হিমাদ্রি ঘোষ
লেখক পেশায় সাংবাদিক
মিডিয়া বা সংবাদমাধ্যম সমাজের আয়না হিসেবে নিজের ভূমিকা পালন করবে, তার কাছে এটাই প্রত্যাশিত। মিডিয়ার একটিই কাজ— যে ঘটনাটা ঘটছে সেটা ঠিকঠাক তুলে ধরো, এবং সত্যি কথাটা তোমার দেশের মানুষকে জানাও। কিন্তু, এ কথা অস্বীকার করার কোনও জায়গা নেই— তাদের যেটা প্রধান দায়িত্ব ছিল সেটা পালন করতে ভারতীয় সংবাদমাধ্যম সার্বিকভাবে ব্যর্থ হয়েছে।
এখানে উল্লেখ করে রাখা দরকার, রাষ্ট্র বহুদিন ধরেই নিজস্ব নিয়ন্ত্রণব্যবস্থাকে ব্যবহার করে সংবাদমাধ্যমকে নিজের পক্ষে রাখার ব্যাপক চেষ্টা চালিয়ে এসেছে, যাতে সংবাদমাধ্যম কেবল সেই তথ্যই জানায় যা রাষ্ট্রের পক্ষে সুবিধেজনক। এভাবে রাষ্ট্র চেয়েছে যে কোনও প্রশ্ন, বিরুদ্ধ স্বর ও বিরোধিতার কণ্ঠ সমূলে রোধ করতে। আর এভাবেই, সংবাদমাধ্যম সমাজের আয়না না-হয়ে কার্যত রাষ্ট্রের বক্তব্যেরই প্রতিধ্বনি করার যন্ত্র হয়ে উঠেছে। এবং, এ ঘটনা যে আজকেই নতুন ঘটছে, তা নয়— অভিজ্ঞতা থেকে আমরা জানি, এ ঘটনা ঘটে আসছে বহু বছর ধরেই।
অবশ্য গত ছ বছর ধরে, আরও সঠিকভাবে বলতে গেলে গত দেড় বছর ধরে, মিডিয়ার ওপর রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণবাদী ও কর্তৃত্ববাদী চেহারাটা আমরা বারবারই খুব প্রকাশ্যভাবে দেখতে পাচ্ছি। উলটোদিকে মিডিয়াও যেন উত্তরোত্তর আরও বেশি করে রাষ্ট্রের অনুগত তল্পিবাহকের ভূমিকায় নিজেকে মানিয়ে নিয়েছে— হয়ে দাঁড়িয়েছে প্রশ্নাতীত আনুগত্যের পরাকাষ্ঠাবিশেষ। এবং, যেটা আমাদের নজর এড়াচ্ছে না তা হল, এই অনুগত আজ্ঞাবহের ভূমিকা পালন করতে গিয়ে বারবারই মিডিয়া সামনে এনেছে জাতীয় স্বার্থের প্রশ্নটি— লজ্জাজনক হলেও স্বীকার করে নেওয়া ভাল, জাতীয়তাবাদের নগ্ন অজুহাতকে মিডিয়া এক সুবিধেজনক ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে চলেছে।
বৈদ্যুতিন সংবাদমাধ্যম, আরও ঠিকভাবে বলতে গেলে টিভি সাংবাদিকতা, গত কয়েক বছরে এক অন্ধকার গহ্বরে ঢুকে পড়েছে। সে এমন এক গহ্বর, যেখানে রাষ্ট্র তাকে প্রতিনিয়ত ব্যবহার করে চলেছে সাধারণ মানুষকে দৈনন্দিন বাস্তবতা থেকে যেন তেন প্রকারেণ দূরে সরিয়ে রাখতে। রাষ্ট্রের দাসত্ব করতে গিয়ে মিডিয়া ভুলেই গিয়েছে যে, তার কাজ আসলে ছিল ঠিক তার উলটো— মানুষকে সেই বাস্তবতা ও তার নিজের চারপাশ সম্পর্কে যথাযথ অবহিত করা।
রিপাবলিক টিভি-র কর্ণধার অর্ণব গোস্বামীর সাংবাদিকতার যে ঘরানা, সেটিকে উদাহরণ হিসেবে সামনে রাখলে বিষয়টা আরও পরিষ্কার হবে। অর্ণব সাংবাদিকতার যে ঘরানায় বিশ্বাস করেন সেটি এই নয়া সাংবাদিকতার মডেলটিকে বুঝতে সাহায্য করে। এই ধারার সাংবাদিকতার মোদ্দা কথাই হল, বিরোধী রাজনৈতিক শক্তিগুলিকে প্রশ্ন করো আর শাসকদলকে যাবতীয় প্রশ্নের হাত থেকে রেহাই দাও। অথচ, ঘটনা হল, সাংবাদিকতার যে চিরাচরিত প্রথা, তা আমাদের ঠিক এর উলটো পদ্ধতি অনুসরণ করতে শিখিয়েছে। সেখানে সাংবাদিকতার প্রধান ও প্রাথমিকতম চালিকাশক্তিই ছিল ক্ষমতার কেন্দ্রকে প্রশ্ন করা। অর্থাৎ, খুব সংক্ষেপে বলতে গেলে, সাংবাদিকতার এই নয়া ঘরানা ধ্রুপদী সাংবাদিকতার মৌলিক ভিত্তিভূমিটিকেই আগাগোড়া উলটে দিয়েছে।
