সুব্রত রায়
ভারতীয় বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সমিতির কেন্দ্রীয় সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য
When the person who commits a violent act is removed
from the equation, it almost guarantees that retaliation
will be escalated above the level of personal vengeance,
to the impersonal level of competing ideologies.–Sean Hastings, Paul Rosenberg (“God Wants You Dead”)
‘আইন আইনের পথেই চলবে’
কথাটা ক্লিশে, ঘোরতর সন্দেহজনক এবং রাজনীতিকদের জন্যে বিশেষভাবে সংরক্ষিত। সন্দেহজনক, কারণ একটু খুঁটিয়ে নজর করলে বাণীটির মধ্যে একটি অনুচ্চ কিন্তু মদগর্বী ইঙ্গিত টের পাওয়া আদৌ কঠিন নয় যে, আইনকে চাইলে তাহলে বেপথুও করা যায়! যে পথরেখা বেয়ে পক্ষপাতহীন ও নিক্তিমাপা চূড়ান্ত বিচার ক্ষিপ্রতার সঙ্গে ধেয়ে আসবে বিচারপ্রার্থীর দিকে, আইনের বা সামগ্রিকভাবে বিচারব্যবস্থার নিজস্ব তেমন কোনও ঋজুপথরেখা আছে কিনা, তা ভেবে দেখবার মতো। যুক্তিসম্মতভাবে মামলা সাজিয়ে, উপযুক্ত সাক্ষ্যপ্রমাণ দর্শিয়ে এবং আইনের বিভিন্ন ধারা-উপধারা নিখুঁতভাবে প্রয়োগ করে কোনও মামলায় বিচারপদ্ধতিকে পুরোপুরি ব্যক্তিনিরপেক্ষ করে তোলা যায় কিনা, যাতে বিচারের বাণী সর্বসমক্ষে সশব্দে হর্ষধ্বনি করে উঠবে, তা নিয়ে কিন্তু প্রত্যয়ী হওয়া কঠিন। আদালত কক্ষে সাক্ষ্য-যুক্তি আশ্রিত শাণিত ও নিবিড় তর্কযুদ্ধ বিজ্ঞানের যৌক্তিক কাঠামোকে মনে করাতে পারে। কিন্তু আইনে গণিতের নিয়মের মতন যুক্তিধারা কঠোরভাবে মান্য করে এক এবং অদ্বিতীয় বৈচারিক সিদ্ধান্তে পৌঁছনোর পথে অনেকগুলো বাধা আছে। এর কারণটা এই যে, ব্যবহারশাস্ত্র হল এক সামাজিক অনুশীলনবিদ্যা; সামাজিক আচারআচরণ, ধ্যানধারণা, রীতিনীতি, মূল্যবোধ ইত্যাদি অনেক কিছুর ওপরে এর গতিপথ নির্ভর করে। আইনের ধারাগুলি কীভাবে প্রযুক্ত হবে, তাও এর ভাষ্য, মতামত, টীকাটিপ্পনির ওপরে বহুলাংশে নির্ভরশীল, অর্থাৎ আইনের প্রয়োগকে নৈর্ব্যক্তিক করে তোলা কঠিন। বস্তুত, বিচারব্যবস্থার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের ব্যক্তিগত বিশ্বাস-অবিশ্বাস, নীতি-নৈতিকতা, ইচ্ছে-অনিচ্ছে, মূল্যবোধ গোটা প্রক্রিয়ার সঙ্গে অচ্ছেদ্যভাবে জড়িয়ে থাকে। ক্রিমিনাল মামলায় যেমন তদন্ত একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, সঠিক ও নিরপেক্ষভাবে তদন্ত করে সত্যিটা তুলে ধরা এবং তার ভিত্তিতে মামলা সাজানোর ব্যাপারে এক্ষেত্রে প্রশাসনের ভূমিকা অনেকখানি। যে দেশে প্রশাসনের সুনীতি ও নিরপেক্ষতা প্রশ্নাতীত নয়, স্বভাবতই সেখানে বিচার প্রক্রিয়াতেও নিরপেক্ষতা আশা করা যায় না। আইনকাঠামো এবং বিচারপ্রক্রিয়ার নানান অংশও ভীষণভাবে সমাজসাপেক্ষ। এমনকি একই দেশের বিভিন্ন এলাকায় একই বিষয়ের নিষ্পত্তির জন্য পরস্পরবিরোধী আইনেরও দৃষ্টান্ত আছে। একই সঙ্গে, কোনও আইনই অচল-অনড় নয়, সামাজিক পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে আইনকেও যুগোপযোগী করে নিতে হয়। যোগবিয়োগ চলতেই থাকে। উপরন্তু, সংবিধান ও আইনের আকর