Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

প্রতিরোধযোগ্য অসুখ এবং অকালমৃত্যুর জন্যে সরকার কি বৃহত্তর দূষণকারীদের দায়ী করবে?

সন্দীপ পাণ্ড্যে, শোভা শুক্লা ও ববি রমাকান্ত

 

লেখকত্রয়ী সমাজকর্মী ও রাজনৈতিক কর্মী

১৬.৭ লক্ষ ভারতীয় ২০১৯ সালে বায়ুদূষণের কারণে প্রাণ হারিয়েছেন। ল্যানসেট প্ল্যানেটারি হেলথ-এর হিসাব অনুযায়ী এই সংখ্যাটি ভারতে মোট মৃত্যু সংখ্যার ১৭.৮ শতাংশ। বিশ্ব জুড়ে অকালমৃত্যুর ক্ষেত্রে বায়ুদূষণ ছিল চতুর্থ বিপজ্জনক কারণ। মোট মৃত্যুর ১২ শতাংশ এই বায়ুদূষণের কারণে ঘটেছে। স্টেট অফ গ্লোবাল এয়ার রিপোর্ট ২০২০ অনুযায়ী, শুধুমাত্র ২০১৯ সালেই ষাট লক্ষ সাতষট্টি হাজারের বেশি মানুষের মৃত্যু ঘটেছে। এর প্রত্যেকটিকে এড়ানো যেতে পারত এবং বায়ু দূষণের কারণে যে অসুখগুলি ঘটেছে, তার প্রত্যেকটিকে প্রতিরোধ করা যেতে পারত।

পরিবেশগত স্বাস্থ্য সঙ্কটের মধ্যে বায়ুদূষণ সবচেয়ে বেশি বিপজ্জনক। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বারবার সাবধান করেছে এই বলে যে বায়ুদূষণ হল অদৃশ্য ঘাতক। বিশ্বের মৃত্যুহারের নিরিখে প্রতি ১০,০০০ মানুষের মধ্যে বায়ুদূষণের জন্যে ৮৬ জন মারা যান। সারা পৃথিবীর জনসংখ্যার ৯২ শতাংশ এমন জায়গায় বসবাস করেন যেখানে বায়ুদূষণের মাত্রাগুলি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা-র মাপদণ্ডে শ্বাসযোগ্য বায়ুর তুলনায় অনেক বেশি নিকৃষ্ট। আমরা যখন লখনউতে এই নিবন্ধটি লিখছি, তখন এখানে বায়ুর গুণ সূচক (এয়ার কোয়ালিটি ইন্ডেক্স) ৪৬.৫-এর আশেপাশে ঘুরছে, যেখানে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সীমা ৫০-এ নির্দিষ্ট।

মহামারিগুলিকে ইন্ধন জোগাচ্ছে বায়ুদূষণ। পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি মৃত্যু ঘটে ইসকিমিক হৃদরোগে। সেগুলির মধ্যে ২০ শতাংশের জন্যে দায়ী বায়ুদূষণ। ক্যানসার রোগের মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ হল ফুসফুসের ক্যানসার, যার ১৯ শতাংশ ঘটে বায়ুদূষণের কারণে। সিওপিডি হৃদরোগের ৪০ শতাংশ রোগীদের ক্ষেত্রে দায়ী বায়ুদূষণ। হাঁপানি (অ্যাসথমা) আর একটা ভোগান্তি, যা বায়ুদূষণের কারণে আরও সঙ্কটজনক হয়ে ওঠে। এর সঙ্গে তামাক এবং অ্যালকোহল সেবনের কারণে সাধারণ ঝুঁকিগুলির কথা ভুললে চলবে না। কারণ, এই ঝুঁকিগুলি প্রতিরোধযোগ্য। মানুষের প্রাণ এবং তাঁদের দুর্ভোগের ফলে অপূরণীয় ক্ষতি ঘটানোর জন্যে জাঁদরেল তামাক এবং জাঁদরেল অ্যালকোহল উৎপাদকদের কি আমাদের সরকার দায়ী করবে না?

