Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

প্রখর দাবির পথ পেরেক ফুটিয়ে স্তব্ধ করা যায় কি?

সমর্পিতা ঘটক

 



কবি, প্রাবন্ধিক

 

 

 

‘যায় যদি যাক প্রাণ, হীরকের রাজা ভগবান’— এই ধরতাই নামাবলির মতো লেপটে নিতে হবে। পাঠাশালা তো বন্ধ আছেই আর মগজধোলাই হয়নি যাদের আজও তাঁরা জেলে পচছেন। বাকিদের অবস্থা উটের মতো, বালিতে মুখ গুঁজে বিপদকে এড়িয়ে চলা। এখন মগজধোলাইয়ের নানা ধরন। কিছু সেলেবদের শেখানো বুলি বলিয়ে দাও। তাঁরা বিভিন্ন সময়ে, ভিন্ন অবতারে, কপি পেস্ট টুইটে বুঝিয়ে দেন দেশের ‘ভালো’, দশের ‘ভালো’, কোন আন্তর্জাতিক ‘শক্তি’ আমাদের খারাপ চায়, দেশপ্রেমের সংজ্ঞা এবং যৌক্তিকতা। প্রযুক্তি ট্রযুক্তি ব্যবহার করে বুঝিয়ে দেওয়া হয় আমরা লক্ষ রাখছি সব।

এ দেশের মানুষ চিরকালই খুব সামান্য চায়। খাওয়া, পরা ছাড়া বাকি সবকিছুই তাদের কাছে বাড়তি সুখ। ওইটুকু সামান্য চাওয়ার পথও ইনিয়েবিনিয়ে মিষ্টি কথা বলে, উদোর পিন্ডি বুদোর ঘাড়ে চাপিয়ে সমঝোতায় নিয়ে আসতে চায় সরকার। যেভাবে তারা চায় সেভাবে না হলে হুজ্জত পাকিয়ে, রাস্তায় পেরেক ফুটিয়ে, চোখ রাঙিয়ে, নিন্দা বদনাম করে বাঁকা আঙুলে ঘি তোলার বহুব্যবহৃত কায়দা ইস্তেমাল করা হয়, হয়ে এসেছে। কতখানি দুর্ভাগা দেশ তাই ভাবি! কৃষকদের ন্যূনতম দাবি নিয়ে পথে বসতে হয়। যে দাবি তাঁদের হকের, তার জন্য দরবার করতে হয়। ৭০ দিন ধরে ঘরবাড়ি ছেড়ে রাস্তায় বসে আছেন তাঁরা। দুশোর অধিক কৃষকের প্রাণ গেছে। আর আমরা টুইট যুদ্ধ দেখছি। রিহানার টুইটের আগে যেন সব ঠিক ছিল! নিজের ঘরবাড়ি, ক্ষেত খলিয়ান ছেড়ে ফুর্তির প্রাণ গড়ের মাঠ নিয়ে রাজধানীর রাজপথে রোদ পোহাচ্ছিলেন কৃষকরা। যেন বলিউডি মশালা ফিল্ম, ফর্মুলা মেনে ছকে ছক মিলিয়ে দিলেই হল! তারপর অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নাক গলিয়ে গ্রেটা থুনবার্গ, রিহানা, মিয়া খলিফা, সুসান সারানডান মহাপাতকী হয়ে গেলেন! হায় হায় ইয়ে কেয়া হুয়া! দেশের সম্মান বাঁচাতে ভারতরত্নরা নেমে পড়লেন। তাঁরা তো খান না খাবার, তাঁদের খাদ্য কেবল কপিপেস্ট বুলি। ধারণ করেন আর উগরে দেন। জর্জ ফ্লয়েডকে খুন করার পর এঁরাই লিখেছিলেন, ব্ল্যাক লাইফ ম্যাটারস। তখন কিন্তু আমেরিকা বলেনি আমাদের দেশের ঘটনায় তোমাদের গেরুয়া নাক ঢুকিও না। কৃষকের প্রাণ যাক, তাঁরা আত্মহত্যা করুক, অভিবাসী শ্রমিকরা রাস্তায় মুখ থুবড়ে পড়ে থাকুক, পেট্রোল, গ্যাসের দাম বাড়ুক, স্কুল দিনের পর দিন বন্ধ থাকুক… এদের কোনও মাথাব্যথা নেই। যত দেশপ্রেম সরকারের গায়ে আঁচ লাগলে। এই যে ৯৭১ কোটি টাকা খরচ করে সংসদ ভবন তৈরি হবে নতুন আঙ্গিকে, মণ মণ ঘি পুড়বে, ভরসা পূর্তি হবে, মূর্তি হবে, বাগান হবে, রোশনাই, আশনাই সব হবে— কেবল টুঁ কোরো না। কথা বোলো না, কেউ শব্দ কোরো না, ভগবান নিদ্রা গিয়েছেন, গোলোযোগ সইতে পারেন না।

