কুন্তলা বন্দ্যোপাধ্যায়
‘এই তো, নিদান সব দেওয়াই আছে।’ লাল চামড়া বাঁধানো প্রকাণ্ড বইখানা কোনওমতে কোলের ভেতর সাঁটলেন মন্ত্রীমশাই। ‘দুই হাত পিছমোড়া করে শিমূলকাঁটার শেকল বেঁধে, হাতুড়ি মেরে জং ধরা পেরেক মাথা ঘিরে মুকুটের মতো বিঁধিয়ে, বিছুটি পাতার রসে চুবোনো সুতো দিয়ে চোখের পাতা সেলাই করে রানিমারের মাঠে গর্ত করে হাঁটু পর্যন্ত পুঁতে দেওয়া। তারপর অপেক্ষা। উত্তরের বনের শেয়ালগুলো সারাবছর আধপেটা খায়, শ্মশানের মড়ার মাংস নিয়ে কামড়াকামড়ি করে, গোঙানি শুনে আর জ্যান্ত মাংসের গন্ধ পেয়ে দেখতে আসবে ব্যাপারটা কী। প্রথমটা সতর্ক হয়ে দূরে দূরে পাক খাবে, তারপর একটা দুটো সাহসী শেয়াল মাটি শুঁকতে শুঁকতে এগোবে। পিছু পিছু দলের সবাই, জিভের লালা ফেলতে ফেলতে…’
রাজপুত্র ছিটকে উঠে পড়লেন।
‘অলরাইট, অলরাইট। আমি আজকেই চলে যাচ্ছি। ওঃ, আপনারা কি মানুষ?’
মন্ত্রীমশাই মাথা নেড়ে বললেন, ‘কূটনীতির রাস্তা বড় বন্ধুর বাপান। হাত পা বাঁধা আমার। এই যা সব পড়ে শোনালাম, সেগুলো ছোটরানির সঙ্গে করতে আমার কি হাত সরবে, বলো? কিন্তু রাজধর্ম। জনাদেশ।’
মন্ত্রীমশাই সবসময় এটা করেন। যেই না বুঝিয়ে দেওয়ার ব্যাপার থাকে যে রাজপুত্র স্রেফ নামেই, আসলে তুমি নিধিরাম সর্দার, অমনি রাজপুত্র সম্বোধন বাতিল, অমনি বাপান।
রাজপুত্রও এটা করতে পারেন উল্টে। মন্ত্রীমশাইকে হরিপদ বলে ডেকে উঠে। ওঁর আসল নামটা গোটা রাজ্যে হাতে গোনা যে কজন জানে, রাজপুত্র তাদের মধ্যে একজন। মন্ত্রীমশাই ওই নাম ভুলেও ব্যবহার করেন না। সই করতে হলে হিজিবিজি কেটে নিচে দড়াম করে সিংহের হাঁ-মুখওয়ালা রাজসরকারি সিলমোহর মেরে দেন।
কিন্তু হরিপদমন্ত্রী (রাজপুত্রর রাগ হয়ে গেছে তাই মাথার মধ্যে আপাতত হরিপদ ছাড়া কিছু আসছে না) জানে যে রাজপুত্র এটা করবে না। তোমার ভদ্রতাই যখন বিপক্ষের অস্ত্র, তখন তো যুদ্ধ শুরু হওয়ার আগেই শেষ।
চাইলে রাজপুত্র অনেকগুলো কথা বলতে পারতেন। যেমন, ‘কোথায় জন? কীসের আদেশ? আমি তো আশেপাশে আমাকে, আপনাকে আর বাবাকে ছাড়া কাউকে দেখছি না। বাবাকেও গুনতি থেকে বাদ দেওয়া যায়। তিনি তখন থেকে সিংহাসনের হাতলে কনুই রেখে হাতের আঙুল দিয়ে মুখ ঢেকে ভান করছেন যেন মনোজকুমার কিন্তু আসলে তাকিয়ে আছেন হাতলের ওপর রাখা বনদেবীদের ছবির দিকে। তাকিয়ে আছেন আর ফিক ফিক করে হাসছেন, আঙুলের ফাঁক দিয়ে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে।’
বললেন না। রাজপুত্র লস্ট কজ দেখলে চিনতে পারেন।
তাছাড়া ছোটরানির অপরাধটাই বা কী? ষড়যন্ত্র? ব্যভিচার? প্রজাদের বিদ্রোহে প্ররোচনা? রাজপাকশালা থেকে বিস্কুট চুরি? সকালবেলা ডানের বদলে বাঁ কাতে ঘুম থেকে ওঠা?
যায় আসে না। সত্যিটা হচ্ছে রাজার মন এবং নিয়ন্ত্রণ রাজ্যশাসন থেকে সম্পূর্ণ উঠে গেছে, হরিপদর টিয়াপাখি নাক (রাজপুত্রের রাগ এখনও পড়েনি কাজেই তিনি বডি-শেমিং-এ প্রবৃত্ত হয়েছেন) রাজসিংহাসনের গন্ধ পেয়েছে। পথের কাঁটা রাজপুত্র। তাকে রাজ্যছাড়া করতে পারলেই হরিপদমন্ত্রীর রাজা হওয়ার রাস্তা পরিষ্কার। আর রাজপুত্রকে রাজ্যছাড়া করার সেরা উপায় হল এই প্রাসাদে একমাত্র যার প্রতি রাজপুত্রের টান এখনও রয়ে গেছে, সেই ছোটরানির, বাপানের মায়ের, প্রাণনাশের হুমকি দেওয়া।
হুমকিটা ফাঁপা নয়। রাজবাড়ির উত্তরের পাঁচিলের ওপারের ন্যাড়া মাঠটার নাম রানিমারের মাঠ। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে বেঁটে রানি, লম্বা রানি, রোগা রানি, মোটা রানি, সেয়ানা রানি, নিজের-ভালো-নিজে-না-বোঝা রানি, রাজা/মন্ত্রী/সেনাপতি/পুরোহিতের থেকে বেশি বুদ্ধিমান রানি, কারও ল্যাজে পাড়া না দেওয়া কিন্তু রাজা/মন্ত্রী/সেনাপতি/পুরোহিতের সন্দেহ হওয়া কে-জানে-ভবিষ্যতে-ল্যাজে-পা-দিলেও-দিতে-পারে রানি— যতরকম, সবরকম রানিদের ওই মাঠে মারা হয়েছে। মারতে মারতে মাঠের নামই হয়ে গেছে রানিমারের মাঠ। ওই যে লালচামড়া বাঁধানো রাজ্যশাসনের ছাত্রবন্ধু, ওর একটা গোটা চ্যাপ্টারের নাম ‘অসুবিধেজনক রানিদের হত্যাপ্রক্রিয়া’। শূলে চড়িয়ে, মাটিতে পুঁতে, জানোয়ার দিয়ে খাইয়ে— সেদিন কর্তৃপক্ষের ঘুম থেকে উঠে মনমেজাজ কেমন থাকে বুঝে অজস্ররকম বৈচিত্র্যপূর্ণ প্রক্রিয়ার মতলব দেওয়া আছে।
হরিপদ যেমন মরিয়া, সবকটা প্রক্রিয়ার ককটেল করলেও রাজপুত্র অবাক হবেন না। তার থেকে সিংহাসনের দাবি ছেড়ে চলে যাওয়াটাই বেস্ট।
রাজপুত্র থাকতেও চান না। কে থাকে এখানে? একটা ঝিম মারা প্রাসাদ। একটা ধুঁকতে থাকা রাজ্য। খেতেপরতে না পাওয়া, পড়তে না পাওয়া এবং না চাওয়া প্রজার দল। খালি পারে সবলের মার খেতে আর দুর্বলকে মারতে আর নিজেদের মধ্যে খেয়োখেয়ি করে মরতে। উত্তরের বনের শেয়ালগুলোর সঙ্গে আকারআকৃতিতেই যা তফাৎ।
কিন্তু ছোটরানির প্রাণের ভয় দেখিয়ে রাজপুত্রকে রাজ্যছাড়া করার হরিপদর এই যে কৌশল, এটা অপমানজনক।
‘পথে যা যা লাগতেটাগতে পারে একটা থলেতে ভরে দিতে বলেছি, ঘরের বাইরে থলে নিয়ে লোক দাঁড়িয়ে আছে। আর এই যে,’ হরিপদর হাতে একটা গোল্লা পাকানো রেশমি কাপড়। রাজবাড়ির কোণে কোণে, পালঙ্কের নিচে, আলমারির পেছনের ধুলোয়, ওই রকম গোল্লা পাকানো কাপড় গণ্ডায় গণ্ডায় গড়াগড়ি খাচ্ছে। ওগুলোকে বলে ‘সার্কুলার’। রাজবাড়ির জানালা কে খোলা রেখেছে, কে কল টিপে বন্ধ করেনি, কে বাগান থেকে পা না ধুয়ে ঢুকে সারা প্রাসাদ কাদা করছে— সবের জন্য এতদ্বারা, অনুমত্যানুসারে জাতীয় ভাষায় লেখা ও জিনিস একটা করে ইস্যু হয়। নিচে হরিপদর হিজিবিজি আর সিলমোহর।
