Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

উত্তরাখণ্ডের সাম্প্রতিক বিপর্যয় ও কিছু প্রশ্ন

সোমনাথ মুখোপাধ্যায়

 



গদ্যকার, অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক

 

 

 

আবারও সংবাদের শিরোনামে উঠে এল উত্তরাখণ্ড। সাম্প্রতিক অতীতের সামান্য ধূসর হয়ে যাওয়া স্মৃতির পাতাগুলো একটু নেড়েচেড়ে দেখলে দেখা যাবে বিগত তিন দশক সময়ের মধ্যে হিমালয়ের কোল জুড়ে আশ্র‍য় নেওয়া এই ছোট্ট রাজ্যটি নেই নেই করে পাঁচবার প্রকৃতির রুদ্ররোষের শিকার হয়েছে। ঘটনাগুলি এই অবসরে একবার স্মরণ করে নেওয়া যাক। ২০০০ সালের ৯ নভেম্বর উত্তরপ্রদেশের পার্বত্য অংশকে নিয়ে এই রাজ্যের স্থাপনা হলেও এই অঞ্চল বিপর্যয়ের আঁতুড়ঘর হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে বারংবার। বিপর্যয়ের ক্রমতালিকা অনেকটা এইরকম–

উত্তরকাশীর ভূমিকম্প (১৯৯১): অক্টোবর মাসে ৬.৮ কম্পাঙ্ক-যুক্ত ভূমিকম্পের আঘাতে তৎকালীন উত্তরপ্রদেশ রাজ্যের উত্তরকাশী বিধ্বস্ত হয়। সরকারি হিসেবে মারা যান ৭৬৮ জন, কয়েক হাজার বাড়ি ধ্বংস হয় চিরতরে।

মালপার ভূমিধস (১৯৯৮): ভূমিধসের দাপটে হিমালয়ের ছোট্ট গ্রাম মালগা সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস হয়ে যায়। এই ঘটনায় ৫৫ জন মানস সরোবর-কৈলাস তীর্থযাত্রীসহ ২৫৫ জন গ্রামবাসী মারা যান। ভেঙে পড়া পাথুরে অবষ্কর এসে অবরোধ করে সারদা নদীর গতিপথ।

চামোলির ভূমিকম্প (১৯৯৯): উত্তরকাশী বিপর্যয়ের মাত্র আট বছরের মাথায় চামোলি জেলার নির্বিবাদী সরল মানুষদের জীবনযাত্রা ব্যাহত হয় ৬.৮ কম্পাঙ্কের ভূমিকম্পের দাপটে। মারা যান শতাধিক গ্রামবাসী। ভূমিকম্পের দাপটে প্রভাবিত হয় পার্শ্ববর্তী রুদ্রপ্র‍য়াগ জেলার বিস্তীর্ণ অংশ। ব্যাহত হয় প্রাত্যহিক জীবন ও পরিষেবা৷

কেদারনাথের মেঘভাঙা বৃষ্টি (২০১৩): জুন মাসের মেঘভাঙা বৃষ্টির দাপটে হড়পা বানের ফলে শৈবতীর্থ কেদারনাথ ও তার সংলগ্ন অঞ্চল বিপুল বিপর্যয়ের শিকার হয়। প্রবল বন্যার দাপটে মারা যান প্রায় ৬০০০ মানুষ। তীর্থভূমিতে নেমে আসে মানুষের বিপন্নতার সুতীব্র হাহাকার। একাধিক জনপদ হারিয়ে যায় চিরদিনের মতো। বিপুল পরিমাণ স্থাবর সম্পত্তি নষ্ট হয়।

চামোলির হিমানিসম্প্রপাত (ফেব্রুয়ারি ৭, রবিবার, ২০২১): চামোলি জেলা আবারও সংবাদের শিরোনামে। নন্দাদেবী পর্বত থেকে নেমে আসা হিমবাহ ভেঙে পড়ে ওই অঞ্চলের পূতপ্রবাহী দুই নদী— ঋষিগঙ্গা ও ধৌলিগঙ্গায় প্রবল জলস্ফীতি ঘটানোয় ইতিমধ্যেই দুটি নির্মীয়মান জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস হয়ে গিয়েছে। এখনও পর্যন্ত মারা গিয়েছেন ২৬ জন; নিখোঁজ মানুষের তালিকা ক্রমবর্ধমান। এই ঘটনা উসকে দিল ২০১৩ সালের বিপর্যয়ের ভয়াল স্মৃতিকে।

