Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

‘ইজরায়েল’ শব্দটা উচ্চারণেই আমি ঘৃণা বোধ করি

‘ইজরায়েল’ শব্দটা উচ্চারণেই আমি ঘৃণা বোধ করি: নাহিদা ইজাত | ভাষান্তর: সোহেল ইসলাম, সুদীপ্ত মুখোপাধ্যায়

নাহিদা ইজাত

 

গদ্য: সুদীপ্ত মুখোপাধ্যায়

প্যালেস্তিনীয় কবি নাহিদার জন্ম জেরুজালেমে। ১৯৬৭ সালে নাহিদার বয়স যখন ৭, তখন তার পরিবারকে প্যালেস্তাইন ছাড়তে হয়। সে সময় চলছিল সেই ‘৬ দিনের যুদ্ধ’। এরপর বিভিন্ন দেশ ঘুরে ১৯৮৫ থেকে পাকাপাকিভাবে ইউকে-তে বসবাস শুরু করেন নাহিদা। তিন সন্তানের মা, গণিতের প্রফেসর। কবিতা লেখা শুরু করেন দ্বিতীয় ইনতিফাদের সময় অর্থাৎ ২০০০ সাল থেকে। তার প্রকাশিত বইগুলোর প্রথমটি ‘আই বিলিভ ইন মিরাকেলস’ এবং দ্বিতীয়টি ‘প্যালেস্তাইন: দ্য ট্রু স্টোরি’। নাহিদা স্বপ্ন দেখেন স্বাধীন-শান্তিপূর্ণ প্যালেস্তাইনের, একদিন যেখানে তিনি ফিরবেন।

নাহিদা হলেন সেই প্যালেস্তিনীয় কবি যিনি সর্বসমক্ষে দৃপ্ত কণ্ঠে বলতে পারেন:

‘ইজরায়েল’— এই শব্দটা আমি নিজে উচ্চারণ করতেই ঘৃণা বোধ করি এবং সাধারণত এই শব্দটা আমি এড়িয়ে চলি। ‘ইজরায়েল’ হল এমন একটি সত্তা যার কোনও তাত্ত্বিক অস্তিত্ব নেই, আবার শূন্যতাও কাজ করে না। দখলদারিত্বই এর মূল ভিত্তি। ‘ইজরায়েল’ কোনও বিমূর্ত ধারণা বা অনুমানমূলক শূন্যতা নয়, এটি ‘জনগণ’ দ্বারা পরিচালিত একটি সত্তা বা অস্তিত্ব।

‘ইজরায়েল’ হল এমন একদল ‘জনগণ’ দ্বারা চালিত একটি অস্তিত্ব যে ‘জনগণ’ নিজেই সিদ্ধান্ত নেয়। যে ‘জনগণ’ রাজনীতিবিদদের নির্বাচন করে। যে ‘জনগণ’ তার হিংস্র-উন্মাদগ্রস্ত সেনাবাহিনীর সেবায় নিয়োজিত। যে ‘জনগণ’ স্বজাতিবাদী বিশ্বাস, মনোভাবকে প্রতিপালন করে, উৎসাহিত করে। যে ‘জনগণ’ অন্যের ভূখণ্ড আক্রমণ করে, সেখানকার ভূমিপুত্রদের অধিকার কেড়ে নেয়, এবং বলপূর্বক তাদের দখল করে। যে ‘জনগণ’ শিশুদের বন্দি করে রাখে এবং নির্দ্বিধায় গুলি করে। যে ‘জনগণ’ পৃথিবীর ঐতিহ্য ধংস করে। যে ‘জনগণ’ জল, জমি, সমুদ্র এবং আকাশ অপহরণ করে। যে ‘জনগণ’ আশা, আকাঙ্খা, আনন্দ প্রতিদিন খুন করে। যে ‘জনগণ’ প্যালেস্তিনীয়দের রক্ত এবং ধ্বংসের ওপর নিজেদের বসতি স্থাপন করে।

‘ইজরায়েল’ হল এমন একদল ‘জনগণ’ দ্বারা চালিত একটি অস্তিত্ব যাদের ৯৪ শতাংশ গাজাকে আক্রমণ করবার পক্ষে ভোট দেয়। যাদের ৭১ শতাংশ চায় আমেরিকা ইরানকে আক্রমণ করুক। যারা সমস্ত আইন লঙ্ঘন করে প্রতিবেশী সমস্ত দেশের ওপর ইতিমধ্যেই প্রবল আক্রমণ চালিয়েছে।

‘ইজরায়েল’ হল এমন একদল ‘জনগণ’ দ্বারা চালিত একটি অস্তিত্ব যারা গত ৬ দশক ধরে চুরি করা একটা ভূখণ্ডে বাস করছে। যার জন্য লজ্জা, অনুশোচনা, বিবেকদংশন, বা সেই কৃতকর্মের জন্য ভুল স্বীকার করার ন্যূনতম কোনও চিহ্ন তাদের মধ্যে নেই।

‘ইজরায়েল’ শব্দটা শুনলেই আমার চোখের সামনে ভেসে ওঠে ইহুদিদের ঘৃণ্য অপরাধমূলক কার্যকলাপ, আমি কিছুতেই নিজের প্রতিক্রিয়া থামাতে পারি না। অন্যদিকে আরেকটা সত্য হল আমরা, প্যালেস্তিনীয়রা কোনওভাবে, কোনও পরিস্থিতিতেই হলোকাস্ট অপরাধের জন্য দায়ী নই। এবং ইহুদিদের ওপর যা ঘটেছিল তার কোনও দায় আমরা বহন করতে রাজী নই। আমার চোখে রেসিজমের মধ্যে কোনও পার্থক্য নেই, সে রেসিজম ইহুদিদের বিরুদ্ধেই হোক না কেন। ইহুদিদের বিরুদ্ধে যে রেসিজম হয়েছিল সেটা যদি আমরা আলাদা কিছু হিসেবে মেনে নেই তবে যেটা দাঁড়াবে সেটা হল হিংসাত্মক রেসিজম সম্পর্কে ইহুদিদের ব্যতিক্রমী তত্ত্বকেই আমরা মেনে নিচ্ছি।

আমি মনে করি রেসিজমের অর্থ রেসিজমই। রেসিজমের পেছনে ভিন্ন ভিন্ন কারণ থাকতেই পারে কিন্তু সবক্ষেত্রেই পরিণতি একই। বলতে পারেন কেন প্রতিনিয়ত প্যালেস্তিনীয়দের হলোকাস্টের বীভৎসতা মনে করানো হচ্ছে। যে হত্যাকাণ্ড ঘটাবার পেছনে আমাদের কোনও ভূমিকাই ছিল না। কেন হলোকাস্টের শিকারদের মতোই পরিণতি ভোগ করতে হবে প্যালেস্তিনীয়দের। যারা আমাদের ওপর অত্যাচার চালাচ্ছে, দখলদারি চালাচ্ছে সেই ইহুদিদের হলোকাস্টের ইতিহাসকে কেন বারবার স্মরণ করায় জাতিসঙ্ঘ। আমাদের বাচ্চারা যারা দিনের পর দিন শরণার্থী শিবিরে বিষণ্ণ দিনযাপন করছে… যারা তাদের বাবা-মা, দাদু-দিদার সঙ্গে জাতিগত হানাহানির শিকার। সবচেয়ে অবাক করা বিষয় হল যারা এই সমস্ত ঘটনাগুলো ঘটাবার জন্য পরিকল্পনা করলে এবং ঘটালে, তারা যখন সহানুভূতি দেখাতে আসে তখন কি মানা যায়? আমি বুঝি না কীভাবে বিশ্ব আমাদেরকে ইহুদি সেটলারের মানবতাকে স্বীকৃতি দিতে বলে? যে অস্ত্রে সুসজ্জিত সেটলাররা বন্দুক দেখিয়ে প্যালেস্তিনীয় পরিবারগুলোকে উচ্ছেদ করেছিল, তাদের সংসারের টুকিটাকি সমস্ত কিছুকে রাস্তায় ছুঁড়ে ফেলে ছিল…. আমার পাল্টা প্রশ্ন, সেটা তবে কি ধরনের মানবতা?

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল, যারা লাগাতার আমাদের হত্যা করে চলেছে, অপমান করে চলেছে সেই নির্যাতনকারীদের প্রতি কেন আমাদের বারবার সমবেদনা জানাবার কথা বলা হচ্ছে। যারা আমাদেরকে, আমাদের ইতিহাসকে ধ্বংস করে চলেছে আমি বুঝতে পারছি না কেন, বা কী উদ্দেশ্যে আমাদেরকে বলা হচ্ছে তাদের মানবিকতাকে বোঝবার জন্য? অথচ এখনও তাদের ছুরি তীক্ষ্ণভাবে আমাদের হৃদয়ের গভীরে বিদ্ধ হয়ে আছে।

তবে সমস্ত প্যালেস্তিনীয়দের পক্ষ থেকে বলতে না পারলেও আমার নিজের স্বীকার করতে কোনও দ্বিধা নেই, গাজার সাম্প্রতিক আক্রমণের আগে পর্যন্ত আমি ভাবতাম একদিন না একদিন জিওনিস্টদের মধ্যে মানবতা জেগে উঠবেই, তারা যে খারাপ কাজ করে চলেছে তার জন্য তাদের অনুশোচনা হবেই। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় হল, আমি ওদের যত দেখছি তা থেকে আমার উপলব্ধি এতদিন আমি যা ভেবেছি সেটা শুধু ভুলই নয়… অত্যাধিক আশাবাদী হওয়ার কারণে সেটা আমার ইলিউশন ছাড়া আর কিছুই নয়।

না, এখানেই শেষ নয়। নাহিদা কতটা প্রতিবাদী? কতটা সাহসী? কতটা স্পষ্টবাদী? কতটা ইজরায়েল বিরোধী? কতটা অ্যান্টি জিওনিস্ট? সে সব জানবার জন্য এবার বরং একটি সাক্ষাৎকার থেকে তার কিছু কথা শোনা যাক।

প্র: সম্প্রতি ফেসবুক একদিনের জন্য আপনাকে সাসপেন্ড করেছিল এবং তারপর আপনার আবেদন পুর্নবিবেচনা করে কয়েক ঘন্টা পরে সাসপেশন তুলে নেয়। এটা দেখে মনে হচ্ছে কেউ একজন আপনাকে থামাবার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে। এটা নিয়ে আপনার কী মনে হয়? কেন ঘটল এটা, কী মনে হচ্ছে?

