সুশীতল
রাজনৈতিক ভাষ্যকার
বিজেপি বনাম তৃণমূল। ২০১৯ লোকসভা ভোটের ফলাফল প্রকাশের সময় থেকেই বাংলার রাজনীতিতে এই বাইনারি তৈরি হয়ে গেছে। মিডিয়াপ্রতর্কে, দুটি দলের ঘাত-প্রতিঘাতে ও ভোটারদের প্রতিক্রিয়ায়। অন্যান্য সংসদীয় দলগুলিও এই মেরুকরণের অংশ হয়ে গেছে। সিপিএম এককালের ‘আধা-ফ্যাসিস্ট’ কংগ্রেসের সঙ্গে ২০১৬ সালের মতো এবারও জোট বেঁধেছে রাজ্যের শাসকদলের বিরুদ্ধে। বিজেপি ২০১৯-এ বামফ্রন্টের ভোটের ২৩ শতাংশ নিজেদের দিকে টেনে নিয়ে আপাতত একের পর তৃণমূল বিধায়ক ও সাংসদকে নিজেদের দিকে টেনে নিচ্ছে (কয়েকজন সিপিএমের পৌরপ্রতিনিধি ও সাংসদকেও টেনে নিয়েছে)। তৃণমূলের অভিযোগ বিজেপি+সিপিএম+কংগ্রেস, সিপিএমের অভিযোগ বিজেপি+তৃণমূল। আরেসেসের দীর্ঘদিনের মতাদর্শগত নিয়ন্ত্রণে ও সম্প্রতি গোবলয়ের রাজনৈতিক সংস্কৃতি আমদানি করে বিজেপি পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতির শিরোনাম দখল করেছে অনেকদিনই। দেশজুড়ে একের পর এক মানবতাবিরোধী আইনকানুন বলবৎ করে রাজ্যে সাম্প্রদায়িক বিভাজননীতি (হিন্দুদের ধর্মাভিমান উসকে দেওয়া) ও ‘আর নয় অন্যায়’-এর স্লোগান সামনে রেখে ক্ষমতাদখল করতে চাইছে তারা। তৃণমূল বিজেপিকে মূল শত্রু চিহ্নিত করেছে, সিপিএম-কংগ্রেস বাংলায় তৃণমূলকে মূল শত্রু চিহ্নিত করেছে ও বিজেপিকে রোখার কথা বলছে, বিজেপি তৃণমূলকে মূল শত্রু চিহ্নিত করেছে, সিপিআই (এম-এল লিবারেশন) বিজেপিকে মূল শত্রু চিহ্নিত করেছে ও তৃণমূলের বিরোধিতাও করছে এবং ‘বিজেপিকে একটিও ভোট নয়’ সংগঠনটি প্রচার করছে যাতে বিজেপিকে একটাও ভোট না দেন মানুষ— পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা নির্বাচন ঘিরে সংসদীয় দলগুলির এই হচ্ছে অবস্থান।
১১ তারিখের মিছিল ছিল ছাত্রছাত্রীযুবদের। ১০টি বামপন্থী ছাত্রছাত্রীযুব সংগঠন ‘নবান্ন অভিযানের’ ডাক দিয়েছিল। রাজ্য সরকারের কাছে দাবি ছিল কর্মসংস্থান, সরকারি চাকরিতে নিয়োগের স্বচ্ছতা এবং দাবি ছিল করোনার জন্য বন্ধ স্কুল-কলেজ অবিলম্বে খোলার। এই সংগঠনগুলির সদস্যরা মিছিল করে যাচ্ছিল নবান্ন অভিমুখে। পথে পুলিশ ব্যারিকেড দিয়ে তাদের পথ আটকায়। সদস্যরা ব্যারিকেড ভেঙে এগোতে চাইলে তাদের বলপ্রয়োগ করে আটকাতে চায় পুলিশ, জলকামান ও টিয়ার গ্যাস ছোঁড়া হয় পুলিশের তরফে। তাতেও বিক্ষুব্ধরা পরাস্ত না হলে পুলিশের লাঠির বাড়ি নেমে আসে তাদের ওপরে। বহুজন আহত হয়। এই ঘটনায় বা ঘটনার বর্ণনায় অত্যাশ্চর্য কিছু নেই। ক্ষমতা হস্তান্তরোত্তর পশ্চিমবঙ্গে এই দাবিগুলি (যদিও করোনার জন্যে বন্ধ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার