Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

ছায়াপাখি — দুই দিগন্ত, পর্ব ৭

বিশ্বদীপ চক্রবর্তী

 

পূর্ব প্রকাশিতের পর

তিন শালিক

ভোক্কাটা!

স্বপন রুটি গুড় সাঁটাচ্ছিল। শুনেই তড়াক লাফ। সবে রুটির একটা টুকরো মুখে গেছে কি না গেছে, থালা হটকিয়ে রাস্তায়।

রমা হাঁইমাই করে উঠল— হেঁই স্বপইন্যা, হারামির পুত! খাওন থুইয়া যাস কনে?

হরেন স্নান সেরে গা ঝাড়ছিল। সবে সকালের ট্রিপগুলো মেরে এসেছে, বুকে এখনও হাঁফ। খানিক বাদে আবার অফিসের প্যাসেঞ্জার। খিঁচিয়ে উঠল, পুঙ্গির ভাই। ভ্যান টাননের কথা কইলে অর গা টাটায়। আয় আজ, কচুয়া ধোলাই আছে তর কপালে।

–দামড়া পোলারে মারন যায়? মরণ! রান্নাঘরে ঢুকে স্বপনের এঁটো থালাটা ঢাকা দিয়ে তুলে রাখে রমা। তার বাড়িতে এক গরাস ফেলা যাওয়ার উপায় নেই। ছেলে হলহলিয়ে বাড়ছে, খিদে পেলে ঠিক খুঁটে নেবে। হাঘরের হেঁসেলে এঁটোকাঁটা নিয়ে অত চাঁইচুকুর নেই।

স্বপনের কানে এসব কিছুই সেঁধোয়নি। তার চোখ গোঁত মারা ঘুড়িটার দিকে। কালো-সাদা পেটকাটিটা লাট খেতে খেতে নামছিল। পেছনে বস্তির সবকটা ফ্যা ফ্যা গোবিন্দ। তাদের পেছনে স্বপনও ছুটতে শুরু করল। কী খায় না খায়, শরীরের কাঠামোটা সরেশ। এই বয়সেই বেশ ফড়ফড়াচ্ছে। হাতে পায়ে বরাবরই লম্বার ধাঁচ। দৌড়েও একটা আড় আছে। ছুটলে কারুর বাপের ক্ষমতা নেই ওর নখের ডগাও ছোঁয়। ছুটছে না, স্বপন যেন হাওয়ায় ভাসা ঘুড়িটার মতই পতপতাচ্ছিল। লম্বা লম্বা পায়ে দূরত্ব কমছিল। ছোটার সময় স্বপনের আলাদা রোয়াব।

রেললাইনের ধারের রাস্তাটা এমনিতেই ঘিঞ্জি। দুধারে ব্যাঙের ছাতার মত বেড়ে ওঠা দোকানপাট, খুচরো সবজি বেচার মাচান। সব নিয়ে থিকথিক। সকালের এই সময়টায় রিক্সা, সাইকেল, কলের জলের লম্বা লাইনে উপচে পড়া মানুষ। এর মধ্যে একপাল ছেলের দিগ্বিদিকজ্ঞানশূন্য হয়ে দৌড়ানোয় কেজো পথিকদের ভিরকুটির অন্ত ছিল না।

–বাপে খেদানো, মায়ে তাড়ানো যত্তসব!
–জঞ্জাল!
–ঢ্যামনা!

ওরা শুনলে বলত, ছেঁড়া গেল! কিন্তু ওদের এসব দেখার বা শোনার সময় নেই! মাটি থেকে খুঁটে খাওয়া জীবনে আকাশের দিকে তাকিয়ে ছোটার এটাই এক বাহানা। ম্যাদামারা জীবনে বাঁচার টুসকি। যারা দৌড়োচ্ছে তাদের অর্ধেকের বেশির গায়ে ত্যানাও নেই। ঘুড়ির খবরে লাফ মেরেছে রাস্তায়, জামা থাকলেও গায়ে দেওয়ার সময় কোথায় ছিল? পায়ে চপ্পলের কথাও ওঠে না। পায়ে থাকলেও ওটাই সবার আগে পথের ধারে ছুড়ে দিয়েছে, ফেরার সময় স্ট্র্যাপে গুঁজতে গুঁজতে অশ্লীল গালি ঝাড়বে। স্বপনের গায়ে জামা ছিল, বেরোনোর আগে টান মেরে তার থেকে নামিয়ে নিয়েছিল। কিন্তু বোতাম লাগানো ছিল না একটাও। এখন দৌড়ানোর সময় হাওয়ায় জামাটা পিঠের পিছনে ভোটের ঝাণ্ডার মত উড়ছে। অথবা ডানা। একবগগা দৌড়ের সঙ্গে হাপরের মত ওঠানামা করা বুকটা সামনে ঠেলে বেরিয়ে এসেছে, মাথাটা তেরচা করে আকাশের দিকে রাখা চাউনি। সবারই তাই। নোঙরছাড়া ঘুড়ি মাঝেমধ্যেই পালটি খেয়ে দিক বদলাচ্ছে। সঙ্গে সঙ্গে খেউর তুলে পথ বদল। কীভাবে ঘুপচি রাস্তার রকমারি বাধা বিঘ্ন টপকে পার হয়ে যাচ্ছে, সেটাই অবাক। এই রাস্তার সবকটা ওঠাপড়া ভাঙাজোড়া যেন এদের নখদর্পণে। তবে এব্যাপারে স্বপনই সেরা, ঠেলেঠুলে সবার সামনে চলে এসেছে। একটু একটু করে ছেলের পালকে পেছনে রেখে ঘুড়ির সামনে পৌঁছে যাওয়া। পতঙ্গ হাসিলের আনন্দে চোখ চকচক করছিল ওর। আর একটু গেলেই এলানো ঘুড়িটার ভেসে যাওয়া সুতো হাতের মুঠোয়।

উল্টোদিক থেকে তেড়ে ছুটছিল সুবল— স্বপনের পাশের ঘর। ডাক ছাড়ল— স্বপন!

সুবল স্বপনের থেকে বছর চারেকের বড়, স্কুল ছেড়ে দিয়েছে গোঁফ গজানোর আগেই। এখন ওর হাতেপায়ে কয়লার কালিমাখা, বগলদাবায় মাঝারি সাইজের একটা চটের বস্তা। ফুল দমে দৌড়াচ্ছিল, কিন্তু শাকালুর মত দাঁত বের করল স্বপনকে দেখেই।

কেস কিচাইন, পিছনে মামা! মালটা নিয়ে পাশের গলিতে সেঁধা। স্বপনকে কিছু বলার সুযোগ না ছেড়ে ওর হাতে বস্তাটা গুঁজে দিয়েই ছিটকে বেরিয়ে গেল। এইরকম একটা বস্তা হাফ পাত্তি না হয়ে যায় না। মাগনা তো করছে না, যা বখরা পাবে তাতেই কদিনের রেজকি। স্বপন কার্নিক মেরে দৌড়ের দল ভেঙে বেরিয়ে গেল। একটা আশার হুল্লোড় ছড়িয়ে পড়ল পিছন পিছন ছুটে আসা জটলায়। হাতের কাছে এসে ফস্কে গেল ঘুড়িটা! কিন্তু আফসোস ছেড়ে ততক্ষণে স্বপন পাশের গলিতে। ঘুড়ি ধরার পরের বচসা আর খেউর ভেসে আসছিল রাস্তা থেকে, কিন্তু স্বপন তখন বস্তা নিয়ে দূর থেকে দূরে চলে যাচ্ছিল।

এই চত্বরে কাউকে বলে দিতে হয় না, ওই বস্তায় কী আছে। রেলের ওয়াগনগুলো লেভেল ক্রসিঙের কাছাকাছি এলে ধীর গতিতে চলতে থাকে। এই গলির আকুশি হাতে ঘোরা মায়েরা রেললাইনের ধারে তক্কে তক্কে থাকে। সুযোগ পেলেই ওয়াগনের কোণাঘুঁচি বের করে যত পারে কয়লা বের করে নেয়। গুঁড়ো পেলে গোবরের সঙ্গে মিশিয়ে ঘুঁটে দেয়। দানা বড় পেলে বাবুদের বাড়ি বিক্রি। ছেলেরা মায়ের মাল সাফ করা দেখতে দেখতে বড় হয়। একটু হাতে পায়ে হলে খুচিয়ে শুধু ন্য, ওয়াগন ব্রেক করে। সবাই জানে, এমন কি রেলপুলিশও। সবকটা ছেলের ইঞ্চি মাপা আছে ওদের। ওদের তোলা ফিট করা আছে, দেখলেও ফিকির নেই। তবু মাঝে মাঝে এরকম তাড়া দেয় নিজেদের ভাগ বাড়ানোর জন্য। কিছু কেসও তো দেখাতে হবে।

গলিতে ঢুকেও বেশ খানিকটা দৌড়েছিল। যখন বুঝল পেছনে আর ফেউ লেগে নেই, তখন দম নিল। এবার সটান বাসায় যেতে হবে। পেটে মোচড় দিচ্ছে। হাতটাও টাটাচ্ছে। বস্তাটা টানতে টানতে বাড়ির রাস্তা ধরেছিল স্বপন।

তোর পায়ে তো ভালো দম দেখছি!