তবে এই রেশমি সার্কুলারের বয়ান অতটাও তুচ্ছ নয় বলেই রাজপুত্রের সন্দেহ।
‘সার্কুলারে উল্লিখিত তিনটি কাজ সফলভাবে সম্পন্ন করলে রাজপুত্র নিজেকে রাজসিংহাসনের উপযুক্ত প্রমাণ করতে পারবে এবং রাজপ্রাসাদের দরজা রাজপুত্রের জন্য উন্মুক্ত থাকবে।’ রাজপুত্রের সন্দেহ সত্যি করে হরিপদ পড়তে শুরু করল। ‘প্রথম কাজ উত্তরের বনের ডাইনিদের আগুনের কাঠ সংগ্রহ করা। দ্বিতীয় কাজ পূর্বের রাক্ষসরাজ্যের পাটরানির ঘরের দাঁড় থেকে হিরেমন চুরি। তিননম্বর আর শেষ কাজটি হল দক্ষিণের রাজ্যে কুড়ি বছর ধরে ঘুমিয়ে থাকা রাজকন্যার ঘুম ভাঙানো।’
তিন নম্বর কাজটার কথা রাজপুত্রর জানা। ছোটবেলায় গাল টিপে চুল আঁচড়াতে আঁচড়াতে রাজবাড়ির দাসি, কিশোরবেলায় চোখ মটকে কনুইয়ের ঠেলা মেরে এঁচোড়ে পাকা বন্ধুরা, কাজটার কথা রাজপুত্রকে ভুলতে দেয়নি। এক মারকাটারি যুদ্ধে দক্ষিণের রাজ্য ছারখার হয়ে গিয়েছিল কুড়ি বছর আগে। মন্ত্রীসান্ত্রী সেপাই বরকন্দাজ সব যখন মৃত, রাজারানির মরতে মিনিটখানেক, রাজতান্ত্রিক মন্ত্র পড়ে রাজ্যের একমাত্র উত্তরাধিকারী শিশুকন্যাকে ঘুম পাড়িয়েছিল কুড়ি বছরের মতো। সে রাত ছিল পূর্ণিমার। ভবিষ্যদ্বাণী মতো ঠিক কুড়ি বছর পরের পূর্ণিমার রাতে যদি কোনও রাজপুত্র এসে সোনার কাঠি রুপোর কাঠি, যা রাখা থাকবে তোশকের নিচে, রাজকন্যার দুই চোখের পাতায় ছোঁয়ায়— ঘুম ভেঙে যাবে। কুড়ি বছর পূর্ণ হবে আজ থেকে ঠিক তিন মাস পর।
‘কিন্তু সাবধান,’ হরিপদর মুখ সিরিয়াস হল, ‘যা করার করতে হবে পূর্ণিমার চাঁদ ওঠার আগেই। না হলে আবার কুড়ি বছরের জন্য রাজকন্যা ঘুমের ভেতর তলিয়ে যাবেন। শত পায়ে ধরলেও চোখ খুলবেন না।’
চমৎকার। একা কাজে রক্ষা নেই ডেডলাইন দোসর। ডাইনি আর রাক্ষসের খপ্পর পেরিয় রাজকন্যা পর্যন্ত আদৌ পৌঁছতে পারবেন কি না রাজপুত্রের সন্দেহ। রাজকন্যাকে সম্ভবত আরও কুড়ি বছর ঘুমিয়েই কাটাতে হবে।
যদি সবকিছু ঠিকঠিক ঘটে আর রাজপুত্র রাজকন্যার ঘুম ভাঙাতে পারেন তখন রাজকন্যা, দক্ষিণের রাজ্য সব রাজপুত্রের। চাইলে তিনি সে রাজ্যে সুখেশান্তিতে সংসার করতে পারেন বা বউ নিয়ে নিজের রাজ্যেও ফিরে আসতে পারেন। সিংহাসন তাঁর জন্য সাজানো থাকবে।
রাজপুত্র একবার নিয়মরক্ষা যাচাই করলেন। বেরোনোর আগে একবার ছোটরানির সঙ্গে দেখা বোধহয়…?
‘খবর পাওয়া গেছে রানিমার মাইগ্রেনের ব্যথাটা ফের উঠেছে। এই মুহূর্তে তাঁকে বিচলিত করাটা কি বিবেচনার হবে?’
রাজপুত্র ভাবলেন যাওয়ার আগে আর কাকে ‘আসছি’ বলা যায়। রাজামশাই এখনও লুকোনো ছবির দিকে তাকিয়ে ফিকফিক হেসে চলেছেন। রাজপুত্র বেরিয়ে এলেন।
**
রাজবাড়ির মাঠ কোণাকুণি পার করলেই আস্তাবল। রাজপুত্র মাঠ বেড় দেওয়া পাথরবাঁধানো রাস্তা ধরলেন। এ রাস্তা রানিমহলের গা ঘেঁষে যাবে। একসময় এই মাঠটাকে, এই বাড়িটাকে, নিজের বাড়ি মনে হত রাজপুত্রের। রাজপ্রাসাদ নয়, বাড়ি। এই মাঠে পৌষের রোদ্দুরে বসে মা উল বুনতেন, সোনার থালায় মোটা মোটা টসটসে কমলালেবুর কোয়া রাখা থাকত। পাশে ছিবড়ে ফেলার রুপোর থালা। থালার সোনারুপো নজর করার রাজপুত্রের তখন বয়স হয়নি। তখন বয়স সদাগরপুত্রর সঙ্গে খেলতে খেলতে মায়ের ডাক শুনে ছুটতে ছুটতে এসে কমলালেবু কোয়ায় টপ করে ছোঁ মেরেই আবার দৌড় মারার। আজকাল রাজপুত্রের মাঝে মাঝে সন্দেহ হয় সময়টা কি সত্যি? নাকি একটা মস্ত খেলানো স্বপ্ন? স্বপ্নজুড়ে উজ্জ্বল কমলা রং, উলের কাঁটার ঠুনঠুন, মায়ের হাসি। চারদিকে এত রোদ্দুর যে সে হাসি দেখতে হাত দিয়ে চোখ আড়াল করতে লাগে।
এখন অন্ধকারে মায়ের মুখ ঢাকা। রানিমহলের তিনতলার ঘরের মৃদু হলুদ আলোয় জানালায় মায়ের ছায়া ফুটে আছে। মা খবর পেয়েছেন বাপানের রাজ্য ছেড়ে যাওয়ার আদেশ হয়েছে তাই জানালায় এসে দাঁড়িয়েছেন। জানালার পাশ দিয়ে উঠেছে মায়ের প্রিয় কাঁঠালচাপা গাছে। ফুলের গন্ধে বাতাস ভারি হয়ে আছে।
কাঁচে মায়ের হাত উঠে এল। বাপান প্রত্যুত্তরে হাত তোলার চেষ্টা করল, তারপর দৌড়ল আস্তাবলের দিকে।
**
আস্তাবলের গেটের চল্লিশ ওয়াটের বাল্বের আলোর নিচে দাঁড়ানো ঘোড়াদুটোর সাদাটাকে সাদা আর অন্যটাকে বাদামী বোধ হচ্ছে কিন্তু ও বাদামী এমন গাঢ় যে তেমন তেমন আলোয় লাল বলে ভুল হয়। ঘোড়াদুটোর আশেপাশে নড়েচড়ে বেড়াচ্ছে একটা লোক। জিন পরাচ্ছে, নাল পরীক্ষা করছে, গুছিয়ে নিচ্ছে জরুরি যা নেওয়ার। খাবারদাবার, ওষুধবিষুধ, রাতের মতো জল।
একবস্ত্রে প্রাসাদ থেকে বেরিয়ে যাওয়ার আদেশ হয়েছে রাজপুত্রের। সদাগরপুত্রকে ছাড়া যাওয়ার আদেশ হয়নি। চাঁদের যেমন জ্যোৎস্না, প্রাণের যেমন শ্বাস, রাজপুত্রের তেমন সদাগরপুত্র। সদাগরপুত্রকে সঙ্গে না যেতে দেওয়া মানে রাজপুত্রর ছায়াকে আটকে রাখা।
‘রেডি?’ রাজপুত্র জিজ্ঞাসা করলেন।
‘রেডি।’ সদাগরপুত্র জবাব দিলেন।
ঘোড়ায় চড়ে বসলেন দুজন। সাদা ঘোড়া লাল ঘোড়া অনেকদিন পর প্রাণ খুলে ছুটতে পাওয়ার আশায় কেশর ঝাঁকিয়ে পা ঠুকল।
‘কোনদিকে?’ সদাগরপুত্র জানতে চাইলেন।
দুচোখ যেদিকে যায় সেদিকে গেলেই হয় তবু রাজপুত্র এক নিমেষ ভেবে সাদা ঘোড়া ছোটালেন উত্তরের বনের দিকে। পিছু নিল সদাগরপুত্রের লাল ঘোড়া। প্রাণ নিয়ে ফেরার আশা যখন নেই তখন প্রাণ পণ করেই ঝাঁপানো যাক।