এখনই নানা প্রশ্ন উঠে আসছে এই সাম্প্রতিক বিপর্যয়কে ঘিরে। তবে সেই আলোচনায় ঢোকার আগে হিমানিসম্প্রপাত বিষয়ক কতগুলো প্রাথমিক আলোচনা সেরে নেওয়া যাক।

 

বহমান বরফের স্তূপ

আমাদের স্কুলবেলার ভূগোল বইয়ের পাতায় নজর দেওয়া যাক। হিমবাহ কাকে বলে? ভূমিরূপ বিজ্ঞানের ভাষায় হিমবাহ হল— বরফের নদী— বহমান বরফের স্তূপ। উৎস অঞ্চলের সীমানা ছেড়ে বহমান বরফের স্তূপ যখন ধীরে ধীরে চলতে থাকে তখন তাকে হিমবাহ বলি। পৃথিবীর দুই মেরু অঞ্চলে সাদা বরফের যে আস্তরণ লক্ষ করা যায় যায়, তা আসলে হিমবাহ— মহাদেশীয় হিমবাহ। এছাড়া পৃথিবীর সমস্ত উচ্চ পার্বত্য অঞ্চলেই হিমবাহের দেখা মেলে। ভারতের উত্তর সীমানা আগলে দাঁড়িয়ে থাকা সুবিস্তৃত হিমালয় পর্বতমালার নামের মধ্যেই নিহিত রয়েছে অগণিত বরফের স্তূপের উপস্থিতির বিষয়টি। পরিভাষায় এগুলির পরিচিতি পার্বত্য বা উপত্যকা হিমবাহ হিসেবে। নন্দাদেবী পর্বতমালার উচ্চতম অংশে থিতু হয়ে থাকা চামোলি হিমবাহ ভেঙেই ঘটেছে এত বড় একটা বিপর্যয়। নামের মধ্যে সচলতার আভাস থাকলেও সব হিমবাহই যে সমান সচল, সমান গতিতে বহমান— এমনটা মোটেই নয়। দুই মেরু মহাদেশকে ঢেকে রাখা মহাদেশীয় হিমবাহগুলির অবস্থান প্রায় সমতল মেরুপৃষ্ঠের ওপরে, ফলে তারা প্রায় স্থাণু হয়ে স্বস্থানে অবস্থান করছে বহু লক্ষ বছর ধরে। অন্যদিকে পর্বতের পার্বত্য উপত্যকার খাড়া ঢালের ওপরে থাকা উপত্যকা হিমবাহগুলো আয়তনে যথেষ্ট বড় হলে মাধ্যাকর্ষণের টানে ধীরে ধীরে নিচে নেমে আসে। একটা সুবিশাল বরফের স্তূপ তার বিপুলায়তন নিয়ে কীভাবে নমনীয় পদার্থের মতো আচরণ করে আঁকাবাঁকা পাহাড়ি উপত্যকা পথ বেয়ে নেমে আসে তা নিয়ে তথ্যাভিজ্ঞ বিশেষজ্ঞ মহলে রয়েছে নানা মতের টানাটানি। আলোচ্য প্রবন্ধে সেই সব বিষয়ে আলোচনার সু্যোগ নেই বলে এই প্রসঙ্গটিকে আপাতত এড়িয়ে যাচ্ছি।

 

