সুমন কল্যাণ মৌলিক
প্রাবন্ধিক, মানবাধিকার কর্মী
কর্পোরেট মিডিয়ার লাগাতার কুৎসা, আইটি সেলের ভুয়ো খবরের বন্যা, সংসদীয় রাজনৈতিক দলগুলির গেল গেল রব, সিভিল সোসাইটির একটা অংশের আর্তনাদ সত্ত্বেও যে সত্যটা লুকোনো যাচ্ছে না তা হল ২০২১ সালের ২৬ জানুয়ারি রাজধানীর রাজপথে আমাদের অন্নদাতারা এক গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসের জন্ম দিয়েছেন। এটা অস্বীকার করছি না যে ইতিহাস গড়ার এই প্রক্রিয়ায় কিছু অবাঞ্ছিত ঘটনা ঘটেছে, রাষ্ট্রযন্ত্রের পরিকল্পিত চক্রান্ত (দীপ সিন্ধু ও তার দলবলের কার্যকলাপ) সামান্য অংশে গন্ডগোল পাকাতে পেরেছে, কিন্তু সামগ্রিকতার বিচারে এই ট্র্যাক্টর যাত্রা অসাধারণ, অভূতপূর্ব এবং অবিস্মরণীয়। যারা বস্তুবাদে বিশ্বাস করেন তারা কখনও ঘটনাকে তার প্রেক্ষিত থেকে বিযুক্ত করেন না। তাই আন্দোলনে যে হিংসার অভিযোগ উঠেছে তাকে সমালোচনা করতে হলে অবশ্যই মনে রাখতে হবে যে দেশে শতকরা ৫৫ ভাগ লোক প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কৃষিকাজের সঙ্গে যুক্ত, তাদের সঙ্গে কোনওরকম আলোচনা না করে কর্পোরেট স্বার্থে তিনটি এমন কৃষি আইন তৈরি করা হয়েছে যা তাদের অস্তিত্বকে বিপন্ন করবে। মনে রাখতে হবে এই আইনের বিরুদ্ধে পাঞ্জাব, হরিয়ানা, উত্তরপ্রদেশ ও রাজস্থান সহ ভারতের বিভিন্ন প্রদেশে ধারাবাহিক আন্দোলন হয়েছে কিন্তু সরকার কোনও প্রতিক্রিয়া দেখায়নি। ফলত বাধ্য হয়ে লক্ষ লক্ষ কৃষক তাদের পরিবার, কৃষিকাজ ছেড়ে এই হাড়কাঁপানো শীতে দিল্লিতে জমায়েত হয়েছেন, ৬২ দিন ধরে সমস্ত গণতান্ত্রিক রীতিনীতির প্রতি দায়বদ্ধতা দেখিয়ে আন্দোলন করছেন, ১১ বার সরকারের সঙ্গে আলোচনায় বসেছেন, কিন্তু সরকারের তরফে কোনও সদর্থক প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি। ১৭১ জন বীর কৃষক শহীদ হয়েছেন। কিন্তু তাতেও সরকারের হুঁশ ফেরেনি। উল্টে প্রথম দিন থেকে সরকারের মন্ত্রী, নীতিপ্রণেতা, শাসকদলের বিভিন্ন নেতা এই আন্দোলনকে ‘খলিস্তানি’, ‘মাওবাদী’, ‘দেশদ্রোহী’ বলে দেগে দিয়েছেন এবং আলোচনা চলাকালীন দেশের প্রধানমন্ত্রী বিভিন্ন পাবলিক ফোরামে এই বিতর্কিত আইনের পক্ষে সওয়াল করে গেছেন। একথাও ভুলে গেলে চলবে না যে প্রজাতন্ত্র দিবসের ঘটনার আগে থেকেই আন্দোলনের নেতাদের বিরুদ্ধে ন্যাশানাল ইনভেসটিগেটিভ এজেন্সি (এনআইএ) লেলিয়ে দেওয়া হয়, ঘটনার দিন পুলিশের পক্ষ থেকেই প্রথম লাঠিচার্জ ও টিয়ার গ্যাসের সেল ফাটানো হয়, এমনকি অনুমতিপ্রাপ্ত পথেও পুলিশের পক্ষ থেকে ব্যারিকেড দেওয়া হয়। একজন কৃষক শহীদ হন। এই প্রেক্ষিতকে অস্বীকার করে শুধুই কৃষকদের একটা ক্ষুদ্র অংশকে সমালোচনা করা, আর যাই হোক বস্তুবাদী দ্বান্দ্বিকতা হতে পারে না। ২৬ জানুয়ারি দুপুরবেলা থেকে একটা খবর (কর্পোরেট মিডিয়া ও বিজেপির আইটি সেলের সৌজন্যে) দাবানলের