সুমন কল্যাণ মৌলিক
প্রাবন্ধিক, মানবাধিকার কর্মী
কোভিড অতিমারির কারণে ১ কোটির বেশি পজিটিভ রোগী, ১ লক্ষ ৫০ হাজারের বেশি মৃত মানুষ, ভেঙে পড়া চিকিৎসাব্যবস্থা আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে ভারতে জনস্বাস্থ্যব্যবস্থার হাল-হকিকত। এই জরুরি অবস্থায় বিগত এক বছরে নিয়মিত হাসপাতাল চিকিৎসা, প্রসূতি যত্ন, টিকাকরণ প্রায় বন্ধ হওয়ার জোগাড়। অবশ্য কোভিড পূর্ববর্তী অবস্থাও উল্লেখ করার মত কিছু ছিল না। চিকিৎসাব্যবস্থার মানের প্রশ্নে আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে ১৮০টা দেশের মধ্যে ভারতের স্থান ১৪৫। আর সরকারের কাছে জনগণের স্বাস্থ্য ও চিকিৎসার গুরুত্বের প্রশ্নে ভারতের স্থান ১৮৯টি দেশের মধ্যে ১৭৯। বাজেটপূর্ববর্তী আর্থিক সমীক্ষায় তাই প্রস্তাব করা হয়েছিল স্বাস্থ্যখাতে যেন জিডিপির ২.৫-৩ শতাংশ বরাদ্দ করা হয়। বাজেট ঘোষণার পর দেখা গেল মাননীয়া অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন সহ শাসকজোটের ছোট-বড় নেতা, কর্পোরেট কলমচি সবাই একযোগে দাবি করছেন এবারের স্বাস্থ্যবাজেট ঐতিহাসিক, কারণ স্বাস্থ্যখাতে বরাদ্দ ১৩৭ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। এখন ভারতের মতো চিকিৎসায় অনুন্নত দেশে যদি একধাক্কায় স্বাস্থ্যখাতে বাজেট ১৩৭ শতাংশ বৃদ্ধি পায় তবে অবশ্যই আমাদের হাততালি দিয়ে তাকে স্বাগত জানানো উচিত। কিন্তু সত্যিই কি সরকারের এই দাবি যথার্থ না কি সংখ্যা তত্ত্বের নির্ভেজাল কারচুপি— এই নিবন্ধের উপজীব্য এটাই।
সরকারের ‘ঐতিহাসিক বৃদ্ধি’র গল্পটা জেনে নেওয়া দরকার। হিসাবটা হল ২০২০-২১ আর্থিক বর্ষে স্বাস্থ্যবাজেট ছিল ৯৪,৪৫২ কোটি টাকা। এবছর করা হল ২,২৩,৮৪৬ কোটি টাকা অর্থাৎ ১৩৭ শতাংশ বৃদ্ধি। এবার একটু যুক্তি দিয়ে বিষয়টা বোঝার চেষ্টা করা যাক। ভারতবর্ষের ইতিহাসে এই প্রথম স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা সংক্রান্ত বাজেটের সংজ্ঞাটাই পাল্টে দেওয়া হল। সুসংহত কর্মসূচির নামে অন্য ক্ষেত্রের বাজেট স্বাস্থ্যের সঙ্গে জুড়ে দিয়ে নতুন নামকরণ হল ‘Health and Wellbeing’। এবার আমরা এই বাজেটটাকে বিষয়ভিত্তিকভাবে ভাগ করি:
- স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ— ৭১,২৬৯ কোটি
- স্বাস্থ্য গবেষণা— ২,৬৬৩ কোটি
- আয়ুশ প্রকল্প— ২,৯৭০ কোটি
- জল ও শৌচ সংস্কার— ৬০,৬৩০ কোটি
- পুষ্টি— ২৭,০০০ কোটি
- কোভিড ভ্যাকসিন— ৩৫,০০০ কোটি
- জল ও শৌচ ও স্বাস্থ্যে অর্থ কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী অনুদান— ৩৯,২২৪ কোটি।
বাজেটে আরও কিছু কথা রয়েছে যা লিপিবদ্ধ করা দরকার:
৪,৩৭৮টি পৌরসভার অন্তর্ভুক্ত ২.৮৬ কোটি বাড়িতে সরাসরি জলের সংযোগ দেওয়া হবে। এর জন্য আগামী ৫ বছর ধরে মোট ২.৮৭ লক্ষ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হবে। এটা কোনও নতুন প্রকল্প নয়, এর কোনও সময়সীমাও নির্দিষ্ট করা হয়নি।
