প্রবুদ্ধ বাগচী
প্রাবন্ধিক, সমাজভাবুক
তখন সিঙ্গাপুর শহরে আজাদ হিন্দ বাহিনীর সদর দফতর। নেতাজি সুভাষচন্দ্র রয়েছেন সেখানেই। বাহিনীর জন্য আর্থিক সাহায্য দরকার। শহরের অন্যতম ধনী ব্যবসায়ী ব্রিজলাল জয়সওয়ালকে ডেকে পাঠালেন নেতাজি। ব্রিজলালজি নেতাজির গুণমুগ্ধ ভক্ত, তিনি রাজি হলেন আর্থিক অনুদানে। কিন্তু তাঁর শর্ত হল, তিনি নিজে নয়, এই অর্থ সাহায্য করা হবে স্থানীয় চেট্টিয়ার মন্দিরের ট্রাস্টের তরফে আর সেই অনুদান নিতে স্বয়ং সর্বাধিনায়ককে হাজির হতে হবে সেখানে। মন্দিরের পক্ষে তারা সম্বর্ধনা দেবেন নেতাজিকে আর তার পরেই হবে অর্থপ্রদান। ব্রিজলালের একান্ত অনুরোধ, নেতাজি যেন এই প্রস্তাব না ফেরান। এর পরে তাঁকে নেতাজি দুটো কথা বলেছিলেন। প্রথমত, বাহিনীর প্রধান হিসেবে সামরিক পোশাকে তিনি কোনও মন্দিরে যেতে অপারগ। কারণ আজাদ হিন্দ বাহিনী কোনও বিশেষ ধর্মের অনুগত হতে পারে না। আর দ্বিতীয় বক্তব্য ছিল, মন্দিরে যদি যেতেই হয় তবে সাধারণ পোশাকে তিনি তার সহকর্মীদের নিয়েই যাবেন। ব্রিজলাল পড়লেন বিপদে। কারণ, নেতাজির সহকর্মীদের মধ্যে রয়েছে মুসলিম, শিখ ও খ্রিস্টধর্মের মানুষ— অথচ চেট্টিয়ার মন্দিরের এলাকায় কোনও অহিন্দু প্রবেশ নিষিদ্ধ। তিনি বললেন, এ কী করে সম্ভব! মন্দিরে তো ভিন্নধর্মের মানুষদের ঢুকতে দেওয়া হয় না! কিন্তু নেতাজি তার বক্তব্যে অবিচল, প্রয়োজন হলে তিনি আর্থিক সাহায্য প্রত্যাখ্যান করতেও পিছপা নন। এই কাহিনির উপসংহার বড় আশ্চর্য। শেষ পর্যন্ত মন্দির কমিটি তাদের মত বদলালেন, সপার্ষদ নেতাজি গেলেন সেই মন্দিরে, আড়ম্বরপূর্ণ এক অনুষ্ঠানে তাঁরা তাঁদের সাহায্য তুলে দিলেন আজাদ হিন্দ বাহিনীর হাতে। ব্রিজলাল-এর অপূর্ব সুন্দরী কন্যা সুভদ্রা নিজে হাতে আপ্যায়ন করলেন অতিথিদের— পরবর্তী জীবনে এই সুভদ্রা যোগ দেবেন আজাদ হিন্দ ফৌজের ঝাঁসি ব্রিগেডে। রেঙ্গুন থেকে নেতাজির চলে যাওয়ার আগে অবধি তার সঙ্গে ছিলেন ঝাঁসি ব্রিগেডের চল্লিশজনের একটি দল, সেই দলে ছিলেন ল্যান্সনায়ক সুভদ্রা জয়সওয়াল ওরফে ভাবিজি।
এই কাহিনির কথা মনে পড়ল, তাঁর একশো পঁচিশতম জন্মবার্ষিকীর দিকে তাকিয়ে যতটা নয়, তার থেকে অনেক বেশি আমাদের এই সময়ে চারপাশের দিকে তাকিয়ে। নেতাজির অভীষ্ট স্বাধীন ভারতের চুয়াত্তর বছরে দেশের প্রধানমন্ত্রী যখন রীতিমতন সরকারি সফরে সাঙ্গপাঙ্গ নিয়ে চলে গেলেন প্রাচীন মসজিদ ভেঙে তৈরি হতে যাওয়া একটি আপাদমস্তক হিন্দু মন্দিরের শিলান্যাসে। সত্যি মিথ্যে জানি না, সোশ্যাল মিডিয়ায় একটি পোস্টে দেখছি মন্দির বানানেওয়ালারা নাকি দেশের রাষ্ট্রপতির কাছে মন্দির তৈরির জন্য চাঁদা চাইতে