শুভার্থ মুখার্জ্জী
ছাত্র, ছাত্র রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত
বারবারই বলছি বিদ্রোহ জনতার উৎসব। সেখানে সমস্ত কিছু ঘটনা প্ল্যানমাফিক (অথবা বাজারি মিডিয়ার পছন্দমতো) হবে, একথা আশা করা সোনার পাথরবাটি। কৃষক ইউনিয়নগুলোর হাতের বাইরে সাময়িকভাবে আন্দোলনের রাশ চলে গেছিল বিদ্রোহী জনতার স্বতঃস্ফূর্ততার ঢেউয়ে।
সকাল থেকেই বেশ টানটান উত্তেজনার পরিস্থিতি দিল্লিতে, যারা সশরীরে উপস্থিত ছিল না অনেকেরই চোখ ফেসবুক লাইভে। গত চব্বিশ তারিখ ছাত্রছাত্রী সংগঠন, যুব সংগঠন, বস্তিবাসী সংগঠনের একটা দল কলকাতা থেকে দিল্লি রওনা হয়েছিল। তাদেরকে কোথাও কৃষকরা অনুরোধ করেছেন বাংলা গান করতে, গান হচ্ছে “হেই সামালো”। ছেচল্লিশের তেভাগার স্মৃতি ঘুরে আসছে একুশের দিল্লিতে কৃষক আন্দোলনে।
ততক্ষণে কৃষকরা ব্যারিকেড ভেঙে এগিয়ে চলেছেন। টিয়ার গ্যাস, লাঠিচার্জ চলছে। প্রায় দুশো কৃষক পুলিশের হাতে আটক। পুলিশি বর্বরতার পরেও দেখা যাচ্ছে কৃষকরা জল-খাবার দিচ্ছেন পুলিশবাহিনীকে। সংগঠনগুলির নির্দেশ ছিল পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ যথাসম্ভব এড়িয়ে যাওয়ার। ‘উর্দি পরা চাষি’ আর ট্রাক্টরের চাষির সংঘাত চান না নেতৃবর্গ। দুপুরে খবর আসছে কৃষকরা ঢুকে পড়েছেন লালকেল্লায়। সম্ভবত এটি পরিকল্পনা বহির্ভূত ছিল। লালকেল্লায় উড়ছিল বিদ্রোহের পতাকা, তেরঙ্গার পাশেই। মিডিয়া যাই অপপ্রচার করুক, সাতচল্লিশ সালে তেরঙ্গা ওড়ানোর পেছনে কৃষক বিদ্রোহের দীর্ঘ ইতিহাসের কথা তো দেশবাসী ভোলেনি। বরং পাশাপাশি দুটি পতাকা এদেশের গৌরবময় অতীত সংগ্রামকেই মনে করিয়ে দেয়।
দিল্লি জুড়ে ভয়ানক উথালপাথাল হলেও বাংলায় আঁচ যথেষ্টই কম ছিল। সেটার জন্যে এখানকার অতীত ভূমিসংষ্কার নীতি, ষাটের দশকের শেষে কৃষিতে পুঁজির অনুপ্রবেশের তারতম্য, আরও অনেকগুলি কারণ বিদ্যমান। তবে বিভিন্ন জায়গায় বিক্ষিপ্তভাবে বিভিন্ন প্রতিবাদী অবস্থান সংঘটিত হয়েছে। সকাল থেকে পরপর অনেকগুলি কর্মসূচি ছিল। সিঁথির মোড় থেকে ডানলপ অব্দি নাগরিক মিছিল ছিল। উদ্যোক্তা মূলত বরানগর নাগরিক উদ্যোগ, দমদম বাগুইহাটি নাগরিক মঞ্চ। আরও বেশ কিছু ব্যক্তিবর্গ, ছাত্রছাত্রী সংগঠন নিয়ে সকালে তিনশোজন মানুষ রাস্তায় হেঁটেছে। পোস্টারে লেখা— ক্ষেতে কিষাণ কলে মজুর নওজওয়ান তৈরী হও জোট বাঁধো। সঙ্গে ভারতের জাতীয় পতাকা, স্বাধীনতা সংগ্রামের উত্তরসূরিদের হাতে।
হুগলিতে উত্তরপাড়া থেকে চুঁচুড়া অব্দি মিছিল আইএফটিইউ, আইপিটিএ, পিডিএসএফ, ফ্যাসিস্ট আরএসএস বিজেপির বিরুদ্ধে বাংলা, মানবিক ও বাকি ব্যক্তিবর্গের উদ্যোগে। এলাকায় ব্যাপক সাড়া ফেলেছে এই মিছিল। প্রায় দুশোজন ছাত্রযুব এই মিছিলে অংশ নেয়।
দুপুরে রামলীলা ময়দান থেকে ধর্মতলা অব্দি মিছিল এনআরসি বিরোধী গণ আন্দোলনের। এই মঞ্চ এনআরসির বিরুদ্ধ প্রতিক্রিয়ায় তৈরি হলেও সামগ্রিকভাবে বিজেপি আরএসএসের ফ্যাসিস্ট নীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার।