গলির মুখে সাইকেল নিয়ে দাঁড়িয়েছিল লোকটা। অবাক হয়ে স্বপন ভুরু কুঁচকে তাকাল। ভাবটা, এ মাকড়াটা আবার কে? আনশাটকা কথা কিসের! হিলহিলে চেহারা। এত দামড়া লোক, কিন্তু উদগান্ডুর মত সাদা রঙের একটা হাফ প্যান্ট পরে আছে, উপরে ফ্যাকাসে কমলা রঙের গোলগলা গেঞ্জি, পায়ে লম্বা সাদাটে মোজা আর ঘোলা রঙের কেডস। চেহারা যেমনতেমন, ওই পোশাকের জন্যই দেশবন্ধুনগরের ফ্রেমে পাইলিং করা যায় না।

স্বপনের কাছ থেকে কোনও সাড়া না পেয়ে এবার সাদা দাঁত দেখিয়ে হাসল লোকটা। দেখছিলাম এতক্ষণ। ঘুড়ির পিছনে দৌড়াতে দৌড়াতে কিভাবে সবাইকে টপকে যাচ্ছিলি।

স্বপন পিচিক করে রাস্তার ধারে থুতু ফেলে হাতের পাতা উল্টাল— বেফালতু, চপে চুল হয়ে গেল। পেটকাটিটা নাগালে এসেও ফসকে গেল। ঘুড়ির শোকটা আবার ঘাই দিল বুকে। সুবলের কাছ থেকে ভালো দাঁও না মারতে পারলে এ শোক ভোলার নয়।

গদগদ ভাবটা লোকটার মুখে এখনও নাছোড়বান্দা দোকানদারের দেখন হাসির মত লেপটে আছে। এরকম দৌড়ালে তার থেকেও অনেক বেশি কিছু পেতে পারিস।

–জানি। দাঁত দেখিয়ে এবার হাসার পালা স্বপনের। সুবলরা অনেকবার বলেছে ওদের দলে ঢুকতে, মামারা আমার বালটাও ছুঁতে পাবে না। গাঁতের মাল ঘরে ঢুকবে রোজ।
–তবে ঢুকিসনি কেন?
–বাবা পেঁদিয়ে বৃন্দাবন দেখিয়ে দেবে না!
–আমার কাছে দৌড়াবি? লোকটা এখন সাইকেল থেকে নেবে স্বপনের সঙ্গে সঙ্গে হাঁটছে।
–দৌড়াব? রেসের মতুন? লোকটার আন্টসান্ট কথায় স্বপনের গলায় তাচ্ছিল্য। এত কিছু দেখেছে এইটুকু জীবনে, কোনও কিছুতেই টিউবলাইট ঝলকায় না স্বপনের চোখে।
–হ্যাঁ। দেখেছিস কীভাবে দৌড়ের রেস হয়?
–কত! ফি বার জিতি ইস্কুলে, পেরাইজও পাই। অবিশ্যি খাজা মাল দেয়! পিচিক করে থুথু ফেলল স্বপন।
–স্কুলের দৌড় না, আরও অনেক বড়। প্রাইজ পাবি, কাপ পাবি— এত্ত বড়। লোকটা হাত দিয়ে কাপের বহরটা বুঝিয়ে দেয়।

আতাক্যালানে একটা! নিজের মনেই খিস্তি করল স্বপন। একে পেটে টান মেরেছে, এই মাকড়াটা ফালতু জ্ঞান চোদাচ্ছে। কাপ পেয়ে কি গাঁড়ে দুব্বো গজাবে? আনখা লোকটাকে ঝেড়ে ফেলার চেষ্টায় জোরে পা চালায় এবার। ধুস! খোরাক জুটবে ওতে?

নাছোড়বান্দা পায়ে সমান তালে টক্কর মারতে মারতে লোকটা মোক্ষম টোপ ফেলে এবার, টাকাও দেবে, যখন ভালো দৌড়াবি।

পাত্তির লোভে চকচক করে ওঠে স্বপনের চোখ। দেবে? ক পাত্তি? আমি তো এখনই ভালো দৌড়াই। দেশবন্ধুনগরের কেউ একটা বালও ছুঁতে পারে না আমার।

–তাতে কিচ্ছু হয় না। পুরো দুর্গাপুরের ছেলেদের হারাতে পারবি? গোটা বর্ধমানের? আছে সেই ক্যাপাকাইটি? তার জন্য অনেক ট্রেনিং লাগে।

দৌড়াতেও আবার টেনিং লাগে? এরপর শুনবে অ্যাঁড়ে হাত বোলানোরও কেলাস হয়। সক্কাল সক্কাল জুটেছে বটে এক মাল তার কপালে। জম্মো থেকে দৌড়াচ্ছে। কলজে ভরে দম নাও, আর লম্বা লম্বা পা ফেলে ছুট লাগাও। এর আবার টেনিং লাগে নাকি? কাজ নেই তো ভেরেন্ডা ভাজ! পাগলা লোক। কয়লার বস্তা বাগিয়ে এবার আরও জোরে পা চালাল স্বপন। ফেলে আসা রুটি গুড় অনেকক্ষণ থেকেই ডাক ছাড়ছে।

লোকটা এবার সাইকেলে উঠে ধীরে ধীরে প্যাডেল করে সমান তালে চলতে থাকে।

–কত কিছু শিখতে হয় রে। এই ধর না তুই টানটান হয়ে দৌড়াস, এতে হাওয়ার ধাক্কা বেশি লাগে, ইস্পিড কমে যায়। ওটা বদলাতে হবে। হাত দুটো এমন এলোপাথাড়ি পড়লে চলে নাকি? পক্ষীরাজের মতন হাওয়া কেটে বেরোতে হবে। নিজের কথার ধার বাড়াল লোকটা। খালি পায়ে হয় না এসব! জুতো পরে দৌড়েছিস কখনো?

এসব আনশান কথায় বিরক্ত লাগছিল স্বপনের। কেউ ছিনেজোঁকের মতন লেগে থাকলে ওর পোষায় না। নেহাত কাঁচাপাকা চুলের লোকটা তার বাপের বয়সী, না হলে দিত খিস্তি করে। স্কুলে যাই, তাই বাপের কসি ঢিলে। বলেছে এবার বিকেলের দিকে আমাকে রিক্সা নিয়ে বেরুতে হবে।

হাঁ, হাঁ করে উঠল লোকটা। কখনও করবি না, পায়ের গুলি শক্ত হয়ে যাবে। তোর পা রিক্সা চালানোর জন্য নয়।

শালা পাগলা লোক তো! রিক্সা চালানোর কথায় এক্কেবারে ভেবরে গেছে লোকটা। ফিক করে হাসল স্বপন। দাঁতগুলো বেরিয়ে কৈশোরের সব জয় করা সারল্য এই প্রথম তার চোখেমুখে উপচাল। এইসব বাতেলা ঝেড়ে দেখো আমার বাপের সামনে। খাল খিঁচে নেবে।

হাসল লোকটাও, কালি মাস্টারের ওসব অনেক দেখা আছে। আগে বল তুই রাজী কিনা।

যাস শালা! মাস্টার নাকি? একটু থতমত খেল স্বপন। পোশাকআশাক দেখে মাস্টারির কথাটা মাথায় আসেনি তো! তাও ভালো, তেড়ে খিস্তি করে বসেনি। আপনি মাস্টার? কোন ইস্কুলের?

–এ তোর এমনি সেমনি ইস্কুলের মাস্টার না রে, আমার দৌড়ের ইস্কুলের। তোর মত আরও অনেক ছেলে আমার কাছে দৌড়ের ট্রেনিং নেয়। তবে তোর যেমন সরেস পা অমনটা আর কারও নেই।

দৌড়ের মাস্টার শুনে স্বপনের সম্মানের দাঁড়িপাল্লায় কালিপদ আবার টাল খেয়ে নিচে নেবে গেছে। শিখিয়ে তোমার কী ফয়দা? পাত্তি পাও?

এই প্রশ্নটা কালি মাস্টারের বউও প্রায় রোজই করে। ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়াও কেন? কে তোমাকে পয়সা দেয়? তার বদলে চাকরিটা একটু মন দিয়ে করলে তবু ঘরের কিছু উজ্জুগ হত।

কী করে বোঝাবে কালি আর কাউকে! নিজের ঘরের পয়সা দিয়ে কেন এক দঙ্গল ছেলেকে দৌড় শেখাচ্ছে সে? না শিখিয়ে পারে না যে। এমন নয় যে এটা না করলে চাকরিটা ভালো করে করতে পারত। আবগারি বিভাগের অধস্তন কর্মীর চাকরি, তার আবার ভালো খারাপের কী আছে? বরং এই দৌড়টা আছে বলেই, চাকরিতে মনটা বেঁধে রাখতে পেরেছে এখনও। এদিক ওদিক যে দু পয়সা বাড়তি ইনকাম, সব ঢালে এই দৌড়ের স্কুল চালু রাখতে। আসলে স্কুল না ছাই, রেলের মাঠটায় দৌড়াতে নিয়ে যায় ছেলেদের। কিন্তু ওদের কিটস কিনতে, খাবার দিতে রেস্ত লাগে। এদিক ওদিক রেসে নিয়ে যায় যখন, তখন যাওয়ার খরচটা জুটাতে হয়।

–তোকে কোন পয়সা দিতে হবে না।

–তাহলে আমারে বুঝি ক্যাশ দেবে?