সপ্তাহকয়েক আগে, টেলিভিশন রেটিং-সংক্রান্ত মামলার তদন্ত করতে গিয়ে মুম্বাই পুলিশ যে তথ্যপ্রমাণ খুঁজে পেয়েছে তা এককথায় অবিশ্বাস্য। পাঠকের মনে থাকবে, ওই মামলায় জড়িত সন্দেহে অভিযুক্তদের তালিকায় রয়েছেন অর্ণব গোস্বামী স্বয়ং। ওই মামলার তদন্তকারী অফিসার খুঁজে পেয়েছেন অর্ণবের সঙ্গে বার্ক-এর (BARC) ভূতপূর্ব সিইও পার্থ দাশগুপ্তর প্রায় ৫০০ পাতার দীর্ঘ হোয়াট্স্যাপ বার্তালাপ। সেই বার্তালাপে এমন সব বিষয়ে আলোচনা রয়েছে, যা চমকিয়ে দেওয়ার পক্ষে যথেষ্ট। আলোচ্য হোয়াট্স্যাপ বার্তাটি যদি সত্যি প্রমাণিত হয়, তা হলে মেনে নিতে হয় পুলওয়ামায় সন্ত্রাসবাদী হামলা, বালাকোটে ভারতীয় বিমানবাহিনির আক্রমণ, সংবিধানের ৩৭০ ধারার অবলুপ্তি এবং কেন্দ্রীয় সরকারের আরও বহু গুরুত্বপূর্ণ এবং অতি গোপনীয় সিদ্ধান্তের বিষয়ে অর্ণব আগে থেকেই ওয়াকিবহাল ছিলেন। এখানে যে প্রশ্নটা সবার আগে মাথায় আসে – একটি বেসরকারি টিভি চ্যানেলের প্রধান সম্পাদকের পক্ষে কীভাবে পুলওয়ামা বা বালাকোটের ঘটনার মতো এত স্পর্শকাতর বিষয়ে আগাম তথ্য পাওয়া সম্ভব? নাকি ধরে নিতে হবে, সরকারি গোপন তথ্য ফাঁস হয়ে যাওয়া ইদানিং আর অফিশিয়াল সিক্রেট্স অ্যাক্ট-এর সীমা লঙ্ঘন করছে না?
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবীদের মধ্যে অন্যতম পরিচিত মুখ প্রশান্ত ভূষণ সম্প্রতি বলেছেন, “মনে হচ্ছে অর্ণব, কেন্দ্রীয় সরকার এবং সর্বোপরি প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং নিজেদের মধ্যে এমন কোনও গোপন যোগসূত্র গড়ে তুলেছিলেন যা উভয়পক্ষকেই সহায়তা করেছে— টিআরপি বাড়ানোর লক্ষ্যে, এবং সরকারের রাজনৈতিক স্বার্থ চরিতার্থ করতে।” [“He (Arnab) and the government and the prime minister in particular formed a cosy club which served both to increase his TRPs whilst promoting the government’s political interests.”] প্রশান্ত ভূষণ আরও বলেছেন, “এটা খুবই পরিষ্কার যে, কোনও গোপন বোঝাপড়া অবশ্যই ছিল, যা গোস্বামীর চ্যানেলের আর্থিক স্বার্থ পূরণ করেছে, এবং অন্যদিকে সরকারের রাজনৈতিক উদ্দেশ্যও পূরণ করেছে। বলা যেতে পারে, গোস্বামীর চ্যানেলকে ব্যবহার করেই সরকার নিজের রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধি করেছে, এবং তার বিনিময়ে সরকার ওই চ্যানেলের আর্থিক স্বার্থরক্ষা করেছে।” [“There was clearly a cosy club in existence whereby Goswami’s channel’s commercial interests were promoted at the same time as the government’s political interests. His channel was being used to promote the political interest of the government and, in turn, the government was promoting his commercial interests.”]