তার চেয়েও ভয়ের কথা, আবহাওয়া পরিবর্তন এবং বায়ুদূষণের মধ্যে সম্পর্কটি অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ। এর ফলে দেশগুলির অর্থনীতিতে ক্ষতির পরিমাণ যেমন বাড়ছে, তেমনি বাড়ছে মানুষের স্বাস্থ্যবিষয়ক সঙ্কট। তবু লক্ষণ দেখে মনে হচ্ছে না এই বিষয়ে গড়িমসি কাটিয়ে সরকার জরুরি ভিত্তিতে কিছু পদক্ষেপ নিচ্ছে। মানুষ যাতে শুদ্ধ বায়ু গ্রহণ করে বাঁচতে পারে, তার জন্যে অনেক বেশি তৎপরতা প্রয়োজন।

 

বৃহত্তর দূষণকারীদের উচিত মূল্য দিতে হবে

সম্প্রতি প্রকাশিত ল্যানসেট প্ল্যানেটারি হেলথ-এ বলা হয়েছে যে বায়ুদূষণের ফলে মানুষের অকালমৃত্যু এবং অসুস্থতায় শুধুমাত্র ভারতবর্ষে যে অর্থনৈতিক ক্ষতি হচ্ছে, তার পরিমাণ ২৮.৮ বিলিয়ন ডলার (প্রায় ২,১৩,৪৫১ কোটি টাকা)। ল্যানসেট বলছে “জিডিপি-তে সবচেয়ে বেশি অংশ লোকসান হচ্ছে উত্তর প্রদেশ এবং বিহারে, যেখানে জন প্রতি (পার ক্যাপিটা) জিডিপি ভারতের অন্য রাজ্যগুলির মধ্যে সবচেয়ে কম। এর থেকে বোঝা যাচ্ছে যে বায়ুদূষণের কারণে অর্থনৈতিক ক্ষতির নিরিখে এই দরিদ্র দুই রাজ্য সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত।”

অত্যধিক ভারাক্রান্ত এবং ভয়াবহভাবে দুর্বল স্বাস্থ্যব্যবস্থা নিয়ে ভারতকে এখন কোভিড-১৯ অতিমারির অতিরিক্ত চ্যালেঞ্জ নেওয়ার পর আমরা আর অন্য প্রতিরোধযোগ্য রোগের অতিমারিগুলির ভার সামলাতে পারব না। কেউ যেন এমন রোগে না ভোগে, যার প্রতিরোধ সম্ভব। একই যুক্তিতে কারও যেন না এমন রোগে অকালমৃত্যু হয়, যার চিকিৎসা সম্ভব।

ভারতের রাষ্ট্রপতি সম্প্রতি একটি অর্ডিন্যান্সে স্বাক্ষর করেছেন যার নাম ‘দ্য কমিশন অফ এয়ার কোয়ালিটি ম্যানেজমেন্ট ইন ন্যাশনাল ক্যাপিটাল রিজিয়ন অ্যান্ড অ্যাডজয়েনিং এরিয়াস ২০২০’’ যাতে এক কোটি টাকার জরিমানা এবং/অথবা পাঁচ বছরের জন্য হাজতবাসের কথা বলা হচ্ছে তাদের জন্যে যারা বায়ুদূষণ সংক্রান্ত নিয়মগুলি ভাঙবেন। কৃষকেরা খড়কুটো জ্বালিয়ে যে সমস্যা সৃষ্টি করে, তার পরিপ্রেক্ষিতে এই অর্ডিন্যান্স আনা হয়েছে। ইতিমধ্যে শিল্পোদ্যোগে এবং যানবাহনের ফলে শহরে দূষণ পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়েছে, যা বন্ধ করবার জন্যে কোনও সরকারই শক্ত কোনও আইন প্রণয়ন করেনি। সত্যি কথা বললে, দূষণ পর্ষদগুলির ইতিহাস দেখলে দেখা যাবে যে শিল্পোদ্যোগগুলিকে তুষ্ট করবার জন্যে তাঁরা দূষণ সংক্রান্ত বিষয়ে বারবার সমঝোতা করে গেছেন। প্রমাণ চাইলে যে কেউ শিল্পাঞ্চল অথবা শহরের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া নদীগুলিতে দূষণের মাত্রার দিকে স্রেফ তাকাতে পারেন।

