রোদ্দুর মিত্র
শুরুয়াতের আগে: অফিউকাস নক্ষত্রপুঞ্জে পৃথিবী থেকে ছয় আলোকবর্ষ দূরে বার্নাডস স্টারের সন্ধান মেলে উনিশশো ষোলো সালে। আমেরিকান জ্যোতির্বিজ্ঞানী এডওয়ার্ড এমারসান বানার্ড প্রথম এই নক্ষত্রের গতিপ্রকৃতি সম্পর্কে আলোকপাত করেন, যা সূর্যের সাপেক্ষে প্রতি বছরে ১০.৩ আর্কসেকেন্ড। বার্নাডস স্টার আসলে একটি লাল বামন নক্ষত্র। আমাদের গল্পটা বার্নাডস স্টারকে নিয়ে নয়, সাইকিকে নিয়ে। সাইকি বার্নাডস স্টার ফ্যামিলির দ্বিতীয় গ্রহ, কাকতালীয়ভাবে পৃথিবীর সঙ্গে যার আগধ সাদৃশ্য। তবে সাইকি তুলনায় উষ্ণ— সর্বনিম্ন উষ্ণতা পঞ্চান্ন ডিগ্রি। সাইকিতে প্রাণ নেই। সন্ধানও কেউ করেনি। কিন্তু সাইকিতে মানুষ আছে। কনসেন্ট্রেশান ক্যাম্প আছে। আমরা ধরে নেব, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মিত্রশক্তি হেরে গেছে। এইমুহূর্তে পৃথিবীটা চালায় নাৎসি পার্টি। এইমুহূর্তে পৃথিবীতে মানুষ না, ডিক্টেটার জন্মায়। সাল দু হাজার পঁচানব্বই। বিদ্রোহ, ভালোবাসা, অন্তর্ঘাতের মিশেল এই গল্পের শুরু বার্লিন শহরে।
৬ই আগস্ট, ২০৯৫
বার্লিন
–হাইল হিটলার!
সমবেত কণ্ঠে, ‘হাইল হিটলার!’
–আজ, আমাদের পৃথিবীর জন্মদিন। আজ, হের ফ্যুয়েরারের দিন। আজ আমাদের উল্লাসের দিন, আমাদের জাতির নবজাগরণ হয়েছিল আজকের দিনে! যদি ফিরে তাকাই উনিশশো পঁয়তাল্লিশ সালের ছয়ই আগস্টের দিকে, এতক্ষণে ম্যানহাটান প্রজেক্টের ধ্বংসস্তূপের ছবি গোটা পৃথিবী দেখে ফেলেছে। হ্যারি ট্রুম্যানের মৃত্যুদণ্ডের খবর জার্মানির প্রতিটা শিশুর মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়েছে। আমেরিকার অন্দর থেকে শোনা যাচ্ছে, ‘হাইল হিটলার!’
এবার উচ্চকণ্ঠে, ‘হাইল হিটলার!’
–ব্লাডি আমেরিকা! এখনও চোখ বন্ধ করলে দেখতে পাচ্ছি তিনটে মেসার্সমিট মি-২৬২ ম্যানহাটনের আকাশে ঘুরপাক খাচ্ছে। ঠিক মিনিট দশেক পরেই পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথম অ্যাটম বোম আছড়ে পড়বে আমেরিকার মাটিতে। তারপর একটা মুষ্টিবদ্ধ মেঘ, আমাদের স্বপ্নপূরণের মেঘ, আমাদের জাতিদর্পের মেঘ দখল নেবে গোটা পৃথিবীর আকাশ…
বক্তৃতা দিচ্ছেন এসএস-স্ট্যান্ডার্টফ্যুয়েরার লুইস উলফ। শোনা যায়, হিটলারের আত্মহত্যার পেছনে লুইস উলফের কোনও এক পূর্বপুরুষ জড়িত ছিল। অতএব বিশ্বাসঘাতকতা লুইসের রক্তে। তাঁর মগজেও ক্রমাগত তৈরি হচ্ছে এক গুপ্তহত্যার ব্লু-প্রিন্ট। টার্গেট— মঞ্চের পেছনের সারিতে বসে থাকা এসএস-কর্নেল ম্যাক্সিমিলিয়ান বাওয়ার।
ম্যাক্সিমিলিয়ান শ্রমিক পরিবারের সন্তান। রক্তঘামের দরদ ওর মধ্যে ফিকে হতে হতেও হয়নি। নিজস্ব দুর্বলতা যতটা সম্ভব চেপেই রাখে সে। ম্যাক্সিমিলিয়ানের তীক্ষ্ণ বুদ্ধি, নিষ্ঠুর মনন এবং অত্যন্ত শীতল মস্তিষ্ক— লুইসের ঈর্ষার কারণ, আতঙ্কের কারণও বটে। যে-কোনও দিন লুইসকে সরিয়ে এসএস-এর চূড়ান্ত পদ অধিকার করতে পারে ম্যাক্সিমিলিয়ান। আবিশ্ব জানে, আর্নল্ড ডিট্রিক শুধুমাত্র আন্তর্জাতিক নাৎসি পার্টির চ্যান্সেলার। অন্দরে অন্দরে পার্টি বিভাজিত হয়ে আছে লুইস উলফ এবং ম্যাক্সিমিলিয়ান বাওয়ারের মধ্যে। ইতিহাস সাক্ষী, ক্ষমতার বণ্টন কখনও সুষম আকার ধারণ করতে পারে না। অগত্যা ডিক্টেটারদের পৃথিবীতেও কোল্ড ওয়ার অবশ্যম্ভাবী।
পৃথিবী থেকে ছয় আলোকবর্ষ দূর
সাইকি — সেল নাম্বার তেরো
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অক্ষশক্তির অকল্পনীয় জয়ের পরে কনসেন্ট্রেশান ক্যাম্প তৈরি হল খোদ লন্ডনে। শুধু লন্ডন কেন, সোভিয়েত রাশিয়া, আমেরিকা, জাপান, সমগ্র আফ্রিকা এবং মাইলের পর মাইল অস্পৃষ্ট বনভূমি ধ্বংস করে রাতারাতি জন্ম নিল কনসেন্ট্রেশান ক্যাম্প। একজনও ইহুদির পায়ের ছাপ যাতে এই পবিত্র পৃথিবীতে না পড়ে! এদিকে পশুর ভেতরেও একটা পশু লুকিয়ে থাকে, রক্তের স্বাদ পেলেই দুই সত্তা একাকার হয়ে যায়। তাই দেশ দখলের সীমা অতিক্রম করে, নাৎসিবাহিনী রওনা হল গ্রহ দখলের উদ্দেশ্যে। গ্রহে গ্রহে তৈরি হবে কনসেন্ট্রেশান ক্যাম্প। সকল অনার্য রক্তের মানুষদের গ্রহান্তর দেওয়া হবে। হাইল হিটলার! সাইকি আসলে নিপীড়িতের গ্রহ।
