Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

ভিত মজবুত করছে কৃষক আন্দোলন— একটি প্রতিবেদন

চার নম্বর নিউজডেস্ক

 

তিন তিনটে মাস। দেশের সর্বকালের অন্যতম আলোচিত এবং শিহরণ ফেলা এক আন্দোলন উত্থান পতন পেরিয়ে এখনও নির্বিকার। কখনও রাস্তা ভুল করে হোঁচট খাচ্ছে। কখনও তীব্রভাবে জয়ের মুখে। কখনও একটু হলেও স্তিমিত। আসলে এ সবই বাহ্য। সবই আপামর নিরাপদ ভারতবাসীর কথা। থার্ড পারসন, প্লুরাল নম্বর। একজন কৃষক হয়ে লড়াইটা কীরকম? অবস্থান? ভবিষ্যৎ স্ট্রাটেজি? কোন দিকে? একটু জেনে নিই।

পাঞ্জাব হরিয়ানার চাষিরা দিল্লি সীমান্তে স্থায়ী বসবাসের কথা ভাবছেন। ভাবছেন টেকসই কিছু বসত নির্মাণেরও। স্থানীয়ভাবে তাঁদের মধ্যে প্রচলিত একটি শব্দ হল ‘কুনবা’। কুনবা বলতে একটি সাধারণ কাজে জোট বাঁধা কিছু গোষ্ঠীর কথা বোঝায়। সীমান্তের চাষিরা ছোট ছোট কুনবা তৈরি করে সেই কুনবার প্রত্যেক পরিবারের থেকে নিচ্ছে ২০০ থেকে ৫০০ টাকা। তৈরি হচ্ছে স্থায়ী বসত তৈরির রসদ। সেই টাকা দীর্ঘদিনের খাবার জমা করতে পাথেয় হচ্ছে। তাঁরা রোটেশনের কোথাও ভাবছেন। কারণ দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলনে বসার মতো আর্থিক বা মানসিক স্থৈর্য ধরে রাখা সম্ভব হচ্ছে না কৃষক পরিবারগুলির। ঠিক করা হচ্ছে পরিবারের এক বা একাধিক সদস্য ঘুরে আসবেন গ্রামে। কিছুদিন পর ফিরে এসে জায়গা ছেড়ে দেবেন অন্যদের। এতে শেষমেশ লাভ হবে তাঁদের নিজেদেরই। আন্দোলনের শক্তি বাড়বে।

হিসার জেলার দানোদা গ্রামের কৃষক কুলওয়ান্ত সিং টিকরি সীমান্তে তাঁবু খাটিয়ে সেই তাঁবুতে পরিবারের প্রধান মঙ্গল রাম নয়নের নাম খোদাই করে দিয়েছেন। বলছেন, কালা কানুন না ওঠা অবধি যাচ্ছেন না তাঁরা। পড়শি তাঁবুর পালা রাম ফতেপুর জেলার চাষি। ‘চাষিদের ক্লান্ত করে দেওয়ার কৌশল খাটবে না সরকারের। আমরা জমি ছাড়ব না। লড়াই ছাড়ব না। যদি জমি হারিয়ে ফেলি, কী জবাব দেব পরের প্রজন্মকে?’ কণ্ঠে দৃপ্ততা পালা রামের।

যমুনানগর জেলার বিকেইউ ইউনিয়ন সভাপতি সুভাষ গুর্জর বলছেন প্রত্যেক পরিবার থেকে অন্তত একজন করে সীমান্তে থেকে যাওয়ার কথা। বিদ্যুতের আবেদন করছেন তাঁরা। প্রচুর সংখ্যক মশারির বন্দোবস্ত করছেন।

