অরুণপ্রকাশ রায়
পূর্ব প্রকাশিতের পর
তৃতীয় পর্ব
এ দেশে হাতে গোণা যে ক’জন বাহাউদ্দিন আর কুতুবুদ্দিন কাওয়ালকে শুনেছেন, তাঁরা জানেন, কী অসাধারণ প্রতিভাবান শিল্পী ছিলেন এঁরা দুই ভাই। বাহাউদ্দিন যাকে বলে কাওয়াল বাচ্চোঁ কে ঘরানার একেবারে যোগ্য উত্তরসূরি ছিলেন। ওঁর দুই সুপুত্র, নাজমুদ্দিন ও সাইফুদ্দিনও মন্দ গান না, কিন্তু প্রতিভা বা শৈলীর প্রয়োগের দিক দিয়ে বাপের ধারেকাছেও নন। আধুনিক কাওয়ালরা অনেকেই বাহাউদ্দিন সাহেবের স্টাইল অনুসরণ করেন, এবং সেটাই হয়তো স্বাভাবিক। যথেষ্ট যুক্তিযুক্তও বটে। বাহাউদ্দিন সাহেবের গানে সবই একেবারে যাকে বলে নিক্তি মেপে নিখুঁত— গজল-এ যেমন রাদিফও কাফিয়ার (বয়েৎ-এর অন্ত্যমিল) হিসেবে কোথাও এতটুকু পান থেকে চুন খসবার জো নেই, ঠিক তেমনই বাহাউদ্দিন সাহেবের গায়নশৈলীর গ্রামার— একেবারে নিখুঁত কপিবুক। মিসরা, সানি মিসরা (গানের দ্বিতীয় পংক্তি), মিসরা উলা বা সেকেন্ডারি রাইমিং— কোত্থাও এতটুকু ত্রুটি পাওয়া যাবে না। পারলে ওঁর ‘তুম সঙ্গ মোহন প্রীত লগানা’ বা ‘গঞ্জ-শাকার কা লাল’ শুনে নিন স্পটিফাই বা ইউটিউবে, গ্যারান্টি দিতে পারি, অতি চমৎকার লাগবে।
শুধু কাওয়ালরাই নন, শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের বহু দিকপালও প্রচুর সুফি কালাম হরহামেশা গেয়ে থাকেন। একবার হয়েছে কী, দিল্লির কামানি অডিটোরিয়াম-এর এক অনুষ্ঠানে মিশ্র পাহাড়িতে ‘আজ রাধা ব্রিজ কো চলি’ গেয়ে পাততাড়ি গোটাতে যাচ্ছেন রাশিদভাই, আচমকাই অডিয়েন্সের তৃতীয় সারি থেকে কোনও এক অর্বাচীন চিৎকার করে ‘করম কর দিজে’ গাইবার জন্য অনুরোধ করে উঠল। রাশিদ খাঁ প্রথমে একটু আঁতকে উঠলেও, তারপরে, হয়তো সেই শ্রোতাকে শান্ত করার জন্যই, ধরলেন দেশ রাগে বসানো বিখ্যাত বন্দিশটি। সে গানের মাত্রই বারো মিনিটের একটি রেকর্ডিং আমি এই পর্বটিতে রাখলাম। কেমন গেয়েছিলেন রাশিদভাই? এককথায়, অপূর্ব, অপূর্ব!