সিংহাসনে বসার একবছরের মধ্যেই নাৎসি পার্টি বহু প্রতীক্ষিত ‘হিলিগ আর্ডে’ অর্থাৎ ‘পবিত্র পৃথিবী’র অভিযানে নেমে পড়ে। প্রতিটা দেশের প্রতিটা বাড়ি, প্রতিটা ইট, প্রতিটা গলি, অন্ধগলি, প্রতিটা সুড়ঙ্গ তন্নতন্ন করে খুঁজে, হিংস্র কুকুর লেলিয়ে টেনেহিঁচড়ে বের করে আনা হয় ইহুদিদের। তবুও কেউ কেউ ভুয়ো পরিচয়ে, নিখুঁত ছদ্মবেশে ইতিউতি ছড়িয়ে ছিল। লেনিনগ্রাদের পার্শ্ববর্তী গ্রামে তখনও দু-একটা লাল পতাকা লুকিয়ে লুকিয়ে জ্বলছিল। তারই ফলশ্রুতি উনিশশো উনষাট সালে পৃথিবীব্যাপী সেই আকস্মিক অভ্যুত্থান। আজ কিউবা, পরশু ফ্রান্স, তারপর একত্রে চিন এবং ভিয়েতনাম, সবশেষে ভারত। কিন্তু ততদিনে জল গড়িয়ে গড়িয়ে হিটলারের পোষা কুত্তাদের কাছে পৌঁছে গেছে। কীভাবে পৌঁছল কেউ জানে না। অভ্যুত্থানের তিনদিনের মাথায় সব দেশের বিদ্রোহী নেতাকে কারাবন্দি করল এসএস-জেনারেল আর গোয়েরিং বাহিনী। মিছিলের ওপর অবাধে মেশিনগান, টিয়ার গ্যাস, হ্যান্ড গ্রেনেড ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, মাত্র তিনদিনের রক্তাভ বিক্ষোভ দানা বেঁধেছিল আদ্যোপান্ত স্বতঃস্ফূর্তভাবে। কিউবার সঙ্গে ফ্রান্সের, ফ্রান্সের সঙ্গে চিনের, এমনকি চিনের সঙ্গে ভারতের বিন্দুমাত্র যোগাযোগ পর্যন্ত ছিল না। তবু সবাই একসঙ্গে জেগে উঠেছিল, একসঙ্গে পথে নেমেছিল যুদ্ধ করতে— বিপ্লবের এমনই ধরন।
তারপর থেকে পৃথিবীর ইতিহাস নতিহীন। সরলরৈখিক অন্ধকার। নাৎসিদের কাছে এই অন্ধত্বই অদ্ভুত এক আলো। যে আলোয় জীবনের আকাঙ্খা ক্ষয়ে ক্ষয়ে কেবলই সিংহের মতো চেয়ে থাকে সন্দেহ। উনিশশো পঁচাত্তরের মধ্যে পৃথিবী থেকে ইহুদিদের সমূলে নিশ্চিহ্ন করার পরেও নির্ঘুম রাত কপালে জুটল না কারও। আটলান্টিক সাগরের জল ক্রমশ লাল হতে শুরু করল, অ্যামাজনের রেইন ফরেস্টে উপচে পড়ল লাশ, হিমালয়ের খাঁজে খাঁজে ন্যাংটো ইহুদি কিশোর। তারপরেও একটা প্রকাণ্ড ‘কিন্তু’ নাৎসি পৃথিবীর বুকে প্রেতের মতো জুড়ে বসল। কেউ কাউকে বিশ্বাস করে না, নিজের বউকে পুড়িয়ে মেরে দেয়, শহরের মধ্যিখানে ছেলের গলাকাটা দেহ ঝুলিয়ে রেখে প্রমাণ করতে চায় কে কত সৎ নাৎসি।
উনিশের দশকে সরকারি হিসেবে যখন ইহুদি হত্যাপর্ব একেবারে শেষ হল, কনসেন্ট্রেশান ক্যাম্পগুলো কিন্তু ভেঙে দেওয়া হল না। কালো চামড়ার মানুষেরা তখনও সেখানে বন্দি। ঘটনাটা ঘটল বিশের দশকের শুরুতে। সমীক্ষায় দেখা গেল, কতটা সঠিক তা বলতে পারি না, পৃথিবীতে যত ধরনের খুনখারাপি, লুঠপাট, ধর্ষণ শুরু হয়েছে, সবের মূলে রয়েছে এই নিগারের দল। স্বজাতীয় সন্দেহ এবং হিংসা সাময়িক কিছু বছরের জন্যে থামিয়ে নাৎসি পার্টির শিরোনামে উঠে এল নিগার নিধন। মৃত্যু যতই সহজলভ্য হোক পৃথিবীতে, কয়েকশো কোটি ছাপিয়ে গেল নিগারের সংখ্যা। অগুনতি বৈঠক, তর্ক-বিতর্ক, অর্ধসত্য তথ্য নিয়ে হইচই, সভা-বিচারসভা, শুনানির তারিখ পিছিয়ে যেতে যেতে একদিন হঠাৎই জানা গেল, ওদের গ্রহান্তর দেওয়া হবে।
প্রথম বেছে নেওয়া হল মঙ্গল গ্রহকে। অভুতপূর্ব সাফল্যের পর পরই বুধ, শুক্র, বৃহস্পতিতেও কালো চামড়ার মানুষ উপচে পড়ল। একটা সময় পরে সমস্ত সৌরজগত পরিণত হল কনসেন্ট্রেশান ক্যাম্পে। কিন্তু তারপরেও অচ্ছুৎ, নীচ মানুষের সংখ্যা শূন্যে এসে ঠেকল না। তাহলে উপায়? অপাপবিদ্ধ পৃথিবীতে নিগ্রো, অনার্য মানুষের সংস্পর্শ যে জাতির কলঙ্ক!
আমরা জানি, সূর্যের নিকটতম নক্ষত্র প্রক্সিমা সেন্টরি। তাহলে এরপরের এক্সপেরিমেন্ট তাকে নিয়ে করা যাক। কিন্তু প্রক্সিমা সেন্টরি তো প্রায় ৪.২২ আলোকবর্ষ দূরে, সেখানে পৌঁছনোর আগেই যে মৃত্যু। অথচ মানুষ পৌঁছল, কীভাবে? এখানে গল্পের রাশ টেনে, আমরা জেনে নেব ওয়ার্মহোল জিনিসটা কী।
মনুষ্যজাতির ইতিহাসের প্রথম পর্বে কল্পনা করা হয়েছিল, মহাকাশ আসলে ইট, কাঠ, পাথরের মতোই দৃঢ়। কোনও মহাজাগতিক ঘটনাই সেই দৃঢ়তাকে প্রভাবিত করতে পারে না— সে অবিনশ্বর। অ্যালবার্ট আইনস্টাইন রণে ভঙ্গ দিলেন। তিনি থিওরি অফ রিলেটিভিটিতে বললেন, মহাকাশ আসলে টাইম আর স্পেসের যুগলবন্দিতে সৃষ্টি এবং খুব আশ্চর্যজনকভাবে এই টাইম আর স্পেস মহাশূন্যের প্রতিটি স্থানে সর্বদা অভিন্ন থাকতে পারে না। মহাশূন্যের গঠনপ্রণালীর ভিতটাই হুড়মুড়িয়ে ভেঙে পড়ল যেন! এতকাল যে মহাশূন্য দৃঢ় হয়ে আমাদের মনে বিরাজ করছিল, আইনস্টাইনের থিওরি অফ রিলেটিভিটি সেই মহাশূন্যকেই বললো, একটা ইলাস্টিক স্পেস। অর্থ্যাৎ মহাশূন্যের সঙ্কোচন-প্রসারণ উভয়ই সম্ভব। কেন সঙ্কোচন সম্ভব? আমাদের পৃথিবীকেই ধরা যাক। বিজ্ঞানীদের গণনায়, পৃথিবীর ওজন ৫.৯৭২ x ১০২১ টন। পৃথিবী অবস্থান করছে মহাশূন্যে, যে মহাশূন্য আর দৃঢ় নয়। এখন পৃথিবীর এই বৃহৎ ওজন ইলাস্টিক স্পেস সহ্য করতে না পেরে ছিঁড়ে যেতে পারে, তৈরি করতে পারে মহাজাগতিক এক প্রকাণ্ড ছিদ্র। এই ছিদ্রের নাম দেওয়া হল ওয়ার্মহোল, একটা সুড়ঙ্গ, যার মধ্যে দিয়ে কয়েক আলোকবর্ষের পথ এক তুড়িতে অতিক্রম করে ফেলা যায়। সুড়ঙ্গের প্রথম ছিদ্রের সম্পর্কে তো জানা গেল, কিন্তু শেষপ্রান্ত কোথায়? আদৌ শেষ আছে নাকি একটা ইনফাইনাইট লুপ?
