Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

প্রবাদপ্রতিম পুরুষতন্ত্র

প্রবাদপ্রতিম পুরুষতন্ত্র -- শ্রীজাতা গুপ্ত

শ্রীজাতা গুপ্ত

 


গবেষক, লেখক

 

 

 

অসীম ক্ষমতাশালী এক অস্ত্র মনুষ্যভাষা।

আমাদের চিন্তাভাবনা ভাষা সৃজন করে। মানুষের অনন্যসাধারণ ভাষা-উৎপত্তির মূল ব্যাখ্যা এখান থেকেই শুরু। আমাদের ভাবনার অভ্যন্তরে থাকে কিছু অস্পষ্ট চিত্রাবলি। এই অ্যাবস্ট্রাক্ট ধোঁয়াশাকে গুছিয়ে বুঝতে এবং অপরকে বোঝানোর উপক্রমে নানা সঙ্কেতের উদ্ভাবনা। নিরাকার ধারণাদের অর্থপূর্ণ করে তোলার তাগিদে ভাষার দ্বারস্থ হওয়া। ভাষা-বিবর্তন তত্ত্বের গোড়ার কথা এই।

অপরদিকে, ভাষার নির্দিষ্ট ব্যবহার চিন্তাক্ষমতা গড়ে তোলার অন্যতম কারিগর। পরিবেশ, সমাজ, অবস্থান সম্পর্কে ধারণা তৈরি হয় ভাষা ব্যবহারের মাধ্যমে।  কথ্যভাষা, লিখিত ভাষা, শারীরিক ভাষা শোনা পড়া দেখা মাত্র চেতনায় ছবি ফুটে ওঠে।

যেমন ধরুন, ‘কুকুর’ শব্দটি শুনলে তৎক্ষণাৎ একটি চারপেয়ে প্রাণীর ছবি দেখতে পাই। পৃথিবীর ঊনকোটি কুকুরের বিবরণ ছাপিয়ে একটি প্রোটোটাইপ কুকুর আমরা মানসচক্ষে পাই।

যেমন ধরুন, বাংলা ভাষায় শব্দের শেষে আকার-যুক্ত অক্ষর থাকা মানেই স্ত্রীলিঙ্গ-শব্দ, এমন ধারণা ধরে রেখে ‘সবিতা’ শব্দটি শুনে বা পড়ে আমাদের চিন্তায় স্ত্রীমুখ ভেসে ওঠে।

আবার, ফরাসি ভাষায় ils সর্বনাম দিয়ে বোঝানো হয় থার্ড পার্সন প্ল্যুরাল ম্যাসকুলিন, elles সর্বনাম থার্ড পার্সন প্ল্যুরাল ফেমিনিন। কিন্তু মানুষের একটি বড় দলে যদি একশোজন নারী এবং একজন মাত্র পুরুষ থাকে, ফরাসি ব্যকরণ বলছে, মিশ্র গ্রুপের সর্বনাম হবে থার্ড পার্সন প্ল্যুরাল ম্যাসকুলিন ফর্ম ils।

অর্থাৎ, ভাষায় প্রতিষ্ঠিত কার্যকরী নিয়মমাফিক আমরা বাস্তবের সরলীকরণ করে প্রোটোটাইপ ধারণা নিয়ে বাঁচি। কগনিটিভ লিঙ্গুইস্টিকস-এর গোড়ার কথা। অতঃপর, ধারণাগুলি বিশ্বাসে পরিণত হয়। বিশ্বাসের প্রভাবে ভবিষ্যত কর্মাবলি নির্ধারণ। পৃথিবীতে তিন-পেয়ে, দু-পেয়ে কুকুর আছে জেনেও সরলীকরণ প্রক্রিয়ায় ‘কুকুর’ শব্দে আমরা চারপেয়ে সারমেয়ে ভাবতে বাধ্য হই। ‘সবিতা’ শব্দের আসল অর্থ জেনেও মেয়েদের নামকরণ ছাড়া এই শব্দের ব্যবহার সচরাচর করতে অক্ষম। এক দঙ্গল লোকের মধ্যে সমসংখ্যায় লিঙ্গ নির্বিশেষে মানুষ উপস্থিত থাকতে পারে জেনেও ভিড়ের কথা শুনলেই এক দল ফরাসি পুরুষ ভাবতে শেখাচ্ছে এই ভাষা।

