ময়ের ভান করি? সংসদীয় বৃহত্তর বামেদের ভোটপুঁজি চরম দক্ষিণপন্থায় পরিবর্তিত হওয়া নিয়ে, কোমল দক্ষিণপন্থীর সঙ্গে উগ্র দক্ষিণপন্থীর মিলিজুলি নিয়ে কিংবা প্রায়-উগ্র দক্ষিণপন্থীর সঙ্গে সংসদীয় বামেদের জোট নিয়ে বিস্ময়ের অবকাশ কি সত্যিই থাকা উচিত ছিল? তবু, সংসদীয় দলগুলির নীতিহীনতার উদাহরণে এখনও আমরা বিস্মিত হই, আমোদিত হই, লজ্জায় ভুগি এবং এদিক-ওদিক থেকে তত্ত্বের গোঁজামিল দিয়ে সেইসব নীতিহীনতাকে মান্যতা ও ন্যায্যতা দেওয়ার চেষ্টা করি।

#

উত্তর-সত্য বা পোস্ট ট্রুথ শব্দের যথার্থ প্রয়োগ রাজনৈতিক ক্ষেত্রে বারবার ঘটে। একদা বাস্তব সত্যকে পরবর্তীতে সম্পূর্ণ অস্বীকার করে চক্রান্তের তত্ত্ব খাড়া করা হয়। নথিবিকৃতি বা বয়ানবিকৃতি ঘটে। একদা শোষক ‘প্রমাণ কই, প্রমাণ?’ বলে এড়িয়ে যায় অত্যাচারের দায় কারণ সব অত্যাচারের লিখিত প্রমাণ আর কানুনমাফিক নথি হয় না। গণহত্যার ৪০ বছর পরে তা অস্বীকার করে নিহত ও শোষিতদের ওপরেই দায় চাপিয়ে দেয় পূর্বতন শাসক; তাত্ত্বিকেরা তা নিয়ে ফেসবুকে পোস্টও দিয়ে দেয়। আর, শোষক পার পেয়ে যায় আদালতে, প্রশাসনের সঙ্গে যোগসাজশে। ভারতের আইনি ঢক্কানিনাদে ক’টা গণহত্যার মাথা শাস্তি পেয়েছে? কতগুলো রাজনৈতিক হত্যাকারী সংসদীয় গণতন্ত্রের ফাঁকফোকর গলে বেরিয়ে গেছে? সিবিআই-সিআইডির তদন্তরিপোর্ট কেন্দ্র আর রাজ্যের দড়ির ফাঁস গলায় পড়ে নেয়। গুজরাত গণহত্যা আর নন্দীগ্রাম গণহত্যার মূল অভিযুক্তরা নিরপরাধ সাব্যস্ত হয় সিবিআই দ্বারা। গণপ্রতিরোধ মঞ্চের ১২ জনকে জীবন্ত পুড়িয়ে মেরেও ‘কঙ্কাল-নেতা’র অপরাধ প্রমাণিত হয় না আদালতে। সিবিআই হঠাৎ সারদা-নারদার তদন্ত ঢিলেগতি, থেমে যায়, জড়দ্গব, অপরাধীরা জেলের বাইরে। রাষ্ট্রীয় হেফাজতে দ্রোহী যুবক-যুবতীদের চরম নির্যাতন করা, মহিলা দ্রোহীদের ধর্ষণ করা রুনু গুহনিয়োগীর কোনও শাস্তি হয়নি, রাষ্ট্রপতির মেডেল পেয়েছিল রুনু ফেক এনকাউন্টারে দক্ষতার জন্যে; বামফ্রন্ট জমানায় তার পদোন্নতি হয়েছিল। সে পরে বই লেখে, নিজেকে নিরপরাধ সাফাই দেওয়ার হাজার দোহাই পেড়ে। সেই বই জনপ্রিয়ও হয়! সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়ের জমানাকে ‘আধা-ফ্যাসিস্ট’ বলে চিহ্নিত করেছিল যারা, তারাই পরে সুসম্পর্কের দায়ে ক্ষমাশীল হয়ে গেছে। এমনকি নাজিদের কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প ও ইহুদি হত্যার বাস্তবতাকে নয়া-নাজিরা খারিজ করে দিয়েছে সোভিয়েত ও আমেরিকার ‘বানানো সত্যি’ বলে। তথ্যসঙ্গম এবং ফোটোশপ-সূত্রবিকৃতির যুগে পুরনো ঘটনাকে গুলিয়ে দেওয়ার, একদা ঘটিত অপরাধকে তরলীকৃত ক’রে দেওয়ার অনেক পন্থা তৈরি হয়ে গেছে। কিন্তু ইতিহাস তো জেগে থাকে…

