Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

বাংলার মানুষকে দ্রুত শিক্ষা নিতে হবে

তৃষ্ণিকা ভৌমিক

 





শিক্ষক, সমাজকর্মী

 

 

ভারতবর্ষের অন্যতম প্রগতিশীল রাজ্য হওয়া সত্ত্বেও নারীবিদ্বেষমূলক মন্তব্য কিংবা স্লাট শেমিং-এর সংস্কৃতি বাংলার সামাজিক এবং রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে নতুন কিছু নয়। তথাকথিত প্রগতিশীল এবং বামপন্থী রাজনীতির পরিসরেও এ খুব পরিচিত বিষয়। বাংলার বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে তার রাজনৈতিক উত্থানের শুরুর সময় থেকেই তৎকালীন শাসকদল এবং তাদের সমর্থকদের এক বিপুল অংশের কাছে স্লাট শেমিং-এর শিকার হতে হয়েছে। এবং আজ যখন তিনি নির্বাচিত মুখ্যমন্ত্রী, এখনও তার রাজনৈতিক বা প্রশাসনিক পদক্ষেপের সমালোচনা করতে গিয়ে দিকভ্রষ্ট হয়ে একইভাবে নারী-বিদ্বেষী মন্তব্যের ফোয়ারা ছোটে। তিনি লিঙ্গ পরিচয়ে একজন ‘নারী’ বলেই এই ধরনের নোংরা মন্তব্য ধেয়ে আসে। গুজরাত দাঙ্গার নায়ক ভারতবর্ষের বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর সমালোচনা করতে গিয়ে কেউই এধরনের ভাষার ব্যবহার করেন না।  আবার মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিজে এবং তাদের দলের কর্মী-সমর্থকরাও বিভিন্ন সময়ে নারীবিদ্বেষী মন্তব্য করেছেন অবলীলায়। সুজেট জর্ডনের গণধর্ষণের পরবর্তীকালে অকারণ অন্যায়ভাবে ভিক্টিম-ব্লেমিং এর অধ্যায়ও ভুলে গেলে চলবে না।

কয়েকদিন আগেই বর্তমান বাংলার রাজনৈতিক বাতাবরণ নিয়ে টক শোতে নিজেদের মতামত প্রকাশ করবার পরে অভিনেত্রী সায়নী ঘোষ এবং দেবলীনা দত্তকে নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়া থেকে পাড়ার চায়ের ঠেকে খাপ বসেছে। স্লাট শেমিং এবং গণধর্ষণের হুমকি উপচে পড়ছে। এই ভয়ানক নিন্দনীয় ঘটনা নিয়ে আলোচনায় যাওয়ার আগে, উপরোক্ত অতীত প্রেক্ষাপট ঝালিয়ে নেওয়া বিশেষভাবে প্রয়োজন ছিল। বর্তমান পরিস্থিতি নিঃসন্দেহে অতীতের থেকে অনেক বেশি সঙ্কটজনক এবং এক ভয়ানক আগামীর আভাস দিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু সাথে এটাও মাথায় রাখতে হবে যে, আজ যেই সামাজিক-রাজনৈতিক পরিমণ্ডল আমরা প্রত্যক্ষ করছি তার বীজ বহুদিন ধরে এই প্রগতিশীল বাংলায় সযত্নে লালিত হয়েছে, হঠাৎ করে উত্তর ভারত থেকে ঘুরতে আসেনি। পিতৃতান্ত্রিক মানসিকতার সাথে যুক্ত হয়েছে মনুবাদী, ব্রাহ্মণ্যবাদী, সংবিধান-বিরোধী এবং সর্বোপরি ভারতীয় সংস্কৃতি-বিরোধী দৃষ্টিকোণ যা নিঃসন্দেহে অনেক অনেকগুণ বেশি ভয়ঙ্কর এবং বলিষ্ঠ প্রতিবাদ এবং প্রতিরোধের দাবী রাখে।

