Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

একমাত্র বিকল্প বাম-গণতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষ জোট

তনয় রায়

 

প্রাক্তন প্রশাসক, রাজনৈতিক প্রবন্ধকার

আজকের ভারতবর্ষে বিজেপি অবশ্যই প্রধান শত্রু— গোটা দেশ এবং এ রাজ্যেও। এ নিয়ে তাবৎ বামপন্থীরাই একমত হবেন। সংসদ, আদালত এবং নির্বাচন কমিশনসহ সমস্ত সাংবিধানিক এবং গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানকে খতম করে দেশে সাম্প্রদায়িক ফ্যাসিবাদ কায়েম করার কাজটা সম্পূর্ণ করতে চাইছে বিজেপি। কোনও আলোচনা ছাড়াই তিন কৃষি বিল পাশ করিয়ে নেওয়া হয়েছে মহামারির নিষেধাজ্ঞার সুযোগে। দেশে বিধানসভা, রাজ্যসভার নির্বাচন কোভিড পরিস্থিতিতে হতে পারে, কিন্তু পাছে কৃষক আন্দোলন নিয়ে বিরোধীরা প্রশ্নবাণে সরকারকে জর্জরিত করেন, তিন কৃষি আইনের কৃষকবিরোধী চরিত্র ফাঁস করে দেন, তাই সংসদের শীতকালীন অধিবেশন ডাকাই হল না বিজেপির বিপুল বহুমত সত্ত্বেও। বাজেট অধিবেশনকেও যথাসম্ভব সংক্ষিপ্ত করা হয়েছে। একই কায়দায়, কোনও আগাম বিজ্ঞপ্তি ছাড়াই জম্মু ও কাশ্মিরের বিশেষ মর্যাদা লোপ করার জন্য সংবিধান সংশোধনের প্রস্তাব প্রথমে রাজ্যসভায় এবং পরে লোকসভায় পাশ করানো হয়েছে। সর্বোচ্চ আদালত এমনই নতিস্বীকার করেছে যে, বাবরি মসজিদ ধ্বংস বেআইনি কাজ হয়েছে বলেও বিতর্কিত এলাকাটি পুরোপুরি হিন্দুদের হাতে তুলে দেওয়ার রায় ঘোষিত হয়েছে। মৌলিক অধিকারের এবং নাগরিক স্বাধীনতার অধিকারের সম্পূর্ণ বিরোধী হওয়া সত্ত্বেও উত্তরপ্রদেশের লাভ জিহাদ-বিরোধী আইনের ওপর কোনও স্থগিতাদেশ দিতে রাজি হয়নি সুপ্রিম কোর্ট। দিল্লির দাঙ্গায় মুসলমানদেরই মূলত দাঙ্গা বাধানোর অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। দাঙ্গায় প্ররোচনা দেওয়ার স্পষ্ট প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও বিজেপি নেতাদের গ্রেপ্তার করা তো দূর অস্ত, তাদের বিরুদ্ধে দায়ের করা কোনও অভিযোগ শুনতেও রাজি হয়নি আদালত। আরবান নকশাল বলে দাগিয়ে দেশের প্রখ্যাত ও ভীষণভাবে অসুস্থ সমাজকর্মীদের দানবীয় ইউএপিএ আইনে বিনা বিচারে মাসের পর মাস আটক করে রাখা সত্ত্বেও আদালত তাদের জামিন অগ্রাহ্য করেছে। নির্বাচনী বিধি প্রকাশ্যে অগ্রাহ্য করা সত্ত্বেও করা সত্ত্বেও নরেন্দ্র মোদি-অমিত শাহদের বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা গ্রহণ করতে অস্বীকার করেছে কমিশন, অথচ বিরোধী নেতাদের বিরুদ্ধে আরও কম অপরাধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে ওই একই নির্বাচন কমিশন। রিজার্ভ ব্যাঙ্কের যেসব চেয়ারম্যান ও সদস্যগণ মোদির কর্মসূচি সমর্থন করেননি, তাঁদের পদত্যাগে বাধ্য করেছে সরকার। এইরকম সহস্র উদাহরণ দেওয়া যায় যেখানে দেখা যাবে পুলিশ, সেনাবাহিনী, এবং অন্যান্য গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলির স্বাধীনতা কীভাবে হরণ করছে এই ফ্যাসিবাদী জমানা।

