শৈলেন সরকার
১৪ মে, ২০১৯। কলকাতা শহরে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও বিজেপি সরকারের দ্বিতীয় প্রধান মুখ অমিত শাহের রোড শো। রাজনৈতিক হিন্দুত্ববাদীদের রোড শো থেকে ভাঙা হল ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের মূর্তি এবং খোদ বিদ্যাসাগর-স্থাপিত ও পরে তাঁর নামে নামাঙ্কিত কলেজেই।
৬ ডিসেম্বর, ২০২০। বাংলাদেশের কুষ্টিয়া জেলার কুষ্টিয়া শহরের থানাপাড়ার পাঁচ রাস্তার মোড়ে নির্মীয়মান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের প্রতিকৃতি ভাঙা হল। ধৃতরা এক মাদ্রাসার ছাত্র। তারা স্বীকার করেছে, হেফাজতে ইসলামের বক্তাদের বক্তৃতায় উদ্বুদ্ধ হয়েই এই কাজ করেছে।
বাংলাদেশে শেখ মুজিবের মূর্তি ভাঙা আর পশ্চিমবঙ্গে বিদ্যাসাগরের মূর্তি ভাঙার মধ্যে এক স্পষ্ট আস্ফালন আছে। অর্থাৎ বাংলাদেশের বেলা বক্তব্যটা হল, অনেক হয়েছে, আর নয়, এবার রাজনৈতিক ইসলাম। আর পশ্চিমবঙ্গের বেলায়, এবার জয় শ্রীরাম, আর বাঙালিয়ানা নয়, রাজনৈতিক হিন্দুত্ব শুরু হোক।
ওপার বাংলায় রাজনৈতিক ইসলাম পা ফেলা শুরু করেছে সেই ১৯৭৫-এ মুজিব হত্যার পর থেকেই। ১৯৭২ সালের সংবিধান অনুযায়ী যে বাংলাদেশ ছিল ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র ১৯৮৮ সালে প্রেসিডেন্ট হুসেইন মহম্মদ এরশান নিজের রাজনৈতিক স্বার্থে উলটো পথে হাঁটা শুরু করলেন। বাংলাদেশের রাষ্ট্রধর্ম ঘোষণা করলেন ইসলাম। আর ধর্মের ভূত একবার ঘাড়ে চাপলে যা হয়, সেই ভূত নামানোর সাহস মুজিবের কন্যা শেখ হাসিনারও হয়নি। শুধু তাই নয় হুসেইন মহম্মদ এরশাদের ওই সংবিধান সংশোধনী যে সংবিধানের মূল নীতির অর্থাৎ ধর্মনিরপেক্ষতার বিরোধী তা জানিয়ে একটি মামলা হয়, আর ২০১৬-তে এই শেখ হাসিনার আমলে কোনওরকম শুনানি বা আবেদনকারীর কোনও কথা না শুনেই সে মামলা খারিজ করে দেওয়া হয়।
ওপার বাংলায় এখন হেফাজতের প্রচারকের ছড়াছড়ি। মিজানুর রহমান আজাহারি, গিয়াসুদ্দিন তাহেরি, এনায়ুতুল্লা আব্বাসি, কাজী ইব্রাহিম। এদের কাছে বাংলাদেশিরা আগে মুসলিম পরে বাঙালি। আরবি ভাষা একেবারা আল্লার মুখের ভাষা। হেফাজতিদের ১৩ দফা দাবী অনুযায়ী একেবারে প্রাইমারি থেকে উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত ইসলামি ধর্মশিক্ষা বাধ্যতামূলক করতে হবে। বিদেশি সংস্কৃতির প্রবেশ বন্ধ করতে হবে। অর্থাৎ পাশ্চাত্য সংস্কৃতি, যার জন্যই নাকি নারীরা লজ্জাহীন আচরণ করছে। পুরুষ-নারীর খোলামেলা মেলামেশা নিষিদ্ধ করতে হবে ইত্যাদি ইত্যাদি।
অন্যদিকে বাংলাদেশের জাতির জনক মুজিবর মনে করতেন ‘আমি আগে পৃথিবীর মানুষ, পরে বাঙালি আর তারও পরে মুসলমান।’