নাহিদা: এটা ঠিক,এর আগেও আমার অ্যাকাউন্ট সাসপেন্ড করা হয়েছিল। এবং আমার পোস্ট বা মন্তব্যগুলো মুছে দেওয়া হয়েছিল। আমাকে নতুন করে অ্যাকাউন্ট খুলতে হয়েছিল। ফেসবুক আমার কাছে আমার পরিচয়ের প্রমাণ হিসেবে আমার কাছ থেকে পাসপোর্ট, জন্মের প্রমাণপত্র, ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট, ড্রাইভিং লাইসেন্স যেকোনও দুটো কাগজপত্র চেয়েছিল। এবং তারপর প্রমাণ হয় আমার অ্যাকাউন্টটা ফেক নয়।

আবার সে সময় ফিরে এসেছে। প্রায় প্রতিদিনের ভিত্তিতে আমাকে আবার হয়রানির শিকার হতে হচ্ছে। আমাকে একটি নোটিস দেওয়া হয়েছে যেখানে বলা হয় আমি একটি বিদ্বেষমূলক বক্তৃতা পোস্ট করেছি সেটা নাকি ফেসবুক কমিউনিটির যে স্ট্যান্ডার্ড রয়েছে তার বিপরীতে গেছে। আমি তৎক্ষণাৎ তীব্র প্রতিবাদ করি এবং পুর্নবিবেচনা করার জন্য অনুরোধ করি। এরপর কয়েক ঘন্টা পর ফেসবুকের তরফ থেকে ক্রটি স্বীকার করে একটি বার্তা পাই, তাদের ভুলের জন্যই আমার অ্যাকাউন্টটা সাসপেন্ড হয়, তারা তাদের নিষেধাজ্ঞাটা তুলে নিচ্ছে।

পশ্চিমে প্যালেস্তিনীয়দের হয়ে স্পষ্ট কথা বলবার অন্যতম কণ্ঠস্বর হিসেবে পরিচিতির কারণে এবং যেহেতু ওদের টেনে দেওয়া লক্ষণরেখার গণ্ডির বাইরে বের হওয়ার সাহস দেখিয়েছি, তাই আমাকে চুপ করিয়ে দেওয়ার অজুহাত খুঁজতে মরিয়া চেষ্টা চলছে।

কয়েক বছর আগেও আমাকে সেন্সরড করার চেষ্টা করা হয়েছিল, সত্যিকারের নিগ্রহ কাকে বলে সে অভিজ্ঞতা রয়েছে আমার। আর সেটা করার পেছনে শুধু ইহুদিরাই নয়, জায়নবাদ-বিরোধী (অ্যান্টি জিওনিস্ট) আন্দোলনের সমর্থকরাও ছিল। যাদের সঙ্গে বহু বছর আমি একসঙ্গে হাতে হাত মিলিয়ে কাজ করেছি, যাদেরকে আমি বিশ্বাস করেছিলাম। তারা সেটা করেছিল কারণ যে বিষয়গুলোকে তারা নিষিদ্ধ বলে মনে করত আমি সেগুলোকে অনুসন্ধান করবার সাহস দেখিয়েছিলাম। এবং প্যালেস্তিনীয় সংগ্রামের আলোচনায় তাদেরকে লঙ্ঘন করে যে কোনও কিছুই অনুমোদিত হয় না, আমি তার বিরোধিতা করেছিলাম। তাই আমার লেখাকে থামাবার জন্য এবং অনলাইনে প্রকাশিত হওয়া থেকে বিরত রাখবার জন্য ‘ইহুদিবিদ্বেষ’-এর সেই একই কারণকে ব্যবহার করেছে ওরা।

কয়েক বছর আগে আমি এমন কিছু বিষয় চিহ্নিত করেছিলাম যেগুলো তারা নিষিদ্ধ বলে মনে করে। যেমন:

১. ইহুদিদের আধিপত্যবাদের মতবাদ এবং প্যালেস্তাইনের সংগ্রামে তার ভূমিকা, এবং প্যালেস্তিনীয়দের জীবন এবং তাদের ধ্বংসের যে শ্রেণিবিন্যাস।

২. বিশ্বব্যাপী ইহুদি জিওনিস্টদের যে নেটওয়ার্ক তা ইহুদি রাষ্ট্র হিসেবে ইজরায়েলকে ধারাবাহিকভাবে টিকিয়ে রাখবার জন্য আন্তর্জাতিক ‘ব্লাড লাইন’ হিসেবে কাজ করছে।

৩. আমি মনে করি, বছরের পর বছর ধরে মধ্যপ্রাচ্য জুড়ে যে ধ্বংসলীলা চলছে সেটা যত না সন্ত্রাসবাদীদের কারণে হচ্ছে তার থেকে বেশি হচ্ছে সিআই-এর চর মোসাদবাহিনীর ‘ফলস্ ফ্ল্যাগ ওয়ার’-এর কারণে।

ও হ্যাঁ, ‘ফলস্ ফ্ল্যাগ ওয়ার’ বিষয়টি কী সেটা বলা দরকার। এক্ষেত্রে উদাহরণ দিয়ে বললে বোধহয় বুঝতে সুবিধে হবে। ১৯৮৪-তে লিবিয়ার ত্রিপলিতে গদ্দাফির বাসভবনে একটি রেডিও ট্রান্সমিটার বসিয়ে মোসাদ বাহিনী সেখান থেকে সন্ত্রাসবাদীদের সমর্থনে একটি ফেক খবর সম্প্রচার করে। সম্প্রচারিত যে খবরকে অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করেই সে সময় রেগন লিবিয়ার ওপর বোমাবর্ষণের নির্দেশ দেন। মজাটা হল প্রেসিডেন্ট গদ্দাফি যে ঘটনার জন্য দায়ীই নন, তার জন্য তাকে শাস্তি পেতে হল। আরেকটা ঘটনা বলি ২০০৫ সালে ইজরায়েলি সেনা নিজেই স্বীকার করে তারা নিজেরাই নিজেদের সৈন্যের দিকে পাথর ছুঁড়েছে প্যালেস্তাইনের শান্তিপূর্ণ আন্দোলনকে থামাবার জন্য। আশাকরি ‘ফলস্ ফ্ল্যাগ ওয়ার’টা কী সেটা বোঝাতে পেরেছি।

তবে আমার প্রতিনিয়ত চিৎকার করে চলা প্যালেস্তিনীয় কণ্ঠকে চুপ করিয়ে দেবার সমস্ত চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। আসলে কিছু ক্রিয়ার বিপরীত প্রতিক্রিয়া রয়েছে। আমার কথা ইউকে-র একটা ছোট শহর থেকে ক্ষীণভাবে প্রতিধ্বনিত হবার পরিবর্তে এখন অনেক দূর পর্যন্ত প্রসারিত, কারণ আমাকে চুপ করাবার জন্য তাদের যে প্রয়াস তা আমাকে আমার ভলিউম বাড়াতে সাহায্য করেছে।

প্র: শুরুর দিকে মনে হয়েছিল জিওনিস্ট এবং তাদের ইজরায়েলি দালালরা আপনাদের ইন্টেলেকচুয়াল কাজে হস্তক্ষেপ করতে শুরু করেছে, এখন এটা প্রতিষ্ঠিত যে অ্যান্টি জিওনিস্ট জিউসরা ওই ফ্রন্টে অনেক বেশি সক্রিয়। এটা নিয়ে আপনার কী মত?

নাহিদা: জিওনিস্ট লুটেরারা মানসিকভাবে লড়াই করতে আগ্রহী নয়। তারা বরং বোমা, বুলেট, এবং মাইন নিয়ে লড়াই করতেই বেশি পছন্দ করে। পুরোপুরি শত্রু নির্মূল করাতেই তাদের আগ্রহ। অন্যদিকে অ্যান্টি জিওনিস্টরা নৈতিকতা এবং সার্বজনীন মূল্যবোধের ওপর ভিত্তি করেই এগিয়ে চলেছে, ফলে অস্ত্রনির্ভরতাটা তাদের কাছে নৈতিকতা-বিরোধী, এবং সে কারণে তারা নিজের মনোজগতের মধ্যেই মনোনিবেশ করে। কিন্তু তাদের যুক্তিগুলো বড়ই দুর্বল, এবং সত্যের মুখোমুখি দাঁড়াতে পারে না। তাদের কাজের লক্ষ্য কোনও সময় স্থির থাকে না, এবং মনে হয় সত্যকে গোপন করাটাই যেন তাদের মূল উদ্দেশ্য। আমার মনে হয় তারা তাদের শেষ খেলায় সত্যকে ‘অ্যান্টি সেমিটিসিজিম’ এবং ‘হলোকাস্ট’ অস্বীকার করবার ভাবনার সঙ্গে তালাবন্দি করে, সেই চাবির গোছাকে চিরদিনের জন্য বিদ্বেষমূলক বক্তৃতার অন্ধকূপে সমাহিত করবে। এই যে অ্যান্টি জিওনিস্টরা আমার মনে হয় সত্যের ভেতর যে সহজাত অদম্য আলো রয়েছে তা তাদের দুর্বল আত্মারা উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হয়েছে, শুধু তাই নয় সে আলোকে কখনওই তারা আঘাত করে নেভাতে পারবে না।

একটা বিষয় অবশ্য আমার পরিষ্কার করা উচিত সেটা হল, জিওনিস্ট এবং অ্যান্টি জিওনিস্ট জিউসদের মধ্যের পার্থক্য। এরা উভয়েই যদি ইহুদি হয় তবে অ্যান্টি জিওনিস্ট জিউসরা জিওনিস্টদের বিরোধিতা করে কেন? আর সেটা প্যালেস্তিনীয়দের পক্ষেই বা যায় কী করে? জিওনিজম হল ইহুদি জনগণের জাতীয়তাবাদী আন্দোলন যা বর্তমান ইজরায়েলের যে ভূখণ্ড সেখানে ইহুদি রাষ্ট্রের পুনঃপ্রতিষ্ঠাকে সমর্থন করে। আর যারা এই দর্শনটি বিশ্বাস করে তারাই হলেন জিওনিস্ট। অ্যান্টি জিওনিস্ট জিউসরা হল পুরোন ইহুদিবাদী যারা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পর্যন্ত ইহুদি সম্প্রদায়ের ব্যাপক সমর্থন পেয়েছিল। এরা জিওনিস্টদের ইহুদি রাষ্ট্রের যে ভাবনা সেটা মানে না। ইহুদি সম্প্রদায় কোনও একক দল নয়, এক একটা গোষ্ঠী এবং এদের প্রত্যেকটি গোষ্ঠীর মধ্যেই মতপার্থক্য রয়েছে। এদের মধ্যে মূল পার্থক্য হল একদল ধর্মনিরপেক্ষ ও অন্যদল ধর্মীয়। ইহুদি রাষ্ট্র নিয়ে এই সমস্ত গোষ্ঠীর যে বিরোধিতা তা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তিত হয়েছে এবং তারা বিভিন্ন ধর্মীয়, নৈতিক ও রাজনৈতিক অবস্থান গ্রহণ করেছে।