গিয়েছিলেন— এখনও খাতায় কলমে ধর্মনিরপেক্ষ দেশের প্রথম নাগরিক তথা দেশের সেনাবাহিনীর প্রধান নাকি তাদের পাঁচ লক্ষ টাকার চেক লিখে দিয়েছেন। অবশ্য কেউ কেউ ঠোঁটকাটার মতো বলতেই পারেন, যারা ‘মন্দির ওহি বানায়েঙ্গে’ বলে গোল বাধিয়েছিলেন তারাই তো এমন এক আইন বানিয়েছেন যার ফলে দেশের যুগ যুগ ধরে বাস করা মুসলমানরা হঠাৎ বেনাগরিক হয়ে পড়েছেন। তাঁদের আবার নতুন করে নিজেদের নাগরিকত্ব প্রমাণের জন্য কাগজপত্র হাতড়ে বেড়াতে হবে নচেৎ তাদের ডিটেনশন ক্যাম্পের আড়ালে বন্দি করা হবে। কোনও এক বৃদ্ধ তাঁর বাড়ির ফ্রিজে কীসের মাংস রেখেছিলেন সেই অপরাধে তাঁকে বেঘোরে প্রাণ দিতে হয়েছে। মনে পড়ে গেল, ‘ভালো মৌলবাদী’ অটলবিহারীর আমলে গ্রাহাম স্টুয়ার্ট স্টেইন্স নামের এক নিরীহ যাজককে তার দুই শিশুপুত্র সমেত জ্যান্ত পুড়িয়ে মারা হয়েছিল। যারা মেরেছিল এখন তাদের জমানা। এখন রাজ্যে রাজ্যে আইন করে ‘লাভ জিহাদ’ বিরোধী কর্মসূচি চলছে, ভিনধর্মের ছেলে-মেয়ে নিজেরা পছন্দ করে বিবাহ করলে রাষ্ট্র তাদের ঝাড়েবংশে উচ্ছেদ করবে। সুভাষচন্দ্র বসুও তো ভিনধর্মের মহিলার সঙ্গে বিবাহসূত্রে আবদ্ধ হয়েছিলেন, তিনিও কি লাভ জিহাদি?
আসলে মুশকিল হল, যারা দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের দীর্ঘ লড়াইয়ে একছটাকও অংশ নেননি তারাই আজ মুখে দেশপ্রেমের বাণী আউরাচ্ছেন। আরএসএস বাহিনীর মতটাই হল, মুসলিম শাসকদের হাত থেকে যে মুহূর্তে দেশে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি, পরে সরাসরি ব্রিটিশ রাজশক্তি, ভারতের শাসনভার দখল নিল সেই হল নাকি ভারতের স্বাধীনতালাভ। কারণ, মুসলিম শাসকরা নাকি বাইরে থেকে এসেছিলেন, তারা নাকি ভারতের ধর্ম ও সংস্কৃতিকে নষ্ট করেছেন— যদিও ব্রিটিশরা নাকি ‘বহিরাগত’ দোষে দোষী নয় এতটুকু। তাই সাভারকার থেকে গোলওয়ালকারের অনুচররা চিরকাল ব্রিটিশদের প্রতি অপার প্রভুভক্তি দেখিয়ে এসেছেন, স্বাধীনতাকামী দেশের নেতারা তাদের চোখে ছিল ঘৃণ্য। অন্যদিকে নেতাজি আমৃত্যু মনে করেছেন তাঁর প্রধান শত্রু ব্রিটিশ। আজাদ হিন্দ বাহিনীর একমাত্র উদ্দেশ্য স্বাধীন ভারত। বিশ্বযুদ্ধের শেষপর্বে যখন জাপান আত্মসমর্পণ করেছে, আজাদ হিন্দ বাহিনীও প্রায় বিধ্বস্ত, তখন বাহিনীর উচ্চস্তরের কয়েকজন নেতাজিকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, এবার তাঁরা কী করবেন? তিনি জবাব দিয়েছিলেন, যুদ্ধে তাদের পরাজয় হলেও আজাদ হিন্দের লড়াই ভারতের স্বাধীনতাকে অন্তত কুড়ি বছর এগিয়ে দিয়েছে। তিনি তাঁর বাহিনীর সর্বোচ্চ সেনানীদের নির্দেশ দিয়েছিলেন, আত্মসমর্পণ করার পর কোর্ট মার্শালে যদি তোমাদের