**
রানিমারের মাঠ পেরোলে শ্মশান, শ্মশান পেরোলে উত্তরের বন। প্রকাণ্ড সে বনের গোপন, গহনতম অংশে ডাইনিদের বাসা। লোকে বলে রানিমারের মাঠে খুন হওয়া রানিদের প্রেতাত্মারাই ডাইনির চেহারা ধরে বনে বাসা বেঁধে থাকে। বাসার সামনে চব্বিশ ঘণ্টা জ্বলে আগুন। আগুন ঘিরে ঘুরে ঘুরে ডাইনিরা হাত পা ছুঁড়ে নাচে, পা ছড়িয়ে বসে শ্মশান থেকে কুড়োনো মড়ার মাথার খুলি থেকে ঢকঢক মদ ঢালে গলায়, খনখন হাসে। এমনিতে ফলমূল খেয়ে বাঁচে কিন্তু বেয়াদপ মানুষেরা চুরি করে বনে ঢুকে পশুপাখির অনিষ্ট করার উপক্রম করলে সে সব মানুষদের ধরে শিকে গেঁথে আগুনের ওপর ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে সেঁকে। মনোমতো সেঁকা হলে দাঁত দিয়ে মাংস ছিঁড়ে ছিঁড়ে আরাম করে চিবোয়, খাওয়া শেষে ঢেঁকুর তোলে।
কোনওদিন না নেভা সে আগুনের কাঠ জোগাড়ের প্রথম কাজ রাজপুত্র সম্পন্ন করলেন। কী করে করলেন, ওই ভয়ানক ডাইনিদের যুদ্ধে হারালেন নাকি বোকা বানালেন নাকি তাঁদের সঙ্গে কাণ্ডজ্ঞানসম্পন্ন ভদ্রসভ্য মানুষের মতো ব্যবহার করে সব খুলে বললেন আর ব্যাপার শুনে ডাইনিরা, ‘এই নে’ বলে জ্বলন্ত আগুনের মধ্যে হাত ঢুকিয়ে একটা কাঠ আপনি রাজপুত্রের হাতে গুঁজে দিলে, সেটা আরেকদিনের গল্প।
**
পুবের রাজ্যের পাটরানির দাঁড় থেকে হিরেমন চুরির দ্বিতীয় কার্যটিও সমাধা হল। আগেরটার তুলনায় কিঞ্চিৎ অশান্তিপূর্ণ উপায়ে। রাজ্যের সেপাইসান্ত্রীরা মারকাট করার জন্য মাসমাইনে পায়, তারা রাজপুত্র সদাগরপুত্রকে নাকাল করলে। প্রাসাদের প্রহরীদের সঙ্গে যুদ্ধ করতে করতে রাজপুত্র সদাগরপুত্রর নাকমুখ ছড়েকেটে গেল, পোশাকআশাক ছিঁড়েখুঁড়ে গেল, কিন্তু শেষমেশ দুজনে জয়লাভ করলেন। রানিমার কুঠুরিতে গিয়ে হিরেমনের দেখা মিলল।
হিরেমন দাঁড়ে বসে কুটুর কুটুর করে সোনার দানায় ঠোকর মারছিল, ঘাড় বাঁকিয়ে বলল, ‘এতক্ষণে টাইম হল? সেই কবে থেকে হাঁ করে বসে আছি। আমার কি নাওয়াখাওয়া নেই? কাজ নেই তোমাদের পথ দেখা ছাড়া? এই জেনারেশনের রাজপুত্রগুলোর সময়ানুবর্তিতা বলে যদি কিছু…’ রাজপুত্র তাঁর অলরেডি ছেঁড়া জামার একটা অংশ ছিঁড়ে পাখির মাথার ওপর ছুড়ে বক্তিমে বন্ধ করে তাকে বগলদাবা করে বেরিয়ে এলেন।
হাক্লান্ত হয়েছিলেন দুজনেই, হিরেমন দেখা গেল রাস্তাঘাট চেনে, নিকটবর্তী একটি বনভূমির সন্ধান দিল। যে বনে ডাইনি নেই, বাঘভাল্লুক নেই, ব্যঙ্গমাব্যাঙ্গমী নেই। খালি শালশিমূলের প্রাণজুড়োনো ছায়া আর পাতার ফাঁকে সরসরানো হাওয়া আছে। রাজপুত্র সদাগরপুত্র লাল ঘোড়া সাদা ঘোড়া গাছের গুঁড়িতে বাঁধলেন। তাদের পরিচর্যা করে, ঝর্ণার জলে নিজেদের ছেঁড়াকাটা ধুলেন, ফার্স্ট এড বাক্স খুলে একে অপরের ক্ষতে ডেটল লাগিয়ে ব্যান্ডেড সাঁটলেন। তারপর দু মিনিট চোখ বুজে নিতে গিয়ে দু ঘণ্টার গভীর ঘুম নেমে এল। ঘুম ভাঙল চশমার কাঁচে হিরেমনের ঠোক্করে।
‘হচ্ছেটা কী?’ রাজপুত্র মহা বিরক্ত হয়ে যেই না হিরেমনের দিকে তাকালেন, অমনি সে ঘাড় বাঁকিয়ে, বাঁ পা কাত করে যেন ঘড়ি দেখছে ভঙ্গি করে বলল, ‘রাজকন্যার কপালটাই খারাপ। আবার কুড়ি বছরের ধাক্কা।’
রাজপুত্রের মনে পড়ল তিন রাত পরেই কুড়ি বছর পরের পূর্ণিমা।
দক্ষিণের রাজ্য অনেকখানি পথ। ক্লান্ত শরীর তুলে দুই বন্ধু রওনা দিলেন। আরও কত দুর্গম অরণ্য পেরিয়ে, খরস্রোত ডিঙিয়ে, শেষ পাহাড়ের চুড়োয় এসে থামলেন। হিরেমন ঝিমুনি ভেঙে বলল, ‘এসে গেছি বুঝি?’
চশমার কাঁচ মুছে, চোখ সরু করে, সদাগরপুত্রের তর্জনী বরাবর ঝাড়া দেড়টি মিনিট তাকিয়ে থেকে অবশেষে আভাস পেলেন রাজপুত্র। জঙ্গল ফুঁড়ে জেগে আছে প্রাসাদের চুড়ো। তিনপ্রহরের রোদে চুড়োর সোনা ঝিকিয়ে উঠছে। এখনও কে জানে কীসের দেমাকে পতপতিয়ে উড়ছে ছেঁড়াখোড়া রাজনিশান।
পাহাড় থেকে নেমে, চোরডাকাত বাঘভাল্লুকে পরিপূর্ণ জঙ্গল পেরিয়ে, প্রাসাদঘেরা আগুনের পরিখা লাফিয়ে, ভাঙাচোরা সিংদরজা পেরোতে যাওয়া মাত্র দরজায় খোদা যক্ষপ্রহরীর কাটামুণ্ডু জ্যান্ত হয়ে উঠে রাজপুত্র সদাগরপুত্রকে আক্রমণ করল। রাজপুত্র সদাগরপুত্র কীভাবে তাদের পরাস্ত করে প্রাসাদে ঢুকলেন, ভাঙাচোরা প্রাসাদের ততোধিক ভাঙাচোরা সাড়ে তিনশো ঘরের কোন ঘরটায় রাজকন্যা ঘুমোচ্ছেন কীভাবে খুঁজে বার করলেন, বাড়ি মারতেই কেমন ঘরের দরজা খুলে দিয়ে রাজকন্যার দাসি মুখ নিচু করে ঘরের কোণে গিয়ে দাঁড়াল সে ব্যাখ্যান করে বলার সময় নেই, জানালার বাইরে আকাশের নীল ততক্ষণে কালো হয়ে এসেছে। পূর্ণিমার চাঁদ ওঠে ওঠে।
সদাগরপুত্র যখন দৌড়ে সোনার কাঠি রুপোর কাঠি খুঁজতে নামলেন, দুই হাত বুকের ওপর বিবেকানন্দ-মুড়ে রাজপুত্র গিয়ে দাঁড়ালেন রাজকন্যার পালঙ্কের পাশে। গত তিনমাসের পথে পথে ঘোরা, যুদ্ধবিগ্রহ, চুরিচামারি, রক্তারক্তি, প্রাণ নিয়ে টানাটানির সঙ্গে জঙ্গুলে প্রাসাদের ছায়াসুনিবিড় ঘরটিতে সোনার পালঙ্কে, সাতপরত বিছানায়, পালকের চাদর মুড়ি দিয়ে ঘুমিয়ে থাকা রাজকন্যার ছবিটার অসামঞ্জস্য রাজপুত্রকে থমকে দিল।
এ যাবত গল্প শুনে রাজপুত্র তৈরি ছিলেন গিয়ে বুঝি দেখবেন মহিলার চামড়া মার্বেলের মতো কনকনে, চুল রেশমের মতো শিরশিরে, আঙুলের জায়গায় হাত থেকে বেরিয়ে এসেছে কাঁটা দেওয়া পদ্মের ডাঁটা, চোখের জায়গায় কেউ বসিয়ে রেখে গেছে আধখানা পটল আর ঠোঁটের জায়গায় আধফোঁটা গোলাপ। যার ভেতর একটিদুটি খুদি খুদি কালো পোকা নড়েচড়ে পাপড়ি খুঁটে খাচ্ছে।
সে রকম কিছু না। পাঁচটা হেঁটেচলে বেড়ানো মানুষকে যেমন দেখতে হয়, রাজকন্যাকেও তেমনটিই দেখতে।
‘কী রে, পাচ্ছি না তো।’ এপাশওপাশ হাতড়ে, খাটের নিচে ডিঙি মেরে, সাত পরত তোশক জাজিম যথাসম্ভব ঘেঁটেঘুঁটে সোনার কাঠি রুপোর কাঠি না খুঁজে পেয়ে সদাগরপুত্রর গলা নার্ভাস। ঘরের কোণে দাঁড়ানো দাসিকে তিনি প্রশ্ন করলেন, ‘আপনি জানেন কোথায় আছে সোনার কাঠি রুপোর কাঠি?’
