পার্থজিৎ চন্দ
শিক্ষক, কবি
বৌদ্ধ-লামাদের প্রাণীহত্যা নিয়ে বেশ ভাবিয়ে তোলার মতো এক গল্প প্রচলিত আছে। তারা প্রকাশ্যে প্রাণীহত্যা করে না, কিন্তু মৃত্যুর পর সম্ভবত বেচারি ভেড়াটিও তীব্র ‘কনফিউজড’ থাকে এ বিষয়ে যে তার মৃত্যুর জন্য প্রকৃত দায়ী কে। কারণ প্রথমে এক লামা ভেড়াটিকে নিয়ে পাহাড়ে ওঠে, আরেক লামা এসে তার গলায় পাথর বেঁধে দেয়। আর সব শেষে আরেকজন লামা সে পাথর গড়িয়ে দেয় পাহাড়ি-খাদের দিকে।
যে পাহাড়ে তুলেছিল সে পাথর বাঁধেনি, যে পাথর বেঁধেছে সে পাথর গড়িয়ে দেয়নি আর যে পাথর গড়িয়ে দিয়েছে সে পাথর বাঁধেনি। এই অপযুক্তির অন্ধকূপ একবার তৈরি করতে পারলে যে কোনও অবদমন বেশ নরম হয়ে আসে। পার্শ্ব-শিক্ষকদের বর্তমান অবস্থা ও তাঁদের নিয়ে উৎকৃষ্ট ‘নাটকের’ দিকে তাকিয়ে এ কথা আরও বেশি করে বিশ্বাস করতে ইচ্ছা করে।
এমনিতে আমাদের দেশের আমলাতান্ত্রিক ব্যবস্থা আঠারো-শো তিরানব্বই সালের কলোনিয়াল স্ট্রাকচারের থেকে একবিন্দু পরিবর্তিত হয়নি। এখানে পদমর্যাদাসূচক টার্মগুলি নিছক টার্ম নয়; তারা ক্ষমতা ও সামাজিক অবস্থানের চিহ্নায়ক হিসাবে কাজ করে। বর্ণাশ্রম প্রথার থেকেও মারাত্মক সেটি। এখানেও নিয়েছে, শিক্ষকের আগে ‘প্যারা’ যুক্ত করে সেই চিহ্নায়ণের কাজ প্রথমেই শুরু করে দেওয়া হয়েছিল। শুধু তাই নয়, ‘স্টেট’ যে কী পরিমান ধুরন্ধর ও সতর্ক হতে পারে তা এঁদের দেখলেই বোঝা যায়। একদম প্রথম দিকে একটি শর্তের দিকে তাকানো যাক, Notification No – 841- SE(Pry)/2D-1/2007 dated 7.8.08 মোতাবেক প্রতিবছর নবীকরণ সাপেক্ষে পার্শ্ব-শিক্ষকদের চাকুরি বহাল থাকত ও একদিন করে ‘বাধ্যতামূলক’ ব্রেক অফ সার্ভিস করতে হত। অর্থাৎ টানা-একবছর চাকুরি করলে এঁরা যে পূর্ণ-সময়ের শিক্ষকের ‘স্ট্যাটাস’ দাবি করতে পারেন এবং সে ক্ষেত্রে আইনি জটিলতার মধ্যে পড়তে হতে পারে, সরকার সে বিষয়ে প্রথম থেকেই বেশ ‘সতর্ক’। আরও একধাপ এগিয়ে বলা যায়, এঁদের সার্বিক উন্নতির থেকেও সরকার বেশি ‘চিন্তিত’ ও ভাবিত ছিল আইনের ফাঁক খুঁজতে, যে রন্ধ্র দিয়ে এই সব পার্শ্ব-শিক্ষকদের দাবি ঝেড়ে ফেলা যায়। পরবর্তী সময়ে এই ব্রেক অফ সার্ভিসের ব্যপারটি উঠে যায়, কিন্তু এটি বুঝিয়ে দেয় যে সিস্টেম নিজেকে ‘সুরক্ষিত’ রাখবার জন্য ছুতো খুঁজে বেড়ায় ও বাসরঘরে ছিদ্র রেখে দেয়।
২০০৯-এর এপ্রিলে ও ২০১৮-এর মার্চে পার্শ্ব-শিক্ষকদের ভাতা বৃদ্ধি হয় দু দফায়। একটি আগের সরকারের সময়ে ও একটি বর্তমান সরকারের আমলে। ২০০৯-এ ভাতা বৃদ্ধির সঙ্গে তৎকালীন সরকার ঘোষণা করে প্রতি তিন-বছর অন্তর ৫ শতাংশ হারে ভাতা বৃদ্ধির (এই বৃদ্ধির হার কচ্ছপের বৃদ্ধিকেও লজ্জা দেবে, যদিও)। ২০১৮ সালে বর্তমান সরকার প্রাথমিকে ৮১৮৬ টাকা ও উচ্চ-প্রাথমিকে ১৩০০০ টাকা প্রতিমাসে ভাতা ও চাকুরির শেষ এককালীন এক লক্ষ টাকা দেবার কথা ঘোষণা করে। কিন্তু সেই মুহূর্তেই সুড়ুৎ করে হাওয়া হয়ে যায় প্রতি-তিনবছরে ৫ শতাংশ করে ভাতা বৃদ্ধির বিষয়টি। ফলে এই ভাতা-বৃদ্ধি প্রকৃত অর্থে notional effect এর কাছাকাছি পৌঁছে গেল।