অ্যান্টি জিওনিস্ট জিউসদের একটি দীর্ঘ ঐতিহ্য রয়েছে যারা শুরু থেকেই জিওনিজিম ধারণাটির বিরোধিতা করে এসেছে। বানডিস্ট, অটোনোমিস্টিস, সংস্কার পরবর্তী জুডাইজম এবং আগুড সকলেই জিওনিজমের যুক্তিবাদী ও আঞ্চলিক উচ্চাভিলাষকে ত্রুটিপূর্ণ ভাবনা বলে মনে করে। নাগরিক দায়িত্ব ও দেশপ্রেমের অনুভূতিকে ভিত্তি করে গড়ে ওঠা জিওনিজমের ধর্মীয় মতবাদ বা দৃষ্টিভঙ্গিকে সনাতনপন্থী জুডাইজম শুরু থেকেই তীব্র বিরোধিতা করেছে। কারণ জিওনিজম জাতীয়তাবাদকে সমর্থন করেছিল ধর্মনিরপেক্ষতার মোড়কে, এবং পবিত্র শব্দের পরিবর্তে তারা ‘জিয়ন’ অর্থ্যাৎ ‘জেরুজালেম’ (তাদের উৎসস্থল, জায়গার নাম), ‘ইজরায়েল ভূখণ্ড’, ‘পুনরুদ্ধার’, বা ‘নির্বাসকদের জোট’-এর মত শব্দ ব্যবহার করেছিল একটা ভূখণ্ডকে অর্জন করার জন্য। গোড়া ইহুদিরা মসিহার আবির্ভাবের আগে ইহুদি রাষ্ট্র গঠন মেনে নেয় না। উল্টোদিকে সংশোধনবাদী ইহুদিরা জুডাইজমকে জাতীয় বা জাতিগত পরিচয় হিসেবে প্রত্যাখ্যান করেছিল এবং কোনও মসিহার আবির্ভাবের প্রত্যাশাও ত্যাগ করেছিল।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে অনেক ইহুদিই জিওনিজমকে একটি কল্পিত ও অবাস্তব আন্দোলন হিসেবে মনে করত। ইউরোপীয় রেনেসাঁসের সময় অনেক উদারপন্থী যুক্তি দিয়েছিলেন, ইহুদিদের কেবল এই শর্তে পূর্ণ সাম্যতা উপভোগ করা উচিত যে তারা যে দেশের সঙ্গে যুক্ত হবে, সেই দেশের প্রতি তারা যেন নিজ নিজ আনুগত্যের প্রতিশ্রুতি দেয় এবং সেখানকার জাতীয় সংস্কৃতিকে নিজের করে নেয়। তারা অধিকারের বিনিময়ে ইহুদিদের পুর্নজন্মের আহ্বান জানিয়েছিল। যেসমস্ত উদারমনস্ক ইহুদি এই সংযুক্তি বা মিশে যাওয়ার নীতিকে গ্রহণ করেছিলেন তারা ইউরোপীয় জাতিরাষ্ট্রের প্রেক্ষিতে ইহুদি নাগরিকত্ব ও সাম্যের জন্য জিওনিজমকে ভয় প্রদর্শনের নতুন পন্থা হিসেবে দেখেছিলেন। আবার ইহুদিদের বেশির ভাগ গোঁড়া ধর্মীয় গোষ্ঠীগুলো জিওনিস্ট মতাদর্শ গ্রহণ না করলেও ইজরায়েলকে দেশ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছিল এবং সক্রিয়ভাবে সমর্থন জানিয়েছিল। মোদ্দা কথা হল তত্ত্বগতভাবে যত পার্থক্যই থাকুক না কেন এরা সকলেই ইজরায়েলকে সমর্থন করে।

প্র: কদিন আগে প্যালেস্তাইনপন্থী ইজরায়েলি অ্যাক্টিভিস্ট আবিগেইল আবারবানেলের অবমাননাকর পোস্ট দেখে আমরা খুবই বিস্মিত হই। ইহুদি ধর্মগ্রন্থের প্রাথমিক উৎস প্রকাশ করবার জন্য তিনি আপনাকে অ্যান্টি সেমিটিসিজম এবং রেসিজমের সমর্থক হিসেবে দায়ী করেন। আবারবানেল আপনাকে নিয়ে লেখেছেন যে আপনি উদ্ভট, “নাহিদার কবিতায় সবসময় তীব্র ব্যঙ্গোক্তি”, “সে নির্লজ্জভাবে রেসিস্ট মন্তব্য পোস্ট করে”, “নাহিদার মানসিক নিয়ন্ত্রণ ঠিক নেই, সে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না, এবং ইহুদিদের বিরুদ্ধে অবিশ্বাস্যভাবে রেসিস্ট মতামত প্রকাশ করে”, “ইজরায়েল তার জনগণের সঙ্গে কী করছে এবং ইজরায়েলের প্রতি তার ক্রোধ এই দুইয়ের মধ্যে তিনি বোধহয় পার্থক্য করতে পারছেন না, এবং এর জন্য তিনি পুরো ইহুদি জনজাতির মানহানি করছেন”, “তিনি সকল ইহুদিদের বিরুদ্ধেই রেসিস্ট মতামত পোষণ করেন, ইহুদি রেসিজমের যে নির্দিষ্ট কয়েকটি ঘটনা রয়েছে তা মানতে চান না”… ইত্যাদি…। যখন একদিকে কোনও ইজরায়েলি একদিকে আপনার পক্ষের সমর্থক হিসেবে দাবী করছে আবার উল্টোদিকে আপনাকে উদ্ভট, রেসিস্ট হিসেবে উল্লেখ করছে… তাতে আপনার অনুভূতি কী?

নাহিদা: ঠিক আছে, কী আর মনে হবে। যদিও তিনি আমার সম্পর্কে বেশকিছু কদর্য মন্তব্য করেছেন, তবু আমার তার প্রতি কোনও রাগ, শত্রুতা, এমনকি কোনও ঘৃণাবোধও নেই। ব্যক্তিগতভাবে তার সঙ্গে আমার কখনও দেখা হয়নি, একজন মানুষ হিসেবে আমি তার জন্য দুঃখবোধ করি, যখন কারও সংবেদনশীলতা নষ্ট হয়ে যায় তখন সে তার অক্ষমতার কারণে অন্যদের সহমর্মিতা জানাতে ব্যর্থ হয়। আমি দুঃখিত তার অক্ষমতা দেখে। মানবিকতা এবং নৈতিকতার সবটাই তিনি আয়ত্ত করে ফেলেছেন তার এই বিশ্বাস দেখে আমি সত্যিই মর্মাহত।

আমি তার জন্য দুঃখ প্রকাশ করছি, তিনি তার পরিবারের সদস্য এবং তার নিজের স্বজাতি দ্বারা শৈশবে নির্যতিত হন এবং আরোগ্য লাভ করার পরও সেই ক্ষতচিহ্ন বয়ে বেড়াচ্ছেন, এমনকি সে সময় ব্যাপক সংখ্যক মানুষের ওপর নির্যাতন চালাবার জন্য প্রশ্রয় দেওয়া হয়েছিল। যদিও তিনি সমস্যাটির মূলে পৌঁছতে পারেননি।

প্র: বছর কয়েক আগেও আপনি ছিলেন প্রান্তিক একক প্রতিবাদী স্বর। কিন্তু বর্তমানে পরিস্থিতিটা পুরো পাল্টে গেছে। পশ্চিমের রাজনীতি, সংস্কৃতি, মিডিয়ার ওপর জিওনিস্টদের প্রভাবে ইউরোপের মানুষ আজ তিতিবিরক্ত। জনগণের সচেতনতার একটা পরিবর্তন আমরা লক্ষ্য করছি। এই পরিবর্তনটাই কি আশা দেখাচ্ছে না?

নাহিদা: শেষ দশক জুড়ে খুব কম সময়ের মধ্যে বেশ কিছু পরিবর্তনের সাক্ষী আমি। এবং একজন পর্যবেক্ষক হিসেবে লক্ষ করছি চারপাশে মারাত্মক বিপর্যয় ঘটে যাচ্ছে। প্রধান যে রাজনৈতিক ব্যবস্থা তা নড়বড়ে হয়ে যাচ্ছে, গ্লোবাল ক্ষমতার বদল ঘটছে, পরিবর্তন মহাবিশ্বেরই একটি নিয়ম। এবং আমি লক্ষ করছি জিওনিস্ট এবং অ্যান্টি জিওনিস্টদের মধ্যে কোনও পার্থক্য নেই, তাদের রং, বিভিন্ন শেড, বিশ্বাস, মতামত সমস্ত কিছু আটকে আছে একটা সঙ্কুচিত সংকীর্ণ ক্ষেত্র যুদ্ধের ভাবনার মধ্যে। অথচ ব্যক্তিগত আক্রমণ এবং অ্যান্টিসেমিটিসিজমকে দোষারোপ করার মত হাস্যকর বিষয় ছাড়া তাদের হাতে আর কোনও অস্ত্র নেই। আমার বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই ধীরে হলেও এটা নিশ্চিত, মন এবং আত্মার লড়াইয়ে তারা পরাজিত হবেই।

সবকিছুর সাক্ষী হিসেবে এ সবের ভেতর থেকেও আমি দৃঢ়তা, আত্মবিশ্বাস অনুভব করি, এবং আমি মনে করি আমার দৃঢ়তা বজায় রাখার জন্য সবধরনের আশা, শক্তি এবং ধৈর্য্যের প্রয়োজন।

