Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

চামোলি, চিপকো, চৌড়ি সড়ক, চাঙড়…

সোমনাথ মুখোপাধ্যায়

 


গদ্যকার, প্রাবন্ধিক, অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক

 

 

 

তিন দশকেরও আগের কথা। শিক্ষকতা জীবনের একেবারে সূচনা পর্ব। ষষ্ঠ শ্রেণির বাছাই করা জনা দশেক ছাত্রকে নিয়ে আমরা দুই তরুণ শিক্ষক রওনা দিলাম পুরুলিয়ার উদ্দেশ্যে। আমাদের চিরতরুণ হেডমাস্টারমশাই অবশ্য দুদিন আগেই রওনা দিয়েছেন। আমরা যাব অযোধ্যা পাহাড় পরিক্রমা যাত্রায় অংশ নিতে। আমাদের আগাম জানানো হয়েছিল পদযাত্রায় পা মেলাতে সুদূর উত্তরাখণ্ড (তখনও অবশ্য রাজ্যটি স্বতন্ত্র হয়ে ওঠেনি) থেকে আসছেন ‘চিপকো বহিনেরা’। অযোধ্যা পাহাড়কে, তার ক্ষয়ে যাওয়া বন-পরিবেশকে রক্ষা করবার জন্য সচেতনতা পদযাত্রায় সামিল হবেন তাঁরা। তাঁদের সঙ্গে পায়ে পায়ে হাঁটবেন আরও বহু মানুষ, হাঁটব আমরাও। সে এক রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা।

