Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

কিছু গন্ধ কিছু আলো

অয়নেশ দাস

 



গদ্যকার, বিজ্ঞাপনজগতের সঙ্গে যুক্ত

 

 

 

 

 

কিছু অলৌকিক গন্ধ ছিল।

স্মৃতির ভাঁজে-ভাঁজে, অনন্ত ভুলভুলাইয়ায় যেন হারিয়ে যাওয়ার মতো করে লুকিয়ে থাকে যারা। যেন ছিলই না তারা আদৌ। তারপর হয়তো এমন কিছু ঘটে যায়— তীক্ষ্ণ সুড়ঙ্গ লহমায় খোঁড়া হয়ে যায় চেতনার গভীরে— ঘটে যায় অগ্ন্যুৎপাত। স্মৃতির ভাঁজ খুলে যায়।

কর্পোরেশানের জলে ধোওয়া, বর্ণহীন, গন্ধহীন, অবসাদগ্রস্ত যাপনপথ হু হু করে ছাড়িয়ে ছুটে চলে বুকের ভেতর মফস্বলের লোকাল। দুই দিকে জেগে ওঠে ভারতবর্ষ। সেই সব মুখ। কাদাজলে ডোবা সেইসব পায়ের পাতা। স্মৃতির ভাঁজ খুলে যায়।

কনুই আর হাঁটু পর্যন্ত শুকিয়ে যাওয়া কাদাজলের প্রলেপে মাখা কাঁচা ধানের গন্ধ। ধান ঝাড়াই-এ ছড়ে যাওয়া, খড়ি ফোটা চামড়ায় দেগে যাওয়া পাকা ধানের গন্ধ। কাঠ-কয়লার গন্ধ ছাপিয়ে ধান সিদ্ধের ডেকচি থেকে উবতে থাকা ধোঁওয়া-ধোঁওয়া নতুন চালের গন্ধ। এবং শেষে ফুটন্ত হাঁড়িতে গুবগুব শব্দে মিশে থাকা গরম ভাতের গন্ধ। গন্ধ থেকে গন্ধে চুঁইয়ে চুঁইয়ে জিইয়ে ওঠে জীবনের বর্ণমালা। স্মৃতির ভাঁজ খুলে যায়।

সুপারমার্কেটের চালের প্যাকেটে লেখা থাকে ক্যালোরি আর নিউট্রিয়েন্টস্‌-এর তুল্যমূল্য তালিকা। যা লেখা থাকে না তা হল এই গন্ধ থেকে গন্ধে বয়ে চলার আখ্যান, শ্রম থেকে সৃষ্টিতে বয়ে চলার আখ্যান, বীজ থেকে স্বপ্নে বয়ে চলার আখ্যান। এই আখ্যানমালা থেকে গড়ে ওঠে এক অনন্য শাশ্বত সমীকরণ; বীজ > মাটি-জল-বাতাস-শ্রম-জ্ঞান-স্বপ্ন > ফসল > বীজ। যেদিন থেকে মানুষ আবিষ্কার করেছিল একটি বীজের অন্তঃস্থ সম্ভাবনা; যেদিন থেকে মানুষ আয়ত্ত করেছিল রুক্ষ মাটিকে উর্বর করে তোলার পরম জ্ঞান; সেই দিন থেকেই মানুষ হয়েছিল এই গ্রহের সর্বোত্তম জ্ঞানী। যে জ্ঞান বিকশিত হয়ে চলে হাজার হাজার বছর ধরে প্রকৃতি-পরিবেশ-বাস্তুতন্ত্রের সঙ্গে মানুষের এক নিবিড় মিথোষ্ক্রিয়ার আখ্যানময়তায়।

সে ইতিহাস আজকের বিকাশের প্রকল্পে থাকে স্মৃতির ভুলভুলাইয়ায় হারানো। বিস্মৃতির বিচ্ছিন্নতায় হারানো। নয়া উদারবাদী স্বপ্নে হারানো। ‘চাষির ছেলেকে চাষিই কেন হতে হবে? চাষির পরিচয় ছাড়া অন্য কোনও ভালো কিছু পরিচয় কি তার হতে পারে না!’— এই প্রগলভতায় হারানো। ফসলের গায়ে জেগে থাকা স্বপ্নদের, অনন্ত লাভের কচকচিতে নিষিক্ত প্যাকেটজাত পণ্যে রূপান্তরেরসংকোচনে হারানো।