এইটুকু শোনার পর নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন নাহিদা শুধু কবিতার মধ্যে নিজেকে বা তার প্রতিবাদকে আটকে রাখেননি। নাহিদা যে একজন কত বড় মাপের চিন্তাশীল মানুষ সেটা আমরা উপলব্ধি করতে পারি যখন ‘শরিয়া’ সম্পর্কে প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, “শরিয়া একটি আরবি শব্দ যার অর্থ সৃষ্টির উৎস বা স্রষ্টার কাছে পৌঁছনোর পথ এবং ধর্মীয় দিক থেকে এর অর্থ ন্যায়ের পথ বা ধর্মের পথ।” ‘শরিয়া’ কোনও আইন নয়, বরং শরিয়া হল ন্যায়বিচার সমন্বিত একগুচ্ছ নীতিসমূহ। শরিয়ার ৬টি নীতি হল— ১. জীবনকে রক্ষার অধিকার। ২.পরিবারকে সুরক্ষিত রাখবার অধিকার। ৩. শিক্ষাকে সুরক্ষিত রাখবার অধিকার। ৪. ধর্মকে রক্ষার অধিকার। ৫. সম্পত্তি রক্ষার অধিকার। ৬. মানুষের মর্যাদা রক্ষার অধিকার।

আমরা উপলব্ধি করতে পারি যখন নাহিদা ইজরায়েলকে সমর্থন করার জন্য আমেরিকার জনগণকে খোলা চিঠি দেন, যে চিঠিতে নাহিদা লেখেন… আপনাদের সরকারের কারণে আমার দেশে ধ্বংসাত্মক ঘটনা ঘটে চলেছে সেকারণেই এই চিঠি। আমি মানবতার প্রতি যত্নশীল, এবং এই গ্রহকে, এর সমস্ত বাসিন্দাকে ভালোবাসি তাই এই চিঠি। আমি এমন একটা সভ্য সমাজের প্রতি বিশ্বাস রাখি যেখানে নিজের বিশ্বাসের জন্য কারও পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়াই, বিদ্রূপের পাত্র না হয়ে, জেলবন্দি না হয়ে, খুন না হয়েই নির্দ্বিধায় নিজেকে প্রকাশ করতে পারে কোনও মানুষ। আপনাদের চিঠি লিখছি কারণ জিয়নিস্ট (ইহুদিবাদী) মিডিয়া আমাদের ধর্মকে বিকৃত করে আপনাদের সামনে উপস্থাপনা করছে। তারা মানুষের মাথায় ঢোকাচ্ছে ইসলাম মানেই সন্ত্রাস। জেহাদ হল পবিত্র যুদ্ধ। ফতোয়া হল মৃত্যুদণ্ড। মুসলিম নারী মানেই তারা নিপীড়িত, তারা অশিক্ষিত, তাদের বোরখা পড়তে বাধ্য করা হয়, তারা তাদের পুরুষদের দাস। মুসলিম পুরুষ মানেই তারা ধর্মান্ধ, নিষ্ঠুর, স্ত্রীর ওপর নির্যাতন করে। প্রত্যেক মুসলিম শিশুই সন্ত্রাসবাদী তৈরি হয়। সাধারণত যখন কোনও অপরাধ সংগঠিত হয়, যে অপরাধ করে সে অপরাধী হিসেবে গণ্য হয়। কিন্তু যখন কোনও মুসলিম অপরাধ করে সে অপরাধ যত ছোটই হোক না কেন তখনই তাকে মুসলিম অপরাধী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এবং সে মুসলিম অপরাধী থেকে মুসলিম সন্ত্রাসী হয়ে যায়। বলা হচ্ছে সে অপরাধটি করেছে তার কারণ সে মুসলিম, আর প্রত্যেক মুসলিমকেই নাকি তার বিশ্বাস মন্দ কাজ করতে শেখায়। কিন্তু মোটেই এটা সত্য নয়, সত্যটা কী সেটা জানাবার জন্যই এই চিঠি।

‘ইসলাম’ শব্দের উৎপত্তি ‘সালাম’ থেকে। আর এই ‘সালাম’ হল ঈশ্বরের পবিত্র নামগুলির মধ্যে একটি। আরবিতে ‘সালাম’-এর অর্থ হল শান্তি। আর এই ‘সালাম’ শব্দটি অন্যকে অভিবাদন জানাতে ব্যবহৃত হয়। কাউকে ‘আসসালাম আলাইকুম’ বলার অর্থ ‘আপনার ওপর শান্তি নেমে আসুক’ বা ‘আপনার ওপর শান্তি বর্ষিত হোক’। একজন মুসলিম যখন অন্য কাউকে সালাম জানায়, তার মানে দাঁড়ায় তিনি সেই ব্যক্তিকে শান্তি চুক্তির প্রস্তাব দিচ্ছেন। সুতরাং কোনও ব্যক্তি সালাম জানাবার পরেও যদি তার প্রতি হিংসার উদ্দেশ্য থাকে, তবে বুঝতে হবে সে ভণ্ডামি করছে এবং ইসলাম মতে যা অন্যতম পাপ হিসেবে গণ্য হবে।

‘জিহাদ’ একটি আরবি শব্দ যার অর্থ এই পৃথিবীকে আরও উন্নত করতে আপনার যথাসাধ্য চেষ্টা বা উদ্যম।যে কোনও কিছু অর্জনের জন্য যে প্রচেষ্টা তাকেই জেহাদ বলে। যেমন মায়ের সন্তান পালন, ইস্কুলে লেখা-পড়া শেখা, শিক্ষকতা বা লেখার মাধ্যমে জ্ঞান ছড়িয়ে দেওয়া, রোগীদের চিকিৎসা করা, অসুস্থ পিতা-মাতার দেখাশোনা করা, আক্রমণ করার সময়ও নিজেকে রক্ষা করা, অত্যাচার বা নিপীড়নের বিরুদ্ধে লড়াই করা। মানবজাতির মঙ্গলের জন্য যে কোনও পদক্ষেপ গ্রহণ করাটাই হল ‘জিহাদ’।

‘ফতোয়া’ হল কোনও জ্ঞাত ব্যক্তির মতামতের বহিঃপ্রকাশ ছাড়া আর কিছুই নয়। এটি মোটেই কারও ওপর জোর করে অন্য পক্ষের মতামত চাপিয়ে দেওয়া নয়। ইসলামে কোনও পুরহিততন্ত্র বা যাজকতন্ত্র নেই, গির্জার মত কোনও প্রতিষ্ঠান নেই, ধর্মযাজক নেই। এটা খুব কমই কখনও উল্লেখ করা হয়েছে যে কোনও মুসলিমই কোরান পাঠ করে তার উপলব্ধি ও মতামত তৈরি করার অধিকারী।

যদি এই সমস্ত মিথ্যাবাদিতা, বিকৃতি এবং ইসলামের মিথ্যা উপস্থাপনা জরুরিভাবে, যৌক্তিকভাবে, মুক্তমন ও মমত্ববোধের সঙ্গে সমাধান করা না হয় তবে আমাদের পৃথিবী ধ্বংসপ্রাপ্ত হবে।

গণতন্ত্র এবং স্বাধীনতা বিষয়ে কোরানের কিছু উদ্ধৃতিও তুলে দিলাম আপনাদের।

১. ইসলাম ধর্মে বা মতাদর্শে কোনও বাধ্যবাধকতানেই (২:২৫৬)।

২. আমি তাকে পথ দেখিয়েছি। তাতে সে আমার ওপর কৃতজ্ঞ হতেও পারে নাও হতে পারে (৭৬:৩)।

৩. তোমাদের মধ্যে এমন একটা দল থাকা উচিত যারা আহ্বান জানাবে সৎকর্মের প্রতি, নির্দেশ দেবে ভালো কাজের এবং অন্যায় কাজ থেকে বিরত থাকার জন্য, তারাই প্রকৃত সম্মানের ভাগীদার (৩:১০৪)।

৪. যে সৎ কাজ করে সে নিজের কল্যাণার্থেই তা করে, আর যে অসৎ কর্ম করে তা তার ওপরই বর্তাবে। এবং সবশেষে আমাদের সকলকেই তাঁর কাছেই ফিরতে হবে (৪৫:১৫)।

৫. প্রত্যেকেই এই পৃথিবীতে পাপ-পুণ্য এই দুই দিয়েই তিনি পাঠান। কিন্তু কেউ পুণ্যটাকে কাজে লাগিয়ে তার পুণ্যের পরিমাণ দ্বিগুণ করে। আবার কেউ কেউ পাপের পরিমাণ বাড়তে বাড়াতে পুণ্যের ঘড়া শূন্য করে দেয়। তখন সে আসলে ধারে চলে, এই ধার পুণ্যের ধার (৪২:৩৮)।

কী ভাবছে বন্ধুরা? তোমাদের কী মনে হয় আমরা খুব বোকা? তোমাদের হস্তক্ষেপে আমাদের দেশ, আমাদের ভূখণ্ড আজ মৃত্যু মুখে। বিশ্বের অন্যান্য দেশের প্রতি তোমাদের যে শ্রেষ্ঠত্বের মনোভাব এবং আধিপত্য তা আমাদের আরও মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়েছে। আমরা চাই আমাদের মাতৃভূমির স্বাধীনতা। আমরা আমাদের সরকার নির্বাচন করবার জন্য, আমাদের অধিকার প্রয়োগ করবার জন্য সক্ষম হতে চাই। আমরা চাই শান্তিপূর্ণ ও মর্যাদার সঙ্গে বাঁচার অধিকার যেখানে কোনও বোম্বিং বা জাতিহত্যার চোখরাঙানি থাকবে না। আমরা আমাদের ঘরে ফেরার, চিরকাল শরণার্থী হিসেবে বেঁচে না থাকার অধিকার চাই।

নাহিদার কথা শুনতে শুনতে খুব স্বাভাবিকভাবেই মনে হয় যে কোনও কিছুর একেবারে ভিত নড়িয়ে দিতে পারেন তিনি। প্রত্যেকটি বিষয়ের একেবারে মৌলিক যে অবস্থা তিনি শুরু করেন সেখান থেকে এত গভীর তার অন্তর্দৃষ্টি মাঝে মাঝে চমকে উঠতে হয়। কী অবলীলায় নাহিদা ‘ঈশ্বর’ সম্পর্কে বলতে পারেন—

আমি খুব অল্প বয়স থেকেই বিশ্ব সম্পর্কে এবং পরে আমার নিজের অস্তিত্ব সম্পর্কে এবং ঈশ্বর সম্পর্কে প্রশ্ন করতে শুরু করি। আমি যখন ছোট ছিলাম আমার পারিপার্শ্বিক, গাছপালা, ফুল, মানুষ দেখে আমি মুগ্ধ হয়েছি। কিন্তু আকাশের বিশালতা, তার সৌন্দৰ্য্য, সম্পূর্ণতা আমাকে সবচেয়ে বেশি প্রলুব্ধ করেছে। সে আমাকে সব সময় তাকে দেখবার জন্য, প্রশংসা করার জন্য, প্রশ্ন করার জন্য বলে গেছে। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আমার মুগ্ধতা আরও গভীর হতে শুরু করে, আমার চারপাশে কী আছে তার অর্থ অনুধাবন করবার জন্য এবং ব্যাখ্যা কী হবে তার সন্ধান শুরু করি। আমার চারপাশে যা রয়েছে তারা আসলে কী? কেনই বা আছে? এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে আমার কি সত্যিই কোনও অস্তিত্ব রয়েছে? কীভাবে এবং কেন আমি আমার অস্তিত্বকে উপলব্ধি করতে পারি? আমি এখানেই বা কেন? আমার জীবনের উদ্দেশ্য কী?