সেটা ১৯৭৩ সাল। উত্তরাখণ্ডের চামোলি অঞ্চলের মানুষজন সরকার নিযুক্ত ঠিকাদারদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ালেন। দেশে তখন উন্নয়নের কাড়া-নাকাড়া সবে বাজানো শুরু হয়েছে, তার টাট্টুঘোড়ায় সওয়ার হওয়ার জন্য কোমর বেঁধে তৈরি হয়েছেন সকলে। এহেন ব্যস্ত সময়ে এমন বেসুরো আন্দোলন কেন ওই দূর পাহাড়তলির গ্রামে! চামোলির রেনে গাঁওয়ের মানুষদের অভিজ্ঞতা অবশ্য অন্য কথা বলে। অলকানন্দার অকৃপণ সাহায্যে লালিত মানুষজন লক্ষ করেন তাঁদের এতদিনের সহচরী নদী যেন হঠাৎ অন্য সুরে গাইছে, নদীর শান্ত কূল উপচে উঠে আসছে জল, ভাসিয়ে দিচ্ছে ঘর-দোর-উঠোন, বিপন্ন মানুষের জীবন। কেন এমন হচ্ছে? দেবভূমিতে কোনও পাপের স্পর্শ লাগল? সবাই তখন এই বিপর্যয়ের কারণ খুঁজতে ব্যস্ত। উত্তর অবশ্য মিলল কিছুদিনের মধ্যেই। পাহাড়ের ঢালের যে মাটি, বন, বুগিয়াল বা চারণভূমিকে জড়িয়ে ধরে এতদিনের যাপন সেই বনেই সহসা লেগেছে উন্নয়নের আগুন। শহুরে ঠিকাদার আর তাদের শাণিত যান্ত্রিক কুঠারের আঘাতে কাটা পড়ছে পাহাড়ি ঢালের উপর পরম মমতায় মাথা তুলে দাঁড়িয়ে থাকা মহাদ্রুমেরা; মাটির বাঁধন আলগা হয়ে বেরিয়ে আসছে নিচে থাকা পাথুরে কঙ্কাল; মাটি ধুয়ে জমা হচ্ছে নদীখাতে; ভরে উঠছে নদীখাতের বুক; কমছে নদীর জল ধরে রাখার ক্ষমতা; বাড়ছে বন্যা, আশঙ্কা, দুর্গতি। এসব কথা— চামোলির মনকথা— আমরা শুনেছিলাম ঝালদার এক স্কুলের লাগোয়া মাঠে, এক জোছনা ভরা চাঁদনি রাতে চিপকো বহিন দেবিকা দেবীর মুখে। ‘তারপর কী হল? ঠিকাদারের লোকেরা বড় বড় গাছগুলো কেটে নিয়ে গেল?’— ভিড়ের মধ্যে থেকে উঠে আসে এক নবীন কিশোরের উদ্যত প্রশ্ন। একটু হেসে প্রত্যয়ী কণ্ঠে দেবিকা দেবী আবার শুরু করেন তাঁর কথা, চামোলির মনকথা। ‘ঔর কেয়া হোগা রে বাবুয়া! আমরা তো রুখে দাঁড়ালাম ঠিকাদারদের বিরুদ্ধে। আমাদের নেতা চণ্ডীপ্রসাদ ভাটজি, সুন্দরলাল বহুগুনাজি আমাদের বোঝালেন পরিবেশ-সমস্যার নানা দিক। আমাদের মতো পাহাড়জীবী মানুষেরা প্রকৃতির রুদ্ররূপের সঙ্গে পরিচিত। পাহাড়ে ধস নামা বা ভূমিকম্পের সঙ্গে আমরা যুঝতে শিখেছি একেবারে মা-বাপের কোলেপিঠে চড়ার বয়স থেকে। তোমাদের যেমন সবকিছু ওই কিতাব পড়ে পড়ে শিখতে হয়, আমাদের শেখাটা তো ঠিক তেমন ধারার নয়। আমরা প্রকৃতি মায়ের সঙ্গে নিরন্তর লীলা করতে করতেই সব শিখে যাই। কিন্তু এবারের ঘটনা যে সম্পূর্ণ আলাদা। তাই ঠিকাদারদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো ছাড়া আর কোনও উপায় ছিল না। কাঠুরেদের ঘাতক যান্ত্রিক কুঠারের সামনে বুক চিতিয়ে লড়াইয়ে নামলাম আমরা। পাহাড়ের ঢালে মাথা উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা গাছগুলোকে গভীর আশ্লেষে জড়িয়ে ধরে আমরা, রেনে গ্রামের ‘আনপঢ়’ মহিলারা, সূচনা করলাম ‘চিপকো’ আন্দোলনের।’ রেনে থেকে ‘সেই বার্তা রটি গেল ক্রমে’। চামোলি থেকেই শুরু হল নতুন এক ভাবনার, প্রকৃতির অনুশাসনগুলোকে মেনে চলার ভাবনার। প্রকৃতির ঐক্যসূত্রগুলোকে মেনে চললে আমাদের জীবন টেকসই হবে। তার সিম্ফনিকে উপেক্ষা করা মানেই প্রকৃতিকে রুষ্ট করা।