এদিকে রাজনৈতিক হিন্দুত্বের প্রচারক বিজেপি-র তাত্ত্বিক ভিত্তি আরএসএস কী বলে দেখা যাক। আরএসএস প্রধান মোহন ভাগবত বলেন, ‘সংস্কৃত ভাষা এইভাবে শিক্ষাদানের ব্যবস্থা করতে হবে যেন প্রত্যেকেই এই ভাষা শিখতে পারে।’ আরএসএস অনুমোদিত ‘ভারতীয় শিক্ষণ মণ্ডল’-এর সনদে আছে ‘ত্রিভাষা সূত্রের বাইরে (সূত্রানুযায়ী হিন্দি তো শিখতেই হবে) একেবারে প্রি-প্রাইমারি থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত সংস্কৃত বাধ্যতামূলক করতে হবে।’ (দ্য প্রিন্ট, ২২ জুলাই, ২০১৯)। ‘সংস্কৃতকে বিশ্বভাষা করতে হবে, তা না করতে পারার জন্যই (হিন্দুধর্ম) বিশ্বধর্ম না হয়ে ভারতীয় ধর্ম হয়ে থেকে গেছে।’ (দ্য হিন্দু, ৭ নভেম্বর, ২০২০)। আর কী আশ্চর্যের ভাবুন প্রায় সব ব্যাপারেই কিন্তু ধর্মান্ধ হেফাজতি আর বিজেপি-র প্রচারকরা একমত। বিজেপি-প্রচারকদের কথামতো, দেশটাকে হিন্দু রাষ্ট্র ঘোষণা করতে হবে। ছেলেমেয়েদের অবাধ মেলামেশা বন্ধ করতে হবে। পশ্চিমা শিক্ষার জন্যই মেয়েদের লজ্জাহীন আচরণ ও এটাই ধর্ষণের কারণ।
বাংলাদেশের মুক্তমনা নাস্তিক চিন্তক জাহাঙ্গীর আলমের মতে ‘আরবি ভাষা আসলে আরব সাম্রাজ্যবাদের ভাষা, আর কোরান এই আরব সাম্রাজ্যবাদের প্রধান হাতিয়ার।’
রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছেন, ‘বঙ্গদেশে আবিষ্কৃত কুলগ্রন্থসমূহে দেখিতে পাওয়া যায় যে, আদিশূর নামক একজন রাজা ভারতবর্ষের অন্য কোনও স্থান হইতে যজ্ঞ করাইবার জন্য বাঙ্গালাদেশে পঞ্চজন ব্রাহ্মণ আনয়ন করাইয়াছিলেন।’(বাঙ্গালার ইতিহাস, প্রথম খণ্ড) কিন্তু এই আদিশূরের সময়কাল বা অস্তিত্ব নিয়ে বা কোন দেশ থেকে আনা হয়েছিল ব্রাহ্মণদের সে সব নিয়ে অনেক মত। নগেন্দ্রনাথ বসুর ‘বঙ্গের জাতীয় ইতিহাস’-এর কথা ধরলে, ‘রাঢ়ীয় কুলমঞ্জরীতে বর্ণিত হইয়াছে, ৬৫৪ শকে অর্থাৎ ৭৩২ খ্রিস্টাব্দে আদিশূর রাজা হন এবং ৬৬৮ শকে বা ৭৪৬ খ্রিস্টাব্দে সাগ্নিক বিপ্রগণ গৌড়ে আগমন কররেন।’ কিন্তু রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় নগেন্দ্রনাথ বসুর এই একই বইয়ে নানা অসঙ্গতির জন্য তাঁর এই মত মেনে নেননি। রমেশচন্দ্র মজুমদার তাঁর History of Ancient Bengal গ্রন্থে লিখেছেন,”King Adisura is the pivot round which the genealogical accounts move. No positive evidence has yet been obtained of his existence, but we have undoubted reference to a Sura family ruling in Western Bengal in the eleventh century.’ আবার আখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘বাঙ্গালার ইতিহাস’ প্রথম খণ্ডে দেখি, ‘জয়পালের অথবা তৃতীয় বিগ্রহপালের রাজত্বকালে বরেন্দ্রভূমির শীয়ম্ব গ্রামে প্রহাস নামে একজন ব্রাহ্মণ দুইটি মন্দির সংস্কার করাইয়াছিলেন। তাঁহার পিতার নামে ত্রিবিক্রম বা বিষ্ণুর একটি মুর্তি প্রতিষ্ঠা করাইয়াছিলেন এবং একটি দীঘিকা খনন করাইয়াছিলেন।’ বিভিন্ন প্রমানসাপেক্ষে রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় এই প্রহাস নামক ব্রাহ্মণের মন্দির স্থাপনকে একাদশ শতাব্দীর ঘটনা বলে মনে করেছেন। অর্থাৎ ঐতিহাসিক দিক থেকে আমরা বঙ্গে ব্রাহ্মণদের আগমনের সময়কাল দশম-একাদশ শতক বলে ধরতে পারি। আর মুসলিমরা? রিচার্ড ঈটন তাঁর Rise of Islam and the Bengal Frontier 1204-1760গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন। ‘A Century later another Arob geographer Mas’udi (d 956) recorded the earliest-known Muslims residing in Bengal.’ অর্থাৎ এটা স্পষ্ট বাংলায় মুসলিমরা ব্রাহ্মণদের থেকে কখনই পরে আসেনি। আর যেহেতু তখনও ভারত বা হিন্দুস্তান বলতে খুব বেশি হলে উত্তর ভারতের ছোট ছোট কিছু অংশই বোঝাতে পারে আর বঙ্গ বা গৌঢ় একেবারে পৃথক তাদের থেকে, শুধু তাই নয়, রিচার্ড ঈটন-এর উল্লেখিত বই অনুসারে তাঁরা ঘৃণাই করত এই অঞ্চলের মানুষদের। ‘Brahmin priest’ দের ‘Taboo’ ছিল ‘about residing in unclean lands to the East’ অর্থাৎ বঙ্গের কোনও হিন্দু যদি মুসলমানদের বহিরাগত মনে করেন তবে মনে রাখতে হবে ব্রাহ্মণ্যবাদ এসেছে ইসলামেরও পরে, অর্থাৎ ইসলাম বহিরাগত হলে ব্রাহ্মণরা আরও বেশি বহিরাগত। মুসলমানেরা যদি সঙ্গে করে তাদের ধর্ম ইসলাম নিয়ে আসে, ব্রাহ্মণেরাও নিয়ে এসেছে তাদের বেদ গীতার জাতপাত বিভাজনের সনাতন ধর্ম। অর্থাৎ দুটোই বাংলার বহিরাগত ধর্ম। বাংলা বা বঙ্গ বা গৌড় তখন অতীশ দীপঙ্কর বা শীলভদ্রের দেশ। বাংলায় ততদিনে বৌদ্ধধর্ম জাঁকিয়ে বসে। একদিকে নালন্দা মহাবিহার, অন্য দিকে বিক্রমশীলা মহাবিহার, পাহাড়পুর, উদ্দণ্ডপুর। বাঙালি বণিকরা তখন নৌবাণিজ্যে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে ভারত মহাসাগরে। ওদিকে উত্তর-পুব ভারত মহাসাগর অঞ্চল থেকে দক্ষিণ পশ্চিম সাগরের শ্রীলঙ্কা। রয়েছে তাম্রলিপ্তের মতো সমুদ্রবন্দর। ব্রাহ্মণ্যবাদীরা বা ইসলাম আসার আগেই বাংলা ভাষার জন্ম হয়ে গেছে। বাংলা তখন পৃথিবীর অন্যতম সমৃদ্ধ এলাকা।
বাংলাদেশী চিন্তক জাহাঙ্গীর আলমের কথা ধরে বলা যায়, সংস্কৃত ভাষাও উত্তর ভারতের এক বিশেষ অঞ্চলের বিশেষ সংস্কৃতির প্রসারণশীল মানসিকতার হাতিয়ার। তাদের বেদ বা গীতাও ছিল তাই। যে কারণে পাল বা সুলতানী যুগে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির যে জাগরণ বা উন্নতি দেখি সেন আমলে তা উধাও। হিন্দু সেন রাজারা পুরোপুরি পৃষ্ঠপোষকতা করত সংস্কৃত ভাষাকে। আর কী আশ্চর্যের মুসলমানদের মধ্যেও ‘সমাজে এক শ্রেণির লোক বাংলা ভাষাকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করত এবং তারা ছিল ওই আশরাফ সম্প্রদায়ভুক্ত।(আনিসুজ্জামান : ‘বাংলার মুসলমানদের পরিচয়-বৈচিত্র্য’ (অষ্টাদশ শতাব্দী অবধি), জ্ঞানতাপস আবদুর রাজ্জাক গুণীজন বক্তৃতা, ঢাকা, ২৯ অক্টোবর ২০১৭। পৃষ্ঠা ৯, ১৩, ১৫)