গণতন্ত্র প্রকাশিত হয় বিরোধীদলের নির্ভয় উচ্চারণে, বিরোধী পরিসরের উপস্থিতিতে এবং বিরোধী প্রতিষ্ঠানগুলির স্বাধীন কার্যকলাপের মধ্যে। বলপূর্বক কণ্ঠ স্তব্ধ করার, স্বাধীনতা হরণ করার এবং বিরোধী পরিসরকে নির্মূল করার মধ্য দিয়ে ফ্যাসিবাদী অথবা স্বৈরতান্ত্রিক প্রবণতা প্রকাশিত হয়। সেটাই জাতীয় স্তরে বিজেপি করে চলেছে। এইরকম দুঃশাসনের শক্তিকে প্রতিহত করাটা প্রধান কর্তব্য সন্দেহ নেই। তাই বিজেপিকে একটি ভোটও নয়। এবং এটা নিশ্চিত করার জন্য বিজেপিবিরোধী সমস্ত গণতান্ত্রিক ও ধর্মনিরপেক্ষ শক্তিকে একজোট হতে হবে। ১৯৩৫ সালে কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিকের সপ্তম কংগ্রেসে জর্জি ডিমিট্রভ ফ্যাসিবিরোধী যুক্তফ্রন্ট গঠন প্রসঙ্গে এ কথাই বলেছিলেন। আজকের ভারতবর্ষে অনুরূপ একটি পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে। এই পরিস্থিতি গত শতকের ত্রিশের দশকে জার্মানি পরিস্থিতির অবিকল প্রতিরূপ অবশ্যই নয়— কারণ জার্মানির ফ্যাসিবাদের থেকে বর্তমান ভারতের সাম্প্রদায়িক ফ্যাসিবাদ ভিন্ন প্রকৃতির— কিন্তু আদতে তা ফ্যাসিবাদ-ই।

এই প্রেক্ষিতে সমাজমাধ্যমে প্রবল সক্রিয় বেশ কিছু ইন্টেলেকচুয়াল সম্প্রতি একটা গ্রুপ তৈরি করেছেন যার নাম ‘নো ভোট টু বিজেপি’। অর্থাৎ পশ্চিমবঙ্গে আসন্ন বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপিকে একটি ভোটও নয়। ফ্যাসিস্ট বিজেপি যেন কোনওপ্রকারেই পশ্চিমবঙ্গে গরিষ্ঠতা না পায়। এই ইন্টেলেকচুয়ালরা ব্যতিক্রমহীনভাবে বামপন্থী— ঘোর মাওবাদী রাজনীতির সমর্থক থেকে শুরু করে মার্কসবাদী নন এমন ‘বামপন্থী’রাও সামিল হয়েছেন। এঁদের অনেকে ‘স্বাধীন বাম’-ও বলে থাকে। এঁরা আবার বামফ্রন্টভুক্ত সংগঠনগুলিকেই ব্রাত্য মনে করেন, যারা ৩৪ বছর এ রাজ্যে ক্ষমতায় আসীন ছিল।

কিন্তু শুধুমাত্র ‘নো ভোট টু বিজেপি’ বললেই হবে না। পরিবর্তে কাকে ভোট দেব সে কথাটা বলা না হলে স্লোগানটি অসম্পূর্ণ থেকে যায়। তাই ‘নো ভোট টু বিজেপি’ এই আওয়াজ তুললে সঙ্গে সঙ্গে বলতে হবে তাহলে কাকে ভোট দেব? কারণ গত ১০ বছর ধরে এই রাজ্য শাসন করা মমতা ব্যানার্জিও বলছেন ‘নো ভোট টু বিজেপি’। তিনি আরও বলেছেন এই রাজ্যে বিজেপির বিরুদ্ধে একমাত্র তিনিই লড়ছেন। ২৯৪টি আসনেই বিজেপির বিরুদ্ধে তিনিই প্রার্থী। ফলে বিজেপিকে এই রাজ্য থেকে হটাতে চাইলে সকলের উচিত তাঁকেই ভোট দেওয়া। তাহলেও ‘নো ভোট টু বিজেপি’ মানে কি তৃণমূলকে ভোট দেওয়া? তৃণমূলই কি বিজেপির বিকল্প শক্তি? এই বুদ্ধিজীবীরা কি আদতে এই কথাই বলতে চাইছেন?