গতিতে ছড়িয়ে পড়ে যে লালকেল্লায় জাতীয় পতাকা সরিয়ে দেশদ্রোহী কৃষকেরা খলিস্তানি পতাকা উড়িয়ে দিয়েছে। সমস্ত সাক্ষ্যপ্রমাণ থেকে এটা প্রমাণিত যে জাতীয় পতাকা কখনওই নামানো হয়নি। কিছু মানুষ লালকেল্লার দু একটা জায়গায় সংগঠন ও তাদের ধর্মীয় পতাকা উড়িয়েছিল যা অবশ্যই কৃষক সংগঠনগুলির যৌথ সিদ্ধান্তের উলঙ্ঘন এবং সমালোচনাযোগ্য। কিন্তু প্রজাতন্ত্রর প্রজারা লালকেল্লার মত এক জাতীয় সৌধে প্রবেশ করলে, পতাকা ওড়ালে দুর্গের পবিত্রতা নষ্ট হয়— এই রাষ্ট্রীয় প্রচারের পক্ষে দাঁড়ানো এক নির্বোধ যুক্তি ছাড়া আর কিছু নয়। ভুললে চলবে না, ৫ লক্ষ কৃষকের এই জনসমুদ্র রাষ্ট্রের এই প্ররোচনার মুখে দাঁড়িয়ে কখনও কখনও সামান্য বিশৃঙ্খল হতে পারে। এটাও ভুললে চলবে না যে জনতার বিদ্রোহ কোনও সুনির্দিষ্ট চিত্রনাট্য মেনে চলে না।
রাষ্ট্র নির্মিত এই ‘কৃষক সন্ত্রাস’ আখ্যানের ফাঁদে যদি আমরা না পড়ি তবে দেখতে পাব আসলে ২৬ জানুয়ারি দিল্লির বুকে দুটি প্রজাতন্ত্রের গল্প বলা হয়েছে। প্রথমটি রাষ্ট্র কর্তৃক তৈরি করা এক আপাদমস্তক শৃঙ্খলাবদ্ধ নিয়মতান্ত্রিক সামরিক অপেরা, যেখানে রাজপথে সশস্ত্র বাহিনীর সগর্ব কুচকাওয়াজ, রাষ্ট্রের অধিকারে থাকা মারণাস্ত্রের প্রদর্শনী, রাষ্ট্রের উন্নয়নগাথার প্রতীক স্বরূপ সুদৃশ্য ট্যাবলো। ভীমনাদে মনে করিয়ে দেওয়া হয় নাগরিকদের নিরাপত্তার জন্য রাষ্ট্রনায়করা কি ভীষণ আয়োজন করেছেন। রাষ্ট্রের সেই পরম শক্তিধর মূর্তি দেখে প্রজা প্রশ্নহীন আনুগত্যে মেনে নেয় রাষ্ট্রের অপার মহিমা। নির্দিষ্ট সময় অন্তর হাততালি দেওয়া ছাড়া প্রজার সেখানে আর কোনও কাজ নেই। শাসক দল, তাবৎ বিরোধী দল, আমলা, নীতিপ্রণেতা, মিডিয়া— সবাই সেই গ্র্যান্ড ন্যারেটিভের অংশ। ইতিহাস সাক্ষী ১৯৫০ সালের ২৬ জানুয়ারি মুন্ডাকা উপনিষদের ‘সত্যমেব জয়তে’ উচ্চারণ করে যে ভারতীয় প্রজাতন্ত্র তার যাত্রা শুরু করেছিল সেখানে আজ পর্যন্ত একটা ন্যারেটিভেরই মৌরসিপাট্টা ছিল। এই প্রথম আমরা দেখলাম লক্ষ লক্ষ কৃষকের উপস্থিতি ও প্রাণবন্ত অংশ গ্রহণে আর এক নতুন প্রজাতন্ত্রের গল্প। যে ন্যারেটিভ অসম্পূর্ণ, হয়তো আপাত-বিশৃঙ্খল— কিন্তু তার পরতে পরতে লুকিয়ে আছে নাগরিকের স্বপ্ন ও কল্পনা। এই প্রজাতন্ত্র মনে করে দেশ কোনও সামরিক বাহিনী দ্বারা ঘিরে থাকা মানচিত্র নয়, দেশ মানে দেশের মানুষ, তাদের ভালেমন্দ, তাদের আশা-নিরাশা। আমাদের অন্নদাতারা মনে করিয়ে দিলেন প্রজাতন্ত্রের প্রকৃত অর্থ। ভারতের ইতিহাসে এই প্রথমবার আমরা প্রজাতন্ত্রের উদযাপনে ‘we the people’-কে ভরকেন্দ্রে দেখলাম। তাই তো স্থিতাবস্থার সমর্থকদের এত অস্বস্তি, এত চিল-চিৎকার।