সহজভাবে বললে, ভাষা গড়ে ওঠে সামাজিকতার কারণেই। পারস্পরিক যোগাযোগের জন্য প্রতিনিয়ত অভিজ্ঞতার মাধ্যমে পাওয়া পারস্পরিক বোধ্য চিহ্ন, সঙ্কেত বা ধ্বনি দিয়েই গড়ে ওঠে ভাষা। আমরা যাকে প্রাকৃত বলি তা ছিল তাই, ‘প্রকৃত’, ‘ন্যাচারাল’। দক্ষিণ এশিয়াতেও। খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম-চতুর্থ শতক থেকে এলিট শ্রেণি বাকি অংশের থেকে নিজেদের আলাদা করার প্রয়াসে নিজেদের মতো করে নিজেদের জন্য ভাষা ‘সংস্কৃত’ করার কাজ শুরু করে। অর্থাৎ ‘দেব ভাষা’র বিশুদ্ধায়ণের কাজ শুরু করে। ‘দেব ভাষা’ অর্থাৎ যে ভাষায় অধিকার থাকবে দেবতা বা প্রকৃত অর্থে শুধু তাদেরই। হ্যাঁ, শুধু তাদেরই, কেননা তাদের তৈরি নিয়মে সমাজের বাকি অংশের পড়াশোনার অধিকারই কেড়ে নেওয়া হবে। জ্ঞানের অধিকার যেন তাদের হাতের বাইরে থাকে। ভাষা দিয়ে এই যে এই যে সামাজিক শ্রেণিবিভাজন তার উদাহরণ পাই ভরতের নাট্যশাস্ত্রে। যেখানে স্পষ্টত উল্লেখ করা হয়, নাটকে সংস্কৃত বা দেব ভাষা হবে সুরুচিসম্পন্ন, উচ্চশিক্ষিত ও উচ্চ-শ্রেণির মানুষের বা দেবতাসদৃশ মানুষের। একই শ্রেণির মহিলারা কথা বলবে সৌরসেনিতে। যারা হারেমে কাজ করবে তারা কথা বলবে মাগধিতে, আর যারা চাকর-বাকর বা নিম্নশ্রেণির তারা কথা বলবে অর্ধমাগধিতে। অর্থাৎ প্রাকৃতে। হাটুরে মানুষের অসংস্কৃত মৌখিক ভাষায়।
আমাদের বাংলায় বহিরাগত ব্রাহ্মণ্যবাদীরা এসে প্রথমেই তাদের নিজের মতো করে বাংলার স্থানীয় ভাষার উপর নিয়ন্ত্রণে সচেষ্ট হয়। বাংলায় বৈশ্য বা ক্ষত্রিয় বর্ণ কোনওকালেই ছিল না, থাকার কথাও নয়। ব্রাহ্মণরা স্থানীয় মানুষদের শূদ্র বলে অভিহিত করল। দুই ধরনের শূদ্র। আর নিজেদের মধ্যেই ভাগ শুরু হল অনেক। সে সব এখানে গুরুত্বপূর্ণ নয়, গুরুত্বপূর্ণ হল এই শূদ্র শ্রেণির মানুষকে তো নিজেদের মুঠোয় রাখতে হবে। অতএব, পরের দিকে পর্তুগিজ বা ইংরেজরা যা করল বা সাম্রাজ্যবাদী শক্তি নতুন ভূখণ্ডে গিয়ে যা করে থাকে এরাও ঠিক তাই করল। অর্থাৎ স্থানীয় ভাষাকে নিজেদের তাঁবে আনার চেষ্টা। পালটে নেওয়া নিজেদের মতো করে। নিজেদের মতো করে স্থানীয় ভাষার ব্যাকরণ তৈরি। স্থানীয় মানুষের মুখের ভাষাটাকেও নিজেদের নিয়ন্ত্রণে এনে পুরো জাতিটাকেই আয়ত্তে আনা। নিজেদের মধ্যে ভাববিনিময় বা শাসকের কাছে আবেদন-নিবেদনের জন্য যেন শাসকের জারি করা শৃঙ্খলার মধ্যেই বন্দি থাকে সবকিছু। কিন্তু শত চেষ্টাতেও এই ক্ষেত্রে ব্রাহ্মণ্যবাদীরা বাংলায় কিন্তু সব সময় সফল হয়নি। ১৮৬৮ সালে হান্টার সাহেব তাঁর ‘অ্যানালস অব রুরাল বেঙ্গল’ গ্রন্থে লেখেন, ‘নিম্ন গাঙ্গেয় প্রদেশে বিশেষত বীরভূম ও সীমান্তবর্তী ভিন্ন সংস্কৃতির অন্য জেলার সাধারণ মানুষ যে ভাষায় কথা বলে সেই ভাষায় এমন সব শব্দ বা পদ ব্যবহৃত হয় যা কিছুতেই সংস্কৃত ভাষা থেকে আহরিত হয়নি। আর লিখিত বাংলা ভাষায় এই সব শব্দ বা পদ বাদ দেওয়া সত্ত্বেও এই সব জেলার কৃষক, পশুপালক বা অরণ্যবাসীরা এই ভাষাতেই কথা বলে। এই ভাষাতেই তারা তাদের ঘর-গেরস্থালির মায়া-মমতা প্রকাশ করে, এই ভাষাতেই তাদের ঘরের কোনও মা তার সন্তানের সঙ্গে কথা বলে।’ (দি অ্যানালস অব রুরাল বেঙ্গল, তৃতীয় অধ্যায়)। অর্থাৎ পলিটিকাল হিন্দুত্ব বা পলিটিকাল ইসলামের হাজার চেষ্টাতেও বাঙালি কিন্তু তার মুখের ভাষা— মাতৃভাষা হারায়নি। টিকিয়ে রেখেছে একেবারে ব্রাহ্মণ বা আশরফি মুসলমানদের থেকে দূরে থাকা ‘প্রাকৃতজন’, প্রকৃত বাঙালিরা।
মাতৃভাষা একটি জাতির জাতিসত্তার প্রধান উপাদান। এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। একই মাতৃভাষা, একই ধরনের ভূগোল ও ইতিহাস নিয়ে তৈরি বাঙালি জাতি জাতিত্বের (ethnicity) বিচারে দক্ষিণ এশিয়ার এবং আলাদা করে শুধু ভারতের বৃহত্তম জাতি ও আরব বা চিনের মান্দারিন বাদ দিলে পৃথিবীর তৃতীয় বৃহত্তম। রাজনৈতিক (political) ইসলাম বা রাজনৈতিক (political) ব্রাহ্মণ্যবাদ বা এখনকার বহুল প্রচারিত হিন্দুত্ব কোনও কালেই বাঙালি মেনে নিতে পারেনি। পশ্চিমবঙ্গের ব্রাহ্মণ্যবাদী নেতৃত্ব যেমন বাংলাভাষা নিজের নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার জন্য (ওদের কথায় ভাষার সৌন্দর্যায়ণের জন্য) ব্যাকরণ ও সাহিত্যসৃষ্টির মাধ্যমে যথেচ্ছ সংস্কৃত শব্দ ঢোকাতে চেয়েছে, তেমনি রাজনৈতিক ইসলাম চেয়েছে যথেচ্ছে আরবি ঢোকাতে। ব্রাহ্মণ্যবাদী ও ইসলামের তাড়নায় বৌদ্ধরা ধর্মান্তরিত বা বাংলা ছেড়ে পালিয়ে আরও পুবে চট্টগ্রাম বা পার্বত্য চট্টগ্রাম হয়ে বার্মা বা থাইল্যান্ডে চলে গেলেও তাদের যুগে তৈরি হওয়া বাংলা ভাষা কিন্তু এখনও নিজের মতো করে আলাদা একটা ধারার বিশিষ্টতা বজায় রেখেছে। বা শুধু ভাষাই কেন, পাল যুগের উদারতা বা সহনশীলতা বা যুক্তি-তর্কে আসক্তিগুলিও বজায় রয়েছে। আর তাই উত্তর ভারতীয় ধর্মীয় বা জাতপাতের সংস্কৃতি যেমন এখানে বাধা পাচ্ছে বা এখানকার মানুষ বেদ-গীতার ঐশ্বরিক মাহাত্ম্য নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে, তেমনি বাংলাদেশেও অসংখ্য যুক্তিবাদী মানুষ কোরান-হাদিস নিয়ে আজ প্রশ্ন তুলেছে। আরবির পরিবর্তে বাংলায় কেন নামাজ বা আজান দেওয়া হবে না তা নিয়ে কথা উঠিয়েছে।
