স্টেশন মাস্টার
মেদিনীপুর সদর ছেড়ে একটু এগিয়ে ভাদুতলা মোড় থেকে যে রাস্তাটা বাঁ দিকে নেমে গেল, সেটাই লালগড় যাওয়ার পথ। সেই বাঁ দিকের পথ ধরে আরও খানিক এগোলে ছোট্ট একটা গ্রাম পড়ে, পাথরকুঙ্কুমি। অনেক গ্রামেই যেমন, ফি-শনিবার পাথরকুঙ্কুমিতেও তেমনি ছোট্ট একটা হাট বসে। সেই হাটে গিয়ে গ্রামের মানুষের মুখে একবার একটা গল্প শুনেছিলাম। শহর থেকে দুই টুরিস্ট ছোকরা এসেছিল। টুরিস্ট যেমন হয়-– গলায় ক্যামেরা, চোখে কালো রোদচশমা, মাথায় টুপি। বাইকে চেপে খুব জোর আওয়াজ তুলে এসে থামল। নেমে ফস করে সিগ্রেট ধরাল। টুপি খুলে চুল ঠিক করল। তারপর ক্যামেরা বাগিয়ে এদিক-ওদিক তাক করে খচখচ ফটো তুলতে লাগল। হাটুরেদের মুখে শোনা… ইয়া লম্বা চোঙা-লেন্স, সাপের ফণার মতো সরসর বেরিয়ে আসে, সরসর ঢুকে যায়। এমন সময় একটা কাণ্ড হল। উলটোদিকের পায়ে-চলা পথ ধরে গোদাপিয়াশাল থেকে মাথায় কুঁদরির ঝাঁকা নিয়ে হেঁটে আসছিল বলরাম মুর্মুর বউ। কমবয়েসি সাঁওতাল মেয়ে, হাঁটু-অব্দি ধুলো, খালি গা, শাড়িটা বুকে শক্ত করে প্যাঁচানো। গোদাপিয়াশাল অনেকটা পথ, হেঁটে আসার পরিশ্রমে তার সারা গা ভিজে গেছে, কপাল বেয়ে টপটপ করে ঘাম, মুখের চারপাশে ভিজে লেপটে থাকা চুলের ডগায় মুক্তোর দানার মতো লেগে আছে। চোখের সামনে এমন চমৎকার সাবজেক্ট দেখে টুরিস্টদুটো নাকি ছবি তুলতে গিয়েছিল। দু’বার-তিনবার ক্যামেরায় চোখ লাগিয়ে চেষ্টাও করে। কিন্তু তারপর ভূত দেখার মতো চমকে উঠে তারস্বরে চেঁচাতে-চেঁচাতে উলটোদিকে দৌড় দিয়ে কয়েক পা গিয়ে অজ্ঞান হয়ে পড়ে যায়। কী ব্যাপার! হাটুরেদের ব্যাখ্যা, লোকদুটো যতবারই লেন্সে মেয়েটার মুখটা ফোকাস করছিল, দেখছিল দুই ভুরুর মধ্যিখানে আরও একটা চোখ ঝাপসা থেকে ধীরে ধীরে স্পষ্ট হয়ে ফুটে উঠছে। আর সেটা দিয়ে নাকি আগুনের হলকা ঠিকরে বেরোচ্ছে…
তারপর বহিরাগত ওই দু’জনের কী হয়েছিল, তাকে কেন্দ্র করে এই নাটকীয় ঘটনাপ্রপাতে মেয়েটি খুব বিব্রত হয়ে পড়েছিল কিনা, সেসব আর জানা যায় না। গল্পটা ওখানেই শেষ। শহর থেকে আসা আমাদের দেখে কি হাটুরেদের ওই গল্পটা আচমকাই মনে পড়ে গিয়েছিল? তাই শোনাল? নাকি শহরের লোকেদের চোখ থেকে নিজেদের মেয়েদের আড়াল করে রাখতে এই গল্পটাকে ওরা জেনেশুনেই অস্ত্রের মতো কাজে লাগায়? যেন জানিয়ে রাখে, সাবধান, সাহস কোরো না…