ফায়ারিং স্কোয়াডের সামনেও দাঁড়াতে হয় তাও তোমাদের সেই সুযোগ নিতে হবে, কারণ বিচারের সময় তোমরা তোমাদের কথা বলার সুযোগ পাবে। তোমাদের মতো বীর সেনানীদের কথা দেশের মানুষের সামনে প্রচারিত হলে দেশজোড়া আলোড়ন উঠবে, তখন ব্রিটিশ আর তাদের সাম্রাজ্য রক্ষা করতে পারবে না। ঘটনা তো ঘটেছিল সেইরকমই। লালকেল্লায় আজাদ হিন্দ সেনানীদের বিচারপর্বে সারাদেশে সম্প্রদায়নির্বিশেষে মানুষ উত্তাল হয়ে উঠেছিলেন— ১৯৪৫এর শেষ দিক থেকে ১৯৪৬এর ফেব্রুয়ারি মাস অবধি সারা দেশ যে অভূতপূর্ব জনজাগরণ দেখেছিল ইতিহাসের পাতায় তা সোনার অক্ষরে লেখা আছে। বরং এটাই মনে করে দেখার সেই উদ্দীপিত ধর্মনিরপেক্ষ লড়াইয়ের অল্প পরেই কীভাবে ভেদবুদ্ধিকে প্রশ্রয় দিয়ে ঘটানো হল ছেচল্লিশের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা— তার নেপথ্য নায়ক ছিল শাসক ব্রিটিশ রাজশক্তি ও তার দোসর হিন্দু-মুসলমান সাম্প্রদায়িক দল আর তাদের আশ্রিত দুষ্কৃতীরা। কেউ কেউ তখন ফন্দি আঁটছিলেন কীভাবে মহাত্মাজিকে গুলি করে নিকেশ করা যায়।
আসলে ইতিহাস বা দেশপ্রেমের সংজ্ঞা এই উগ্র মৌলবাদীদের কাছে সবসময়েই ভিন্নরকম। আর সেই বিকৃত আদল যে কতদূর পর্যন্ত বিধবংসী হতে পারে তার অজস্র উদাহরণ রয়েছে আজ আমাদের হাতের কাছেই। নির্বাচনে হাওয়া ঘোরানোর জন্য দেশপ্রেমের জিগির তোলা, প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে বিরোধ জিইয়ে রেখে তাদের সঙ্গে ছায়াযুদ্ধ চালানো— এই সবই নাকি দেশপ্রেম। আর অন্যদিকে দেশের রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলিকে দেদার বিক্রি করে দেওয়া, ঋণখেলাপী শিল্পপতিদের লুঠতরাজের প্রতি সরকারি সদয় প্রশ্রয় আর বৃহৎ কর্পোরেট পুঁজির স্বার্থে দেশের অর্থনৈতিক নীতির পালে হাওয়া লাগানো হল দেশসেবা। অথচ এইসবের বিরুদ্ধে যারা বলবেন, যারা হিসেব নিকেশ করে দেখাবেন কীভাবে দেশের আর্থিক স্বয়ম্ভরতা, এর ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, বলবেন দেশের সাধারণ মানুষ কীভাবে এইসব নীতির শিকার হয়ে দুর্দশায় পড়েছেন তাদের বলা হবে দেশদ্রোহী— কারণ তাঁরা সরকারি নীতির বিরোধিতা করেছেন। মনে পড়ে, কংগ্রেসের সভাপতি থাকাকালীন সুভাষচন্দ্র পরিকল্পনা কমিশনের কথা বলেছিলেন এবং তা তৈরি করেছিলেন। তিনি মনে করতেন স্বাধীন ভারতের সার্বিক উন্নয়নের প্রশ্নে এই ধরনের কমিশন সাহায্য করবে, সেই রীতি মেনে নেহেরু আমলেও প্ল্যানিং কমিশন চালু ছিল। ২০১৪ সালে বদলের সরকার এসে সেটিকে তুলে দেন, কী কারণে এই বদল বোঝা যায়নি। নেতাজির প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য বুঝি?
