Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

মুসাফির এ মন

নীলাঞ্জন হাজরা

 

পূর্ব প্রকাশিতের পর

ওপরের যে ছবিটা দেখছেন এটা পাকিস্তানের রাজধানী ইসলামাবাদের৷ এ ছবিটা আমি তুলেছিলাম ইসলামাবাদের পাশেই একটি ছোট্ট শৈলাবাস আছে, যার নাম দামন-ই-কোহ্, সেখানকার একটি পার্ক থেকে৷ আমার ইসলামাবাদের স্মৃতি ঠিক এই ছবিটার মতোই— কিছুই বলে না যে ছবি৷ কিছু কিছু শহর আছে, আমি দেখেছি, আমার মনে কোনও ছাপ ফেলে না৷ সেটা আমারই দোষ নিশ্চয়ই, নইলে শিকাগো বা লন্ডনের মতো জাঁদরেল শহরও সে তালিকায় ঢুকে পড়বে কেন! এ সব শহর আমার মুখোমুখি বসে না, রসিয়ে নিজের রঙের কথা, রসের কথা আমায় শোনায় না দু পাত্তর খেতে খেতে৷

ইসলামাবাদের স্মৃতিও আমার কাছে তেমনই এক শহরের৷ এমনই ঝাপসা যে, কোন হোটেলটায় ছিলাম, তার ঘরটা কেমন ছিল, তাও ভাল করে মনে করতে পারছি না৷ সরকারি আতিথেয়তার নাগপাশে বাঁধা শীতাতপনিয়ন্ত্রিত জাপানি মিনিবাসে ঘুরে বেড়াতে বেড়াতে বুঝলুম, অন্তত যে অঞ্চলটায় আমাদের নিয়ে ঘুরে বেড়ানো হচ্ছে সেটা বেশ ছিমছাম, পরিপাটি৷ অনেক বিদেশি গাড়ি৷ সোজা সোজা, চওড়া চওড়া, মসৃণ রাস্তা৷ রাস্তার পাশে বড় বড় গাছ৷ সব বেশ মেপেজুপে করা৷ মনে হল কোনও পাঁচতারা হোটেলের লবিতে ঘুরে বেড়াচ্ছি, যার গোটাটাই আসলে দেখনাই৷

আমাদের সঙ্গে গাইড হিসেবে থাকা প্রোটোকল অফিসার কুরেশি সাহাব গর্বের সঙ্গে জানান, ১৯৬০-এর দশকে রাজধানী হিসেবেই বিশেষ যত্ন নিয়ে তৈরি হয়েছে ইসলামাবাদ শহর৷ প্রথম বাক্যেই উত্তর পেয়ে যাই, কেন এ শহর আমার মুখোমুখি বসে দু পাত্তর খেতে খেতে শোনাচ্ছে না হরেক রঙের হরেক রসের গপ্পো। কী করে শোনাবে? যে উপমহাদেশে সভ্যতার শুরু কম সে কম পাঁচ হাজার বছর আগে হরপ্পা-মহেঞ্জাদাড়ো দিয়ে, সে আসরে কে ঢুকতে দেবে ৫০ বছরের ছোকরাকে? আটটি পরিপাটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে ইসলামাবাদকে— প্রশাসনিক পাড়া, কূটনৈতিক পাড়া, বসতি পাড়া, বাণিজ্যিক পাড়া… এইরকম আর কী। একবার ভাবলাম, জিজ্ঞেস করি গণিকা-পাড়াও আছে নাকি? কারণ যে শহরে সেটি নেই সে শহর এখনও বড় হয়নি, নাদান৷ জানি কথাটা ভয়ঙ্কর ‘পলিটিক্যালি ইনকারেক্ট’, কিন্তু আসলে আমাদের সভ্যতাটাই (বা অসভ্যতাটাই) যে বড় পলিটিক্যালি ইনকারেক্ট৷ সে যাকগে, এহেন ইসলামাবাদের উত্তরে মারগাল্লা পাহাড় শহরকে দেয় শীতল বাতাস, জানান কুরেশি সাহাব। তিনি আরও জানান, এই ইসলামাবাদের রাস্তায় রাস্তায় নাকি লাগানো রয়েছে ২০০০ ক্যামেরা৷ সব নজরবন্দি। স্বাধীনতার পায়ে অদৃশ্য বেড়ি৷