স্বপনের টাস টাস কথায় রাগ করতে পারে না কালি। আসলে এরকম অনেক শুনেছে। তার সবকটা দৌড়ের ছেলেই আসে হাঘরের থেকে, কী পাবে না জেনে এক পাও বাড়াতে রাজী নয়। বাপমাগুলোও এক সে বঢ়কর এক! টাকা তাদের কাছে খুব দরকারি। কালি তাদের কাছে স্বপ্ন ব্যাচে, ভবিষ্যতের। মেডেল, চাকরি, টাকা। তার একটা ছেলে স্টেট মিটে একশো মিটারে সোনা জিতেছে গত বছর। রেলে ফোর্থ ক্লাস স্টাফের চাকরি পেয়েছে। ফলাও করে বলে সেসব কথা। ভাবতে ভাবতেই ছেলেটার কথা মনে পড়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলল। ন্যাশানাল মিটে নিজের ছেলেদের সঙ্গে কোচ হয়ে যাওয়ার সাধ বহুদিনের। কিন্তু সুরেশ ন্যাশানাল মিটে যাবে রেলওয়েজের হয়ে, সঙ্গে তাদের কোচ, অফিসিয়াল এসব। কালির সেখানে সুযোগ নেই। যাকগে ছেলেটা যদি ন্যাশানালে কিছু করতে পারে, সেটাই তার জীবনের প্রাপ্তি। সে তো শুধু ওদের স্বপ্ন দেখায় না, নিজেও তো দেখে। ওদের নিয়ে। ওই সব স্বপ্ন নিয়েই বেঁচে থাকা। এই যেমন এখন এই ছেলেটাকে ঘিরে মনে একটা রামধনু আঁকছে। এদিক ওদিক খানাখন্দ, বস্তা পেটি পেরিয়ে যেমন লাফাচ্ছিল ছেলেটা, ওর পায়ের বেড় দেখে টসকে গেছে কালিপদ। হার্ডলসে নাবাবার জন্য নিসপিস করছে মন।

–তোর নাম কিরে?
–স্বপন, স্বপন গুঁই।
–বা, বা বেশ নাম! স্বপন। ড্রিম, ওটা রাখতে হবে বুঝলি। স্বপ্ন দেখা ছাড়বি না। ওইটা জিইয়ে রাখতে পারলে কত কিছু করা যায় রে। কোথা থেকে কোথায় চলে যাবি। কালিপদর চোখটা এখন স্বপ্নের মায়াজালে জটাপটি।

লোকটার আকাশ থেকে ঘুড়ি নাবানোর চেষ্টায় স্বপনের হাসি পেল। মালটা কে রে? পাত্তির কথায় মুখে ছিপি গুঁজেছে, এদিকে দিনের বেলায় খোয়াব দেখাচ্ছে। বয়ে গেছে লোকটার কাছে দৌড়াতে।

–বললে না তো ক্যাশ দেবে কিনা?
–ওসব কোত্থেকে দেব? কালিপদর ভুরু কুঁচকে যায়, বড্ড ত্যাঁদোর তো ছেলেটা! কোথায় তোর এই চুরিচামারির জীবন থেকে বের হয়ে যাবার একটা রাস্তা দেখাচ্ছি, আর তুই এই বয়েসেই টাকা টাকা করে হেদিয়ে মরছিস? রাগ হলেও নিজেকে সামলায়। কালি জানে গরীবের ঘরের এই ছেলেগুলোকে গেঁথে তুলতে গেলে খাওয়ার ব্যাপারটা খুব জরুরি। বেড়ে ওঠা এই শরীরগুলোয় খুব খিদে, বাড়িতে অর্ধেকদিনই কিছু জোটে না। জুটলেও ডিম দুধ তো কখনওই নয়। ওসব দামী খোরাক সেও যে রোজ ওদের জন্য জোটাতে পারে তা নয়, কিন্তু পেট ভরে খাওয়ার ব্যাবস্থাটা রাখে। একটা হোটেলের সঙ্গে খাতির আছে। সকালে দৌড়ের শেষে আটার রুটি আর কুমড়োর ঘ্যাঁট থাকেই। শনি রবিবার অফিস ছুটি থাকে বলে একটু বেশি খাটায় ওদের, তখন ডিম দুধও দেয়। কিন্তু ডিম দুধের কথাটা সবসময়েই ফলাও করে বলতে ছাড়ে না। এইবার সে তার শেষ টোপটা ছাড়ল, এতেও না হলে সাইকেল করে উল্টো রাস্তা ধরবে।
–সকালে দৌড় করলে ভরপেট খেতে পাবি— ডিম, রুটি, কলা… টোপ ছাড়তেই ফাতনা নড়ে উঠল।
–রোজ?

স্বপনের জিভ দিয়ে ঠোঁট চাটা দেখেই বুঝতে পারল টোপ গিলেছে।

–কাল দেখে যা না হয়, দ্যাখ আর সবাই কেমন করছে। খেয়েও নিবি সেই ফাঁকে। তারপর ভালো লাগলে আসলি, না লাগলে নয়। ব্যাস! কালি জানে গেঁথে গেছে ছেলেটা, এখন শুধু ধীরেসুস্থে ডাঙ্গায় তোলার যা ফুরসতটুকু দিতে হবে।
–তোমার দৌড়ের কেলাসটা কোনখানে?

কালি উত্তর দেওয়ার আগেই দাঁত কেলাতে কেলাতে সুবল হজির। স্বপন আসার অপেক্ষায় ওঁত পেতে ছিল। দে দে, এত দেরি করলি কেন? গাঁতের মাল হাতে না পেয়ে বিচি শুকিয়ে আঁটি হচ্ছিল। ভাবলাম মামার বাড়ি তুলে নিয়ে গেছে।

–কোনওদিন পেরেছে সুবলদা। চটের বস্তাটা তবুও হাতছাড়া করে না স্বপন।

সুবল অস্থির, দে না ল্যাওড়া। বাড়ির নাকের ডগায় দাঁড়িয়ে কানামাছি খেলছিস কেন? ঘরের থেকে দেখতে পেলে পাত্তির ভাগ ছাড়তে হবে।

–আর আমারটা?
–উফ, কি চোদনা হয়েছিস না? আমি কি পালিয়ে যাচ্ছিলাম? ব্যাজার মুখে জামার হাতার ভাঁজ থেকে একটা নোংরা এক টাকার নোট গুঁজে দেয় স্বপনের বাড়ানো হাতে। কয়লার বস্তা হাতবদল হয়ে হারিয়ে যায় প্যাঁচানো গলিপথে।

কালিপদ চুপচাপ এইসব লেনদেন দেখছিল। সুবল যেতে হারানো কথার খেই ধরে ফেলে কালি আবার। তাহলে আসছিস কাল? রেলের মাঠে, সকাল পাঁচটায়।

নোটের ভাঁজ সোজা করতে করতে চোখ তুলে তাকাল ছেলেটা। দোনামনার ছাপ। ডিমের কথাটা মাথা থেকে এক ঝটকায় ফেলতেও পারছে না। জামার বোতাম লাগাতে লাগাতে বলল, আচ্ছা দেখব, সক্কাল সক্কাল চোখ খুললে এসে যাব না হয়।

অপসৃয়মান স্বপনের পথের দিকে চেয়েছিল কালি। চোখে রোদ এসে পড়ছিল। এবার সাইকেলে প্যাডেল মারল। একটু ফাঁক রেখে স্বপনের পেছন পেছন। কারণ ছেলেটার বাড়িটা তাকে দেখে রাখতে হবে। যদি দুএকদিনের মধ্যে সকালের প্র্যাকটিসে হাজির না হয় তাহলে আবার ট্রাই মারতে হবে। সহজে ছেড়ে দেওয়ার লোক কালিপদ মাস্টার নয়। ছেলেটার মধ্যে মশলা আছে।

 

পেটের টান বড় টান। আসব না আসব না করেও স্বপন বিছানা ছেড়ে উঠে পড়ল।

একচালার ঘরে সকাল থেকে হুড়োহুড়ি। সরকারবাড়ির বৌদি বেরিয়ে যাবে সাড়ে সাতটায়, রমাকে তার আগে কাজ তুলে দিতে হয়। হরেনের প্রথম ট্রিপ ছটার আগে নয়, কিন্তু ভোরের দিকে কাশির টানে খখাতে খখাতে উঠে পড়ে। স্বপনের এক বছরের ছোট বোন কাকলি জল আনতে টিউকলে লাইন দেয়, একেকবার বালতি ভরে জল আনে, আর খেউর করে। ঘরে বসে দামড়াগুলো ঝাঁট পাকাবে আর আমি পাছা ঘষটে ঘষটে জল এনে মরছি। দামড়া বলতে স্বপন, কারণ তপন এখনও ছোট। এসব কাকলির রোজকার কথা। শুধু শব্দ বদলে যায়, সুর বদলায় না। খুব রেগে গেলে স্বপন দুএকটা চড়থাপ্পড় কসিয়ে দেয়। তা না হলে দাঁত দেখিয়ে বলে ঘষলি না হয়, ওটা কি শুধু সুবলের হাত বুলাবার জন্য রাখা থাকবে? কাকলিও ছেড়ে দেওয়ার পাত্রী নয়। সেও মুখ চালায়। নিজের বুনের নামে বলতে শরম করে না? মুখ সামলে কথা ক, নয়তো ঝাটার পিছা পোঁদে গুইজ্যা দিমু। স্বপন অত সহজে থামার পাত্র না। চোখ টিপে বলে, কালকে সাইকেলে চেপে সুবলের গায়ে গা ঘসছিলি, তোর খানকিপনা দেখিনি মনে করেছিস? মাকে বললে তোর পিঠের ছাল তুলে নেবে খন। কাকলি এই নিয়ে বাড়িতে বেশি কথা হোক চায় না। তাই রণে ভঙ্গ দিয়ে গজগজ করতে করতে আরেক বালতি জল আনতে চলে যায়। এইসব হুড়ুমতালের মধ্যে তপনটা কেমন করে গুড়িমুড়ি মেরে পড়ে থাকে, কে জানে!