হিমানিসম্প্রপাত

আপাতভাবে ধীরগতিসম্পন্ন হিমবাহ বা বরফের স্তূপ যখন পর্বতের খাড়া ঢাল বরাবর দ্রুত নেমে এসে ভেঙে পড়ে তখন তাকে হিমবাহ ধস বা হিমানিসম্প্রপাত (Avalanche) বলা হয়। বিজ্ঞানীদের মতে সম্প্রপাতের সময়ে হিমবাহের চলনগতি থাকে গড়ে ১৬০ কি.মি. প্রতি ঘণ্টা বা তার বেশি। বলা বাহুল্য, বেশ কয়েক কিলোমিটার দীর্ঘ একটি বরফের স্তূপ আকস্মিকভাবে ভেঙে পড়লে বিপুল ক্ষয়ক্ষতির সম্ভাবনা তৈরি হয়। একটা বড় গাছ ঝড়ে ভেঙে পড়লে যেমন গাছের আশেপাশে থাকা মানুষজনের জীবন বিপন্ন হয়, হিমানিসম্প্রপাতের অভিঘাত তেমনই বা তুলনায় অনেকগুণ বেশি। গাছের পতনজনিত বিপর্যয় একটা নির্দিষ্ট ক্ষেত্রপরিসীমায় সীমাবদ্ধ থাকলেও হিমধসের প্রভাবে দূরতম প্রান্তের মানুষও ক্ষতিগ্রস্থ হতে পারেন। যোশিমঠের বিপর্যয় হয়তো তেমনই একটা চেহারা নিতে চলেছে।

পার্বত্য অঞ্চলে হিমানিসম্প্রপাতের ঘটনা অস্বাভাবিক মোটেই নয়। প্রকৃতিগত তারতম্যের বিচারে সম্প্রপাতকে দুটি ভাগে ভাগ করেছেন হিমবিজ্ঞানীরা।

১) শিথিল তুষার হিমধস এবং ২) চাঁই বরফ হিমধস।

প্রথম শ্রেণির সম্প্রপাতের ফলে বড় রকমের ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কা থাকে না। বড় গাছে পাতা ঝরে পড়া যেমন একটি স্বাভাবিক ঘটনা, এটিও অনেকটা তেমনই। কিন্তু দ্বিতীয় শ্রেণির সম্প্রপাত তীব্র প্রতিক্রিয়া তৈরি করে। হিমবাহ ভেঙে যে সুতীব্র জলোচ্ছাসের সৃষ্টি করেছে, তা বারংবার ২০১৩ সালের মেঘভাঙা বৃষ্টির দরুণ সৃষ্টি হওয়া বিপর্যয়ের কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে। নেটপথে ভেসে আসা ছবি থেকে আমরা জেনেছি যে অকুস্থলে ভেঙে পড়ার পর কঠিন হিমবরফ গলে গিয়ে বিপুল জলরাশির সৃষ্টি করে যা ধৌলিগঙ্গা ও ঋষিগঙ্গার নদীখাত বরাবর বইতে থাকে প্রবল রভসে। শীতকালের শান্ত নদীখাত সহসা উদ্বেল হয়ে ওঠে হিমগলা জলের পরশে। তীব্রগতিতে বইতে থাকা জলের আঘাতে মুহূর্তে লোপাট হয়ে যায় নদীকে শাসন করার তথাকথিত সমস্ত কংক্রিটের বাধা। ঘটনার দুদিন পর ধীরে বহে স্রোতস্বিনী।

 

