Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

কৃষি আইনে দাগিয়ে দেওয়া ‘উপকারিতাগুলি’র বাস্তবতা যাচাই

সঞ্জীব পোহিত

 





লেখক নতুন দিল্লির ন্যাশনাল কাউন্সিল অফ অ্যাপ্লায়েড ইকোনমিক রিসার্চ (NCAER)-এর অধ্যাপক। মূল লেখাটি কাউন্টারভিউ-তে গত ১১ জানুয়ারি ইংরাজিতে প্রকাশিত। লেখকের অনুমতিক্রমে আমরা এটি অনুবাদ করে প্রকাশ করলাম। বাংলায় অনুবাদ করেছেন সত্যব্রত ঘোষ।

 

 

 

অনেক দফার আলোচনার পরেও কৃষকদের বোঝানো যায়নি কেন তাঁরা বিক্ষোভ থেকে বিরত হবেন। কৃষি আইনের পক্ষে যাঁরা রয়েছেন, তাঁরা বিলের উপকারিতাগুলির উপর জোর দিচ্ছেন। কিন্তু সাধারণ কৃষকদের জন্যে এই উপকারগুলির অধিকাংশ বাস্তবে উপকার নয়। আলোচনা তাই এক জায়গাতেই এখনও আটকে আছে। সুতরাং, কৃষি আইনের মুরুব্বিদের নিম্নোক্ত সূক্ষ্ম দিকগুলি বুঝতে হবে:

বেদবাক্য ১— কৃষকরা ভারতের যে কোনও জায়গায় তাঁদের ফসল বিক্রি করতে পারবেন। অর্থাৎ, যে সবচেয়ে বেশি দাম দেবে, ওনারা তাঁর কাছেই ফসল বিক্রি করতে পারবেন। তা তিনি শহরে থাকুন, অথবা দূর কোনও গ্রামে। দালালদের শোষণের দিন শেষ।

বাস্তবতা যাচাই— অবস্থাপন্ন কৃষকদের বাদ দিলে বাকিরা টাকা ধার নিয়েই কৃষিকাজ করেন। যে টাকা দিচ্ছে, সে স্থানীয় মহাজন হতে পারেন অথবা বীজ/সার/অন্যান্য কিছুর বিক্রেতা/বিতরক। এই বস্তুগুলির জোগানদার মানুষটি কৃষকদের বিশ্বাস করে ঋণ দেয়। তাই ফসল উঠলেই সে টাকা ফেরত পেতে কৃষকদের উপর হামলে পড়ে।

সেই কারণে অধিকাংশ ক্ষেত্রে দ্রুত ঋণশোধের জন্যে কৃষকরা ফসল বেচে দিতে চান। তাছাড়া, ফসল মজুত রাখবার জন্যে যে জায়গা প্রয়োজন, তা কৃষকদের বাড়িতে নেই। যত শীঘ্র তাঁরা ফসল বিক্রি করবেন, ততই তাঁদের মঙ্গল।

তাই তাড়াহুড়ো করে ফসলের হাতবদলটা যে কোনও কৃষকের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কাছাকাছি শহরে গিয়ে বেশি দামে ফসল বিক্রি করাটা তাঁর পক্ষে সুবিধজনক নয়, কারণ শহরে বিক্রি করবার জন্যে যে ট্রেড লাইসেন্স প্রয়োজন তাঁর কাছে সেটি নেই। ট্রাক্টরের পিছনে ট্রেলার জুড়ে চলাটাই কৃষকদের যান ও বাহন। বড়জোর কাছাকাছি বাজারগুলিতে তাঁরা ফসল বয়ে নিয়ে যেতে পারেন।

যদি বা ধরে নেওয়া যায়, তাঁরা বেশি দাম পাওয়ার জন্যে কাছাকাছি শহরের হোলসেল বাজারে ফসল বয়ে নিয়ে গেলেন, সেক্ষেত্রে তাঁরা তখনই হাতে হাতে টাকা নাও পেতে পারেন। কারণ, মালের বিনিময়ে মূল্যের একটা অংশ দিয়ে বাকি টাকাটা নিয়মিত বেচাকেনার সময়ে কিস্তিতে মেটানোটাই হোলসেল বাজারের রীতি।

সার কথা এই যে এই বেদবাক্যটি কৃষকদের ক্ষেত্রে খাটে না। বিশেষ করে যখন পাওনাদারেরা প্রতিদিন তাঁদের বাড়িতে কড়া নাড়ে। মোট কথা, যে ফসল তোলা হল, তা বিক্রি করে হাতে নগদ টাকা হাতে পাওয়ার জন্যে কৃষকদেরকে কমিশন এজেন্ট/দালালের উপর নির্ভরশীল হতেই হয়।

বেদবাক্য ২— এগ্রিকালচারাল প্রোডিয়ুস মার্কেট কমিটি (APMC) অ্যাক্ট বাতিল করলে বেসরকারি বাজারগুলি ক্রমশ নিজেদের পায়ে দাঁড়াবে, যেখানে প্রতিযোগিতামূলক চাপের সুবাদে কৃষকরা তাঁদের ফসলের জন্যে বেশি মূল্য পাবেন।