গ্রন্থগুলির বিভিন্ন অংশের পরস্পরবিরোধিতাও বিরল নয়। আবার, একটি আইন অন্য আইনের প্রয়োগের রাস্তাকে সুগম বা রুদ্ধ করতে পারে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, যে দেশে ব্লাসফেমি আইন আছে, সে দেশে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ রক্ষার জন্য উপস্থিত আইনগুলোকে কার্যত ঠুঁটো জগন্নাথ হয়েই থাকতে হয়! আইনের কোন ধারা সরকার কীভাবে প্রয়োগ করবে, কোনও ধারার অপব্যবহার করবে কিনা, কোন ধারাকে ঠান্ডাঘরে শুইয়ে রাখবে, তাও কখনও শাসকের রাজনৈতিক মতাদর্শ-নিরপেক্ষ হতে পারে না। কাজেই, ইদানীং আইনকে ‘জ়ুডিশিয়ারি সায়েন্স’ বলা হচ্ছে ঠিকই, কিন্তু আসলে আইনে বিজ্ঞানের তুলনায় সামাজিক-রাজনৈতিক মূল্যবোধটা আছে ঢের বেশি। আর এসব কারণেই বোধ হয় সুবিচার পাওয়ার অধিকারটা অনেক ক্ষেত্রেই আজও কথার কথা রয়ে গেছে।
আইন ও বিচারব্যবস্থা নিয়ে এই কূটকচালিটা মাথায় নড়ে উঠল সম্প্রতি বাংলাদেশে অভিজিৎ রায় হত্যা মামলার রায় প্রকাশিত হওয়ার পর। মৌলবাদী চাপাতির আঘাতে নৃশংসভাবে নিহত অভিজিৎ রায়ের মৃত্যুর ছ বছর পর চলতি বছরের ১৬ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশের সন্ত্রাসবিরোধী বিশেষ আদালত পাঁচ অভিযুক্তকে প্রাণদণ্ড ও এক অভিযুক্তকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছে। মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত দুজনকে অবশ্য এখনও প্রশাসন ধরতে পারেনি। মৌলবাদীরা অভিজিতের লেখা বই প্রকাশ করার অপরাধে প্রকাশক ফয়সাল আরেফিন দীপনকেও হত্যা করেছিল। ওই মামলাটিরও নিষ্পত্তি হয়েছে এই রায় ঘোষণার ক-দিন আগে, আট জন অপরাধীর প্রাণদণ্ড ঘোষণার মাধ্যমে। আরও একগুচ্ছ ব্লগার-মুক্তচিন্তকের হত্যার মামলা ও দেশের নানান আদালতে বিচারাধীন। এই রায় দুটি উপমহাদেশের যুক্তিবাদীদের অবশ্যই স্বস্তি দেবে। ঘোষিতভাবে ধর্মীয় রাষ্ট্র হওয়া সত্ত্বেও বাংলাদেশ সরকার যেভাবে দোষীদের চিহ্নিত করে সাজা দেওয়ার চেষ্টা করছে, ব্যক্তিগতভাবে মৃত্যুদণ্ড সমর্থন না করলেও, তাকে অবশ্যই প্রশংসা করতেই চাইব। কিন্তু একই সঙ্গে, চার ভারতীয় যুক্তিবাদী ব্যক্তিত্বের হত্যা মামলাগুলোর গতিপ্রকৃতির দিকে তাকিয়ে গভীর বিষাদে ডুবে যেতে হচ্ছে!
আধুনিক ভারতের যুক্তিবাদী শহীদরা
মুক্তচিন্তা, বিজ্ঞানমনস্কতা ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের সমর্থনে জনমত গঠন ও লড়াই দিতে গিয়ে আধুনিক ভারতে যাঁরা মৌলবাদী ঘাতকের হাতে প্রাণ দিলেন, তাঁদের মধ্যে সর্বাগ্রে আসবে নরেন্দ্র অচ্যুত দাভোলকরের নাম। ২০১৩ সালের অগস্ট মাসের এক সকালে প্রাতর্ভ্রমণ সেরে ফেরার পথে পুনে শহরে তিনি গুলিবিদ্ধ হন। যুক্তিবাদের টানে চিকিৎসা পেশা ছেড়েছিলেন তিনি। জাতীয় কবাডি দলে খেলেছেন, ক্রীড়াপ্রশাসকও ছিলেন। বিজ্ঞানমনস্কতা প্রসারের ব্রত নিয়ে প্রিয় খেলার মাঠকেও বিদায় দিয়েছিলেন। একই কুয়োর জল জাতপাত নির্বিশেষে ব্যবহারের অধিকার দাবি, গণেশ প্রতিমা নদী-সমুদ্রে বিসর্জনের ফলে দূষণ আটকাতে আন্দোলনে সামিল হওয়া, এসবের পাশাপাশি বহুল প্রচারিত মারাঠি সাপ্তাহিক পত্রিকা ‘সাধনা’-র সম্পাদনা করেছেন দীর্ঘদিন ধরে। ১৯৮৯ সালেমহারাষ্ট্র অন্ধশ্রদ্ধা নির্মূলন সমিতি (মান্স্) গড়ে দু দশকের মধ্যে কুসংস্কার বিরোধী আন্দোলনকে রাজ্যের কোণায় কোণায় ছড়িয়ে দিয়েছেন। তবে তাঁর সর্বশ্রেষ্ঠ কীর্তিটি হল অলৌকিকতা-তন্ত্রমন্ত্রকে কাজে লাগিয়ে প্রতারণা আটকানোর জন্য এক শক্তপোক্ত আইন নির্মাণ, যা তাঁর জীবদ্দশায় মহারাষ্ট্র মন্ত্রিসভায় সাতবার পাশ হয়েও বিধানসভায় পেশ করা হয়নি। তাঁর মৃত্যুর পরে অবশ্য তড়িঘড়ি একে অর্ডিন্যান্সের আকারে লাগু করা হয়। গোটা পৃথিবীতেই এ ধরনের আইন নজিরবিহীন। এই আইন ব্যবহার করে এখনও পর্যন্ত ৫০০-রও বেশি মামলা রুজু হয়েছে, যার মধ্যে কয়েকটির সাজা ঘোষণাও হয়ে গেছে।
২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে মহারাষ্ট্রের আহমেদনগরে নিজের বাসভবনের অদূরে একই কায়দায় মৌলবাদী হত্যার শিকার হয়েছিলেন গোবিন্দ পানসারে। পানসারে ছিলেন ভারতের কম্যুনিস্ট আন্দোলনের এক ঊজ্জ্বল ব্যক্তিত্ব। স্ব-জাতের বাইরে গিয়ে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপনকে উৎসাহিত করে, এমন সংগঠনের সঙ্গেও তিনি আজীবন ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত থেকেছেন। পুত্রসন্তান লাভের আশায় ‘পুত্রকামেষ্টি যজ্ঞ’ নামক এক পুরুষতান্ত্রিক ও অযৌক্তিক হিন্দু লোকাচারের বিরুদ্ধে তিনি উচ্চকণ্ঠ ছিলেন। মহারাষ্ট্র তথা গোটা দেশজুড়ে হিন্দুত্ববাদী শক্তি মারাঠি রাজা শিবাজিকে হিন্দুত্বের আদর্শ হিসেবে তুলে ধরার যে চেষ্টা করে থাকে, তার মুখোশ খুলে দেয় পানসারের লেখা ‘শিবাজি কে?’। এতে তিনি ইতিহাসের পাতা থেকে যুক্তিসম্মতভাবে শিবাজির ধর্মনিরপেক্ষ প্রশাসনিক ব্যবস্থাকে হাজির করেন এবং দেখান যে, কোনও ধর্মরক্ষার উদ্দেশে তিনি রাজকার্য পরিচালনা করেননি। জ্যোতিবা ফুলে যেভাবে শিবাজিকে অব্রাহ্মণ ও নীচু জাতের প্রতিনিধি হিসেবে দেখিয়েছিলেন, পানসারেও অব্রাহ্মণ ও অক্ষত্রিয় শিবাজির উপর মারাঠি ব্রাহ্মণদের অসন্তোষের কথা তুলে ধরেছেন। গান্ধিঘাতক নাথুরাম গডসেকে মহিমান্বিত করার প্রতিবাদে তিনি বারবার কলম ধরেন। দাভোলকরের মৃত্যুর পরে যাতে তাঁর অপূর্ণ ইচ্ছেগুলোর অপমৃত্যু না ঘটে, তার জন্য তিনি আমৃত্যু প্রতিনিয়ত মান্স্-এর কর্মীদের সাহস জুগিয়ে গিয়েছেন।
পানসারে হত্যার কয়েক মাসের মধ্যে একই বছরে কোলাপুর শহরে এম এম কালবুর্গির হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়। সময়টা এক্ষেত্রেও সাতসকাল। তবে রাস্তায় নয়, এক্ষেত্রে ঘরে ঢুকে আততায়ীরা খুন করে এই কন্নড় সাহিত্যের এই স্বনামধন্য গবেষককে। কালবুর্গি ২০০৬ সালে সাহিত্যে জাতীয় অকাদেমি পুরস্কার পান। জন্মসূত্রে তিনি ছিলেন কর্নাটকি লিঙ্গায়ত সম্প্রদায়ের মানুষ। লিঙ্গায়ত সম্প্রদায়ের আদিগুরু বাসবকে ইতিহাসসম্মতভাবে তুলে ধরতে গেলে তিনি ওই গোষ্ঠীর পুরোহিতদের দ্বারা অভিযুক্ত হয়ে তীব্র মানসিক নির্যাতনের শিকার হন। শৈব লিঙ্গায়ত গোষ্ঠীর ‘উদারতা’ ও ‘জাতপাতবিরোধিতার’ মুখোশ ছিঁড়ে যায়। ২০১৪ সালের জুন মাসে বেঙ্গালুরু শহরে কুসংস্কারবিরোধী আইনের খসড়া নিয়ে এক