ওরা তিন ভাইবোন এখনও স্কুলে যায়। যদিও হরেন যেমন চায় স্বপনকে রিক্সায় জুততে, রমা যখনই পারে কাকলিকে সঙ্গে করে নিয়ে যায় হাতে হাতে কাজ তুলে দেওয়ার জন্য। লুকিয়ে কাকলির হাতে দুটো পয়সা গুঁজে দেয় তাই ও কোনও হাঙ্গামা করে না। ওই টাকাগুলোই কাকলির সিনেমা দেখতে যাওয়ার ভরসা। ইদানীং অবশ্য সুবলের সঙ্গে পিরিত জুটেছে, ও শেষদুটো সিনেমা দেখিয়েছে। কিন্তু ওর সঙ্গে হলে বেশি যেতে চায় না।  অন্ধকারে এখানে ওখানে হাত গুঁজে দেয়, মন দিয়ে সিনেমা দেখা যায় না। তাছাড়া বেশি সুবিধা নিলে কোনদিন ঝুপড়ির ভিতরে টেনে নেবে। কাকলি এখনই ওসব চায় না। সুবল যে লাইনে আছে কবে যে রেলের লাইনে কাটা পড়বে কি পুলিশের গুলিতে বেঘোরে মরবে কেউ বলতে পারে না। এক চুল্লির আগুন থেকে আরেক উনুনের গনগনে তাপে ভাজাভাজা হওয়ার পিত্যেস নেই কাকলির। সে ভড়বাড়ির সবিতাদির মত সাদা ফ্রক পড়া নার্সের চাকরি করতে চায়। বড় হাসপাতালে। সবিতাদি বলেছে মাধ্যমিকটা পাশ দিতে পারলেই নার্সের ভর্তির পরীক্ষায় বসা যাবে। ওমনি একটা সাফসুতরো জীবন হাতছানি দেয় কাকলিকে, মানুষের চাপে ভেঙে পড়া এই পাড়াটা থেকে যা অনেক দূরে নিয়ে যাবে।

স্বপনের স্বপ্নদোষ বীর্যপাতে সীমাবদ্ধ। ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাববার বাওয়াল নেই। জীবনটা ঘুড়ির মতই। এলোমেলো হাওয়ায় পতপত করে উড়ছে, কাটা খেতে না চাইলে মাঞ্জা কড়া হওয়া চাই। হাত পা চালাতে পারে ভালোই। খেয়ে না খেয়েও শরীরটা বেশ মজবুত। আর পা দুটো তো ভগবানের দান। বাতাসের সঙ্গে দৌড়াতে পারে স্বপন। তেজও আছে ষোল আনা। ফটফট মুখ চালায়। গরীবের ঘরে জন্মালে জান কড়া না হলে চলে না। এই বয়সেই বেশ কয়েকবার মরণের দোর থেকে ঘুরে এসেছে। একবার ঘুড়ি ধরতে গিয়ে দোতলার ছাদ থেকে সোজা মাটিতে। নেহাত ঢালাইয়ের কাজের জন্য এক লরি বালি ফেলে গেছিল আর পড়বি তো পড় সোজা বালির ঢিবিতে। ব্যথা পেয়েছিল, কিন্তু হাত পা টসকায়নি তেমন। শুধু কোমরের ধাগায় আর একটা মাদুলি ঢুকিয়ে দিয়েছে রমা। স্বপন নিজে এই পড়ে যাওয়া বা ব্যথা পাওয়া কোনও কিছুকেই আমল দেয় না। যেন ঘুড়ির পিছনে দৌড়াতে দৌড়াতে একদিন যে এমনভাবে পটকাবে সে অজান্তে ধরেই রেখেছিল। বরং বেঁচে যাওয়াটাই আশ্চর্যের। নিস্পৃহ ফলাফলহীন জীবনবোধ বিনা প্রশ্নে নিজের ভবিতব্যে বিশ্বাস করতে শিখিয়েছে, নিজেকে ঠেলে অন্য কোনও বৃত্তে নিয়ে যাওয়ার কোনও আশা বা আকাঙ্ক্ষা নিয়ে ভাবেনি কখনও। ঠিক যেমন পাড়ার নোংরা আবর্জনা বোঝাই ঢিবি, উপচে পড়া নর্দমা, সকাল বিকেল জলের লাইনে কাড়াকাড়ি মারামারি তার গা সহা। নিত্যদিন দেখে দেখে চোখে দাগ কাটে না। রাস্তার কলে মার্গো সাবান ঘষে ঘষে যখন ফেনা তোলে, সাবানের তেতো স্বাদের সঙ্গে সঙ্গে গায়ের ময়লা এক একটা কালো ধারা নিয়ে নেবে যায়। জলের তিরতিরে গতিপথে ভাসতে ভাসতে সাবানের ফেনা পাঁকে ভরা নর্দমায় কচুগাছের ডাঁটির চারপাশে ঘুরপাক খেয়ে ঘোরে। কোথাও যাবার জায়গা নেই। ধীরে ধীরে পাঁকের অংশ হয়েই এই নর্দমার মুখ আটকে দাঁড়িয়ে থাকবে। যখন একেবারে সব বন্ধ হয়ে যাবে কোদাল দিয়ে মিনিসিপ্যালিটির ধাঙরগুলো একদিন এসে সব পাঁক সাফ করবে। আগে আগে গাঁয়ের বাড়ি মাথায় ঝিলিক মারত, এখন আর ফারাক পড়ে না।

কালিপদর সঙ্গে দেখা হওয়াটা মনে কোনও দাগ কাটেনি। কী হবে এসব করে? তার চেনাজানার মধ্যে দৌড়ঝাঁপ করে কাউকে টাকা করতে দেখেনি। হ্যাঁ, গায়ে জোর থাকলে, ভালো দৌড়াতে পারলে অনেক ধান্দায় সহজে এগিয়ে যাওয়া যায়। কিন্তু তার জন্য কেউ দৌড়ের ট্রেনিং নেয় না। আর সেই দৌড়ে মিশে থাকে হয় মাল বাঁচানোর নয় জান সামলানোর মত মরণপণ সমস্যা, লোকে এমনিতেই জোরে দৌড়াবে।

এই কথা মনে করে মাঠের এক কোনায় বসে থাকা স্বপন ফিক করে হাসল। লোকটাকে বলতে হবে টেনিঙের সময় দোনলা হাতে একজনকে পেছন পেছন দৌড় করাতে। সবাই বাপ বাপ করে ছুটবে। এই কথায় ওর মুখের কী চেহারা হবে ভেবে আর এক দফা ভ্যাটকাল স্বপন। কিন্তু লোকটা তার থেকে অনেক দূরে। ক্লাস শুরু হয়ে গেছে। তবে স্কুল কোথায়! চারটে ছেলে মাঠের অন্য কোনায় ব্যায়াম করছে। দেখতে পেয়ে লোকটা হাত তুলে জানান দিয়েছিল, ভাবখানা যেন ও আসবে জানাই ছিল। কিন্তু দৌড়োতে ডাকেনি। স্বপন বসে বসেই দেখছিল। না দৌড়ালেও খেতে দেবে তো? এই ভাবনাটা মাথায় বার দুয়েক ঘাই মেরেছিল। তবে চাপা দিয়ে রেখেছে। ওরকম ত্যাঁদড়ামি করলে সপাটে দু-একবার হাত পা চালিয়ে তবেই ফিরবে স্বপন। সকাল সকাল ঘুম থেকে হিঁচড়ে উঠে এসেছে। মামদোবাজি নাকি?

বেশ খাটাচ্ছিল ছেলেগুলোকে। সকালবেলাতেই ঘামে ওদের গা চিকচিক করে রোদ ঝলকাচ্ছে, কুকুরের মত জিভ বের করে হ্যা হ্যা করে শ্বাস নিচ্ছে একেকজন। একটা ছেলে তো কোমরে হাত দিয়ে বসেই পড়ল। সঙ্গে সঙ্গে কঞ্চি নিয়ে লোকটার বাছুর খেদা। একেবারে বাপ মা তুলে গালাগালি। খিস্তি শোনা কিছু নতুন না। কিন্তু বেফালতু শুনবে কেন? দৌড়ের স্কুল থেকে মন উঠে যাচ্ছিল স্বপনের। মাদারচোত খেতে যা দেয়, খাটিয়ে নেয় তার দ্বিগুণ। এসব তার পোষাবে না। এর থেকে সুবলের হয়ে দুটো কয়লার বস্তা পাচার করতে পারলে দুপয়সা আসবে। যেটুকু উৎসাহ ছিল সেটাতেও জল ঢেলে মাঠের চারধার দিয়ে পাক মারা ছেলেগুলোকে দেখতে দেখতে ঘাসের উপর ঝিমোচ্ছিল স্বপন। খোলা মাঠে সকালবেলা শরীর জোড়ানো নরম ফুরফুরে বাতাস। তাদের ঘরের পাখাটা একদম হাফসোল, একেকপাক ঘুরতে কুঁতেপেদে একাকার, হাওয়াই হয় না। তার উপর বাপের রাতভর খকখক কাশি। ওইটুকু চৌকিতে গাদাগাদি করে শোয়া, অর্ধেক দিন তপনের পা তার মাথায় উঠে আসে। এরকম নিশ্চিন্ত ঘুমের অবসর নেই।

চটকা ভেঙেছিল বাসনের আওয়াজে। ঢুলতে ঢুলতে কখন যে সবুজ ঘাসে গড়িয়ে পড়েছিল নিজেও জানে না। হঠাত আওয়াজে অনভ্যস্ত জায়গায় ঘুম ভেঙে থতমত খেয়ে গেল স্বপন। খোলা হাওয়ার ঘুমের জন্যেই হয়তো খুব সিনসিনারিওয়ালা একটা স্বপ্ন দেখছিল আজ। অনেকটা হিন্দি সিনেমার গানের সিনের মতন। চোখ খুলতেই সামনে এমন জলজ্যান্ত কমলি দেখে স্বপ্ন আর বাস্তবের গুঁড়িপথে বেসামাল হয়ে গেল স্বপন।

–এখানে শুয়েছ, কানে পিঁপড়ে ঢুকে যাবে না? মেয়েটা বলতে নিজের অজান্তেই স্বপনের হাত কানে। মেয়েটা খিলখিল হাসিতে ভেঙে পড়ে এবার বলল, এমা, তোমাকে আমি কান ধরতে বলেছি না কি?