কৃষকের অসহায় অবস্থা যেমন দেখেছে দেশ, অদৃষ্টের ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে হাহাকার করা, ঋণের বোঝা সইতে না পেরে নিজেকে শেষ করে দেওয়া, বন্যা, খরায় মরণ বুকে বাঁচা যেমন দেখেছে— তেমন নীলচাষের বিরুদ্ধে আন্দোলন, ঐতিহাসিক তেলেঙ্গানা আন্দোলন, জোতদারের বিরুদ্ধে তেভাগা আন্দোলন, সাম্প্রতিক কালের মহামিছিল থেকে আজকের এই ন্যূনতম সহায়ক মূল্যের দাবি ফেরত পাওয়ার লড়াইও তীব্র থেকে তীব্রতর হয়েছে এবং প্রতিবারই সরকার কৃষকের ন্যায্য দাবির কাছে নতি স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছে। কর্পোরেট মুনাফার কাছে মাথা ঝুঁকিয়ে থাকা বর্তমান সরকার এইভাবেই বারবার ছোট ব্যবসায়ী, অসংগঠিত শ্রমিক, কৃষকের গর্দানে কোপ মেরেছে। সরকারের দাবি ছিল, স্বামীনাথন কমিটির রিপোর্ট বাস্তবায়ন করে কৃষিক্ষেত্রের মধ্যস্বত্বভোগীদের ভূমিকা সঙ্কুচিত করা, কিন্তু এসব করতে গিয়ে ন্যূনতম সহায়ক মূল্য কিংবা এমএসপি, যা কৃষকরা এতদিন পেয়ে এসেছেন, তা তুলে দিতে চাইছে সরকার। কৃষকদের আশঙ্কা যে সত্যি তা উপলব্ধি করেই সুপ্রিম কোর্ট এই আইনের ওপরে স্থগিতাদেশ দিয়েছে। বড় কর্পোরেটদের হাতে একচেটিয়া সমস্ত স্বত্ব তুলে দিতেই এই আইন। মাঝারি ও ক্ষুদ্র আড়তদাররা এতদিন কৃষকদের হাত থেকে সমস্ত কৃষিপণ্য কিনে নিত। কিন্তু নতুন আইন লাগু হলে বড় বড় কর্পোরেটরা সরাসরি পণ্য কিনবে কৃষকদের কাছ থেকে এবং দাম তারা তাদের ইচ্ছেমতো কমিয়ে দেবে।

অতিমারির আবহে কৃষি সংস্কারের নামে যে তিনটি আইন নিমেষের মধ্য পাশ হল তাতেই প্রশ্নচিহ্ন উঠেছে। কোনও আলোচনার সুযোগ ছিল না, সিলেক্ট কমিটিতে পৌঁছল না— বিল পাশ হয়ে গেল! এত তাড়াহুড়ো কিসের জন্য? যাদের স্বার্থের জন্য আইন সংস্কার করা হচ্ছে তাদের মতামতের দাম নেই কোনও? এত কিছুর পরেও বিরোধী দলগুলোর অবস্থান হাস্যকর। তারা একজোট হয়ে কতটুকু প্রতিবাদ করছে এইসব চটজলদি পাশ হয়ে যাওয়া আইনগুলোর বিরুদ্ধে? কৃষক নেতারা হঠা্ৎ করে দিল্লিতে এসে অবস্থান করছেন না, তাঁরা তাঁদের মনোভাব বিভিন্নভাবে ব্যক্ত করেছেন এর আগে, সরকারের কাছে পেশ করেছেন নিজেদের অসন্তোষ, নিজেদের রাজ্যে আন্দোলন করেছে্ন অনেক দিন ধরে— কিন্তু কোনওকিছুই আমল দেয়নি বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকার। উপরন্তু দেশদ্রোহের তকমা। আগেকার দিনের কুচুটে জমিদারদের মতো শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে লোক ঢুকিয়ে গোলমাল পাকানোর চেষ্টা! প্রতিবেশী দেশ থেকে নিজের দেশের বিরোধী লোকমত সবই নাকি দেশের পরিপন্থী! জামিয়া, জেএনইউ, যাদপুরের ছাত্ররা, কৃষকরা, বিরোধী দল, পরিবেশকর্মী, সাংস্কৃতিক কর্মী, শিল্প সাহিত্য চলচ্চিত্র… যে ক্ষেত্রের, যে পেশার মানুষই হন না কেন সমালোচনা করলেই গদ্দার! নতুন আইন প্রণয়ন করে গৃহবন্দি, জেল খাটানো, শারীরিক, মানসিক নির্যাতন, এমনকি নিজের দেশের রাজধানীর রাস্তায় গজাল পুঁতে আন্দোলনকে স্তব্ধ করে দেওয়ার চেষ্টা। নিত্যদিনের পরিষেবা তুলে নিয়ে দিনের পর দিন মানবাধিকার লঙ্ঘন! কোথায়? বিশ্বের বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশে। গ্রেটা থুনবার্গের বিরুদ্ধে দিল্লি পুলিশের উচ্চপদস্থ কর্তা এফআইআর করছেন। গ্রেটা থুনবার্গের টুলকিট শেয়ার করায় গ্রেপ্তার হয়েছেন পরিবেশকর্মী দিশা রবি। দিল্লি পুলিশ দাবি করেছে, ওই টুলকিট খলিস্তানিদের তৈরি। হিংসা ছড়াবার উপাদান আছে ওতে।

