অনির্বাণ ভট্টাচার্য
গদ্যকার, কবি
১৬ জানুয়ারি। গত দেড় বছর যাবৎ ঘুমকাড়া কোভিড ১৯ এবং শেষমেশ সোনালি দিন। তথাকথিত সোনালি। কারণ একটাই, গণসচেতনতার বিকাশ সভ্য দেশগুলিতেই যেখানে দূরহস্ত সেখানে কাজের খোঁজে দিনরাত এক করা ভারতবর্ষের মতো দেশে সামাজিক দূরত্ববিধিতে অতিমারি ঠেকানো এক কোথায় অসম্ভব। তবু, তথাকথিত। কেন? সেকথায় পরে আসছি। শুরুতে ভ্যাক্সিনেশনের প্রথম দিনের একটা হিসেব দিয়ে দিই। দেশজুড়ে ১ লক্ষ ৯১ হাজার ১৯১ মানুষ ভ্যাক্সিনেটেড হয়েছেন। সিরাম ইনস্টিটিউট অফ ইন্ডিয়ার মতে, সবকটি রাজ্যেই কোভিশিল্ড সরবরাহ করা হয়েছে, বারোটি রাজ্যে দেওয়া হয়েছে ভারত বায়োটেকের কোভ্যাক্সিন। উপসর্গ? হ্যাঁ, এবার সেখানে আছি। সরকারি হিসেবে ৫১ জনের কিছুটা উপসর্গ দেখা দিয়েছে যাদের মধ্যে একজনের অবস্থা কিছুটা খারাপের দিকে যাওয়ায় হাসপাতালে ভর্তি করা হলেও তিনি এখনও অবধি স্থিতিশীল। খুব স্বাভাবিক, এই হিসেব আসলে জলের উপরিতল। ভেতরটা অর্থাৎ বাকি দিনগুলো আসল কথা বলবে।
মূল প্রসঙ্গে আসি। একটা সংখ্যা এখনও উপরের হিসেবে বলা হয়নি। ভ্যাক্সিনেটর। মোট ১৬৭৫৫। অর্থাৎ যাঁরা ভ্যাক্সিন দিচ্ছেন। দিল্লিতে এই ভ্যাক্সিনেটরদের এ এক অন্য গল্প। বেতন সমস্যা। প্রতিবাদ। সেই তথাকথিত সোনালি দিনের শুরুতেই। দিল্লি পুরসভার কর্মীরা ভ্যাক্সিনেশনের দিনই অসহযোগ আন্দোলন শুরু করেছেন। কনফেডারেশন অফ এমএসডি (মিউনিসিপ্যাল ওয়ার্কার্স অফ দিল্লি) এমপ্লয়িজ ইউনিয়নের মতে প্রায় ২২০০০ কর্মী ভ্যাক্সনিশনের শেডিউল পেলেও একজনও কাজে আসেননি। কেন? বেতন। হ্যাঁ, বিশ্বাস নাও করতে পারেন। ফ্রন্টলাইন কোভিড যোদ্ধাদের বেতন নেই। গত সাতই জানুয়ারি থেকে উত্তর এবং পূর্ব দিল্লি পুরসভার প্রায় ১ লাখ কর্মী ধর্মঘটে বসেছেন বকেয়া বেতনের দাবিতে। গত বছরের শেষ দিকের বেশ কিছু মাস থেকেই যা অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত। উত্তর দিল্লিতে বকেয়া পরিমাণ ছ মাস, পূর্ব দিল্লিতে যা তিন মাস। বলা বাহুল্য, নিম্নমধ্যবিত্ত ফ্রন্টলাইন কর্মীদের কাছে এক একটা মাস অনেকটাই। এই প্রসঙ্গে জেনে নিই কারা আছেন এই বয়কটে? নার্স, আশা অঙ্গনওয়ারি কর্মী, মহিলা হেলথ ভিজিটর, শিক্ষক, নিরাপত্তা রক্ষী, স্যানিটেশন কর্মী— এঁরা। একটা গোটা বছর যাঁদের পরিশ্রম এবং ঝুঁকি ছিল অমানবিক। দক্ষিণ দিল্লিতে কর্মীদের বেতনের সমস্যা না থাকলেও তাঁরাও আসছেন বয়কটে। ইন সলিডারিটি।
অদ্ভুৎ এক আয়রনি। এখানে চিকিৎসকদের বেতন কিন্তু বকেয়া নেই একদিনেরও। আর্থিক অবস্থা যাচাই করে দেখতে গেলে, মানবিকতার খাতিরে বলা যায়, সংস্থা থেকে নিচুতলার কর্মীদের বেতন মিটিয়ে তারপরই উপরতলার কর্মীদের কথা ভাবা উচিত। এখানে হয় না। চিকিৎসকদের কোনওরকম ছোট না করে, তাঁদের পরিশ্রম, মেধা, ঝুঁকি ইত্যাদিকে কোনওরকম প্রশ্ন না করেই বলছি, আর্থিক দিক থেকে তাঁরা কিন্তু একটু সুবিধেজনক জায়গায় আছেন। তাঁরা পারতেন একটা দুটো মাস কষ্ট স্বীকার করতে। সেবিকা বা আশাকর্মীরা সেই বিলাস দেখানোর জায়গায় নেই। অথচ তাঁদেরই টার্গেট সরকারের। সমস্ত উদাসীনতা, লাল ফিতের টার্গেট তাঁরাই।
প্রথম দিনের হিসেব অনুযায়ী দিল্লি সরকার থেকে মোট ৮৯টি স্বাস্থ্যকেন্দ্রকে ভ্যাক্সিনেশন কেন্দ্র হিসেবে ঠিক করা হয়েছে, যাদের মধ্যে ৩৬টি সরকার পরিচালিত। এই লক্ষ্যমাত্রা ধার্য করা হয়েছে ১০০০, অর্থাৎ ৮৯ থেকে বাড়িয়ে হাসপাতাল, স্কুল, ডিসপেনশারি মিলিয়ে সংখ্যাটা ১০০০-এ নিয়ে যাওয়া হবে। কোনও সন্দেহ নেই, সাধু উদ্যোগ। কিন্তু কারা দেবেন ভ্যাক্সিন? তাঁদের বেতন? পারিশ্রমিক? নেই…
কস্তুরবা হাসপাতালে বহুদিন ধরেই ধর্মঘটে বসা নিওনেটাল ইন্টেনসিভ কেয়ার ইউনিটের নার্সের অন্যতম সুনীতা মেহেন্দ্রুর বাড়িতে সাতজন সদস্য। শাশুড়ির বয়স ৮৫। এগারো বছর ধরে হাসপাতালকে সময় দেওয়া সুনীতা এই ঝুঁকি নিয়েই কাজ করছেন। আর পারছেন না। নগর নিগম শিক্ষক সংঘের বরিষ্ঠ সহ-সভাপতি বিভা সিং শিক্ষকদের অবস্থাটা জানালেন। গত বছরের জুলাই মাস থেকে তাঁদের অনেকেই বেতনহারা। তাঁদের অনেকেই স্কুলে খাওয়া ছেড়ে দিয়েছেন। মিল স্কিপ করছেন। সবজি এবং এমনকী জামাকাপড় বিক্রি করতে হচ্ছে এঁদের অনেককেই। দিল্লি পুরসভা বকেয়া টাকা বাকি রেখে, পেটে খিদে রেখে এই মানুষগুলোকে দিয়ে দেশ বাঁচাচ্ছেন।
এভাবে বাঁচবে দেশ?
তথ্যসূত্র – Theprint.in, Hindustantimes.com