সংসদীয় রাজনীতিতে রাজনৈতিক নেতৃত্ব দুটো বাক্যে ভরসা রাখে— ১. জনগণের গণস্মৃতিভ্রংশ হয় এবং ২. দলের ইচ্ছেই জনগণের ইচ্ছে। আর, এই দুই বাক্যের নির্যাসে জনগণকে বোধবুদ্ধিহীন আলাভোলা ভোটদানমেশিন মনে করে দলগুলি। সেইজন্যেই শাসনশোষণের পদ্ধতি দল থেকে দলে পুনরাবৃত্তে ফেরে। সেইজন্যেই ন্যূনতম আত্মসমালোচনা ও অপরাধস্খালন ছাড়াই দলগুলি বছরের পর বছর ‘ভোটের লাগিয়া ভিখারি সাজিনু’ কাঁদো-কাঁদো গলায় গাইতে থাকে। ঠিক ভোটের মুখে সুচতুর অপরাধী সুশান্ত ঘোষকে কেন নিজভুঁয়ে ফিরতে দেয় তৃণমূল, তা কি মানুষ বোঝে না? ঠিক ভোটের আগে যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত ছত্রধর মাহাতোর সাজা মকুব করে তাঁর নিজভুঁয়ে সংগঠকের দায়িত্ব সঁপা হয়, তা কেউ জানে না? কোন জাদুবলে নারদায় অভিযুক্ত, সারদায় জনগণের টাকা মারা রাজনৈতিক রাঘববোয়ালরা কলার তুলে ঘোরে? কোন স্পর্ধায় জল-জমি-জঙ্গল কেড়ে নিয়ে আর করের টাকা নয়ছয় করে কর্পোরেটদের হাতে তুলে দেওয়া হয়, তা বোঝা খুব শক্ত? কৃষিজ ক্ষেত্রকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে, প্রাথমিক শিল্পে লালবাতি জ্বালিয়ে দিয়ে বাম-ডান নির্বিশেষে প্রত্যেকটি সংসদীয় দল কোন স্ফূর্তিতে সেজ-এফডিআই ইত্যাদির লাগামছাড়া অনুমোদন দেয়? আমরা কি এগুলো জানি না, নাকি ভোটের আগে ভোট দেওয়ার বাধ্যতাবশত স্বেচ্ছানীরবতা পালন করি?

#

ভোট মানেই বাইনারি। মাল্টিপল চয়েস কোশ্চেন। এর মুশকিল হচ্ছে যে, ‘না’ বলার সঙ্গে সঙ্গে কোনও একটা ‘অপশন’ বেছে ‘হ্যাঁ’ বলতে হবেই। ‘এই মৃত্যু উপত্যকা আমার দেশ না’ সামাজিক মাধ্যমের স্টেটাসে লিখে দেওয়া যতটা সোজা, বাস্তবের ভোটে শুধুমাত্র ‘না’ বলা ততটাই কঠিন। কারণ, শুধু ‘না’ বলে দিলে সরকার গঠন হয় না! হ্যাঁ, সেই সরকার নিশ্চিতভাবে পাঁচ বছরের জন্যে অনুমোদন পেয়ে যাবে আমদেরই শোষণ করার, তবু, আমাদেরই তো দায় সরকার গঠনের; শুধু ‘না’-তে সেই গঠন হবে না, কোনও একটা চয়েসে হ্যাঁ প্রয়োজন হবে।