এই ইসলামাবাদেই ছিল আমাদের প্রথম সরকারি প্রেস ব্রিফিং৷ পাকিস্তান বিদেশ দফতরে। মনে মনে ঠিক করেই রেখেছিলাম জিজ্ঞেস করব, কেন এই শহর-বন্দি ভিসার হাস্যকর নিয়ম? অন্য কোনও দেশে তো দেখিনি৷ যে-দুটি দেশ পাঁচ হাজার বছর আসলে একই অস্তিত্বের অঙ্গ হিসেবে একসঙ্গে হাজার ঝঞ্ঝা মাথায় নিয়ে বড় হয়েছে, কেন সে দু দেশের মানুষ একে অপরের কাছে যেতে পারবে না অবাধে? আমাদের মুখোমুখি হলেন পাকিস্তানি বিদেশমন্ত্রকের মুখপাত্র তসনিম আসলম৷ তাঁর সুসজ্জিত অফিসে একটুক্ষণ অপেক্ষা করিয়ে তারপর তিনি প্রবেশ করলেন৷ তিনি ঘরে ঢোকামাত্র আমার মুখ দিয়ে আপনা থেকেই বেরিয়ে গেল— আল্লাহ্ আপকো উম্র্-দরাজ় করেঁ! ঈশ্বর আপনাকে দীর্ঘজীবী করুন৷ ভারত আর পাকিস্তানের মাঝখানে যে অর্থহীন ঘৃণার পাঁচিল তা অনেক কিছু দিয়েই হুড়মুড় করে ভেঙে ফেলা যায়, তার মধ্যে একটি অবশ্যই নারীর রূপ, যদি অবশ্য অবলোকনকারীটি হন পুরুষ। আর আমরা তো ১৩ সাংবাদিকই মুশকো মরদ! সুগন্ধী দীর্ঘশ্বাসের মতো ঘরে প্রবেশ করলেন অপরূপ সুন্দরী তসনিম আসলম৷

অতি উচ্চশিক্ষিত— পড়াশুনা তাঁর টাফট্‌স বিশ্ববিদ্যালয়ে৷ কলকাতার সাংবাদিক আমরা, এ কথা শুনেই তাঁর মনে পড়ল তিনি সুভাষচন্দ্র বসুর ভ্রাতুষ্পুত্র সুগত বসুর সহপাঠিনী৷ চাকুরিসূত্রে ছিলেন দিল্লিতেও৷ কিন্তু ওই অবধিই, তার পরেই ভদ্রমহিলা সেই যে সরকারি ভাষার ঘেরাটোপে ঢুকে পড়লেন, আর বেরোলেন না৷

দু দেশের মধ্যের এই অর্থহীন ঘৃণার ঝড় যে আসলে সবসময় ভারতের দিক থেকেই বইতে থাকে, দাউদের হাল-হকিকত থেকে কাশ্মিরের সংঘাত থেকে ভারতীয় সংসদ আক্রমণ থেকে সমঝওতা এক্সপ্রেসে বিস্ফোরণের মতো প্রতিটা প্রসঙ্গে রঙিন তোতার মতো সে কথাই ঘণ্টাখানেক ধরে মার্কিন-মাড়া ইংরেজি উচ্চারণে আউড়ে গেলেন একের পর এক৷ সত্যি বলতে কী, তার যে পুরোটাই উড়িয়ে দেওয়ার মতো তাও হয়তো নয়৷ কিন্তু তা পাকিস্তান সরকারের সরকারি ভাষ্য৷

চেষ্টা করি আমলা নয়, মানুষ তসনিমকে বের করে আনতে৷ ঘুরিয়ে ফিরিয়ে প্রশ্ন করি, ব্যক্তিগত স্তরে কেমন ছিল দিল্লি শহরে দিন গুজরানের অভিজ্ঞতা? আশা, অন্তত একবার একটু উষ্ণতা মিলবে৷ একটু প্রশংসা৷ ফিরে গিয়ে ‘কপি’ লেখার সময় একটু ‘কালার’ দেওয়া যাবে৷ বারবার এল এক শব্দের একই উত্তর, ‘ইন্টারেস্টিং’৷ মূর্খ আমি৷ এই পরিস্থিতিতে এ মিটিং-এ এমন আশা কেউ করে?

বুঝতে পারি আমরা আসলম সাহিবার সঙ্গে কথা বলছি না, কথা বলছি পাকিস্তান বিদেশমন্ত্রকের মুখপাত্রর সঙ্গে৷ আর সেটা বুঝতে পেরেই শেষ পর্যন্ত সেই ভিসার প্রশ্নটা আর তুলি না৷ কেন তুলব? শুধু শুধু বাজে কথার খরচ৷ দু দেশেরই সরকারি পদাধিকারী ছোট-বড়-ফুল-মেজ-সেজ আমলাদের আগডুম বাগডুম শুনতে শুনতে ক্লান্ত হয়ে গেছি৷ এই একই আগডুম-বাগডুম কি আমরা ভারতীয় টেলিভিশনেও অহরহ শুনি না পাকিস্তানে ভারতের প্রাক্তন রাষ্ট্রদূত গোপালপুরম পার্থসারথির মতো ভারত-পাক সম্পর্কের বিষয়ে সবজান্তাদের মুখে?