দাবিটি বিশিষ্ট ও সময়োপযোগী) বারবার উঠেছে, মিছিল-বিক্ষোভ-আন্দোলন হয়েছে। পঞ্চাশ-ষাটের দশকে ট্রামভাড়া বা বাসভাড়া ক পয়সা বাড়ানোর বিরুদ্ধে সংগঠিত জনক্ষোভ আছড়ে পড়েছে। কংগ্রেস, সিপিএম, তৃণমূল— প্রত্যেক সরকারের আমলেই বিরোধীরা বিশেষত ছাত্রছাত্রীযুবরা মিছিল করেছে, বামফ্রন্ট আমল পর্যন্ত মহাকরণ অভিযানের ডাক আর তৃণমূল আমলে মহাকরণের বদলে নবান্ন। পুলিশ আন্দোলনকারীদের সুনজরে দেখেনি, মিছিলে টিয়ার গ্যাস বা লাঠি চালিয়েছে— আহত হয়েছে অনেকেই। পুলিশ বরাবরই শাসকদাস; আজ্ঞাবহের মতো আঁটি বেঁধে বিক্ষোভকারী ‘অ-বাধ্য’ ছাত্রছাত্রীদের পেটানোই তাদের কাজ। ‘শান্তি বজায় রাখা’র অজুহাতে রক্ত ঝরাতেই যে তাঁরা বেতন পান, তা ব্রিটিশ আমল থেকে এখনও অবধি প্রমাণিত সত্য। এই বিষয়ে এক রাজনৈতিক নিবন্ধকারের আলোচনাও দেখেছি এই কাগজেই (ফ্যাসিস্ট বনাম মানুষ)। কিন্তু, ১১ই ফেব্রুয়ারি ছাত্রছাত্রীদের ওপরে অমানবিক পুলিশোচিত লাঠিচালনা কিছু তাৎপর্য বহন করে ২০২১ বিধানসভা নির্বাচনাবহে।
##
অক্টোবরের শুরুতে বিজেপি নবান্ন অভিযান করে পেশীশক্তির পরিচয় দিতে চেয়েছিল। অক্টোবর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত তৃণমূলের বেশ কয়েকজন প্রভাবশালী সাংসদ-বিধায়ক ‘অনুগামীবাহিনী’ সহ বিজেপিতে যোগ দিয়েছে। বিজেপি এখনও অবধি পশ্চিমবঙ্গে বিকল্প উন্নয়ন মডেল দিতে পারেনি, বিভিন্ন কেন্দ্রীয় প্রকল্পের কুমিরছানা দেখিয়ে যাচ্ছে ও ‘আর নয় অন্যায়’ বলে যাচ্ছে। তৃণমূলের সাংসদ-বিধায়ক কিনে নেওয়া অর্থবল-ক্ষমতা প্রদর্শন হতে পারে কিন্তু মতাদর্শগত উন্নয়ন-মডেল কখনোই নয়। সিপিএম, যারা ১৯৭৭-২০১১ পশ্চিমবঙ্গের ক্ষমতাস্বাদ ভোগ করেছে ও ২০১৬ বিধানসভার আগে পর্যন্ত প্রধান বিরোধীদল ছিল, নির্বাচনই ছিল যাদের একমাত্র শ্রেণিনীতি, তারা ক্রমেই ‘ভোট মেশিনারি’ খুইয়ে খুইয়ে চতুর্থ স্থানে চলে গেছে (তৃতীয় স্থানে কংগ্রেস)। এই বিধানসভা নির্বাচনের আগে এখনও পর্যন্ত তারা তৃণমূলের বিরোধিতা ছাড়া (অবশ্যই সে বিরোধিতা ন্যায্য) কোনও বিকল্প উন্নয়ন মডেলের রূপরেখা দিতে পারেনি। শ্রেণি-মতাদর্শগত অবস্থান থেকে নির্ভরযোগ্য দৃঢ়ভিত্তি তৈরি করতে পারেনি এবং মানুষের আস্থা পুনরুদ্ধার করতেও পারেনি। ২০১৮ পঞ্চায়েত নির্বাচনে তৃণমূল যখন ‘নির্বাচন=প্রহসন’ ক’রে তুলেছিল কিংবা সমস্ত বিরোধীকণ্ঠ রুদ্ধ করে রেখেছিল, তখন কমিউনিস্ট পার্টির যেটুকু প্রতিরোধী দায়িত্বপালন প্রয়োজন, সিপিএম তা করেনি (তাদের স্বঘোষিত ‘রেজিমেন্টেড পার্টি’ তকমা এক্ষেত্রে প্রশ্নের মুখে পড়তে বাধ্য)। একদিকে