ভারতের বর্তমান পরিস্থিতিতে পয়লা নম্বর সন্ত্রাসবাদী দল আরএসএস; ভারতের সংখ্যাগুরুর ধর্মাবেগে সুড়সুড়ি দিয়ে সংগঠিত হিংসা-হত্যায় মদত দেওয়া সুসংবদ্ধ একটি দল আরএসএস। আর, সেই দলেরই সংসদীয়-গণতন্ত্রের মুখোশ বিজেপি। হিন্দু মহাসভা ও জনসঙ্ঘের দীর্ঘদিনের ঘাঁটি বাংলায় বিজেপি কখনও ক্ষমতা পায়নি। সামান্য কিছু ভোট শতাংশ পেয়েছে, ১৯৯৮ সালে একজন সাংসদও ছিল। কিন্তু, ২০১১ পরবর্তী সময়ে তৃণমূলের স্বৈরাচারিতা, সিপিআই(এম)-র প্রতি বৃহত্তর জনসাধারণের না-ফুরোনো ঘৃণা ও কংগ্রেসের সুস্পষ্ট নীতিহীনতায় ‘বিরোধী’ পরিসর ক্রমেই শূন্য হয়েছে। ২০১৪ সালে দেশজুড়ে মোদি হাওয়ায় ধর্মের কল তো নড়েই গেছে, তদুপরি কর্পোরেট পুঁজি উদ্বাহু ভূতের নেত্য শুরু করেছে। ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনের পর দেখা গেল যে, বাংলায় বামফ্রন্টের ভোট মেশিনারি অকেজো হয়ে যাওয়ার ফলে তাদের এতদিনের ভোটবাক্স বিজেপির হাতে চলে গেছে। ‘২০২১ সালে বাংলায় বিজেপি’-এই প্রচারহাওয়ার শুরু তখন থেকেই। কংগ্রেস, সিপিআইএম, তৃণমূল কংগ্রেস শোষণতন্ত্রের বিভিন্ন অবতার হলেও, একথা অনস্বীকার্য যে, এরা কেউ ‘বিজেপি’ নয়। এরা কেউই আরএসএসের মতো ফ্যাসিস্ট নয়। এই মুহূর্তে পশ্চিমবঙ্গের ক্ষমতা দখলের জন্যে সাত হাত জিভ আর দু লিটার লালা ফেলতে ফেলতে বিজেপি এগিয়ে আসছে— সারা দেশের মুৎসুদ্দি বুর্জোয়ার বিনিয়োগ এবং সিংহভাগ সংবাদমাধ্যমের প্রচার তাদের হয়ে। সাম্প্রতিক কিছু উদাহরণে খোলসা হয়েছে যে, আইন-আদালতও তাদের পক্ষেই। দেশে একের পর এক আইন-বিল চালু করে, নাগরিকদের নাগরিকত্বে সন্দেহ প্রকাশ করে, কৃষকদের ভাতে মারতে চেয়ে বিজেপি নিজেদের ফ্যাসিস্ট রূপ ক্রমশ বিকটদর্শন করছে। তাদের বঙ্গীয় নেতৃত্বের ‘বাংলাকে গুজরাত বানিয়ে দেব’ হুমকি থেকে এবং গুজরাত প্রদেশের পরিণতি থেকে এটুকু পরিষ্কার যে, বাংলাকে গুজরাত বানালে শ্রেণি-ধর্ম-লিঙ্গ নির্বিশেষে বাঙালির জন্যে তা সুখকর হবে না। কাজেই, ‘বিজেপিকে ভোট না’ স্লোগান জায়েজ। কিন্তু, গণতন্ত্রের ক্ষিধে তাতে মেটে না; ছদ্ম-গণতন্ত্রের মুখোশ তাতে আঁটোসাঁটো হয় না। নির্বাচকদের অর্থাৎ আমাদের ‘হ্যাঁ’ বলতেই হবে কোনও অপশনে।

#

স্যহি অওর গলত কে বিচ্‌ চুননা আসান হ্যায়, লেকিন দো গলত মে সে এক চুননা বহোত মুশকিল