আর্থিক সুরাহার দিকটিও ভেবে রাখা আছে। ভাড়া করা গাড়ি যতটা সম্ভব কম ব্যবহার করা হচ্ছে নিজেদের গ্রাম থেকে দিল্লি সীমান্তে আসা যাওয়ার জন্য। ব্যবহৃত হচ্ছে নিজেদের গাড়ি। যেসমস্ত কৃষকদের নিজেদের গাড়ি নেই, তাঁরা সহযোদ্ধা অন্য কৃষকদের জ্বালানির খরচা দিয়ে তাঁদের গাড়ি ব্যবহার করছেন। বন্ধুত্ব, আর্থিক রসদ দুইই গাঢ় হচ্ছে। পাতিয়ালা-জিন্দ-দিল্লি জাতীয় সড়ক কৃষকদের পতাকা-রঞ্জিত গাড়িতে গাড়িতে ভরে উঠছে ক্রমশ।

কৃষক ইউনিয়নগুলিকে জোরালো করার কথা ভাবা হচ্ছে। নির্মিত হচ্ছে আস্ত এক একটি সেনাবাহিনি। হরিয়ানার জিন্দ জেলার তরুণী চাষি সিকিম নয়ন বলছেন অতীত দিনের কথা। নয়ন ইউনিয়ন করতেন না। নিজের পরিবার, চাষ, ছেলেমেয়ে এসব নিয়েই সুখী ছিলেন। প্রতিকূল পরিস্থিতি সব পাল্টে দিল। জোটবদ্ধ না হলে খাবার কেড়ে নেবে সরকার, রাষ্ট্র। অতএব ইউনিয়ন। দাবি। কালা কানুন ভেঙে দেওয়ার, গুঁড়িয়ে দেওয়ার দাবি। একটা সময়ে বহু আলোচিত ট্র্যাক্টর প্যারেডে অংশ নেওয়া। অন্যান্য মেয়েদের জোটবদ্ধ করা। এভাবেই আজ জিন্দের মহিলা শাখার সভাপতি সিকিম নয়ন। এখন তিনি অনেকের মুক্তির আলো, বাঁচার পাথেয়, আলোর দিশারী। বিকেইউ নেতা গুরনম সিং চাদুনির কথায় উঠে আসছে সব সদস্য চাষির ফোন নম্বর একত্র করার কথা। হোয়াটসআপ গ্রুপের মাধ্যমে সমস্ত ছোট বড় আপডেট পৌঁছে যাচ্ছে কৃষকদের কাছে। জরুরি প্রসঙ্গ, মতামত রাখা সবকিছুই সম্ভব হচ্ছে।

কৃষকদের এইসব ছোটবড় পরিকল্পনা, কাজকর্মের মাঝে অন্যভাবে সংগ্রামের ডাক দিচ্ছে সংযুক্ত কিসান মঞ্চ। গত ২৩ ফেব্রুয়ারি পালিত হল ‘পাগঢ়ি সম্ভল দিবস’। চাচা অজিত সং এবং স্বামী সহজানন্দ সরস্বতীর স্মৃতিতে প্রত্যেক চাষি সেদিন পড়েছেন আঞ্চলিক পোশাক পাগড়ি। প্রতীকী। বিদ্রোহের সামগ্রিক দৃষ্টিকোণ থেকে ২৪ ফেব্রুয়ারি ডাকা হয়েছিল ‘দমন বিরোধী দিবস’। রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠানো হচ্ছে সম্মিলিত এক বয়ান। ২৬ ফেব্রুয়ারি ডাকা হচ্ছে ‘যুব কিসান দিবস’। প্রধানত যুবক চাষিরা এই দিন সামনের সারিতে থাকছেন। ২৭ ফেব্রুয়ারি পালিত হচ্ছে ‘মজদুর কিসান একতা দিবস’।

ব্যক্তিগত থেকে বৃহত্তর ক্ষেত্রে এভাবেই বিক্ষোভ জোরালো হচ্ছে দেশের রাজধানী লাগোয়া সীমান্ত অঞ্চলে। তাই, নির্বিকার উদাসীন ভারতবর্ষের কাছে ‘আন্দোলন স্তিমিত’ হয়ে যাওয়ার হাস্যকর যুক্তির ভেতরেই দৃপ্ত এক আগুনের সলতে পাকাচ্ছে কৃষক ভাতরবর্ষ। জয় আসবেই আসবে…