আসা যাক, গণতান্ত্রিক রীতিনীতির প্রশ্নে। আজাদ হিন্দ বাহিনীতে সুভাষচন্দ্রের ব্যক্তিগত স্টেনোগ্রাফার কেরলবাসী ভাস্করন লিখছেন সামরিক বাহিনীর শৃঙ্খলা সত্ত্বেও কীভাবে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণের সময় সবাইকে একসঙ্গে ঘরে ডেকে নিয়ে গভীর আলোচনায় বিশ্বাসী ছিলেন তিনি। কোনও কোনও সময় এমন হয়েছে বাকি সদস্যরা একযোগে সুভাষচন্দ্রের মতামত মেনে নিয়েছেন বা সকলেই বলেছেন, তাদের নেতা যা বলবেন তাই তাঁরা শর্তহীন ভাবে পালন করবেন। কিন্তু যুদ্ধের কঠোর নিয়মানুগত্য স্বীকার করে নিয়েও খোলা মনে সুভাষচন্দ্র বলেছেন সকলের মতই তাঁর কাছে সমান গুরুত্বপূর্ণ, প্রত্যেকের মতেরই সমান সম্মান। এমনকি যে নেহেরু বা গান্ধিজির সঙ্গে তাঁর রাজনৈতিক বিরোধ ঘটেছিল, নিজের গড়ে তোলা আজাদ হিন্দ বাহিনীতে তাঁদের নামেও সেনা ব্রিগেডের নামকরণ করতে তাঁর কোনও অসুবিধে হয়নি— বিরুদ্ধ মতের প্রতি তাঁর এতটাই ছিল শ্রদ্ধা আর সৌজন্য। আর আজকের ভারতবর্ষে দেখতে পাচ্ছি তার এক বিপরীত ছবি। সংসদ ভবনে আভূমি প্রণত হয়ে যিনি শপথ নিলেন তার হাতেই গণতন্ত্রের সর্বাধিক অবমাননা। সংসদে বিরোধী দলের ভূমিকা তাদের কাছে গৌণ, প্রশ্নোত্তরপর্ব ক্রমশ খর্বিত। সারা দেশেই বিপক্ষ মতপ্রকাশের পরিসর ক্রমশ ছোট ও ক্ষীণ হয়ে এসেছে গত কয়েক বছরে। যে কোনও সরকারি সিদ্ধান্ত বা নীতির সমালোচনা করলেই তাদের উপর নেমে আসছে নজিরবিহীন প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক আক্রমণ। পথে নেমে যারা প্রতিবাদ করছেন তাদের উদ্দেশে অশ্লীলভাবে ছুড়ে দেওয়া হচ্ছে ‘গোলি মারা’র হুমকি— যেন দেশে আইনকানুন, বিচারব্যবস্থা সবকিছুরই পঞ্চত্বপ্রাপ্তি ঘটেছে। একইভাবে সংসদে কোনও আলোচনার অবকাশ না রেখে পাশ করা হচ্ছে একের পর এক জনবিরোধী বিল, রাতারাতি তা পরিণত হচ্ছে আইনে। এরই মধ্যে একজন খাঁটি দেশপ্রেমিক আর প্রখর গণতান্ত্রিক চেতনাসম্পন্ন ভারতসন্তানের একশো পঁচিশ বছরের জন্মদিন এসে পড়ল। ইদানিং দেশপ্রেমের বদলে একে নাম দেওয়া হচ্ছে পরাক্রম দিবস যার ব্যঞ্জনায় রয়েছে একটি আগ্রাসী ইঙ্গিত, দখলদারি মনোভঙ্গিমা, গা জোয়ারির ইশারা।