ভাষা-মন-চিন্তা-চেতনা-ধারণা-ব্যবহার-বিশ্বাস— এসবের মধ্যে এমন পরস্পর প্রভাববিস্তারী অন্তর্জালগুলি জৈবিক এবং মনস্তাত্ত্বিক। সামাজিক-রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান তাদের কার্যসিদ্ধির জন্য নির্দিষ্টরূপে ভাষা ব্যবহার করে মানুষের অবচেতন নিয়ন্ত্রণ করে থাকবে, তা সহজে অনুমেয়। এতে কোনও আবিষ্কারের রোমাঞ্চ নেই। কোন পরিস্থিতিতে এমন ভাষা-রাজনীতি চলে? ভাষার কেমন বিশেষ ব্যবহারগুলির অস্ত্ররূপ প্রয়োগ সম্ভব? বরং, সেই কথা ভাবতে হবে। ভাষাকে বোঝার জন্য। রাজনীতি বোঝার জন্য। ভাষার আজনীতি সনাক্ত করার জন্য।

রাজনীতির বহু ক্ষেত্রে ভাষার মাধ্যমে মানুষের ভবিষ্যৎ আচরণ প্রভাবিত করা হয়। কোন শব্দে বিশ্বাস দৃঢ় হয়, কোন ইঙ্গিতপূর্ণ বাক্য ডিপ্লোম্যাসি বজায় রেখে দাঙ্গা পর্যন্ত বাঁধিয়ে দিতে পারে, স্বরের ওঠাপড়া কীভাবে নিয়ন্ত্রণ করবে দলের প্রতি আস্থা, এইসব নিয়ে স্পিচ-অ্যানালিস্ট, সাইকোলজিস্ট, বিহেভিয়র ইকোনোমিস্টরা বিশ্বের তাবড় তাবড় নেতৃবৃন্দের ভাষণ কাটাছেঁড়া করে এসেছেন। সেসব বড় মানুষদের কারবার।

অন্যদিকে, চলতি জীবনে লোককথা, পুরাণ, রূপকথা, প্রবাদ, প্রবচন ব্যবহারে রোজের ভাবনাচিন্তায় কারসাজি করা অন্যতম খতরনাক অস্ত্র। পুরুষতান্ত্রিক অ্যাজেন্ডাসমূহ মুখফিরতি প্রবচনের মাধ্যমে আবহমানকালব্যাপী গেঁথে দেওয়া হয়েছে, হচ্ছে সামাজিক-মনস্তত্ত্বে। ইন্টারকালচারাল লিটারারি স্টাডিজ-এর প্রোফেসর, মাইনেকে শিপ্পার, তাঁর গবেষণায় তুলে এনেছেন ২৪৫টি ভাষা-সংস্কৃতিতে বহুলব্যবহৃত মেয়েদের নিয়ে প্রচলিত প্রবচন। মাইনেকে বলছেন,

Proverbs about women tend to reflect the old habit of setting ‘us’ against ‘them’, not in terms of culture but in terms of sexual embodiment. [….] Proverbs about women substantially help to explain how and why, worldwide, sexual differences have resulted in a growing gap, a gap that has estranged men and women from sharing both public roles in life and responsibilities at home. [….] The preponderance of proverbs [all the 15,735 examples that I found] representing male perspectives, promoting male superiority and defending male interests and privileges, is indeed striking. [….] ‘Truths’ as seen from women’s perspectives are hard to come by, and not only in proverbs.