এবার আসা যাক গ্রাউন্ড-রিয়ালিটি ও বেশ কয়েকটি বানিয়ে তোলা উৎকট প্রশ্নের কাছে।
পিছিয়ে পড়া ছাত্র-ছাত্রীদের সহায়তা, অ্যাক্টিভিটি-বেসড লার্নিং চালিয়ে নিয়ে যাওয়া ও ড্রপ-আউট ছাত্রছাত্রীদের খুঁজে বের করা— মূলত এই তিনটি কাজ পার্শ্ব-শিক্ষকদের জন্য নির্দিষ্ট হয়ে থাকলেও এর পাশাপাশি খুড়োর কল অথবা গিলোটিনের মতো ঝুলতে থাকে ‘ফর দ্য গ্রেটার ইন্টারেস্ট অফ দ্য ইন্সটিটিউশন’ মার্কা নির্দেশনামা। কর্তৃপক্ষের হাতে এই ব্রহ্মাস্ত্র থাকার ফলে ছাতা-সেলাই থেকে মেঘদূত-পাঠ… সবই করতে বাধ্য হন পার্শ্ব-শিক্ষকরা। নবম থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত ক্লাস নেন এমন প্যারাটিচারের সংখ্যা সুপ্রচুর। ফলে বাস্তবে দেখা যায়, তাঁরা পূর্ণ সময়ের শিক্ষকের সমান কাজ করেও ভাতা পান অবিশ্বাস্য রকমের কম।
এসএসসি ও নন-এসএসসি নামক সে ধাঁধাটি বাজারে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে ও যে বিষয়টি বেশ বড় সংখ্যক মানুষ ‘খেয়েছে’ তাও বেশ গোলমেলে। এসএসসি বহাল থাকার পরেও কোন বাধ্যবাধকতা থেকে এই পার্শ্ব-শিক্ষক নিয়োগের দরকার পড়েছিল তা নিশ্চয় দিনের আলোর মতো স্বচ্ছ। এসএসসি-র দ্বারা নমিনেটেড না-হয়ে পূর্ণ সময়ের শিক্ষকের মর্যাদা দাবি করা যদি অপরাধ হয় তাহলে তো প্রথম অপরাধ সরকার-বাহাদুরের। চাকুরি পাবার পর শর্তের বাইরে বেরিয়ে দাবিদাওয়া আদায়ের লড়াই যদি অপরাধ হয় তার থেকেও বড় অপরাধ শিক্ষিত বেকারদের অসহায় অবস্থার সুযোগ নিয়ে তাদের হাতে নীলকর-সাহেবদের মতো চুক্তিপত্র ধরিয়ে দিয়ে শিক্ষকতায় নিয়োগ করা। আমাদের বিশ্বাস করতে অসুবিধা হয় যে সদিচ্ছা থাকলে এঁদের জন্য নির্দিষ্ট বেতন-কাঠামো চালু করা যায় না।
এর সঙ্গে মাঝে মাঝেই ভাসিয়ে দেওয়া হয় কেন্দ্রের বঞ্চনা ও রাজ্যের উদাসীনতা। সর্বশিক্ষা-র অর্থ কোন পথে এসে কত শতাংশে থিতু হয় বা কেন্দ্রের টাকা শিক্ষক-প্রতি ঠিক ব্যয় হয় কি না সেটি আসলে গোলমেলে এক প্রশ্ন। পার্শ্ব-শিক্ষকদের সত্যিই এটি জেনে খুব বেশি উপকার হবার কথা নয়। কারণ এই বিতর্কের সমাধান হলেও, অর্থাৎ যদি নিরূপণ হয়েও যায় যে কোনও একটি সরকার বঞ্চনা করছে তাতে নামমাত্র ভাতায় গ্রাসচ্ছাদন করতে বাধ্য হওয়া পার্শ্ব-শিক্ষকদের বিশেষ কোনও রকমফের হবার কথা নয়। তাঁরা যে তিমিরে সেই তিমিরেই থাকতে বাধ্য। কেন্দ্র ও রাজ্য এই রাজনৈতিক কুযুক্তিপূর্ণ বিষয়টিকে বাজারে ছেড়ে রাখে শুধুমাত্র নিজেদের হাত ধুয়ে ফেলার খাতিরে।