–ওয়ন্স আপন আ টাইম ইন মুম্বাই, ২০১০

ভারতীয় সংসদীয় গণতন্ত্রের ৭৪ বছরের অভিজ্ঞতা এটাই যে, নির্বাচনে ভালো এবং মন্দের মধ্যে ‘ভালো’কে বেছে নেওয়া হয় না। মন্দ, অতিমন্দ এবং সাঙ্ঘাতিক মন্দের মধ্যে ক্ষমতার লড়াই চলে। মন্দের ভালোকে বেছে নিয়ে জনগণ প্রত্যাশা করে কিছুটা ভালো হবে তার। আপাতত যে দলের শাসনে ছটফট করছে, সেই ছটফটানি থেকে সাময়িক মুক্তি প্রত্যাশা করে; বাজে শাসনের আশু সমাধান। এতে বিপ্লব তো দূর অস্ত, ক্ষমতাকাঠামো বা সমাজ বদলায় না একটুও; আগের শোষণকাঠামোয় নতুন শাসকদল বসে নিজেদের মতো গড়েপিটে নেয় আর্থ-সামাজিক শোষণের উপাদানগুলিকে। জনগণের সম্মতি নিয়েই তা করে, সুনাগরিক সমাজের মতামতের ভিত্তিতেই তাদের শোষণশাসনের ছক অবিকল থাকে। আমরা অর্থাৎ নির্বাচকেরাও নিশ্চিত জানি যে, দুটো-তিনটে মন্দের মধ্যে থেকে একটা মন্দকে বেছে নেওয়া মোটেই সহজ নয়। তবু হায়, গণতান্ত্রিক দায়। যদি এই সব বুঝে নিয়ে রাষ্ট্রব্যবস্থা আর শোষণকাঠামোর বিরুদ্ধে কেউ প্রতিস্পর্ধী হয়, তবে নির্ঘাৎ সে মাওবাদী, অসংসদীয় নকশাল; আর, রাষ্ট্রীয় শাসনকাঠামোকে চ্যালেঞ্জ করে মাওবাদী হওয়ার শাস্তি ছ মাসের ইউএপিএ, ভুয়ো এনকাউন্টার অথবা বিনাবিচারে জেলবন্দি থাকা। আর, যদি কেউ সীমাবদ্ধতাবশত মেনে নেয় নির্বাচনী কাঠামো, তাহলে কয়েকটি মন্দের থেকে কম মন্দকে বেছে নিতে হবে। মুশকিলটা এখানেই। বিজেপি যে চরম খারাপ, তা নিয়ে দ্বিধা নেই। কিন্তু, ‘মন্দের ভালো’ কে?

আর, এখানেই চলে আসে প্রধান শত্রু নির্ধারণের প্রশ্ন। তৃণমূল বিগত দু-তিন বছর ধরে প্রধান শত্রু হিসেবে বিজেপিকে বেছে নিয়েছে। বিজেপির ঘোষিত প্রধান শত্রু তৃণমূল। সম্প্রতি বিহার বিধানসভা নির্বাচনে এনডিএ-র বিরুদ্ধে আরজেডি ও কংগ্রেসের মতো দক্ষিণপন্থী দলের সঙ্গে জোট করে আসনগত সাফল্যলাভ করেছে সিপিআই (এম-এল) লিবারেশন; তারাও বাংলায় বিজেপিকে প্রধানতম শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করতে দ্বিধাবোধ করেনি। সর্বভারতীয় স্তরে কংগ্রেসের শত্রু বিজেপি, তবু বাংলায় এখনও তাদের অবস্থান দ্বিধান্বিত। আর, সিপিআই(এম) বাংলার সংসদীয় দলগুলির মধ্যে সবচেয়ে দ্বিধাগ্রস্ত প্রধান শত্রু বেছে নিতে। বিগত লোকসভা নির্বাচনে তাদের প্রায় ২৩ শতাংশ ভোট বিজেপিতে চলে যাওয়ার লোকলজ্জা তো আছেই, তার সঙ্গে রয়েছে বিগত শাসক-অবস্থানের না-ফুরোনো প্রবল ইগো। বিগত দশ বছর তৃণমূল বিরোধিতা করতে করতেই ২০১৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনে একদা-প্রধান-শত্রু কংগ্রেসের সঙ্গে জোট করেছিল তারা। কিন্তু, তাতে লাভের চেয়ে ক্ষতি বেশি হয়েছিল, প্রধান বিরোধী দলের তকমা তো হারিয়েছিলই, উপরন্তু, পূর্বতন শাসকাবস্থানের ঘৃণিত ইমেজ পুনরুদ্ধার করতে পারেনি। এই মুহূর্তে কংগ্রেসের সঙ্গে জোট করে তৃণমূল ও বিজেপির বিরুদ্ধে লড়াইয়ের পরিকল্পনা তাদের। কিন্তু, কংগ্রেসের নৈতিক অবস্থান কি তৃণমূলের থেকে ভিন্ন? কংগ্রেসি শাসকদের প্রত্যক্ষ নির্দেশে ১৯৮৯ সালে বামপন্থী সফদর হাসমিকে খুন করেছিল কংগ্রেসি গুণ্ডারা। অথচ জোট-ভোটের দায়ে এখন কংগ্রেসকে সফদর হাসমির ছবিতে শ্রদ্ধার্ঘ প্রচার করতে হয় এবং সিপিআই(এম)কে জোট-ভোটের দায়ে সফদর হাসমির মতাদর্শ ভুলে সেই প্রচারকে প্রাণপণে ন্যায্যতা দিতে হয়! ভোটের দায় আর ক্ষমতার লোভ এদের প্রত্যেকের আছে, তাই জোটের প্রশ্ন এবং দলবদলের সার্কাসও অব্যাহত। কিন্তু, শ্রেণির প্রশ্ন? নির্বিত্ত-নিম্নবর্গের শোষণমুক্তির সর্বাত্মক প্রচেষ্টা? আশু হাঁফ-ছাড়া নয়, দীর্ঘস্থায়ী সমাধানের প্রশ্নে শ্রেণিভিত্তিক জোটবদ্ধতা? এগুলি কই?