(Women in Proverbs from Around the World: Never Marry a Woman with Big Feet, Speaking Tiger Publishing Pvt. Ltd., 2017)

পুরুষতন্ত্রের মূল অ্যাজেন্ডাগুলি পরিষ্কার হল? ১। নারী এবং পুরুষ সমান নয়। ২। নারী পুরুষের থেকে দুর্বল। নিজের বোঝাপড়া এবং মাইনেকের কাজ থেকে কিছু উদাহরণ দিয়ে স্পষ্ট ধারণা দেওয়ার চেষ্টা করব পরের অংশে।

(ক) সিংহভাগ প্রাণীদের মত, মানুষের মধ্যেও নারীশরীর নতুন জীবনের জন্ম দিতে সক্ষম। অসাধরণ শক্তিশালী এই ক্ষমতা, বিশ্বাসীকুলের কাছে ঈশ্বর সমতুল্য। জীবনের ধারা বহন করে নিয়ে যাওয়ার প্রক্রিয়াটির মধ্যে নারীর ভূমিকা এবং ক্ষমতা যতখানি প্রকট, পুরুষের ভূমিকাটি ততখানি ক্ষণস্থায়ী। এর ফলে কি গুরুত্বহীনতায় ভুগেছিলেন আদি-পুরুষ? দেশে-দেশে পুরাণে বলা/লেখা হল, আদমের পিঞ্জর থেকে জন্ম নিয়েছে ইভ, কোথাও শয়তানের ল্যাজের টুকরো থেকে; ব্রহ্মার হাই থেকে সরস্বতীর উৎপত্তি, ইত্যাদি প্রভৃতি। অতএব, একজন ক্ষমতাশালী পুরুষের দেহের তুচ্ছতম প্রত্যঙ্গ থেকে তোমার জন্ম যদি না হত, হে নারী, নতুন জীবন লালন করার ক্ষমতা তুমি পাচ্ছিলে কই? যে জৈবিক ক্ষমতাকে মেয়েশরীরের সর্বশক্তিমান ক্ষমতা রূপে প্রতিষ্ঠা করা যেত, সেই একই গল্পে সামান্য কল্পনা বুলিয়ে সমগ্র ন্যারেটিভটি উলটোমুখে ঘুরিয়ে দেওয়া হল। একটি মিথ সমাজ মনস্তত্ত্বে আজন্মকালের জন্য প্রতিস্থাপিত হল অন্ধবিশ্বাস রূপে।

(খ) রাজস্থানি প্রচলিত একটি প্রবাদের তর্জমা করলে দাঁড়ায়,

When a girl is born, don’t take care of her, she will grow like a cactus; when a boy is born, take good care of him, as you would with a rose tree.

বাংলায় এর অনুরণন পাওয়া যায়,

মেয়েমানুষের জান, কইমাছের প্রাণ

অতএব, কন্যাসন্তানের যত্ন অপ্রয়োজনীয়,  যে কোনও পরিস্থিতিতেই বেড়ে ওঠার ক্ষমতা সে রাখে। সুখে রাখো ছেলেদের। এই ন্যারেটিভটিকে মেয়েদের অসীম সহনশীলতার আত্মপক্ষ সমর্থনে বসানো হল। বলা হল,

A girl is an olive tree, a boy a tadpole. — (নামিবিয়ার প্রবাদ)

অর্থাৎ মেয়েরা ঠিক তরতরিয়ে বেড়ে উঠবে। ছেলেরা ধীরে সুস্থে সযতন বেড়ে উঠুক।

অনেকগুলি ভাইয়ের মধ্যে একটি বোনের পর্যাপ্ত খাবার না জোটাই স্বাভাবিক, সেটিকেও ধরে রাখা হল ভাষার দৈনন্দিনতায়,

Brought up among boys, a girl weakens. — (কেনিয়ার প্রবাদ)

মেয়েদের শক্তপোক্ত শরীর যে কোনও অভাব অনটনেও সুখে বেড়ে ওঠে, এই ‘সত্য’ প্রমাণ করে মেয়েদের ন্যায্য থেকে বঞ্চিত করার পথটি সুগম করা হল। এর ফলে, আধপেটা খেয়ে মেয়ে ভাবে, এই তো প্রাপ্য। সকলের জন্য হাসিমুখে জোগাড় করে নিজের শূন্য পাত্রে তাকিয়ে ভাবে, এই তো পুণ্য।

কল্যাণী দত্তের লেখায় একটি ছড়া পাই:

এক পো দুধে কী হবে তা বল না
ক্ষীর হবে, সর হবে, ছানা হবে, মাখম হবে।
হারু খাবে, গুপি খাবে,
বংশীধারী কেশো রুগি
তারে একটু দিতে হবে

সোহাগের টিয়াপাখি
সর না পেলে বকাবকি

….