সংসদীয় মুখরক্ষার দায় অন্যদিকে শ্রেণিভিত্তি থেকে আরও দূরে সরে যাওয়ার জন্যে। রাজনীতিতেও ‘শূন্য’স্থান থাকে না। বিজেপি সেই শূন্যতা পূরণে দ্রুত তিনটি পদক্ষেপে জোর দিয়েছে— ১) শাসকের অত্যাচারের পাল্টা মার ২) হিন্দু ধর্মাবেগে সুড়সুড়ি দেওয়া ও ৩) অগাধ অর্থ-ক্ষমতার যুগলবন্দিতে সাংসদ-বিধায়ক এবং অধিকাংশ সংবাদমাধ্যমকে কিনে নেওয়া। সিপিএম ও বামফ্রন্ট পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচনী লড়াইতে দিশাহীন দ্বিধাদীর্ণ অবস্থানে ফেঁসে গেলেও তাদের একটি গণসংগঠন ভূমিকা রেখে যাচ্ছে ধারাবাহিকভাবে— এসএফআই। এসএফআই, এআইএসএফ সহ বামফ্রণ্টের অন্যান্য ছাত্রছাত্রী ও যুবসংগঠনগুলি প্রাসঙ্গিকতা হারায়নি। ২০১১ অবধি কলেজে কলেজে তাদের একচ্ছত্র স্বৈরাচারী আধিপত্য ছিল, পাড়ায় পাড়ায় ডিওয়াইএফআই-র কর্তৃত্বমূলক দাপট ছিল। কিন্তু, পরবর্তীতে সেই কর্তৃত্ব ও আধিপত্য তৃণমূলের গণসংগঠনে হস্তান্তরিত হয়। ক্ষমতার প্রবহমানতা ও হস্তান্তর রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে স্বাভাবিক। ছাত্রছাত্রী সংগঠনের দুটো বৈশিষ্ট্য হচ্ছে— ১) ছাত্রছাত্রীদের শ্রেণিচরিত্র নেই ও ২) কলেজ জীবন (কলেজ+বিশ্ববিদ্যালয় মিলিয়ে পাঁচ বছর) মাত্র কয়েক বছরের, ফলে, নতুন মুখ তাজা প্রাণ প্রবহমান। বিগত চার-পাঁচ বছরে এসএফআই, এআইএসএফ সংগঠনে সদ্য-তরুণতরুণী সদস্য এসেছে। তারা বিগত বামফ্রন্টি শাসনজমানার স্বৈরাচারী আধিপত্যমূলক পদ্ধতি অভিজ্ঞতা করেনি, তারা বর্তমান দক্ষিণপন্থী তৃণমূলের স্বৈরাচার প্রত্যক্ষ্য করছে। সরকারি নিয়োগ থেকে শুরু করে উচ্চশিক্ষা- নেপোটিজম ও অবক্ষয়ের দায় বিগত বা বর্তমান কোনও শাসকই এড়িয়ে যেতে পারে না; ক্রমশ তা আরও নিয়ন্ত্রণহীন প্রকাশ্য হয়েছে। প্রতিস্পর্ধা ছাত্রছাত্রীদের স্বাভাবিক প্রবৃত্তি, সংসদীয় বা সংসদ-অবিশ্বাসী কমিউনিস্ট পার্টিগুলির ছাত্রছাত্রী সংগঠন বারেবারে সেই স্পর্ধা দেখায়। কেন্দ্রের উগ্র দক্ষিণপন্থী দল বা রাজ্যের দক্ষিণপন্থী দলের শাসনের বিরুদ্ধে তাদের ক্ষোভ-আন্দোলন সম্পূর্ণ ন্যায্য। পুলিশের ব্যারিকেড ভেঙে ‘অধিকার বুঝে নেওয়া প্রখর দাবিতে/ সারারাত জেগে আঁকা লড়াকু ছবিতে’ তাদের স্বর নিখাদ, সৎ। কিন্তু, শাসকের তো তা অজানা নয়। প্রশ্ন এখানেই যে, শাসকবাহিনী হঠাৎ জলকামান-লাঠি-টিয়ারগ্যাসে আক্রমণাত্মক হয়ে উঠল কেন? নির্বাচনের দু মাস আগে ছাত্রছাত্রীযুবদের বীভৎস মারলে সহানুভূতিশীল জনগণের রোষ শাসকের বিরুদ্ধে যাবে এবং সিপিএমের ‘তৃণমূল প্রধান শত্রু’ প্রতর্কটি মান্যতা পাবে— এই সরল হিসেব কি শাসক বোঝে না? তাহলে?