‘আঃ, উনি কী সারাদিন এখানে পাহারায় বসে থাকেন নাকি? কাজকর্ম নেই? দেখছিস তো, আমাদের ঢোকার রাস্তাতেই যতরকম গোলমাল পাকিয়ে রাখা হয়েছে, বাকি দিকে তো জানালাদরজায় ছিটকিনি পর্যন্ত নেই। যে কেউ যখন তখন ঢুকে যা কিছু হাতিয়ে হাঁটা দিতে পারে। তাছাড়া সোনার কাঠি রুপোর কাঠি আদৌ রাখা হয়েছিল কি না সেই বা কে জানে। তোকে যদি বলা হত কুড়ি বছরের মতো সবাই ঘুমিয়ে পড়বে, এবার তুমি সোনার কাঠি রুপোর কাঠি বানিয়ে রাজকন্যার মাথার কাছে রেখে দাও, তুই রাখতিস?’
বলেই রাজপুত্র বুঝলেন প্রশ্নটা ভুল লোককে করা হয়েছে। সদাগরপুত্রর মাথায় অন্য কোনও সম্ভাবনার উদয়ই হত না।
‘তাহলে? পূর্ণিমার চাঁদ তো উঠল বলে।’
‘তাহলে আর কী?’ রাজপুত্র বেডসাইড টেবিলে রাখা সোনার জগ থেকে এক আঁজলা জল নিয়ে রাজকন্যার মুখে ছুঁড়ে দিলেন।
‘উঠুন, আর কত ঘুমোবেন?’
**
রাজকন্যা ধড়মড়িয়ে উঠে বসলেন। রূপকথার ঘুম কি না, আর পাঁচটা ভোঁসভোঁসিয়ে ঘুমের সঙ্গে তফাৎ আছে। এ ঘুমের জাত অনেকটা মাঝপুকুরে চোখ বুজে চিৎ হয়ে ভেসে থাকার মতো। কান জলের তলায় হলে কী হবে, পুকুরঘাটের পিএনপিসি দিব্যি শোনা যাচ্ছে।
রাজকন্যা কুড়ি বছর ঘুমিয়েছিলেন ঠিকই, হেঁটে চলে বেড়াতে পারেননি, কিন্তু চারপাশে, বিশেষ করে তাঁর নিজের জীবনে কী ঘটেছে বা ঘটতে চলেছে সে ব্যাপারে তাঁর সম্যক ধারণা ছিল। এর পেছনে কৃতিত্ব রাজবাড়ির বুড়ি দাসির, যাকে রাজকন্যার সঙ্গে লুকিয়ে রাখার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। যাতে রাজকন্যাকে বাঘভাল্লুকে খেয়ে না যায় আর পরিষ্কারপরিচ্ছন্নতাও বজায় থাকে।
ঘর ঝাঁট দিতে দিতে, খুন্তি নাড়তে নাড়তে, রাজকন্যার গা ধুয়েমুছিয়ে দিতে দিতে, চুলে তেল মাখিয়ে, আঁচড়ে, বিনুনি বেঁধে দিতে দিতে সে বুড়ি নন-স্টপ বকবক করত। যুদ্ধের আগে এ রাজ্যে কেমন গোলাভরা ধান, পুকুরভরা মাছ আর ঘরদোরভরা সুখী মানুষ ছিল। তারা হাসত খেলত নাচত গাইত বাঁচত। এত সুখে শত্রুদের চোখ টাটাল, তারা রাজ্য আক্রমণ করল। প্রতিরক্ষা খাতে শত্রুদের বাজেট অনেক বেশি, দক্ষিণের রাজ্যের রাজারানি মন্ত্রী সেনাপতি চাষি কামার ছুতোর কুমোর শিক্ষক জান লড়িয়েও শেষরক্ষা করতে পারল না। শেষটায় যখন রাজ্য ছারখার, দাউদাউ আগুন, কান্না ছাপিয়ে উঠেছে শত্রুপক্ষের কদর্য উল্লাস, রাজারানি আর রাজতান্ত্রিক জড়ো হলেন প্রাসাদের গর্ভগৃহে। বুড়ি দাসিকেও ডাক পাঠানো হল। জানালাহীন, একটামাত্র কোমর সমান দরজাওয়ালা সে ঘরের পাথুরে দেওয়াল আর নিচু ছাদে যজ্ঞের আগুনের গুমগুমে গর্জন, রক্তাভা, ডানেবাঁয়ে, পুবে পশ্চিমে, মাথার ওপর ক্রমশ বেড়ে চলা উন্মত্ত দাপাদাপি বর্ণনা করতে বুড়ির গায়ে অত বছর পরেও কাঁটা দিত।
তরুণ রাজা, নবীন রানি যুদ্ধবেশে দাঁড়িয়ে ছিলেন পাশাপাশি। রানির কোলে রাজকন্যা। কন্যার একবছর হতে আর কয়েকটা মোটে দিন।
কী হতে চলেছে তা নিয়ে সন্দেহ ছিল না কারও মনে। সেই শিশুকন্যাকে যে বাঁচাতে হবে তা নিয়েও। আঁকজোক কেটে কুড়ি বছর পর রাজকন্যার জীবনে একটা শুভ যোগ দেখতে পেয়েছেন রাজতান্ত্রিক। ভালো কিছু একটা না ঘটে যায় না। পরামর্শ দিয়েছেন ততদিনের জন্য রাজকন্যাকে ঘুম পাড়িয়ে রাখার। পাহারায় রাখা হোক রাজপ্রাসাদের নাড়িনক্ষত্র জানা বুড়ি দাসিকে, রাজারানি যাকে নিজেদের থেকেও বেশি বিশ্বাস করেন।
মেঝেতে পা ছড়িয়ে বসে বসে বুলি না-ফোটা আরেকটি শিশুকন্যা যজ্ঞের কাঠ চুষছিল। বুড়ি দাসি বলল, ‘আমার ছেলে-বউ দুজনেই মরেছে, বাকি আছে এই নাতনি। একে আমি কার হাতে দিয়ে যাব?’ স্থির হল নাতনিও যাবে দাসি আর রাজকন্যার সঙ্গে।
‘তাহলে তাই?’
‘তাহলে তাই।’
রানির কোল থেকে রাজকন্যাকে নিজের কোলে নিলেন তান্ত্রিক। কন্যা কেঁদে উঠলেন। তান্ত্রিক মন্ত্রোচারণ শুরু করলেন। কান্না থেমে এল। বুড়ি দাসি হাত বাড়িয়ে চরম সতর্কতায়, পরম মমতায় ঘুমন্ত রাজকন্যার দায়িত্ব নিল।
গর্ভগৃহের দুয়ার খুলে মাথা উঁচু করে রাজারানি ছুটে গেলেন দু হাত বাড়ানো মৃত্যুর কোলে।
**
কাজেই জলের ছিটে খেয়ে ধড়মড়িয়ে উঠে বসে ঘরের মধ্যে একগাদা লোক দেখে রাজকন্যা মোটেই ঘাবড়ালেন না এবং দ্রুত পরিস্থিতি পড়ে ফেললেন। ঘরের কোণে জড়সড় দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটা নিশ্চয় বুড়ির নাতনি, যে লোকটা রাজকন্যা চোখ মেলতেই তোশক হাতড়ানো ছেড়ে লাফ মেরে সরে গিয়ে ভাজা মাছটি উল্টে না খেতে পারার ভান করছে সে নিশ্চয় বহিরাগতর দলের লোক, আর রাজকন্যার মুখোমুখি হাতে সোনার জগ নিয়ে যে লোকটা তাঁর দিকে ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে আছে সে-ই কি…
বুড়ি বলেছিল সে দেবতার মতো সুন্দর, তার সিংহের মতো তেজ, সে আসবে পক্ষীরাজে চড়ে কাড়ানাকাড়া বাজিয়ে, এসে রাজকন্যার ঘুম ভাঙিয়ে, রানি করে মহাসমাদরে নিয়ে যাবে নিজের রাজ্যে যেখানে গোলাভরা ধান, পুকুরভরা মাছ আর ঘরদোরভরা সুখী মানুষ।
বুড়ি রং চড়িয়েছিল যদি ধরেও নেন রাজকন্যা, তবু রাজপুত্ররা কি এরকম ধুলোমাখা ঝোড়ো কাকের মতো হয়? যেন তিন মাস চান করেনি, যেন পথে তেত্রিশখানা যুদ্ধ হারতে হারতে জিতে এসেছে। ছেঁড়াখোঁড়া জামা ধুলোয় কিচকিচ, গালে কপালে ব্যান্ডেড, ঝাঁপিয়ে আসা চুলে কপাল এবং একদিকের চশমার কাঁচ সম্পূর্ণ অদৃশ্য, অন্যদিকের কাঁচটার কোণ ঘেঁষে স্পষ্ট ফাটল।
**
প্রাসাদের আরেকটি মোটের ওপর পদস্থ ঘর দাসি খুলে দিল। ঠাকুমার কাছে শুনেছিল রাজপুত্ররা কখনও একাবোকা চলেন না, কাজেই বুদ্ধি করে ঘরে দুটো সিঙ্গল খাট পেতে রেখেছিল সে। আনাচকানাচ মুছেটুছে, ঝুলটুল ঝেড়েঝুড়ে যথাসম্ভব ঝকঝকে করে রাখলেও সিলিং-এর কোণা ফাটিয়ে যেখানে বটের চারা গজিয়েছে সেটা তার পক্ষে মেরামত করা সম্ভব হয়নি। একখানা সোনার তোবড়ানো বালতি ফাটলের নিচে বসিয়ে রেখেছে পাছে অসময়ের বৃষ্টিতে ঘর ভাসে।
রাজপুত্র সদাগরপুত্র চানটান সারলেন। রান্নাঘরে এসে দেখলেন রাতের খাওয়া রেডি। পুকুরে গামছা ফেলে চারটে চারাপোনা ধরে রেঁধেছে দাসি, বাগানের মাটি খুঁড়ে দুটো আলু দিয়েছে ঝোলে, সঙ্গে ভাঁড়ার ঘরের কুড়ি বছরের পুরোনো চালের ভাত আর বিউলির ডাল যা মুখে দিয়ে রাজপুত্র মনে মনে মুখ ভ্যাচকালেন। এই হড়হড়ে ব্যাপারটা নিয়ে লোকে এত আদিখ্যেতা করে কী করে সেটা রাজপুত্রের আজীবনের রহস্য। শেষপাতে প্রাসাদের পেছনের জঙ্গলে দেদার ফলা চালতার চাটনি।
রাজকন্যা না হয় কুড়ি বছর ধরে ঘুমিয়েছেন, রাজপুত্র সদাগরপুত্র যেরকম ক্লান্ত তাতে তাঁদের দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ঘুমিয়ে পড়তে পারার কথা কিন্তু এত ঘটনাবহুল দিনে চট করে ঘুম কি আসে? সকলেই ওপরে চুপচাপ, ভেতরে টানটান। খাওয়া শেষে রাজকন্যা রাজপুত্র এসে দাঁড়ালেন প্রাসাদের বারান্দায়। গত কুড়ি বছরে প্রকৃতি দখল নিয়েছে রাজ্যের। পূর্ণ চাঁদের আলোয় যতদূর চোখ যায় উদ্ভাসিত অরণ্য।
‘আপনি এর পরের ঘটনাক্রম সম্পর্কে জানেন আশা করি?’