আর্বান স্বচ্ছ ভারত মিশনের অন্তর্গত বায়ুদূষণ ও বর্জ্য পদার্থ নিয়ন্ত্রণ প্রকল্পের জন্য আগামী ৫ বছরে ১.৪১ লক্ষ কোটি টাকা ব্যায় করা হবে। এটিও একটি পুরনো প্রকল্প।
এবার আমরা দেখব কীভাবে সংখ্যার কারচুপি করে বৃদ্ধির মিথ্যা গল্পটা তৈরি করা হয়েছে:
- ২০২০-২১ আর্থিক বর্ষে স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ খাতে বরাদ্দ হয়েছিল ৬৫,০১১.৮ কোটি টাকা। কিন্তু অতিমারির কারণে সেই বরাদ্দ বেড়ে দাঁড়ায় ৭৮,৮৬৬ কোটি টাকা। আর এবার এই বরাদ্দ হল ৭১,২২৬৮.৭৭। এর অর্থ বৃদ্ধি তো দূরের কথা এবারের বাজেটে মূল স্বাস্থ্যখাতে বরাদ্দ ৯.৩ শতাংশ কমেছে।
- ২০২০-২১এ গবেষণা খাতে ব্যায় হয়েছে ৪০৬২.৩০ কোটি টাকা। এবার বরাদ্দ কমে হয়েছে ২৬৬৩ কোটি টাকা। আয়ুশ প্রকল্পে বরাদ্দ ২৩২২.০৮ কোটি টাকা থেকে সামান্য বেড়ে হয়েছে ২৯৭০ কোটি টাকা।
- স্বাস্থ্য বাজেটে যে সমস্ত নতুন বিষয় ঢোকানো হয়েছে তারমধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল পুষ্টি প্রকল্প। এক্ষেত্রে ২৭০০ কোটি টাকা বরাদ্দ হয়েছে যা গতবছরের বাজেটের চেয়ে ২৭ শতাংশ কম।
- করোনা ভ্যাকসিনের খাতে যে ৩৫০০০ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে তা এককালীন এবং এটা সেই অর্থে বাজেটের বিষয় নয়। এই বরাদ্দের অধিকাংশই ভ্যাকসিন প্রস্তুতকারক সংস্থাগুলির জন্যই বরাদ্দ হতে চলেছে। এটা প্রতিবছর থাকবে না।
এইবার আরেকটি বহু বিজ্ঞাপিত প্রকল্প নিয়ে আলোচনা করতে চাই যার নাম এবছর করা হল ‘প্রধানমন্ত্রী আত্মনির্ভর স্বাস্থ্য ভারত যোজনা’। সরকার যতই নতুন বলে চালাবার চেষ্টা করুক না কেন এটা আসলে ন্যাশানাল হেলথ মিশনের নতুন নাম। এখন এই প্রকল্পে ৬৪,১৮০ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে যা খরচ হবে ৬ বছর ধরে। এই বরাদ্দ নিয়ে বিশ্লেষণ করলে দেখা যাচ্ছে গড়ে প্রতিবছর ১০,৬৯৬ কোটি টাকা ধার্য হয়েছে। সরকার বলছে গ্রামে ১৭ হাজার ও শহরে ১১ হাজার ‘হেলথ অ্যান্ড ওয়েলনেস সেন্টার’কে এই প্রকল্পের আওতায় সাহায্য করা হবে। সেই সঙ্গে ১১টি রাজ্যের সমস্ত জেলা এবং তিন হাজারের বেশি ব্লকে জনস্বাস্থ্য ল্যাব, ক্রিটিকাল কেয়ার সেন্টারও তৈরি করা হবে। এই সামান্য টাকা দিয়ে ২৮ হাজার স্বাস্থ্যকেন্দ্রের পরিকাঠামোর খোলনলচে পাল্টে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি নেহাতই গিমিক ছাড়া কিছু নয়।
এই সংখ্যার কারসাজির ফলে স্বাস্থ্য বাজেট এবারও জিডিপির ১ শতাংশ হতে পারল না। কোভিড অতিমারি দেখিয়ে দিয়েছিল চিকিৎসার ভঙ্গুর অবস্থা। হাসপাতালে শয্যা, ওষুধ, ডাক্তার, স্বাস্থ্যকর্মী, যন্ত্রপাতি— সব কিছুই চাহিদার তুলনায় সামান্য। কিন্ত সরকারের কাছে আমজনতার জীবনের মূল্য কানাকড়িও নয়, তাই বাজেটে মিথ্যার খতিয়ান ছাড়া তাদের ভাগ্যে আর কিছুই জুটল না।