আজ এই কৃষক আন্দোলন শুধুমাত্র কর্পোরেটমুখী কৃষি আইন বাতিল ও দেশের মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা বজায় রাখার আন্দোলনের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। এ আন্দোলন এক প্রজাতন্ত্র ফিরে পাওয়ার লড়াই যে প্রজাতন্ত্রে দেশের মানুষ চিরকালই প্রান্তিক থেকেছে এবং বর্তমান সময়ে তার সেই প্রান্তিক অবস্থানটুকুও বিপন্ন। বিশেষ করে ২০১৪-পরবর্তী সময় থেকে আমরা ধারাবাহিকভাবে প্রত্যক্ষ করছি আমাদের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান, দেশভাবনা, সম্প্রীতি, অধিকারের উপর আক্রমণ। নোট বাতিল, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী এবং যুক্তরাষ্ট্রীয় অর্থকাঠামোতে কৌশলগতভাবে দুর্বল করে দেওয়ার জন্য জিএসটি, রাষ্ট্রের সম্পদগুলিকে জলের দরে কর্পোরেট বেনিয়াদের কাছে বেচে দেওয়া আর দেশের মানুষদের নিজেদের মধ্যে লড়িয়ে দেবার জন্য নাগরিক আইন— অন্তহীন ধ্বংসের কথকতা। তারপর এল মাত্র চার ঘন্টার নোটিশে পৃথিবীর কঠোরতম লকডাউন যার ফলে হাজার হাজার অভিবাসী শ্রমিক তাদের জীবনজীবিকা থেকে ছিন্নমূল। আর এই অতিমারির সুযোগকে কাজে লাগিয়ে শ্রমিক মারা শ্রমকোড, গরীব মানুষের সন্তানকে শিক্ষা থেকে বিযুক্ত করার নীল নকশা নয়া শিক্ষানীতি। সেই পরিকল্পনারই অংশ নয়া কৃষি আইন। শাসকেরা ভেবেছিল এই পরিস্থিতিতে খুব একটা প্রতিবাদ হবে না। কিন্তু কৃষকরা প্রত্যাঘাত করেছেন। অধ্যাপক অমিত ভাদুড়ি তার সাম্প্রতিক লেখায় খুব সঠিকভাবে মন্তব্য করেছেন কৃষির কর্পোরেটকরণ আসলে ভারতীয় গণতন্ত্র এবং সাংবিধানিক অধিকারের কর্পোরেটকরণের সূচনা মাত্র। কৃষকরা সেই আসন্ন বিপদকে উপলব্ধি করেছেন এবং সমগ্র দেশের লড়াই লড়ছেন। সেই লড়াইয়ের ক্ষেত্রে কখনও এক কদম এগিয়ে দুকদম পিছোতে হতে পারে, আপাত পরাজয় হতে পারে, কিন্তু তাতে লড়াইয়ের ন্যায্যতাটা শেষ হয় না। এই ট্র্যাক্টর যাত্রা, দিল্লির মাটি কামড়ে অবস্থান প্রজাতন্ত্রকে ফিরে পাওয়ার লড়াইয়ের এক একটা অধ্যায়। এই লড়াইয়ের ময়দানে নিরপেক্ষতার কোনও জায়গা নেই।
সংযোজনী: এই লেখা যখন শেষ করলাম তখন সংবাদমাধ্যমের কল্যাণে রাষ্ট্রের সন্ত্রাসের নকশাটা আরও স্পষ্ট হয়ে উঠছে। গাজিপুর সীমান্তে অবস্থিত কৃষকদের দুদিনের মধ্যে জায়গা খালি করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। সেখানকার জল, বিদ্যুৎ সংযোগ ছিন্ন করা হয়েছে, ব্যাপক সংখ্যায় আধা সামরিক বাহিনীর সমাবেশ করা হয়েছে সিংঘু, টিকরি ও গাজিপুরে। আন্দোলনের নেতৃত্বের বিরুদ্ধে লুক আউট নোটিস জারি করা হয়েছে ও পরিকল্পিতভাবে পরিচিত মুখগুলির বিরুদ্ধে জনরোষ তৈরি করার চেষ্টা চলছে (তথ্যসূত্র: আজ সকালে প্রকাশিত যোগেন্দ্র যাদবের ভিডিও বার্তা)। সরকারের এই ভূমিকা প্রত্যাশিত, কিন্তু প্রতিরোধের এই তরঙ্গকে বাঁচিয়ে রাখতে আমাদের সক্রিয় হতেই হবে। এ সময় দাবি করছে কৃষক, শ্রমিক সহ সমস্ত গণতান্ত্রিক শক্তির ইস্পাতকঠিন জোট যা নিশ্চিতভাবে অন্নদাতাদের লড়াইকে শক্তিশালী করবে।