বিপর্যয়ের সুলুকসন্ধান

ঘটনা ঘটে যাওয়ার পর শুরু হয়েছে কারণ নিয়ে কাটাছেঁড়া— ময়নাতদন্ত। হিমরাজ্যে কী এমন ঘটল যার ফলে প্রকৃতির অভিশাপ নেমে এল মানুষের কর্মকাণ্ডের ওপর? সংশ্লিষ্ট বিজ্ঞানীরা তথ্যনিষ্ঠ অনুসন্ধানের ওপর ভিত্তি করে কারণগুলো আমাদের সামনে আনার চেষ্টা করছেন। হিমবাহ বিজ্ঞানীদের মতে, পাহাড়ের খাড়া ঢালে সাময়িকভাবে থিতু হয়ে থাকা অস্থিত হিমবাহগুলো অনেকটা টোটাভরা বন্দুকের মতো। বন্দুকের ট্রিগারে সামান্য আঙুলের চাপ দিলেই যেমন নলপথে অগ্নিস্পর্শ— গুলি ধেয়ে আসে, হিমবাহের ক্ষেত্রেও ঠিক তেমনটাই ঘটে। ভূমিঢাল, হিমভার, হিমতল ও ভূমিতলের সুস্থিতি, নিম্নমুখী টানের মাত্রার মতো বিষয়গুলো যতক্ষণ একটা সুস্থিত ভারসাম্য বজায় রাখে, ততক্ষণ হিমবাহ ঢালের ওপর অবস্থান করে। কোনও অভ্যন্তরীণ বা বাহ্যিক কারণে এই আন্তক্রিয়াজ উপাদানগুলির ভারসাম্যে সামান্য পরিবর্তন ঘটলেই ঘটে হিমপতন বা হিমধস বা হিমানি সম্প্রপাতের ঘটনা। প্রশ্ন উঠেছে কোন ঘটনা শীতঘুমে থাকা হিমবাহকে সহসা ট্রিগারে চাপ দিয়ে এমন রুদ্ররূপ ধারণে বাধ্য করল? বিপুল তরঙ্গে ধেয়ে আসা জলরাশির উৎসই বা কী?

এই বিষয়েও কিন্তু বিজ্ঞানীরা এখনও পর্যন্ত কোনও সর্বসম্মত সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারেননি, তবে একাধিক সম্ভাবনার কথা বলেছেন তাঁরা। এই কারণগুলোকে নিয়ে দু-এক কথা বলা যেতে পারে।

একদল তথ্যভিজ্ঞ বিজ্ঞানী মনে করেন এ সবই হল বিশ্ব-উষ্ণায়নের ফল— অনিবার্য প্রক্রিয়া। একদা দাপিয়ে বেড়ানো হিমবাহরা আজ পৃথিবীর বায়বীয় উষ্ণতা বেড়ে যাওয়ার কারণে নিজভূমে রীতিমতো কোণঠাসা হয়ে পড়েছে। পৃথিবীর অন্যান্য অংশের হিমবাহগুলোও আজ উষ্ণতার কারণে তাদের চেনা জমি ছেড়ে দিতে বাধ্য হচ্ছে। পরিবেশ বিজ্ঞানীদের মতে উষ্ণতার প্রভাবে দ্রুত অবক্ষয় হচ্ছে নন্দাদেবীর শরীর জুড়ে থাকা হিমবাহর, ফলে পার্বত্য ঢালের সুস্থিতি বিনষ্ট হচ্ছে, হিমগলনের ফলে হিমবাহের উপত্যকার বুকে তৈরি হয়েছে সুবিশাল হ্রদ, পার্বত্য ঢালের ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যাওয়ার ফলেই হয়তো এভাবে হুড়মুড়িয়ে বয়ে আসছে হিমচাঙড় গলা জল। আইআইটি-ইন্দোরের ‘গ্লেসিওলজি এন্ড হাইড্রোলজি’ বিভাগের অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর ফারুক আজমের মতে এমনভাবে ‘হিমবিস্ফোরণের’ (Glacial burst) ঘটনা ‘অতীব বিরল’ (extremely rare event)। সদ্য সংগৃহীত উপগ্রহচিত্র এবং গুগল আর্থ প্রেরিত চিত্রমালায় এমন কোনও হ্রদের উপস্থিতির কথা দেখানো হয়নি, তবে হিমবাহের অধীনে থাকা ওই অঞ্চলে সম্ভবত ‘ওয়াটার পকেট’ তৈরি হয়েছে। আর জলপূর্ণ এই ওয়াটার পকেট বিস্ফারিত হওয়ার দরুণই হয়তো এমন ঘটনা ঘটেছে। তবে এমনটা নিছকই প্রাথমিক অনুমান এবং অবশ্যই বিস্তারিত অনুসন্ধান সাপেক্ষ।