ও বড় বউ আর কী হবে বল না।

ঘরের ছেলে, বাইরের লোক, নিদেনপক্ষে টিয়ার জুটবে এক পো দুধের ভাগ। যে বড় বউকে শুধানো হয়, ‘আর কী হবে বল না’, তার ভাগের কোথাও কোনও উল্লেখ থাকে না। বড় বউ এখনও এক পো দুধের ভাগ করে চলেছে সকলের পছন্দমত। লিস্টে ওর নাম ওঠেনি। আর কী হবে, বল না!

(ক) এবং (খ) এর মধ্যে যৌক্তিক গোলযোগ পাচ্ছেন? সময়মত মেয়েদের শারীরিক ক্ষমতা খর্ব করা হল; প্রতিপাদ্য: তারা অপূর্ণ, দুর্বল। পুরুষের অধীন। অপরদিকে বলা হল, তাদের সহনশীলতা গগনচুম্বী; প্রতিপাদ্য: যা পাচ্ছ তাতেই তোমার চলবে। চাহিদা অপ্রয়োজনীয়।

(গ) লক্ষ-লক্ষ বছরের সেক্সুয়াল সিলেকশানের ফলস্বরূপ গড় পুরুষ-মানুষের দেহের গঠন মেয়ে-মানুষের দেহের চেয়ে দীর্ঘকায়, বলশালী। প্রকৃতিতে এই নির্বাচনের নেপথ্যে কাজ করছে স্ত্রী-জাতির পছন্দমত বাছাবাছি। বৈজ্ঞানিক হাইপোথিসিস অনুযায়ী পুরুষ-জাতির সুঠাম স্বাস্থ্য নির্বাচনের এজেন্ট তাহলে স্ত্রী-জাতি। আরও একবার, স্ত্রী-জাতিকে ক্ষমতাশালী প্রতিভাত করার সুযোগ ছিল। কিন্তু, কীভাবে ন্যারেটিভ ঘুরে গেল? নারীর ছোটখাটো দেহরূপ নাকি দুর্বলতার সাক্ষ্যপ্রমাণ। দৈহিক গঠন শক্তিপ্রদর্শনের পরিকাঠামো হল, পাওয়ার-রিলেশন নারী-পুরুষের সম্পর্কে অন্তরায় হয়ে উঠল। ক্ষুদ্রাকৃতির দোহাই দিয়ে নারী এবং শিশু সমতুল্য হল, তাদের বোধশক্তিকেও সমতুল্য জ্ঞান করার স্বীকৃতি দেওয়া হল। মাইনেকে লিখছেন,

In many proverbs, women and children are equally considered to be ‘minors’.

পশ্চিম আফ্রিকায় বলা হয়,

Woman’s intelligence is a child’s intelligence.

কেবল তাই নয়, মেয়েদের ছোটখাটো দেহাকৃতিকে মোহিমান্বিত করে বুঝিয়ে দেওয়া হল, এইরকমটাই তার জীবনের লক্ষ্য। হাঙ্গারিয়ান প্রবাদ বলছে,

Of women, misfortunes and gherkins the smallest are always the best.

ইথিওপিয়ায় বলা হয়,

A wife and a plough handle are best when shorter than the man.

এবং আমাদের বঙ্গদেশে বলা হয়,

A housewife likes a small pot; a husband likes a small wife.

