Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

পদ্মের কুঁড়ি? নাকি বিভীষিকাময় নাৎসিস্বস্তিকা

শঙ্কর রায়

 



সাংবাদিক, প্রাবন্ধিক

 

 

 

একদা আমাদের কাছে, ন্যায়ের পূজারীদের কাছে এক অনিবার প্রেরণার মত জ্বলে উঠত সুকান্ত ভট্টাচার্যের দুটি পঙক্তি: ‘বন্ধু তোমার ছাড়ো উদ্বেগ সুতীক্ষ্ণ করো চিত্ত/ বাংলার মাটি দুর্জয় ঘাঁটি বুঝে নিক দুর্বৃত্ত।’ আজ সেই পঙক্তিদ্বয় যেন নিদারুণ পরিহাসে পর্যবসিত হয়েছে। সংসদীয় চত্বরে সবচেয়ে বড় বামপন্থী দল ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্ক্সবাদী) তথা সিপিআই (এম)-এর সদস্য-সমর্থকদের একটা বড় অংশ খোয়াব দেখছে: ‘একুশে রাম, ছাব্বিশে বাম’। দলের সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরি থেকে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সম্পাদক সূর্যকান্ত মিশ্র, মহম্মদ সেলিম থেকে সুজন চক্রবর্তী বারবার বলেছেন, বিজেপিকে হারাতে গেলে আগে সারা ভারত তৃণমূল কংগ্রেস (টিএমসি) সরকারকে (পড়ুন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়) ক্ষমতাচ্যুত করা দরকার। তাই ২০২১ সালে পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা নির্বাচনে আরএসএস-অধীন ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) যদি টিএমসিকে পরাস্ত করে সরকার গঠন করে, সিপিআই (এম) নেতারা খুশি হবেন। স্মরণ করিয়ে দিই, ২০১৯ সালে লোকসভা নির্বাচনে সিপিআই (এম) রাজ্যের ২৯৪টি বিধানসভা কেন্দ্রের একটিতেও প্রথম স্থানে ছিল না।

কলকাতার আশপাশের জেলা থেকে জীবিকার জন্য নিত্যযাত্রীদের (যেমন সাইকেল রিক্সাচালক, রাজমিস্ত্রি, গার্হস্থ্য কর্মী ইত্যাদি) যাদের সাথে কথা বলেছি, তাঁদের অনেকেই বলছেন এবার পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা নির্বাচনে গ্রামাঞ্চলে ঘাসফুল বনাম পদ্মফুলে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হবে। যাঁরা কিছুটা রাজনৈতিক ভাষায় কথা বলেন, তাঁদের কেউ কেউ বলছেন এবার বামফ্রন্ট-এর প্রার্থীদের লড়তে হবে জামানত বাঁচানোর জন্যে। আশঙ্কা করছেন কেউ কেউ যে এবার পদ্মফুল (আসলে যার নিচে লুক্কায়িত হিটলারের নাৎসি দলের স্বস্তিকা চিহ্ন) ফুটবে। গত লোকসভা নির্বাচনে (২০১৯) পদ্মফুলকে স্বাগত জ্ঞাপন করেছিলেন ভোটদাতাদের (যাঁরা ভোট দিয়েছিলেন ও যাঁদের ভোট বাতিল হয়নি) ৪০ শতাংশেরও বেশি। তাই ১৮টি আসনে জিতেছিল ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) এবং ২৯৪টি বিধানসভা আসনের মধ্যে এগিয়ে ছিল ১২১টি আসনে। ক্ষমতাসীন সারা ভারত তৃণমূল কংগ্রেসের (টিএমসি) ৪০ জন মন্ত্রীর মধ্যে ১৭ জনই নিজ নিজ বিধানসভা আসনে পিছিয়ে ছিলেন। তাই প্রশ্ন উঠছে, এবার বিধানসভা ভোটে কি বিজেপি সেই ১২১ আসনে এগিয়ে থাকাকে আরও এগিয়ে নিয়ে ১৪৭টির বেশি আসনে জিতে সরকার গঠন করতে পারবে? ঐ পার্টির সর্বভারতীয় সভাপতি জগৎ প্রকাশ নাড্ডা, রাজ্য সভাপতি ও সাংসদ দিলীপ ঘোষ এবং কেন্দ্রের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও প্রাক্তন সর্বভারতীয় সভাপতি অমিত অনিলচন্দ্র শাহ বুক চাপড়িয়ে বলছেন যে তাঁরা ২০০টির বেশি আসনে জিতবেন এবং টিএমসি দলটি উঠে যাবে।