আজ এত বছর পরেও চাঁদনি রাতের সেই ‘চলিশা’ কানে বাজে, অথচ আমরা কোনও শিক্ষাই নিইনি। কখনও ‘উন্নয়নের’ নামে, কখনও বা ‘বিকাশের’ নামে আমরা একের পর এক প্রকৃতিবিরুদ্ধ কাজ করে চলেছি, যার ফলে পবিত্র দেবভূমির বিপন্নতা বাড়ছে। সদ্যঘোষিত চারধাম সড়ক সংযুক্তি প্রকল্পের কথাই ধরা যাক। উত্তরাখণ্ডের চার প্রধান তীর্থক্ষেত্র বা ধামকে একটিমাত্র প্রধান সড়কপথের মাধ্যমে যুক্ত করার পরিকল্পনা করেছেন বর্তমান সরকার। প্রধানমন্ত্রীর এই স্বপ্নপ্রকল্প রুপায়ণে আনুমানিক ব্যয় ধরা হয়েছে ১২০০০ কোটি টাকা। প্রধান সড়কের সঙ্গে যুক্ত হবে অসংখ্য বাইপাস, সেতু, ভায়াডাক্ট, পিট স্টপ, পার্কিং লট, হেলিপ্যাডের মতো অত্যাধুনিক সহযোগী পথ-পরিষেবা ব্যবস্থা। ৭১৯ কিমি দীর্ঘ ১০ মিটার প্রস্থ বিশিষ্ট এই মূল সড়কপথটি যুক্ত করবে একাধারে গঙ্গোত্রী, যমুনোত্রী, কেদারনাথ ও বদ্রীনাথধামকে। এমন একটা সড়ক নির্মাণ প্রকল্পের কাজ যে উত্তরপ্রদেশের নদীবিধৌত সমতলপৃষ্ঠবিশিষ্ট সমভূমিতে হচ্ছে না সে কথা বুঝবে কে? হিমালয়ের মতো অতি সংবেদনশীল, ভঙ্গুর পীঠভূমির উপর যে কোনও নির্মাণই অত্যন্ত ঝুঁকিবহুল, বিপজ্জনক; কিন্তু সে কথা শুনছে কে? মানছে কে? ‘বিকাশ পুরুষে’র স্বপ্নকে সাকার করে তুলতে গিয়ে আগামী দিনে আরও ‘কত প্রাণ হবে বলিদান’ তা কে জানে! দুর্গম পার্বত্য অঞ্চলে একটি ‘অল ওয়েদার রোড’ তৈরি করতে গিয়ে প্রথমেই কোপ পড়ছে হিমালয়ের বনরাজির উপর। এই কর্তনযজ্ঞের ওপর কোনও নিয়ন্ত্রণ নেই। প্রতিদিন শয়ে শয়ে ট্রাক কাটা গাছের কাঠে খোল বোঝাই করে নেমে আসছে নিচে। এই ঘটনায় আতঙ্কিত চিপকোর চামোলি। এমন দৃশ্য প্রত্যক্ষ করার জন্যই কি একদিন জীবন বাজি রেখে আন্দোলনে সামিল হয়েছিল চামোলির মানুষেরা? অথচ প্রধানমন্ত্রী লোকসভায় সদম্ভে ঘোষণা করেছিলেন যে এই গৌরব প্রকল্প রুপায়ণ করতে গিয়ে যে পরিমাণ অরণ্যভূমি বিনষ্ট হবে সেই পরিমাণ বনভূমি সৃজন করবে সরকার। এখনও পর্যন্ত এই প্রতিশ্রুতি রক্ষার কোনও প্রয়াস নেই। আর তাছাড়া সরকারি প্রতিশ্রুতি আর কবেই বা রক্ষিত হয়েছে আমাদের এই পোড়া দেশে! বিস্তৃত দুর্গম পার্বত্য পটভূমিতে সড়ক জাল নির্মাণ করতে গিয়ে বিপুল পরিমাণ বনরাজি ইতোমধ্যেই পাহাড়ের বুক থেকে লোপাট হয়ে গেছে। এক সরকারি পরিসংখ্যান থেকে জানা যাচ্ছে যে ১৯৯১ সাল থেকে ২০২১ সালের মধ্যবর্তী সময়ে ৫৮৬৮৪ হেক্টর পরিমিত বনাঞ্চল সম্পূর্ণভাবে উজাড় হয়ে গিয়েছে রকমারি বিকাশ কর্মের যূপকাষ্ঠে। এইসব বহুবিধ কর্মকাণ্ডের মধ্যে রয়েছে খনিজ সম্পদ উত্তোলন, জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন, সড়ক নির্মাণ এবং অতি অবশ্যই প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে আরও সুরক্ষিত করার লক্ষ্যে বহুবিধ কর্মকাণ্ড। উত্তরাখণ্ড রাজ্যের মোট তেরোটি জেলার মধ্যে বৃক্ষহননের বিচারে শীর্ষে অবস্থান করছে তেহরি গাড়োয়াল, চামোলি, আলমোড়া, পিথোরাগড়-এর অতি সংবেদনশীল পার্বত্য জেলাগুলি।