জন্মসূত্রে ছিন্নমূল পরিবারের এই আমি কৃষিকাজের যোগ্যতা হারিয়েছি দুই পুরুষ আগেই। আমার দুই হাতে সেই সৃষ্টির অপরূপ কারিগরির লেশমাত্র নেই। যদিও এক মফস্বলী ছেলেবেলার দৌলতে, নেহাতই কাছাকাছি থাকার সুবাদে, সেই কিছু অলৌকিক গন্ধ ছড়িয়েছিটিয়ে যায় আমারও নিজস্ব ভুবনে। কিন্তু বহু-বহু দিন আগেই তামাদি, অপাংক্তেয় রঙের মতো তারা হারিয়ে যায় চেতনার গ্রহান্তরে। আমার যাপনচিত্র ছয়লাপ হয়ে থাকে কেতাবি মেনুকার্ডে, যেখানে গুবগুব শব্দে মাখামাখি গরম ভাতের গন্ধ নেই। আমার ইন্দ্রিয় আর চেতনার মধ্যে ঘটে গিয়েছে দুস্তর ব্যবধান। আমি বেঁচে থাকি খাদ্যগ্রহণে নয়, খাদ্যের অতলান্ত কনজিউমে। আজ এই আমাকে ঘিরে কোথাও কোনও অলৌকিক গন্ধরা নেই।

তারপর এমন কিছু ঘটে যায়—

সেই শাশ্বত স্বপ্ন ও সৃষ্টির অস্তিত্ব রক্ষার দাবীতে ওরা রাষ্ট্রের চোখে চোখ রেখে দাঁড়িয়ে পড়ে হাজারে হাজারে সিংঘু-টিকরির সীমান্তে। ওরা কৃষিকাজ করে। ওরা জানে মাটি-জল-বাতাসে কীভাবে ফসল ফলাতে হয়। কীভাবে বাঁচিয়ে রাখতে হয় বীজ— বীজের স্বপ্ন; ফসল থেকে ফসলে— পরম্পরা থেকে পরম্পরায়। ওরা বাঁচাতে জানে। ওরা বাঁচতেও জানে। তাই ওরা মাটির, ফসলের অধিকারের জন্য শহীদও হতে জানে। ওদের ছেলে-মেয়েরা সোচ্চার উচ্চারণে বলতে পারে— ‘হ্যাঁ, আমি কৃষক সন্তান। এটাই আমার পরিচয়।’ মাটি কেঁপে ওঠে কৃষকের আশ্চর্য প্রতিরোধে। প্রতিস্পর্ধায়। আমারও ঘুম ভেঙে যায়। যতদূর চোখ যায় আমি দৃষ্টি চালিয়ে দিই। সিংঘু-টিকরির সীমান্তে লক্ষ লক্ষ মানুষ। ওরা কৃষিকাজ করে। ওদের করতলে মাখামাখি বীজের আহ্লাদ। ওদের আঙুলের ফাঁকে ফাঁকে জমে থাকে ফসলের আঘ্রাণ। ওদের লঙ্গরের হাঁড়ি থেকে ভেসে আসে গুবগুব গরম ভাতের গন্ধ।

আমার চেতনার গভীরে ঘটে যায় অগ্ন্যুৎপাত। স্মৃতির ভাঁজ খুলে যায়। আমার বুক সেই মফস্বলি লোকালের গতিতে ছুটতে চায় সিংঘুতে, টিকরিতে। স্মৃতির লুকানো প্রকোষ্ঠ থেকে বেরিয়ে পড়ে কার্তিকের জোনাকিরা।

সিংঘু-টিকরির সীমান্তে আজ সেই সব কিছু অলৌকিক গন্ধরা জমা হয়ে আছে।

কিছু অলৌকিক মশাল ছিল।

মাটির ওপর গভীর অন্ধকার নেমে এলে আলো দিত। পথ করে দিত। দিত পথ চিনে নেওয়ার শক্তি। ছিল নিভন্ত মশাল থেকে নতুন মশাল জ্বালিয়ে নেওয়ার রীতি। যেমন করে মানুষ আয়ত্ত করেছিল এই গ্রহে বেঁচে থাকার, বাঁচিয়ে রাখার অনিন্দ্যসুন্দর জ্ঞান। ব্যক্তিমানুষের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে সেই জ্ঞান শেষ হয়ে যেত না। প্রবাহিত হয়ে চলত প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে। কিন্তু যদি ছেদ পড়ে যায় এই প্রবাহধারায়? যদি ভুলে যাই নতুন মশাল জ্বালিয়ে নিতে?