বঙ্গীয় নির্বাচনের যে সমীকরণগুলি নিয়ে আলোচনা করলাম, তার প্রত্যেক সমীকরণে একটা ‘কমন ফ্যাক্টর’ আছে— বিজেপি। সিপিএম যত পরিমাণে ভোটার-জনগণ খুইয়েছে ও সাম্প্রতিক দ্বিধাগ্রস্ততায় খোয়াচ্ছে, তাতে প্রধান বিরোধী দলের স্থান আরও পাকা হচ্ছে বিজেপির। কংগ্রেসকে আপাতত ধর্তব্যে আনা যায় না কারণ, বং-কংগ্রেসের মতো তাদের ছাত্রছাত্রী-যুব গণসংগঠগুলির রাস্তায় নেমে লড়াই শেষ কবে হয়েছিল, তা বঙ্গবাসী ভুলে গেছে! শাসক তৃণমূল বিগত কয়েক মাসে বুঝে গেছে যে, বিজেপি-হাওয়াকে যেভাবে ফাঁপিয়ে তোলা হয়েছে এবং সিপিএম-কংগ্রেসের ভোটারদের টেনে যেভাবে তারা নিজেদের ভোট-আখের গোছাচ্ছে, তা তৃণমূলের কাছে সমস্যাজনক। তৃণমূল সরকার স্বাস্থ্যসাথী, ‘দুয়ারে সরকার’ সব লুকোনো তাস খেলে ফেলেছে (নির্বাচনের দিন ঘোষণার পরে আর তাস ফেলা যাবে না), কিন্তু, তাতেও তাদের দশ বছরের অপরাধের পূতিগন্ধ ঠেকানো যাচ্ছে না। একটাই বিপরীত প্রক্রিয়া বাকি থাকে— বামফ্রন্ট-কংগ্রেসের ভোট-শতাংশ যদি টেনে বাড়ানো যায়, তাহলে বিজেপির ভোট-শতাংশ কমবে। সংসদীয় কিংবা সংসদ-অবিশ্বাসী বামপন্থীদের কর্মকাণ্ড যদি বাড়ে, তাহলে উগ্র দক্ষিণপন্থী বিজেপির বাড়বাড়ন্ত কমতে বাধ্য। ছত্রধর মাহাতোকে ইউএপিএ ও যাবজ্জীবন সাজা থেকে মুক্ত করে জঙ্গলমহলের দায়িত্ব দেওয়া কিংবা সুশান্ত ঘোষকে সাজা থেকে খালাস দিয়ে গড়বেতা-কেশপুরে ফের বসিয়ে দেওয়া এই পরিকল্পনার অংশ। ২০১৯ লোকসভা ভোটের পরে রাজ্যজুড়ে সিপিএমের বন্ধ পার্টি অফিসের ৮০% খুলে গেছে[1]; তৃণমূল ক্ষমতায় এসে বাহুবলে কিংবা সিপিএম কর্মীদের তৃণমূলে যোগদানের জন্যে অধিকাংশ পার্টি অফিস তালাবন্ধ বা দখল করেছিল। বর্ধমান, কুচবিহার, ঝাড়গ্রামে পার্টি অফিস ‘পুনর্দখল’ করা বা তালা খুলে ঝুল ঝাড়ার সময়ে তৃণমূলের নীরব উৎসাহ ছিল। ত্রিপুরায় বিজেপি ক্ষমতায় এসেই লেনিনমূর্তি উপড়ে দিয়েছিল, তৃণমূল এখন কিছু জায়গায় লেনিনমূর্তি তৈরি করছে স্থানীয় বামনেতাদের পাশে নিয়ে। খড়গপুরে তৃণমূল কংগ্রেসের স্থানীয় বিধায়কের উদ্যোগে লেনিনের মূর্তি উন্মোচিত হয়, উপস্থিত ছিলেন স্থানীয় বামফ্রন্ট নেতারা[2]। যে ছাত্রছাত্রীযুবরা মিছিলে গেছিল, তারা প্রত্যেকেই ভোটাধিকার প্রয়োগ করবে। শাসকের আক্রমণ যদি তাদের ভোট বামফ্রন্ট শিবিরে সংবদ্ধ করে, তাহলে সংসদীয় বামেদের পাশাপাশি তৃণমূলেরও লাভ। ‘২১শে রাম ২৬শে বাম’— যে চোরাহাওয়া বইছিল ২০১৯ লোকসভা নির্বাচনের ফলাফল থেকে, তাকে স্তব্ধ করার একমাত্র উপায় যদি বামফ্রন্টের ভোট-শতাংশ তাদের নিজেদের কাছে থাকা সুনিশ্চিত করা যায়। বিজেপি রাজ্যজুড়ে রথযাত্রা