বহু বছর চিন্তা করার পর যে ব্যাখ্যাটা আমার বৈধ মনে হয়েছিল সেটা হল এই সবকিছুর পেছনে রয়েছে একজন মাস্টারমাইন্ড, এক নিখুঁত ডিজাইনার, এক প্রখর বুদ্ধিদীপ্ত শক্তি। যে কোনও কিছুর যে কোনও মানেই হতে পারে কিন্তু এটাই ছিল আমার একমাত্র সিদ্ধান্ত। বিশ্বাস এবং ঈশ্বরের ধারণা যদি আমার অস্তিত্বের জন্য একটি যৌক্তিক ব্যাখ্যার জোগান দেয়, পাশাপাশি এটা যদি আমার চারপাশের বিশ্বকে এবং আমার নিজেকে যুক্তিযুক্তভাবে বুঝতে সাহায্য করে, যদি এটা আমাকে পরিপূর্ণতা, তৃপ্তি এবং তৃপ্তির অনুভূতি দিতে পারে, যদি এটা আমাকে ন্যূনতম ট্রমা, আরও ধৈৰ্য্য, অনুগ্রহ, এবং তুচ্ছতার সঙ্গে জীবনের প্রতিকূলতা থেকে নিজেকে উদ্ধার করতে সক্ষম করে, যদি এটি আমার আত্মাকে ভালোবাসা, আনন্দ দিয়ে পূর্ণ করে তোলে, শান্তি ও প্রশান্তি দেয়, যদি এটি জীবনকে আরও উপভোগ্য, আরও মজাদার এবং আমার অভিজ্ঞতাগুলোকে আরও বাস্তব ও তীব্র করে তোলে, তাহলে আমি কেন, কী জন্য অভিযোগ করবে? সর্বোপরি হারানোর কী বা আছে, সবটাই তো লাভ।

আবার ‘ইসলাম’ সম্পর্কে নাহিদার বক্তব্য হল, কৈশোরে আমি বিভিন্ন ধর্মকে অনুধাবন করবার জন্য পড়াশুনো শুরু করি। কিছু সময়ের জন্য বৌদ্ধধর্মের অনেক ধারণার প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়ি। তবে ইসলাম আমার যুক্তি ও বুদ্ধিকে আরও আকৃষ্ট করেছিল। একেবারে সরল ও স্পষ্টভাবে এবং আপাতদৃষ্টিতে দ্বন্দমূলক ধারণাগুলিকে একত্রিত করার দক্ষতার কারণে এটি আরও তাৎপর্যপূর্ণ হয়েছিল; যেমন বিশ্বাস ও জ্ঞান, মন ও আত্মা, বিজ্ঞান ও ধর্ম, বস্তু ও আধ্যাত্মিক, যুক্তি ও আবেগ, রাজনীতি ও নৈতিকতা, অর্থনীতি ও নৈতিকতা, প্রত্যেকেই একে অপরের সঙ্গে সুন্দরভাবে, মসৃণভাবে মিশে গেছে।

আবার মুসলিম নারীদের স্বাধীনতা বিষয়ে নাহিদার বক্তব্য হল, আপনারা যদি মুসলিম সমাজের নারীদের বৈষম্য নিয়ে উদ্বিগ্ন হন এবং যদি মনে করেন মহিলাদের মাথায় কাপড় দিতে বাধ্য করা হয় বা গাড়ি চালাতে দেওয়া হয় না, তবে আমি বলব আপনাদের বরং উদ্বিগ্ন হওয়া উচিত এটা জেনে যে ধর্মনিরপেক্ষ ফ্রান্সে মুসলিম নারীদের মাথা থেকে স্কার্ফ সরিয়ে নেওয়াটা বাধ্যতামূলক হচ্ছে, তাদের স্কার্ফের ব্যবহার কাজের ক্ষেত্র ও পড়াশুনার জায়গায় নিষিদ্ধ করা হচ্ছে। আমার জিজ্ঞাসা মানুষ হিসেবে একজন নারীর মানবাধিকার এবং তাদের নিজেদের পছন্দের স্বাধীনতা রক্ষার জন্য দুটি ক্ষেত্রের মধ্যে কোনটি নিয়ে আমাদের প্রচারে যাওয়া প্রয়োজন?

তুরস্ক, তিউনিশিয়া বা ফ্রান্সের মত ধর্মনিরপেক্ষ দেশগুলোতেও স্বাধীনতা বা সাম্যতা মোটেই মান্যতা পায় না। এই সমস্ত দেশেই কর্মস্থল, ইস্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে মেয়েরা মাথায় স্কার্ফ দেবে কি দেবে না সেই স্বাধীনতাটা তাদের কাছ থেকে কেড়ে নেওয়া হয়েছে। ইসলাম স্পষ্টতই নারীদের অধিকারকে মূল্য দেয় এবং সুরক্ষিত করে। তা নিয়ে সন্দেহ থাকলে গবেষণাও করতে পারেন। এবং দয়া করে ইসলাম সম্পর্কে আপনার গবেষণার জন্য মিডিয়ার ওপর নির্ভর করবেন না। কারণ তারা যেমন প্যালেস্তাইন ও ইজরায়েলি সমস্যা নিয়ে একতরফা ব্যাখ্যা দিয়ে চলেছে, তেমনি তারা ইসলাম সম্পর্কেও ভুল ধারণা পোষণ করে চলেছে।

মুসলিম নারীদের অধিকার সম্পর্কে কথা বলার সময় আমাদের সমাজের আভ্যন্তরীণ সমস্যাগুলো অবশ্যই আমাদের নিজস্ব উপায়ে, নিজস্ব গবেষণার মাধ্যমে মোকাবিলা করার অনুমতি দেওয়া উচিত। যত গর্হিত সমস্যাই থাকুক না কেন, তার সমাধান বাইরে থেকে কারওই আমাদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া উচিত নয়। কারণ এটা যারা করবেন তাদের ইতিহাস আলাদা, বর্তমান আলাদা, তাদের দৃষ্টিভঙ্গি আলাদা। ইউরোপের নারীদের কিছু অধিকার এবং কিছু স্বাধীনতা অর্জনের জন্য নারীবাদী লড়াইয়ের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছিল, তার মানে এই নয় যে আমরা হুবহু তাদের কপি করব বা সারা বিশ্বের অন্যান্য জায়গাতেও তাদের মত করে লড়াই হবে। এটা হতে পারে না, কারণ আমাদের ইতিহাস আলাদা এবং আমরা একটা ভিন্ন বাস্তবতার মধ্যে রয়েছি। ইউরোপে যখন সেটা হয়েছিল তখন মুসলিম নারীরা ছিলেন সমাজের বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব। তারা কেউ ছিলেন ডাক্তার, কেউ কবি, অনেকেই আবার বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পড়াতেন। প্রত্যেকেই ছিলেন কোনও না কোনওভাবে বিশিষ্ট। তাছাড়া প্রত্যেক সমাজের মত আমাদের সমাজেও কিছু সমস্যা আছে। কিছু সমস্যা অতি নগণ্য আবার কিছু হয়ত বড় সমস্যাও রয়েছে। কিন্তু আমরা কীভাবে সেগুলোর সমাধান করতে চাই তা সম্পূর্ণ আমাদের বিষয় হওয়া উচিত। সেটা মোটেই আমাদের ওপর চাপানো উচিত নয়।

নাহিদার কথা শুনতে শুনতে নিশ্চয়ই ভাবছেন মেয়েটার কথা বড্ড কঠিন। কেমন যেন সব কিছু গুলিয়ে দেয়, বড্ড খটোমটো। কিন্তু না এ সব তাত্ত্বিক কথার বাইরেও নাহিদা খুব সহজ করে, সরল করে, জলের মতো করে কথা বলতে পারেন, সেকারণেই নাহিদার কবিতায় হাসান-কে আমরা পাই, আমরা পাই প্যালেস্তাইনের অসংখ্য শিশুকে। নাহিদা তার ওয়েবসাইট জুড়েও প্রতিনিয়ত বলে চলে তাদের কথা।

 