এ অভিযোগ যদি সত্যি হয়, তা হলে তার চেয়ে দুর্ভাগ্যজনক ও দুঃখের আর কিছু হতে পারে না। আরও বেশি দুর্ভাগ্যের বিষয় হল, এ পর্যন্ত কোনও সংবাদমাধ্যমকে সরাসরি এই প্রশ্নগুলি তুলতে দেখা যায়নি। কোনও নিউজ চ্যানেল এ বিষয়ে কোনও লাইভ বিতর্ক আয়োজন করেনি। এমন একটি বিষয় যেখানে দেশের প্রধানমন্ত্রীর দফতর সরাসরি প্রশ্নের মুখে, তা নিয়ে দেশের কোনও বড় সংবাদমাধ্যমে প্রায় কোনও কথাই নেই, এ কি বিস্ময়কর নয়? এখানেই তৈরি হয়ে উঠছে পরের প্রশ্নটি। তা হল, আমরা ইদানিং যে ধরনের সাংবাদিকতার ঘরানায় অভ্যস্ত হয়ে উঠেছি তাতে এই তথাকথিত নৈঃশব্দ আদৌ খুব অপ্রত্যাশিত ছিল কি?
কেন এই নৈঃশব্দ তা এতই দিনের আলোর মতো পরিষ্কার যে, খুলে বলারও প্রয়োজন নেই। ইদানিং সাংবাদিকতার দুনিয়া শাসন করছে বৃহৎ কর্পোরেট ও পরিবার-কেন্দ্রিক মিডিয়া ব্যবসায়ীরা। কেবল রিলায়েন্স ইন্ডাস্ট্রিজ গোষ্ঠীরই হাতে রয়েছে অন্তত ২৪টি নিউজ চ্যানেলের সিংহভাগ শেয়ার, এবিপি গ্রুপের হাতে রয়েছে ২২টি সংবাদ-প্রকাশনা, ইন্ডিয়া টুডে গ্রুপের হাতে টিভি, প্রিন্ট ও অনলাইন মিলিয়ে ১২টি, জাগরণ প্রকাশন-এর হাতে প্রিন্ট ও রেডিও মিলিয়ে মোট আটটি। মিডিয়াতে কর্পোরেট পুঁজির অতিসন্নিবেশের এই যদি হয় চালচিত্র, তারপরেও প্রশ্ন করবেন, কেন কোত্থাও কোনও প্রশ্ন উঠছে না?
মানতে কোনও দ্বিধা নেই, সারা বিশ্বের বৃহত্তম মিডিয়া-বাজারগুলির অন্যতম এই ভারতবর্ষ। কিন্তু, হাতে গোণা কয়েকটি পরিবার বা বৃহৎ ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর পুঁজি যেভাবে এই ব্যবসায় পুঞ্জীভূত হয়ে রয়েছে, তা থেকেই এ দেশে সাংবাদিকতার চরিত্র স্পষ্ট হয়ে আসে। এরই সঙ্গে, মাথায় রাখতে হবে, বিশাল মিডিয়া ব্যবসা ছাড়াও আরও নানা ধরনের ব্যবসায়, বিশেষত রিয়েল এস্টেট ব্যবসাতে, বিপুল পুঁজির লগ্নি রয়েছে মুষ্টিমেয় এই কয়েকটি পরিবারের। এবং যেটা সবচেয়ে উদ্বেগের— নিজেদের বাণিজ্যিক স্বার্থ সুরক্ষিত রাখার উদ্দেশ্যে তারা ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে গা ঘষাঘষি চালায় প্রকাশ্যেই। এতে দু’তরফেরই সুবিধে— এভাবে একদিকে যেমন কর্পোরেটের ব্যবসায়িক শ্রীবৃদ্ধি সুনিশ্চিত হয়, অন্যদিকে সরকার তার অ্যাজেন্ডা প্রচার করে চলে কর্পোরেটের হাতে থাকা মিডিয়া চ্যানেলের সৌজন্যে।