ঘোষণা করেছে (যে রথযাত্রার কুফল ১৯৯২ থেকে দেশের মানুষ ভোগ করছে), ‘জয় শ্রীরাম’-এর মতো ধর্মীয়-রাজনৈতিক স্লোগানকে বাংলায় প্রতিষ্ঠা দিচ্ছে; এই প্রচার থেকে মানুষের দৃষ্টি ঘুরে যেতে পারে বামপন্থীদের লড়াকু ছবি আরও বেশি সামনে এলে। পুলিশের নির্দয় লাঠিচালনা, আহত যুবকযুবতীদের ছবি, গণসংগঠনগুলির দৃঢ়পতাকা নিশ্চিতভাবেই সেই সম্ভাবনা বাড়াবে। বিজেপি বনাম তৃণমূল বাইনারি ক্ষইয়ে যদি তৃণমূল বনাম সিপিএম পরিচিত প্রতর্ক উঠে আসে, তাহলে তা বাংলার রাজনৈতিক সংস্কৃতির জন্যে স্বস্তিদায়ক।
##
বঙ্গ রাজনীতিতে কংগ্রেস বনাম কমিউনিস্ট (নকশাল+সিপিএম), বামফ্রন্ট বনাম কংগ্রেস, বামফ্রন্ট বনাম মাওবাদী, সিপিএম বনাম তৃণমূল+কংগ্রেস, তৃণমূল বনাম মাওবাদী ও তৃণমূল বনাম সিপিএম+কংগ্রেস এই অঙ্কগুলিই ঘুরেফিরে এসেছে। বিজেপি বঙ্গবাসীর কাছে কোনওদিনই খুব কাঙ্খিত ছিল না। ১৯৭৫ সালের জুনে জনসঙ্ঘের তথা জয়প্রকাশ নারায়ণের নেতৃত্বে সিপিএম দলীয় পতাকা ছাড়া কংগ্রেস-বিরোধী মিছিলে অংশগ্রহণ করে রাজ্যকমিটির স্বীকৃত আহ্বানে[3], সিপিএমের সর্বভারতীয় সম্পাদক পি সুন্দরাইয়া পার্টির উচ্চ নেতৃত্বের সঙ্গে আরএসএসের ঘনিষ্ঠতার কারণে এবং জনসঙ্ঘের সঙ্গে জোটবাঁধার গ্লানিতে পদত্যাগ করেছিলেন[4]। তৃণমূল ১৯৯৮-৯৯ সালে পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির সঙ্গে জোট বেঁধে কেশপুর-গড়বেতা দখলের চেষ্টা করে ও জনযুদ্ধ গোষ্ঠীর সংগ্রামের কাছে পরাস্ত হয়। পরে এনডিএ জোটে থেকে মন্ত্রিত্ব পায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কিন্তু, এই টুকরো-টাকরা উদাহরণ আর তপন শিকদারের সাংসদপদ (১৯৯৮) ছাড়া বঙ্গরাজনীতিতে বিজেপির বিষদাঁত তেমন ফোটেনি। আরএসএস দীর্ঘ বেশ কিছু দশক ধরে মুসলিমবিদ্বেষ ও হিন্দুজাগরণের চোরাবয়ান প্রচার করে এবং খুচরো কিছু প্রতিক্রিয়াশীল অশান্তিচেষ্টায় নিজেদের মতাদর্শ প্রচার করে গেছে; ‘মতাদর্শের চেয়েও ধর্ম বড়’, প্রকাশ্য ধর্মীয় অনুশীলনে শাসকমদতের ভূমিকা পূর্বতন কোনও শাসক এড়িয়ে যেতে পারে না। বামফ্রন্টি শাসনে যে বিষফোঁড়া চামড়ায় পুঁজরক্ত জমিয়ে নিচ্ছিল, দক্ষিণপন্থী শাসনে তা গোদসমেত মাথাচাড়া দিয়েছে! সন্ত্রাসবাদী আরেসেসের চোরা মতাদর্শপ্রচার নয়, তাদের সংসদীয় মুখোশ বিজেপি কেউটেভঙ্গিতে এগিয়ে আসছে। রাজনৈতিক বোধসম্পন্ন বৃত্ত বিজেপির বিপদ সম্পর্কে সচেতন। সাম্প্রতিক অনমনীয় কৃষক আন্দোলন এবং সিএএ-এনআরসি আইন বিজেপির গণতান্ত্রিক মেকি সাজপোশাক খুলে দিয়েছে। এঁদের একটা অংশের মতামত, বাংলায় ক্ষমতার লড়াইতে তৃণমূল-সিপিএম-কংগ্রেস লড়াই থাকুক, বাইরের