তবে আরেকটি কারণে এ মুহূর্তে পার্শ্ব-শিক্ষকদের এই অবস্থা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে যাচ্ছে। করোনাভাইরাস-অতিমারি সারা পৃথিবীর শিক্ষা-ব্যবসায়ীদের কাছে সুবর্ণ সুযোগ এনে দিয়েছে। ক্লাসরুম টিচিং-এর বিষয়টি যে ‘অপশনাল’ করে দেওয়া যায়, বা ক্লাসরুম টিচিং-এর ধারণা থেকে বেরিয়ে অন-লাইন টিচিং নামে এক ধ্যাস্টামোর জন্ম দেওয়া যায় সেটি পরীক্ষামূলকভাবে দেখে নেওয়া গেছে। বহু শহরে বেসরকারি স্কুলে শিক্ষকদের মাইনে কমিয়ে দেওয়া হয়েছে, বা তাদের চাকুরি থেকে বরখাস্ত করে দেওয়া হয়েছে। শিক্ষা ও স্বাস্থ্য থেকে সব বৃহৎ রাষ্ট্র-ব্যবস্থাই হাত তুলে নিতে প্রস্তুত। এ সময়ে পার্শ্ব-শিক্ষক ব্যবস্থা (আসলে যা অত্যন্ত কম ভাতা দিয়ে শিক্ষকতা করানোর নির্লজ্জ উদাহরণ) টিকিয়ে রাখাই তো স্বাভাবিক। সে ক্ষেত্রে জলজ্যান্ত উদাহরণ দিয়ে দেখিয়ে দেওয়া যাবে যে একই সিস্টেমে কত কম ভাতায় শিক্ষককে কাজ করাতে বাধ্য করা যায়।
আর সব শেষে যে নির্লজ্জ বাইনারির জন্ম নিয়েছে, ‘পার্শ্ব-শিক্ষকদের তো কেউ জোর করে নিয়োগ করেনি এবং নিয়োগের পূর্বে শর্ত দেওয়াই ছিল’ ইত্যাদি মার্কা বাইনারি— তার প্রেক্ষিতে একটাই কথা বলার। ছত্তিশগড় থেকে পশ্চিমবঙ্গ— সরকারি সম্পত্তি ধ্বংস থেকে শুরু করে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করবার অভিযোগ যাদের বিরুদ্ধে তাদের প্রতিও রাষ্ট্র সহানুভূতি দেখায়। মূলস্রোতে ফিরে আসার সুযোগ দিয়ে সম্মানজনক চাকুরি থেকে শুরু করে নানা প্যাকেজ দেওয়া হয়। তখন এই প্রশ্ন ওঠে না। কিন্তু পার্শ্ব-শিক্ষক কন্ট্র্যাকচুয়াল টিচার ভোকেশনাল স্ট্রিমের হাজার হাজার শিক্ষক-শিক্ষিকার ক্ষেত্রে চক্রব্যূহে প্রবেশের শর্তটিকেই একমাত্র শর্ত হিসাবে গণ্য করা হয়ে থাকে। এই অশ্লীলতা আসলে আমাদের চেতনার দৈন্য প্রকাশ করে।
উদয়ন পণ্ডিতদের মেরুদণ্ড ভেঙে দেবার কাজ চলছে বেশ মনোযোগ দিয়ে। নানা অছিলায় সে কাজ আরও দ্রুত পাশবিকতার সঙ্গে সম্পন্ন হবে। একদিন ভবিষ্যতের ছেলেমেয়েরা পড়বে এ বঙ্গে নীলচাষিদের মতো পার্শ্ব-শিক্ষকেরা ছিলেন। অবশ্য ততদিনে ইতিহাস শিক্ষার ধারাটিও হয়তো পালটে যেতে পারে।
এ তোমার পাপ, এ আমার পাপ। আসলে আমরা সবাই ‘পার্শ্ব’। স্থায়ী শিক্ষক পূর্ণ সময়ের শিক্ষক বলে আলাদা করে সিস্টেমের কাছে কিছুই নেই আর। জেনে রাখুন সবাইকে ধীরে ধীরে সিস্টেম ‘পার্শ্ব’ করে তুলছে ও তুলবে। কিছু শিক্ষক-শিক্ষিকাকে এই সিস্টেম কিছুটা বেতন বেশি দিচ্ছে, এইমাত্র। আর কিছু নয়। যে ঘাতক উদাসীনতা নিয়ে এই লড়াই ও হতভাগ্য পার্শ্ব-শিক্ষকদের দিকে আপনি-আমি তাকিয়ে আছি, একদিন এই উদাসীনতাই আমাদের উপরেও বর্ষিত হবে।
‘পার্শ্ব’ হওয়ার সামনে দাঁড়িয়ে অন্তত একবার চিৎকার করে উঠুন।