দু’বার করে ‘অপূর্ব’ লেখার পরে, মনে হচ্ছে এর চেয়ে আন্ডারস্টেটমেন্ট আর কিছু হতে পারে না। হায় রে, শব্দের ক্ষমতা এতই কম! বিশেষ করে ‘তুম হো দাতা পীরন কে পীর’ যখন রে-মা-পা-নি-সা হয়ে ওপরের দিকে উঠছে, তার সুতোর টানে যখন আসছে ‘ওয়ালিয়াঁ কে তাজ, ইনায়েত কি শরম রাখ লো’… শুনে, মনে হয়েছিল, যেন জন্নতের সাত সিঁড়ির রাস্তা খুলে যাচ্ছে! বিশ্বাস করবেন কিনা জানি না, মনে হচ্ছিল চোখ বুজলেই মুহূর্তে খোয়াজা মঈনুদ্দিন চিশতির দরগায় পৌঁছে যাব, সেখান থেকে পাঁচশো কিলোমিটার দূরের আজমেঢ় শরিফে। একথা আমি সেদিন প্রোগ্রামের পর গ্রিনরুমে গিয়ে রাশিদভাইকে জড়িয়ে ধরে বলেও ফেলেছিলাম। উত্তরে একটা হাসি হেসেছিলেন তিনি। সেই হাসির ফ্রেমটা আমি সারাজীবনের জন্য বাঁধিয়ে রেখে দিয়েছি।
কিন্তু, যে কথা বলছিলাম। চিশতি সিলসিলার প্রতিটি দরগার কিছু সিগনেচার কাওয়ালি রয়েছে। যেমন আজমেঢ়-এর ‘মইনুদ্দিন, কিরপা করো মহারাজ’। নুসরত ফতেহ আলি খান, ফরিদ আয়াজ, বাহাউদ্দিন সাহেব ছাড়াও বহু নামি-অনামি শিল্পীকে আমি এই গানটি গাইতে শুনেছি। কাওয়ালিটি সকলেই প্রায় একইরকম করে গান, কেবল শুরুর কয়েকটি পংক্তি গাওয়ার সময় প্রত্যেকেই কিছু না কিছু স্বাধীনতা নিয়ে থাকেন। যদি জিজ্ঞেস করেন আমার সবচেয়ে প্রিয় কোনটি; মানতেই হয়,পছন্দের তালিকায় সবার ওপরে থাকবে বাহাউদ্দিন সাহেবের ‘হম ওছে সব বাত কে সো তুম পুরে মহারাজ’, আর তারপরে থাকবে (যাকে বলে ক্লোজ সেকেন্ড) জাকি তাজি কাওয়ালের গাওয়া ‘খুদা তেরা, নবি তেরি, আলি তেরি, হাসান তেরি; হ্যায় শান-এ-পঞ্জতন তেরি, মঈনুদ্দিন আজমেঢ়ি’।
ভারী বিচিত্র মানুষ এই জামান জাকি তাজি। এত বড় গাইয়ে, কিন্তু নিজের বাবার গাওয়া গান শ্রোতাদের সামনে গাইতে ভারী লজ্জা পান! কিসের লজ্জা? জিগেস করলেই কিন্তু-কিন্তু করে মাথা নামিয়ে বলেন, “আরে, আপ তো আব্বা কে সুননেওয়ালে হ্যায়”… এতটাই শ্রদ্ধা এঁদের সিলসিলার প্রতি! একেবারে এই একই জিনিস দেখেছি আলি আকবর খাঁ সাহেবের মধ্যে… বাবা আলাউদ্দিনের চিজ বাজিয়ে গিয়েছেন সারাজীবন, আর সিদ্ধির ওই উচ্চতায় পৌঁছেও সারা জীবন আক্ষেপ করে গিয়েছেন, বাবার বাজনার ছিটেফোঁটাও নিজের যন্ত্রে হাসিল করে উঠতে পারেননি বলে। আজ যখন বড় বড় অনুষ্ঠানে বসে দেখি হালফিলের ওস্তাদেরা কিরানা, গোয়ালিয়র, জয়পুর, আগ্রা, আত্রাউলি সব মাখিয়ে ঘন্ট পাকিয়ে ফেলছেন, ভাবি, হায় রে, বুজুর্গের প্রতি, ট্র্যাডিশনের প্রতি, গুরুর প্রতি এর একছটাক শ্রদ্ধাও যদি আজকের শিল্পীদের মধ্যে থাকত!