–বুঝলে জাফারি, ওয়ার্মহোল একটা ম্যাজিকাল সুড়ঙ্গ। সুড়ঙ্গের ইনিশিয়াল পয়েন্ট হয়তো তুমি জানতে পারলে, কিন্তু ওর শেষ কোথায়, অতীতে না ভবিষ্যতে, নাকি সম্পূর্ণ ভিন্ন কোনও গ্যালাক্সিতে, টেলিস্কোপে চোখ রেখে সেসব বলা অসম্ভব। ওয়েশটার-৪৯ প্রথম যে ওয়ার্মহোলের ছবি পাঠিয়েছিল, তার নাম জানো তোমরা?
–উফ! তুমি আমাদের সাইকির গল্পটা বলো না!
–প্রথম ওয়ার্মহোলের নাম ছিল লিশ্ত্! ইংরাজিতে যার অর্থ আলো। ওয়েশটার-৪৯ লিশ্তে প্রবেশ করার ঠিক চব্বিশ ঘন্টা পরেই প্রক্সিমা সেন্টরির অ্যাটমোস্ফিয়ারে ঢুকে পড়ে— একেবারে অবিশ্বাস্য! ল্যাবরেটরির জায়ান্ট স্ক্রিনে সেই ছবি দেখে মানে আই ওয়াজ ক্রাইং লাইক অ্যান ইনফ্যান্ট…
–না, না, হবে না। এই পার্টটুকু স্কিপ করে যাও, প্লিজ, প্লিজ!
–কিন্তু এইটুকু না শুনলে—
–আমরা সাইকির গল্পটাই শুনব।
–কিন্তু তোমাদের প্রক্সিমা সেন্টরির গল্পটাও জানা উচিত!
–কাল শুনব কাল, প্রমিস প্রমিস প্রমিস!
–আচ্ছা বেশ। তাই হোক। এবার তাহলে আমরা লাফ মেরে চলে যাই দু হাজার বিয়াল্লিশ সালে। প্রক্সিমা সেন্টরি দখলের বারো বছরের মাথায় সাইকি এক্সপিডিশান হল। তখনও পর্যন্ত আমার প্রকৃত পরিচয় কেউ জানতে পারেনি। বলা ভালো, কেউ জানতে চায়নি, কারণ ওদের প্রয়োজন ছিল আমার তুখোড় মস্তিষ্কের। থার্ড এপ্রিল, দুজন বিজ্ঞানী, পাঁচজন এসএস-কর্নেল এবং তিনজন প্রিজনারের একটা টিমকে নিয়ে গার্ডিয়ান-১৬ উড়ে যায়। দি টোর দেস হিমেলস— স্বর্গের সিঁড়ি— প্রথম এই ওয়ার্মহোলের সন্ধান আসলে পেয়েছিল ওয়েশটার-৪৯-এরই এক আত্মীয়, ওয়েশটার-৫৩। হয়েছিল কী, প্রক্সিমা সেন্টরি থেকে ফিরে আসার পথে ওয়েশটার-৫৩ সোলার স্ট্রমের মধ্যে আটকে পড়ে। আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়ার আগের মুহূর্তে একটা ছবি পাঠিয়েছিল, বেশ বুঝতে পারছিলাম ওয়েশটার-৫৩ প্লুটোতে খুব বিপজ্জনকভাবে ল্যান্ড করবে। স্পেসশিপে দুজন এসএস-কর্নেল ছিলেন, যাদের মৃত্যু অবধারিত। আমরা অপেক্ষা করেছিলাম দিন পনেরো, কিন্তু ওয়েশটার আমাদের সিগন্যালের কোনও রেসপন্স করল না। শেষ যে ছবিটা ওয়েশটার পাঠিয়েছিল, তার সঙ্গে ছিল একটা কোডেড মেসেজ। হয়তো শেষ মুহূর্তে, স্পেসশিপের সিস্টেম কিছু নেগেটিভ এলিমেন্ট ট্রেস করেছিল। তাই মেসেজটা ডিকোড করে জানা যায় গেল যে, নেগেটিভ এলিমেন্টের উৎস আমাদের এই ওয়ার্মহোল, স্বর্গের সিঁড়ি!
–হঠাৎ নেগেটিভ এলিমেন্ট কেন?
–ধরো, ওয়ার্মহোল তৈরি হল। কিন্তু আমাদের মাধ্যাকর্ষণ শক্তি চাইবে, ক্রমাগত চাপ দিয়ে দিয়ে ওয়ার্মহোলের মুখটা বন্ধ করে দিতে। মহাশূন্যের সাম্যতা মজায় রাখতে হবে না! এই চাপের বিরুদ্ধেই রুখে দাঁড়ায় নেগেটিভ এলিমেন্টস। যারা চায়, ওয়ার্মহোলের মুখটা খোলা থাকুক…
গল্পটা আচমকাই থামিয়ে দিতে হল বিশ্ববিখ্যাত অ্যাস্ট্রোফিজিসিস্ট নিকোলাই ইভানভকে। তাঁর আসল পরিচয় কয়েক বছর আগে পর্যন্ত কেউ জানত না। ইলিয়াস ওয়েবার নামেই তিনি সর্বজনবিদিত। দীর্ঘ পঞ্চাশ বছর এই পরিচয় তিনি গোপন রেখেছিলেন, সত্তরের চৌকাঠে পা দিয়েই জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল। এসএস-জেনারেল এবং স্ট্যান্ডার্টফ্যুয়েরার ঠাসা বৃহৎ হলঘরে নিকোলাই মাতৃভাষায় বিস্ময় প্রকাশ করে বসলেন।
এইমুহূর্তে নিকোলাইকে ঘিরে ধরেছে ফরাসি বন্দিদের একটা দল। সবাই মাত্রাতিরিক্ত উত্তেজিত এবং ভীত।
–নিকোলাই, নিকোলাই?
–আজকে নতুন যে প্রিজনার শিপটা ল্যান্ড করেছে…
–সেখানে, সেখানে একটা পাগল মেয়ে—
–পাগল মেয়েটা বলছে, ও কী যেন একটা দেখে ফেলেছে!
নিকোলাই বিরক্ত হয়ে বলল, ‘কী দেখে ফেলেছে? পরিষ্কার করে বলবে তো!’
–সেই পাগল মেয়েটা বলছে, বলছে যে— নিকোলাই আমার কথাটা বলতে খুব ভয় করছে।
জাফারি, মানে জাফারি গেইটা, নিগ্রো কিশোর এবং তার দলবলের ধৈর্যের বাঁধ ভাঙছে। তাদের গল্প শোনায় বাধা পড়েছে। কিন্তু ঐ পাগল মেয়ে কী বলেছে সেটাও কেউ ঠিকমতো বলছে না।
মুহূর্তের মধ্যে সাইকির এই বৃহৎ কনসেন্ট্রেশান ক্যাম্পের তেরো নম্বর সেগমেন্টটা স্থবির হয়ে গেল। একটা পাগল মেয়ে, উকুনভর্তি চুল, নাৎসিবাহিনীর সুখচারের বশে জামাটা এমনভাবে ছিঁড়েছে যে নামমাত্র আব্রু বজায় আছে। ঘরভর্তি লোকের সামনে ছেঁড়া জামার একটা অংশ মুখের সামনে তুলে ধরল মেয়েটা, যেন মাইক, ‘কমরেডস! দ্য ওয়ার্ল্ড ইজ ফ্রি ফ্রম নাৎসি। আমরা জিতে গেছি। পৃথিবীতে কোনও নাৎসি নেই। কমরেড, আপনারা শুনতে পাচ্ছেন? চ্যান্সেলার আর্নল্ড ডিট্রিক বাস্টার্ড হিটলারের মতোই আত্মহত্যা করেছে। ফ্রম নাও, দ্য ওয়ার্ল্ড ইজ বিলংস্ টু আস…’
নিকোলাই ইভানভ জীবনে দ্বিতীয়বারের জন্যে শিশুর মতো কেঁদে ফেললেন, কিন্তু এই সাইকিতে কেউ তাঁর কান্না লক্ষই করল না।
৯ই আগস্ট, ২০৯৫
বার্লিন
–হাইল হিটলার!