সম্প্রতি নাড্ডা তৃণমূলকে কটাক্ষ করে বলেছেন ‘তৃণমূল ভয় পাচ্ছে। মমতাজি এত ভয় পাচ্ছেন কেন?’ কাটোয়ায় এদিন তিনি রাজ্যের কৃষকদের উদ্দেশ্য বলেছেন, ‘কৃষক আইনে কৃষকদের সুবিধা চায় কেন্দ্র। বাংলায় জমির অভাব নেই, সেচে কাজ তেমনভাবে হয় না। রাজ্যের মানুষ পরিবর্তন চাইছে। বিজেপিকে চাইছে। দুর্গা মা-র নামে শপথ, কৃষকদের নিয়ে পরিবর্তন আনবে বিজেপি। কৃষকদের বাজেট মোদি সরকার ৬ গুণ বাড়িয়েছে। রাজ্যে বিজেপি এলে আমরাই কেন্দ্রের কৃষক নিধি সম্মান চালু করব।’ তিনি ধরেই নিয়েছেন যে দিল্লির উপকণ্ঠে সিংঘু সীমান্তে ও আশেপাশে কেন্দ্রের সর্বনাশা তিন কৃষি আইনের বিরুদ্ধে যে লাগাতার ঐতিহাসিক প্রতিরোধ আন্দোলন চলছে, যাতে ৬০ জনেরও বেশি কৃষক শহীদত্ব বরণ করেছে, সে নিয়ে বাংলার মানুষ আদৌ ভাবছে না। আর তারা সোৎসাহে পদ্মফুল ফোটাবে নবান্ন ভবনে, মহাকরণে।

টিএমসি আবার জয়ী হওয়ার পরিবর্তে যদি টিএমসিকে হারিয়ে বিজেপি যেতে, তাহলে সিপিআই (এম) নেতারা ও তাঁদের অনুসারীরা খুশিই হবেন, কারণ গত লোকসভা ভোটের পরে তিনটি বিধানসভা উপনির্বাচনে বিজেপি ২০১৯এ বিপুল ব্যবধানে এগিয়ে থাকলেও একটি আসনও জিততে পারেনি, এমনকি রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষের ২০১৬ বিধানসভা ভোটে জেতা খড়্গপুর বিধানসভা আসনও না। অথচ বিজেপি নেতা মুকুল রায় পার্টির কেন্দ্রীয় নেতাদের আশ্বস্ত করেছিলেন যে বিজেপি তিনটি আসনেই জিতবে। তাই ‘জনগণেশের প্রচণ্ড কৌতুক’ কোন দলের মুখে হাসি ফোটায়, তা এখন থেকে বলা সহজ নয়।

গত লোকসভা ভোটের আগে টিএমসির সর্বেসর্বা ও মহানেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর স্বভাবজ উদ্ধত স্বরে বলেছিলেন টিএমসি এ রাজ্যে ৪২টির আসনের মধ্যে ৪২টিই জিতবে। বলা বাহুল্য, রাজ্যের ৪০ শতাংশ মানুষ সেই দর্প চূর্ণ করে দিয়েছিলেন। কিন্তু তাঁর ঔদ্ধত্য কমেনি। মানুষের কাছে নিজের ভুল স্বীকার করেননি, তাঁর স্বৈরতান্ত্রিক স্বভাবের জন্য। একথা ঠিক যে ২০১৯এ পদ্মফুলের ফুটে ওঠার অন্যতম কারণ ২০১৬ থেকে ২০১৯এ বামফ্রন্টের ভোট ২৬.৬ শতাংশ থেকে ৭.৫ শতাংশে নেমে যাওয়া এবং হয়ত তার প্রায় সবটাই বিজেপির পক্ষে যাওয়া… (হয়ত বলছি এজন্যে যে এর সপক্ষে কোনও সমীক্ষা হয়নি। এই প্রতিবেদকের মত, বামেদের শক্তপোক্ত ভোটব্যাঙ্ক বলে কিছু ছিল না, নেইও। নচেৎ ১৯৮০ থেকে ১৯৮৪ সালে লোকসভা নির্বাচনে কংগ্রেসের আসন পাঁচ থেকে ১৬য় বাড়ত না। শক্তপোক্ত ভোটব্যাঙ্ক থাকলে তা ইন্দিরা গান্ধির নিহত হওয়ার কারণে সাময়িকভাবেও ভাঙত না)। ইয়েচুরি অবশ্য কবুল করেছেন যে বামেদের ভোট ২০১৯ সালে বিজেপির দিকে পড়েছিল। কিন্তু এজন্যে রাজ্য নেতৃত্ব দায়ী এবং সেজন্যে রাজ্য নেতৃত্বর অপসারণ বা তাদের কারণ দর্শানোর কথা বলেননি, সে সংস্কৃতি নেই একে গোপালন ভবনের স্তালিনবাদী (হয়ত বেরিয়াপন্থী-ও) আমলাদের।

