সৌম্য শাহীন
অধ্যাপক, সমাজকর্মী
লেনিনকে আমরা দাঁড় করিয়ে রেখেছি ধর্মতলায়
ট্রামের গুমটির পাশে।
আঁস্তাকুড়ের ভাত একদল খুঁটে খুঁটে খাচ্ছে
ডাস্টবিনে হাত চালিয়ে দিয়ে।
লেনিন দেখছেন।…
দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে লেনিনেরও খুব হাই পাচ্ছিল।
হঠাৎ দেখলাম একটু নড়েচড়ে সোজা হয়ে দাঁড়ালেন।
যেদিকে তাঁর নজর, সেইদিকে তাকিয়ে দেখলাম
লাল নিশান নিয়ে একদল মজুরের এক বিশাল মিছিল আসছে।
আমার মনে হল, লেনিন যেন চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বললেন,
শতাব্দী শেষ হয়ে আসছে—
একটু পা চালিয়ে, ভাই, একটু পা চালিয়ে।।
সুভাষ মুখোপাধ্যায় এই কবিতাটা যখন লিখেছিলেন, তখনও বার্লিনের দেওয়াল ভাঙা পড়েনি, চিন সবেমাত্র মুক্ত অর্থনীতির পথে গুটিগুটি পায়ে হাঁটা শুরু করেছে, আর ব্রিটেনে কোনও এক মার্গারেট থ্যাচার সদ্য প্রধানমন্ত্রী পদে নির্বাচিত হয়েছেন। নয়া উদারবাদী অর্থনৈতিক দর্শন সবেমাত্র ফ্রিডম্যান-হায়েকদের হাত ধরে রাষ্ট্রীয় নীতিনির্ধারণের স্বপ্ন দেখছে। শতাব্দী পেরিয়ে আজকের ভারতবর্ষে সেই দর্শন ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রের ঘাড়ে চেপে শ্রমজীবী মানুষের বাঁচার অধিকারটুকু কেড়ে নিতে চাইছে। বহু লড়াইয়ে অর্জিত শ্রমিক-কৃষকের অধিকারগুলোকে ছিনিয়ে নিয়ে পুঁজিবাদকে তার নিজের তৈরি ফাঁদ থেকে মুক্ত করাই শাসকের প্রধান প্রকল্প। অতিমারিকে সামনে রেখে সংসদীয় গণতন্ত্রের সমস্ত রীতিনীতিকে লঙ্ঘন করে একটার পর একটা জনবিরোধী আইন পাশ করিয়ে নিচ্ছে তারা। জনগণকে ধর্মীয় আফিমে আচ্ছন্ন রেখে দেশ বিক্রির এই পরিকল্পনা দিব্যি সফল হচ্ছিল, কিন্তু বাধ সাধল দেশের কৃষক সমাজ। তিনটে নতুন কৃষি আইন এনে কৃষিক্ষেত্রে কর্পোরেট রাজ পাকা করার বন্দোবস্ত করে ফেলেছিল মোদি সরকার। মূলত ফসলের ন্যূনতম সহায়ক মূল্যের দাবিতে শুরু হয়েছিল যে আন্দোলন, অচিরেই তা কৃষি অর্থনীতির মৌলিক প্রশ্নগুলোকে ঘিরে জনজীবনে এক গভীরতর প্রতর্ককে উসকে দিয়েছে।
দিল্লির প্রবল শীত উপেক্ষা করে গত দেড় মাসের বেশি সময় ধরে সর্বনাশা কৃষি আইন বাতিলের দাবিতে আন্দোলনরত পাঞ্জাব, হরিয়ানা সহ বিভিন্ন রাজ্যের কৃষকরা। খুব সঠিকভাবেই তাঁরা দেশের সম্পদ লুণ্ঠনকারী আম্বানি-আদানিদের মূল শত্রু রূপে চিহ্নিত করেছেন এবং এদের তৈরি সমস্ত পণ্য বয়কটের ডাক দিয়েছেন। এই আন্দোলনের নেতৃত্ব স্পষ্ট জানিয়েছেন যে তাঁদের দাবিসমূহ মানা না হলে আগামী ২৬শে জানুয়ারি, প্রজাতন্ত্র দিবসের দিন কুচকাওয়াজ করে তাঁরা দিল্লি শহরে ঢুকবেন। আন্দোলনের সঙ্গে সংহতি জানিয়ে সারা দেশের বিভিন্ন প্রান্তে গণ সংগঠনগুলি রাস্তায় নেমেছে। গত ৯ই জানুয়ারি থেকে অখিল ভারতীয় কৃষক সংঘর্ষ সমন্বয় সমিতির পশ্চিমবঙ্গ শাখার উদ্যোগে কলকাতার ধর্মতলায় লাগাতার অবস্থান শুরু হয়েছে। “অন্নদাতাদের সাথে বাংলা” নামের এই ধর্নামঞ্চের উদ্বোধনে উপস্থিত ছিলেন সিপিআইএমএল (লিবারেশনের) পলিটব্যুরো সদস্য কমরেড কার্তিক পাল, ফরোয়ার্ড ব্লক নেতা হাফিজ আলম সৈরানি, স্বরাজ অভিযানের অভীক সাহা প্রমুখ।