সমবেত কণ্ঠে, ‘হাইল হিটলার!’
–আন্তর্জাতিক নাৎসি পার্টির সর্বোচ্চ সাফল্যের আজ দেড়শো বছর পূর্তি। আপনারা সকলেই জানেন, উনিশশো পঁয়তাল্লিশ সালের আজকের দিনেই স্তালিনগ্রাদের ওপর আমরা দ্বিতীয় পরমাণু বোমাটি ফেলেছিলাম, সগর্বে। অথচ আজকে, এই দুহাজার পঁচানব্বইয়ে দাঁড়িয়ে আমার ইন্দ্রিয় বলছে, আমরা অতীতের গর্ব, সেই অহঙ্কার, সেই দানবীয় তেজ যেন ধীরে ধীরে হারিয়ে ফেলেছি। দেড়শো বছর আগে আমাদের প্রযুক্তি যে উচ্চতায় পৌঁছেছিল, সাম্প্রতিক সময়ে তার অগ্রসর একেবারে শূন্যই। কেন এই ধ্বংসের পথে এগোতে শুরু করল আমাদের সভ্যতা? কেন এই সঙ্কটের মুখে পড়তে হল সমগ্র জার্মান জাতিকে? আছেন কেউ ভবিষ্যৎদ্রষ্টা…
ভিড়ের মধ্যে কয়েকজন তিতিবিরক্ত হয়ে উঠল। তারা মনেপ্রাণে আগামীর, এমনকি বর্তমান থেকেই চাইছে বিরত থাকতে, কিন্তু এসএস-কর্নেল ম্যাক্সিমিলিয়ান বাওয়ার লোকটি খুব একগুঁয়ে। ঘাড় ধরে কি আর মানুষকে ভাবানো যায়? ওদের আইডল লুইস উলফ। আইডল বলেছেন, আমরা হলাম অ্যারিস্টোক্র্যাট। আমাদের অত ভাবনাচিন্তা করলে চলে না। নিগার মেরে, ফূর্তি করে, পার্টির সভায় ভিড় করলেই জীবনটা সার্থক। পৃথিবীটাও দিব্যি চলে।
–আবার এই ইডিয়েটের ইঞ্জিন চালু হল।
–কেমন শুয়োরের মতো ঘোঁত ঘোঁত করছে দেখো!
–উফ, নয়েজ পলিউশান।
ভিড়ের মধ্যে ওদের হাসির ভ্রূক্ষেপ তেমন কেউ করছে না। বয়স পঁচিশ হলে কী হবে, ম্যাক্সিমিলিয়ানের অনুরক্ত ভক্ত সারা পৃথিবীতে তৈরি হয়ে গেছে। লোকটা বাস্তবের তেতো কথাগুলো বলে। সত্যিই তো জার্মান জাতি আজ দ্বিধাবিভক্ত। পৃথিবীটা জার্মানদের বাপের সম্পত্তি বলে এই নয় যে, সভ্যতার অগ্রধাবন থেমে থাকবে। শুধুমাত্র জাতির অহং-এর ধ্বজাধারী হয়ে বসে থাকা তো নিজের ছায়ার সঙ্গে প্রবঞ্চনার সামিল। বাওয়ারের অনুগামীরা বুঝতে পেরেছে, লুইস উলফ লোকটা ধান্দাবাজ।
ম্যাক্সিমিলিয়ানের বক্তৃতা শেষের পরে এক আকস্মিক দৃশ্যে হইচই পড়ে গেল বার্লিনের সভায়। লুইস উলফ চেয়ার ছেড়ে উঠে একেবারে বুকে জাপটে ধরলেন তাঁর চরমতম শত্রুকে।
পিঠ চাপড়ানি দিতে দিতে বেশ কয়েকবার বললেন, ‘ব্র্যাভো, ব্র্যাভো মাই বয়! পার্টি এতদিনে যোগ্য নেতা খুঁজে পেয়েছে!’
কিন্তু যেটা শোনা গেল না, সেটা একটা ছোট্ট শব্দ। ম্যাক্সিমিলিয়ানের কানের গোড়ায় মুখ ঠেকিয়ে লুইস ঠান্ডা গলায় বললেন, ‘গুডবাই!’
তখন জনতা উচ্ছ্বসিত। কেউ কেউ ভীষণ অবাক। তবু সকলে পরস্পরকে জড়িয়ে ধরে আনন্দে লাফাচ্ছে। চিৎকার করছে। পবিত্র পৃথিবী বোধহয় এই দিনের অপেক্ষাতেই ছিল। ঠান্ডা যুদ্ধে অবশেষে ইতি। অবশেষে স্নেহের আলিঙ্গন এবং অবশেষে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। হইচই স্তব্ধ করে দিয়ে একটা বেওয়ারিশ স্নাইপারের বুলেট ছিঁড়ে নিয়ে গেল ম্যাক্সিমিলিয়ানের স্নায়ুর কিয়দাংশ। লুইস আলিঙ্গন মুক্ত করে নিথর দেহটা শুইয়ে দিল মঞ্চের ওপর। লুইসের ঝাঁঝালো চাহনি বোধহয় সাধারণের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল, আমরা হলাম অ্যারিস্টোক্র্যাটস। এই আমাদের দর্প। হাইল হিটলার!
পৃথিবী থেকে ছয় আলোকবর্ষ দূর
সাইকি — সেল নাম্বার তিন
–মেয়েটা কে? জানতে পারলে?
–পাগলের প্রলাপ!
–নাৎসিদের মৃত্যু অতই সস্তা?
–যদি সত্যি হয়, তাহলে?
সেল নাম্বার আট
–আমারও মন বলছে, খবরটা সত্যি।
–সত্যি হলেই বা, তোমার আমার কী?
–উঁহু। তোমার আমার নয়, আমাদের।
–মানে?
সেল নাম্বার তেরো
–বাঁচতে ইচ্ছে করছে না তোমার?
–ভুলে গেলে, কাল সকালেই আমাদের হোলি শাওয়ার।
–তার মানে হাতে এখনও এগারো ঘন্টা!
–হোয়াট?
–ঐ তো নিকোলাই ইভানভ!
সাইকিতে বন্দির সংখ্যা দশ হাজারের বেশি। বন্দিদের কুড়িটা সেগমেন্টে ভাগ করে রাখা হয়েছে আলাদা আলাদা সেলে। যেমন তেরো নম্বর সেল— বিশ্বযুদ্ধের আমলের খুপড়ি নয়— বাতাসবহুল একটা ঘর তবে দুশো জনের পক্ষে যথেষ্ট নয়। জানলা নেই। পাসওয়ার্ড প্রটেকটেড হাইটেক মেটালের দরজার ওপারে ছোট অফিস, যেখানে দুজন এসএস-জেনারেল লেজার গান হাতে পাহারায়।
পাগল মেয়েটাও নিকোলাইয়ের গল্প শুনছে একমনে। ওর চোখ দুটো সবসময়েই জ্বলছে, কখনও মনে হয়, মেয়েটা সুস্থ। পাগলামির ভান করছে। কিন্তু তাই বা করবে কেন এই নিপীড়িতের গ্রহে?
