শঙ্খদীপ ভট্টাচার্য
প্রাবন্ধিক ও গল্পকার; পেশায় কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার
কুনাল কামরার কথায় পরে আসছি। আপাতত ‘খেলছে শচীন খেলছে শচীন, মারছে শচীন ছয়’ নিয়ে কথা শুরু হোক।
শচীন তেন্ডুলকার গড অফ ক্রিকেট দেশের তামাম জনতার কাছে। কেন গড? গডকে কি কেউ দেখেছে? গড কি ক্রিকেট খেলে? গডের কটা সেঞ্চুরি, স্ট্রাইক রেটই বা কত, কেউ কি সেসব জানে? জানার মোটেও দরকার নেই, কারণ গড মানুষের ভাব-জগতের সবচেয়ে শক্তিশালী প্রতিনিধি। গড সর্বশক্তিমান। গডই শেষ কথা। তার ওপর গড যদি কোঁকড়াচুলো, মিহি গলার সুইট দেখতে ছোটোখাটো এক মানুষের চেহারা নিয়ে মাত্র সতেরো বছর বয়েসে পাকিস্তানের বাঘা বাঘা বোলারদের নাস্তানাবুদ করে জাতীয় দলের হয়ে ডেবিউ করে ক্রিকেট-গ্ল্যামার জগতে পা রাখে, তাহলে ‘ইট ক্রিকেট, ড্রিঙ্ক ক্রিকেট, স্লিপ ক্রিকেট’-ওয়ালা দেশের ভগবানসন্ধানী আবালবৃদ্ধবনিতার কাছে তিনি এক সময় অবিসংবাদিত আন্তর্জাতিক-ক্রিকেট-ভগবানের তকমা পাবেন, সেটাই তো স্বাভাবিক। এ তো গেল মানুষের ভাবের জগতের জাতীয় কারবারের এক দিক। কিন্তু বাস্তবে তো আর ক্রিকেট খেয়ে, পান করে বেঁচে থাকা যায় না, আর এই বাস্তবের আন্তর্জাতিকতা কিন্তু ক্রিকেটভগবান ও তার শিষ্যরা হাড়ে হাড়ে বোঝেন। বেঁচে থাকতে দরকার হয় অন্নের— যাকে ছোঁয়া যায়, আঙুল চেটে খাওয়া যায়। এখানেই ঘটল বিপর্যয়। সুইট দেখতে এই গড ক্রিকেটার এক টুকরো টুইট করে অন্ন, অন্নদাতা, জাতীয়তাবাদ, আন্তর্জাতিকতা ইত্যাদি বিষয়ে নিজেকে জড়িয়ে এতদিনের আড়াল করে রাখা দুষ্টু কালো সত্তাটিকে জনতার দরবারে প্রকাশ করে ফেললেন।
বলিউড ভারতের মানুষকে অজয় দেবগণ, অক্ষয় কুমারের মতো নায়ক উপহার দিয়েছে। তাদের এক ঘুষি পদার্থবিজ্ঞানকে কাঁচকলা দেখিয়ে গুন্ডা বদমায়েশের দলকে পাল্টি খাওয়ায়। অনুভূতি পণ্য করা বিজ্ঞাপনে, ফিল্মফেয়ার আওয়ার্ড অনুষ্ঠানে, সিনেমার পর্দায় তাদের চমৎকার স্ক্রিপ্টেড কায়দায় উন্মাদ হয়ে ওঠেন কত নিম্নবিত্ত মধ্যবিত্ত নিম্নবয়সী মধ্যবয়সী ছেলেমেয়েরা। অতি নিম্নমানের সিনেমা হলেও তারা সেখানে শ্রমিকের পক্ষে, কৃষকের পক্ষে। হোক না তা অভিনয়, ফেক, ফ্যান্টাসি। কিন্তু ভাবের জগতের লীলা এমনই যে রোজকার দৈন্যদশা, গাড়লের মতো ধুঁকতে থাকা জীবনকে পাশ কাটাতে বলিউডের ধাতিং ডান্স এবং ক্রিকেট ঈশ্বরদের ফ্লাড লাইটের আলোয় হাতড়ে বেড়িয়েই যেন দুদণ্ড শান্তি। অতএব আমরা যত বেশি অসহায়, তত বেশি বলিউড, তত বেশি ক্রিকেট, তত বেশি ভগবান। এ এক আশ্চর্য সমীকরণ! এই সমীকরণের এক প্রান্তে জাঁকিয়ে বসে থাকে শচীন তেন্ডুলকারের চকচকে ফেরারি, অক্ষয় কুমারের লাখ টাকার ডায়েট চার্ট, অনিল আম্বানির প্রাইভেট