কোনও দল যেন মাথা না গলায় (বিজেপি বাংলার সংস্কৃতি ও রাজনৈতিক সংস্কৃতিকে জবরদখলের চেষ্টা চালাচ্ছে, কিন্তু, এই বাংলার সংস্কৃতিকে আত্মস্থ করতে পারেনি), বিশেষত যে দলের প্রথম সারির সিংহভাগ নেতা গোবলয়ের বা পশ্চিমভারতের। তাই, সিপিএমের গণসংগঠন যদি আরও শক্তিশালী হয়, তাদের গণআন্দোলনের তেজ যদি বাড়ে, নিয়মিত কর্মসূচি যদি বাংলার রাজনীতিকে ব্যস্ত রাখতে পারে, তাহলে বিজেপির প্রভাব কমে যাবে— তৃণমূলের বুদ্ধ্যাধার (থিঙ্কট্যাঙ্ক) একথা ভালমতোই জানে। সিপিএম যদি নিজেদের ভোটজমি শক্ত রাখতে পারে, তাহলে লোকসভার ভোটধ্বস আটকে আরও বেশি আসন জিতে বিজেপির রংবেলুন ফুটো করে দিতে পারবে। ‘ওরা ৭%’ বলে রাজনৈতিকবোধহীনরা যতই ব্যঙ্গ করুক, ৩৪ বছর ভোট-মেশিনারি যাদের দখলে ছিল, যাদের অসীম শক্তিধর লোকাল কমিটি প্রত্যেক বাড়ির হাঁড়ির চাল গুনে দেখত, তাদের ভোট কমা-বাড়ার ওপরে এখনও শাসক পরিবর্তন নির্ভর করে।
ছাত্রছাত্রীযুবদের প্রতিস্পর্ধা ডান-বাম সব শাসকই প্রত্যক্ষ করেছে। ন্যায্য দাবিতে প্রতিবাদরত ছাত্রহাত্রীরা রক্তাক্ত আহত হলে সমাজে আলোড়ন ওঠে। ১২ তারিখে বন্ধ ডেকেছিল ওই ১০টি ছাত্রছাত্রীযুব সংগঠনের সদস্যরা। যেসব ইস্কুল-কলেজে প্রতিবাদী বামপন্থী মানুষ আছেন, সেখানে ভাল প্রভাবও ফেলেছিল বন্ধ। বাজার-সমাজতন্ত্রের পক্ষে সওয়াল করা বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য সহ সিপিএম নেতৃত্ব একদা ধর্মঘট নিষিদ্ধ করতে চেয়েছিল, তৃণমূল জমানায় সে নিষেধের কড়াকড়ি বেড়েছে। কিন্তু, ধর্মঘট এখনও নিপীড়িত জনতার হাতিয়ার; উদারনীতিকদের পোদ্দারির তোয়াক্কা না করেই শ্রমিক-কৃষক-ছাত্ররা হরতাল উদ্যাপন করেন। ছাত্রছাত্রীরা তাদের প্রতিস্পর্ধী অ-বাধ্যতায় শাসকের চোখরাঙানিকে তোয়াক্কা করে না, আর, প্রতিবাদের মতাদর্শে যদি মার্কসবাদের সামান্য ছোঁয়াও লেগে যায়, তাহলে তা শাসকের কপালের ভাঁজ বাড়ায়। তৃণমূল সরকার বিগত কয়েক মাসে বিজেপির কাছে ভাতে ও হাতে মার খেয়েছে; ‘বিজেপিকে আমরাই রুখব’ আওয়াজ দিয়েও তাদের গুরুত্বপূর্ণ নেতামন্ত্রীরা দল ছাড়ছে। তৃণমূল যদি সত্যিই ফ্যাসিবাদকে রুখতে চায়, তাহলে তাদের শাসনপ্রক্রিয়ায় গুরুত্বপূর্ণ বদল আনতে হবে। বিরোধী কণ্ঠকে লাঠি-জলকামানে কিংবা এলাকাগুণ্ডামিতে চুপ করিয়ে রাখা বা আমফানের পরে ত্রাণ-দুর্নীতির ফল ফলতে শুরু করেছে বিপরীত প্রক্রিয়ায়। কেন্দ্রীয় সরকারের ফ্যাসিবাদের বিরোধিতার সঙ্গে সঙ্গে নিজেদের স্বৈরাচারের অপরাধও তো শোধরাতে হবে, নইলে ফ্যাসিবাদ-বিরোধিতা প্রচারের ঢক্কানিনাদ হয়েই থেকে যাবে। তৃণমূলকে বিরোধীদের (মূলত সিপিএম, কংগ্রেস ও লিবারেশন, এমনকি বিষাক্ত উদ্দেশ্য না থাকলে বিজেপিকেও) বিরোধিতার গণতান্ত্রিক ক্ষেত্র ছেড়ে দিতেই হবে, শুধু আসন্ন নির্বাচনের আগের কৌশল হিসেবে নয়, বরং দীর্ঘমেয়াদি নীতিতে।