যাই হোক, আজ বাংলায় ফ্যাসিবাদী সরকার হলে এ রাজ্যে অভাবনীয়ভাবে গণতন্ত্রনিধন ও সীমাহীন সন্ত্রাস নেমে আসবে, যা ঘটছে ত্রিপুরায়, যা সিপিআই (এম)-এর পলিটব্যুরো সদস্য ও ত্রিপুরার প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী মানিক সরকার বুঝলেও বিমান বসু ও সূর্যকান্ত মিশ্র বুঝেও বুঝবেন না। মানিকবাবু কয়েক দিন আগে একটি বিবৃতি দিয়ে ত্রিপুরার বিজেপি সরকারের নিপীড়ন সম্পর্কে বলেছেন, পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূল কংগ্রেস সরকার বুলডোজার দিয়ে পার্টি অফিস ভাঙেনি। সে খবর এ রাজ্যের সিপিআই (এম)-এর প্রভাতী দৈনিক ‘গণশক্তি’ সেন্সর করেছে।

সিপিআই (এম-এল) লিবারেশন-এর সাধারণ সম্পাদক দীপঙ্কর ভট্টাচার্য বারবার বলেছেন, আমাদের প্রধান শত্রূ তৃণমূল কংগ্রেস নয়, আমদের প্রধান বিপদ ফ্যাসিবাদী আরএসএস ও বিজেপি, যা ইতিহাস আমাদের শিখিয়েছে। ভারত জুড়ে চলমান আন্দোলন, ভারত বন্ধ, ধর্মঘট ইত্যাদি নিয়ে তিনি অন্যভাবে ভাবতে বলেছেন: “এত অন্যায় কেন? এত অন্যায় এত অত্যাচার কেন? কৃষকেরা তো সেই অর্ডিন্যান্সের সময় থেকেই বলছেন, কিন্তু সরকার কান দেয়নি, সেই অর্ডিনান্সগুলোকেই বিল হিসেবে এনে তারপর জোর করে সেগুলি আইনে পরিণত করল। এখন যখন কৃষক রাস্তায় তখন ওরা ক্ষতির কথা বলছে। একটা সরকার কৃষকদের আটকাতে রাস্তা খুঁড়ল। ক্ষেতের মধ্যে দিয়ে ট্রাক্টর চালিয়ে এলেন কৃষকেরা। বিজেপি বলছে ওঁরা নাকি নকল কৃষক। আসল কৃষক কি তাহলে আদানি আর আম্বানি? বলছে কৃষকেরা কৃষি আইন বোঝে না। পাঞ্জাব হরিয়ানার সবুজ বিপ্লবের কৃষকেরা না বুঝলে কি হাফ প্যান্ট পরে আরএসএস হয়ে বুঝতে হবে? বলছে শুধু পাঞ্জাব। এখন দেখা যাচ্ছে সারা দেশের কৃষকেরা পথে।”

অনুজপ্রতিম দীপঙ্কর মানুষের কথা বলছেন। বাংলার মানুষ যদি শেষ অব্দি বিজেপিকে জেতান, তাহলে কি ধরে নিতে হবে, এ রাজ্যের মানুষ রাজনৈতিক চেতনাসম্পন্ন আর নেই? রাজনৈতিক চেতনার এই অবলুপ্তির জন্য কি তাহলে বামফ্রন্ট দায়ী?

ভাবছি টিএমসি-র অপশাসনের জন্য (একথা যেমন অনস্বীকার্য, আবার এও ঠিক এ আমলে জনস্বাস্থ্যব্যবস্থার উন্নতি উপলব্ধ হচ্ছে, দশ বছরে পুলিশ একবারও ‘ট্রিগার হ্যাপি’ হয়নি) যারা পদ্মফুলে ছাপ দেবেন, তাঁরা কি ভেবে দেখবেন না যে কেবল বিজেপি-শাসিত রাজ্যতেই ঐ দলের নেতা-কর্মীরা কাঠুয়াতে ধর্ষণে অভিযুক্তদের সপক্ষে মিছিল করেছে; বলাৎকার-অভিযুক্ত স্বামী চিন্ময়ানন্দকে ফুলের মালা পরিয়েছে, মুসলিম মেয়েদের কবর থেকে তুলে ধর্ষণের আহ্বান দিয়ে হাততালি কুড়িয়েছে, হাথরসে দলিত ধর্ষণে অভিযুক্তদের নির্দোষ প্রতিপন্ন করতে কোমর বেঁধে আসরে নেমেছে। পশ্চিমবঙ্গে ২০২১ সালে বিধানসভা নির্বাচনে এমন দল-মনোনীত প্রার্থীদের জিতিয়ে আনতে বিবেকে বাধবে না?