‘ফ্যাসিস্ত আরএসএস-বিজেপির বিরুদ্ধে বাংলা’ নামক মঞ্চের কেন্দ্রীয় স্লোগান– ‘নো ভোট টু বিজেপি’। এই মঞ্চের পক্ষ থেকে জানুয়ারির ৪ তারিখ একটি গণকনভেনশনের আয়োজন করা হয়। আগামী তিন মাস বিজেপির বিরুদ্ধে পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জেলা জুড়ে লাগাতার প্রচারের উদ্দেশ্য তাঁদের। তাঁদের প্রকাশ্য আহ্বান– “এই মঞ্চ মনে করে, ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন প্রশ্নে দীর্ঘস্থায়ী গণআন্দোলন ও সামাজিক নির্মাণের কাজই পারে ফ্যাসিবাদের উত্থানকে প্রতিরোধ করতে। তাই এই মঞ্চ বাংলার সাধারণ মানুষকে পাশে নিয়ে আশু উদ্যোগ তথা দীর্ঘমেয়াদি গণআন্দোলনের উদ্যোগের মধ্যে দিয়ে ফ্যাসিবিরোধী গণ-প্রতিরোধ গড়ে তোলার সংকল্প নিয়েছে। বাংলার যে কোনো মানুষ সহমতের ভিত্তিতে এই মঞ্চের সদস্য হতে পারবেন।” নিঃসন্দেহে এই মুহূর্তে বিজেপিকে ক্ষমতা-পাওয়া থেকে আটকাতে এই বাক্যগুলি তাৎপর্যপূর্ণ। দীর্ঘস্থায়ী গণআন্দোলন ও সামাজিক নির্মাণের কাজ সবচেয়ে জরুরি আরএসএসের মতো সংগঠিত আতঙ্কবাদী দলের মতাদর্শগত বাড়বাড়ন্ত ঠেকাতে। কিন্তু, এই মঞ্চ আশা করি ভবিষ্যতে স্পষ্ট করবে যে, তাঁদের মতাদর্শগত ভিত্তি কী? বিজেপিকে ভোটের ক্ষেত্রে ‘নো-ভোট’ বলে যদিও বা রুখে দেওয়ার আশা করা যায়, কিন্তু আরএসএসকে তো সেইভাবে রোখা সম্ভব নয়; বস্তুত নির্দিষ্ট মতাদর্শগত সাংগঠনিক দৃঢ়ভিত্তি ছাড়া আরএসএস-বিজেপি শক্তিকে আটকানো অসম্ভব। ‘ফ্যাসিস্ত আরএসএস-বিজেপির বিরুদ্ধে বাংলা’ যদি একটি রাজনৈতিক সংগঠন হয়ে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করত, তাহলে তাদের উদ্দেশ্য সাধারণ মানুষের কাছে খোলসা হত আরও। কিংবা যদি এটি সংসদীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার ক্ষয়াভাঙ্গা অবস্থা ও সংসদীয় দলগুলির প্রতি জনগণের সার্বিক অনাস্থার কথা তুলে ধরে নির্দিষ্ট ইস্তাহারের ভিত্তিতে অসংসদীয় পার্টি হয়ে উঠত, তাহলে তাদের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য স্পষ্টতর হত। কিন্তু, এখনও অবধি যেটুকু তাঁরা বলেছেন, তাতে তাঁরা অন্তত ২০২১ পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা নির্বাচনে ২৯৪টা আসনের কোনওটিতেই কোনও প্রার্থী দিচ্ছেন না। ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে দীর্ঘমেয়াদি গণআন্দোলন কিন্তু কেন্দ্রীয় মতাদর্শভিত্তি ছাড়া অসম্ভব। সামাজিক নির্মাণের মতো বৃহত্তর কর্মযজ্ঞের ‘মডেল’ কী হবে? শুধুমাত্র একটি রাজনৈতিক দলের বিরোধিতা কি একমাত্র মতাদর্শ হতে পারে? সেক্ষেত্রে আবারও সেই ‘না’-এর বিকল্পে কোনও ‘হ্যাঁ’-র প্রয়োজনের প্রশ্নটা থেকেই যায়। ‘মঞ্চ’ মানে বহুত্বের ধারণা, কিন্তু তা বাইরের খোলস মাত্র। আর, যেকোনও মঞ্চ বা গণসংগঠনের কেন্দ্রীয় চালিকাশক্তি যদি নির্দিষ্ট মতাদর্শ দ্বারা চালিত না হয়, তা’লে তার দীর্ঘস্থায়িত্ব ক্রমে অভিমুখহীন হয়ে যায় বা থাকে না। রাজনীতি সচেতন ব্যক্তিমাত্রেই এটুকু জানেন। আশা করা যায়, আগামী দিনে মঞ্চটি তার নির্দিষ্ট রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ও অভিমুখ তথা কেন্দ্রীয় চালিকাশক্তির মতাদর্শ স্পষ্ট করবে।