আলোচনাসভায় কালবুর্গি যুক্তিবাদী কন্নড় লেখক ইউ আর অনন্তমূর্তিকে উদ্ধৃত করে বলেন যে, অনন্তমূর্তি ছোটোবেলায় পাথরের বিগ্রহের উপরে প্রস্রাব করে দেখতে চাইতেন, পাথরের মূর্তির কোনও অলৌকিক ক্ষমতা আছে কিনা। এতে কালবুর্গি বিশ্ব হিন্দু পরিষদ ও বজরং দলের মতো উগ্র হিন্দুত্ববাদী সংগঠনের চক্ষুশূল হয়ে ওঠেন। তাঁর বাড়িতে পুলিশ প্রহরা বসাতে হয়। কিছুকাল পরে তাঁরই ইচ্ছেয় এই প্রহরা তুলে নেওয়া হয়, ঘাতকরা এর অপেক্ষাতেই ছিল।
আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন সাংবাদিক গৌরী লঙ্কেশখুন হন ২০১৭ সালের ৫ সেপ্টেম্বর। বেঙ্গালুরুতে নিজের বাড়িতেই তাঁকে গুলিবিদ্ধ করা হয়। প্রথমে প্রয়াত পিতার প্রতিষ্ঠিত পত্রিকার সম্পাদনা, পরে নিজের আলাদা পত্রিকা প্রতিষ্ঠা করে গৌরী তার দায়িত্বভার গ্রহণ করেছিলেন। ইনিও ছিলেন কর্নাটকি লিঙ্গায়ত সম্প্রদায়ের মানুষ। জাতপাত ব্যবস্থার কট্টর সমালোচক গৌরী হিন্দু নারীদেরদ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক হয়ে থাকার পেছনে ধর্মের ভূমিকা সঠিকভাবেই চিহ্নিত করতে পেরেছিলেন। তিনি অবহেলিত পিছড়ে বর্গের জন্য ‘কোমু সৌহার্দ্য বেদিকে’ নামক সংগঠন গড়ে তোলেন, মূল উদ্দেশ্য ছিলসাম্প্রদায়িক সংহতির বার্তাটি সর্বত্র ছড়িয়ে দেওয়া। সংবাদপত্রের স্বাধীনতার ব্যাপারে দেশের সাংবাদিকদের মধ্যে তিনি অন্যতম লড়াকু ব্যক্তিত্ব ছিলেন। ২০০৮ সালে নিজের পত্রিকায় কয়েকজন বিজেপি নেতার জালিয়াতির তদন্ত প্রকাশ করে তিনি হিন্দুত্ববাদী শক্তির বিষ নজরে পড়েন।
তদন্তের গোলকধাঁধায়
দাভোলকর হত্যার পর সাড়ে সাত বছরেরও বেশি সময় পেরিয়ে গেলেও এই হত্যাকাণ্ডের মূল চক্রান্তকারীকে এখনও চিহ্নিত করা যায়নি। অন্য তিনটি খুন সম্পর্কেও একই কথা। কয়েকজনকে আটক করা হলেও হত্যাকাণ্ডের দায়ে সুনির্দিষ্টভাবে অভিযুক্ত করা সম্ভব হয়নি। ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে বোম্বে হাইকোর্টে দাভোলকর ও পানসারে পরিবারের আবেদনের শুনানির পরে বিচারপতি ধর্মাধিকারী ও চাগলার ডিভিশন বেঞ্চ তদন্তের অকারণ শ্লথতা নিয়ে বিরক্তি প্রকাশ করেছে। মান্স্-এর বর্তমান কার্যনির্বাহী সভাপতি অবিনাশ পাতিল ক্ষোভ উগরে দিয়েছেন এই বলে যে, দাভোলকরের হত্যার মোটিভ খুঁজতে গিয়ে তদন্তের নামে সিবিআই ব্যক্তিগত শত্রুতা বা টাকাকড়ি সংক্রান্ত গোলমাল খুঁজে বেড়াচ্ছে। তথ্যপ্রমাণ যা কিছু ছিল, তাও লোপাট হতে বসেছে। কয়েকটা বোড়ে ধরা পড়লেও আসল ষড়যন্ত্রকারীরা রয়ে গেছে নিরাপদ পর্দার আড়ালে।
কেউ যদি ভাবেন যে, কোনও জড়িবুটিওয়ালা তার ব্যবসা হারানোর ভয়ে দাভোলকরকে মেরেছে, তদন্তের নামে প্রহসনের মহড়া দেখলে তিনি নিঃসন্দেহে নিজের মত বদলে ফেলবেন। এ ব্যাপারে প্রথম ধরপাকড়ের ঘটনা ঘটে দাভোলকরের মৃত্যুর পরের বছর, ২০১৪ সালের জানুয়ারি মাসে। দুজন অস্ত্রব্যবসায়ী, যারা বন্দুকের বেআইনি কারবার করতে গিয়ে অনেক বারই জেলের ঘানি টেনেছে, তাদের ঘাড়েই দোষ চাপাবার চেষ্টা করা হয়। আদালতে দাঁড়িয়ে অভিযুক্ত অস্ত্রব্যবসায়ী মনীশ নাগোরি ও তাঁর সহযোগী বিলাস খান্ডেলওয়াল মহারাষ্ট্র