বছর ১৬-র আবদল্লা কাসেককে দিয়েই শুরু করা যাক। “জানেন কয়েকমাস আগেও মাত্র ১৫ মিনিটে আমি আমার স্কুল জুলিস পাবলিক হাই-এ পৌছে যেতাম। আর এখন আমার দুই বড় ভাইয়ের কাঁধে ভর করে আমাকে নামতে হয়। আমরা থাকি গাজার শেখ রেড়োয়ানে তিনতলার ওপর একটা অ্যাপার্টমেন্টে। আর সেই ঘরে ঢোকবার দরজাটা এতটাই ছোট যে আমার হুইলচেয়ারটা আটকে যায়, তাছাড়া বাড়িটায় কোনও র‌্যাম্পও নেই যা দিয়ে সহজে হুইলচেয়ারে ওঠানামা করা যাবে। তাছাড়া ইস্কুলে যাওয়ার রাস্তাটাও কাঁচা আর বালি ভর্তি বলে হুইলচেয়ার কিছুতেই এগোতে চায় না। আগে অবশ্য এসব কিছুই বুঝতাম না। তবে আমার মত হুইলচেয়ারে বসা ছাত্রের সংখ্যা দিন কে দিন বাড়ার কারণে এখন নিচের তলাতে আমাদের ক্লাস হয়। অবশ্য সব ধরনের সুবিধা যে আমরা পাচ্ছি এমন নয়। যেমন টয়লেট, লাইব্রেরি, ল্যাবরেটরি এগুলো নিচের তলায় নেই। দিনে তিনটের বেশি ক্লাস করতে পারি না, কারণ তারপরই আমাকে ফিজিক্যাল থেরাপির জন্য যেতে হয়। ইস্কুলে ইংরাজি এবং অঙ্কের ক্লাস মিস করবার জন্য এখন সপ্তাহে দুবার প্রাইভেট টিউশনি নিতে হয়। কিন্তু তাতেও সহপাঠীদের সঙ্গে তাল মেলাতে পারছি না। পিছিয়ে পড়ছি। গত মাসের হাফ-ইয়ারলি পরীক্ষাটা দিতে পারিনি অপারেশনের কারণে, কাটা পায়ের হাড়টা যাতে বাইরের দিকে আর বেরিয়ে না আসে, নতুন করে সমস্যা না তৈরি করে, তার জন্য ২৪ অক্টোবর আবার অপারেশন হয়েছে। টানা কয়েক সপ্তাহ হাসপাতালে ছিলাম, তারপর এখন বাড়িতে… পুরোপুরি সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত ইস্কুলে যেতে পারছি না। আমি সব সময় স্বপ্ন দেখতাম আমি ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে পড়াশুনো করব, কিন্তু এই নতুন পরিস্থিতিতে আমি জানি না আমার জীবন কী হবে! তার ওপর আমাদের নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবার। পরিবারের একমাত্র উপার্জনকারী হলেন আমার বাবা। স্বাস্থ্যমন্ত্রকের তথ্য বিভাগে চাকরি করেন। বেতন হিসেবে হাতে পান ৪০০ ডলার। আমার পা-কাটার আগে সংসারটা কোনও মতে চলে যেত আর এখন আমার জন্যই সংসারের খরচ হয়ে গেছে দ্বিগুণ। সরকারি হাসপাতালে ওষুধ না থাকার কারণে অ্যান্টেবায়োটিক, পেনকিলার এসব কিনতে দু সপ্তাহ অন্তর আমার জন্য আমার পরিবারকে ৩০-৫০ ডলার খরচ করতে হয়। প্রাইভেট টিউশন, স্কুলে আসা-যাওয়া, সপ্তাহে তিনদিন ফিজিক্যাল থেরাপির জন্য যাতায়াত… এখন সব ক্ষেত্রেই আমার জন্য ট্যাক্সি লাগে, মানে খরচ ই খরচ। বাকি জীবনটাও অন্যের ওপর নির্ভর করা ছাড়া আমার গতি নেই। কিন্তু কেন এমন হল? কেন বাকি জীবনটা আমাকে হুইলচেয়ারে কাটাতে হবে? কারণটা ইজরায়েল। হ্যাঁ, দিনটা ছিল ১৪ মে, প্যালেস্তিনীয়দের প্রতিবাদের একটি দিন। ‘গ্রেট মার্চ’ নামে গাজা আর ইজরায়েলের ৬৫ কিমি সীমানা বরাবর যে প্রতিবাদ শুরু হয়েছিল মার্চ ২০১৮ থেকে, যে প্রতিবাদের মূল উদ্দেশ্য ছিল ১৯৪৮ সালে যে প্যালেস্তিনীয় পরিবারগুলো পালিয়ে এসেছিল এবং গত ১১ বছর ধরে যাদের সমুদ্রতীরবর্তী ভূখণ্ডে অবরুদ্ধ করে রাখা হয়েছে তাদের ঘরে ফেরার অধিকার দিতে হবে। সেদিন বেলা ১টা নাগাদ গাজার উত্তর-পূর্ব স্ট্রিপে কাঁটাতারের বেড়া থেকে মাত্র ১০ পা দূরে মালাকা স্কোয়ারে বসে আন্দোলনকারীরা কতটা তীব্রভাবে প্রতিবাদ করছে। দেখছিলাম, হঠাৎ দেখলাম একটা বুলেট আমার ডান-পা ভেদ করে বাঁ-পা দিয়ে বেরিয়ে গেল। এরপর আমাকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল গাজার সবচেয়ে বড় সরকারি হাসপাতাল আল-সিফা-তে। কিন্তু সেখানে আমার মত আহতদের সংখ্যা এত ছিল যে আমার অপারেশন শুরু হয়েছিল রাত ১০টা নাগাদ। ততক্ষণে আমার প্রচুর রক্তক্ষরণ হয়ে গেছে। তারপর দু-দুটো অপারেশন সহ্য করতে হয়, শেষ পর্যন্ত দুটো পা-ই বাদ দিতে হয়। ডাক্তার বলেছে আরও ৬ মাস থেরাপি নিতে হবে, তবে কৃত্রিম পা লাগাবার মত উপযুক্ত অবস্থায় পৌঁছাব। গ্রেট মার্চের ঘটনায় ইজরায়েল সেনার গুলিতে ২১০ জনের বেশি প্যালেস্তিনীয় মারা যান, যাদের মধ্যে ১৯ শতাংশ ছিল আমার মত শিশু-কিশোর। সেই প্রতিবাদ-আন্দোলনে প্রায় ১০০০০-এর কাছাকাছি প্যালেস্তিনীয় মানুষ আহত হন, যার মধ্যে ১৮০০ শুধুই শিশু ছিল। গাজার সরকারি ইস্কুলে নথিভুক্ত ২১০ জন ছাত্রের মধ্যে ৯২ জন আঘাতের কারণে শারীরিকভাবে এতটাই অসমর্থ যে তারা এখন আর ইস্কুলে যেতে পারে না।

ওয়াসেম মাহমুদ— “আমি ওয়াসেম মাহমুদ, বয়স ১৫। মাহমুদের বাড়ি গাজা স্ট্রিপের উত্তরে জাবালার আবু সাফিয়া জেলায়। গ্রেট মার্চের সময় গাজা স্ট্রিপ জুড়ে গাজা-ইজরায়েল সীমানা বরাবর ৭০০ মিটারের মধ্যে বেশ কয়েকটা তাঁবু টাঙানো হয়েছিল। তেমনি একটি তাঁবুর ভেতর প্রতিবাদের প্রতীক স্বরূপ ওখানকার চিরাচরিত নাচ ‘ডাবকে’ চলছিল। আমি এতটাই মন দিয়ে অনুষ্ঠানটা দেখছিলাম প্রথমটা বুঝতেই পারিনি, হঠাৎ মনে হল আমার ডান পা-টা অসাড়… আমি আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারছি না… মাটিতে পরে যাই। ইজরায়েলি স্নাইপার আমাকে গুলি করে।”

মাহমুদ অল-বানেন সরকারি ইস্কুলে নাইন্থ গ্রেডে পড়ত। বাড়ি থেকে মাত্র ১ কিমি দূরে তার ইস্কুল। রোজ সে হেঁটেই ক্লাসে যেত। কিন্তু ডাক্তার তার পায়ে ধাতুর পাত বসানোর পরও ক্র্যাচ নিয়ে হাঁটতে তার প্রচণ্ড কষ্ট হয়। তবু ক্র্যাচে ভর করেই যন্ত্রণা নিয়ে প্রতিদিন ক্লাসে পৌঁছতে হয় মাহমুদকে। কারণ মাহমুদের পরিবারের অর্থনৈতিক যে পরিস্থিতি তাতে করে ট্যাক্সি ভাড়া দিয়ে তার পক্ষে ইস্কুলে যাওয়াটা অসম্ভব। ৩ বছর আগে বাবা মারা গেছেন। তাদের পরিবার মাসে মাত্র ৩৫০ ডলার পেনশন পায়, যা দিয়ে কোনও মতে মাহমুদের প্রতি সপ্তাহের থেরাপি আর সংসারটা খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছে।

পরের জন আরাফত হার্ব। “আমি সবসময় আমাদের অধিকৃত ভূমিতে ফিরে যাওয়ার স্বপ্ন দেখি। আমার সেই সাহসের কারণেই আমি কাঁটাতার পেরিয়েছিলাম। প্যালেস্তাইনের দিকে আসার আগে পর্যন্ত ১৫ মিনিট আমি ইজরায়েলের সীমানায় পড়েছিলাম। চিকিৎসার ব্যবস্থা না হওয়া পর্যন্ত টানা ব্লিডিং হয়ে যাচ্ছিল। আমার মধ্যে কোনও ভয় ছিল না।”

৩০মার্চ, গ্রেট মার্চের প্রতিবাদ আন্দোলনের প্রথম দিনই আন্দোলনের কর্মসূচি মোতাবেক ১৫ বছরের আরাফত গাজার আবু সাফিয়া অঞ্চলে গাজা-ইজরায়েল সীমান্তের কাঁটাতার পেরিয়ে অন্যদের সঙ্গে ইজরায়েলের সীমানায় যায়, কিন্তু অন্যরা আবার গাজার সীমানায় নির্বিঘ্নে ফিরে আসতে পারলেও আরাফত পারে না, ইজরায়েলি সেনার গুলি সোজা এসে লাগে তার তলপেটে। বুলেটের কারণে তার পেলভিক এরিয়ায় এতটাই ক্ষতি হয় যে গাজার বেইট লাহিয়া হাসপাতালে আরাফতের বেশ কয়েকবার অপারেশন করতে হয়। এরপর আরাফতের আরও দ্রুত আধুনিক চিকিৎসার জন্য তাকে ঈজিপ্টে নিয়ে যাওয়া হয়। এবং সেই চিকিৎসার জন্য তার বাবাকে ১৭০০ ডলার লোন পর্যন্ত নিতে হয়। সেখানে আবার তার দুটো অপারেশন হয় এবং ৩ মাস তাকে ঈজিপ্টে থাকতে হয়। ডাক্তার বলে তার ক্ষত সারতে কমপক্ষে ১ বছর সময় লাগবে। ঘটনার সময় ২০১৮তে আরাফত পশ্চিম গাজার অল-তাকোয়া সরকারি ইস্কুলে টেনথ গ্রেডে পড়ত। আট ভাই-বোন এবং বাবা-মা সকলে মিলে তারা গাজার শেখ রাডোয়ান জেলায় থাকে। আরাফত এখন হুইলচেয়ারে ঘোরাফেরা করতে পারে, তবে শারীরিকভাবে এখনও সে খুবই দুর্বল। এবং যেহেতু ওরা পাঁচতলায় থাকে সেকারণে খুব বেশি চলাফেরার তো প্রশ্নই নেই। আঘাতের কারণে গত বছর সে ফাইনাল পরীক্ষায় বসতে পারেনি৷ এবং এক বছরের বেশি সময় সে ক্লাসে যেতে পারেনি। “আমার স্বপ্ন আমি একজন কাঠমিস্ত্রি হব। এবং ভোকেশনাল কোর্সটা শেষ করব। কিন্তু ইজরায়েলি বুলেট পরপর দুটো বছর আমার জীবন থেকে কেড়ে নিল।”