বিষয়টি অনেকটা কাকতালীয় মনে হলেও সত্যি যে বিগত তিন দশক সময়কালের মধ্যে (১৯৯১-২০২১) উত্তরাখণ্ডকে পাঁচটি বড় রকমের প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের সম্মুখীন হতে হয়েছে— উত্তরকাশী ভূমিকম্প (১৯৯১), মালপার ভূমিধস (১৯৯৮), চামোলির ভূমিকম্প (১৯৯৯), কেদারনাথের মেঘভাঙা বৃষ্টি ও প্রবল বন্যা (২০১৩) এবং অতি সাম্প্রতিক কালের চামোলির হিমানিসম্প্রপাত (২০২১)। কার্যকারণ সূত্রের নিয়মমাফিক বিশ্লেষণ সূত্রে বলা যায় যে ভূমিকম্পের ঘটনাদুটির ক্ষেত্রে ভূ-অভ্যন্তরীণ শক্তির প্রভাব থাকলেও বাকি তিনটি ঘটনায় বাহ্যিক প্রক্রিয়ারই প্রাধান্য রয়েছে। মনে রাখতে হবে যে প্রকৃতির সমস্ত ঘটনাই কোনও না কোনওভাবে পরস্পর নিবিড় সম্পর্কে সম্পর্কিত। যেমন ভূমিকম্পের ফলে ভূমিধস যেমন হয়, তেমনই প্রবল ধসের ফলে পার্বত্য অঞ্চলে ভূমিকম্পও ঘটতে পারে। বাস্তব সত্যটা হল এই যে তথাকথিত উন্নয়নের নামে আমরা হিমালয় পর্বতকে নিয়ে এক মারণ খেলায় মেতে উঠেছি।

নগাধিরাজ হিমালয় আমাদের প্রাকৃতিক ও আত্মিক সম্পদ। এই চিরন্তন শাশ্বত সত্যকে আমরা আমাদের চিন্তন ও কর্মে তেমনভাবে গ্রহণ করিনি। পশ্চিমে নাঙ্গা পর্বত থেকে পূর্বে নামচাবারওয়া পর্যন্ত প্রায় আড়াই হাজার কিলোমিটার বিস্তৃত এই পর্বত জুড়েই চলেছে চোখধাঁধানো সব উন্নয়ন প্রকল্প রূপায়ণের কাজ— রাস্তা, বাড়িঘর, হোটেল, পার্কিং লট, জলবিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র ইত্যাদি। ২০১৩-র ভয়ঙ্কর হড়পা বানের ক্ষত মুছতে না মুছতেই চামোলিতে আবারও ঘটল বিপর্যয়। লক্ষ লক্ষ, কোটি কোটি টাকা খরচ করে এমন সব জাঁকজমকপূর্ণ আয়োজনের আদৌ কোনও প্রয়োজন আছে? সাম্প্রতিক হিমানিসম্প্রপাতের ঘটনার অনুষঙ্গে তাঁর একান্ত অনুভবের কথা বলতে গিয়ে People’s Science Institute-এর ডিরেক্টর শ্রী রবি চোপড়া মহোদয় ঠিক কী বলেছেন তা এই প্রসঙ্গে আলোচনা করা যেতে পারে। দ্য হিন্দু পত্রিকায় এক সাক্ষাৎকারে তিনি জানিয়েছেন—