একটু খেয়াল করলেই দেখবেন, এই কর্পোরেট-নিয়ন্ত্রিত মিডিয়ার সাংবাদিকরা (যদি অবশ্য এঁদের এখনও সাংবাদিক বলে ডাকা যায়) ইদানিং একেবারে সরকারের ভাষায় কথা বলা শুরু করেছেন। এর অর্থ পরিষ্কার। প্রভুরা তাঁদের যে ভাষায় কথা বলতে শেখাচ্ছেন, তাঁরা হুবহু সেই ভাষাটাই শিখছেন। এবং, সরকারের ভাষায় কথা বলতে গিয়ে, নিজেদের আর্থিক স্বার্থ সুরক্ষিত রাখতে গিয়ে এমনকী নিজের পেশার অন্যান্য সাংবাদিককেও এঁরা রেয়াত করছেন না।
আপনারা আমার সঙ্গে একমত হবেন কি না জানি না, কিন্তু আমার মনে হয় এই গোটা সিস্টেমটাই একেবারে এক সর্বগ্রাসী নৈতিক দেউলিয়াপনার মুখে এসে দাঁড়িয়েছে। একদিকে বাজারের চাপ, ও অন্যদিকে অত্যাচারী সরকারের শাসনযন্ত্র আজকের মিডিয়া ইকো-সিস্টেমকে আক্ষরিক অর্থেই এক শ্বাসরোধী অবস্থার দিকে ঠেলে দিয়েছে— সামান্য আত্মসম্মানবোধ ও নৈতিক মূল্যবোধ রয়েছে এমন কারও পক্ষেই টিকে থাকার পক্ষে এ এক অবাঞ্ছিত, অনভিপ্রেত পরিবেশের নামান্তর।
যে কথা একটু আগেও বলছিলাম, ইদানিং দেখা যাচ্ছে সাংবাদিকরা রেটিং ও রিডারশিপ (কিংবা ভিউয়ারশিপ) বাড়াতে যে কোনও অনৈতিক পথ বেছে নিতে বিন্দুমাত্রও দ্বিধাবোধ করছেন না— অর্ধসত্য, অসত্য এমনকী স্রেফ বিনোদনকেও খবরের বিষয়বস্তু বানিয়ে তোলা হচ্ছে নির্দ্বিধায়। আবারও অর্ণবের উদাহরণ দিয়েই বলি, তিনি সম্ভবত ভারতীয় সাংবাদিকতার জগতে অন্যতম প্রথম ব্যক্তি যিনি বুঝতে পেরেছিলেন ভারতীয় মধ্যবিত্ত শ্রেণি চরিত্রগতভাবেই জটিল সমস্যার সরল ও চটজলদি সমাধান আশা করে। এই তত্ত্বকে তিনি অত্যন্ত সফলভাবে তাঁর প্রোগ্রাম ডিজাইনিং-এর ক্ষেত্রে কাজে লাগিয়েছেন। এবং কে না জানে, পাবলিক সেন্টিমেন্টে সুড়সুড়ি দেওয়ার পক্ষে সস্তার জাতীয়তাবাদ ও ধর্মীয় মৌলবাদের চেয়ে সফল এবং সুলভ টোটকা আর কিছু হতে পারে না। অতএব, তিনি সেই রাস্তাই নিলেন। এবং, তাঁর দেখাদেখি, আরও অনেকেই একই পথ ধরলেন। ফল যেটা হল, যে কোনও ডিবেটেই জাতীয়তাবাদের একটা অ্যাঙ্গল আমদানি করা হতে লাগল, এবং নিজেদের দর্শক (ক্যাপ্টিভ অডিয়েন্স) ধরে রাখার ব্যাপারটাও সুনিশ্চিত করা হতে লাগল।
এরই পাশাপাশি, মিডিয়া ইন্ডাস্ট্রি-তে আরও এক শ্রেণির সাংবাদিক আছেন, যাঁরা প্রায়ই নিজেদের এক পেশাদার ও বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতার মুখোশের আড়ালে রাখতে পছন্দ করেন। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে তাঁরাও ঠিক সেই কাজটাই করেন, যেটা করে থাকেন অর্ণব গোস্বামীর মতো সাংবাদিকেরা। তথাকথিত এক গম্ভীর ও বুদ্ধিজীবীসুলভ ভাবমূর্তির আড়ালে এঁরা প্রত্যেকেই এক-একজন ছদ্ম-অর্ণব, এবং এই আপাত-বিশ্বাসযোগ্য মুখোশের কারণেই, অনেক বেশি অবিশ্বাসযোগ্য ও বিপজ্জনক।