বোঝাই যায়, গল্পটার মধ্যে দিয়ে আমরা সেদিন একটা অতিকথা বা মিথকে গড়ে উঠতে দেখছিলাম। সাংস্কৃতিক দখলদারি প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠরাই যে কেবল সবসময় সংখ্যালঘুর সাংস্কৃতিক উপাদানকে আত্মসাৎ করে তা নয়, মাঝে মাঝে তার উলটোটাও যে ঘটে – আত্মরক্ষার তাগিদে সংখ্যাগরিষ্ঠের সাংস্কৃতিক উপাদানকে ব্যবহার করেও যে তাকে পালটা আক্রমণ করা যায়, তার একটা চমৎকার ব্যবহারিক উদাহরণ হতে পারে পাথরকুঙ্কুমির হাটে শোনা সেই গল্প। কে বলতে পারে, হয়তো অনেক বছর পর এটা তাদের লোককথার সঙ্গে মিশে আরও অতিপ্রাকৃত চেহারা নেবে…
অনেকদিন আগে শোনা গল্পটা মনে পড়ল চার নম্বর প্লাটফর্ম-এর সেপ্টেম্বর সংখ্যার বিষয় ভাবতে বসে। কয়েকবছর আগে লাইফ পত্রিকার একটি সংখ্যা হাতে এসেছিল, যার বিষয় ‘ব্ল্যাক’। সেখানে প্রতিটি লেখার মধ্যে মিশে ছিল কালোর নানা প্রত্যক্ষ-অপ্রত্যক্ষ স্তর… লেখার বিষয় থেকে শুরু করে ছবি, লে-আউট, এমনকী প্রতিটি বিজ্ঞাপনেও দৃশ্যমান ও অদৃশ্যের মাঝখানের নো ম্যান্স ল্যান্ড জুড়ে কালোর এক বহুমাত্রিক উদ্যাপন। মাথার মধ্যে ঘুরপাক খেতে থাকা সেই স্মৃতিটার হাত ধরেই, ভাবা হচ্ছিল, কীভাবে একটি বিশেষ থিমকে নানা ধরনের লেখার মধ্যে বুনে দেওয়া যায়।
একই সঙ্গে মাথায় রাখতে হচ্ছিল, এটা পুজোর মাস। মাতৃকাশক্তির বোধন ও বিজয় উদ্যাপনের ঋতু। সারাবছর ধরে জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে মেয়েদের পিছমোড়া করে বেঁধে রাখতে-রাখতে, যাপনের প্রতিটি আয়োজনে তাদের পেটে পাথর চাপা দিয়ে মুখে নুন দিয়ে সারা শরীরে সুচ ফুটিয়ে মেরে ফেলতে-ফেলতে, ঘোমটায়-ওড়নায়-বোরখায়-হিজাবে মুড়ে ব্যক্তিগত সম্পত্তি করে অন্তঃপুরে তালা-চাবি দিয়ে আটকে রাখতে-রাখতে, হঠাৎ একদিন মাঠজোড়া কাশফুল আর নীল আকাশে সাদা মেঘের ভেলার ভোরে জেগে উঠে তাদের ঘিরে জয়ধ্বনি দেওয়ার মাস। এমন মায়াময় সে জয়ধ্বনির সম্মোহ, যাতে আমানি খাওয়ার গর্তে জমা চোখের জল দেখে মনে হয় সাক্ষাৎ পুণ্যিপুকুর…
এইসব ভাবতে-ভাবতে বলরাম মুর্মুর বউয়ের গল্পটা মনে পড়ে গেল। আর তারপর ধীরে-ধীরে ফুটে ওঠা তৃতীয় নয়নের মতোই তার মুখের চারপাশে আস্তে-আস্তে স্পষ্ট হতে থাকল আরও অনেক মুখ। সারা গায়ে সুচ ফুটে থাকা পুরুলিয়ার তিন বছরের বাচ্চা মেয়েটি, পাথরপ্রতিমা থেকে পাচার হয়ে গুরগাঁওয়ের পতিতাপল্লি থেকে উদ্ধার হওয়া কুলসুম খাতুন, নাপামে পোড়া খোলা শরীর নিয়ে গোটা পৃথিবী পেরিয়ে ছুটে আসতে থাকা ভিয়েতনামের কিম ফুক, সৌভেন্দ্রশেখরের গল্পের রুপি বাস্কে, ওডিশার দানা মাঝির চাদরে-মোড়া মরা বউয়ের রাইগর হয়ে