(বাংলায় এই প্রবাদটি আমার জানা নেই। মাইনেকে-র থেকে ইংরিজি তর্জমা চোখ বুজে ধার করলাম)।

(ঘ) প্রকৃতি বৃহদাকৃতির পুরুষদের নির্বাচিত করলেই তো আর আপামর পুরুষ রদাঁ-র মূর্তি হয়ে উঠবে না? ক্ষুদ্রাকৃতি পুরুষদের তবে কীভাবে সাহস জোগান দেবে পুরুষতন্ত্র? ঠিক (গ)-এর উলটো একটি ন্যারেটিভ পেশ করে।

আরব দেশে বলা হবে,

A man, even a man of small size, will be called great in comparison to women.

এর চেয়ে মরিয়া প্রচেষ্টা সম্ভব?

মধ্য আফ্রিকায় মুখে মুখে ঘুরবে,

A small string binds a big parcel.
A small squirrel can lift up a big nut.
The small hawk can carry off a big chick.

Big parcel, big nut, big chick— যথাক্রমে নারী, নারী এবং নারী।

(গ) (ঘ)-এর মধ্যে যুক্তির পারম্পর্য পেলেন? না। যে শীর্ণদেহের দোহাই দিয়ে বলা হচ্ছে, চুপচাপ মেনে নাও, তোমার চেয়ে আকারে বড় পুরুষটি সর্বশক্তিমান, সেই একই দেহসৌষ্ঠব পুরুষের ইগো স্ফীতিহেতু জ্বলজ্বল করছে প্রবাদে, প্রবচনে।

(ঙ) বলা হয়, শ্রেষ্ঠ পুরুষটিকে ছলে বলে কৌশলে ম্যানেজ করে সঙ্গী করার জন্য স্ত্রী-মানুষের আচরণ লাস্যময়ী হয়ে উঠেছে। সুন্দর হওয়া ছাড়া তার দ্বিতীয় উপায় নেই, কাজ-ও নেই। নির্বাক সৌন্দর্য ছাড়া পুরুষকে দেওয়ার মত তার কিছুই নেই। নারীচরিত্রের বাকি সবকিছুই অর্থহীন, অথবা ক্ষতিকর।

সেক্সুয়াল সিলেকশান অনুযায়ী, স্তন্যপায়ী প্রাণীদের মধ্যে যা হয়ে থাকে, মানুষের মধ্যেও এর উলটো ধারণা হওয়াই যুক্তিযুক্ত ছিল। পুরুষদের ছলাকলা করে নারীর মন পাওয়ার গল্প প্রচলিত হওয়ার কথা, যেমন সিংহ তার কেশর ফুলিয়ে সিংহীর মন চায়, হরিণ শিং বাগিয়ে লড়াই করে আকর্ষণ করতে চায় হরিণীকে। মানুষের ভাষা, আরও একবার, জৈবিক যুক্তিযুক্ত ন্যারেটিভ ঘুরিয়ে দিল।  জার্মান প্রবাদে আছে,

A woman has the shape of an angel, the heart of a snake, and the brains of an ass.

পোল্যান্ডের ভাষা বলছে,

A doll’s head and an empty brain.

এবং, আরব দেশে নারী পুরুষের উচিত সৌন্দর্য্য বেঁধে দেওয়া হয় এক প্রবাদে,

God protect us from hairy women and beardless men.

(চ) প্রকৃতিতত্ত্ব দিয়ে নারীকে একবার যখন মোহময়ী, প্রলোভনে ভরপুর একটি পদার্থ বানিয়ে ফেলা হল, সেইভাবে রেখে দিলেই হত। পোস্টারে টেলিভিশনে কাব্যে গীতে নারীদেহসৌন্দর্যের বর্ণনায় অনায়াস অব্জেক্টিফিকেশন-ও করা যেত, পুরুষদের সেই দিকে হাঁ-করে তাকিয়ে থেকে বলপূর্বক কেড়ে নেওয়ার প্রচেষ্টাও যুক্তিযুক্ত হত। সবটাই সেক্সুয়াল সিলেকশানের ঘাড়ে।

এর উলটো যুক্তি তবে কেন সাজানো হল? লাস্যময়ীদের এড়িয়ে চলাই ভালো, সুন্দরের আড়ালে বিপদ লুকিয়ে, সাবধান— এমন শেখাল কেন প্রবচন?