শেষ মশালটিরও আলো নিভে গেলে আমরা দুচোখ বন্ধ করে ফেললাম। হালকা বুকে, বন্ধ চোখে, নিভু নিভু আলোর খোঁয়ারি চলল অনেক দিন। তারপর একদিন হঠাৎ পাঁজরেরর ওপর চাপ চাপ অন্ধকারের ভারে সেই দীর্ঘ খোঁয়ারি গেল কেটে। চোখ খুলে দেখলাম অন্ধকার অবয়ব নিয়ে ফেলেছে। গ্রাস করে চলেছে আমাদের নদী, বাতাস, সফেন সমুদ্র। গ্রাস করে চলেছে আমাদের অরণ্য, বহুফসলি মাটি। গ্রাস করে চলেছে আমাদের পরিবেশ, সজীব বাস্তুতন্ত্র। গ্রাস করে চলেছে আমাদের ঘর, উঠোন, ইতিহাস, অর্জিত নৈতিক অধিকার। গ্রাস করে চলেছে আমাদের সংস্কৃতি, সম্পর্ক, উত্তাপ আর ভালোবাসা। এমনকি আমাদের কণ্ঠস্বর।

প্রতিবার শেষ মশালটি যখন জ্বলে, অন্ধকার খুব কাছেই ওঁত পেতে থাকে। যখন বুঝলাম তখন এত দেরি হয়ে গিয়েছে যে অন্ধকারের বর্শামুখ ভেদ করে ফেলেছে আমাদের পাঁজর। অবাক হয়ে দেখলাম আমরা আর পারছিলাম না নতুন মশাল জ্বালিয়ে নিতে। একটুও আলো থাকল না আমাদের হাতের মুঠোয়। আসলে আমরা ভুলে গিয়েছিলাম মশাল জ্বালানোর বীজমন্ত্র। ক্রমশ এই গ্রহ, এই দেশ চলে যেতে থাকল মুনাফার লালসাময় অন্ধকারের নীচে। ভোগের অতল অন্ধকারের নীচে। ক্ষমতার উদগ্র অন্ধকারের নীচে। ঘৃণার চিরবিনাশী অন্ধকারের নীচে। এক সর্বগ্রাসী, অতলান্ত ডিস্টোপিয়ার নীচে।

আমরা নিরুপায়। কারণ আমাদের শেষ মশালটিও নিভে গিয়েছে।

তবে ওরা কারা? শীতার্ত ঘনকৃষ্ণ অন্ধকারের গভীরে দীর্ঘস্থায়ী ফসফরাসের মতো ফুটে উঠছে এক একটি আলোর ফুলকি! এক থেকে দুই-এ! দুই থেকে চারে! চার থেকে সহস্রে— লাখে লাখে! ওরা কারা এ অসময়ে?

‘এই পৃথিবী আমরা পূর্বপুরুষদের থেকে লাভ করি না, বরং ধার করি আমাদের উত্তরপুরুষদের থেকে।’* এই প্রবাদ আমরা ভুলে গেলেও ওরা ভোলেনি। ওরা ভোলেনি কারণ ওরাই প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে ছড়িয়ে চলেছে বীজ থেকে অঙ্কুরোদ্গমের অনুপম শৈলী। ওরা ভোলেনি কীভাবে রক্ষা করতে হয় ক্ষেত, পেকে ওঠা ফসল। ওরা ভোলেনি উত্তরপুরুষের অধিকার। ওরা ভোলেনি মশাল জ্বালানোর বীজমন্ত্র। সেই বীজমন্ত্র নিয়ে ওরা সমবেত সিংঘু-টিকরির সীমান্তে। অন্ধকারের মুখোমুখি।

সিংঘু-টিকরির সীমান্তে হাতে হাতে জ্বলে উঠছে মশাল। যদি নেভেও বা কোনও এক, জ্বলে উঠছে অনেক। জ্বলে উঠছে চেতনাধারায়। জ্বলে উঠছে সারা দেশে। জ্বলে উঠছে উত্তরপুরুষে।

জ্বলে উঠছে মশালের এক-একটি নাম। জ্বলে উঠছে নোদীপ, নভরীত, শিউকুমার, মনদীপ, দিশা রাভি। ডিস্টোপিয়ার মুখোমুখি।

সিংঘু-টিকরির সীমান্ত থেকে সেই সব অলৌকিক মশালেরা ছড়িয়ে পড়ছে। দূর দূরান্তে।


*নেটিভ আমেরিকান প্রবাদ