এমনই এক আকস্মিক প্রাকৃতিক ঘটনার পেছনে বিশ্ব উষ্ণায়নের বিষয়টিকে সম্পূর্ণভাবে এড়িয়ে যাওয়ার কোনও সুযোগ হয়তো আজ আর নেই। আমাদের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতাই বলছে যে পৃথিবীর আবহ-মণ্ডলের শৃঙ্খলা অনেকটাই নষ্ট হয়ে গেছে— অনিয়মিত হয়েছে বৃষ্টিপাত ও তুষারপাতের ঘটনা। এই সময়ের শীতকালগুলো আগের তুলনায় উষ্ণতর হয়ে উঠেছে ক্রমে ক্রমে। এর ফলে হিম বরফের গলন মোটেই অসম্ভব নয়। হিমবাহের ‘অভ্যন্তরীণ তাপীয় প্রস্থচ্ছেদ’ পর্যবেক্ষণ করেও এমন অনুমানের সত্যতা যাচাই করছেন বিজ্ঞানী মহল। তাহলে কি এমন ঘটনাই সাম্প্রতিক বিপর্যয়ের কারণ?

সকলেই এই মত বা অনুমানের সঙ্গে সহমত তেমনটাও কিন্তু নয়। হিমবাহবিজ্ঞানী ও ভূমিরূপবিজ্ঞানীরা চামোলির সাম্প্রতিক বিপর্যয়ের সম্ভাব্য কারণ হিসেবে হিমহ্রদে জলোচ্ছ্বাসের ঘটনাকে খারিজ করে বড় মাপের ভূমিস্খলনকেই (landslip) বিপর্যয়ের মুখ্য কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। তাঁদের মতে, হিমবাহ খোদিত ভূমিভাগে জল জমে হ্রদের সৃষ্টি হলেই হ্রদবিস্ফোরণের ধারণা মান্যতা পায়। কিন্তু উপগ্রহচিত্রে এ অঞ্চলে কোনও হ্রদের অস্তিত্বের বিষয়টি প্রতিষ্ঠা পায়নি। দ্য সেন্ট্রাল ওয়াটার কমিশন (CWC) কৃত অনুসন্ধানে এমন কোনও বড়মাপের হ্রদের ধরা পড়েনি, তবে কিছু কিছু ছোট ‘ওয়াটার পকেট’ হয়তো উপগ্রহের নজর এড়িয়ে গেছে। CWC-র ডিরেক্টর শারাত চন্দ্র মনে করেন— ‘আকস্মিক এই জলোচ্ছাসের কারণ খানিকটা রহস্যময় এবং আরও কিছু পরীক্ষা ও পর্যবেক্ষণের পরেই হয়তো জানা যাবে এই বিপর্যয়ের সঠিক প্রাকৃতিক কারণ।’

বিপর্যয়ের সম্ভাব্য কারণ হিসেবে আরও একটি বিষয়ের কথা এ প্রসঙ্গে উঠে এসেছে ‘ওয়াদিয়া ইন্সটিটিউট অফ হিমালয়ান জিওলজি’-এর ডিরেক্টর কালাচাঁদ সাইনের কথায়। নন্দাদেবী পর্বতের খাড়া ঢালের কথা মাথায় রেখে তিনি জানিয়েছেন যে ‘অমন খাড়া ঢালে জল জমে হ্রদ তৈরি হওয়া মোটেই সম্ভব নয়। ফলে হিমহ্রদ উপচে পড়ার ফলে এমন বিপর্যয় ঘটেছে, এই তথ্য হয়তো ঠিক নয়। আর হিমবাহ ভেঙে এমন বিপর্যয় ঘটে থাকলে নদীখাত বরাবর খরস্রোতের ধারা এখনও অব্যাহত থাকত, অথচ তেমনটা এক্ষেত্রে হয়নি।’

তাহলে? এই কূটকাচাল আরও দীর্ঘায়িত হবে বলে মনে হয়, বিশেষ করে যতদিন না বিশেষজ্ঞদল ওই এলাকা সরেজমিনে তদন্ত করে আসতে পারছেন। এই অবসরে একটা অন্যতর দৃষ্টিকোণ থেকে বিষয়টিকে দেখা যাক।

 

এ খেলা চলবে নিরন্তর…..?