বিরোধী সংসদীয় দলগুলির ভূমিকা কী হবে? বিজেপির ফ্যাসিবাদী অবস্থান নিয়ে কোনওই দ্বিমত নেই, ক্রমশ তা আরও নগ্ন হবে। নরমপন্থী হিন্দুত্ববাদী কংগ্রেসের অতীত ভূমিকা স্যাঁতস্যাঁতে, দক্ষিণপন্থী স্বৈরাচারের চরম নমুনা তারা দেখিয়েছে ২০০৪-২০১৪ সালে আদিবাসী-কৃষক-শ্রমিকদের ওপরে নামিয়ে আনা শ্রেণিশোষণে। সংসদীয় কমিউনিস্ট পার্টিগুলিকে সংশয়হীন দৃঢ় অবস্থান নিতেই হবে। যে ছাত্রছাত্রীরা বাংলায় সংসদীয় কমিউনিস্ট পার্টিগুলির মতাদর্শগত দুরবস্থার পরেও রাস্তায় নেমে শাসকের চোখে চোখ রাখার হিম্মত দেখাচ্ছে, যে ছাত্রছাত্রীরা বাংলার রাজনীতিতে চতুর্থ স্থানে চলে যাওয়া সংসদীয় কমিউনিস্ট পার্টির দ্বিধাগ্রস্ত নীতিকৌশলকে বারবার রাস্তায় নেমে চাঙ্গা করে তুলছে, তাদের প্রতি পার্টির দায়বদ্ধতা তো থেকে যায়। বিরোধিতার ক্ষেত্র তৈরি করে নিয়ে মুহুর্মুহু আন্দোলনে সেই ক্ষেত্রকে কৃষক-শ্রমিকের অধিকার অর্জনের ক্ষেত্রে রূপান্তরিত করা জরুরি। পুলিশের মার খাওয়া আহত প্রত্যেক ছাত্রছাত্রীর চোখে বিজেপি ও তৃণমূল-বিরোধিতার স্পষ্ট আগুন, পার্টিনেতারা কবে পার্টির পতাকা হাতে এই আগুনকে ধারণ করে রাস্তায় নামবেন? দিল্লিসহ দেশজুড়ে কৃষকেরা ফ্যাসিবাদ বিরোধিতায় জেগে উঠেছেন তাত্ত্বিক কচকচিকে ঠাট্টা করে দ্রোহমুক্তির সংজ্ঞা তৈরি করছেন, বাংলার সংসদীয় পার্টিনেতারা কবে শাসকশ্রেণির অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বে মূল শত্রুকে চিহ্নিত করবেন? বিরোধিতার অধিকার প্রতিমুহূর্তে গণআন্দোলন গড়ে আদায় করে নিতে হয়; আর, কমিউনিস্ট পার্টির কাছে সেই প্রত্যাশা থাকে শ্রেণিভিত্তিক গণআন্দোলনের। সব মিছিল তো আহত হয়ে ঘরে ফিরতে নাও চাইতে পারে, সব প্রতিবাদী তো প্রতিবাদের রূপান্তর ভোটফলাফলের বাড়া-কমায় (যেহেতু সমাজব্যবস্থার পরিবর্তন কাম্য, শাসনকাঠামোর বদল) নাও চাইতে পারে। যে ছাত্রছাত্রীযুবরা আপসহীন লড়াইয়ে সমাজের বদল চেয়ে শাসকের দ্বারা নির্যাতিত হচ্ছে, তাদের ক্রোধ-সততাকে কোন অভিমুখে পরিচালিত করা হচ্ছে? নাকি, ছাত্রছাত্রীযুব সংগঠনে নতুন মুখ আসতেই থাকবে, ছাত্রছাত্রীযুবরা মার খাবে আবার সব মেনে নিয়ে ভিড়ে মিশে যাবে স্বপ্ন মুছতে, আবার তাজাপ্রাণ সদস্য আসবে— এই স্বস্তিচাকা ঘুরেই যাবে? বিধানসভা নির্বাচন তিন মাস পরে শেষ হয়ে যাবে, কিন্তু তারপর? আশু লক্ষ্য দক্ষিণপন্থার বাড়াবাড়ি ঠেকানো, কিন্তু দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্য কী? কখনও কংগ্রেস, কখনও অন্য অ-কমিউনিস্ট দলের সঙ্গে জোটে আসনভাগে শ্রেণি-বর্ণ-লিঙ্গগত বিভাজনে বিভক্ত সমাজের দীর্ঘস্থায়ী মুশকিল আসান যে হয় না, তা অভিজ্ঞতা করতে এখনও বাকি আছে কিছু? আসন্ন পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা নির্বাচনে দক্ষিণপন্থার তাণ্ডব রুখে দেওয়া নিশ্চয়ই কর্তব্য, কিন্তু, সংসদীয় কমিউনিস্ট পার্টিগুলির (তা সোশ্যাল ডেমোক্র্যাট হলেও) থেকে প্রত্যাশা আরও বেশি। যে ছাত্রছাত্রীযুবরা প্রবল প্রতিরোধে শাসকের ব্যারিকেড ভাঙার সৎ সাহস রাখে, তাদের বিদ্রোহী সত্তা যেন শুধু বিভিন্ন শাসকের ভোট-জোটের লক্ষ্যে চাপা পড়ে না যায়। ছাত্রছাত্রীযুবদেরও রাজনৈতিক দায়িত্ব আপসহীন সংগ্রাম অব্যাহত রাখা এবং অভিমুখহীন আপসকামী পার্টিনেতৃত্বকে প্রতিবিপ্লবী অবস্থান থেকে সরে আসতে বাধ্য করা।
সংযোজন: ১১ ফেব্রুয়ারি পুলিশের মারে গুরুতর আহত মইদুল ইসলাম মিদ্যা ১৫ই ফেব্রুয়ারি সকালে শহীদ হয়েছেন। কর্মসংস্থান, শিক্ষার অধিকারের দাবিতে তিনিও তাঁর সহযোদ্ধাদের সঙ্গে মিছিলে গেছিলেন। পশ্চিমবঙ্গে রাজনৈতিক মৃত্যু, বিশেষতঃ বামপন্থী ছাত্রছাত্রীযুবদের মৃত্যু ইতিহাসে বারবার ঘটেছে। লতিকা সেন, প্রতিভা গাঙ্গুলি, অহল্যা, নুরুল ইসলাম, আনন্দ হাইত, মাধাই হালদার, সুদীপ্ত– মিছিলে গুলি-লাঠি চালিয়ে প্রতিবাদীদের মেরে ফেলার নজির প্রচুর, মইদুল সেই তালিকায় নবতম সংযোজন। এই মৃত্যুর দায় রাজ্য সরকার ও পুলিশের ওপরেই বর্তায়। আর, তাদের ওপরেও দায় বর্তায়, যারা দক্ষিণপন্থী শাসকের ‘প্রগতিশীল’ মুখ খুঁজে চুপ করে থাকে। মইদুলের শাহাদাত ‘বিজেপি বনাম তৃণমূল’ বাইনারিতে আঘাত করবে, সংসদীয় বামেদের আরও প্রাসঙ্গিক ক’রে তুলবে। গণসংগঠনের কর্মীর মৃত্যুতে পার্টির ক্ষোভে জ্বলে ওঠার কথা, শোককে ক্রোধে পরিণত করার সময়। সংসদীয় মুখরক্ষার আপসে ও আশু ভোট-জোটের অজুহাতে তারা নিশ্চয়ই ছাত্রছাত্রীযুবদের দ্রোহের আগুনকে প্রতিবিপ্লবী পথে ঠান্ডা করে দেবে না, বরং সেই ক্ষোভকে আরও দীর্ঘমেয়াদী লড়াইয়ের চালিকাশক্তি করবে।
- The Hindustan Times, Feb 6, 2021.
- বিজেপির উষ্মা শ্যামাপ্রসাদের বদলে লেনিনের মূর্তি বসানোয়, কিন্তু, বামনেতৃত্ব একে শুভ উদ্যোগ বলে স্বীকার করেছেন। The Statesman, January 20, 2021.
- দীপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, নো পাসারান, অনুষ্টুপ শারদীয় ১৪১০, ৫৫৮
- P. Sundarayya: My Resignation, revolutionarydemocracy.org.archive/resig.htm
ছবি সৌজন্য: শুভদীপ ভট্টাচার্য