বাস্তবতা যাচাই— এমনটা বিশ্বাস করা হয় যে কৃষি আইন তিনটি চালু হলে কর্পোরেট সংস্থাগুলি কৃষি বাজারে প্রবেশ করবে। কৃষিকাজে লগ্নি করবার পাশাপাশি নিজেদের ব্যবসার জন্যে বেসরকারি বাজারগুলিকে উন্নত করবে তারা। কৃষিপণ্য মজুতের ঊর্ধ্বসীমা তুলে দেওয়াটা স্পষ্ট বুঝিয়ে দেয় এই বাজারে কর্পোরেট সংস্থাগুলিকে নিজেদের ভূমিকা পালন করবার জন্যে স্বাগত জানানো হচ্ছে।

কৃষকরা যদি কৃষি উৎপাদক সংগঠন (FPO)-গুলি বানিয়ে অন্যান্যদের সঙ্গে বোঝাপড়া করেন তাহলে তাঁদের দরকষাকষির ক্ষমতা বাড়বে। কিন্তু তেমন সংগঠন প্রায় দেখাই যায় না।

তা কি সত্যিই ঘটবে, বিশেষ করে করোনা-র প্রাদুর্ভাবের পর কর্পোরেট সংস্থাগুলি যখন ‘ধীরে চলো’ পথ ধরেছে? ব্যবসায় মন্দা চলায় কৃষি-উৎপাদনের মতো নিবিড় মূলধন-কেন্দ্রিক ক্ষেত্রে সংস্থাগুলি কি অর্থ বিনিয়োগ করবে? এখানে উল্লেখযোগ্য তথ্যটি হল যে, এক দশকেরও বেশি সময় আগে বিহার রাজ্যে এপিএমসি বাতিল হয়। সম্ভবত, বিহারের উদাহরণটি বেসরকারি সংস্থাগুলির আচরণের দিকে কিছুটা আলোকপাত করতে পারে। ২০০৬ সালে সেখানে এপিএমসি বাতিল হবার পরেও নতুন বাজার তৈরির জন্যে বেসরকারি বিনিয়োগ আসেনি অথবা যে ব্যবস্থাগুলি রয়েছে সেগুলিকে আরও শক্তিশালী করা হয়নি। এর ফলে বাজার ঘনত্ব ক্রমশ কমেছে। পরিবর্তে কমিশন এজেন্টদের রাজত্ব শুরু হয়েছে যারা গ্রামে গ্রামে গিয়ে কৃষকদের থেকে কৃষি উৎপাদনগুলি কিনে আনে।

কাছাকাছি চালু একটি বাজার না থাকলে কৃষকদের হাতে বিকল্প রাস্তা অত্যন্ত সীমিত। কমিশন এজেন্টরাই কৃষকদের দর ওঠানামার সঙ্কেত দেয়। অথচ তারাই সাধারণত ফসলের জন্যে কৃষকদের কম দাম হাঁকে। যেহেতু কৃষকদের ফসল মজুত করবার জায়গা নেই এবং কৃষিকাজের জন্যে নেওয়া ঋণ শোধ করবার জন্যে তাঁদের টাকার প্রয়োজন, তাই কমিশন এজেন্টদের সঙ্গে দরকষাকষি করবার উপায় তাঁদের হাতে নেই বললেই চলে। সব মিলিয়ে বেসরকারি বাজারের থেকে তুলনামূলক বেশি দাম পাওয়ার জন্যে কৃষকদের যে স্বপ্ন, তা পূরণ হয়নি।

বেদবাক্য ৩— চুক্তিভিত্তিক কৃষিতে কৃষকদের জন্যে কম ফসলের ঝুঁকি বা কম দামে ফসল বিক্রি করবার ঝুঁকি কমে যাবে।

বাস্তবতা যাচাই— তত্ত্বগতভাবে এটা হওয়ারই কথা, যদি দুই পক্ষের মধ্যে মেনে নেওয়া চুক্তির প্রতি সম্মান রজায় রাখা যায়। তবে এমন অজস্র উদাহরণ আছে যেখানে কৃষি উৎপাদন ক্রয়কারী কর্পোরেট সংস্থাগুলি চুক্তির প্রতি সম্মান না রাখায় শুধু কৃষকদেরই লোকসান হয়েছে। ভারতের আইনব্যবস্থায় যে শিথিলতা, তাতে এক পক্ষ যদি চুক্তির খেলাপ করে কৃষকের নিজের হকটুকুও আইনি পথে দাবি করে পাওয়া প্রায় অসম্ভব।

অবশ্য কৃষকরা এফপিও-গুলি বানিয়ে যদি অন্য পক্ষের সঙ্গে বোঝাপড়া করেন তাহলে তাঁদের দরকষাকষির ক্ষমতা বাড়বে। কিন্তু বাস্তবে এমন কৃষি উৎপাদন সংগঠন ভূভারতে প্রায় নেই বললেই চলে।