হিমবাহ অধ্যুষিত অঞ্চলে বাঁধ নির্মাণ সবসময়ই অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ এবং সুস্থিত উন্নয়ন (Sustainable Development) ভাবনার পরিপন্থী। অথচ সেইসব সতর্কবার্তার প্রতি সামান্যতম মান্যতা না দিয়েই অবাধে চলছে বাঁধ নির্মাণের কাজ। আমরা বারংবার জানিয়েছি যে ২২০০ মিটারের বেশি উচ্চতায় জলবিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র স্থাপন একদমই পরিবেশবিরুদ্ধ কাজ। অথচ তেমনটাই হচ্ছিল। এখন এমন একটা বিপর্যয় কেন ঘটল তার কারণ খুঁজতে সবাই ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। অথচ যে মানুষগুলো মারা গেলেন, তাঁদের কাছে, তাঁদের পরিজনদের কাছে স্বজন হারানোর যন্ত্রণাটাই মুখ্য, হিমবাহের ভেঙে পড়াটা নয়। নিষেধ, সতর্কতা সত্ত্বেও যখন এমন অবৈধ নির্মাণের কাজে হাত দেওয়া হয় তখন সেই বিপর্যয়কে ম্যানমেড বা মানুষের তৈরি বিপর্যয় বলতে আপত্তি কোথায়?

এই প্রবন্ধের শেষাংশটুকু লেখার কথা যখন ভাবছি তখনই একটি সংবাদ নজরে এল— ঋষিগঙ্গা নদীতে নতুন করে জল বাড়তে শুরু করেছে। সাম্প্রতিক সম্প্রপাতের ফলে বিপুল পরিমাণ অবস্কর এসে জমা হয়েছে নদীখাতে। ফলে অবরুদ্ধ হয়েছে নদীর গতিপথ। প্রাকৃতিক বাঁধের পেছনে জমা হচ্ছে বরফগলা জল, যা একটু একটু করে হ্রদের চেহারা নিতে চলেছে। এই আবদ্ধ জল যখন বাঁধ উপচে নতুন করে খাতপথে বইতে শুরু করবে তখনই হয়তো ঘটবে সদ্য ঘটা প্লাবনের পুনরাবৃত্তি। এখন বিদায়ী শীতের রেশ চলছে, ফলে বরফের গলন হার এখনও শ্লথ। খুব বেশি জল হয়তো এখনও জমা হয়নি। সেই কারণে অনুমান আগের মতো বড় মাপের বিপর্যয় হয়তো এবারে ঘটবে না। তবু আশঙ্কা থেকেই যায়।

এমনই আশঙ্কা নিয়েই বেঁচে আছে চামোলির মানুষ, উত্তরাখণ্ডের মানুষ, হিমালয়কে আশ্রয় করে বেঁচে থাকা, লড়াই করে বেঁচে থাকা লক্ষ লক্ষ মানুষ। এই সব মানুষদের কৃষ্টি-সংস্কৃতি, আনন্দ-বেদনা, হাসি-কান্না সবকিছুই তাদের আত্মার আত্মীয় হিমালয়কে ঘিরে। কেবল মানুষ নয়, হিমালয়ের বিপুল জীব-বৈচিত্র, হরিৎ বনরাজি, অসংখ্য ভেষজ গুল্ম সবকিছুই হিমালয়ের অস্তিত্বের উপর নির্ভরশীল। বেঁচে থাকার যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা তারা অর্জন করেছে প্রকৃতির সঙ্গে নিবিড় স্বতঃস্ফূর্ত যাপনসূত্রে, তাকে বিপন্ন করার অধিকার আমাদের কে দিল? গুটিকয় মানুষের দ্বারা, গুটিকয় মানুষের জন্য উন্নয়নের নামে, বিকাশের নামে এই চরম অবিমৃশ্যকারিতা বন্ধ হোক। ভাবা হোক উন্নয়নের বিকল্প পথ ও উপায় নিয়ে। আর দেরি নয়, এখনই শুরু হোক নতুন পথের পথচলা। এখনই…

