Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

কৃষক আন্দোলনের সাম্প্রতিক ওঠানামা— এখনও অনেক গল্প বাকি

চার নম্বর নিউজডেস্ক

 

শাসকবিরোধী, স্বেচ্ছাচারবিরোধী ঐতিহাসিক এক আন্দোলন। হিংসার ছিটেফোঁটাও নেই এমন এক আন্দোলন। হঠাৎই প্রজাতন্ত্র দিবস। পর্দা বদল। পূর্বনির্দেশিত ট্র্যাক্টর র‍্যালির রুট বদলে মূল দিল্লির দিকে যাওয়া, যার হোতা, আন্দোলনরত কৃষকদের একটা অংশ। শেষমেশ সপ্তদশ শতকের এক স্থাপত্যে শিখ ধর্মীয় পতাকা নিশান সাহিব ওড়ানো। আপাতদৃষ্টিতে কেল্লা ফতে মনে হলেও হঠাৎ মোড় ঘুরে যাওয়া। তারপর থেকে জাতীয় পতাকার অবমাননা, হিংসামূলক রণনীতি ইত্যাদি নিয়ে সত্যি মিথ্যের এক পাঁচমেশালি তৈরি হয়ে গেল চব্বিশ ঘন্টার মধ্যেই। ফলপ্রসূ আন্দোলনের মুখ বদলে গেল। মানুষ সহানুভূতি সরিয়ে নিচ্ছে, কৃষক সংগঠনে ভাঙন ধরছে এমন অর্ধসত্যে দাগিয়ে দেওয়া হল দুমাসেরও বেশি সময় ধরে চলে আসা ন্যায্য, দৃষ্টান্তস্বরূপ এক আন্দোলনকে। বলা বাহুল্য, এর মোড় কোন দিকে, আরও নাটক বাকি আছে নাকি শেষমেশ শাসকেরই জয়ের আরেক হতাশাজনক পরিসমাপ্তির পথে চলে যাওয়া— তা বলার এখনও কি সময় হয়েছে? নাকি বাকি আছে আরও অনেক কিছু দেখার?

কেন এই সন্দেহ? তার কারণ, শাসক এখনও ভয় পেয়েই রয়েছে। যার হোতা, সাধারণ মানুষ নামধারী শাসক দলের এক শ্রেণির ক্যাডার। এবং তার সঙ্গে বরাবরই শাসক দলের স্বৈরাচারী এক একটি আদেশ পালনকারী দিল্লি পুলিশ ব্রিগেড। সরকারি বিভিন্ন মন্ত্রক। ছলে বলে কৌশলে ক্যামেরার পেছনে থাকা এমন আরও কত কুশীলব …

 

দৃশ্য এক:

এক এক করে আসা যাক। টিকরি, সিংঘু, গাজিপুর— দিল্লির সীমান্তে মূলত এই তিনটি জায়গায় জমাট বাঁধা কৃষক সমাবেশ এবং ধরনা সরিয়ে দেওয়ার নির্দেশ এসেছে পুলিশের কাছে। বলা বাহুল্য সহযোগী উত্তরপ্রদেশ সরকার সে চেষ্টা শুরু করে দিয়েছে আদেশের আগেই। জল, বিদ্যুৎ ইত্যাদি সরবরাহ বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে। রাস্তায় ট্রেঞ্চ খোঁড়া হচ্ছে। ভাইরাল সোশ্যাল মিডিয়া। রাতের অন্ধকারে চোরা গোপ্তা আক্রমণ। যেন সূর্যের আলোয় কোনওভাবে শাসকের এহেন কীর্তি ধরা না পড়ে। ভাইরাল হতেই ওজর তৈরি। স্থানীয় মানুষের সঙ্গে কৃষকদের সংঘর্ষ এড়াতেই নাকি এমন সব ট্রেঞ্চ। অথচ সত্য এটাই, সাংবাদিকদের এড়াতে, কৃষকদের দিল্লির ভেতরে কোনওভাবে ঢুকতে বাধা দিতেই এমন সব ফাউল প্লে। আন্দোলনের মূল সংগঠক সংযুক্ত কিসান মোর্চার মতে কৃষকদের হেনস্থাকারী লোকজন আসলে অসুবিধেয় পড়া সাধারণ স্থানীয় মানুষের ছদ্মবেশে আসা শাসক দলের ক্যাডার। অনেকগুলি সংবাদমাধ্যমের সমীক্ষা অনুযায়ী, হরিদাসনগর এবং বেশ কিছু অঞ্চলে কথা বলে দেখা গেছে কৃষকদের জন্য সমস্যায় পড়ে তাঁদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেছেন এমন মানুষের সংখ্যা নগণ্য। যাঁরা করছেন, তাঁদের পাত্তা পাওয়া যায়নি। বোঝা সহজ, কেন যায়নি। তাঁরা কারা? ট্রেঞ্চের বাইরেও অনেক জায়গায় কৃত্রিম ব্যারিকেড উঠিয়ে সিমেন্টিং করে দেওয়া হচ্ছে। কোথাও দৃষ্টান্তহীনভাবে পেরেক গেঁথে দেওয়া রাস্তা বরাবর। যেভাবে হোক আটকাতে হবে এই আন্দোলন। প্রজাতন্ত্রের দোহাই দিয়ে খুব বেশিদিন মানুষের সহানুভূতি চলে যাওয়ার আফিম খাওয়ানো যাবে না দেশবাসীকে।