অ্যান্টি টেররিজ়ম স্কোয়াড (এটিএস)-এর প্রধান রাকেশ মারিয়ার বিরুদ্ধে অভিযোগ আনেন যে, ইনি তাঁদের দাভোলকর খুনের দায় স্বীকার করার মূল্য হিসেবে ২৫ লক্ষ টাকা দিতে চেয়েছিলেন। পরে অবশ্য এঁরা এই মন্তব্য প্রত্যাহার করে নেন। আশ্চর্যজনকভাবে কয়েক মাসের মধ্যে এঁদের জামিন হয়ে যায় এবং এই মামলায় আর তাঁদের আবির্ভাব ঘটেনি। দাভোলকরের মৃত্যুর খবর কেবলমাত্র দেশের চৌহদ্দিতেই সীমাবদ্ধ ছিল না, তা হয়ে উঠেছিল আন্তর্জাতিক উৎকণ্ঠার বিষয়। বোম্বে হাইকোর্ট বিষয়টির গুরুত্ব অনুধাবন করে ২০১৪ সালের জুন মাসে এর তদন্তভার সিবিআই-এর হাতে সমর্পণ করে। কিন্তু মজার কথা হল, প্রথম দেড় বছর এই কাজের তদন্ত চালানোর জন্য একজনও কর্মচারী বরাদ্দ ছিলেন না। ইতিমধ্যে ২০১৫ সালে পানসারে ও কালবুর্গির মৃত্যু মৌলবাদী হত্যাকাণ্ডে নতুন মাত্রা যোগ করে। মামলা হাতে নেওয়ার পর সিবিআই-এর প্রথম তৎপরতা চোখে পড়ে ২০১৬ সালের মাঝামাঝি। জনৈক সাক্ষীর বিবৃতির ভিত্তিতে সিবিআই নাক-কান-গলা বিশেষজ্ঞ ড. বীরেন্দ্র সিং তাওয়াড়ে-কে গ্রেপ্তার করে এবং তাকে চক্রান্তের অন্যতম পাণ্ডা হিসেবে সাব্যস্ত করে। উল্লেখ্য যে, এই ঘটনার আগেই মহারাষ্ট্র পুলিশ পানেসর হত্যা মামলায় তাওয়াড়ে-কে গ্রেপ্তার করেছিল। সেপ্টেম্বরে সিবিআই তাওয়াড়ের বিরুদ্ধে চার্জশিট পেশ করে। এই সময়েই পুনের হিন্দুত্ববাদী কট্টরপন্থী ধর্মীয় সংগঠন সনাতন সংস্থার নাম তদন্তে উঠে আসে। তাওয়াড়ে ছিলেন এই সংগঠনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত। কিন্তু সবিশেষ আশ্চর্যের কথা হল, এই সংগঠনের অন্য যে দুই সদস্যকে দাভোলকরের খুনি হিসেবে চিহ্নিত করা হয়, যাঁরা নাকি পিস্তল থেকে গুলি ছুড়েছিলেন, সেই সারাং আকোলকর ও বিনয় পাওয়ার দাভোলকর হত্যার অনেক আগে ২০০৯ সাল থেকেই নিখোঁজ হিসেবে পুলিশের মিসিং স্কোয়াডের খাতায় নাম তুলিয়ে রেখেছে। সিবিআই-এর দাবি ছিল, প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ শুনে আঁকা স্কেচ এদেরই মুখচ্ছবি ফুটিয়ে তুলেছে! খুনের মোটিভ হিসেবে কুসংস্কার বিরোধিতার সূত্র ধরে সনাতন সংস্থার সঙ্গে মান্স্-এর দীর্ঘকালীন শত্রুতার দিকে আঙুল তোলে সিবিআই। ২০১৭ সালে গৌরী লঙ্কেশকে হত্যা করা হয়। ২০১৮ সালের অগস্ট মাসে সিবিআই দু-বছর আগের তত্ত্ব থেকে পশ্চাদপসরণ করে এবং নতুন এক জোড়া ‘বন্দুকবাজ’-কে খুনি হিসেবে তুলে ধরে। সনাতন সংস্থার সঙ্গে এই ঘাতকদ্বয় সচিন প্রকাশরাও আন্দুরে ও শরদ কালাস্করেরও যোগাযোগের কথা উঠে আসে। এরই সূত্র ধরে পরের বছর গ্রেপ্তার হন সনাতন সংস্থার মুম্বইনিবাসী আইনজীবী সঞ্জীব পুনালেকর ও তাঁর সহকারী বিক্রম ভাবে। একে একে অমল কালে (ইনি সনাতন সংস্থার সহযোগী সংগঠন হিন্দু জনজাগ্রুতি সমিতির সঙ্গে যুক্ত), অমিত দিগওয়েকর ও রাজেশ বঙ্গেরা-কে হেফাজতে নেয় সিবিআই। কর্নাটক স্পেশাল ইনভেস্টিগেশন টিম কালাস্করসহ উপরোক্ত তিন জনকে গৌরী হত্যায় সন্দেহভাজনের তালিকায় রেখেছিল। মহারাষ্ট্র এটিএস-ও পানসারে হত্যার দায়ে কালাস্কর-কে গ্রেপ্তার করে। কিন্তু সিবিআই এঁদের বিরুদ্ধে চার্জশিট গঠন করতে ব্যর্থ হয়। ২০২০ সালের এপ্রিল মাসে সিবিআই পুনে কোর্টকে এই তথ্য দেয় যে, কালাস্কর ৭ জুলাই ২০১৮ তারিখে পুনালেকর-এর পরামর্শ অনুযায়ী থানে শহরের নিকটবর্তী স্থানে আরব সাগরের এক খাঁড়িতে চারটি দিশি পিস্তল ফেলে দেয়। জলে ছুঁড়ে ফেলার আগে পিস্তলের যন্ত্রাংশগুলো ছাড়িয়ে নেওয়া হয়েছিল। সিবিআই-এর অনুমান, এই অস্ত্রগুলোর মধ্যে একটি সম্ভবত দাভোলকর হত্যায় ব্যবহৃত হয়েছে। ততদিনে পুনালেকর তিরিশ হাজার টাকার ব্যক্তিগত বন্ডে জেলের বাইরে। তাঁকে আবার হেফাজতে নেওয়া হয়। ২০২০ সালে সাড়ে সাত কোটি টাকা ব্যয় করে বিদেশ থেকে উন্নত যন্ত্রপাতি ও ডুবুরি এনে সমুদ্রের খাঁড়ির মধ্যে চল্লিশ ফুট পুরু বালির স্তর তল্লাশি করে একটি পিস্তল উদ্ধার করা হয়। তবে এই অস্ত্রটির সঙ্গে নিধনকাণ্ডের সম্পর্ক অদ্যাবধি প্রতিষ্ঠিত হয়নি। এই মুহূর্তে সচিন প্রকাশরাও আন্দুরে, শরদ কালাস্কর, বীরেন্দ্র সিং তাওয়াড়ে, সঞ্জীব পুনালেকর ও বিক্রম ভাবে জেলে আছেন। মামলার অগ্রগতি বলতে এটুকুই। আন্দুরে একটি বস্ত্র বিপণিতে সেলসম্যানের কাজ করেন। কালাস্কর পেশায় লেদ মেশিন অপারেটর। সমাজের এরকম নিচুতলার মানুষ কেন একজন যুক্তিবাদী আইকনকে প্রাণে মেরে ফেলার মতো চরম সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, তা সিবিআই-কে অবশ্যই তথ্যপ্রমাণ সহযোগে ব্যাখ্যা করতে হবে।
কেন এই প্রহসনের মহড়া
কালাস্কর নিজেই তাঁর সঙ্গে এক ‘দক্ষিণপন্থী দল’-এর গাঁটছড়া কবুল করেছেন। কীভাবে অস্ত্রচালনার এক ‘ক্র্যাশ কোর্স’ তাঁকে করিয়ে নেওয়া হয়েছিল, সনাতন সংস্থায় যুক্ত তাওয়াড়ের কাছ থেকে কী কী নির্দেশ এসেছিল, তার বয়ানও দিয়েছেন তিনি। এমনকি, সিবিআই দাভোলকরকে লেখা পুনালেকরের একটি চিঠিও খুঁজে পেয়েছে বলে দাবি করেছে, ২০১২ সালের এই চিঠিতে পরিষ্কার যে ওই কুসংস্কারবিরোধী যোদ্ধাকে পুনালেকর কতখানি অপছন্দ করতেন। অথচ এভাবে বারবার সনাতন সংস্থার নাম উঠে আসার পরেও সিবিআই এই মামলার নিষ্পত্তি করতে পারছে না কেন? অপরাধবিদ্যার আধুনিকতম রীতিনীতি-উপকরণ হাতে থাকা সত্ত্বেও কেন সফলতা আসছে না? ২০১৯ সালেও আদালতে সিবিআই এই বলে সাফাই দিয়েছে যে, পুনালেকর ও অন্যান্যরা তদন্তের কাজে যথেষ্ট সহযোগিতা করছেন না। সহযোগিতা পাওয়ার উপায় কি জানা নেই দেশের সর্বোচ্চ তদন্তকারী সংস্থার? নাকি সত্যিটাকে সামনে আনতে তাদের নিজস্ব অনিচ্ছেটাই বাগড়া দিচ্ছে সবচেয়ে বেশি? অবিনাশ পাতিল তো বলেই দিচ্ছেন যে, কেন্দ্রে আসীন বর্তমান শাসক দলের কোনও রাজনৈতিক সদিচ্ছাই নেই সনাতন সংস্থার মতো হিন্দুত্ববাদী সংস্থার বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেওয়ার। এতকাল ধরে তদন্তের নামে যাবতীয় নাটক আসলে তাঁদের বোকা বানানোরই জন্য করা হয়েছিল। জানলে আশ্চর্য হতে হয় যে, পুনে পুলিশ কমিশনার দাভোলকরের খুনিদের ধরার জন্য প্ল্যানচেটের আসর বসানোর কথা ভেবেছিলেন! কুসংস্কারের অবসান চেয়ে দাভোলকর সারা জীবন উৎসর্গ করলেন, রহস্যমোচনের জন্য সেই কুসংস্কার ও জালিয়াতির সাহায্য নেওয়ার কথা ভাবছেন তদন্তকারীরা। কুৎসিত নাট্যমহড়া ছাড়া একে আর কীই-বা বলা যায়!