সোজা তাকিয়েছিলেন বলে রাজকন্যার সংক্ষিপ্ত মাথা নাড়াটা মিস করে গেলেন রাজপুত্র।
‘কালই কি রওনা?’ রাজকন্যার গলা।
‘দেরি করে লাভ কী?’
যা নিয়তিনির্বন্ধ তার আজ আর কাল।
‘অবশ্য আপনি যদি না যেতে চান,’ অজান্তে মুখ থেকে বেরিয়ে আসা শব্দকটায় রাজপুত্র থতমত খেলেন। রাজকন্যার তাঁর সঙ্গে যেতে না চাওয়ার পরিণতি মারাত্মক। সারাজীবন রাজপুত্র বাড়ি ফিরতে পারবেন না তো বটেই, মায়ের কী হবে তা তিনি কল্পনাও করতে চান না। রাজকন্যা পাছে তাঁর অজান্তের অফার লাফিয়ে গ্রহণ করেন শঙ্কায় রাজপুত্র আড়চোখে রাজকন্যার দিকে তাকালেন। একটা মোটাসোটা মেঘ এসে এর মধ্যে চাঁদের আলো চাপা দিয়েছে, রাজকন্যার মুখের ভাব অবোধ্য রয়ে গেল। রাজপুত্রকে আরও ঘুলিয়ে দিল রাজকন্যার পরের প্রশ্নটা।
‘আপনি কি এর আগে এসেছেন এদিকে?’
‘না তো। আমি তো এই তিনমাস আগে জানলাম যে আপনি আদৌ আছেন। রাস্তায় গোলমালে দেরি হয়ে গেল।’
উত্তরটা জানা সত্ত্বেও রাজকন্যার বুক খালি হয়ে গেল।
**
সত্যিটা হচ্ছে, গল্পটার অনেকটা যেমন রাজকন্যা জেনেছেন বুড়ির গল্প শুনে, গল্পের যে জায়গাগুলো বুড়ি বাদ দিয়ে গেছে বা ভাসাভাসা বলেছে সেগুলোও রাজকন্যা জানেন। কী করে জানেন চেপে ধরলে বলতে পারবেন না, কিন্তু তাঁর মগজ ঠাসাঠাসি হয়ে আছে গোলা ভরা ধানের দাউদাউ জ্বলা, ক্ষেপণাস্ত্রের বিষে মাছেদের মৃতদেহে পুকুর ভাসা, খোলামকুচির মতো মরে পড়ে থাকা মানুষের ওপর শকুনের ছায়ার ঘুরে ঘুরে নামার ছবিতে।
সবথেকে স্পষ্ট একটা দমচাপা ঘর, আগুনের তাত আর দুটো মানুষ। একজনের চোখে জল, একজনের আগুন। রাজকন্যা টের পাচ্ছেন একটা ভয়ানক ক্ষতি হয়ে যেতে চলছে অচিরেই, অমূল্য কিছু হারাতে চলেছে সারাজীবনের মতো, রাজকন্যা দু হাত বাড়িয়ে তাঁদের ছুঁতে চাইছেন, কিন্তু তাঁরা রয়ে যাচ্ছেন নাগালের বাইরে। বাড়ছে মধ্যবর্তী দূরত্ব, চিৎকার বাড়ছে, বাড়ছে দাপাদাপি। অন্ধকার হওয়ার আগের মুহূর্ত পর্যন্ত রাজকন্যার দৃষ্টি টেনে রেখেছে আগুনজ্বলা দুই চোখ, না-বাঁচা গোটা জীবনটার শোধ তুলে নিতে চাইছে ওই কয়েকটা মুহূর্তে, সেতু বেঁধে নিচ্ছে সারাজীবনের মতো।
সে সেতুর টান বারবার উঠেছে রাজকন্যার ঘুমের ভেতর। চিৎকার, বারুদের গন্ধ, শকুনের ডানা, কালো মণিতে আগুনের নাচ। ঘুমন্ত শরীরের জেলখানার ভেতর রাজকন্যা আছাড়িপিছাড়ি খেয়েছেন, কান্নায় ভেঙেচুরে গেছেন, আর তখন সে এসেছে। জাপটে ধরে, ‘আমি আছি, আমি আছি’ ক্রমাগত উচ্চারণ করতে করতে রাজকন্যার চোখের জলে মিশিয়ে দিয়েছে নিজের চোখের জল।
রাজকন্যা নিশ্চিত ছিলেন শুধু ঘুমটুকু ভাঙার অপেক্ষা। চোখ খুলেই রাজপুত্রকে দেখবেন তিনি। দেখামাত্র চিনে নেবেন।
বদলে দেখা হল এই লোকটার সঙ্গে। এ লোকটা রাজপুত্র কি না সে নিয়ে মাথাব্যথা নেই রাজকন্যার। পৃথিবীতে রাজপুত্র নিশ্চয় অনেক আছে, যেমন আছে তাঁর মতো রাজকন্যাও। সে সব রাজপুত্রদের মধ্যে এ-ই এসেছে তিথিনির্ঘণ্ট মেনে, কাঠখড় পুড়িয়ে। সোনার কাঠি রুপোর কাঠি বুলিয়ে না হোক, ঠান্ডা জল ঢেলে তাঁর ঘুম ভাঙিয়েছে।
পাশে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটার দিকে চোরা দৃষ্টি চালালেন রাজকন্যা। লোকটা ভদ্রসভ্য, স্নান করার পর দেখতে শুনতেও দিব্যি। দৃষ্টিতে প্রেম থাকলে পৃথিবীর সুপুরুষতম ভেবে নেওয়াই যেত কিন্তু দৃষ্টিতে দূর অস্ত, হৃদয়েও না, কল্পনাতেও রাজকন্যা এর প্রতি প্রেম জাগাতে পারছেন না। নিশ্চিত হওয়ার জন্য কৌশল করতে হয়েছে। ফস করে, ‘দিন তো দেখি আপনার আঙুলগুলো একবার ছুঁয়ে,’ তো বলা যায় না, ডালের বাটি চালাচালি করতে গিয়ে রাজকন্যা আলগোছে এঁর আঙুল ছুঁয়েছেন। শিহরণ নেই, রোমাঞ্চ নেই, নেই কত জন্মের চেনা।
এ রাজপুত্র তাঁর রাজপুত্র নয়।
**
রাজকন্যা যে তাঁর দিকে টেরিয়ে টেরিয়ে দেখছেন তা রাজপুত্র টের পেয়েছেন। খাওয়া চলাকালীন একাধিকবার আঙুলে আঙুল ঠেকাটাও যে আচমকা নয় সেটুকু বোঝার মতো ঘিলুও তাঁর আছে। আপাতত সতর্ক হয়ে রাজপুত্র বোঝার চেষ্টা করছেন ব্যাপার কোন দিকে গড়াতে পারে। ওঃ, হরিপদ তাঁকে কী গেরোতেই না ফেলেছে।
মৃদু শব্দে রাজপুত্র ঘুরে তাকালেন।
‘এ কী, কী হল, কাঁদছেন কেন?’