জেট, নীতা আম্বানির সাতনরি হীরের হার। অন্যপ্রান্তে মিছিল, প্রতিবাদ, অভিবাসী শ্রমিক, কৃষকের পচাগলা লাশ। তবু্ও এই অসহ্য সমীকরণটা বদলায় না। দুই প্রান্তে বিরোধ তীব্র হলে এই সমীকরণকে সুরক্ষা দিতে রাষ্ট্র হাজির হয় অগণতান্ত্রিক উপায়ে পাশ করিয়ে নেওয়া জনবিরোধী ড্রাকোনিয়ান সব কালাকানুন নিয়ে। সঙ্গে পুলিস, মিলিটারি জলকামান, টিয়ার গ্যাস তো আছেই।
মৌলবাদ রাষ্ট্রের মোক্ষম হাতিয়ার। এই রাষ্ট্রকে সাষ্টাঙ্গ প্রণাম জানিয়ে রিলায়েন্স অধিকৃত মিডিয়ার স্মার্ট সাংবাদিক টকটক ইংরেজি বলে কত সহজেই প্রভাবিত করে আইআইটি-আইআইএম-আইআইএসসি-র মতো প্রতিষ্ঠানের নামজাদা অধ্যাপক, ছাত্রদের। এইসব কিছুর পেছনেই কাজ করে, ভ্রান্ত ইতিহাসবোধ, অবৈজ্ঞানিক চিন্তা, অসামাজিক স্বার্থপর মূল্যবোধ, স্বাধীনতা পরবর্তী বিভিন্ন পার্টির বিচিত্র সব কর্মকাণ্ডে গুলিয়ে ওঠা রাজনৈতিক অসচেতনতার এক জটিল কম্বো।
উল্টোদিকে এই সংক্রামক অমানবিক মননের বিপক্ষে এক দল মানুষ শিড়দাঁড়া টানটান রেখে নিরন্তর সরব থাকেন। এমনই একজন মানুষ হলেন কুনাল কামরা। গোদি মিডিয়ার প্রাণপুরুষ উচ্চকণ্ঠ উচ্চকিত ব্যক্তিত্বের অধিকারী অর্ণব গোস্বামীকে বিমানপথে বাগে পেয়ে কুনাল তার মুখোশ খুলেছিলেন স্বভাবসিদ্ধ কায়দায়। তার খেসারত দিতে হয়েছিল তাকে। অর্ণবের নিজস্ব রিপাবলিক স্টুডিয়োতে এতদিনের গড়ে তোলা কোটি টাকার হিন্দুত্ববাদী জিঙ্গোইজম বেলুনের মতো চুপসে যাওয়ায় সে নালিশ করে তার পালকপিতাকে। এ যেন এক ধনী শিশুর চুষতে থাকা ললিপপ কেড়ে নেওয়ার নালিশ তার বাবার কাছে। বাবার পোষ্য জুডিসিয়ারি কুনালকে ইন্ডিগো এয়ারলাইনে পা রাখতে বারণ করে। কুনালরা এসবে ভয় পাওয়ার পাত্র নন। আইন আইন তামাশায় বীতশ্রদ্ধ হয়ে হালে টুইট করেন, “The Supreme Court of this country is the most Supreme joke of this country…” তা নিয়ে সুপ্রিম কোর্ট আবার বেশ কিছুদিন সরগরম। আসলে সত্য সবসময়ই অপ্রিয় ধড়িবাজদের কাছে। এই জিঙ্গোইজম সার্কাস যারা টিকিট কেটে দেখে সার্কাসকে আরও সমৃদ্ধ করার দায়িত্ব নিয়েছেন তাদের কাছে কুনাল কেবলই একজন কমেডিয়ান বা শিবসেনার মুখপাত্র। অসামাজিক, রাজনৈতিক অসচেতন, অর্ধেক মানুষগুলোর কাছে কমেডিয়ান, শিল্পী, সাহিত্যিকের সামাজিক সত্তা থাকাটা একেবারেই অস্বাভাবিক। তারা লোক হাসাক, কবিতা লিখুক কিন্তু শয়তানদের মুখোশ খুলবে কেন? কিন্তু উল্টোদিকে যেসকল অভিনেতা এবং ক্রিকেটাররা শিরদাঁড়া নিলামে বেচে স্ব স্ব ক্ষেত্র ছাড়িয়ে সমাজ, দেশ, কৃষক প্রসঙ্গে ভয়ঙ্কর হাস্যকর টুইট করেন তখন তাদের জুতো পালিশ করে দিতে তারাই আবার লাইনে দাঁড়ান। এইসকল স্ববিরোধী কাজকর্মের ফিরিস্তি দেওয়া মানে যুক্তি, বুদ্ধি, বিজ্ঞান ও মানবিক চেতনাকে পাতালে নামিয়ে আনা।