লাহোর এয়ারপোর্ট থেকে দুশো কিলোমিটারের পথ খোয়াজা ফরিদউদ্দিন গঞ্জশাকার বা বাবা ফরিদের দরগা। সেই দরগায় গাওয়া হয় ‘মাননিয়াম বল্লাহ যারা মাননিয়াম’, যা আমি ফরিদ আয়াজ সাহেবের গলায় শুনেছি। এই কালামটি খুব সম্ভবত বাবা ফরিদেরই রচনা। দিল্লির মেহরৌলির খোয়াজা কুতুবুদ্দিন বখতিয়ার কাকি-র দরগায় নানান কিসিমের কালামই শুনেছি। বাবা ফরিদের ভাগ্নে, মাখদুম সাবির কালিয়ারি-র উদ্দেশে গাওয়া ‘মোরে মাখদুম বাজে মধুর বাঁশুরি’ শুনেছি নুসরত-এর গলায়। রুরকির কাছে এই দরগা কালিয়ার শরিফ নামে বিখ্যাত, সেখানে অবিশ্যি আমার এখনও যাওয়া হয়ে ওঠেনি। পানিপথের বু আলি শাহ কালান্দার-এর রচনা ‘হাইদেরিয়াম কলন্দরম মস্তম’ শুনেছি। আর খোয়াজা নিজামুদ্দিন আউলিয়ার দরগায় তো আমির খুসরো একই একশো।
এখানে একটা কথা নিবেদন করে রাখতে চাই। সমালোচনা অবশ্যই আমার উদ্দেশ্য নয়। প্রবাদপ্রতিম আমির খুসরো ‘রং’ লিখেছিলেন তাঁর পির-এর উদ্দেশ্যে; আর কবিতা শেঠের গাওয়া ‘ট্রান্স উইথ খুসরো’ অ্যালবামে ওই একই গান শুনে, কী বলব, আমি আর একটু হলে মূর্ছা যেতাম! মন চাইলে সোনা মহাপাত্রের গাওয়া ‘তোরি সুরত কে বলিহারি’ শোনার চেষ্টা করে দেখতে পারেন। সে গান শুনে আমির খুসরো তাঁর পির-এর পায়ের কাছে ছোট্ট দরগাটির চত্বরে চিরনিদ্রা ভেঙে উঠে বসলেও আমি অবাক হব না। আবার বলি, সমালোচনা আমার উদ্দেশ্য নয়, তবে, কেন জানি না মনে হয় যে, সবার গলায় সব জিনিস মানায় না। কাওয়ালিতে একটা প্রথা আছে, যাতে ‘মেহফিল এ সামা’-তে সবাই উপস্থিত থাকতে পারেন, ধনীদরিদ্র নির্বিশেষে। আর ভাল জিনিস শুনে শিখতে তো কোনও মানা নেই। ফলে অনেকেই হয়তো বা খুসরোর ‘রং’-এর মধ্যে নিজের মনের রং মিশিয়ে দিয়ে থাকবেন। কিন্তু, তাতে সেই বৃদ্ধের ওপর যতটা অত্যাচার হয়, ততটা তাঁর প্রাপ্য নয় বলেই আমার মনে হয়েছে।
এথনোমিউজিকোলজি বলে যে বিষয়টি নিয়ে পণ্ডিতেরা গবেষণা করেছেন, সেখানে বলা হয় যে, কাওয়ালিতে ‘উরহানা’ বা পরদ্রব্য বিলকুল আত্মসাৎ করা (যাকে সাদা বাংলায় ঝেপে দেওয়া বললেই সমীচীন হয়), অর্থাৎ কোনও কাওয়ালি শুনে পছন্দ হলে তা নিজের করে নেওয়া একেবারেই আইনসিদ্ধ; তাতে গুনাহ বা