সাইকির জন্মই হয়েছে অত্যাচারের জন্যে, সে যেদিকে তাকিয়েছে, সেদিকেই দেখেছে মৃত্যু। বিষাক্ত কেমিক্যালে পোড়া লাশ সাইকির দেহে ঢিবি হয়ে রয়েছে। প্রাণ কাকে বলে সাইকি জানে না। সাইকির নিঃশ্বাসে মাংসপোড়া গন্ধ, বিষাক্ত কেমিক্যাল আর অ্যাসিড বৃষ্টির ধোঁয়াশা। সেই মাটিতে দাঁড়িয়ে কিনা মুক্তপৃথিবীর খবর রটেছে, তাও রটিয়েছে কে? বছর তেইশের একটা পাগল মেয়ে।
মেয়ে! সাইকি তো কোনওদিন নারীর স্পর্শ পায়নি। প্রথম যখন সাইকিতে আকাশঢাকা ধোঁয়া ছেড়ে মাদারশিপ ল্যান্ড করেছিল, সাইকির রক্তক্ষরণ বন্ধ হয়ে যায় সেদিনই। তারপর থেকে প্রতিমাসে প্রিজনার শিপের ল্যান্ডিং, এসএস-জেনারেলের ভারী বুটের শব্দ, উন্মাদ বন্দিদের শীৎকারে কেঁপে উঠেছে সাইকি, এখন কেমন অভ্যেস হয়ে গেছে। কৃত্রিম পৌরুষত্ব আরোপ করে সাইকিকে কক্ষনও জানতে দেওয়া হয়নি, সে আসলে নারীই। ঠান্ডা ঘরে বসে বাচ্চা বিয়োনো ছাড়া এই পৃথিবীতে নারীদের কতটুকুই বা অস্তিত্ব আছে? তাদেরও জন্ম হয় অত্যাচারের জন্যে, টিপে-চুষে নেওয়ার জন্যে। কী আশ্চর্য মিল সাইকির সঙ্গে!
–নিকোলাই, হাতে এখনও এগারো ঘন্টা!
–তাহলে তোমাদের মগজও বিগড়েছে দেখছি।
–বেশ, মেনে নিচ্ছি খবরটা আদ্যোপান্ত মিথ্যে। প্রমাণ কই?
–আচ্ছা হলই বা সত্যি। এরপরে কী করবে তোমরা? প্রিজনার শিপের সিস্টেম রিবুট করবে?
–করব।
–ইউ গাইজ আর গোয়িং ক্রেজি! প্রফেশনাল প্রোগ্রামার ছাড়া সিস্টেম রিবুট করা অসম্ভব।
–আপনি তাহলে এটাও বলতে পারবেন যে, কোন সেলে একজন দক্ষ প্রোগ্রামার বন্দি আছেন?
কয়েক মিনিট চুপ করে রইলেন নিকোলাই। ছলছলে চোখ দুটো মেঝের দিকে স্থির। যেন স্মৃতির উল্কাপাত হচ্ছে মস্তিষ্কের ভেতর।
–অরিঘ্ন বোধহয় আর বেঁচে নেই!
–অরিঘ্ন! মানে অরিঘ্ন বোস? যিনি লুইস উলফের সেক্স স্ক্যান্ডেল ইন্টারনেটে লিক করে দিয়েছিলেন?
–হ্যাঁ।
–সেল নম্বরটা বলুন নিকোলাই, প্লিজ!
–হবে না, কিচ্ছু হবে না। আর তোমাদের কেনই বা মনে হল যে খবরটা সত্যি? কেন? সারাজীবন যে পৃথিবীর স্বপ্ন দেখতে দেখতে বড় হয়েছি, এতই সহজে পেয়ে যাব আমি? হয় না। বাস্তবের মাটিতে তাকাচ্ছ না কেন তোমরা?
–তাকিয়েই তো দেখতে পাচ্ছি বিদ্রোহের অস্পষ্ট ভাষা। কুইক নিকোলাই, সেল নম্বরটা বলে দিন।
–শেষ দেখা হয়েছিল সাত নম্বর সেলে!
তেরো থেকে সাত, সুদীর্ঘ একটা পথ। শিয়রে মৃত্যু, তবুও শেষ কামড়টা না দিলে চলবে! ভবিষ্যত প্রজন্ম চিনবে কেমন করে মানুষকে? হয়তো ইতিহাস হয়ে ওঠার পিছনে এতটাই নাছোড়বান্দা মনোভাব দায়ী থেকে যায়। এগারো ঘন্টা সময়টা বড্ড কম, এক্ষুনি মাথা তুলে দাঁড়াতে হবে। কিন্তু এর মধ্যেই যদি প্রিজনার শিপ পৃথিবীর পথে রওনা দেয়, তাহলে? চুলোয় যাক, আলোর খোঁজ করতে শুরু করলে আর থামা নয়। দৌড়, দৌড়, দৌড়…
পৃথিবীর সময়ানুযায়ী সাইকিতে এখন রাত আটটা। আগামীকাল সকাল সাতটায় ওদের হোলি শাওয়ার। অর্থ্যাৎ যুদ্ধটা এই মধ্যবর্তী এগারো ঘন্টার। ঠিক রাত নটায় হাইটেক মেটালের দরজা খুলে যাবে। দুজন এসএস-জেনারেলসহ আটজন গার্ড সেলে ঢুকবে। লাইন করে দাঁড় করিয়ে গুনবে, আর একথালা করে গমসেদ্ধ হাতে ধরিয়ে দেবে। তখনই ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে। সামান্য একটা মিথ্যে কথার এত জোর!
১২ই আগস্ট, ২০৯৫
হেস্যেন
ম্যাক্সিমিলিয়ানের নিজের প্রদেশেই প্রথম স্ফুলিঙ্গ জ্বলে উঠল। স্বাভাবিক। শহরের রাস্তা অচল। হেস্যেনের চোখধাঁধানো ওয়াটার প্ল্যান্টেশানে তালা পড়েছে— যে জল সমস্ত জার্মানির তৃষ্ণা মেটাত। হেস্যেন প্রদেশের এসএস-এর প্রতিটা অফিস জ্বালিয়ে দিয়ে বার্লিনের দিকে এগোচ্ছে ক্ষিপ্ত বাওয়ারপন্থীরা। শহরের টাওয়ারে টাওয়ারে ম্যাক্সিমিলিয়ান বাওয়ারের ছবি ঝুলছে, বৃহৎ এলইডি স্ক্রিনে ‘হ্যাশট্যাগ ফাক উলফ!’ টানা আড়াই দিন ধরে সোশ্যাল মিডিয়ায় একনম্বর ট্রেন্ডিং লুইস উলফের সেক্স স্ক্যান্ডেলের ভিডিও।
বার্লিনের দক্ষিণপ্রান্তে হেস্যেন প্রদেশ। পৃথিবীর সর্বোৎকৃষ্ট ল্যাবরেটরি ‘ডি এলিট’ এই রাজ্যের হৃদপিণ্ড। ‘ডি এলিট’ হেস্যেনে গড়ে ওঠার পেছনে ছিল হেস্যেনের গর্ভে ইউরেনিয়াম, প্লুটোনিয়ামের মতো রেডিও-অ্যাক্টিভ মৌলের আধিক্য। মেইন-কিনজিক জেলার রনেনবুর্গ মিউনিসিপ্যালিটিতে ইউরেনিয়াম খনি আবিষ্কৃত হয়েছিল উনিশশো পঞ্চাশ সালের শেষদিকে। আকরিক থেকে প্রায় পঁয়তাল্লিশ শতাংশ ইউরেনিয়াম নিষ্কাশন করা সম্ভব হয়েছিল সেইসময়। চল্লিশ বছর ধরে যথেচ্ছ পারমাণবিক শক্তির ব্যবহারের পরে রনেনবুর্গের ভাণ্ডার এখন প্রায় নিঃস্ব। তাই বলে ‘ডি এলিট’কে তো সরিয়ে আনা সম্ভব নয়। বহাল তবিয়তে সে হেস্যেনেই রয়ে গেল। অতএব হেস্যেনের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্নতার অর্থ মূর্খামি। বাইরের পৃথিবীতে থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখলে ক্ষমতা হাত থেকে ছুটে যাবে। তখন কী করবে লুইস?