স্বপন মেয়েদের সঙ্গে এরকম ফষ্টিনষ্টিতে অভ্যস্ত নয়। বোনের সঙ্গে তো হরদম চাপানউতোর লেগে আছে।  পাড়ার কলে স্নান করতে গিয়ে কলসি হাতে দাঁড়ানো ছোট বড় মেয়েদের সঙ্গে জলের দখল নিয়ে লড়াই করে। গালাগালির উত্তরে তোড়ে খিস্তি দিতে পারে। ভেজা গায়ে বাড়িফেরতা মেয়েদের বুকপাছা দেখে ইঞ্জিন গরম করে। ঘুড়ি ধরে মোড়ের মাথায় সবার সঙ্গে গুলতানি করার সময় কোনও মেয়ে গেলে কানকি মেরেছে। কিন্তু কচি কোনও মেয়ের সঙ্গে ভালোভাবে কথা বলতে গেলেই জিভ আড়ষ্ট। মাথাটা ফাঁকা মাঠ। কী বলবে বুঝতে না পেরে ভেতরে একটা রাগ বাড়ল।

মেয়েটা ওর অস্বস্তিতে মজা পেয়ে বলল, তুমি নতুন?

নতুন কিসে? দৌড়ানোতে? কী বলবে বুঝতে না পেরে স্বপন বলল, তোমাদের এই ছেলেগুলোকে না আমি চোখ বুজে হারাতে পারি।

–হ্যাঁ সে তো দেখলাম। যখন এলাম তোমার চোখ দুখান বোজাই ছিল। মেয়েটার গজদাঁত বের করা হাসির উত্তরে একটা মুখতোড় জবাব দিতে না পেরে রাগ আরও বেড়ে গেল স্বপনের। অথচ শরীরের মধ্যে এক অচেনা সিরসির। একলা কোনও মেয়ের দিকে সোজা চোখে সে তাকায়নি কখনও। এক পলক ফেলেই আবার চোখ ঘুরিয়ে নেয়। বেশ ধাক আছে মেয়েটার। খাপচু।
–ঘুমের মধ্যেই দৌড়াচ্ছিলে বুঝি? ঠ্যাং তুলে?

দেশবন্ধুনগরের কোন ছেলের সঙ্গে এমন হ্যাটা করে কথা বললে এর জবরদস্ত উত্তর দেওয়া দরকার। জুতসই কিছু মাথায় এল না মোটেই। তাই তড়াক করে লাফ দিয়ে ওঠে স্বপন। দৌড়াতে পারি কি না দেখবে?

মেয়েটাকে উত্তর দেওয়ার সুযোগ না দিয়েই পায়ের স্যান্ডালটা ছুঁড়ে ফেলে মাঠের এক প্রান্ত ধরে দৌড় শুরু করল স্বপন। আজ সামনে কোন ঘুড়ি ছিল না, বগলে ছিল না চোরাই কয়লার বস্তাও। পিছনে ছিল না মৌমাছির চাকের মত একঝাঁক ছেলে কিংবা ব্যাটন হাতে রেল পুলিশের পেয়াদা। পায়ের তলায় এবড়ো খেবড়ো রাস্তার বদলে সবুজ ঘাস। তার চেয়েও বড় কথা স্বপনের চোখের সামনে মেয়েটার মুখটা যেন ফানুসের মত ঝুলছিল। বুকের মধ্যে মেয়েটার পিড়িংমারা কথাগুলো। তার যে এমন রেগে ওঠার ক্ষমতা আছে সেটাই জানা ছিল না স্বপনের। মুখরা মেয়েটার কথায় তার শরীরের কোন কোনায় লুকোনো একটা সত্তা যেন গা ঝাড়া দিয়ে উঠে দাঁড়িয়েছে হঠাৎ। কিন্তু এটাও দস্তুরমত বুঝেছিল যে মুখের কথা দিয়ে কায়দা করতে পারবে না সে। শুধু বুকের অফুরন্ত দম আর পায়ের অপ্রতিরোধ্য গতি যে ওকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে, অনায়াসে পদক্ষেপে মাঠটাকে পাক দিতে দিতে এই প্রথম এভাবে বুঝতে পারছিল স্বপন। পুরো একপাক মেরে মেয়েটার কাছে এসে থামল। এরকম আর কয়েক পাক দিতে পারে অনায়াসে। কিন্তু তার দরকার হল না।

মেয়েটা হাততালি দিয়ে উঠল। ওরেব্বাস! তুমি তো দারুণ ছোটো! আমাদের কালু যখন ধাওয়া মারে, তোমার দৌড়ে তার চাইতেও বেশি ধাক।

–কালু কে? প্রশংশা হচ্ছে কিনা সেটা ধরতে পারছিল না স্বপন।
–পাড়ার নেড়িটা গো। এমনিতে রাস্তার কুকুর, কিন্তু খাবারের জন্য সারাক্ষণ আমাদের হোটেলের আস্তাকুঁড়ের সামনে টো টো করে। খেয়েদেয়ে বেশ তাগড়াই। আর ও মা! দৌড়ায় যেন ছিলাছেঁড়া বাণ। ঠিক তোমার মত। মুখে না হাসলেও মেয়েটার চোখ উপচানো হাসির খোঁচা কিছু কম নয়।

পেটের নাভি থেকে সারা শরীরে ছড়িয়ে যাওয়া একটা রাগের কালবোশেখি ঝড় স্বপনকে গ্রাস করছিল। এর আগে অবধি মেয়েটার জন্য একটা আলুকসুলুক ভাব জেগেছিল। এবার আর পারল না। ধুস শালা, নিকুচি করেছে বালের ক্লাস। অমন খাবারে আমি পেচ্ছাপ করি! ওখানে আর দাঁড়িয়ে থাকলে আরও মুখ খারাপ হবে। স্বপন কোনওদিকে না তাকিয়ে বাড়ির দিকে হনহন করে হাঁটা দিল।

মেয়েটার হাতে একটা ঢাউস টিফিন ক্যারিয়ার। খাবারের থালা আর জলের ক্যানের পাশে ধুপ করে নাবিয়ে রেখে স্বপনের পিছন পিছন দৌড়ে এল। আরে আরে বাবুর রাগ হয়েছে দেখছি। এমন কী বললাম? স্বপন যে গতিতে হাঁটছিল ওকে ধরতে মেয়েটার না দৌড়ে উপায় ছিল না। দাঁড়াও, দাঁড়াও রাগ করো না, লক্ষ্মী বাবু আমার। এই মুহূর্তে মেয়েটার কথায় চিনির মোড়ক। নতুন ছেলে এসেছে, যদি তার মস্করায় চলে যায় তবে কালিস্যার আজ ওকে আস্ত রাখবে না।

এরকম লক্ষ্মী বাবু বলে কেঊ কোনওদিন ডাকে না স্বপনকে। তার গলে যাওয়া উচিত। কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার, গরম তেলে ঠান্ডা জল ছেটানোর মত মিষ্টি কথায় সে আরও তেলেবেগুনে জ্বলে উঠল। না রাগ করবে না! পায়ে পা লাগিয়ে ঝাঁট গরম করিয়েছে, এখন এসছে পুলটিস লাগাতে। আরও জোরে জোরে পা চালাল স্বপন। স্বপনের দ্রুত পা বাড়ানোটা এমন যে দৌড়েও তাল রাখা মুশকিল। মেয়েটা এবার খপ করে ওর বাঁ হাতের কব্জিটা পাকড়ে ধরল। আর ধরেই স্বপনের চলার গতিতে হুমড়ি খেয়ে মাটিতে। এটা ও ইচ্ছা করে পড়েছিল না কি সত্যি হাতের টানে— এই নিয়ে কোনওদিন একমত হতে পারেনি ওরা ভবিষ্যতেও। কিন্তু এখন মেয়েটা পড়তেই স্বপনকে দাঁড়িয়ে পড়তে হল। মেয়েটা মাটিতে পড়ে গেছে, কনুইয়ের কাছে নুনছাল উঠে গেছে। লম্বা স্কার্ট হাঁটু ছাড়িয়ে উঠে গেছে, বকের মত সাদা হাঁটুতেও ছড়ে যাবার লাল দাগ চেপে বসেছে। কিরকম লজ্জা করল স্বপনের। এতটা খচে যাওয়া উচিত হয়নি। নিজেকেই দুষছিল স্বপন। কী এমন বলেছে যে এত ডাকার পরও থামা গেল না?