প্রশ্নটা এইভাবে পেশ করাতে ‘নো ভোট টু বিজেপি’ গ্রুপের এক নেতৃস্থানীয় প্রতিনিধি বললেন, না তারা সে কথা বলছেন না। বরং তারা বলছেন বিজেপির বিরুদ্ধে যেখানে যে দলের প্রার্থীর জেতার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি মানুষ তাকেই ভোট দিন, সেটাই তাঁরা চাইছেন।

এখন দলীয় শক্তির অন্যতম মাপকাঠি হচ্ছে বিগত নির্বাচনগুলোতে দলগুলির প্রাপ্ত ভোটের বিচার। সেই নিরিখে তৃণমূল অবশ্যই সর্বাপেক্ষা শক্তিশালী দল। ২০১৬ বিধানসভা নির্বাচন অথবা আরও সম্প্রতি ২০১৯ লোকসভা নির্বাচনে প্রতিটি আসনে তৃণমূল প্রার্থী হয় বিজয়ী হয়েছে নয়তো দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে। সুতরাং যুক্তির বিচারে বিজেপির বিরুদ্ধে তৃণমূলকেই ভোট দেওয়া উচিত। এমনকি গত ১০ বছরে অ্যান্টি-ইনকাম্বেন্সি ভোট, যা তৃণমূলের বিরুদ্ধে যাবে সেকথা ধরে নিয়েও বলা যায় বিজয়ী না হলে পরাজিত আসনেও তৃণমূল প্রার্থীর ভোট দ্বিতীয় স্থানে থাকার সম্ভাবনাই বেশি। অর্থাৎ ‘নো ভোট টু বিজেপি’-র নির্গলিতার্থ দাঁড়াচ্ছে ‘ভোট ফর তৃণমূল’।

তৃণমূল তথা মমতা ব্যানার্জি বহুদিন থেকেই বলে আসছেন বিজেপির বিরুদ্ধে যে রাজ্যে যে দল শক্তিশালী সে-ই বিজেপির বিরুদ্ধে নির্বাচনে প্রার্থী হবে এবং বিজেপিবিরোধী বাকি সব দল তাকেই সমর্থন করবে। বাংলায় যেহেতু তৃণমূল বিজেপিবিরোধী সবচেয়ে শক্তিশালী দল কংগ্রেস ও বামপন্থীরা সকলে নিজের নিজের দলের অফিস গুটিয়ে আন্দোলনের ঝাঁপ বন্ধ করে তৃণমূলের পক্ষে কাতার দিয়ে দাঁড়াবে। কারণ বিজেপিই সকলের সাধারণ শত্রু! এই কৌশলই ফেডারেল ফ্রন্টের কৌশল।