যাওয়া শক্ত শরীর, হাওড়া পিলখানার ইশরাত জাহান, আট বছরে স্কুলছুট হয়ে জরির কাজ করতে চলে যাওয়া মেটিয়াবুরুজের জবা হালদার, বারো বছর না-পুরোতে বিয়ে হয়ে যাওয়া মেটেলি চা বাগানের মাসুম ছেত্রী, আর তাদের ঠিক পাশেই বিয়ের পিঁড়ি থেকে উঠে পরীক্ষায় বসতে যাওয়া রেখা-অনন্যা-অন্তরাদের অন্তহীন রূপকথা-– ঠিক যেমন বলরামের বউয়ের পায়ের গোছে রুপোর মল, হাতে পেতলের গোট-অনন্তর গা ঘেঁষেই থাকে কপাল-পোড়ানো সিঁদুর আর কোমরে গোঁজা হাঁসুয়ার ঝিলিক। আর এভাবেই, ধীরে-ধীরে স্পষ্ট হয়ে উঠতে থাকে আমাদের এবারের বিষয়, ‘বিজয়া ও বিবর্জিতা’… যেখানে একেবারে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত কেবল মেয়েরাই লিখবেন তাঁদের নিজেদের কথা…
মেল ট্রেনের এ-সংখ্যার রিজার্ভড বগি-তে থাকল একইসঙ্গে বিতর্কিত ও শক্তিশালী, উপমহাদেশের চার লেখকের ক্ষুরধার কলম। স্বাতী ভট্টাচার্য ও তসলিমা নাসরিনের দুটি লেখার সঙ্গে রইল পাকিস্তানের ফতিমা ভুট্টো ও আমাদের গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাকের দুটি পুর্বপ্রকাশিত লেখার অনুবাদ। আমাদের বিভিন্ন প্রদেশের মেয়েদের মুখে সাবেক রামায়ণী কথা কীভাবে হয়ে উঠেছে জনমদুখিনী সীতার জীবন নিয়ে গড়ে ওঠা এক সমান্তরাল ভাষ্য, তা নিয়ে নবনীতা দেবসেনের পুর্বপ্রকাশিত একটি গবেষণাপত্রের প্রথম অংশও পুনঃপ্রকাশিত হল এ-সংখ্যায়। দ্বিতীয় অংশটি পরবর্তী সংখ্যায় প্রকাশিত হবে।
পদ্মভূষণ, ভাটনগর পুরস্কার প্রাপ্ত প্রথম মহিলা বিজ্ঞানী, বিশিষ্ট রসায়নবিদ ডঃ অসীমা চ্যাটার্জীর জন্মশতবর্ষ এ বছর। এ সংখ্যায় আমরা স্মরণ করলাম তাঁকে।
আর রইল একেবারে এই সময়ের একগুচ্ছ কবিতা, গল্প ও প্রবন্ধ। যার প্রতিটি ও সবকটির লেখক, প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত, মহিলারাই।
এই বিশেষ সংখ্যায় ধারাবাহিকের বহতী ধারাকে একটু আটকানো হল। সঙ্গত এবং সহজবোধ্য কারণেই। সামনের মাস থেকে যথারীতি চালু হবে আমাদের সমস্ত ধারাবাহিক।
প্রসঙ্গত, আরও একটি কথা। হয়তো লক্ষ করেছেন, আমরা অত্যন্ত সচেতন ভাবে লেখিকা বা রচয়িতা জাতীয় লিঙ্গনির্দেশক শব্দগুলি এড়িয়ে গিয়েছি। তার কারণ, আমরা বিশ্বাস করি, সাহিত্য অন্তিমত কেবল সাহিত্যই, কোনও লিঙ্গ-পরিচয় দিয়ে তার বিচার চলে না। কিন্তু তা হলে কেন এমন এক মহিলাসর্বস্ব সংখ্যা, কেন চোখে আঙুল দিয়ে লিঙ্গনির্দেশ?
লেখাগুলি মন দিয়ে পড়তে-পড়তে তার উত্তর হয়তো খুঁজে পাওয়া যাবে।
ভালো থাকবেন…