তবু ইসলামাবাদে মুসাফিরি একেবারে ব্যর্থ হয়নি৷ সরকারি আতিথেয়তার বন্দিদশার মধ্যেও ছিটকে এসেছে এক আধটা আশ্চর্য মুহূর্ত৷ কিছু কিছু ছবি এমন এক একটা মুহূর্তকে ধরে ফেলে যা গল্পে ঠাসা৷

এই ছবিটা আমার ক্যামেরাবন্দি হয়ে গিয়েছিল একেবারেই অকস্মাৎ৷ ছবিটা দেখুন৷ ছবির লোকেশন দামন-ই-কোহ্৷ ইসলামাবাদের পাশে একটি ছোট পাহাড়ি বসতি৷ চরিত্রগুলি এরকম: ছবির একেবারে ডান দিকে সাংবাদিক জগন্নাথ চট্টোপাধ্যায়, তার বাঁ দিকে সাংবাদিক শুভাশিস মৈত্র৷ তাঁরা দুজনে একটি পাকিস্তানি পরিবারের ছবি তুলছেন৷ তিন পুত্র তাদের বাবা-মায়ের সঙ্গে একটি পার্কে বেড়াতে এসেছে৷ দুই ভারতীয় সাংবাদিক যখন ছবিটি তোলার জন্য প্রথমবার ক্যামেরা তাক করেন, তখন মা-ও পরিবারের বাকিদের সঙ্গেই ছিলেন৷ কিন্তু তাঁর ছবি তোলা হচ্ছে দেখে তিনি পলকমাত্রে দূরে সরে গিয়ে পিছন ফিরে দাঁড়ালেন৷ গপ্পোটা এখানেই শেষ নয়৷ ছবিটি আর একটু খুঁটিয়ে দেখলে চোখে পড়বে বাচ্চা তিনটির মধ্যে দুজন মায়ের দিকে মুখ ফিরিয়ে আছে৷ আসলে তারা মাকে ডাকছে— “মা, চলে এস, লজ্জার কী আছে।” স্পষ্টতই মহিলার স্বামী বাচ্চাদের উৎসাহিতই করছেন মাকে ডেকে নিতে৷ মা রাজি নন৷ তিনি রুস্যারিতে মাথা ঢাকতে ব্যস্ত৷

যখন অপরিচিত দুনিয়ায় বেরিয়ে পড়ার সুযোগ মেলে, আমার মন চায় ঠিক এমনি সব মুহূর্ত শুষে নিতে৷ কারণ এই সব মুহূর্তই আমাদের মগজের সব স্টিরিওটাইপ ভেঙে চুরমার করে৷ কোথায় এই পরিবারের বাড়ি, কোন প্রদেশের মানুষ তাঁরা, কোন ভাষাভাষী, কী তাঁদের আর্থিক অবস্থা কিছুই জানি না৷ বুঝি পাকিস্তানি, আর বুঝি মুসলমান৷ যে দুনিয়ার বাসিন্দা আমি, দুটোই তার থেকে দূরে৷ মুসলমান সমাজ কিছুটা দূরে, আর পাকিস্তানি হলে তো কথাই নেই৷ ব্যক্তিগতভাবে উদ্যোগ না নিলে, স্বাভাবিকভাবে এ দূরত্ব ঘোচার নয়৷ আজ অবধি পরিস্থিতিটা এমনই৷ বরং হিন্দুত্ববাদীদের ভয়ঙ্কর প্রচারঝড়ে সেই দূরত্ব শত্রুতায় পরিণত হয়েছে এবং আরও হচ্ছে৷