এবার এই তৃণমূল-বিজেপির বিষয়টা একটু খতিয়ে দেখা যাক। পরস্পর কত খারাপ— তৃণমূল ও বিজেপির প্রচারের একমাত্র বিষয় হল এটাই। জনগণের সমস্যার সমাধানে এদের কারও কোনও নির্দিষ্ট পরিকল্পনা প্রচারে নেই। এই রাজ্যের চাষি তাঁর ফসলের জন্য ন্যূনতম সহায়ক মূল্য পাবে কিনা তা সুনিশ্চিত করার কোনও পরিকল্পনা এ দুটি দলের কারও নেই। পশ্চিমবঙ্গে বোনাস সহ ধানের এমএসপি ১৮৮০ টাকা। আর চাষির জোটে বড়জোর ১২০০-১৩০০ টাকা। সরকারি সংগ্রহ কেন্দ্রে ফড়ে আর মিলমালিকদের দখলদারি এড়িয়ে চাষি পৌঁছতে পারেন না। যদি বা কোনও চাষি ধান সংগ্রহ কেন্দ্রে হাজির হতে পারেন তবু দীর্ঘ পথযাত্রার পরিবহন খরচ এবং ধলতা বাদ দিয়ে যেটুকু টাকা চাষির কপালে জোটে তার পরিমাণ অভাবী বিক্রির চেয়ে বেশি নয়। যে তিনটি কেন্দ্রীয় কৃষি আইনের বিরুদ্ধে মমতা এতটা খড়্গহস্ত ২০১৪ এবং ২০১৮ সালে কৃষিবাণিজ্য সংক্রান্ত অনুরূপ যে আইন এ রাজ্যের বিধানসভায় বিরোধীদের বিরুদ্ধতা সত্ত্বেও তিনি পাশ করিয়েছেন তা কিন্তু প্রত্যাহৃত হয়নি। বামপন্থী ও কংগ্রেসের বারংবার দাবি সত্ত্বেও কেন্দ্রীয় কৃষি আইনের বিরুদ্ধে যে আইন পাঞ্জাব, রাজস্থান, ছত্তিশগড় ও কেরলের রাজ্য বিধানসভায় পাশ হয়েছে তা পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য বিধানসভায় পাশ করাতে মমতা ব্যানার্জি অস্বীকার করেছেন। তাই কৃষকদের লড়াইয়ের প্রতি তার দরদ যে কতটা মেকি তার বুঝতে অন্য প্রমাণ লাগে না।

কর্মসংস্থানের কোনও পন্থা নিয়েও এই দল দুটি নিশ্চুপ। নতুন লেবার কোড সংসদে যখন আলোচিত হয়েছিল তখন বাম ও কংগ্রেস তার বিরোধিতা করেছিল, তৃণমূল করেনি। কেবল মিথ্যা তথ্যের ঝুলি খুলে পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূলের আমলে লক্ষ লক্ষ চাকরির ফিরিস্তি একটি শিশুও বিশ্বাস করে না। আর কেন্দ্রের মোদি সরকার তো স্বাধীন ভারতে বেকারের সংখ্যার নতুন রেকর্ড করেছে লকডাউনের আগেই। আর লকডাউন শিথিল হওয়ার পরে আরও প্রায় ১৪ কোটি মানুষ কাজ হারিয়েছেন। পশ্চিমবঙ্গে সরকারি চাকরিতে নিয়োগ ১০ বছর ধরে বন্ধ। বন্ধ স্কুলশিক্ষায় নিয়োগ। যেটুকু নিয়োগের উদ্যোগ দেখা গিয়েছে, সেখানে প্রবল দুর্নীতির অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় আদালত গোটা নিয়োগ প্রক্রিয়া বাতিল ঘোষণা করেছে।