১২ই আগস্ট, ২০৯৫
বার্লিন
রাস্তায়, ট্র্যাফিকে, হোটেলে, ক্যাফেতে, ঘরে ঘরে সশস্ত্র উলফপন্থীরা তৈরি হচ্ছে। বার্লিনকে এক অদৃশ্য ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক ওয়াল দিয়ে ঘিরে ফেলা হয়েছে। দেওয়ালের সম্মুখে আড়াআড়িভাবে প্রতি পাঁচ মিটার অন্তর একটা করে টাওয়ার, টাওয়ারের বেসে একটা মেশিন গান, মাথায় চারটে সিসিটিভি আর একটা রোবোটিক স্নাইপার। অদৃশ্য দেওয়ালের পাঁচশো মিটারের মধ্যে কিঞ্চিৎ নড়াচড়া করলেই প্রথমে সিসিটিভি কানেক্টেড মেশিন গান থেকে ফায়ারিং শুরু হবে। কাজ খতম না হলে স্নাইপার। তারপরেও যদি ভাগ্যের জোরে কেউ বেঁচে যায় এবং দেওয়ালের দশ মিটারের মধ্যে ঢুকে পড়ে, ম্যাগনেটিক ওয়াল অসীম শক্তি দিয়ে তাকে নিজের দিকে টেনে নেবে। ইলেক্ট্রিফায়েড হয়ে মৃত্যু।
জার্মানির ইন্টারনেট শাটডাউন। হেস্যেন থেকে একটাও খবর যেন পৃথিবীতে না ছড়ায়। যুদ্ধ হলেও লুকিয়ে হবে, নইলে যে দর্পচূর্ণ। লুইস উলফের ছাব্বিশতলা উঁচু বাড়ির নিরাপত্তা বাড়িয়ে দিয়েছেন চ্যান্সেলার। এদিকে চ্যান্সেলারের নিজের নিরাপত্তাও সংশয়ে। বার্লিনের আকাশে ড্রোনের ছড়াছড়ি। সর্বদা লাইভ টেলিকাস্ট করছে লুইস উলফের গ্যালারির জায়ান্ট স্ক্রিনে। সাস্পিসিয়াস কিছু ট্রেস করা মাত্রই ছেঁকে ধরবে নাৎসি পুলিশ। অপেক্ষা করা হবে চ্যান্সেলারের সিদ্ধান্তের। কিন্তু সিকিউরিটির মধ্যেই যদি ট্রোজান হর্স থেকে থাকে! গতকাল সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়েছিলেন উলফ এবং যা বললেন, শুনে তাজ্জব হওয়ার জোগাড়।
–ম্যাক্সিমিলিয়ান বাওয়ারের মৃত্যুতে সারা পৃথিবীর পাশাপাশি আমিও গভীরভাবে শোকাহত। কিন্তু এই মৃত্যুর জন্যে আমাকে দায়ী করছেন কেন আপনারা? ম্যাক্সিমিলিয়ান আমার অত্যন্ত স্নেহের পাত্র ছিল। আমি নিজে ওর কথা শোনার জন্যে উন্মুখ হয়ে থাকতাম। তাছাড়া আমাদের ভুলে গেলে চলবে না, মানুষের মৃত্যু এই দু হাজার পঁচানব্বইয়ে দাঁড়িয়ে নিতান্তই ছোট ঘটনা। মোমবাতি হাতে মিছিল করুন, অকারণে ক্ষেপে উঠবেন না। আবারও বলছি, আমি এই মৃত্যুর জন্যে কোনওভাবেই দায়ী নই। আমাদের জাতি শুদ্ধ, ইতিহাসে কোথাও বিশ্বাসঘাতকতার পরিচয় ছিল না, এখনও নেই। এই হত্যা বহিরাগতদের ষড়যন্ত্র, বাওয়ারপন্থীদের সেটা বুঝতে হবে। তারপরেও যদি তারা অবুঝের মতো আচরণ করেন, তাহলে বুকে পাথর রেখে বলছি, স্রেফ গুলি করে মারা হবে।
১৩ই আগস্ট, ২০৯৫
বেজিং
চাঁদের অভিযান বা মঙ্গলে কনসেন্ট্রেশান ক্যাম্প তৈরি, হেভিওয়েট গবেষণা থেকে অধিক ধ্বংসাত্মক কেমিক্যালের আবিষ্কার, এই সমস্ত কর্মকাণ্ড দু হাজার সতেরো পর্যন্ত হেস্যেনের ডি এলিটেই সম্পাদিত হত। সমস্যার সৃষ্টি হল ওয়ার্মহোল আবিষ্কারের পরেই। ওয়ার্মহোলের মুখ খোলা রাখার জন্যে যেহেতু প্রচুর নেগেটিভ এলিমেন্টের প্রয়োজন হয়, তাই প্রয়োজন হয় ইলেকট্রনের। প্রকৃতিতে ফ্লোরিনই একমাত্র মৌল, যার বাইরের কক্ষে সাত সাতখানা ইলেকট্রন বর্তমান। অতএব, ওয়ার্মহোল এক্সপিডিশানের জন্যে চাই ফ্লোরিনের অফুরন্ত ভাণ্ডার। যেহেতু ফ্লোরিন অত্যধিক সক্রিয়, প্রকৃতির মধ্যে তাকে ফ্লোরাইড হিসেবে পাওয়া যায়। আর পৃথিবীর সর্বাধিক ফ্লোরাইড খনি বিরাজ করছে চিনে। তাই দু হাজার আঠেরো সালে ‘ডি এলিট’-এর দ্বিতীয় শাখা গড়ে উঠল চিনের বেজিং শহরে।
ম্যাক্সিমিলিয়ান এসএস-কর্নেল হওয়ার পরেও ছিলেন বিজ্ঞানের একনিষ্ঠ সাধক। শ্রমিক পরিবারের সন্তান, চেতনে-অচেতনে শ্রমিক উন্নয়নের পথ বিস্তৃত হয়ে থাকত। কৃষকের কষ্ট লাঘবের জন্যে অত্যাধুনিক প্রযুক্তির যন্ত্র তৈরির প্রকল্প শুরু করেছিলেন তিন বছর আগে। বাওয়ার নিজে ধানের অধিক ফলনশীল বীজ আবিষ্কার করায় পৃথিবীজুড়ে রব উঠেছিল, ‘সাধু, সাধু!’