গুস্তাকি কিছুই নাই। এমনকী ‘হাথ উঠানা’ (মানে, হাত-পা ছুড়ে গাওয়া), সেও ঠিকঠাক। ‘ক্লাস কি আওয়াজ’ বা শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের তালিম নেওয়া রেওয়াজি গলা হলে যে সুবিধে হয় শিল্পীরই, তারও সাক্ষাৎ প্রমাণ রয়েছে অসংখ্য। রাশিদ খাঁ সাহেবের ‘করম কর দিজে’ তো শুনেইছেন, এমনকী সলামত আলি খাঁ সাহেবের গাওয়া সিন্ধু ভৈরবীতে ‘কলন্দর লাল তে যাওয়া’ বা আভোগী কানাড়ায় ‘লাজ রাখ লিজ মোরি’ শুনলে মাথা ঠিক রাখা মুশকিল, এমনই জবরদস্ত সেই উপস্থাপন।
নিজামুদ্দিনের দরগায় গোসল শরিফের দিনে সারারাত গোলাপজল দিয়ে দরগা ধোওয়া হয়। আর সারারাত ধরে চলতে থাকে কাওয়ালদের লাগাতার হাজরি, একের পরে এক। মেরাজ আহমেদ নিজামিসাব ছিলেন এই ঘরানার দিল্লি অধ্যায়ের শেষ মোহিকান, কাস্টোডিয়ান-ও বটে। ‘অউরও কে ধোয়ে শাল দুশালে মেরি ময়লি চাদরিয়া ধো দে নিজাম’ আমি তাঁর ছাড়া আর কারও গলায় শুনতে রাজি নই। আর মেরাজসাবের পাণ্ডিত্যও সর্বজনবিদিত, দিল্লির ইতিহাসবিদ ও সুফি সঙ্গীতের আলোচকদের কাছে। মেরাজসাবের তিন ছেলেকে আমি চিনি। এঁদের কেউই বাবার কাছে তালিম নেওয়ার চেষ্টা করেননি। ফরিদ আয়াজ সাব ২০১৪ সালে এঁদের করাচি নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন নিজের কাছে রেখে শেখানোর জন্য। সে চেষ্টাও কাজে আসেনি। প্রবৃদ্ধ মেরাজসাব সে কথা শুনে হেসে বলেছিলেন, “ফরিদমিঞা, তুম ক্যা সিখাওগে, মেরে বাদ তো তুমহারি বারি হ্যায়।”
চলে গিয়েছেন মেরাজসাব, তাঁর অপরিসীম জ্ঞানের আমানত সঙ্গে নিয়ে। তার আগে পর্যন্ত, যখনই দেখা হয়েছে, খেয়ে যেতে বলেছেন বাড়িতে। বড় অভাব রেখে গিয়েছেন সংসারে; দরগার কাওয়ালদের মধ্যেও। বিগত দশ মাসে যখনই সুযোগ পেয়েছি, চেষ্টা করেছি পিরজাদা আলতামাশ নিজামির মাধ্যমে তাঁদের পরিবারের পাশে যথাসাধ্য দাঁড়াতে, নিজের ক্ষুদ্র সামর্থ অনুযায়ী। দরগায় ইদানিং কোভিডের দৌলতে কাওয়ালি প্রায় বন্ধই ছিল, গত মাস থেকে ধীরে ধীরে আবার চালু হতে শুরু করেছে মাত্র। কোনও কাওয়াল সবজির ঠেলা ভাড়া নিয়ে সংসার চালাচ্ছেন, কেউ বা অটোচালক হয়ে গিয়েছেন।