দেশপ্রেম কথাটা উচ্চারন করতে কি তাদের বিবেকে লাগছে? আবারও মনে পড়ে গেল আজাদ হিন্দের লড়াইয়ের আরেকটি কাহিনি। ব্রিটিশ বাহিনীর কাছে জাপানের আত্মসমর্পণের পর তখন যুদ্ধ প্রায় শেষের পথে। আজাদ হিন্দ বাহিনীর মনোবল কিছুটা ভেঙে পড়েছে। সামরিক বাহিনীর কর্তারা সুভাষচন্দ্রকে প্রশ্ন করলেন, তাদের কী কর্তব্য? তিনি বললেন, আমরা জাপানের কাছ থেকে সামরিক সাহায্য নিয়েছিলাম ঠিকই, কিন্তু জাপানের পরাজয়ে আমাদের যুদ্ধ শেষ হল না— ব্রিটিশের বিরুদ্ধে আমাদের যুদ্ধ জারি থাকবে কারণ আজাদ হিন্দ ফৌজ ভারতের স্বাধীনতা আনবার জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। শুরু হল বাহিনীকে সুবিধেজনক জায়গায় সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার পালা। চারদিকে যুদ্ধবিধ্বস্ত বার্মাদেশ, তখনও চলছে একটানা বিমানহানা, বোমা-গুলিবর্ষণ। তারই মধ্যে সীমিত যুদ্ধসরঞ্জাম, রসদ নিয়ে পথ চলছেন আজাদ হিন্দ সেনানীরা, সঙ্গে তাদের অকুতোভয় সর্বাধিনায়ক। কখনও শত্রুপক্ষের মেশিনগান থেকে গুলিবর্ষণের মধ্যে দিয়েই প্রাণ হাতে করে এগিয়ে যেতে হচ্ছে জঙ্গল, পাহাড় বা পরিত্যক্ত গ্রাম পেরিয়ে। দিনের বেলায় রাস্তায় বেরোলে শত্রু শিবিরের নজরে পড়ার আশঙ্কা তাই কখনও সারা রাত হেঁটে ভোরের দিকে আবার খুঁজে নিতে হচ্ছে নিরাপদ আশ্রয়। সব জায়গায় সমান সুবিধা নেই, তাই কোথাও নেতাজি আর সবার সঙ্গেই ঘুমিয়ে পড়ছেন খোলা আকাশের তলায় অথবা দড়ির খাটিয়ায়। খাবার ঠিকমতো জুটছে না সকলের। সেই সময়ের এক সেনানী তার স্মৃতিচারণে লিখছেন একদিনের কথা। সেদিন সন্ধ্যায় যেখানে পৌঁছানো গেল সেখানে রাতের খাবারের উপকরণ প্রায় কিছুই নেই। তিনশো সৈনিকের জন্য বরাদ্দ হল শুধু ভাত, অল্প কিছুটা নুন আর পেঁয়াজ, খাবার জল আনা হল স্থানীয় একটা নদী থেকে। সকলের সঙ্গে মাটিতে বসে সেই দিয়েই রাতের খাবার সারলেন নেতাজি। দেশপ্রেম। আরেকদিন সন্ধ্যায় যে পরিত্যক্ত গ্রামে এসে পৌঁছালেন তাঁরা সেখানে রয়েছে একটা অস্থায়ী চিকিৎসা শিবির, আহত সেনানীদের পরিচর্যা করছেন এক চিকিৎসক। সারা দিনের পথশ্রমে সকলেই ক্লান্ত ক্ষুধার্ত অথচ রসদ বাড়ন্ত। একটি সবুজ ক্ষেতের পাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে আছেন সবাই। ক্ষেতে ফলে আছে সবুজ ছোলা। উপায়ান্তর না দেখে স্থানীয় এক গ্রামবাসী সেই ছোলার খেত থেকে ঝুড়ি করে তুলে আনলেন কাঁচা ছোলা। সেই রাত্রে কাঁচা ছোলা খেয়েই সকলের পেট ভরাতে হল, সুভাষচন্দ্রও তার ব্যতিক্রম ছিলেন না। দেশপ্রেম। আত্মত্যাগ। কর্তব্যনিষ্ঠা। দায়বদ্ধতা। যারা দশ লাখ টাকার সুট পরেন, দু লাখ টাকার চশমা চোখে দেন আর ন হাজার কোটি টাকার বিমানে চাপেন তারা দেশপ্রেম অথবা আত্মত্যাগের কী বুঝবেন?
*নেতাজি বিষয়ক উল্লিখিত তথ্যগুলি পাওয়া যাবে নারায়ণ সান্যাল সঙ্কলিত ‘আমি নেতাজিকে দেখেছি’ (দে’জ প্রকাশনা) গ্রন্থে