নাৎসি পার্টি ক্ষমতায় এসে যতই সভ্যতাকে শিখরে পৌঁছে দিক, দুঃখবিদারক ওষুধের বন্দোবস্ত করুক বা বারংবার প্রমাণ করার চেষ্টা করুক যে, আমরাই শ্রেষ্ঠ জাতি; শ্রমিক-কৃষক-মজদুর শ্রেণি যে তিমিরে ছিল, সেই তিমিরেই রয়ে গেল। প্রতিবছর আন্তর্জাতিক সম্মেলনে শ্রমিকশ্রেণির উন্নয়নের স্বার্থে দীর্ঘ দীর্ঘ ভাষণ, লোভনীয় প্রকল্পের প্রস্তাব কাগজকলমেই সীমাবদ্ধ থেকেছে। তাদের অন্ধকারে এক ছটাক আগুন জ্বালতে শুরু করেছিলেন ম্যাক্সিমিলিয়ান। এখন তো মানুষটাই নেই আর…
হেস্যেনের আগুন প্রথমে ছিটকে এসে পড়ল চিনের বেজিং-এ। ‘ডি এলিটের’ ভেতরেও তখন ধ্বংসলীলা শুরু হয়ে গেছে। চ্যান্সেলারের ওপর আক্রোশ, বিদ্বেষ, ঘৃণায় অসংখ্য বিজ্ঞানী একে একে ফেটে পড়ছেন— ল্যাবরেটারি থেকে নেমে আসছেন রাস্তায়। তারস্বরে চিৎকার করে সবাই লুইস উলফের মৃত্যুকামনা করছে। এতকিছুর পরেও স্বার্থান্বেষীরা নীরবেই থাকলেন— পরিস্থিতি একদিন স্বাভাবিক হলে অন্তত তাদের চাকরি থেকে বরখাস্ত করার প্রশ্ন উঠবে না।
বিদ্রোহের আগুন যে এত দৈত্যাকার হয়ে উঠবে, বেজিং-এর এসএস-জেনারেলরা কল্পনাও করতে পারেননি। ‘ডি এলিটের’ সিইও বার্লিনে ফোন করার আগেই খুন হলেন। বেজিং-এর ইন্টারনেট শাটডাউন। পৃথিবীর অন্য সমস্ত দেশও তখন আগুনের খিদেয় রাস্তায় নেমেছে। গোটা আফ্রিকা জ্বলছে, এশিয়াকে নেতৃত্ব দিচ্ছে চিন, লাতিন আমেরিকায় কিউবা। অপার বিস্ময়ে তাকিয়ে দেখতে হয়, নিউইয়র্কের মিছিল আটকে দিয়ে মুহুর্মুহু গর্জে উঠছে রোবোটিক মেশিনগান, এসএস-জেনারেলদের বম্বিং, তবু মানুষের প্রতিরোধ কমছে না। বার্লিনের উলফপন্থীদের পাশে এসে দাঁড়াল ইতালি, ব্রিটেন এবং স্পেন।
বেজিং-এর ডি এলিট থেকে তবুও বার্লিনে খবর পৌঁছল। লুইসকে বলা হল, ‘সাইকির প্রিজনার শিপের সঙ্গে আমাদের কানেকশান লস্ট হয়েছে। এবং আশ্চর্যের বিষয়, প্রক্সিমা সেন্টরিতে অবজার্ভেশানের জন্যে যে শিপটা পৌঁছেছিল, সেটাও সম্পূর্ণ বেপাত্তা।’
–আর তোমরা পায়ের ওপর পা তুলে রঙ্গ দেখছ?
–সিচুয়েশান আমাদের হাতের বাইরে চলে গেছে স্যার।
–হাউ ডেয়ার ইউ?
পৃথিবী থেকে ছয় আলোকবর্ষ দূর
সাইকি — সেল নাম্বার সাত
–অরিঘ্ন! তুমি, তুমি বেঁচে আছো?
–নিকোলাই! তুমি, তুমিও?
–জানি না কতক্ষণ আর বেঁচে থাকতে পারব।
–খবরটা তাহলে সত্যিই নিকোলাই!
নিকোলাই নিঃশব্দে কেঁদে চলেছেন। চারিপাশে এত শব্দ, এত মুখরতা, তবু এক অদ্ভুত নৈঃশব্দ, প্রগাঢ় শান্তি।
–সত্যির জোরেই দেখছ না, এই পাসওয়ার্ড প্রটেকটেড দরজা ভেঙে ফেলেছি আমরা!
রাত নটার সময় সেল নাম্বার তেরোর দরজা খুলেছিল। লাইন করে দাঁড়িয়ে একথালা গমসেদ্ধ হাতে ধরিয়ে দেওয়া হচ্ছিল বন্দিদের। বারুদের ছিটেফোঁটা প্রত্যেকের অন্দরেই বিদ্যমান, তবু কীসের যেন খুব প্রয়োজন। পদদলিত হতে হতে সাহসের ডানা দুটোয় কেমন জং ধরে যায়! নিজেকে বিশ্বাস করতেই ভয় লাগে।
খাবার থালা হাতে নিয়ে সেই পাগল মেয়েটা এসএস-জেনারেলের মুখে থুতু ছিটিয়ে বলল, ‘জানো না, পৃথিবীটা এখন আমাদের!’
লাইনের শেষপ্রান্ত থেকে কোনও মহামানবের নির্দেশে ছিটকে বেরিয়ে গেল কয়েকজনের জটলা। ঝাঁপিয়ে পড়ল এসএস-জেনারেলের ওপর। হাত থেকে লেজার গান কেড়ে নিয়ে চোখের নিমেষে অদৃশ্য করে দিল পাসওয়ার্ড প্রটেকডেড হাইটেক মেটালের দরজা। তারপর পাতা ঝরে যাওয়ার মতো করে আরও একজন এসএস-জেনারেল। আটজন গার্ডের ধাতস্থ হতে সময় লেগেছিল সামান্য। ঐটুকু সময়ের মধ্যেই তারা উধাও। অত্যাধুনিক অস্ত্র এই লেজার গান। ট্রিগারে চাপ দিলেই নিঃসারিত লেজার যে বস্তুর ওপর গিয়ে পড়বে, সেই অদৃশ্য।
সাইকি পৃথিবীর তুলনায় উষ্ণ। বিশেষভাবে তৈরি স্যুট খুব বেশি পাওয়া যায়নি সাইবার সিকিউরিটি রুম থেকে। অক্সিজেনমাত্রা সূচক ঘড়িগুলো প্রায় নেই। আসলে বিপ্লবের সময়ে, সমস্ত প্রতিকূলতাকেই উপেক্ষা করা যায়। শরীরে অক্সিজেনের ভাগ আপনা থেকেই চরমে উঠে যায়। এসএস-জেনারেল আর গার্ডদের শরীর থেকে স্যুট এবং ঘড়িগুলো খুলে নেওয়া হয়েছে। সাইকির উষ্ণতায় তাদের মাংস সেদ্ধ হচ্ছে প্রাকৃতিক নিয়মেই।
সেল নাম্বার তেরো থেকে দুটো লেজার গান আর চারটে অটোম্যাটিক রাইফেল নিয়ে একটা টিম ছুটল সেল নাম্বার সাতের দিকে। বাকি রাইফেলগুলো তুলে নিয়ে সেলের সবাই মুক্তির স্বাদ ছড়িয়ে দেওয়ার জন্যে সেলের পর সেল আক্রমণ করতে শুরু করল। হোলি শাওয়ারের আট ঘন্টা আগেই সাইকি নাৎসিমুক্ত। সত্যি সত্যি।
–আমার বিশ্বাস, সাইকিতে আরও দুটো স্পেসশিপ আছে। ব্যাকআপ হিসেবে শুরুর দিকেই এসেছিল, ফিরে যায়নি।
–এত বড় কথাটা আপনি আমাদের আগে বলেননি কেন নিকোলাই? মুক্ত মানুষের উত্তেজনা ঝরে ঝরে পড়ছে।
–সাইকি এক্সপিডিশানের প্রধান উপদেষ্টা ছিলাম আমিই। চাইনি, প্রাণপণে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেও পারিনি।
প্রিজনার শিপ ছাড়াও সাইকিতে আরও দুটো স্পেসশিপ বর্তমান— যেগুলোকে অ্যাক্টিভেট করতে পারেন একমাত্র নিকোলাই ইভানভ। সাইকির এসএস অফিসের গোপন লকারে ব্যাকআপ স্পেসশিপ দুটো অ্যাক্টিভেটের রিমোট ছিল। অফিস ভেঙেচুরে রিমোট খুঁজে পাওয়া গেছে। এবার শুধু অ্যাক্টিভেশানের অপেক্ষা।
প্রিজনার শিপের দরজা খুলে ভেতরে পা রাখল অরিঘ্ন। এই শিপে করেই বন্দিদের আনা হয়। সাইকির এসএস-জেনারেলের ছাড়পত্র না পেলে, প্রিজনার শিপ পৃথিবীতে ফিরে যেতে পারে না। একটা বিশেষ কোডের মাধ্যমে এই ছাড়পত্র দেওয়া হয়, যেটা থাকে এসএস-জেনারেলের মস্তিষ্কে। আর যাইহোক, মনুষ্য স্মৃতির পরিবর্ত এখনও খুঁজে পাওয়া সম্ভব হয়নি। যেহেতু এইমুহূর্তে একজনও এসএস-জেনারেল বেঁচে নেই, উপায় একমাত্র, প্রিজনার শিপের সিস্টেম রিবুটের সময় ঐ সিস্টেমে ঢুকে স্পেশাল কোডের এন্ট্রিটাকে রিপ্লেস করে ফেলা। তাহলেই প্রিজনার শিপটা অরিঘ্নর হাতের মুঠোয়। সাইকির বাতাসে স্বাধীনতা ঘোরাফেরা করছে।
১৫ই আগস্ট, ২০৯৫
হেস্যেন
–থ্যাঙ্ক গড! সাইকির প্রিজনার শিপটা ফিরে আসছে!