দৃশ্য দুই :

পাঞ্জাব মেল। পাঞ্জাবের ফিরোজপুর থেকে হরিয়ানার রোহতক হয়ে দিল্লির দিকে ঘুরে যায় এই ট্রেনের মুখ। এটিই সাধারণ ছবি। কৃষক আন্দোলনের বর্তমান ছবি। একদল কৃষক গত ৩১ জানুয়ারি ফিরোজপুর থেকে দিল্লির দিকে যাবেন বলে ট্রেনে উঠলে দেখা গেল রোহতকের পরিবর্তে রেওয়ালির দিকে ঘুরে গেল গাড়ি। ক্রমশ আরও পশ্চিমে মুম্বই রুটে চলে গেল পাঞ্জাব মেল। শুধু এই গাড়িটিই নয়, রাজস্থানের গঙ্গানগর থেকে পাঞ্জাব ও হরিয়ানার বহু যাত্রীকে নিয়ে আরেকটি গাড়ি পুরনো দিল্লি স্টেশনে ঢোকে অন্যান্য দিনে। এই গাড়িটি হরিয়ানার বাহাদুরগড়ে থামিয়ে দেওয়া হল। রেলমন্ত্রকের কথা অনুযায়ী, দুটি ঘটনাই প্রযুক্তিগত সমস্যার জন্য। কাকতালীয়। তবে কাক এবং তাল দুটিই এতটাই সমাপতনের কথা বলছে, যে একথা জলের মতোই পরিষ্কার যে শাসক তার সমস্ত মন্ত্রক দিয়েই এক অসম লড়াইয়ে নেমে গেছ ভারতের অর্থনীতির মূল কাণ্ডারি কৃষক শ্রেণির বিরুদ্ধে। যার পরিণতি ভয়াবহ…

 

দৃশ্য তিন:

উত্তরপ্রদেশের কিছু ছবি। যাকে কোলাজ করে একসঙ্গে আনলেই জিগজ পাজলটি বোঝা হয়ে যাবে। বালিয়া জেলার সিকন্দরপুরে ২০০ জন এবং বারাণসী ও মির্জাপুরের আরও ১০০ জন, মোট ৩০০ জন ট্র্যাক্টর মালিককে উত্তরপ্রদেশ পুলিশ নোটিশ ধরিয়ে দিয়েছে। কেন? বলা হল, কৃষিকাজের বদলে রাস্তায় যত্রতত্র ব্যক্তিগত কাজে ট্র্যাক্টরের ব্যবহার করায় নাকি পথদুর্ঘটনা বাড়ছে। কিছু ট্র্যাক্টর অবৈধ খননকাজেও কাজে লাগানো হচ্ছে। তাই এমন নির্দেশিকা। তা বেশ তো। কিন্তু হঠাৎ এখনই কেন? সমাপতন? বড্ড বেশি সমাপতন হয়ে যাচ্ছে না? শোনভদ্রের এক কৃষকের থেকে পাওয়া গেল ভীতির ছবিটা। পুলিশ থেকে, সরকার থেকে ট্র্যাক্টর মালিকদের কাছে গিয়ে রেজিস্ট্রেশন নথি চাওয়া হচ্ছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তার পরিণতি নোটিশ ধরিয়ে দেওয়া। রীতিমতো এক ত্রাসের রাজত্ব। গুন্ডাবাজির রাজত্ব। যেন সাম্প্রতিককালের কোনও ওয়েবসিরিজ। সরকার এখানে সন্ত্রাসবাদী এক মাফিয়া ডন। যখন তখন যা ইচ্ছে আদেশ জারি। প্রসঙ্গত এর আগেই উত্তরপ্রদেশ সরকার থেকে গুন্ডা অ্যাক্ট ১৯৭০ জারি করা হয়েছিল প্রজাতন্ত্র দিবসের বিক্ষোভে অংশ নেওয়া আটজন কৃষক নেতা এবং বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রের বিরুদ্ধে। কারা সেই নেতারা? অল ইন্ডিয়া কিষান সভার ডিস্ট্রিক্ট সেক্রেটারি রামজি সিং, কমিউনিস্ট পার্টি অফ ইন্ডিয়ার ডিস্ট্রিক্ট সেক্রেটারি জয়শঙ্কর সিং, স্বরাজ ইন্ডিয়ার রামজনম যাদব, সিপিআইএম সদস্য বংশরাজ প্যাটেল, নেহলাউদ্দিন, মহম্মদ আলম, শিবশঙ্কর লাল এবং বিএইচইউ-এর সেই ছাত্র শিবরাজ যাদব।