“যদি ভগৎ সিংয়ের রাজ্যের কৃষকরা দিল্লির মসনদ কাঁপিয়ে দিতে পারে, তবে মাতঙ্গিনী-ক্ষুদিরামের বাংলার কৃষকেরাও পিছিয়ে থাকবে না…”— বলছিলেন পূর্ব মেদিনীপুরের খেজুরি থেকে আসা আশিস মাইতি। স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশগ্রহণ করা এই অশীতিপর যোদ্ধার কণ্ঠের প্রত্যয় ছড়িয়ে পড়েছিল সেদিনকার পরবর্তী বক্তাদের মধ্যেও। “ক্ষুদ্র ঋণের জালে জড়িয়ে থাকা প্রান্তিক মানুষ তাদের রক্তজল করা টাকা দিয়ে আর সপ্তাহে সপ্তাহে কিস্তি দেবে না। যে সরকার মালিয়া-মেহুল চোকসি-রামদেবদের ৬৮০০০ কোটি টাকার ঋণ মুকুব করতে পারে, লকডাউনে সর্বস্বান্ত শ্রমজীবী মানুষের ক্ষুদ্র ঋণের দায়ও তাকেই নিতে হবে”— সাফ কথা ভাঙরের আইরুল হকের। ভাঙরের আরেক নেতা, আবু তালেব পুঁজিপতি-রাজনৈতিক নেতা-কর্পোরেট মিডিয়ার দুষ্টচক্রের বিরুদ্ধে শানিত আক্রমণ করেছিলেন তাঁর বক্তব্যে। এছাড়াও ভাঙর জমি আন্দোলনের নেতা শঙ্কর দাস, ANPM-এর কাজী শরীফ, নারী আন্দোলনের কর্মী মিতালি বিশ্বাস, ছাত্রদের পক্ষ থেকে স্নিগ্ধা ও ধ্রুবজিত, ঋতব্রত ঘোষ সহ অন্যান্য বক্তারা তুলে ধরলেন কৃষি আইনের বিভিন্ন ক্ষতিকারক দিক। এগুলি ধর্নার দ্বিতীয় দিনের ঘটনা।
তবে শুধু বক্তৃতা নয়, সেদিনকার অনুষ্ঠানের অন্যতম উজ্জ্বল দিক ছিল বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। প্রখ্যাত শিল্পী প্রতুল মুখোপাধ্যায় সদ্য বাইপাস সার্জারির ধকল সত্ত্বেও আন্দোলনের টানে মঞ্চে উপস্থিত হয়েছিলেন। দমে সামান্য ঘাটতি হলেও তাঁর গানে সংগ্রামী প্রত্যয়ের বিন্দুমাত্র অভাব ছিল না। প্রবীণ অসীম গিরি, নিশীথ রায়দের সাথে নবীন অমৃতা ও তীর্থর গণসঙ্গীতে উদ্বেল হয়ে উঠেছিল উপস্থিত জনতা। “আনকার্টেন” নামক নাটকের দলের উপস্থাপনায় উঠে এল অতিমারি কালে মোদি সরকারের নীতিগত দেউলিয়াপনা। পরিযায়ী শ্রমিকের যন্ত্রণা থেকে হিন্দুত্ববাদী শক্তির নারী, সংখ্যালঘু, দলিত, তৃতীয় লিঙ্গের ওপর লাগাতার আক্রমণ, কোভিড মোকাবিলায় গোমূত্র সেবনের নিদান বা শাঁখ বাজিয়ে, থালাবাসন পিটিয়ে ভাইরাস তাড়ানোর চেষ্টা, বল্গাহীন বেসরকারিকরণ, কর্পোরেট বন্ধু কৃষি আইন, শ্রম কোড এবং সর্বোপরি কালা নাগরিকত্ব আইন— ফ্যাসিবাদের নানা রূপ কোলাজের ফর্মে উঠে এল তাদের নাটকে। তাঁদের অভিনয় চলাকালীন দূরপাল্লার বাস ধরতে ধর্মতলায় আসা মানুষ থেকে শুরু করে অফিসফেরত নিত্যযাত্রীরা ভিড় করলেন ধর্না মঞ্চে। বিলি হল কৃষি আইন বিরোধী লিফলেট, যা হাতে হাতে ছড়িয়ে পড়বে বাংলার বিভিন্ন প্রান্তে। রাত বাড়ার সাথে সাথে ক্রমশ গণসঙ্গীতের সুর আর তীক্ষ্ণ বক্তৃতার যুগলবন্দিতে প্রতিরোধের রঙে রক্তিম হয়ে উঠছে কল্লোলিনী কলকাতা। শীতের রাত জাগার প্রস্তুতির সাথে সাথে দীর্ঘ আন্দোলনের জন্য চোয়াল শক্ত লড়াই শুরু হয়ে গেছে। ধর্মতলার ট্রাম গুমটির পাশে লেনিনের সেই মূর্তিটাও যেন এখন অন্যান্য সময়ের তুলনায় অনেক ঋজু ও সজাগ।