বাংলা দখল এবং বাংলার গেরুয়াকরণ করবার জন্য আরএসএস, বিজেপির মত ফ্যাসিবাদী শক্তি সর্বশক্তি দিয়ে ময়দানে হাজির এই মুহূর্তে। কেন্দ্রীয় সরকারে থেকে ইতিমধ্যেই তারা ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রান্তজুড়ে ভারতীয় বৈচিত্র্যময় সংস্কৃতি এবং তার মধ্যে নিহিত ঐক্যের সুরকে দুমড়ে মুচড়ে এক উগ্রহিন্দুত্ববাদী একরৈখিক সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠা করতে উদ্যত। বিগত বছরগুলিতে সারা ভারতবর্ষ সাক্ষী থেকেছে কীভাবে তারা শ্রমিক, কৃষক, দলিত, মুসলিম, নারী, তৃতীয় লিঙ্গের মানুষসহ সমাজের সকল প্রান্তিকায়িত মানুষের উপর আক্রমণ, অত্যাচার এক স্বাভাবিক বিষয়ে পরিণত করেছে এবং এই ক্রমবর্ধমান হিংসাকে সমর্থন জুগিয়ে চলেছে। এমতাবস্থায় তাদের লক্ষ্য যখন বাংলা, তখন বাংলার দীর্ঘদিনের ঐতিহ্যমণ্ডিত ইতিহাস, সংস্কৃতি এবং গণ আন্দোলনের পরিসরের উপর পর্যায়ক্রমিক আক্রমণ একদমই প্রত্যাশিত। হাজার একটা ত্রুটিবিচ্যুতি থাকলেও বাংলার সমাজজীবন এবং রাজনৈতিক পরিমণ্ডল যে ভারতবর্ষের অধিকাংশ রাজ্যের থেকে অনেক বেশি প্রগতিশীল তা অস্বীকার করবার উপায় নেই। বাংলার শাসনক্ষমতা দখলের জন্য অনেকদিন ধরেই বাংলার সামাজিক পরিমণ্ডলকে বিষিয়ে দিয়ে হিংসার বীজ বপন করে চলেছে ফ্যাসিবাদী শক্তি আরএসএস, বিজেপি। অভিনেত্রী সায়নী এবং দেবলীনার দিকে ধেয়ে আসা গণধর্ষণের হুমকি তারই প্রতিফলন মাত্র।

শুধু সায়নী বা দেবলীনাই কেন? দুটো টক শোতেই আরও বক্তা হাজির ছিলেন। তাদেরকে কমবেশি একই মতামত প্রকাশের জন্য সামাজিক মাধ্যমে স্লাট শেমিং কিংবা গণধর্ষণের হুমকির মুখোমুখি হতে হচ্ছে না। কারণ অবশ্যই লিঙ্গ পরিচয়ে ‘নারী’ হওয়া। আরএসএস, বিজেপির নারীবিদ্বেষী অবস্থান নিয়ে কারও কোনও সংশয় থাকা উচিত নয়। রূপ কানোয়ারকে জীবন্ত জ্বালিয়ে দেওয়া থেকে হাথরাসের দলিত কিশোরীকে গণধর্ষণের পর জ্বালিয়ে দেওয়ার মাঝের লম্বা ইতিহাস এদের মনুবাদী-পিতৃতান্ত্রিক মনোভাবের দলিল। আরএসএস বিজেপির পোস্টার বয় আদিত্যনাথ প্রকাশ্যে একাধিকবার বলেছেন যে, মেয়েদের স্বাধীনতার প্রয়োজন নেই। মুসলিম নারীদের কবর থেকে তুলে ধর্ষণ করবার হুমকি নিশ্চয়ই ভুলে যাইনি আমরা। এদের বিরুদ্ধে একটা টক শোতে এসে কোনও মেয়ে যদি বলিষ্ঠ মতামত রাখে, তাহলে কী করে সহ্য করে নেবে। কে না জানে মেয়েদের যোনিতে তাদের নিজেদের, পরিবারের, পাড়ার, সম্প্রদায়ের, জাতির সম্মান রাখা থাকে। ‘চরিত্র’ মেয়েদের জীবনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ। তাই তাদের চুপ করিয়ে দিতে চরিত্রহননের চেয়ে ভালো অস্ত্র আর কী হতে পারে। তাতেও চুপ না হলে ধর্ষণ। পিতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় এই ধর্ষকামী মানসিকতা বরাবরই বিদ্যমান থেকেছে। বিজেপি বা আরএসএসের প্রত্যক্ষ প্রশয়ে সেগুলো আজ ঝুলি থেকে খুব সহজে নির্ভয়ে বেরিয়ে পড়ছে। এই দল বাংলার শাসনক্ষমতা দখল করলে আজ যা শুধু হুমকি বা উস্কানিতে এবং সোশ্যাল মিডিয়ায় সীমাবদ্ধ, তা বাস্তব রূপ নিতে বেশি সময় লাগবে না। সংবিধান-স্বীকৃত মতপ্রকাশের অধিকার, বাকস্বাধীনতা আরএসএস-বিজেপির ফ্যাসিবাদী, স্বৈরচারী মতাদর্শের পরিপন্থী। তাই দেবলীনা বা সায়নীর উপর এই আক্রমণ। যা শুধু নারীবিদ্বেষী বা পিতৃতান্ত্রিক নয়, ভারতবর্ষের সংবিধান-স্বীকৃত অধিকারগুলোর উপরেও আক্রমণ। দেবলীনার যে বক্তব্যকে কেন্দ্র করে এই আক্রমণ তা আসলে পছন্দমত খাদ্যাভাসের উপর এবং পছন্দমত জীবনসঙ্গী বেছে নেওয়ার অধিকারের উপর নেমে আসা আক্রমণ। সায়নী ঘোষ তার বক্তব্যে বিজেপি সৃষ্ট উগ্র এবং হিংসাত্মক রাজনৈতিক পরিমণ্ডলের সমালোচনা করলে তার বিরুদ্ধে আক্রমণ আসে সোশ্যাল মিডিয়ায়। বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্রে গণতান্ত্রিকভাবে নিজের রাজনৈতিক অবস্থান প্রকাশ করলে শুধু সায়নী বা দেবলীনা নয়, দেশজুড়ে বিভিন্ন মানুষকে আক্রমণের শিকার হতে হচ্ছে কিংবা বরাদ্দ হচ্ছে অনির্দিষ্টকালীন জেলহেফাজত। বাংলায় এখনও বিজেপি ক্ষমতায় আসেনি। তাতেই যে পরিমাণ আগ্রাসী মনোভাব প্রতিফলিত হচ্ছে, ক্ষমতায় একবার আসতে পারলে এরা যে বাংলার সমস্ত প্রগতিশীল সামাজিক-রাজনৈতিক পরিমণ্ডলকে ধবংস করে ফেলবে তা বলার অপেক্ষা রাখে না।