ইতোমধ্যেই চামোলির প্রায় চার শতাধিক পার্বত্য গ্রামকে জনশূন্য করার কথা ঘোষণা করেছে উত্তরাখণ্ড সরকার। এই কাজে আনুমানিক ব্যয় করা হয়েছে ১০০০০ কোটি টাকা। কে যোগাবে এই বিপুল অর্থ? এক পরিবেশে সুদীর্ঘ যাপন অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ একদল মানুষকে তুলে নিয়ে গিয়ে অন্যত্র কোথাও বসিয়ে দিলেই সমস্ত সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে? এই বালখিল্যতা আর কতদিন দেখতে হবে আমাদের? খুব বিনম্রভাবে প্রশ্ন করতে ইচ্ছে করে— নদীতে বাঁধ দিয়ে জলবিদ্যুৎ উৎপাদন, বন কেটে বসত, হোটেল, রিসর্ট নির্মাণ, চৌড়ি সড়ক প্রকল্প গ্রহণের দাবি কি স্থানীয় মানুষজন কখনও করেছিল? এমন সব উচগ্রাম প্রচারে বাঁধা বিকাশ প্রকল্প গ্রহণের আগে এই অঞ্চলের মানুষদের সম্মতি বা অনুমোদন নেওয়া হয়েছিল কখনও? সব প্রশ্নের একটাই উত্তর— না। স্থানীয় মানুষজনের অনুমোদনহীন এমনই সব ‘ডবল ইঞ্জিন’ প্রকল্পের ঢক্কানিনাদে কান পাতাই দায়। মনে পড়ে অধ্যাপক জিডি আগরওয়ালের সেই আশঙ্কিত অনুরোধের কথা। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীজিকে লেখা তিনটি পত্রে তিনি অনুরোধ করে লিখেছিলেন— “অলকানন্দা, ধৌলিগঙ্গা, নন্দাকিনী, পিন্ডার এবং মন্দাকিনী নদীতে বাঁধ দিয়ে জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের সমস্ত প্রকল্পগুলি অবিলম্বে বাতিল করুন। বন্ধ হোক সমস্তরকম খনিজ উত্তোলনের প্রকল্প।” কোনও সাড়া না পেয়ে ২০১৮ সালের ২২ জুন অনশনে বসেন গান্ধিবাবার অনুগামী এই মানুষটি। ১১২ দিনের দীর্ঘ অনশন ব্রতের পর হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে ঋষিকেশে মারা যান আইআইটি-কানপুরের পূর্বতন অধ্যাপক জিডি আগরওয়াল ওরফে স্বামী জ্ঞানস্বরূপ সানন্দ। মৃত্যুর পর প্রধানমন্ত্রীজি এক টুইট বার্তায় নিয়মমাফিক শোকজ্ঞাপন করেই তাঁর দায় এড়িয়েছিলেন, এর বেশি আর কিছুই হয়নি। বিকাশের রথ যে দিগ্বিদিকজ্ঞানশূন্য হয়ে ভুল পথেই ছুটছে সাম্প্রতিক বিপর্যয় তারই জ্বলন্ত প্রমাণ।

শেষ করব এক পরিবেশ সচেতন সহ-নাগরিকের মন্তব্য দিয়ে। বিপর্যয় প্রসঙ্গে তাঁর অভিমত—

আমরা পরিপূর্ণ প্রকৃতির একটা খণ্ড অংশমাত্র, আমরাই সব নই। … ঝুলন খেলার মতো আমরা নিজেদের ইচ্ছেমতো সবকিছু কখনওই বানাতে পারি না। কিছু কিছু দুর্গমতা ভালো। সবকিছু সুগম আর সুলভ করে তোলার চেষ্টাতে খামতি দেওয়া ভালো। দেবভূমি যদি সত্যি সত্যি রোপওয়ে করে অথবা বাতানুকূল গাড়ি করে যাওয়া যায় তাহলে দেবদেবী আর সেখানে অবস্থান করবেন না। তাঁরাও পালিয়ে বাঁচবেন।

অলমতি বিস্তারেণ …