মহম্মদ সারসোর। গ্রেট মার্চের প্রতিবাদে নিজের আগ্রহেই যোগ দিয়েছিল মহম্মদ সারসোর। অবশ্য সেই আন্দোলনে যোগ দেওয়ার পেছনে মহম্মদের মূল উদ্দেশ্য ছিল বাবাকে সম্মান জানানো। কারণ ২০১৪ সালে ইজরায়েলি বোমারু বিমানের বোমাবর্ষণে তার বাবা নিহত হন। যাইহোক ৮ জুন মহম্মদ যখন অন্য সকলের সঙ্গে মালাকা স্কোয়ারে প্যালেস্তিনীয়দের নিজভূমিতে ফেরার অধিকার নিয়ে স্লোগান দিচ্ছিল সে সময়ই ইজরায়েলি সেনাদের গুলি এসে লাগে তার তলপেটে। অবশ্য গুলি বলাটা ভুল, ইজরায়েলি সেনারা ছুঁড়েছিল রকেট প্রপেল্ড গ্রেনেড যার টুকরো এখনও মহম্মদের মেরুদণ্ডের নিচের অংশে ঢুকে থাকবার জন্য তাকে যন্ত্রণা সহ্য করতে হচ্ছে। বেশিক্ষণ সে চেয়ারে বসে থাকতে পারে না। ডাক্তার বলেছে এই অবস্থায় সে যদি চলফেরা করে তবে হিতে বিপরীত ঘটতে পারে। এমনও হতে পারে, চিরদিনের জন্য তার চলাফেরা করবার ক্ষমতাই হয়ত চলে যাবে। মায়ের উৎসাহেই মহম্মদ ডার-অল-আরকম ইস্কুলে গ্রেড নাইন ক্লাসে আবার যেতে শুরু করেছে। কিন্তু যন্ত্রণার কারণে তার পক্ষে টানা ঘন্টার ঘন্টা চেয়ারে বসে থাকাটা মোটেই সহজ নয়। এতকিছুর মধ্যে সুখবর এটাই যে হুইলচেয়ার ছাড়াই সে এখন হাঁটতে পারে। তবে দৌড়ানো বা ভারী জিনিস বহন কোনটাই সে পারে না। মাঝেমাঝেই তার ইনফেকশন হয়। তাছাড়া থেরাপির জন্য সপ্তাহে দু দিন সে ইস্কুলে যেতে পারে না। “আমি ডাক্তার হতে চাই। আমি জানি এই আঘাতের কারণে ভবিষ্যতে আমাকে অনেক সমস্যায় পড়তে হবে।কিন্তু এই ক্ষত আমার স্বপ্নের পথে কিছুতেই বাধা হতে পারবে না।”

এই পর্যন্ত শোনার পর নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন সারা প্যালেস্তাইন জুড়ে ইজরায়েলি স্নাইপারদের গুলিতে হুইলচেয়ার এবং ক্র্যাচ নির্ভর অনিশ্চিত ভবিষ্যত নিয়ে এক নতুন প্রজন্ম তৈরি হয়েছে, দিন কে দিন যাদের সংখ্যা বাড়ছে। বাড়ছে সেইসব পরিবারের ঋণ, আর হতাশা। তবে ইজরায়েল এতেও ক্ষান্ত হয়নি। প্যালেস্তিনীয় শিশু-কিশোরদের ওপর আরও এক ধরনের টর্চার চালাচ্ছে তারা, এবার শোনা যাক সেসব কথা।

ইজরায়েল অধিকৃত প্যালেস্তাইনে রাত যেই দুই প্রহর পেরোয়… সারা বাড়ি জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে ঘুম, ঠিক তখনই শুরু হয় কড়া নাড়ার আওয়াজ। প্রথমে কড়া, তারপর খট খট দরজায়, তারপর ধীরে ধীরে আওয়াজটা বাড়তে থাকবে দুম দুম, টানা চলতে থাকবে দুমদুম.. দিম.. দিম। আর দরজা খোলা মাত্রই হুড়মুড়িয়ে ঢুকে পড়ে সশস্ত্র ইজরায়েলি সেনা। শুরু হয় ঘরে ঘরে তল্লাশি। আর তল্লাশি চালিয়ে যেই মুহূর্তে তারা কোন শিশু বা কিশোরকে পায়, ওমনি টেনে-হিঁচড়ে বিছানা থেকে নামিয়ে ইন্টারোগেশনের নামে নিয়ে গিয়ে তোলে গাড়িতে। তারপর সদরদপ্তরে নিয়ে গিয়ে শুরু হয় জিজ্ঞাসাবাদ। প্রতি বছর জিজ্ঞাসাবাদের জন্য এইভাবে ইজরায়েলি সেনারা যত সংখ্যক শিশু-কিশোরকে তুলে নিয়ে যায় সেই সংখ্যাটা ৭০০।

“এখানে যে কোনও রাতে ইজরায়েলি সেনারা এসে সদর দরজায় কড়া নাড়ে, তুলে নিয়ে যায় সন্তানদের। তেমনি এক রাত এসেছিল আমারও জীবনে। প্যালেস্তাইনের ১৪ বছরের এক কিশোর কাসাই জামারার মা আমি। সে ছিল এক হাড়হিম করা ভয়ার্ত রাত। রাত তখন ২টো, ইজরায়েলি আর্মির দরজা ধাক্কানোতে আচমকা ঘুম ভেঙে দিশাহারা আমি। কী করবে কিছুই বুঝতে পারছি না। ওদিকে সেনারা চিৎকার করছে। দরজা প্রায় ভেঙে ফেলবার জোগাড়। দরজা খুলতেই হুড়মুড়িয়ে ঢুকে পড়ল তারা। তাদের একটাই টার্গেট কাসাই। আমি চিৎকার করে বলতে থাকি… তোমরা তার কাছ থেকে কী চাও? ওরা আমাকে দাবড়ে চুপ করিয়ে দেয়। ঘুমন্ত ছেলেটাকেই মারতে থাকে, টেনে-হিঁচড়ে বিছানা থেকে নামিয়ে নিয়ে গিয়ে তোলে গাড়িতে। আমি বলতে থাকি ওর তো পোশাকের দরকার। ওরা হাসতে থাকে…। আমি একটা জ্যাকেট দিই ছেলেকে পরবার জন্য। ওরা সেটা নিয়েও হাসাহাসি করতে থাকে। আর বলে, বাঃ এবার এটা আমরাই পরব।”

এরপর ১৮টা রাত বিভীষিকাময় কাটাতে হয় কাসাইকে। কাসাই: “আমাকে যেখানে রাখা হয়েছিল সেখানে একটা বড় মেশিন ছিল, যার সঙ্গে বিদ্যুতের তার যুক্ত ছিল। ওরা চাইত আমাকে ইলেকট্রিক শক দিতে। মাঝে মাঝে আমাকে মেঝেতে ফেলে মারতে শুরু করত। আমাকে যে অফিসার জিজ্ঞাসাবাদ করত তার হাতে সবসময় পাইপের মত একটা চাবুক থাকত, যেটা দিয়ে আমাকে মারত।”

ফাদি মাহফুজ, বয়স ১৫: “আমি পালাইনি কারণ আমার কিছুই করার ছিল না। ইজরায়েলি সেনারা আমাকে লক্ষ করেই গুলি করে। ৩-৪টি রবার বুলেট সরাসরি আমার লাগে। এমনকি কাঁদানে গ্যাসের শেলও আমার ওপর এসে পড়ে। জিজ্ঞাসাবাদের সময় ওদের হাতে ইলেকট্রিক ব্যাটন থাকত, যেটা দিয়ে ওরা আমাকে মারত। আর ওরা সবসময় মুখোশ পড়ে থাকত। এক অফিসার একবার মুখোশ খুলেছিল, তাতে বুঝেছিলাম ওরা প্রত্যেকেই মুখে কালি মেখে থাকে। জিজ্ঞাসাবাদের সময় ওরা নিচু স্বরে কথা বলত, আর একনাগাড়ে কঠোরভাবে তাকিয়ে থেকে আমাকে ভয় দেখাত। তার সঙ্গে চলত ইলেকট্রিকের শক।” পাথর ছোঁড়ার শাস্তি হিসেবে মাহফুজের ৮২ দিন জেল হয়।

ইসলাম দারাউব, বয়স ১৪: “ওরা আমাকে একটা কাগজে সই করে দিতে বলে। আমি বলি এটা তো হিব্রুতে লেখা। আমি হিব্রু পড়তে পারি না, আপনি আমাকে পড়ে শোনাবেন? সে বলে এটা তোমার রিলিজ, তোমার একটা সইয়ের প্রয়োজন। পরে কোর্টে আমি সেটা সই করি। আমি অবাক হয়ে যাই যখন জানতে পারি ওটা আসলে ছিল আমার স্বীকারোক্তির কাগজ।”

ইজরায়েল অধিকৃত প্যালেস্তাইনে যে সমস্ত ইস্কুলে প্যালেস্তিনীয় ছাত্ররা পড়ে সেখানে নিত্যদিনের ঘটনা হল যখনই ইস্কুলের সামনে ছাত্ররা জড়ো হয় সে ইস্কুল শুরুর সময়ই হোক বা টিফিনবেলায় বা ইস্কুল ছুটির সময়, ইজরায়েলি সেনারা আচমকা টিয়ার গ্যাসের শেল ছুঁড়তে শুরু করে যেন ওই শিশু-কিশোররা প্ররোচিত হয়… পাথর ছোঁড়ে… আর সেই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে তাদের ওপর অত্যাচার করা যায়, তাদের জেলে পোড়া যায়। ওই শিশু-কিশোরদের মানসিক বিকাশকেই যেন প্রশ্নচিহ্নের মুখে দাঁড় করিয়ে দেওয়া যায়।

নাহিদার কাছ থেকেই আমরা জানতে পারি ২৬ বছরের মিশরের মেয়ে আসমা মাহফুজের কথা, যার ডাকে সাড়া দিয়ে হাজার হাজার মানুষ তাহরির স্কোয়ারে জড়ো হয়েছিল। নাহিদার কাছ থেকেই জানতে পারি, ১০বছরের শাহদের কথা। জানার কথা, ৮ বছরের নাঘামের কথা, লিমার কথা। নাহিদা এই প্রত্যেক শিশুর কবিতার অনুবাদ করেছেন। তবে এত কম সময়ে নাহিদার কথা বলে শেষ করাটা বড় মুশকিলের কারণ নাহিদাকে জানতে জানতে নিজের অজান্তেই এমন এক প্রান্তরে পৌঁছেছিলাম যেখানে থাকে থাকে সাজানো রয়েছে অনবরত ঘটে চলা প্যালেস্তিনীয়দের ওপর অত্যাচারের… সেই সঙ্গে পাল্টা প্রতিরোধের অসংখ্য উদাহরণ। যেন এক মহাফেজখানার মুখোমুখি আমি।