উলটোদিকে, গত পাঁচ-সাত বছরে আমরা বেশ কিছু স্বাধীন মিডিয়া হাউসের আবির্ভাব দেখতে পেয়েছি। তারা স্বাধীনভাবে, সাহসিকতার সঙ্গে তথ্যনিষ্ঠ সংবাদ-সংগ্রহ ও পরিবেশনের চেষ্টা করছে। কিন্তু, স্বীকার করতেই হবে, এদেরও নানা সীমাবদ্ধতা রয়েছে। প্রথমটি হল, এই সব স্বাধীন মিডিয়া হাউসগুলির অধিকাংশই ডিজিট্যাল— ওয়েবসাইট-নির্ভর, ফলে তাদের নাগালও (মিডিয়ার ভাষায় যাকে বলে ‘রিচ’) অতি সীমিত। দ্বিতীয়ত, এদের অধিকাংশই এখনও পর্যন্ত কেবল ইংরেজি ভাষাতেই সীমাবদ্ধ— ফলে এদের সাংবাদিকতা এখনও সমাজের একটি স্বল্পসংখ্যক পাঠকবৃত্তেই আটকে রয়েছে। অর্থাৎ, শহরের বাইরে, প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে খবরের যে বিশালসংখ্যক উপভোক্তামণ্ডলী রয়েছে, এই ওয়েব-নির্ভর মিডিয়া তাঁদের কাছে পৌঁছতেই পারে না। একেবারে হালে অবশ্য এর পরিবর্তন ঘটছে, বেশ কিছু ওয়েব-পাবলিকেশন একাধিক ভাষায় খবর পরিবেশনের দিকে নজর দিতে শুরু করেছে।
এসব অতি অবশ্যই খুবই আশাব্যঞ্জক কথা, কিন্তু স্বীকার না-করে উপায় নেই— এদের প্রায় কারওই এখনও পর্যন্ত শক্তপোক্ত কোনও অর্থনৈতিক শক্তি গড়ে ওঠেনি। এদের না আছে কোনও পরীক্ষিত বিজনেস মডেল, না আছে রেভিনিউ উৎপাদনের কোনও ব্যবস্থা। প্রায় সবক’টি ওয়েব-পাবলিকেশনই এখনও চলে পাঠক ও দর্শকদের অনুদানে। ফলে, সহজবোধ্য কারণেই এইসব প্রকাশনার সাংবাদিকদের মাইনে অত্যন্ত কম— এবং ফলত আদ্যন্ত একটি পুঁজিবাদী মিডিয়া-পরিবেশে এই প্রকাশনাগুলির পক্ষে দীর্ঘমেয়াদে কাজ চালিয়ে যাওয়াও অতি দুরূহ। কেবলমাত্র সৎ অভিপ্রায় দিয়ে তো আর প্রতিযোগিতার বাজারে টিকে থাকা যায় না!
তদুপরি, এই তথাকথিত ‘অবাধ্য’ ও লক্ষ্মণরেখা না-মানা ‘বেয়াদব’ মিডিয়াকে সবক শেখাতে সরকারি শাসনযন্ত্র প্রতিনিয়ত আপ্রাণ চেষ্টায় কোনও খামতি রাখছে না। শাসকদলের ন্যারেটিভ-এর প্রতিধ্বনি না-করার শাস্তি হিসেবে তাদের বিরুদ্ধে যখন-খুশি মিথ্যে মামলা সাজানো হচ্ছে, সাংবাদিকদের ধরে অকারণে জেলে পুরে দেওয়া হচ্ছে। এ লেখা যখন লিখছি তার মাত্রই কয়েকদিন আগে দিল্লি-হরিয়ানার সিংঘু সীমানায় কৃষক-আন্দোলনের খবর করার কারণে দু’জন ফ্রিলান্স সাংবাদিককে গ্রেফতার করেছে দিল্লি পুলিশ। সাংবাদিকদের অপরাধ? তাঁরা এমন সত্য সরবরাহ করছিলেন যা সরকার আমজনতাকে দেখাতে চায় না। শুধু ওই দুই সাংবাদিকই নন, বেশ কয়েকজন সম্পাদক, যাঁরা সরকারের হ্যাঁ-তে হ্যাঁ মেলাতে রাজি হননি, তাঁদের বিরুদ্ধেও এফআইআর রুজু করেছে দিল্লি পুলিশ।