ইহুদি প্রবাদ বলছে,

Keep afar from the love of women, for their beauty is lewdness and their body a graveyard of lust.

জার্মানরা বলছেন,

A pretty woman has the devil in her body.

(ঙ) এবং (চ)-এর সংঘাত আলাদা করে বলে দেওয়ার দরকার নেই। কিন্তু, কেন এই পরস্পরবিরোধিতা?

কারণ, কেবল (ঙ) তত্ত্বটিকে যদি বাঁচিয়ে রাখা হয়, তাহলে নারী ইচ্ছেমত তার যৌনজীবন নির্বাচন করতে পারে। নারীশরীরের ক্ষমতা সম্পূর্ণ নারীর হাতে তুলে দেওয়ার ভুল পুরুষতন্ত্র কখনওই করতে পারে না। কে না জানে, যে নারী স্বেচ্ছায় শরীর দিতে পারে, উপহার বা টাকার বিনিময়ে শরীর দিতে প্রস্তুত, তার ছায়াও অস্পৃশ্য।

A woman who takes, sells her body. (স্প্যানিশ প্রবাদ)

এমন হাজার লক্ষ প্রবাদ প্রবচন মিথ মিথোলজির উদাহরণ সম্ভব। সমস্ত ভাষা, সময়, সংস্কৃতিতে। যার পনেরো হাজার সাতশো পঁয়ত্রিশটি তুলে ধরেছেন মাইনেকে। এর বাইরেও সম্ভব, আমার দৃঢ় বিশ্বাস। হঠাৎ ভাষার এই মাধ্যমগুলি কেন এত ধারালো সামাজিক অস্ত্র হয়ে উঠল?

(১) মৌখিক মাধ্যমে প্রবাদ প্রবচনের ব্যবহার লিখিত পুঁথিগত ভাষার চেয়ে বহু পুরনো। মুখে মুখে বংশানুক্রমে যা বলা হয়ে এসেছে তা কখনও মিথ্যে হতে পারে?

(২) প্রবাদের আকৃতি গঠন ছন্দে বাঁধা, সচরাচর। মানুষের স্মৃতিশক্তি ছন্দে বাঁধা, প্যাটার্নে গাঁথা জিনিস মনে রাখতে পারে অনয়াসে।

(৩) যাহাই পুরনো তাহাই ট্রাডিশান, তাহাই প্রশ্নাতীত। ট্রাডিশনে ভুল দেখে অন্যায় দেখেও চুপ করে থাকাই রেওয়াজ। নইলে পরম্পরা ক্ষুণ্ণ হয়।

(৪) ভাষার মাধ্যমে মানুষ দেখতে শেখে, ভাবতে শেখে, বিশ্বাস করতে শেখে। মানসিক নাশকতা ছড়ানোর এর চেয়ে সু-উপায় অভাবনীয়।

(৫) নেশাগ্রস্ত মন ঝিমিয়ে থাকে। সত্যাসত্য বিচারের ক্ষমতা রাখে না। যা শোনে তাই মানে।

তাহলে? মাইনেকে শিপ্পারের মত মানুষদের কাজ বিফলে যাবে? সেকথা গুরুত্ব দিয়ে বিচার করার সময় এসেছে। অন্যায়প্রতিষ্ঠার উৎস খুঁজে পেয়েও সেই ন্যারেটিভ উলটেপালটে ভেঙেচুরে না ফেলতে পারলে, তা প্রত্যাখ্যান না করলে দোষ হবে আমাদের।

বাংলাদেশে এক সেলুনের দেওয়ালে মাইনেকে দেখেছিলেন, লেখা আছে,

সংসার সুখের হয় রমণীর গুণে।

পরের পংক্তিতে যোগ হয়েছে,

কেবল, গুণবান পুরুষটি সঙ্গে পেলে।

প্রসঙ্গত, সেলুনের মালিক মহিলা। নতুন করে পঠনপাঠন, নতুনরকম চিন্তাধারা, ন্যারেটিভ প্রত্যাবর্তনের উৎস-রহস্য বোঝা গেল?