যদিও রাজপুত্র দাবি করবেন রাজকন্যার ফোঁপানির মধ্যে থেকে আসল কথাটা বার করতে তাঁর অনন্তকাল লেগেছিল, গোটা ব্যাপারটা বাস্তবে ঘটেছিল পাঁচ মিনিটেরও কমে।
‘কী? আরেকজন রাজপুত্র? আমি নই? না না রাগব কেন, কী মুশকিল, এরকম তো হতেই পারে। সে রাজপুত্রের হাইট, ওয়েট, কমপ্লেকশন জানা আছে? না না, আমি জানি আপনি ঘুমোচ্ছিলেন, সরি, আসলে ভাবছিলাম যদি সেই রাজপুত্রকে খুঁজে বার করা যায়। কী? আপনি তার হাত ধরলেই বুঝতে পারবেন? অ, তাই বলুন। ঘাবড়াবেন না, আমি কালকেই খোঁজ নিচ্ছি। একাধিকবার এসেছেন যখন তখন খুব বেশি দূরে হয়তো থাকেন না। কাল সকালে গেলে হবে? নাকি এখনই? থ্যাঙ্ক ইউ। কাল সক্কালসক্কাল বেরিয়ে আমি আপনার আসল রাজপুত্রকে খুঁজে এনে দেব, কথা দিচ্ছি। দয়া করে কাঁদবেন না। প্লিজ।’
**
দড়াম করে দরজা খুলে ঘরে ঢুকলেন রাজপুত্র। ‘কেলেঙ্কারি!’ সদাগরপুত্রের প্রশ্নের অপেক্ষা না করে হড়হড় করে রাজকন্যার অন্য রাজপুত্রর ব্যাপার খোলসা করলেন।
‘খুঁজে এনে দিবি কথা দিয়েছিস মানে কী? কোত্থেকে খুঁজে এনে দিবি?’
‘জানি না বস্। মহিলা এমন কান্নাকাটি জুড়েছিলেন যে ওই মুহূর্তে কথা দেওয়া ছাড়া উপায় ছিল না। তুই থাকলেও দিতিস।’
সদাগরপুত্রর নীরবতা সম্মতির লক্ষণ নয় সন্দেহ করে রাজপুত্র গোঁজ হলেন। ‘তোর যাওয়ার দরকার নেই, আমি একাই যাব না হয় কাল সকালে খুঁজতে।’
‘খোঁজ করাটা সমস্যা নয়, সে গিয়ে আশেপাশের রাজ্যে জিজ্ঞাসাবাদ চালাতে আর কী অসুবিধে। সমস্যাটা অন্য জায়গায়। মন্ত্রীমশাইকে কী বলবি? তিনটে কাজ শেষ না হওয়া তো একটাও কাজ শেষ না হওয়ার সমান। আর কাজ শেষ না করলে তো বাড়ি ফেরা যাবে না।’
রাত গড়াল। চাঁদ হেঁটে হেঁটে চলে গেল রাজপুত্রের খাটের পাশের জানালার এ কোণা থেকে ও কোণায়। মেঘ বেড়েছে, বেড়েছে হাওয়াও। মেঘগুলোকে জমাট বাঁধতে দিচ্ছে না, ছিঁড়েখুঁড়ে ছুটিয়ে মারছে অগোছালো। সদাগরপুত্রের ঘুমন্ত শ্বাসের শব্দ ছাড়া সব চুপচাপ।
**
রাজকন্যা টান টান বসে ছিলেন পালঙ্কের ওপর। দাসি ঘরে ঢুকে দরজা দিতে দিতে বলল, ‘ঘুম আসছে না?’
‘আরও ঘুম?’
দাসি মেঝেতে নিজের বিছানা পাততে লাগল।
‘তুমি ছাড়া কে আসত আমার ঘরে?’
প্রশ্নের আকস্মিকতার থেকেও রাজকন্যার কণ্ঠের কাঠিন্য দাসিকে থমকে দিল।
পালঙ্ক ছেড়ে নেমে রাজকন্যা দু পা এগোলেন দাসির দিকে। দাসি দু পা পেছোল।
‘অস্বীকার করার চেষ্টা করবে না, আমি জানি একজন আসত। একবার নয়, দুবার নয়, বারবার। যতবার আমি দুঃস্বপ্ন দেখেছি, যতবার কেঁদেছি, যতবার আমার বাঁচার ইচ্ছে অন্তর্হিত হয়েছে ততবার সে এসেছে, পাশে বসেছে, শান্ত করেছে। আমাকে বাঁচিয়ে রেখেছে।’
রোগা মেয়েটা ভয়ে কাঁপছে। গলা চড়ানোর জন্য রাজকন্যার লজ্জা হল। তাঁর তো স্রেফ ঘুমিয়ে থাকার অভিশাপ, আর এই মেয়েটার? চেনা নেই শোনা নেই, কোথাকার কোন রাজকন্যাকে কবে কোন রাজপুত্র আসার অপেক্ষায় কুড়ি বছর ধরে ঝেড়েমুছে চকচকে করে রাখার অভিশাপ।
‘আমি তোমাকে কিছু বলব না,’ রাজকন্যা নরম হলেন। ‘কিন্তু যে আসত তাঁকে খুঁজে বার করা আমার ভীষণ দরকার, প্লিজ।’
চোখভরা জল নিয়ে দাসি দুদিকে মাথা নাড়ল। ‘কেউ আসেনি। তান্ত্রিকের কথা মতো কুড়ি বছর পূর্ণ হয়েছে আজ, সিংদুয়ারে বাড়ি পড়েছে, দরজা খুলে দিয়েছি। এই কুড়ি বছরে আমি কাউকে ঢুকতে দিইনি, বিশ্বাস করুন।’ হাত জোড় করেছে মেয়েটা, অঝোরে কাঁদছে।
এত কান্নাকাটি শোনার সময় বা ধৈর্য নেই রাজকন্যার। তাঁর শুধু সত্যিটা জানা দরকার। যে সত্যিটার সঙ্গে তাঁর জীবনমরণের প্রশ্ন জুড়ে আছে। রাজকন্যা দাসির দুই হাত চেপে ধরলেন। ‘বলছি তো, আমি কিছু বলব না তোমাকে, শুধু সত্যিটা…’
রাজকন্যার হাতের ভেতর মেয়েটার দু হাত কাঁপছে। কাঁপন ছড়িয়ে যাচ্ছে রাজকন্যার আঙুলে, হাতে, বুকের ভেতর। প্রতিটি রক্তকণা জুড়ে বইছে জন্মজন্মান্তরের চেনা।
কান্নাবোজা গলা থেকে কয়েকটা শব্দ আটকে আটকে বেরোল। ‘কিছু চাইব না আপনার কাছে কোনওদিন, শুধু কাল আপনাদের সঙ্গে আমাকে নিয়ে যাবেন?’
**
রান্নাঘরে এত বড় বড় জানালা আছে কাল টের পাননি তো? রোদে ভেসে যাচ্ছে ঘর, ডাইনিং টেবিলের ওপর ঝুড়িতে টাটকা কাঁঠালচাঁপা। একটা তুলে নাকের কাছে ধরলেন রাজপুত্র। ছোটবেলার গন্ধ।
কারা খুব হাসছে। রান্নাঘরের দরজা দিয়ে ঢুকছেন রাজকন্যা আর রাজকন্যার দাসি, কেউ একটা চমৎকার জোক বলেছে নিশ্চয়, দুজনেই একেবারে হেসে গড়িয়ে পড়ছেন।
তাঁকে দেখে মহিলারা গম্ভীর হওয়ার চেষ্টা করলেন। রাজকন্যা বললেন, ‘ইয়ে, মানে রাজপুত্র খুঁজতে যাওয়ার আর দরকার নেই।’
অন্য মহিলাই নির্ঘাত কাল রাজপুত্রদের দরজা খুলে দিয়েছিলেন আর রান্না করেছিলেন আর ঘর ঝেড়েমুছেও নিশ্চয় ইনিই দিয়েছিলেন, কিন্তু বারো ঘণ্টারও কম তফাতে একটা লোকের চেহারায়, চলনেবলনে এত পরিবর্তন ঘটতে পারে?
রাজকন্যাও ভোল পালটেছেন। কাল কেঁদে কূল পাচ্ছিলেন না, আজ হেসে গড়িয়ে পড়ছেন।
চা খেতে খেতে রাজপুত্র বললেন, ‘আপনারা যখন এখানেই থাকবেন ঠিক করেছেন তাহলে বাড়িটা তো একটু সারালেটারালে ভালো হয়। আমরা যদি কোনওভাবে হেল্পটেল্প… ‘
মেয়েটা, রাজকন্যা যাকে মিতুন বলে ডাকছেন, চায়ের কাপ নিয়ে টেবিলে এসে বসল। ‘এখন তো আর লোক ডাকতে বাধা নেই। জঙ্গলের কিনারায় কিছু পুরনো প্রজা ঘর বেঁধে আছে, আমি আর কিছুক্ষণ বাদে গিয়ে খবর দিয়ে আসব। রাজকন্যার ঘুম ভেঙেছে শুনলে তারা হইহই করে ফিরে আসবে।’
‘আপনারা খেয়ে যান, নাকি?’ রাজকন্যা ভদ্রতা করলেন।
উল্টে ভদ্রতা করে রাজপুত্র সদাগরপুত্র বললেন আবার রান্নাবান্নার হাঙ্গামার মধ্যে যাওয়ার কোনও দরকার নেই।
‘কেন কালকের রান্না সব শেষ?’