ভারতীয় রাজনৈতিক হিন্দুত্বের প্রধান কেন্দ্র আজ নাগপুর। তেমনি বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইসলামের প্রধান কেন্দ্র সৌদি আরব। সৌদি আরব যেমনি কাওয়ামি মাদ্রাসাগুলির মাধ্যমে বাংলাদেশে অঢেল টাকা আর বিষ ঢালছে, তেমনি নাগপুরী রাজনৈতিক হিন্দুত্ব বিষ ঢালছে আরএসএস বা বিশ্ব হিন্দু পরিষদ বা ওদের বিভিন্ন সংগঠনের মাধ্যমে। আর টাকার বন্যা বইয়ে দিচ্ছে তার প্রত্যক্ষ রাজনৈতিক সংগঠনের মাধ্যমে। বাংলাদেশের হেফাজতে ইসলামের পূর্বসূরিরা যেমন ১৯৭১ সালে মুজিবের নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধতা করেছে বা সরাসরি পাক ফৌজের হয়ে রাজাকার বাহিনী তৈরি করেছে, এই বিজেপি-র পূর্বসূরিরাও তেমনি বিরুদ্ধতা করেছে ইংরেজদের বিরুদ্ধে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের। ১৯৪২ সালে গান্ধিজির ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলনে এখনকার বিজেপি-র পূর্বসূরি জনসঙ্ঘের প্রতিষ্ঠাতা শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি তখনকার বাংলার গভর্নর জন হোবার্টকে ২৬ জুলাই ১৯৪২ তারিখে চিঠি লেখেন— ‘Let me now refer to the situation that may be created in the province as a result of any widespread movement launched by the Congress. Anybody, who during the war, plans to stir up mass feeling, resulting internal disturbances or insecurity, must be resisted by any Government that may function for the time being.’ শুধু তাই নয় গ্রেফতার হয়ে থাকা দামোদর সাভারকার সম্পর্কে লেখেন ‘if he is released, then he would be loyal to the British Government and was also ready to serve it.’ নেতাজি যখন আজাদ হিন্দ ফৌজ নিয়ে ভারতকে মুক্ত করার কথা ভাবছেন জনসঙ্ঘের শ্যামাপ্রসাদ তখন নেতাজিকে বাধা দেওয়ার হাজার ফন্দি আঁটছেন।
আসলে মৌলবাদী শক্তিগুলির মধ্যে মিল থাকেই। হেফাজতিরা যেমন বাংলাদেশে একেবারে শরিয়তি শাসন চাইছে আরএসএস-এরও তেমনি, ‘The Hindu culture is the life-breath of Hindusthan. It is therefore clear that if Hindusthan is to be protected, we should first nourish The Hindu culture.’ (Rashtriya Swayamgsevak Sangha, Vission and Mission, 22 oct, 2012). এদের কাছে উদার মানবতাবাদী চিন্তার বিদ্যাসাগর, রবীন্দ্রনাথ থেকে লালন ফকির বা মুজিবর রহমান বা হুমায়ুন আজাদের কোনও স্থান নেই। আরএসএস-এর শিক্ষাসংস্কৃতি উত্থান ন্যাসের প্রধান দীননাথ বাত্রা এনসিইআরটি-র শিক্ষাক্রম থেকে রবীন্দ্রনাথের যাবতীয় চিন্তা ও সাহিত্যকর্মকে বাদ দিতে বলেছেন। বাদ দিতে বলেছেন শিক্ষাক্রমের অন্তর্গত যে কোনও সাহিত্যকর্মে ব্যবহৃত আরবি, ফারসি বা উর্দু শব্দকে। বাদ দিতে বলেছেন ভারতের সর্বকালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ শিল্পী মকবুল ফিদা হুসেনের আত্মজীবনীকে।
হেফাজতে ইসলাম বা আরএসএস এই দু দলের নেতাকর্মীদের মধ্যে নারীদের দেখা পেয়েছেন? পাবেন না। নারীদের স্থান যে ঘরে, এ বিষয়ে হেফাজত কি আরএসএস দু পক্ষই একমত। নারীর কাজ যে স্বামীর ভালো-মন্দ আহ্লাদের সম্মতি দেওয়া শুধু তাই নয় পুরুষ তার আমোদ-আহ্লাদে স্ত্রীর সায় না পেলে যে তার স্ত্রীকে প্রহারও করতে পারে সে বিষয়েও তারা একমত। হেফাজতের মতো আরএসএস-ও বিশ্বাস করে ইংরেজি শিক্ষাই নারীদের পতনের মূল। হেফাজতিরা যেমন মনে করে from blackbody to black hole ফিজিক্স-কেমিস্ট্রি-বায়োলজি বা সব রকমের জ্ঞান বা প্রযুক্তি রয়ে গেছে কোরানেই, তেমনি এই আরএসএস-ওয়ালারা মনে করে বেদ-গীতা-পুরাণই পৃথিবীর সব জ্ঞানের আধার। হেফাজতি আর বিজেপি-ওয়ালাদের কথা ধরলে ব্যাটা জার্মান আর আমেরিকানরা এই বেদ-কোরান-গীতা ঘেঁটে সব চুরি করে নিজেদের নামে চালাচ্ছে।
এবার ফের রবীন্দ্রনাথের কথায়। ভারত আর বাংলাদেশ এই দু দেশেরই জাতীয় সঙ্গীত আমাদের রবীন্দ্রনাথেরই। কিন্তু এই মুহূর্তে দু দেশেই রব উঠেছে রবীন্দ্রনাথের লেখা জাতীয় সঙ্গীত পাল্টাতে হবে। বাংলাদেশে এই বিরোধীদের একজন এক জনপ্রিয় ইউটিউবার ইলিয়াস হোসেন জানিয়েছেন, ১৯১২ সালে রবীন্দ্রনাথ বিদ্যাসাগর ও আশুতোষ মুখার্জিকে নিয়ে গড়ের মাঠে মিটিং করেছিলেন, মিটিং করেছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় যেন না হয়, আর সেই মিটিং-এর পর একেবারে রক্তক্ষয়ী দাঙ্গা হয়, সাতজন সন্ন্যাসী নাকি আত্মহত্যা করে। কী মনে করেন? ১৯১২ সালে রবীন্দ্রনাথের পাশে ১৮৮৮ সালে মৃত বিদ্যাসাগরকে দেখে অবাক হছেন? ভুল লিখেছি কিছু? একেবারেই না, ১৯১২ সালে রবীন্দ্রনাথের পাশে বিদ্যাসাগর বা গড়ের মাঠে রবীন্দ্রনাথের মিটিং-এর পর সাংঘাতিক দাঙ্গা ও সাত সন্ন্যাসীর আত্মহত্যা— আমার কথা নয়, পণ্ডিত ইলিয়াস সাহেবের কথা। আর একটা সাংঘাতিক অভিযোগ করেছেন ইলিয়াস সাহেব, তা হল কবিতাটি নাকি দেবী দুর্গাকে উৎসর্গ করে লেখা। এবার ভাবুন, যে লোক গড়ের মাঠে বিদ্যাসাগরকে নিয়ে ১৯১২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় যেন না হয় তার জন্য মিটিং করল, আর তাঁরই এক দেবী দুর্গার উদ্দেশ্যে লেখা গান কিনা ইসলামি বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত!