–কী হল, আমি ভেটকে পড়ে আছি আর তুমি জিভ কেটে কালিমার পোজ দিচ্ছ। এইভাবে আর বেশিক্ষণ থাকলে কালিস্যার তার দলবল নিয়ে এখুনি হইহই করে এসে তোমাকে পেঁদিয়ে বেন্দাবন দেখাবে, সেটা মনে রাখো। নিজের ভালো চাইলে হাতটা ধরে তোলো এবার।

হাতে হাত ধরেই সন্ধি হল আপাতত। গায়ের ধুলো ঝেড়ে, স্কার্টটাকে পা পর্যন্ত টেনেটুনে খাবারের বাসনের পাশে বসল এবার মেয়েটা। অনেক ঝগড়া করেছ, এবার নামটা বলো তোমার। আমার আবার অচেনা লোকের সঙ্গে তক্কো করতে ভালো লাগে না।

যাব্বাবা! ও ঝগড়া করল না কি মেয়েটাই? শুরুর থেকে উল্টোসিধে চোপা করছে এমন! কিন্ত কথায় পারবে না জেনে নিজের নামটা বলে দিল। আর তোমার নাম?

–তোমার কোন ফুল সবচেয়ে ভালো লাগে? চোখ মটকে প্রশ্ন মেয়েটার।

এতক্ষণে একটা জুতসই জবাব মুখে এল স্বপনের। ধুতরো ফুল।

এইবার জিভ বের করে ভেঙাল মেয়েটা। ধুতরো ফুলের বিচি খেতে ভালোবাসো বুঝি। ঠিক করে বলো, না হলে ভালো হবে না বলে দিচ্ছি।

–এটা কি কোনও ধাঁধা?
–না, আমার নাম রে বাবা।
–তুমি আর ধাঁধায় ফারাকটা কি? বলেই আশ্চর্য হয়ে ভাবল, একবার মুখ খুলে গেলে লাগসই কথাগুলো কেমন সড়াত সড়াত করে পিছলে বেরোয় তো!
–বলবে? রাগ দেখালেও স্বপনের বুদ্ধির পরিচয়ে যেন বেশ খুশি হল মেয়েটা।
–চাঁপা?
–উঁহু।
–কাঁটাওলা গোলাপ?
–ভালো হবে না বলছি।

আর কী কী ফুলের নামে কোনও মেয়ের নাম হতে পারে ভাবছিল স্বপন।

–সুগন্ধি। মেয়েটাই ধরিয়ে দেয়। পুজোয় লাগে।
–জবা।
–ধুত, জবার গন্ধ আছে তেমন? বোকচন্দর কোথাকার! আচ্ছা, শুরুর অক্ষর শ দিয়ে। লাস্ট চান্স। এবার না পারলে ব্যস।

এরকম একটা বোকা বোকা খেলায় এত ভালো লাগছিল স্বপনের! কাকলি কি সুবলের সঙ্গে এভাবে কথা বলে? বিশ্বাস হল না স্বপনের। তার জানাচেনা কোনও মেয়েকে এমনভাবে কথা বলতে শোনেনি। চনমন করছে শরীরটা। নিঃশ্বাসে গরম ভাপ। লাস্ট চান্সে না পারলে কী হবে ভেবে পেটটা গুরগুর করে উঠল।

–কী ব্যাপার! চুপ করে আছ কেন?
–আসলে পেটে আসছে মুখে আসছে না। লজ্জা লজ্জা মাখা মুখে বলল স্বপন।
–কথা পেটে আসে না কি? বুকে আসে। বলে নিজের বুকের দিকে আঙ্গুল দেখাতেই স্বপন আবার ভেবরে গেল। পনেরো ষোল বছরের একটা মেয়ের বুকের রহস্য জানার জন্য মনটা ছটফট করে উঠল। কিন্তু মাথা থেকে সেই ভাবনা সরিয়ে নাম ভাবার চেষ্টা করল। শাপলা? ধুর ওটা তো খায়, পুজোয় আবার দেয় কখন! শিউলি? কিন্তু, কিন্তু করে বলেই ফেলল।

শিউলির মুখ হাসিতে ভরে গেল এবার। গোলাপি মাড়ির আভাস দেখিয়ে কচি কচি দাঁতগুলো বেরিয়ে এল নির্মল শুভ্র শিউলিফুলের মত। কেন ওর নাম শিউলি সেটা নিমেষে পরিষ্কার হয়ে গেল স্বপনের কাছে।

 

কালিপদ স্নান সেরে গামছা মেলতে মেলতে গুনগুন করছিল— আগুনের পরশমণি, ছোঁয়াও প্রাণে। এই গানটা গাইলে মনে কেমন একটা উত্তেজনা আসে। আবেগপ্রবণ মানুষ কালিপদ। পুরুষদের কাঁদা মানায় না বলে মনেপ্রাণে বিশ্বাস করে, অথচ খুব সহজেই আবগে তার গলা বুজে আসে। খাঁকারি মেরে গলাটা পরিষ্কার করে এবার জোর গলায় ধরল।

সঙ্গে সঙ্গে মল্লিকার ধমক। কী হেঁড়ে গলায় চিৎকার ছেড়েছ বলো তো? ফুর্তিতে গড়ের মাঠ। অত রাগ দেখিয়ে বলেনি, বরং গলায় বেশ সোহাগের ছোঁয়া। লোকটা আজ কোনও কারণে খুশি আছে বোঝা যাচ্ছে। কারণটা জানতে চায়।

–গাইব না? মুখটা কাঁচুমাচু করে বলল কালিপদ। খালি গা, পরনের নীল চেককাটা লুঙ্গিটা দু পালটি করে হাঁটু অবধি গুটানো। শ্যামবর্ণ শরীরের অনেকটা অংশ অনাবৃত। বুকের ঘন চুলে একটু একটু পাক ধরেছে। বয়স তো বাড়ছে। কিন্তু সব ছাপিয়ে ব্যায়াম করা পুরুষালি চেহারা ঝলমল করছে। তবুও মল্লিকার সামনে দাঁড়িয়ে আছে যেন স্কুলের বাধ্য পড়ুয়া। দেখে এমন মজা লাগল মল্লিকার। এমন নয় যে এরকমটা নতুন কিছু, ও এইরকমই। সবসময়। মাঠের টান না থাকলে বোধহয় সারাদিন মল্লিকার আঁচল ধরেই বসে থাকে।
–আচ্ছা আচ্ছা গাও। লোকটার কোনও খুশিতেই বাধা দিতে চায় না কোনওদিন। যা নিয়ে খুশি থাকে, থাকুক না। বিয়ের পরে পরেই বুঝে গেছিল যে এ আর পাঁচটা লোকের মত খাইদাই বগলবাজাই টাইপের নয়। মাঠ অন্ত প্রাণ, খেলার মাঠে ছেলেগুলোকে নিয়ে দৌড়ঝাঁপ করতে করতে স্বপ্নের জাল বোনে। কালিপদ এরকম টগবগ করা মানেই মাঠে ভালো কিছু ঘটেছে। কোথাও রেস ছিল, তাতে তার পোষ্যদের মধ্যে কেউ জিতে এসেছে। কিংবা তালিমের সময় ভালো টাইম করেছে। হয় এমন একেকদিন, সকালবেলা মাঠ থেকে বাড়ি ঢোকে একেবারে হাঁকডাক করতে করতে। মল্লি, মল্লি কী হয়েছে শোনো! প্রথম প্রথম সেও ভাবত কি না কি হয়ে গেছে, কেউ এসেছে বুঝি। হাত মুছতে মুছতে রান্নাঘর থেকে বেরোতেই কালি হুড়মুড়িয়ে উঠত, জানো আজ কী হয়েছে? পালান আজ চারশো মিটারে একবারে দুই সেকেন্ড কমিয়ে দিয়েছে। কী আনন্দ, কী উল্লাস! যেন লটারি জিতে বাড়ি এল। দু সেকেন্ডে মানুষের কী হয়? তার এমন অবোধ প্রশ্নে কালিপদর কী লাফালাফি! কী দুঃখ! তুমি কালিস্যারের বউ হয়ে বলছ দু সেকেন্ডে কী হয়? জানো এর একশো ভাগের এক ভাগ কমাতে কত পরিশ্রম করতে হয়? লোকটার বিস্ময় আর অবিশ্বাসে মাখা চোখমুখ দেখে বলেছিল আচ্ছা বাবা, আচ্ছা! কী করবো বলো পেট থেকে পড়েই তো আর শ্যামাস্যারের বউ হইনি, আমাকে শিখালে শিখে নিতাম না হয়।

মল্লিকা বরের নাম নেয় না, তাই নাম নিতে হলে কালির কোনও একটা অবতারের নাম গুঁজে দেয়। কিন্তু যখন যে নামেই ডাকুক, কালিপদকে হাতের পাতার মত পড়তে পারে মল্লিকা। আর যখন পারে না তখন খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে পেট থেকে কথা বের করে আনে। ওই তো যখন সুবীর বলে ছেলেটা রেলের হয়ে ন্যাশানাল খেলতে গেল। কী গোমরা মুখ কদিন। কিছুতেই বলবে না কী হয়েছে। দুদিন ধরে ঘ্যান ঘ্যান করে পেট থেকে কথা বের করতে হল। মল্লিকাই তখন বুঝাল। এমন অবুঝ হলে চলে? রেলে তুমিই ওর চাকরি করে দিয়েছ। এখন রেলের হয়ে দৌড়াতে যাবে, ওঁর সঙ্গে ওদের লোকজন থাকবে। তোমাকে নেবে কেন?