হালের কৃষক আন্দোলন এখন আর জাতীয় সীমানায় থেমে নেই। শোরগোল ফেলেছে আন্তর্জাতিক মহলে। ভবিষ্যতের কৃষিক্ষেত্রে জিনপ্রযুক্তি মাইক্রোবায়োলজি সেক্টরে বিপুল লগ্নির হিসেব কষে জো বাইডেন কৃষি আইনের সপক্ষে কথা বললেও টুইট করে আন্দোলনরত বীর সংগ্রামীদের প্রতি সংহতি জানিয়েছে রিহানা, গ্রেটা থুনবার্গরা। রিহানা মাত্র কয়েকটি শব্দ লিখেছেন, বলেছেন, “Why aren’t we talking about this?!” কেন আমরা এ বিষয়ে কথা বলছি না। লেখাটির শেষে প্রশ্নবোধক এবং বিস্ময়বোধক চিহ্ন পাশাপাশি। বক্তব্য এবং অবস্থান এখানেই স্পষ্ট। গ্রেটা থুনবার্গের টুইটের বিরুদ্ধে দিল্লি পুলিশ কড়া পদক্ষেপ নেওয়ার কথা বললে গ্রেটা উত্তরে আবার টুইট করে জানান, “I still #StandWithFarmers and support their peaceful protest. No amount of hate, threats or violations of human rights will ever change that. #FarmersProtest,” এইটুকু মেয়ের এতবড় আস্পর্ধা! বার্বাডোজ, সুইডেনের অধিবাসী হয়ে ভারতের কৃষকদের যন্ত্রণার শরিক হচ্ছ! টুইটের সঙ্গে যে টুলকিট বা গুগল ডকুমেন্ট শেয়ার করেছিলেন গ্রেটা তাতে কাদের হাত রয়েছে তার খুঁটিনাটি চেয়েছে দিল্লি পুলিস সমাজমাধ্যমগুলির কাছে।
এ তো গেল প্রত্যাশিত সরকারি পদক্ষেপ। বিশ্বায়নের মধু চাটা যে সকল জনতার হাড়েমজ্জায় জাতীয়তাবাদের গনগনে আগুন সেখানে গ্রেটা, রিহানার টুইট ঘি হয়ে পড়লে কী প্রতিক্রিয়া পাওয়া যাবে তা কল্পনা করতে বেশি কাঠখড় পোড়াতে হয় না। দেশপ্রেমের সিলেবাসে কী টপিক আছে তা এখন সাতে পাঁচে না থাকা মানুষও জানেন। এই সিলেবাস মুখস্থ করে গেরুয়া জনতাও হাস্যকর সব ব্যানার হাতে পথে নামলেন। এদের মুখপাত্র সম্বিত পাত্রর কথা অনুযায়ী টুইটার সফটওয়্যার আসার আগে এবং রিহানার পৃথিবীতে আসার আগে অমুক তমুক ঘটনা নিয়ে রিহানা কেন টুইট করেননি। অর্বাচীন না হলেও হিন্দুত্ববাদের বুলি আওড়ে আলোচনায় স্থান পাওয়ার মতো কাণ্ড করলেন সেলেব্রিটিরা। বস্তুত জাতীয় গণ্ডিতে আবদ্ধ জনতা পুলিশ দিয়ে আন্তর্জাতিক সংহতি প্রতিহত করা কঠিন ব্যাপার বলেই লেলিয়ে দিতে দরকার পড়ল জাতীয় আইকন অনুঘটকের যাঁরা আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে কিছুটা হলেও পরিচিত। কোমর বাঁধলেন দেশপ্রেমিক বিরাট কোহলি, লতা মঙ্গেশকার, সাইনা নেওয়াল, অজয় দেবগণ, শচীন তেন্ডুলকার প্রমুখ। শচীন টুইটে যা লেখেন তার বাংলা করলে দাঁড়ায়, “ভারতের সার্বভৌমত্ব নিয়ে আপস করা সম্ভব নয়। বহির্বিশ্ব দর্শকের ভূমিকায় থাকতে পারে, নিয়ন্ত্রক হতে পারে না। ভারতীয়রাই ভারতকে যথাযথ চেনে এবং কী করা উচিত জানে। আসুন, জাতি হিসেবে আমরা ঐক্যবদ্ধ থাকি।’ আন্তর্জাতিক সংহতিকে প্রোপাগান্ডা তকমা দিয়ে সকলে যা টুইট করেন তার সারমর্ম মোটামুটি এই। এ যেন হিটলার মুসোলিনির হৃদয়ের কথা ভারতীয় সেলেব্রিটিদের টুইটে পুনরায় প্রতিষ্ঠিত হল। শচীন ভারতের ঐক্য নিয়ে ভীষণ চিন্তিত। অথচ যে কৃষকদের ঐক্যবদ্ধ শ্রমের ফসলে শচীন পেট ভরান তাদের বিরূদ্ধেই শচীন টুইট করলেন। যে ব্যাট দিয়ে তিনি ছক্কা মারেন, তা প্রস্তুত করতে দরকার হয় এক ধরনের শ্রমিক ঐক্য। অথচ যে দল মানুষকে বিভাজিত করতে সিদ্ধহস্ত তাদের হয়েই তিনি ঐক্যর কথা বললেন। মানুষের খাদ্যাভাস, ভালোবাসার মতো অতি অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করা দলের ঝাণ্ডা তুলে শচীন কোনটা অভ্যন্তরীণ আর কোনটা নয়, সেই গোটা বিষয়কেই সম্পূর্ণ অন্য মাত্রায় নিয়ে গেলেন। যদিও এই টুইট শচীনের মস্তিষ্কপ্রসূত নয়, কেবল টুইটপ্রবাহে সচেতনভাবে গা ভাসিয়েছেন মাত্র। কস্মিনকালেও বুঝতে পারেননি রাতারাতি তিনি গড থেকে গডসে-তে পরিণত হবেন। রাশিয়ান টেনিস তারকা মারিয়া শারাপোভা শচীনকে চিনতে পারেননি বলে একসময় যে শচীনভক্তরা শারাপোভাকে আক্রমণ করছিলেন তারাই আজ ক্ষমা চাইছেন শারাপোভার কাছে এই বলে যে তারা শচীনকে খেলোয়াড় হিসেবেই চেনেন মানুষ হিসেবে কেউ তাঁকে এখন আর চিনতে পারছেন না।
আসলে সময়টাই যে আজ এইরকম। বৃহত্তম গণতন্ত্রের বলি অন্নদাতা কৃষকদের অভূতপূর্ব আন্দোলনের সঙ্গে জুড়ে গিয়েছে বিদ্যুৎগতিতে ছড়িয়ে পড়া কোটি কোটি পোস্ট, কমেন্ট, টুইট। মানুষ প্রতিবাদে সামিল না হয়ে মুখে কুলুপ এঁটে বসে থাকলেও আজকাল স্বরুপ উন্মোচিত হয়ে যাচ্ছে কত সহজে। সাদা কালোর ফারাক, দুই বিপরীতমুখী শ্রেণির দ্বন্দ্ব আজ ভীষণই প্রকট। পেঁয়াজের খোসা ছাড়িয়ে ভেতরের অদেখা অংশটা বার করে আনছে এই সময়। সময়ের ঝাঁজে চোখের জল ফেলে ভক্তরা নতুন করে চিনে নিচ্ছে সিন্দুকে লুকিয়ে রাখা আইকনদের আসল চেহারা। মানুষ বুঝে নিচ্ছে প্রতিভাবান শিল্পীদের সামাজিক ও মানবিক দিকগুলির কদর্য রূপ। হিরো ভিলেন, চোর সাধু হয়ে উঠছেন চোখের পলকে। বাস্তবতা বিচ্ছিন্ন ভাবের জগতে এমন ওঠানামা অবশ্য হয়েই থাকে।
হ্যাঁ জানি, ফেরারি, প্রাইভেট জেট আর সাতনরি হারের চাঁদোয়ায় যাপনের খরচ বিস্তর। সেই বিপুল খরচের টাকা হোক না আম-আদমি, শ্রমিক, কৃষকের রক্ত শুষে। আইকন হতে গেলে রাষ্ট্র ও মালিকশ্রেণির কাছাকাছি না থাকলে যে চলে না সে তালিম হয়তো শচীন, কোহলি, অক্ষয়রা ছোটবেলা থেকেই পেয়েছেন। তাঁরা বুঝেছেন, ফাটল ধরা শিরদাঁড়ায় তাপ্পি দিতে দরকার হয় ভক্তদের অন্ধ উন্মাদনা, রাষ্ট্রীয় সুরক্ষা, জুডিশিয়াল আশীর্বাদ।
তবু দেশপ্রেমিক সেলেব্রিটিদের বলছি, এখন থেকে ভেবেচিন্তে টুইট করবেন। সময় কিন্তু বদলাচ্ছে।