‘বিজেপিকে ভোট না’— এই স্লোগানের সততা নিয়ে প্রশ্ন চলে না। তবু, থেকেই যায় শ্রেণির প্রশ্ন। বিজেপিকে ভোট না-দেওয়ার অবস্থান কি নির্বিত্ত-নিম্নবর্গের শ্রেণি অবস্থানকে দৃঢ় করে? জোটবদ্ধ করে? ফ্যাসিবাদ হচ্ছে পুঁজিবাদের এক বিশেষ রূপ। মূল প্রশ্ন থেকেই যায় পুঁজিবাদের বিকাশ ও শোষণকাঠামো ঘিরে। এই স্লোগান কি সেই প্রশ্নকে উদ্দেশ্য করতে পারছে? কর্পোরেট ভারতবর্ষের আর্থ-সামাজিক-সাংস্মৃতিক ক্ষেত্রের নিয়ন্তা হয়ে উঠেছে। কেরলের সাম্প্রতিক বিধানসভা নির্বাচনে কর্পোরেট সংস্থার প্রতিনিধিরা সরাসরি জিতেছে ভোটে। মুৎসুদ্দি বেনিয়ারা নির্বাচন থেকে জনগণের মতামত আদায় করে নেওয়া— সব কিছুকেই তালুবন্দি করে ফেলেছে। বাংলার সংসদীয় ক্ষমতা দখলের লোভে দৌড়ানো দলগুলি কি পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে, মুৎসুদ্দি বেনিয়াদের বিরুদ্ধে বিশ্বাসযোগ্য অবস্থান নিতে পেরেছে? কারণ, শুধুমাত্র একটি বিধানসভা নির্বাচন দিয়ে বা একটি নির্বাচনভিত্তিক জোট-আসন দিয়ে পুঁজিবাদ আর তার বিশেষ বিকৃত প্রতিরূপ ফ্যাসিবাদের দৌরাত্ম্য স্তব্ধ করা যাবে না। এর জন্যে রাজনৈতিক দলগুলিকে শ্রেণি অবস্থানভিত্তিক মতামত স্পষ্ট করতে হবেই। কারণ, ফ্যাসিবাদী আর্থ-রাজনৈতিক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে লড়াই শুধুমাত্র সংসদীয় দায়বদ্ধতার জোট-ভোট-আসনে সীমাবদ্ধ থাকতে পারে না।


  1. বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য ১৯৯৬ সালে বিধানসভার এক প্রশ্নোত্তর পর্বে তথ্য দেন যে, ১৯৭৭-১৯৯৬ সালের মধ্যে মোট ২৮,০০০টি রাজনৈতিক খুন হয়েছে পশ্চিমবঙ্গে
  2. West Bengal not new to political murders; after Congress, CPM, the baton seems to have passed to TMC