–তুমি বুঝবে না মল্লিকা। কী যে কষ্ট! শুকনো মুখে বলেছিল কালিপদ। নিজে তো ন্যাশানালে ওই পোডিয়ামে  দাঁড়াতে পারিনি। অন্তত আমার চোখের সামনে যদি আমার ছেলেটা সোনা পায়, জীবনের কিছুটা তো সার্থক।

কালিপদর এই দুঃখ কোনওদিন যাবার নয়। সে বছর স্টেটে আটশো মিটারে ওই চ্যাম্পিয়ান। খুব ভালো দৌড়াচ্ছে, ন্যাশানালে মেডাল নেবে। এলাহাবাদে ন্যাশানালে যাবার আগের দিন বাবা মারা গেল। একমাত্র ছেলে, এমন কোনও লোকবল নেই। মাকে একা ছেড়ে কেমন করে যায়! তখন বয়স কম, নিজে নিজে কী করবে দিশা করে উঠতে পারেনি। নানা মুনির নানা মত। অমন দৌড় বছর বছর আসবে, বাবার কাজ না করে কোথায় যাবি?

কেউ বলল, বাবা তো মারাই গেছে। এখন তুই থাকাই বা কি না থাকাই বা কি।

মাকে দেখল কেমন জবুথবু হয়ে আছে। বাবার তো যাওয়ার সময় হয়নি তখনও, চাকরির আরও সাত বছর বাকি ছিল। বাবার এই হঠাৎ চলে যাওয়াটা মা নিতে পারছিল না। কালিপদও আবেগপ্রবণ মানুষ। গেল না। দুঃখের কথা ন্যাশানাল বছর বছর আসে, কিন্তু সংসারের জোয়াল কাঁধে পড়ে প্রাকটিসে ঢিল পড়ল। ও আর যেতে পারল না। এই না পারার গ্লানি বয়ে বেড়াচ্ছে সারাটা জীবন। নিজের মেডেল না পাওয়ার স্বপ্ন তিরতির করছে ছাত্রদের মধ্যে।

মল্লিকা জানে, বোঝে। সান্ত্বনা দেয়। পেল তো। তবে এত কষ্ট কেন?

কথাটা শুনে কেমন ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইল লোকটা। জানি, তাই জন্য গর্বও হয়। কিন্তু আমার ছাত্র হিসেবে তো কেউ জানল না। সেই কোন বয়েস থেকে ওকে গড়েপিটে নিলাম। এই কয়েকমাস মোটে রেলের টিমে গেছে। সব সুনাম ওই কোচটার হল। কি করেছে সে সুবীরের জন্য, বলো একবার!

মল্লিকা জীবনের বাস্তবটা বোঝে বেশি। অনুশোচনা অনুযোগ কম। সবার কোলজুড়ে ছেলেমেয়ে হয়। তার তো হয়নি। কী করা যাবে। কপালের লিখন কে খণ্ডাবে। তাই বলে দুপা ছড়িয়ে কাঁদতে বসলে লাভ আছে? হয়তো এই নির্ভেজাল জীবনভাবনার জন্যেই এখনও বেশ তাজা তরুণী। বিকেলের মালিন্য স্পর্শ করতে পারেনি। ছেলেমেয়ের পিছনে জীবনপাত করতে হয়নি, সেজন্যও হতে পারে। কোনওকালেই ডানাকাটা পরী নয় মল্লিকা, কিন্তু একটা আলগা শ্রী আছে। কুড়ি বছরের সংসারজীবনের পরেও। এসব মল্লিকা গায়ে না মাখলেও, কালিপদ কষ্ট পায়। জানে সেটা। নিজের একটা ছেলে নিদেনপক্ষে মেয়ে থাকবে। নিজে যেটা করতে পারেনি, নিজের সন্তানকে সেখানে পৌঁছে দেবে। হল না সেটা। কিন্তু এই যে এতগুলো পরের সন্তানকে— সবই তো হাঘরের— শেখাচ্ছে, খাওয়াচ্ছে, একটা ধসে পড়া জীবনের ভগ্নস্তূপ থেকে বের করে জীবনে কোনও না কোনওভাবে দাঁড়াবার সুরাহা করে দিচ্ছে, সেটা কি কম? কে জানে নিজের ছেলেমেয়ে থাকলে এমন করতে পারত কি না। সে নিজেই তো আটকাত। তখন এইসব ছেলেদের পিছনে একটা পয়সা খরচ করলেও গায়ে লাগত। মনে হত নিজের ভাগেরটা দিয়ে দিচ্ছি। নিজের ঘরের চাল উড়ে গিয়ে তাদের পৃথিবীটা অনেক বড় হয়ে গেছে।

সেদিন দুহাতে বুকে টেনে নিয়ে মাথার চুলে বিলি কাটতে কাটতে সান্ত্বনা দিয়েছিল লোকটাকে। মনে করো আমাদের কাকের বাসা। কোকিল বড় করে গান গাওয়ার জন্য ছেড়ে দিচ্ছি। কেউ কোথাও বসে নিশ্চয় তোমাকে আশীর্বাদ করছে। তাছাড়া সুবীর তো তোমাকে ভোলেনি রে বাবা। ওঁর কী দোষ। রেলে চাকরি করে, দলের সঙ্গেই তো ওকে যেতে হবে। এমন কিছু লেখাপড়া তো নয় মল্লিকার। তবু সব কিছু এমন সহজ করে কীভাবে বুঝে যায়, বোঝায়। কালিপদ মল্লিকার সংসারবোধে সবসময়েই চমৎকৃত হয়ে থাকে।

হাওড়া স্টেশনে নেবেই ছুটতে ছুটতে এসেছিল সুবীর। পা ছুঁয়ে প্রণাম করে মেডেল দেখিয়ে গেছে। সঙ্গে এক হাঁড়ি মিষ্টি। আর কী চাই?

তখন অবশ্য লোকটার একমুখ হাসি। ও চলে যেতে বলল, তুমি ঠিক বলেছ মল্লি, আমাদের আর কী চাই? এই যে ওকে দাঁড় করিয়ে দিলাম, সোনা পেয়ে আমাকে প্রণাম করতে ছুটে এলো, বুকটা কেমন গর্বে ভরে যায় না? আমি ওকে বলেছি কাল সকালে মেডেল নিয়ে মাঠে আসতে। অন্য ছেলেগুলোও দেখে বল ভরসা পাবে।

–বললে না তো কী কারণে আজ এত খুশি। চাল বাছতে বাছতে আবার জিজ্ঞেস করল মল্লিকা।

কদিন ধরে একটা নতুন ছেলে আসছে, বুঝলে। একদম খাঁটি হীরে।

তোমার জহুরির চোখ, তুমি তো খাঁটি হীরেই তুলে আনবে। মুখ টিপে হেসে বলল মল্লিকা।

–শুধু তুলে আনলেই হবে না মল্লি, হীরের আসল রূপ কীভাবে তাকে কাটলাম তার উপর। তবে না তার আসল ছটা। বলতে বলতে কালিপদর চোখে স্বপ্নের ছায়া ঘনায়। এই ছেলেটার মধ্যে আছে জানো। দৌড়াচ্ছিল মনে হচ্ছে ঠিক যেন শ্রীরাম সিং। সেইরকম অনায়াস দৌড়ে সবাইকে ঠেলে এগিয়ে চলেছে।
–শ্রীরাম সিংটা কে গো? অচেনা নাম, মল্লিকা ধরতে পারে না। এর আগে ওর মুখে শোনেনি তো।
–আহা, দেখলে না সেদিন টকিজে? মনে নেই আমরা মুকাদ্দার কি সিকান্দার দেখতে গেসলাম। সিনেমা শুরুর আগে এশিয়ান গেমসের রিল দেখাচ্ছিল? আটশ মিটারে সোনা পেল ছেলেটা। উফ, কি দৌড়ায়! ভাবতে পারো, এই নিয়ে দুবার! তেহরান এশিয়াডেও সোনা তুলেছিল। আসলে সেদিন সিনেমার থেকেও ওই ফুটেজ দেখতে যাওয়াই আসল উদ্দেশ্য ছিল কালিপদর। মনের মধ্যে সেই ছবি ভেসে আছে। কিন্তু মুশকিল কী জানো, যার মধ্যে আছে, সে নিজে তো বোঝে না। অত দূরেরটা দেখতেও পায় না। ওটাই আমাদের কাজ। খুঁজে বের করা আর পালিশ দেওয়া।

একটু থামল কালিপদ। কিন্তু মল্লিকা জানে এখন আর খোঁচাতে হবে না। একবার বলতে শুরু করেছে যখন,  পেটের কথা, মনের কথা সব গলগলিয়ে বমি করবে।