‘যখন আমি মন্ত্রী ছিলাম, আমার দপ্তর, হিমালয়ের উত্তরাখণ্ড রাজ্যে বাঁধ নির্মাণ সংক্রান্ত এফিডেবিটে, সংশ্লিষ্ট মহলকে স্পষ্টতই অনুরোধ করেছিল যে, ওই অঞ্চল সংস্থানিক গঠনের দিক থেকে অত্যন্ত দুর্বল ও সংবেদনশীল; সুতরাং কোনওভাবেই গঙ্গা ও তার প্রধান উপনদীর ওপর বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রের নির্মাণ বাস্তবসম্মত হবে না।’— এটি একটি টুইটের প্রতিলিপি। বিপর্যয়ের অব্যবহিত পরবর্তী সময়ে এমন অসংখ্য টুইটের মাধ্যমে বিপর্যয় সম্পর্কে নিজের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন পূর্ববর্তী এনডিএ পরিচালিত সরকারের জলসম্পদ, নদী উন্নয়ন এবং গঙ্গা পুনরুজ্জীবন দপ্তরের ভারপ্রাপ্র মন্ত্রী উমা ভারতী মহোদয়া। তাঁর মতে, চামোলির ঘটনা আমাদের কাছে এক শিক্ষণীয় সতর্কবার্তা।

একেবারে গোড়াতে উল্লিখিত বিপর্যয়ের সালতামামিতে ফেরা যাক৷  আলোচ্য তথ্যলিপি থেকে এই সত্য সততই প্রমাণিত হয় যে পর্বতসঙ্কুল উত্তরাখণ্ডের এই অঞ্চলটি ভূতাত্ত্বিক তথা সংস্থানিক গঠনের বিচারে অত্যন্ত ভঙ্গুর, সংবেদনশীল। এমনই এক টেকটনিক হটস্পটের ওপর বাঁধ নির্মাণের সিদ্ধান্ত মোটেই যুক্তিসঙ্গত নয়। যে অঞ্চলে এমন প্রলয়ঙ্কর ঘটনা ঘটেছে, সেই অঞ্চলেই নির্মাণ চলছিল তপোবন জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের। উল্লেখ্য, এই নির্মীয়মান বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রটি সম্পূর্ণরূপে ধুয়ে গেছে। অতঃকিম?

আজ উমা ভারতী তাঁর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় যে কথা বলেছেন তা কিন্তু খুব নতুন কথা নয়। ভাবতে অবাক লাগে, যে চামোলি একদিন ‘চিপকো’-র মতো এক অনুকরণীয় পরিবেশ আন্দোলনের পীঠভূমি হিসেবে সারা পৃথিবীর নজর কেড়েছিল, সেই চামোলি আজ ভাঙা বরফ চাঙড়ের চাপে বিপর্যস্ত, বিপন্ন। হিমালয় পার্বত্য অঞ্চলকে নিয়ে এক মারণ খেলায় মেতে উঠেছি আমরা। নিজেদের আরও ঝাঁ-চকচকে উন্নত দেখানোর আত্মগর্বী অস্মিতায় বুঁদ হয়ে আমরা নিরন্তর উপেক্ষা করে চলেছি আমাদের পরিবেশকে। দেবভূমিকে ভক্তকুলের কাছে আরও সুগম করে তোলার বাহানায় যথেচ্ছভাবে হিমালয়ের পরিবেশগত ভারসাম্যকে উপেক্ষা করে চলেছি। এর ফল মারাত্মক, ভয়ঙ্কর হতে বাধ্য। বিজ্ঞানীরা বিপর্যয়ের সম্ভাব্য কারণ খুঁজছেন প্রকৃতির অন্দরমহলে, অথচ শান্ত বসুধাকে অশান্ত করার পেছনে মানুষের অনিয়ন্ত্রিত কার্যকলাপের বিষয়ে আশ্চর্য রকমের নীরবতা পালন করছেন। ভাবের ঘরে এমন চুরি করলে প্রকৃতির দেনা শুধবার জন্য পর্যাপ্ত সময় পাওয়া যাবে তো? এখন গভীর ইতিবাচক ভাবনায় মজে ওঠার সময়। ‘বিকাশে’র অশ্বটাকে না হয় আস্তাবলে বেঁধে রাখা হোক। অন্তত কিছু সময়ের জন্য।