অত্যন্ত সহজে এবং সম্পূর্ণত আমরা দরিদ্র মানুষদেরকেই দূষণের জন্যে দায়ী করি। কিন্তু মজাটা হল, দরিদ্র মানুষরা অত্যন্ত কম উপভোগ এবং দূষণ করেন। আমরা, সুবিধাভোগী মানুষরাই এই পৃথিবীর সম্পদ সবচেয়ে বেশি উপভোগ, অপব্যবহার এবং দূষিত করে এসেছি। এবং আমরা এই সুবিধভোগী মানুষ (যারা ভবিষ্যতের কথা না ভেবে বাঁচি, উপভোগ করি এবং দূষিত করি), তারাই আবার ‘সাসটেনেবল ডেভেলপমেন্ট মডেল’ কী হবে তা ঠিক করি! তাই খড়কুটো জ্বালানোর জন্যে কৃষকদের ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে কারও উপকারই হবে না কারণ, সবখানে তো আমরা এয়ার পিউরিফায়ার রাখতে পারব না। কিন্তু আমাদের নিজেদের এবং প্রিয়জনেদের বাঁচবার জন্যে নির্মল বায়ু চাই।

ভাবুন। বায়ুদূষণের কারণে স্বাস্থ্য এবং অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে এই অপরিসীম ক্ষতিগুলির দায় কাদের? আমাদের চারপাশের বায়ু দূষিত করবার জন্যে কেন্দ্রীয় এবং রাজ্য সরকারগুলি কেন বিভিন্ন নিগমগুলির থেকে আর্থিক ক্ষতির মাসুল আদায় করবে না? অথচ বিগত বছরগুলির দিকে ফিরে তাকালে দেখব, ব্যবসার সহজতা (‘ইজ অফ বিজনেস’) অথবা ‘অর্থনীতিকে আবার চাঙ্গা করা’র নামে নিগমগুলির সুবিধা দিতে পরিবেশ রক্ষার বিধিগুলিকে বিভিন্ন সরকার হয় শিথিল করেছে, নয় লঘু করেছে অথবা দুর্বল করেছে।

সরকারের প্রাথমিক দায়িত্ব হল এটা নিশ্চিত করা যে সব নাগরিক যেন নির্মল বায়ুতে শ্বাসগ্রহণ করেন। সরকারের এটাও নিশ্চিত করা প্রয়োজন যে নিগমগুলি যেন এমন কোনও কাজ না করে যাতে এই গ্রহ এবং তার স্বাস্থ্য দূষিত হয়। এবং যে সংস্থাগুলি এমন কাজ করলে তাদের থেকে কৈফিয়ত নেওয়াটাও একান্ত জরুরি। বাজার-ভিত্তিক সমাধানগুলি প্রকৃতপক্ষে কোনও সমাধান নয়। বরং তাতে নিগমগুলির কোষাগারগুলিকে আরও অর্থ দিয়ে ভরা হয়। তাই রাস্তার ধারে ‘এয়ার পিউরিফায়ার’-গুলি বসানোটা বায়ুদূষণ সমস্যার সমাধান নয়। দূষণের (বিভিন্ন) উৎসগুলিকে থামিয়ে উন্নয়নের মডেলটিকে পুনর্নির্মাণ করেই আমাদের চারপাশের বায়ু এবং পৃথিবীর দূষণে সমস্যা সমাধান করা যাবে।