সরকারের দেওয়া তথ্য অনুযায়ীই, ২০১৪ সাল থেকে এ পর্যন্ত গত ছ’বছরে মোট ৪০জন সাংবাদিককে খুন হতে হয়েছে, আহত হয়েছেন ২০০-রও বেশি। বেসরকারি হিসেবে সংখ্যাটা আরও অনেক বেশি। তাঁদের অধিকাংশই স্রেফ ‘হারিয়ে’ বা ‘গুমখুন’ হয়ে গিয়েছেন। ভারত যে সাংবাদিকদের পক্ষে রীতিমত বিপজ্জনক দেশ, এ আর এখন কোনও গোপন তথ্য নয়।
ক্ষমতায় যাঁরা রয়েছেন তাঁরা সহজবোধ্য কারণেই চান এ কথা জানিয়ে দিতে যে, যাঁরা তাঁদের বিরুদ্ধে যাবেন তাঁদের চড়া মূল্য চোকাতে হবে। কিন্তু, এত প্রকাশ্য ও নগ্ন হুঁশিয়ারির পরেও যে এক বিশালসংখ্যক সাংবাদিক, অতি কম মাইনেয় কাজ করতে বাধ্য হওয়া সত্ত্বেও, সব অসুবিধে ও অশান্তির আশঙ্কা তুচ্ছ করে নির্ভীক সাংবাদিকতার পথ বেছে নিচ্ছেন— আমার কাছে সেটাই আপাতত সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ ব্যাপার। সত্যি কথা বলার জন্য কোনও-কোনও মানুষ যে কত বড় দাম দিতে রাজি থাকে, এ তার মস্ত বড় প্রমাণ।
তবু, আপনি যদি আমায় জিজ্ঞেস করেন গোটা বিষয়টা তা হলে কী দাঁড়াল, বলব, ভারতীয় সাংবাদমাধ্যমের একটা মস্ত বড় অংশ অতি সুকৌশলে নিজেদের মোদি সরকারের ২৪ ঘণ্টার প্রোপাগান্ডা মেশিনারির জায়গায় নিয়ে গিয়েছে; রাষ্ট্র ও মিডিয়ার গোপন বিয়ে জনমতকে ভোটে জেতার অস্ত্র ও বিরুদ্ধ মতের মানুষদের বিরুদ্ধে গণ-হিস্টিরিয়াকে উস্কানি দেওয়ার কাজ অত্যন্ত সাফল্যের সঙ্গে সম্পাদন করে ফেলতে পেরেছে। এবং, শেষত, আমরা এই মুহূর্তে আমরা এমন একটা সমাজবাস্তবতার মধ্যে গলা অবধি ডুবে আছি যেখানে চারপাশে ক্রমাগত ঘুলিয়ে উঠছে তথ্যের সফেন সমুদ্র, যে তথ্যপুঞ্জের সামান্যই সত্য, অধিকাংশই মিথ্যে – স্রেফ বানিয়ে তোলা। সত্যিই, চারপাশে এত বিপুল পরিমাণে মিথ্যে ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত সংবাদ ইদানিং ঘনীভূত হয়ে উঠছে যে, এমন সময় শিগগিরই আসবে যখন আমাদের সামনে সংবাদ বলে আর কিছু আদৌ থাকবে না, কিংবা হয়তো কেবল এমন সংবাদই থাকবে যার বিন্দুমাত্রও বিশ্বাসযোগ্য নয়। তাই, আপনাদের কাছে আমার একটাই পরামর্শ— নিজেই নিজের ফ্যাক্ট-চেকার হয়ে উঠুন। হয়ে উঠুন স্বাধীন চিন্তক। হয়ে উঠুন ওপিনিয়ন-লিডার।
শেষ করতে গিয়ে জর্জ অরওয়েল-এর একটি বিখ্যাত কথা ফের একবার মনে পড়ে যাচ্ছে। তিনি বলেছিলেন, ‘“সংবাদপত্রের স্বাধীনতা’ কথাটির সত্যিই যদি কোনও মানে থেকে থাকে, তা হলে সেই মানে হল সমালোচনা ও বিরুদ্ধতা করার অধিকার।”
আর সব শেষে সরকারের জন্য একটি ছোট্ট পরামর্শ— মুক্ত কণ্ঠকে বন্দি করতে পারে, এমন কোনও কারাপ্রাচীর কোথাও নেই। সরকার এ চেতাবনি স্মরণে রাখলে ভাল করবেন।