এই প্রসঙ্গে আরও একবার জাকি তাজি কাওয়ালের প্রসঙ্গ না-তুললেই নয়। আমার গরিবখানায় একবার জাকি তাজি কাওয়ালের রেকর্ডিং শুনে ফরিদ আয়াজ সাহেব গেস্টহাউস-এ ফিরে তাঁর বড় পুত্রবধূকে ফোনে বলেছিলেন, “আরে বড়ি দুল্হন, অরুণ তেরে বাপ কো সুনতা হ্যায়!” তখন কি ছাই জানি যে, ওঁর বড় ছেলে ঘায়ুর আহমেদের শ্বশুরমশাইই জাকি তাজি! মাসকয়েক হল ফরিদ আয়াজ সাবের ছোট মেয়ে তহজিবের বিয়েও ওই একই পরিবারে হয়েছে! তো, সেইসব আচমকাই আবিষ্কার করে খুবই উত্তেজিত হয়ে আমি ফরিদসাবকে পাকড়ালাম, এখনকার শিল্পীদের খবরাখবর জানার জন্য। উনি হেসে বললেন, “জানো, আমিও একটা ছোটখাট ডিপার্টমেন্টাল স্টোর আর তার লাগোয়া একটা ছোটখাট বিউটি পার্লার খুলে বসেছি আমার পাড়ায়।” আমি তো শুনে হতবাক! ছেলেবেলায় বিভূতিভূষণের আরণ্যক-এ পড়েছিলাম, রাজকন্যা ভানুমতীর সঙ্গে ছোটনাগপুরের মহালিখারূপ পাহাড়ের নীচে সাঁওতালদের গ্রামে গিয়ে সত্যচরণ দেখেছিল “রাজা দোবরু পান্না বীরবর্দি ছাগল চরাইতেছেন”… সত্যি বলছি, ফরিদ সাবের কথা শুনে আমার সেই বাক্যটি মনে পড়ে গেল। আমার হাতের মুঠিতে ধরা একটা ছোট্ট ফোন, যার ওপারে বসে রয়েছেন কাওয়ালির অবিসংবাদী সম্রাট, ঈশ্বরের সঙ্গে যাঁর প্রতিমুহূর্তে একান্ত আলাপচারী চলে, যাঁর গানে সারা পৃথিবী সেই আলাপচারীর ঐশ্বর্য শুনতে পেয়ে পাগল হয়ে যায়, সেই ফরিদ সাব, তিনি পেট চালানোর জন্য বাড়ির সামনে মুদির দোকান দিয়েছেন! বিউটি পার্লার খুলে বসেছেন!
কিন্তু, ওই যে! শিশুর মতো সারল্য, আর ভুবনভোলানো হাসি! সেই হাসিটা হেসে ফরিদ সাব বললেন, “সাচ বতাউঁ অরুণ? পারফর্মার যব আওয়াজ খো দেতা হ্যায়, তব উসকা ক্যা হাশর হোতা হ্যায়?” বিশ্বাস করুন, সে কথা শুনে তর্ক করতে পারিনি সেদিন। এমন অসংখ্য উদাহরণের খবর কি আমি নিজেই জানি না? ফোনের ওপাশ থেকে হাসির আওয়াজের সঙ্গে ভেসে এল, “জানো, কেউ কেউ এক কিলো মসুর ডালের পাশাপাশি আমার সঙ্গে একটা সেলফিও তুলে নিয়ে যায়, প্রায়ই।” সে কথা শুনে আমি ছোট্ট একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস লুকোলাম। এই ভদ্রলোক প্রায় সত্তর বছর বয়েসে দিনের বেলায় দোকানে বসেন, আর সন্ধেবেলা প্রোগ্রাম করেন ‘দুনিয়া খুল জানে কে বাদ’!