রাজকন্যার প্রশ্নের উত্তরে মিতুন আশ্বাস দিল। ‘চারজনের আবার খেয়েও বেঁচে যাওয়ার মতো আছে সব। ভাত, পোস্ত, চাটনি, ডাল।’
‘না না, কোনও দরকার নেই।’ তড়িঘড়ি সে সম্ভাবনায় বাঁধ দিলেন রাজপুত্র। ‘অনেকটা পথ আজ কভার করতে হবে। সকাল সকাল বেরোনোই ভালো।’
বেরোনোর আগে সদাগরপুত্রের সঙ্গে শলা করে আরেকটা কাজ সারলেন। ‘ঘটনাটা যখন অন্যরকম ঘটছেই, তখন এইসব লটবহর ঘাড়ে করে ঘোরার কোনও মানে হয় না।’ রাজপুত্র ঝুলি খুললেন। ‘এই যে উত্তরের বনের বুড়িমাদের আগুনের কাঠ, অনেকরকম ক্ষমতাটমতা থাকতে পারে, দেখুন যদি কাজে লাগাতে পারেন। আর,’ হিরেমনকে কাঁধ থেকে নামিয়ে টেবিলের মাঝখানে বসালেন। ‘এ কোনও কাজে লাগবে বলে মনে হয় না, তবু।’ হিরেমন রাজপুত্রকে মুখ ভেংচে রাজকন্যা আর মিতুনের মাঝখানে হাসিহাসি মুখে গুটিসুটি বসল।
মিতুন কোনও কথা শুনল না। জঙ্গলে ঝেঁপে ফলা জামরুল আঁকশি দিয়ে পেড়ে ঝুলি ভরে দিয়ে দিল পথে খাওয়ার জন্য। সব গুছিয়ে নিয়ে শেষবারের মতো পেছন ফিরে হাত নাড়লেন রাজপুত্র সদাগরপুত্র। হাসিমুখে হাত নাড়ল রাজকন্যা আর মিতুন। হিরেমন রংচঙে ডানা দুলিয়ে সুর করে গাইল, ‘টা টা বাই বাই, আবার যেন দেখা পাই।’
**
সূর্য যখন মাঝআকাশ পেরিয়েছে সবুজ এক উপত্যকা দেখে থামলেন দুজনে। লাল ঘোড়া সাদা ঘোড়ার গায়ে হাত বুলিয়ে, দানাপানি দিয়ে রাজপুত্রের পাশে পা ছড়িয়ে বসলেন সদাগরপুত্র। থলে খুলে জামরুলে কামড় দিলেন।
‘কী মিষ্টি রে। ভদ্রতা না করে অন্য থলেটাও নিয়ে এলে হত।’
রাজপুত্র দাঁতে ঘাস কাটতে লাগলেন।
‘কী রে, খা। মুখ হাঁড়ি করে আছিস কেন?’
‘চিন্তা হচ্ছে।’
‘কীসের?’
‘এতদিনের একটা গল্প। আমি শুনেছি, আমার বাবা শুনেছে, বাবার বাবা শুনেছে, তার বাবা শুনেছে, তারও বাবা…’
‘পয়েন্টে আয়।’
‘এটাই পয়েন্ট। শতসহস্র বছরের একটা গল্প, স্রেফ রাজপুত্র অদলবদল হয়ে গেছে বলে ঘণ্ট পাকিয়ে যাবে? নাকি পাকালে কেউ মানতে চাইবে?’ রাজপুত্র উত্তেজিত। ‘তাছাড়া গল্পটা তো শুধু আমার আর রাজকন্যার নয়। গল্পে তুই আছিস, মা আছে, হরিপদ আছে, রানিমারের মাঠে গর্ত খোঁড়া আছে, উত্তরের বনের শেয়ালগুলো উপোসি পেটে বসে আছে…’
পকেট থেকে ফোন বার করলেন সদাগরপুত্র। ‘প্রাসাদে নেটওয়ার্ক ছিল না বলে খবরটা সকালে পাইনি।’ পাসওয়ার্ড খুলে রাজপুত্রের দিকে এগিয়ে ধরলেন।
রোদের ঝলসানিতে দৃষ্টিবিভ্রম ঘটছে নাকি রাজপুত্রের? হাতের তেলো দিয়ে স্ক্রিনে ছায়া ফেললেন তিনি।
মা আর হরিপদর মুখ পাশাপাশি। হরিপদ দুই হাত জোড় করে অল্প ঝুঁকে বশংবদের হাসি হেসে, জয়ের হাসি হেসে মা। এক হাতে ধরা ফোনে ছবিটা তুলেছেন মা, অন্য হাতের দুই আঙুল দিয়ে হরিপদর মাথার পেছনে শিং বানিয়েছেন।
‘রাজবাড়ির অফিশিয়াল ফেসবুক পেজের ডিপি। ছোটমা,’ রাজপুত্রের বেস্ট ফ্রেন্ড হওয়ার সুবাদে সদাগরপুত্র ছোটরানিকে রানি ডাকার দায় থেকে মুক্ত, ‘সিংহাসন অধিকার করেছেন। হরিপদ আপাতত ছোটমার মন্ত্রী।’
রাজপুত্রের হাঁ মুখে বাক্য সরল না।
সদাগরপুত্রও যে সবটা জানেন তেমন নয়, স্পটে ছিলেন না। খানিকটা আন্দাজ, খানিকটা রাজবাড়ি ছেড়ে আসার আগে ছোটমার ভাবগতিক, দুয়েকটা ছুটকোছাটকা কথা ইত্যাদি থেকে যেটুকু পারলেন গল্প খাড়া করে রাজপুত্রকে শোনালেন।
**
হরিপদমন্ত্রী যে সিংহাসন দখলের ফন্দি আঁটছে সেটা এক রাজা ছাড়া সকলেই বুঝেছিল। রাজপুত্রকে ব্ল্যাকমেল করে রাজ্যছাড়া করাটা হরিপদর ষড়যন্ত্রের শেষ ঘুঁটি। সেই ঘুঁটি যখন হরিপদ চালল ছোটরানি বুঝলেন আর চুপ করে বসে থাকলে চলবে না। তাঁর তূণের একটিমাত্র অস্ত্র প্রয়োগের সময়ে এসেছে।
রাজামশাইয়ের সঙ্গে ষড়যন্ত্র।
‘বাবা!’
বাবার শেষ দেখা মূর্তিটা ভেসে উঠল রাজপুত্রর চোখে। ছেলে রাজ্য ছেড়ে তাড়া খাচ্ছে কে জানে কতদিনের জন্য, প্রাণ নিয়ে ফিরবে কি না ঠিক নেই, স্ত্রীর মাথায় পেরেক ঠুকে, চোখের পাতা সেলাই করে জ্যান্ত পুঁতে দেওয়ার রসিয়ে রসিয়ে ব্যাখ্যা দিচ্ছে একজন আর তিনি দু হাতের মধ্যে বসে পরবর্তী সম্ভাব্য রানিদের ছবি দেখছেন আর ফিকফিক করে হাসছেন। বাবার সঙ্গে কে কী ষড়যন্ত্র করবে? বাবার তো শরীরটাই পড়ে আছে খালি। বোধবুদ্ধি তো উবে গেছে কবেই।
সদাগরপুত্র মাথা নাড়লেন।
বোধবুদ্ধি উবে যায়নি। উবে যেটা গিয়েছিল সেটা হচ্ছে রাজা সেজে থাকার ইচ্ছে। ছোটরানি প্রস্তাব দিলেন যে তিনি রাজাকে রাজাগিরি থেকে চিরদিনের মতো ছুটি দিতে পারেন। রাজা জঙ্গলে গিয়ে থাকুন, বল্কল পরে বনফায়ার ঘিরে নাচুন, বনদেবীদের সঙ্গে গাঁজা খান, উকুলেলে বাজিয়ে দেহতত্ত্বের গান ধরুন, কেউ কেয়ার করবে না।
রাজা লাফিয়ে উঠে ছোটরানির হাত চেপে ধরলেন, ‘সত্যি রানি? সত্যি ছুটি দিতে পারো তুমি আমাকে?’