অর্থাৎ শ্রমিক-কৃষক-মধ্যবিত্তের কর্মসংস্থানের সমস্যা, চাষির ফসলের দাম না পাওয়ার সমস্যা, বাজারে গরিবের খাদ্যদ্রব্যের বিপুল মূল্যবৃদ্ধির সমস্যার কোনও সমাধান বিজেপি-তৃণমূলের প্রচারে নেই। রয়েছে কেবল পরস্পরের বিরুদ্ধে খেউড়ের কীর্তন। রয়েছে নতুন নতুনভাবে রাজ্যের মানুষকে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পরিচিতিতে বিভাজনের কৌশল, ধর্মের ভিত্তিতে ঘৃণা ছড়ানোর কৌশল, পঞ্চায়েত ব্যবস্থা ধ্বংস করে ‘দুয়ারে সরকার’ পৌঁছে দেওয়ার ব্যর্থ প্রচেষ্টার চমক, লোভ দেখিয়ে, ভয় দেখিয়ে মানুষের শুভ মূল্যবোধের শিকড় উপড়ে ফেলার কৌশল, ইত্যাদি। বিজেপি যখন রামমন্দির তৈরি করে মিথকে ইতিহাসে পরিণত করতে চাইছে, তৃণমূল তখন ইমামভাতা ও পুরোহিতভাতার ডোল দিয়ে একই মধ্যযুগীয় ধর্মতন্ত্রের কায়েমি স্বার্থকে সন্তুষ্ট করতে চাইছে। এসবের মাধ্যমে রাজ্যের ভোটচিত্রকে এক দ্বিমেরু আখ্যানে বন্দি করে ফেলতে চাইছে উভয় দলই— বিজেপি এবং তৃণমূল। প্রায় সমস্ত সংবাদমাধ্যম এই দ্বিমেরু ভাষ্য নির্মাণে যথাসাধ্য মদত দিয়ে চলেছে। অথচ গত এক বছর ধরে তৃতীয় বিকল্পের যে শক্তিসমূহ জায়মান হয়ে উঠেছে রাজধানী শহরের সীমানা ছাড়িয়ে গ্রামে-গঞ্জে, বসতির প্রান্তসীমায়, লকডাউনের মোকাবিলা করতে, মহামারি ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের আঘাতে বিপর্যস্ত জনসমষ্টির খাদ্য ও ত্রাণ সহায়তা প্রদানে, এবং কাজের দাবি, খাদ্যের দাবি এবং তোলাবাজ চোরেদের শাস্তির দাবিতে মানুষকে সংগঠিত করার প্রচেষ্টা জারি রেখেছে বিক্রি হয়ে যাওয়া সংবাদমাধ্যমে সেই গা ঝাড়া দিয়ে উঠে দাঁড়ানোর প্রচেষ্টার প্রতিফলন নেই। এই ‘নো ভোট টু বিজেপি’-ও কি সেই দ্বিমুখী ভাষ্যের সঙ্গতকারের ভূমিকাই পালন করছে না?

মমতা কেমন ‘এগিয়ে বাংলা’ গড়েছেন, তার প্রমাণ রাজ্য জুড়ে ছড়িয়েছিটিয়ে রয়েছে। বিজেপি কেমন ‘সোনার বাংলা’ গড়বে উত্তরপ্রদেশ অথবা ত্রিপুরায় তার প্রমাণ ছড়িয়ে রয়েছে। সেখানে বেকারির হার ৩৪ শতাংশ— দেশের সর্বোচ্চ। সেখানে প্রতিদিন দলিত ও মুসলমানরা নিহত, নির্যাতিত ও নিপীড়িত হচ্ছেন। সুযোগ পেলে এই দুই দলই সোনার বাংলা নয়, শ্মশানের বাংলা গড়বে— মমতা ব্যানার্জির আরব্ধ কাজ হয় তিনি নিজেই সম্পন্ন করবেন, অথবা সুযোগ পেলে তা সম্পন্ন করবে বিজেপি।

সন্দেহ নেই যে বিজেপিই দেশের তথা রাজ্যের মানুষের প্রধান শত্রু, তাই বিজেপিকে হারানোই প্রাথমিক লক্ষ্য। কিন্তু এ রাজ্যের যে বিপুল সংখ্যক মানুষ গত ১০ বছর তৃণমূলী দুঃশাসনে আরও দুর্দশাগ্রস্ত হয়েছেন, এই শাসনের অবসানে বিরুদ্ধপক্ষকে ভোট দিতে উন্মুখ, তারা ‘নো ভোট টু বিজেপি’র আংশিক স্লোগানকে অবহেলা করবেন নিশ্চিত। যদি বিকল্প কিছু না থাকে তবে প্রতিষ্ঠানবিরোধিতার বিপুল ভোট বিজেপির বাক্সে জমা হবে এ বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। যেমন ঘটেছিল ২০১৯ লোকসভা নির্বাচনে। তা না হলে যে দলের পক্ষে রাজ্যের অর্ধেক বুথে এজেন্ট বসানোর ক্ষমতা নেই, তারা কীভাবে ৪০ শতাংশের বেশি ভোট পেল! আর তা হলে কিন্তু ‘নো ভোট টু বিজেপি’র যাত্রা শেষ হবে ঠিক তার উদ্দেশ্যের বিপরীত মেরুতে। এর আগে আমরা দেখেছি ২০১১ সালে তথাকথিত স্বাধীন বুদ্ধিজীবীরা পরিবর্তন চেয়ে মমতা ব্যানার্জির পেছনে জড়ো হয়েছিলেন। তাই গুন্ডা কন্ট্রোল করা আপাদমস্তক লুম্পেনদের দলের নেত্রীর মাথার পেছনে বামপন্থী আলোকচ্ছটা তৈরি হয়েছিল, এবং তাই একাদিক্রমে ৩৪ বছর শাসন করে অবসন্ন দিশাহীন বামপন্থীদের ফ্রন্ট পরাজিত হয়েছিল। কিন্তু সেই ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটবে না। দুনিয়ার কোথাও ঘটেওনি।