–শুরুতে কি চ্যাটাং চ্যাটাং কথা, ভাবতে পারবে না। একেবারে বুনো মোষ। কীভাবে বাগে আনবো সেটা ভেবে কূলকিনারা পাচ্ছিলাম না। কিছুতেই দৌড়াতে আসবে না। বলে কী হবে দৌড়ে? পয়সা দেবে? মল্লিকার দিকে মুখ ফিরিয়ে লাজুক হাসল কালিপদ। আরে বাবা, আমার নিজের পুকুরে ঘটি ডুবালে জল ওঠে না। আমি তোকে কোথা থেকে পয়সা দেব? হ্যাঁ, ভালো দৌড়ালে তোকে পয়সার দোর অবধি পৌঁছে দিতে পারি। ব্যস, ওই পর্যন্ত। একটা আত্মপ্রসাদের হাসি মুখে ছড়িয়ে দিল কালিপদ। এই কদিনেই কেমন দৌড়াচ্ছে ভাবতে পারবে না! যা বলি মন দিয়ে শুনছেও খুব।
–বাব্বা! তুমি জাদুটোনা জানো তাহলে বলো! কীভাবে কালিপদর মনের খুশি উসকে দিতে হয় সেটা মল্লিকার নখদর্পণে।

মুচকি হেসে কালিপদ মাথা নাড়ে। না গো না, ও ছেলে অত সহজে আমার বশে আসার ছিল না।

–তাহলে?
–শিউলি।
–ওমা কী বলছ গো? লভ ভালোবাসা হচ্ছে তোমার কেলাসে? গলায় একটু চিন্তার কালো মেঘ মল্লিকার। কালিপদ হাসিমুখে চুপ করে আছে দেখে আবার বলে, জানো তো এসব হলে পরে সামলাতে মুশকিল হয়ে যেতে পারে? তাছাড়া তোমার ছেলেগুলো আসে বড় গরীব ঘর থেকে আর শিউলির বাপ অন্নপূর্ণা হোটেলের মালিক। ওঁর বাপ জানতে পারলে সস্তায় খাবার পাচ্ছিলে, সেসব চুলোয় যাবে কিন্তু।

এইসব মাথায় রাখে না কালিপদ এরকম না। শুধু বংশী মিত্তিরের জন্য নয়। দোকান করেছে, কামাচ্ছে ভালো। কিন্তু পয়সা হলেই ওমনি বনেদি লোক হয়ে যায় না কেউ। কিছুই তো ছিল না, দুর্গাপুরে এসে প্রথমে একটা চালা মত করেছিল। লেগে গেছে, তরতর করে বড় হয়ে গেছে। দুকথা শোনাতে আসলে কালিপদও শুনিয়ে দেবে না হয়। অমন সোমত্ত মেয়ের হাত দিয়ে খাবার পাঠায় কেন? সে কিছু তার মেয়েকে সামলানোর ঠেকা নিয়ে রাখেনি। আর ও খাবার না দিলে মাতৃভাণ্ডার থেকে নেবে। ওসব নিয়ে কালি ভাবে না। তার চিন্তা অন্য ছেলেগুলোকে নিয়ে। তারা কী চোখে দেখবে ব্যাপারটা সেটাও ভাবার কথা। তার প্র্যাকটিসের মাঝখানে কিছু হলে সে এমন দেখেও না দেখা করে থাকত না। কিন্তু এসবই হয় প্র্যাকটিস হয়ে যাওয়ার পরে। শিউলির কাজ রোজ সকালের খাবার বয়ে নিয়ে দিয়ে যাওয়া। আবার খাওয়া হয়ে গেলে এসে সব গুটিয়ে ফেরত নিয়ে যাওয়া। কিন্তু স্বপন আসার পর থেকে দেখছে রোজদিন আর ফিরে যাচ্ছে না। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দৌড়ানো দেখে। আবার দৌড়ের শেষে স্বপন ওর বাসন এগিয়ে দিচ্ছে সেটাও নজর করেছে। শিউলি দেখে বলে দৌড়ের সময় আরও যেন বেশি উৎসাহ স্বপনের। টনিকের মত। সেটা তো ওর দৌড়ের জন্য ভালোই। তাহলে কেন কালিপদ না করবে?

তার চিন্তা অন্য দিকে। ছেলেটাকে চারশো মিটার হার্ডলসে নাবানোর ইচ্ছা। তার বদ্ধমূল বিশ্বাস ও ভালো করবে। ওঁর জন্য একটা ভালো জুতো চাই, তিন ফুটের দশ বারোটা হার্ডলস কিনতে হবে। বেশ খরচ। কালিপদর মুখ যেন মনের আয়না। চিন্তার মেঘ মুখটা ঘোলাটে করে দিল। চাল বাছা শেষ করে উঠে যাচ্ছিল মল্লিকা। দেখে থমকে দাঁড়াল। আবার কী হল। মাথা ধরেছে? চা দেব?

জবাবের অপেক্ষা না করেই দ্রুতপায়ে রান্নাঘরে ঢুকে চায়ের দুধ, জল চিনি চা পাতা দিয়ে চাপিয়ে দিল মল্লিকা। তার এখন অনেক কাজ। কথায় কথায় দুপুরের বাসন মাজা হয়নি, এঁটো পড়ে আছে। দুপুরের খাবারগুলো এখুনি গরম করে না রাখলে আবার গন্ধ ধরে যাবে। বিকেলে আর উনুন ধরায় না মল্লিকা। দুটো তো মানুষ। সকালের ডাল আর সবজিটা থাকে। কটা হাতে গড়া রুটির জন্য আর উনুন জ্বালিয়ে লাভ নেই। হিটারেই কাজ সেরে নেয়। বাসন মাজতে মাজতে চা ফুটে গেল। আঁচলে হাত মুছে দুটো মেরি বিস্কুট আর চা নিয়ে এসে দেখে, ওমা লোকটা এখনও শূন্য চোখে তাকিয়ে কী ভাবছে।

এবার সত্যি রেগে গেল মল্লিকা। কী হয়েছে বলবে তো। বাড়ির লোক এমন থোবার মত মুখ করে বসে থাকলে আমার গা জ্বালা করে।

–টাকা চাই মল্লি। একটা দীর্ঘশ্বাস বুকে চেপে করুণ চোখে তাকায় কালিপদ। এই নতুন ছেলেটার জন্য…
–মাসের শেষ, এখন আর কোথায় টাকা আসবে বলো তো। মল্লিকার উষ্মা বুঝতে পেরে একটু থতমত খায় কালিপদ। না, না আজকেই কিনতে হবে না তো। কিন্তু মাসের টাকাতেও হবে না ওসব। খরচ আছে।
–ধারবাকিতে কিনতে পারো না?
–আগের টাকা বাকি আছে, শোধ না হলে ওরা আর দেবে না।
–লোকের জন্য করছ, তুমি কাউন্সিলারকে ধরতে পারো না?
–জানো তো শাসমলকে। যদি কিছু জোগাড় করে দেয়, তারপর সেই অজুহাতে ছেলেগুলোকে কোনও না কোনওভাবে ওর পার্টির কাজে লাগাবে। আজকাল এই হয়েছে, সব কিছুতে লাল ছাপ লাগাতে হাবে। ভালো কাজ হলে তাও ঠিক ছিল, পাঠাবে ওর হয়ে মস্তানি করতে। ওসবের মধ্যে জড়াতে চাই না আমি। একটা কাজ করছি, এরপর শান্তিতে আর করতে পারব না।
–তাহলে কী করবে? কত টাকা লাগবে?
–পাঁচশো হাজারের কমে হবে না।
–সে তো অনেক টাকা গো। মল্লিকা এতক্ষণ তার লক্ষ্মীর আসনের ভাঁড়ের কথা ভাবছিল। কিন্তু অত টাকা কোথা থেকে আসবে?
–অন্তত আটশো তো লাগবেই।

হাতের বালাটার দিকে দেখল একবার মল্লিকা। এটা নেবে? দু ভরির বেশী হবে। খাদ বাদ দিলেও হাজার দিয়ে দেবে তোমায়।

–না, না। আঁতকে উঠল কালিপদ। তোমার বিছেহারটা এখনও গড়িয়ে দিতে পারিনি। আবার এটা নেব?

যখন কালিপদ কোচ হওয়ার ট্রেনিং নিতে গেল পাতিয়ালা, অনেক টাকা লেগেছিল। তখন গলার বিছেহারটা খুলে দিয়েছিল মল্লিকা। কিন্তু কিন্তু করে নিয়েও নিয়েছিল কালিপদ। বলেছিল, দেখো একদিন ঠিক… কিন্তু সেই একদিন আজও আসেনি । দেখতে দেখতে পাঁচ বছর হয়ে গেল তার। রুপোর একটা হার পরে ঘুরে বেড়ায় মল্লিকা। তার ওপর আবার এই বালা নেবে। কক্ষনও না।

এটা কবেকার বালা বলো তো। মোটা হয়ে গেছি, হাতে কেটে বসে। এমনিতেই একটা বড় গড়াতে হবে। এটা গেলে তোমার চাড় হবে নতুন করে একটা বানিয়ে দেওয়ার। মুখে হাসি টানে মল্লিকা। দিতে তার বুক ফেটে যাচ্ছে, কিন্তু লোকটার মুখ দেখে প্রাণ কাঁদছে আরও বেশি। কী হবে তার বালা দিয়ে? এই লোকটাই তো তার সব। নাও এখন, আসছে অক্ষয়তৃতীয়াতে একটা গড়িয়ে দিও। একদম, না দিলে আমি উপোস দেব, এই বলে দিলাম। হাতের বালাটা খুলে কালিপদর হাতে গুঁজে দিয়ে তাড়াতাড়ি রান্নাঘরের দিকে পা বাড়ায় মল্লিকা। সোনার প্রতি মেয়েদের একটা টান থাকে, সব মেয়েরই। হাতের বালা খুলে দিতে যদি আলটপকা চোখে জল এসে যায় তো মল্লিকা কী করবে?

 

(আবার আগামী সংখ্যায়)