সেই একই হাসির রেশ টেনে ফরিদ সাব জানান, এ-মাসের প্রায় প্রতিটি দিনই প্রোগ্রাম রয়েছে। আর তারপরেই ফোনটা তাঁর স্ত্রীর হাতে (‘ভাগ্যবান’ বলে ডাকেন তিনি সাবিহাচাচিকে) ধরিয়ে দেওয়ার আগে অট্টহাস্য করে বলেন, “তুমহারে পাস তো সারে চাচিয়ন কে খবর হ্যায়, হ্যায় না?” আমি আর উচ্চবাচ্য করলাম না, এক-তৃতীয়াংশ বয়েসের মেডিকেল ছাত্রী থেকে অর্ধেক বয়েসের অধ্যাপিকা ইনফ্যাচুয়েশনের চোটে মাঝরাত্তিরে ফেসবুক মেসেনজারে ফোন করে বসলে (মানে ফ্যান ফলোইং আর কী) রাগ করে সাবিহাচাচি যে গোঁসাঘরে খিল দেন না বা বাপের বাড়ি চলে যান না, তা যেমন ফরিদ সাবের পূর্বপুরুষদের মৌসিকির সুকর্মের ফল, তেমনই তাঁর এই কাচের মতো স্বচ্ছ হাসির অতি উচ্চ ডিভিডেন্ডও— যা স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে এমন সহজ যাতায়াতের পথটি পারস্পরিক বিশ্বাস ও সহমর্মিতার মার্বেল পাথরে বাঁধিয়ে রেখেছে।
এই হচ্ছেন ফরিদ সাব। তিনি ফকিরি প্র্যাকটিস করে কনকনে ঠান্ডা হোটেলের ঘরে খালি গায়ে বসে থাকতে পারেন ঘন্টার পর ঘন্টা, আজও যে কোনও নতুন সুর বা গান মুহূর্তে শিখে ফেলতে পারেন অনায়াসে, এবং একইসঙ্গে ছাত্রস্থানীয়দের সঙ্গে হালকা রসের আলোচনাতেও কম যান না কোনওভাবেই। কিন্তু, যাবতীয় ঠাট্টা-রঙ্গরসিকতার মধ্যেও শ্রদ্ধার বোধটি মোমের শিখজার মতো অনির্বাণ জ্বলতে থাকে সারাক্ষণ।
একবার আমার ফোন থেকে পণ্ডিত চন্নুলাল মিশ্রজি-র গাওয়া কিছু গান ওঁকে শুনিয়ে গানগুলির ক্লিপ পাঠিয়ে দিয়েছিলাম। উনি শুনে অভিভূত হয়ে সঙ্গে সঙ্গে ফোন করে বসলেন। “অরুণ, একবার পণ্ডিতজি সে মিলকে উনকো মেরে সালাম জরুর বোলনা, অর কহনা কে ইয়ে এক বহোত সুরিলা ইনসান কো এক থোড়ে কম সুরিলে ইনসান কা নমন।” বলা বাহুল্য, পণ্ডিতজিকে আমি এই বার্তাটি পৌঁছে দিয়েছিলাম, মুহাফিজ হিসেবে। এখনও মাঝেমধ্যেই খবর নেন ফরিদ সাব, চমনলালজি (মানুষের নাম ভুলে যাওয়ার এই এক অদ্ভুত ম্যালাপ্রপিজম আছে বটে ফরিদ সাবের) কা খৈরিয়ৎ জানতে চেয়ে। পণ্ডিতজির কন্যা নম্রতা মিশ্র বাবার হয়ে ফোন তুলে কুশলসংবাদ জানান কাশী থেকে, আর আমি তা রিলে করে পাঠাই করাচিতে। সে খবর শোনার পরে একবার ফরিদ সাবকে আমি ফোনে স্পষ্ট গুনগুন করতে শুনেছিলাম পণ্ডিতজির বিখ্যাত ‘নন্দ ঘর বাজে বাধাইয়া, কাহাওআ কানহাইয়া কো জনম ভায়ো হ্যায়, কাহাওয়া বাজে বাধাইয়া’, একদম নিখুঁত নোটে, যাকে বলে ‘একটাও বাইরে পড়েনি’।
লোকে যখন আমায় সৌহার্দের গল্প শোনান, আমি বলি, আমি ফরিদ সাবকে দেখেছি মানুষকে কীভাবে সম্মান করতে হয়। এ এক এমন সৌহার্দ, যার সামনে তিন ভুবনের সব দূরত্ব নিমেষে মুছে যায়!
(চলবে)
এ সফর সুফিয়ানা-র সব কটি পর্বের জন্য ক্লিক করুন: এ সফর সুফিয়ানা – অরুণপ্রকাশ রায়