‘আরবান নকশাল’, ‘টুকরে টুকরে গ্যাং’, ‘বহিরাগত’, ‘পোশাক দেখে বিক্ষোভকারীদের চিনতে পারা্’,‌ ‘দেশদ্রোহী’— এসবের পর আর একটি তকমা সামনে এল, ‘আন্দোলনজীবী’। এসব কথায় ভারতবর্ষের বৃহৎ ছবিটা পরিষ্কার হয়ে যায়। বিরোধিতার কথা বললেই কত সহজে সস্তা মোড়কে দাগিয়ে দেওয়া যায় এদেশে সে কথাই ভাবি। স্বাধীনতার আগে থেকেই কারা কারা এদেশে আন্দোলনজীবী ছিলেন সেসব ভেবে পুলকিত হই। আর এসব কথায় সাধারণ মানুষের মনের দোলাচলও কেটে যায়। তারা বুঝতে পারে কৃষকদের আন্দোলনকে মুখে ‘পবিত্র’ বলা হলেও তাদের রাস্তায় পেরেক ফুটিয়ে, কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে, বড় বড় সিমেন্টের চাঙর ফেলে, ইন্টারনেট, জল, যাবতীয় জরুরি পরিষেবা বন্ধ করে, আর নানা উপাধিতে ভূষিত করে দেশের নেতা, মন্ত্রীরা ঠিক কোন বার্তা দিতে চাইছেন! কী ধরনের পবিত্রতার মালা গাঁথতে চান তাঁরা কৃষকদের সম্মানার্থে! এর আগেও শাহিনবাগের আন্দোলন নিয়েও এমন সব কুৎসিত উচ্চারণ সামনে এসেছে। তবে যত কুকথা উচ্চারিত হবে ততই আন্দোলনের জোর বাড়বে, ইতিহাস সাক্ষী।

কিন্তু প্রধান বিরোধীদলগুলোর অবস্থা দেখে করুণা হয়। তাঁরা এখন আন্দোলনের পক্ষে গিয়ে অনেক কথা বলছেন। কিন্তু সেসব যেন নিজেদের পালে হাওয়া লাগানোর জন্যই। কৃষক নেতারা যে অনমনীয় মনোভাব নিয়ে আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছেন তেমন দৃঢ়তা দেশের প্রধান বিরোধী দলগুলোর প্রথম সারির নেতাদের মধ্যে দেখা যায়নি। যদি প্রথম থেকেই আন্দোলনে জোর থাকত তাহলে কৃষকদের এমন দিন দেখতে হত না। ভারতীয় কৃষক ইউনিয়নের নেতা রাকেশ টিকায়েত, যাঁকে এখন চেনেন সকলে, তিনি একটি সাক্ষাৎকারে বলছিলেন, “এই দেশে যে কোনও সরকারবিরোধী আন্দোলনে, প্রতিবাদীদের বিরুদ্ধে কেস করে সরকার। আর এসব আসলে প্রতিবাদীদের কাছে শংসাপত্র, যদি কেস না হয় তাহলে বুঝতে হবে আন্দোলনকারী আর সরকারের মধ্যে কোনো সমঝোতা হয়ে গেছে।” বিরোধী দলগুলোর এমন ধরি মাছ না ছুঁই পানি মার্কা আচরণ যতদিন থাকবে ততদিন একপেশে রাজনীতির ধ্বজা উড়বে, ক্ষমতার বদল হবে কিন্তু দেশ যে তিমিরে ছিল সেই তিমিরেই থাকবে।