বিচারব্যবস্থার এই নিষ্পৃহতার কারণ খুঁজতে গেলে আমাদের সময়কালটা মাথায় রাখতে হবে। ১৯৭০-এর দশকের মাঝামাঝি পর্যন্ত গোটা বিশ্বব্যাপী একটা ভরসা ছড়িয়ে পড়েছিল যে, রাজনীতির সঙ্গে ধর্মের গাঁটছড়ার দিনের অবসান কেবল সময়ের অপেক্ষা। শিল্পনির্ভর উৎপাদন ব্যবস্থা যতই সমাজের ভিত্তি হয়ে উঠছে ততই প্রশাসন, আইনকানুন, জ্ঞানচর্চায় আধুনিকতা জাঁকিয়ে বসছে। গোঁড়ামি, অন্ধত্ব, ধর্মান্ধতা পিছু হঠছে। পশ্চিমি বৈজ্ঞানিক ঐতিহ্য যতই গোটা বিশ্বে পরিব্যাপ্ত হচ্ছে ততই ধর্মের সামাজিক ও রাজনৈতিক গুরুত্ব কমে আসছে, তা ক্রমশ সমাজজীবনে অপ্রাসঙ্গিক হয়ে উঠছে। ধর্মবিশ্বাসকে প্রতিনিয়ত টিকে থাকতে হচ্ছে আধুনিকতার সঙ্গে আপস করে, কিন্তু এর ক্রমক্ষীয়মান চেহারাটা লুকিয়ে রাখা যাচ্ছে না। বিগত শতাব্দের শেষদিক থেকে এ নিয়ে যতগুলি সমীক্ষার ফলাফল প্রকাশিত হয়েছে, তার সবগুলোতেই এই চিত্র উঠে এসেছে। ধর্মে আস্থাহীন মানুষের দ্রুত সংখ্যাবৃদ্ধি থেকে এই ঝোঁকটিকে চিনতে পারা যায়। অন্য দিকে, আধুনিকতার সঙ্গে আপসরফা করে ধর্মকে যে বেশিদিন টিকিয়ে রাখা যাবে না, এই উপলব্ধিতে পৌঁছতে ধর্মনেতারাও দেরি করেননি। কাজেই, ধর্মের তরফে শুরু হয় এক মরণকামড়। যাবতীয় গল্পগাছা, বাণী আর তত্ত্বকে আক্ষরিকভাবে গ্রহণ করা এবং যাবতীয় অবিশ্বাস আর প্রশ্নশীলতাকে সহিংসভাবে মোকাবিলা করার এই মানসিকতাই জন্ম দেয় মৌলবাদের। মধ্যপ্রাচ্যে ইসলামি দুনিয়ায় এর অভ্যুত্থান ঘটলেও তা কোনও বিশেষ ধর্ম বা এলাকার গণ্ডিতে আবদ্ধ থাকেনি। ‘স্পিরিচ্যুয়াল আইস-বেল্ট’ রূপে কথিত পশ্চিম ইউরোপ আর অস্ট্রালেশিয়ার দেশগুলো ছাড়া পৃথিবীর প্রায় সর্বত্রই এর প্রকোপ মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে থাকে। বিশ্বের নানা প্রান্তে ধর্মের নামে নিরীহ মানুষের উপরে নামিয়ে আনা নির্বিচার হত্যালীলার পাশাপাশি বেছে বেছে মুক্তচিন্তক আর যু্ক্তিবাদী নিধনের ঘটনাও শুরু হয়ে যায়। যে সব দেশে মৌলবাদীরা শাসনক্ষমতা দখল করতে সক্ষম হয়, সেখানে এই মারণযজ্ঞ আরও তীব্র হয়ে ওঠে। এই প্রেক্ষিতেই ভারতীয় উপমহাদেশের যুক্তিবাদী নিধনকে দেখা দরকার।
সনাতন সংস্থার সঙ্গে মহারাষ্ট্র-কর্নাটকের যুক্তিবাদী আন্দোলনের যুযুধান আদর্শগত ফারাককে বুঝে উঠতে পারলে বিচারব্যবস্থার আচরণকেও আর অস্বাভাবিক লাগবে না। ২০১৪ সালে দ্বিতীয়বার বিজেপি ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার পর ভারতে হিন্দুত্ববাদী রাজনীতি পূর্ণতা পায়। দেশের গণতান্ত্রিক স্তম্ভগুলো একে একে ধরাশায়ী হতে থাকে, বিচারব্যবস্থা যার অন্যতম। অনেকেরই স্মরণে থাকবে এই সময়ে মালেগাঁও বিস্ফোরণ মামলার পরিণতির কথা। বোম্বে অ্যান্টি টেররিজ়ম স্কোয়াড ২০০৮ সালে সংঘটিত এই নারকীয় হত্যাকাণ্ডের তদন্তে নেমে তথ্যপ্রমাণ সহযোগে স্পষ্টভাবে দেখায় যে, কীভাবে সঙ্ঘ পরিবার দেশের বিভিন্ন জায়গায় পরিকল্পিতভাবে একের পর এক উগ্রপন্থী কাজকর্ম চালিয়ে যাচ্ছে। এই ঘটনাপ্রবাহকেই পরবর্তীকালে ‘গেরুয়া সন্ত্রাস’ নামে অভিহিত করা হয়। মালেগাঁও বিস্ফোরণের পেছনে সঙ্ঘ ঘনিষ্ট অভিনব ভারত নামক সংগঠনের ভূমিকা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। বিজেপি, শিবসেনা ও অন্যান্য হিন্দুত্ববাদী সংগঠন বোম্বে এটিএস ও তার প্রধান হেমন্ত কারকারের দিকে অভিযোগের আঙুল তোলে যে, মুসলিম তোষণের জন্য এরা সঙ্ঘ পরিবারের সদস্যদের অন্যায়ভাবে আটক করেছে। এর কিছুকালের মধ্যে হেমন্ত কারকারের রহস্যজনক মৃত্যু ঘটে। অবশ্য তিনি মৃত্যুর আগে যাবতীয় সাক্ষ্যপ্রমাণ জড়ো করে গিয়েছিলেন। কিন্তু ২০১৪ সালের পর থেকে এই মামলায় আকস্মিক বাঁক লক্ষ করা যায়। কেন্দ্রীয় সরকারি গোয়েন্দা সংস্থা ন্যাশনাল ইনভেস্টিগেশন এজেন্সি (এনআইএ) তদন্তের দায়িত্বভার গ্রহণ করে এবং একের পর এক অভিযুক্ত বেকসুর খালাস পেতে থাকে। হঠাৎ একদিন জানা যায় যে, বোম্বে এটিএস যে যে তথ্যপ্রমাণ সংগ্রহ করেছিল, তার গুরুত্বপূর্ণ ফাইলগুলো বেপাত্তা হয়ে গেছে। পরবর্তীকালে এই মামলায় অন্যতম অভিযুক্ত সাধ্বী প্রজ্ঞা ২০১৯ সালের সাধারণ নির্বাচনে বিজেপি-র টিকিটে ভোপাল থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন ও বিজয়ী হন। হেমন্ত কারকারে সঙ্ঘ পরিবারের নাশকতামূলক কাজকর্মের তদন্ত চালানোর সময়ে সনাতন সংস্থা নিয়েও তথ্য জড়ো করেছিলেন এবং এই সংগঠনকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করার দাবিও জানিয়েছিলেন। গৌরী লঙ্কেশ মৃত্যুর তদন্তেও বারবার খুনের সঙ্গে ওই সংস্থার যোগসূত্র পাওয়া গেলে মহারাষ্ট্রের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী দেবেন্দ্র ফড়নবিশ জানিয়েছিলেন যে, কেন্দ্রের কাছে তিনিও সনাতন সংস্থাকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করার দাবি জানিয়েছেন। কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকার এরকম কোনও বিষয়ের অবগতির কথা অস্বীকার করে। কাজেই, এটা বুঝতে অসুবিধে হওয়ার কথা নয় যে, সনাতন সংস্থাকে আড়াল করার চেষ্টা চলছে। কিন্তু কেন?