এবার আসুন ভারতে। ‘জন গণ মন অধিনায়ক জয় হে’ যে পঞ্চম জর্জের উদ্দেশে রচিত এই সন্দেহ তো সবার ছিলই, বলাও হয়েছে বারে বারে, তবে কল্যাণ সিং-এর কথা আলাদা করে বলতে হয়। সেই ১৯৯২-এ অযোধ্যার মসজিদ ভাঙা হচ্ছে তখন, রাজস্থান বিশ্ববিদ্যালয়ের এক অনুষ্ঠানে কল্যাণ সিং বললেন, গানটি এক বিদেশির উদ্দেশে রচিত, তাই এটির পাঠ সংশোধন করে হওয়া উচিত ‘জন গণ মঙ্গল গায়ে’। ২০০৫ সালে সঞ্জীব ভাটনগর নামে এক আইনজীবী সুপ্রিম কোর্টে এই গানে পাকিস্তানে অবস্থিত অঞ্চল ‘সিন্ধ’ শব্দের উপস্থিতি নিয়ে এক পিটিশন দাখিল করেন। আরএসএস অবশ্য সেই ১৯২৫ সাল থেকেই জাতীয় সঙ্গীত ও জাতীয় পতাকার বিরোধিতা করে আসছে, তাদের মত জাতীয় পতাকার রং হওয়া উচিত গেরুয়া আর জাতীয় সঙ্গীত হবে বঙ্কিমচন্দ্রের ‘বন্দে মাতরম’। এবার সুব্রহ্মণ্যম স্বামী— তাঁর মনে হয়েছে ‘সিন্ধ’ শব্দের পরিবর্তন তো জরুরিই তা ছাড়া বর্তমান প্রজন্মের কথা ভেবে জাতীয় সঙ্গীতের পরিবর্তন করা যায় কিনা ভাবতে হবে।
দুই বাংলা মিলিয়ে জাতি তো আমরা একটাই। বাঙালি। এবার এদিকে আমাদের বিদ্যাসাগরের মূর্তি ভাঙা দিয়ে শুরু, ভাঙছে রবীন্দ্রনাথও। ওদিকে ভাঙা হয়েছে মুজিবকে। ভাঙা পড়ছে বাঙালির উদার মানবিকতাবাদ। একদিকে আগ্রাসী পলিটিক্যাল হিন্দুত্ব তার কয়েক শো বছরের চেষ্টায় বাংলায় পায়ের নীচে মাটি পেয়েছে বলে ভেবে ‘জয় শ্রীরাম’ বলে হুঙ্কার ছাড়ছে। অন্য দিকে মুজিবের মূর্তি ভেঙে জানান দিচ্ছে পলিটিক্যাল ইসলাম। চিৎকার একটাই, ভাগো বাঙালি ভাগো। বাঙালি কি পলিটিক্যাল হিন্দুত্ব আর পলিটিক্যাল ইসলামের এই ধর্মান্ধদের সাঁড়াশি আক্রমণ ঠেকাতে পারবে?