অথচ এই ছবিটার মধ্যে একটা আশ্চর্য আটপৌরে স্বাভাবিকতা আছে যা ভাষায় বর্ণনা করা আমার পক্ষে কঠিন, কিন্তু যে গল্প এ ছবি শোনায় তা ওই দূরত্ব বা শত্রুতার নির্মাণটাকেই, ‘কনস্ট্রাক্ট’-টাকেই পরাস্ত করে৷ দামন-ই-কোহ্ তে পেয়ে গিয়েছিলাম এমনি আরও অনেক মুহূর্ত, যার ফলে ইসলামাবাদ সফরটা একেবারে মাঠে মারা যায়নি৷ ইসলামাদ থেকে দামন-ই-কোহ্ যদ্দূর মনে পড়ছে ৪৫ মিনিটের পথ৷ সুন্দর হাইওয়ে দিয়ে এঁকে বেঁকে মারগাল্লা পাহাড়ের পেটের কাছে বিশাল পার্ক৷ ২৪০০ ফুট উঁচুতে৷ এখান থেকে ইসলামাবাদ দেখা যায় কুয়াশার মধ্যে দিয়ে, বিশেষ করে পাকিস্তানের রাজধানীর গর্বের সেভেন্থ অ্যাভিনিউ৷ ওপর থেকে দেখলে বোঝা যায় ইসলামাবাদ শহরটা গাছে ঢাকা৷ অনেকটা ওয়াশিংটন ডিসি-র কথা মনে পড়ে৷ হাসি মশকরা করতে করতে আমরা দামন-ই-কোহ-তে গিয়ে পৌঁছই৷ আতিথেয়তার নাগপাশ থেকে একটু মুক্তি মেলে৷ এখানে স্থানীয় মানুষদেরই ভিড় বেশি৷ যে কোনও পিকনিক স্পটে যেমনটা হয়৷ অনেকেই কৌতূহলী হয়ে পড়েন আমাদের দলটা দেখে৷ ফিসফিস ফিসফিস চলতে থাকে— ভারতীয়, ভারতীয়, ভারতীয়৷ ভারতীয় সাংবাদিকদের দল৷ আড়চোখে দেখেন কেউ কেউ৷ সকলের মুখে স্বাগত জানানোর হাসি৷ একটিবারের জন্যও মনে হয় না, ভয়ঙ্কর কোনও শত্রুর দেশে এসে পড়েছি, যে দেশের মানুষের একমাত্র লক্ষ্য কিনা ভারতীয়দের ক্ষতি করা৷ এই বকোয়াস যে কত বড় বকোয়াস, তা পাকিস্তান না-গেলে বোঝা কঠিন৷ অথচ জন্মানো ইস্তক প্রত্যেক ভারতীয়র মাথায় হাজারভাবে এটা ঢুকিয়ে দেওয়া হয়৷ এমনই ঢুকিয়ে দেওয়া হয় যে, আমার মেয়েদের প্রাইভেট টিউশনের ম্যাডাম পর্যন্ত আমি পাকিস্তান যাচ্ছি শুনে আঁতকে ওঠেন৷

দামন-ই-কোহ্-এর শীতল বাতাসে ঘুরে বেড়াতে বেড়াতে বুঝি, ইসলামাবাদের ওই ঝলমলে অতি উচ্চশিক্ষিত বিদেশ দফতরের মুখপাত্রর অফিস থেকে এখানে আসতে মাত্র ৪৫ মিনিট লাগলেও দুটো জায়গার মধ্যে দূরত্ব আসলে কয়েক আলোকবর্ষ৷ এখানে পাকিস্তানের সাধারণ মানুষের অবাধ আনাগোনা৷ এখানে ভারতীয়দের প্রতি কৌতূহল আছে, দোষারপের আঙুল তোলা নেই৷ আমার যা কাজ, গাড়ি থেকে নেমেই ছবি তুলতে থাকি৷

এই তিনটি ছবি পরপর দেখুন৷ একদল ছেলে দামন-ই-কোহ্-তে বেড়াতে এসেছে৷ কলেজের ছাত্র হবে নিশ্চয়ই৷ চার বন্ধু৷ ক্যামেরায় সেল্ফ-টাইমার দিয়ে নিজেদের গ্রুপ ছবি তুলছে৷ আমি তিনটি শটে পুরোটাকে ক্যামেরাবন্দি করি৷ দেখুন প্রথম ছবিটায়, দুজন দেখছে যে, আমি ওদের ছবি তোলার ছবি তুলছি৷ শেষ ছবিটায় দেখুন একদম ডাইনের জন আমার দিকে তাকিয়েই কী হাসিটা দিচ্ছে৷ মনে হচ্ছে কি যে এরা আমাদের, ভারতীয়দের, ভয়ঙ্কর শত্রু, দেখলেই গলা টিপে মেরে ফেলবে? তবে ইসলামাবাদে এমন ছিটকে আসা মানবিক মুহূর্ত ছাড়াও পেয়েছিলাম আর একটি জিনিস— সেটা ইট-কাঠ-পাথরের৷

সে গপ্পো তোলা থাক পরের মাসের জন্য…

(ক্রমশ)