উত্তরপ্রদেশসহ বিভিন্ন বিজেপিশাসিত রাজ্যের করুণ গণতান্ত্রিক অবস্থান থেকে যদি বাংলার মানুষ শিক্ষা না নেয় তাহলে ঠেকে শেখার ফলাফল মারাত্মক হবে। আজ যারা চুপচাপ আছেন নিজে নিরাপদ ভেবে কিম্বা সায়নী বা দেবলীনার সাথে একমত নন বলে ওদের উপর নেমে আসা আক্রমণ যাদের স্পর্শ করছে না, ভাবিয়ে তুলছে না তারাও বিজেপির এই ফ্যাসিবাদী আগ্রাসন থেকে রেহাই পাবে না। তাই এখনও সময় আছে নিজেকে এবং বাংলাকে এই আগ্রাসী হিংসার রাজনীতি থেকে নিরাপদ রাখার। নইলে অচিরেই বাংলার বাড়িগুলোর রান্নাঘর, ঠাকুরঘর থেকে স্কুল-কলেজ-বাজার রাজপথ, পোশাক, প্রেম, বিয়ে সব কিছু আরএসএস বিজেপির দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হবে। এবং তা উপেক্ষা করবার কোনও সুযোগ থাকবে না। তাই শুধুমাত্র আগামী নির্বাচনে ভোটবাক্সের লড়াই নয়, এই ফ্যাসিবাদী শক্তির বিরুদ্ধে দীর্ঘমেয়াদি সামাজিক, রাজনৈতিক লড়াই আন্দোলন গড়ে তোলার মাধ্যমেই এদের রুখে দেওয়া সম্ভব এবং প্রয়োজনও। নইলে অনেক অনেক মানুষের লড়াই করে পাওয়া সমস্ত অধিকার এবং আত্মত্যাগ তো বৃথা যাবেই, সাথে আগামী প্রজন্মকে এক অন্ধকারময় ভবিষ্যৎ ছাড়া কিছুই দেওয়ার থাকবে না।