দৃশ্য চার:

ইন্টারনেট ব্যবস্থা। শাসক আক্রমণ থেকে নিস্তার নেই এখানেও। আগামী কাল অর্থাৎ ২রা ফেব্রুয়ারি রাত ১১টা অবধি সিংঘু, টিকরি এবং গাজিপুর সীমান্তে এবং ন্যাশনাল ক্যাপিটাল রিজিয়নের বেশ কিছু অঞ্চলে ইন্টারনেট পরিষেবা বন্ধ রাখা হল। কারণ হিসেবে দেওয়া হল গণ-উসকানি ইত্যাদি আটকানোর দোহাই। এছাড়াও টুইটার ইন্ডিয়া থেকে কৃষক আন্দোলনের সমর্থনে কথা বলছে এমন সমস্ত টুইটার অ্যাকাউন্ট ব্যান করে দেওয়া হল। ভারত সরকার থেকে টুইটার ইন্ডিয়াকে এমন একটি নির্দেশিকা জানানোর সঙ্গে সঙ্গেই গুড বুকে থাকার জন্য আদেশ পালন। ফলত, কিসান একতা মোর্চার অ্যাকাউন্ট বা ট্র্যাক্টর টু টুইটার নাম্নী আরেকটি অ্যাকাউন্ট, কিংবা ভারতী কিসান ইউনিয়নের মুখবন্ধ ক্যারাভান পত্রিকার মতো কিছু টুইটার অ্যাকাউন্টে কোপ। শাসকের চিরাচরিত এক পদক্ষেপ। যদিও তা দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। টুইটার সদরদপ্তর থেকে আপত্তি আসায় রাতেই ব্যান তুলে দেওয়া হয়েছে। অন্তত এই পদক্ষেপ একদমই ধোপে টেকেনি সরকারের।

শেষমেশ যেটুকু বাকি থাকে তা হল এসবের পরেও এ আন্দোলন কোথায় পৌঁছচ্ছে তার একটা আন্দাজ। বলা বাহুল্য, লাল কেল্লার ঘটনার পর কৃষক সংগঠনগুলির পক্ষ থেকে আজ অর্থাৎ ১লা ফেব্রিয়ারি ঘোষিত হওয়া সংসদ অভিযান স্থগিত রাখার যে নির্দেশ জারি করা হয়েছিল, তাতে কোথাও একটা সাময়িক পিছিয়ে পড়ার হতাশা জড়িয়ে ছিল। কিন্তু উপরের সমস্ত কারণগুলি একজোট করে আবার লড়াইয়ে ফিরিয়ে দিল। কৃষক সংগঠনগুলির মধ্যে কোথাও একটা চিড় ধরা ঐক্যকে ফিরিয়ে দিয়ে ঘোষিত হল আগামী শনিবার অর্থাৎ ৬ ফেব্রুয়ারির চাক্কা জ্যাম। দুপুর বারোটা থেকে তিনটে অবধি গোটা গোটা দেশজুড়ে পালিত হবে একধরনের পরিবহন ধর্মঘট। সর্বব্যাপী রাস্তা অবরোধ। কৃষকদের উপর নেমে আসা রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস, ২০২১-২২-এর ইউনিয়ন বাজেটে প্রায় ভুলে যাওয়া কৃষকশ্রেণির কথা— ইত্যাদির বিরুদ্ধে সোচ্চার গণবিক্ষোভ।

অর্থাৎ গল্পটা কী দাঁড়াল? এখনও অনেকটাই ছবি দেখা বাকি। এখনও পরাজয়ের থেকে অনেকটাই দূরে কৃষক ভারতবর্ষ। বলা ভালো, অন্তত এখনও জয় মোটেই অসম্ভব কথা নয়। বীভৎস এক বাউন্সি পিচে ধাক্কা খেলেও এখনও জেতার আশা পুরোদমেই আছে আমাদের কৃষক ব্রিগেডের। ভীষণভাবেই আছে…