–শুধু সাইকি না, প্রক্সিমা সেন্টরি থেকেও!
–কিন্তু, দেখো, ঐ যে ওদের পেছনে নেপচুনের দুটো ব্যাকআপ স্পেসশিপ!
–মানে?
–একী, এদিকে সাইকির ব্যাকআপ স্পেসশিপ দুটো অ্যাক্টিভেট হল কীভাবে?
–প্রফেসার, সমস্ত গ্রহের ব্যাকআপ স্পেসশিপগুলো একসঙ্গে অ্যাক্টিভেট করা হয়েছে।
–ওরা পৃথিবীতে ফিরে আসছে।
–ধেয়ে আসছে!
–পৃথিবী পুনরুদ্ধার করতে।
–হোয়াট? হতে পারে না।
স্পেস টেলিস্কোপে চোখ রেখে ডি এলিটের বিজ্ঞানীরা এ কোন অপার্থিব দৃশ্যের সম্মুখীন! স্বপ্ন নয়তো?
১৫ই আগস্ট, ২০৯৫
বেজিং
–প্রতিটা স্পেসশিপের সিস্টেম ওরা কন্ট্রোল করছে।
–আমরা নিরুপায়!
–এই তাহলে অ্যাপোক্যালিপ্স?
–হেস্যেন থেকে অস্ত্র হাতে মানুষ ছুটে আসছে বার্লিনের দেওয়াল ভাঙতে!
১৬ই আগস্ট, ২০৯৫
বার্লিন
–চ্যান্সেলার, খবরটা কি সত্যি?
–মেনে নেওয়া কষ্টসাপেক্ষ। প্রতিটা গ্রহই নিজস্ব শক্তি দিয়ে বিদ্রোহ করেছে।
–তাই বলে একইদিনে? একসঙ্গে?
–নিতান্তই কাকতালীয়!
–মানি না, মানি না। বিশ্বাসঘাতক আমাদের মধ্যেই আছে।
–আছে বলেই বার্লিনের দেওয়াল ভেঙে গেছে।
–আমার মনে হয়, এই সবটাই আপনার মস্তিষ্কজাত।
–আর আমার কী মনে হয় জানো লুইস? তুমি যদি সেদিন ম্যাক্সিমিলিয়ানকে মঞ্চের উপরে না জড়িয়ে ধরতে, তাহলে ও বেঁচে যেত। এত অহঙ্কার তোমার?
–হ্যাঁ হ্যাঁ, আমি, আমিই ম্যাক্সিমিলিয়ানকে মেরেছি। উঁহু, মারিনি তো, খুন করেছি। শ্রমিকের ছেলে হয়ে জন্মেছে, শ্রমিক হয়েই বাঁচবে, শ্রমিকের মতোই মরবে। এতে আশ্চর্যের কী?
–তোমার মধ্যে আমি বেন উলফকে দেখতে পাই।
–ছিঃ ছিঃ ছিঃ! এত বড় অন্ধ আমি?
–ভাগ্যিস! নইলে কী আর আমি চ্যান্সেলার হই!
–মরবে, তুমিও মরবে।
–পরিবর্তে এই যে, পৃথিবীকে তুলে দিচ্ছি মানুষের হাতে।
এরপরে আর লুইস উলফ বা চ্যান্সেলার আর্নল্ড ডিট্রিক, দুজনের কেউ বেঁচে রইলেন না। বার্লিনের রাস্তায় নাৎসিদের যুদ্ধ চলছে। ভাই ভাইকে গুলি করছে, বাবা নিজের সন্তানের পেট চিরে বের করে নিয়ে আসছে নাড়িভুঁড়ি, মেয়েরাই মেয়েদের উলঙ্গ করে ঢেলে দিচ্ছে অ্যাসিড। কেউ জানে না কেন এই হত্যালীলা, সবাই জানে মারতে হবে। মারতে মারতে মরতে মরতে একজনও চেঁচিয়ে বলল না, ‘হাইল হিটলার!’
গ্যালাক্সির সমস্ত ছায়াপথ, মহাশূন্যের প্রতিটা আলোককণা, কিম্বা কোনও ধুমকেতু, প্রত্যেকেই যেন সংক্রামিত হয়েছে এক মুক্তসত্তায়। সাইকির নেতৃত্বে পৃথিবীর দিকে ছুটে আসছে অসংখ্য স্পেসশিপ। তারা প্রত্যেকেই কেমন করে যেন আঁকড়ে ধরেছে সামান্য একটা মিথ্যে কথাকে। তারা প্রত্যেকেই কেমন করে যেন বিশ্বাস করে ফেলেছে, পৃথিবীতে আর নাৎসিরা বেঁচে নেই।
খতমের পরে: সাল উনিশশো বিরানব্বই। অ্যামাজনের দুর্গম এলাকায়, যেখানে রোদ্দুর পৌঁছোয় না, জীর্ণ কুটিরের স্যাঁতস্যাঁতে পারিপার্শ্বিকে গা ঢাকা দিয়েছিল এক রাশিয়ান যুগল। বেন উলফ অর্থ্যাৎ লুইস উলফের পিতাকে গোপনে হত্যার নকশা তৈরি করছিল তারা। কিন্তু তার আগেই নাৎসিবাহিনীর মারণ কামড় পড়ে তাদের ওপর। রাশিয়ান মেয়েটি সদ্য তিনটি সন্তানের মা হয়েছে। নাৎসিদের ক্রূর দৃষ্টির অলক্ষ্যে কুটিরের নীচে সন্তানদের লুকিয়ে ফেলেছিল সে। দিন সাতেক পরে তিনজন শিশুকে খুঁজে পায় আফ্রিকার এক দুর্ধর্ষ উপজাতি— নাৎসিরা যাদের অস্তিত্ব টের পাওয়া সত্ত্বেও যুঝতে চায়নি। আসন্ন অ্যাপোক্যালিপ্সের জন্ম তাদের হাত ধরেই। তিনজনের মধ্যে সবচেয়ে ছোট মেয়েটির নাম আগাথা, যে স্বেচ্ছায় বন্দি হয়ে সাইকিতে পা রাখে। আগাথা এবং তার বোন ইলিনা, যৌথ প্রচেষ্টায় পৃথিবী ঘুরে পনেরো জনের টিম বানিয়েছিল, যারা স্বেচ্ছায় বন্দি হয়ে বিভিন্ন গ্রহে ছড়িয়ে যাবে একটা মিথ্যে খবর রটিয়ে দেওয়ার জন্যে। আগাথা এবং ইলিনার উপরে ছিল তাদের বড়দা— আর্নল্ড ডিট্রিক, প্রথম যিনি মিথ্যে কথাটা বলেছিলেন, ‘পৃথিবীতে আর নাৎসিরা বেঁচে নেই।’
সাইকি সম্পূর্ণরূপে লেখকের মস্তিষ্ক এবং হৃদয়প্রসূত। যদি ইচ্ছে করে, তাহলে বাস্তবের সঙ্গে সাইকির সঙ্গতি থাকবে, নইলে ফিকশান। বলে রাখা উচিত, সাইকি আসলে গ্রিক শব্দ, যার অর্থ আত্মা। বিপ্লবের বীজ আদপে আত্মাতেই নিশ্চিত নিহিত থাকে কিনা!