কবিতার ভাষান্তরে: সোহেল ইসলাম

গল্প হলেও সত্যি

হাসান আমার একমাত্র সন্তান
জন্ম: ৯ এপ্রিল
জিজ্ঞেস করতেই পারো,
এ গল্প কেন শোনাচ্ছি?
কী এমন ঘটেছিল ৯ এপ্রিল
কী ঘটেছিল হাসানের সঙ্গে, যা জানা জরুরি

যদি তুমি এই জন্মভূমির হও
যদি তোমার বিবেকে ঘুন ধরে না থাকে
তাহলে খুব একটা কষ্টের নয়,
মনে কর ১৯৪৮এর ৯ এপ্রিল―
আমাদের সব কিছুর দখল নিতে
একনাগাড়ে শিশু আর মায়েদের হত্যা চলেছিল
যেন হোলির দিনে কেউ হাতে তুলে নিয়েছে রঙিন পিচকারি
কাউকেই বাঁচানো যায়নি,
শুধু বেঁচে ছিলেন, আছেন
আমাদের হত্যাকারী

নতুনের আগমনে
কেউ আজান দেন, কেউ কেউ শঙ্খে দেন ফুঁ
আমরা বুক চাপড়াই
হা-হুতাশ করি,
এখনও আমাদের স্মৃতি দগদগে

আমাদের ভেতর শূন্য, বাহির শূন্য
আমাদের কোনও ইচ্ছে নেই
কোনও রং নেই
শুধু মরুঝড় তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায় আমাদের

তোমরা,
বিছানার চাদরে, দরজা-জানালার পর্দায় ফেব্রিক করো
আমাদের ফেব্রিক, মায়েদের মুখে সন্তানের রক্তের ছিটে দিয়ে আঁকা
সেই তোমরা এসব দেখতে এসে যদি পিছিয়ে পড়ো
কিংবা হারিয়ে ফেলো পথ
মনখারাপ কোরো না,
রাস্তায় রাস্তায়
দেয়ালে দেয়ালে ছড়িয়ে থাকা রং দেখে আনন্দ হবে তোমাদের
উল্লাসে নেচে উঠবে তোমরা
ঘোর ভাঙতে সময় লাগবে না,
একটু কাছে গেলেই দেখতে পাবে
কত বিচিত্র ছবি এঁকে গেছেন বন্দুকধারীরা
তোমরা শুধু ওটুকুই দেখতে পাবে,
আড়ালের খবর জানতেও পারবে না
এই রং আমাদের জীবন বদলে দিয়েছে ১৯৪৮এর পর থেকে

৯ এপ্রিল কত না শিশুই জন্মেছিল
মায়েদের বুকে ওরা ভয় হয়ে বেঁচে আছে
এছাড়া তাদের আজ কোত্থাও কোনও চিহ্ন নেই
আমাদের হাসির মধ্যে
আমাদের বেঁচে থাকার মধ্যে সেই লাল রঙের ভয়

থাক ওসব,
মুডের বারোটা বাজিও না
তোমরা তো ঘুরতে এসেছ
দেখতে এসেছ প্যালেস্তাইন
দেখতে এসেছ খাঁচার ভিতর পাখির দৌড়াদৌড়ি

 

হন্যে হয়ে খুঁজছি

এদিকে দেখুন
এই আমি,
যার কবিতা, ভালোবাসার কথা বলে
যে রং তুলি দিয়ে প্রজাপতি আঁকতে ভালোবাসে
ফুল এবং নাচের প্রতি যার বরাবরের দুর্বলতা

এই আমি,
যে চোখ বুজেও শিশুদের হাসি দেখতে চাই
মাথায় তাক করা একে–৪৭ নয়
তাদের গল্প শোনাতে চাই
দূরদেশের কোনও এক রাজারানির গল্প
যেখানে যুদ্ধ নেই
মেশিনগান নেই
বোমার ছিটকে আসা ফুলকি নেই

কিন্তু, কীভাবে?

মনুষ্যত্ব, তুমি কোন মুলুকে মুখ লুকিয়েছ
এই কসাইখানায় দাঁড়িয়ে
আমার হাত-পা ঠান্ডা হয়ে আসছে
আমি আর নিতে পারছি না
আমি বধির হয়ে যাচ্ছি― কান্না ও গুলির আওয়াজ
আমি আর নিতে পারছি না

মনুষ্যত্ব,
তুমি কোথায়?
কেন মুখ ঘুরিয়ে রেখেছ
কেন তাকিয়ে আছ অন্যদিকে
শিশুদের নাক মুখ দিয়ে রক্ত গড়াচ্ছে
তাকাও
দেখো গাজার দিকে
নুইয়ে পড়া মায়েদের মুখের দিকে তাকাও

যথেষ্ট হয়েছে তোমার লুকোচুরি
দেখেও না দেখার ভান
বুলেটের বরাদ্দ বাড়িয়ে শিশুদের খুন করছে রাষ্ট্র
যন্ত্রণায় ডুকরে উঠছে মায়েরা
এবার তো মুখ তোলো

 

কোনওদিনও কি এখান থেকে বেরিয়ে আসতে পারব

ঘড়ির যন্ত্রগুলো কাজ বন্ধ করার পর থেকে
জীবন ওখানেই থেমে আছে
সাত বছর আগে যেমন রেখে এসেছিলাম
শুধু আমিই এগিয়ে গেছি
খণ্ড খণ্ড হয়ে এগিয়ে গেছি

নিজের শহর ছেড়ে যেতে বাধ্য করা হয়েছিল আমাকে
বাধ্য করা হয়েছিল রিফিউজির জীবন বেছে নিতে
৩৭ বছর পার হল
আজ আর কোনও কিছুই সেভাবে মনে পড়ে না
যেন বইটা খোলা পড়ে আছে
অক্ষরগুলো সময়ের সঙ্গে ধুঁকতে ধুঁকতে আবছা হয়ে গেছে
বাড়ির উঠোন,
বাগান,
সামনে দিয়ে চলে যাওয়া ইটপাতা রাস্তা
কেউ শব্দ দিয়ে একটা চিঠি লিখে পাঠাল না কোনওদিন
ফলে না লেখাই থেকে গেল সব

তবুও জীবন ওখানেই থেমে আছে
দিনের পর দিন গেল
চুলগুলো সাদা হল
অন্ধকার গিলে নিল লোহা আর মরচের গান

ও প্যালেস্তাইন
হাহাকার নিয়ে
শেকড় নিয়ে আমি আবার ফিরব
কাঁধে করে বয়ে বেড়ানো রিফিউজির ভার
আমি ফিরিয়ে দিয়ে যাবই

জানি না,
কেন জীবন ওখানেই থেমে আছে
তখন আমি ৭
আজও আমি তাই
ততদিন ৭ থাকব, যতদিন না আমি ফিরে যেতে পারি
যতদিন না ঘড়ির অংশ জুড়ে
দিন ফিরিয়ে আনতে পারি

আমি বিশ্বাস করি
প্যালেস্তাইনে কোনও যুদ্ধ হবে না আর
বাগানে ফুটবে ফুল
সামনের রাস্তা দিয়ে ফিরে আসবে বাবা আমার নাম নিতে নিতে

 

বিশ্বাস

তুমি আমাকে বুলেটে ঝাঁঝরা করতেই পারো
চাইলে উপড়ে নিতে পারো চোখ
কিন্তু, ভেতরে যে আলো জ্বালিয়ে বসে আছে
তাকে শেষ করবে কী করে
আমাকে শেষ করবে কী করে

তুমি চাইলেই বাড়ি ভেঙে পড়বে এইমাত্র
গ্রামকে গ্রাম ধুলো হয়ে উড়বে
কিন্তু আমার আশা তো জানালাগুলোকে নিয়ে
ওগুলো বন্ধ করবে কী করে

তোমাদের গ্রেনেডের বিরুদ্ধে
ছুড়ে মারা পাথরই আমাদের যুদ্ধ জয়ের উল্লাস
তাকে ধ্বংস করবে কী করে

শাসন কায়েম করতে
তুমি আমাকে ভয় দেখাতে পারো
খুন করে ফেলে রেখে যেতে পারো
তবুও আমাকে শেষ করতে পারবে না
না মিসাইল দিয়ে, না ভয় দেখানো দিয়ে

জেরুজালেমে জল্লাদের নাচ চলছে
দাবি করেছিলে, ৬ দিনে শান্ত হবে বিপ্লব
এই তার নমুনা
এই তোমার প্রতিশ্রুতি
এই তোমার উন্নয়ন
এফ-১৬ ফাইটারের বিরুদ্ধে পাথর ছুঁড়ে যুদ্ধ করতে হচ্ছে

যাও আমেরিকার পা চাটো
কার্তুজ আর মাইন কেনো তেল বেঁচে

ওসব দিয়ে আমাদের কিচ্ছু ছিঁড়তে পারবে না

 

সাত থেকে সতেরো

১.
যখন আমি সাত
কপালে বন্দুক ঠেকিয়ে
জন্মভূমি থেকে
প্যালেস্তাইন থেকে বার করে দেওয়া হয়েছিল আমাদের
দেশের মানচিত্রে
কিংবা নাকবার কোথাও আমাদের নিশান রাখতে দেওয়া হয়নি

আমি সেই থেকে
ভেজা চোখে
জেরুজালেমের দিকে তাকিয়ে আছি

আমার প্রিয় জেরুজালেম

 

২.
যখন আমি সতেরো
আমার পরিবার লিবিয়া ছেড়েও চলে গেল
সমস্ত বন্ধুকে পেছনে ফেলে
একটা দেশের জন্য
আমাকেও যেতে হল

প্যালেস্তাইন ছেড়ে আসার পর
আমি ভেবেছিলাম―
আর কোনও বন্ধু হারাব না
কোনও ভালোবাসাও না
কোনও বিচ্ছেদ আমাকে আলাদা করতে পারবে না কোনওদিন

কিন্তু হায়,
আবার আমাদের উদ্বাস্তু হতে হল
আরও একবার…