‘বদলে একটি জিনিস দিতে হবে।’
‘কী চাও বলো রানি?’ রাজার রক্তে বহুদিন পরে জোয়ার, শিরদাঁড়া টানটান করে বুক ফুলিয়ে দাঁড়ালেন তিনি। ‘প্রাণ চাইলে প্রাণ দিতে পারি তোমার জন্য।’
একসময় এইসব আবোলতাবোল বকেই ছোটরানির বোকা মন ভিজিয়েছিলেন রাজামশাই।
‘প্রাণ চাই না। ক্ষমতা চাই। রাজ্যশাসনের অধিকার নিঃশর্তে চিরজীবনের মতো আমার হাতে ছেড়ে দিলে চিরজীবন তোমার গাঁজার সাপ্লাই যাতে বজায় থাকে আমি দেখব।’
রাজামশাই আপ্লুত হয়ে সিংহাসনের সঙ্গে হরিপদর গর্দানও অফারে জুড়ে দিচ্ছিলেন, রানি বাধা দিলেন। হরিপদ বদের বাসা হলেও কাজ জানে। রাজামশাই অপদার্থ বলে হ্যান্ডেল করতে পারেননি। শক্ত হাতে চালনা করলে হরিপদকে দিয়ে কাজ হবে।
শাঁখ বাজল না, ঢাক পিটল না। রানির রাজ্যাভিষেক হল রাতারাতি, চুপচাপ। রাজশিক্ষামন্ত্রী, রাজবিদূষক আর রাজকবি, যাঁরা হরিপদকে দু চক্ষে দেখতে পারেন না আর হরিপদও যাদের সমঝে চলে, সাক্ষী থাকলেন। রাজা মাথার মুকুট খুলে রানির মাথায় পরিয়ে দিলেন। রানি তিনমাসের মতো উত্তম কোয়ালিটির গাঁজা প্যাক করে রাজাকে খিড়কি দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিলেন। ছুট লাগিয়েও দশ পা গিয়ে থমকে দাঁড়ালেন রাজামশাই। ফিরে এলেন তখনও দরজায় দাঁড়িয়ে থাকা ছোটরানির মুখোমুখি। নিশ্চুপ রাত, নিঃশব্দ হাওয়া আর নিথর পাতারা চাপা চাঁদের আলোয় রাজার চোখের চিকচিকানি ভুল দেখল কি না কে জানে, কিন্তু রানি প্রাসাদে ফিরে এলে পর দাসদাসিরা রানির নাকের ডগার লাল স্পষ্ট দেখল।
সকালবেলা রাজা হওয়ার সুখস্বপ্ন মসমসিয়ে পান চিবোতে চিবোতে হরিপদ রাজসভায় ঢুকল। সে আশা করেছিল দেখবে রোজকার মতো রাজা সিংহাসনে এলিয়ে পড়ে ক্যান্ডি ক্রাশ খেলছেন, বদলে মুখোমুখি হল ছোটরানির। মৃদু হেসে সিংহাসনে বসে আছেন, শিরদাঁড়া টানটান, দুই হাতে উলের কাঁটা ঠুনঠুন। কুরুশের ঢাকনা দেওয়া তেপায়া টেবিল থেকে রাজমুকুটটা এই-গা-ছুঁয়ে-বলছি-কিছু-জানতাম-না ভাব করে তাকিয়ে আছে।
হরিপদর পান চেবানোর গতি ধীর হয়ে এল।
হরিপদ হাঁদা নয়, প্রতিপক্ষর শক্তি মাপতে তার ভুল হয় না। রুদ্ধশ্বাস, নির্নিমেষ মুহূর্ত কটি কেটে যেতে সে ঝুঁকে পড়ে, ‘আহাহা কী সৌভাগ্য, রানিমা রাজা হয়েছেন, ওরে তোরা কে কোথায় আছিস কাড়ানাকাড়া বাজা, উৎসবের আয়োজন কর,’ হাঁকডাক লাগাল। কাঁটার ঠুনঠুনের আড়ালে দামামার মতো বাজতে থাকা হৃদপিণ্ডকে শান্ত হওয়ার সময় দিয়ে রানি রাজ্যের হাল ধরলেন। হিসেবনিকেশ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়লেন, প্রজাদের সঙ্গে মিটিং-এর নিয়মিত দিনক্ষণ ধার্য করলেন। রাজার অনবধানে হরিপদ যে সব জায়গায় নিজের ক্ষমতা বাড়িয়েচাড়িয়ে নিয়েছিল, ছেঁটেকেটে দিলেন।
**
‘এ সব যে হতে চলেছে তুই জানতিস?’
‘জাস্ট একটা আঁচ। ছোটমায়ের সঙ্গে কথা বলে মনে হয়েছিল। তবে এতকিছু যে সত্যি সত্যি ঘটবে নিশ্চিত ছিলাম না বলে কথাটা তুলিনি। আর কোনও কারণ ছিল না বিশ্বাস কর।’
রাজপুত্র বিশ্বাস করার সিদ্ধান্ত নিলেন। তাঁর অনেকদিনের সন্দেহ যে মা তাঁর সঙ্গে খেলাধুলো, হাসাহাসি, গল্প বলা, কবিতা পড়া, কমলালেবু খাওয়া, আদর, বকাঝকা করলেও আর হয়তো সত্যি সত্যি বেশি ভালোবাসলেও, জরুরি কথাগুলো বলেন সদাগরপুত্রকে। রাজপুত্র ভেবে দেখেছেন এ ব্যবস্থায় তাঁর হিংসে হয় কি না। অন্য কেউ হলে হয়তো হত, সদাগরপুত্র বলেই হয়তো হয় না।
জামরুলের থলে গুটিয়ে সদাগরপুত্র উঠে গেলেন। রাজপুত্র ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলে সবুজ ঘাসে চিৎপাত হলেন।
মায়ের চিন্তা ঘুচল। বাবা চলে গেলেন যেখানে যেতে চান। হরিপদর উচিত শিক্ষা হল। রাজকন্যাও সোলমেটের সঙ্গে সেটল হয়ে গেলেন।
প্রকাণ্ড আকাশটা শোঁ করে নেমে ছোঁ মেরে তুলে নেওয়ার আগের মুহূর্তে রাজপুত্র চোখ বুজে ফেললেন। পেটের ভেতরটা খালি, পিঠের নিচে মাঠ হাওয়া। অনন্ত নীল শূন্যতায় রাজপুত্র ভেসে রয়েছেন। একা। কী ভীষণ, ভীষণ একা।
কদিন আর পথে পথে ঘোড়া ছোটানো? ব্যান্ডেড সেঁটে কতদিন আর যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা? একটা নোঙর যদি থাকত।
বন্ধ চোখের পাতায় ভেসে গেল মুহূর্তরা। মাঠের রোদ্দুরে খেলে বেড়ানোর। ছুটির দুপুরে লাফ মেরে দিঘির জলে ফুটে থাকা সূর্যটাকে খানখান করে দেওয়ার। চতুর্দিকে ঝিকিয়ে ওঠা অস্ত্রের থেকে অবিরাম প্রতিরোধের— ভয় না আতঙ্ক না, শরীর এবং মগজের প্রতিটি ইঞ্চির যখন দখল নিয়েছে স্রেফ এবং স্রেফ বেঁচে থাকার আদিমতম তাড়না। যুদ্ধশেষে জেতার উল্লাস না, হারার শোক না, চারপাশের কান্না আর গোঙানি আর আর্তনাদগুলো যে আমার নয়, আমার বুকের যে ভেতর হৃদপিণ্ড এখনও ধুকপুকোচ্ছে, এখনও বুকের খাঁচায় ঢুকছে বেরোচ্ছে শ্বাস— সেই অবিশ্বাস্য উপলব্ধির ক্রমে নেমে আসার মুহূর্তগুলো।
যে মুহূর্তরা জোড়াতাড়া দিয়ে গড়েছে রাজপুত্রের নাতিদীর্ঘ জীবন। সে জীবনটার মানে যদি কাউকে বানান করে বোঝাতে হত না, তাঁর পাশে থেকে তাঁর জীবনটা তাঁর সঙ্গে যদি কেউ বাঁচত। প্রতিদানে নিজের জীবনটা বাঁচতে দিত তাঁকে।
বন্ধ চোখের কোণে জল এল দু ফোঁটা, ফোঁটা ফোঁটা জমে স্রোত হল। রাজপুত্র তাদের অঝোরে ঝরতে দিলেন, অবাধে ভেজাতে দিলেন মাঠের ঘাস। সমস্ত অন্ধত্ব ধুয়ে সে স্রোত বয়ে গেলে রাজপুত্র চোখ খুললেন। জিনস ঝেড়ে হেঁটে হেঁটে ফিরে এলেন।
সদাগরপুত্র বললেন, ‘যাওয়া যাক নাকি?’
রাজপুত্রর মাথা নাড়লেন ওপরনিচ।
‘কোন দিকে?’
রূপকথারই পৃথিবী হোক বা বাস্তবের, এ পৃথিবীর সবার একটা সত্যি থাকে। একটাই জীবন, সে জীবনের একটাই সত্যি। যা যতদিন প্রাণ থাকে ততদিন বুকের ভেতর জ্বলে, অপেক্ষা করে কেউ মনোযোগ দেয় নাকি। দশের মধ্যে নজনই দেয় না। কিন্তু দশের মধ্যে দশজনই টের পায়। ফাঁকা দুপুরের ফেরিওয়ালার ডাকে, আচমকা ছাতিমের গন্ধে, শীতের রাতে ভেসে আসা ট্রেনের ভোঁ কিংবা অন্য ভাষার গানে, ঘরভর্তি ভিড়ের এপারে ওপারে আচমকা কারও চোখে চোখ পড়ে যাওয়ায় ওই যে মুহূর্তের টাল খাওয়া, ওটা আসলে বিস্মরণ নয়, যাকে ভুলে আছি তাকে মনে পড়ে যাওয়া।
আমাদের রূপকথার রোদে ভাসা মাঠে সে রকম একটি মুহূর্ত নেমে এল। ভাতডাল, যুদ্ধবিগ্রহের নিচে চাপা পড়ে যাওয়া রাজপুত্রের জীবনভরের সত্যিটিকে দু আঙুলে তুলে এনে তাঁর জিহ্বাগ্রে স্থাপন করে ফিরে গেল।
‘তুই যেদিকে বলবি।’
আনমনা মুখ অন্য দিকে ফেরানো ছিল বলে কেশরে সদাগরপুত্রের হাতের শ্লথ হয়ে আসাটুকু দেখতে পেলেন না রাজপুত্র, মুখ আড়াল করে নেওয়াটুকুও না। ক্ষতি নেই, যাদের দেখার তারা দেখে নিল। আকাশ ভাসানো রোদ, কেশর ওড়ানো হাওয়া, ঘাসের ওপর নাচন্ত ফড়িং, ডানামেলা চিল। দেখে নিল আরও দুজন।
দুই বন্ধুকে নিয়ে জীবনের দিকে ছুট দিল লাল ঘোড়া আর সাদা ঘোড়া, যাদের একজনের ভালো নাম ‘সুখেশান্তিতে’, অন্যজনের ‘চিরদিনের মতো’।