বিকেলে যাদবপুর এইটবিতে ‘ফ্যাসিস্ট আরএসএস বিজেপির বিরুদ্ধে বাংলা’ মঞ্চের প্রোগ্রাম, বড়পর্দায় কৃষক আন্দোলনের ছবি। এই মঞ্চ তৈরি হয়েছে বিভিন্ন গণতান্ত্রিক ব্যক্তিদের নিয়ে, যার কেন্দ্রীয় স্লোগান ‘নো ভোট টু বিজেপি’। ফ্যাসিবাদকে শুধুমাত্র ভোট হারানো সম্ভব নয় সত্য। কিন্তু সামাজিক-সাংষ্কৃতিক ক্ষেত্রের পাশাপাশি ভোটের লড়াইতেও ফ্যাসিস্টবাহিনীর রাজনৈতিক দল বিজেপিকে পরাজিত করার আহ্বানেই এই মঞ্চ চালিত। উপস্থিত ছিলেন অনিকেত চট্টোপাধ্যায়, মৌসুমী ভৌমিক ও আরও অনেক বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের পাশাপাশি বিভিন্ন ছাত্রছাত্রী সংগঠন, গণতান্ত্রিক মঞ্চের প্রতিনিধিরা। সামগ্রিকভাবে যেসমস্ত স্থানে কর্মসূচি নেওয়া হয়েছে সমস্ত জায়গা ছেয়ে যাচ্ছে লাল-নীল-কালো-সবুজ পোস্টারে, তলায় আহ্বান ‘বিজেপিকে ভোট নয়’। সঙ্গে জনতার উদ্দেশ্যে গণ লিফলেটিং।
এই উদ্যোগগুলি ছাড়াও বিক্ষিপ্তভাবে বিভিন্ন জেলাতে আন্দোলন দানা বাঁধছে। বাঁকুড়ার পাঁচালে দীর্ঘদিন যাবৎ কৃষকদের অবস্থান চলেছে। এছাড়াও বিভিন্ন বিজ্ঞানী, গবেষক, ডাক্তার, নাট্যকর্মীরাও এই অবস্থানে যোগ দিয়েছিলেন। আন্দোলনকারীরা মূলত ক্ষুদ্র-প্রান্তিক চাষী।
ধর্মতলাতে সারা ভারত কৃষক সংঘর্ষ সমন্বয় সমিতির অবস্থান চলেছে টানা চোদ্দ দিন। ছাব্বিশে জানুয়ারি বিভিন্ন সংসদীয় দলের কৃষক সংগঠনগুলি রাজ্যের একুশটি জেলায় বিক্ষোভ কর্মসূচি নিয়েছিল।
তবে দিল্লির মতো লড়াকু দৃষ্টান্ত দেশের মধ্যে বিরল। দশহাজার ট্র্যাক্টর নিয়ে প্রজাতন্ত্র দিবসে প্যারেড, কৃষক নভনীত সিংয়ের শাহাদাৎ, লালকেল্লায় লড়াইয়ে ইতিহাস রচিত হল। তবে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক এত লড়াই সংগ্রামের ফলশ্রুতিতে ভারতের শাসনকাঠামো, রাষ্ট্রব্যবস্থায় মৌলিক কোনও পরিবর্তনের সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না কেন। লালকেল্লা চলে যাচ্ছে কৃষক জনতার হাতে, তবু জনতার ভারতবর্ষ গঠনের স্বপ্ন তো দূর, সামান্য কৃষি আইন জনস্বার্থে পরিবর্তন বা উঠিয়ে নেওয়ার আশ্বাস পাওয়া যাচ্ছে না। ভবিষ্যতের গণআন্দোলনের কাছে এই প্রশ্নগুলি রয়ে যাবে। কোন দিশায়, কোন প্রতিষ্ঠান/ঘটনাকে লক্ষ্যে রাখলে এই শোষণমূলক সমাজব্যবস্থার মূল ভিত্তিতে আঘাত পড়বে, তার উত্তর খুঁজতে হবে গণআন্দোলনগুলির মধ্যেই।
তবে এটুকু পরিষ্কার, ফ্যাসিবাদের গলা টিপে ধরতে গেলে গণআন্দোলনের কোনও বিকল্প নেই। শুধুমাত্র সংসদীয় সংগ্রামে তাকে টলানো যায় না। এর জন্যে জনগণের স্বতঃস্ফূর্ততা লাগে, সংগঠিত সচেতন উদ্যোগও লাগে দিশায়িত করতে।
আর যে কথা আরেকবার মনে করিয়ে দেওয়ার, জনআন্দোলনে ‘নিয়ম ভাঙাই’ নিয়ম। বিপুল জনরাশি কোনও মন্ত্রী-তোষিত মিডিয়ার পছন্দসই গন্ডি মেনে কী আর চলে!