তৃণমূলের সঙ্গে জোট হতে পারে শুধুমাত্র বিজেপিরই। জয় শ্রীরামের মোকাবিলায় হনুমান জয়ন্তী পালনের মধ্যে, রামনবমীর মিছিলের প্রতিযোগিতার মধ্যে, সংসদের মতো বিধানসভাতেও বিরোধীদের কণ্ঠরোধের প্রয়াসের মধ্যে, কেন্দ্রীয় সরকারের মত তুচ্ছ অজুহাতে এ রাজ্যেও বিরোধী দলগুলির সমর্থকদের অসংখ্য মিথ্যা মামলায় ফাঁসানোর মধ্যে দিয়ে আমরা এই সত্যের স্পষ্ট প্রতিফলন দেখতে পাচ্ছি। তৃণমূল ও বিজেপি যে দুঃশাসনের একই মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ— এই সত্যটি বুঝতে হবে। দুর্ভাগ্যজনক বিষয়, বিহার নির্বাচনে ভালো ফল করা বাম দলটিও— যারা ‘কেবলমাত্র বিজেপিই প্রধান শত্রু’ মন্ত্রের প্রথম উদ্গাতা— তারাও এই সত্যটি বুঝছে না বা বুঝতে চাইছে না।

পশ্চিমবঙ্গে বিজেপিকে হারাতে হবে, কিন্তু সেটা তৃণমূলকে সঙ্গে নিয়ে করা যাবে না। এমন যেকোনও প্রচেষ্টা শাসকদলের ওপর রুষ্ট প্রতিষ্ঠান বিরোধিতার ভোটকে বিজেপির দিকে ঠেলে দেবে। বিজেপিকে হারানোর প্রাথমিক লক্ষ্য অর্জনের জন্যই এ রাজ্যে তৃণমূলকে হারাতে হবে। এ রাজ্যে বিজেপির বাড়বাড়ন্তের জন্য কোন দলের ভূমিকা সর্বাগ্রগণ্য এ কথা সবাই জানে। বামপন্থীদের শায়েস্তা করতে মমতা ব্যানার্জি তার পুরনো বন্ধুদের ডেকে এনেছিলেন সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম পর্ব থেকেই। সুতরাং বিজেপির সঙ্গে তৃণমূলকেও হারাতে হবে। মানুষকে আহ্বান জানাতে হবে— বিজেপিকে একটি ভোটও নয়, একমাত্র বিকল্প বাম গণতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষ দলগুলির জোট, তাকেই ভোট দিতে হবে!”

তৃতীয় বিকল্প শক্তির উত্থানের ক্ষেত্র কিন্তু প্রস্তুত হয়েই আছে। তার প্রতিশ্রুতি তৃণমূল বা বিজেপির লাগামছাড়া অবাস্তব প্রতিশ্রুতির প্রতিযোগিতা থেকে আলাদা— একটু স্বস্তির আশ্বাস, তোলাবাজির অবসান, সকলের মিলিত সদ্ভাবনা, বিভাজনের বদলে ঐক্য ও সৌভ্রাতৃত্ব, কর্মসংস্থানের আন্তরিক প্রয়াস এবং গেরুয়া লুম্পেন ও ঘাসফুল লুম্পেনদের যুগপৎ আতঙ্ক থেকে মুক্তি। রাজ্যের মাটিতে পুনর্বার ধর্মনিরপেক্ষতা ও গণতান্ত্রিক শাসনের প্রতিষ্ঠা করতে তারাই একমাত্র বাজি।