যুযুধান মতাদর্শের অনিবার্য সংঘাত
যুক্তিবাদের চার শহীদ যে যে বিষয়ে জনমত তৈরি করতে চাইতেন, তা স্পষ্টভাবে সঙ্ঘের মতাদর্শের একেবারে বিপরীত। কুসংস্কারবিরোধী আইনটিকে হিন্দু জনজাগ্রুতি সমিতি, আর্ট অব লিভিং ফাউন্ডেশন এবং সনাতন সংস্থার মতো সংগঠন গোড়া থেকে ‘হিন্দুবিরোধী’ আখ্যা দিয়েছিল। হিন্দুত্ববাদী প্রাতিষ্ঠানিক দলগুলো এভাবে বিরোধিতা না করলেও বিধানসভায় পেশ কালে নানা খুঁটিনাটি উল্লেখ করে ‘টেকনিক্যাল’ আপত্তি জানিয়েছিল। দাভোলকরের মৃত্যুর পর মহারাষ্ট্রে কুসংস্কারবিরোধী যে আইনটি চালু হয়, তা মূল খসড়াকে বহুবার পরিবর্তন করে নির্মিত হয়েছে। মূল খসড়ায় ৭০টি ধারা থাকলেও অনুমোদিত হয়েছে মাত্র ১২টি ধারা। তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী পৃথ্বীরাজ চৌহান এর বিরুদ্ধাচরণকারীদের এই বলে আশ্বাস দিয়েছিলেন যে, ওই আইনটি এমনভাবে পরিবর্তিত হয়েছে যাতে ধর্মীয় আচার-আচরণ নিয়ে কারও কোনও অসুবিধে হবে না। এমনকি, জ্যোতিষের কারবার, বাস্তু— এসব চালিয়ে যেতেও সমস্যা নেই। কিন্তু মৌলবাদীরা জানে যে, ধর্মের সঙ্গে কুসংস্কারের সম্পর্ক কত নিবিড়। একবার কুসংস্কার ঠেকনোর জন্য আইন এসে গেলে তা অদূর ভবিষ্যতে ধর্মীয় প্রতারণার জন্য আইনের পথকেও সুগম করে তুলবে। খবরে-না-আসা শয়ে শয়ে আশারাম বাপুদের জন্য তা বিপজ্জনক হয়ে উঠবে। কাজেই, তারা দাভোলকরকে হত্যা করে একে চরম আঘাত দেওয়ার চেষ্টা করে।
দাভোলকর, কালবুর্গি ও গৌরী জাতপাত নিয়ে যে ধরনের কাজকর্ম করেছিলেন তা সঙ্ঘের আদর্শের পরিপন্থী। আম্বেদকর জাতব্যবস্থার বিলোপ চেয়ে প্রকাশ্যে ‘মনুস্মৃতি’ দাহ করেছিলেন। বিপরীতে সঙ্ঘ মনুকেই তাদের আদর্শ বলে মানে। জয়পুর আদালতের সামনে বিশ্বের একমাত্র মনুর মূর্তিটি স্থাপন করেছিলেন সঙ্ঘের বরিষ্ঠ নেতা ভৌরোঁ সিং শেখাওয়াত। ২০১৮ সালে ভীমা-কোরেগাঁওয়ে দলিতদের সমাবেশে শিব প্রতিষ্ঠান ও হিন্দু একতা মঞ্চ নামক হিন্দুত্ববাদী সংগঠনের তাণ্ডব এবং দলিতদের সমর্থনে পাশে দাঁড়ানো বুদ্ধিজীবীদের উপরে দানবীয় ইউএপিএ আইন প্রয়োগ করে মিথ্যা মামলা সাজানোর ঘটনাও আমাদের অজানা নয়। সঙ্ঘ মতাদর্শে যেভাবে নারীদের অবস্থান নির্দিষ্ট করা হয়, তার পেছনেও সমর্থন আসে মনুস্মৃতি থেকে। হরিয়ানার মুখ্যমন্ত্রী মনোহরলাল খট্টর যখন ‘মুক্ত’ হওয়া কাশ্মির থেকে কন্যা নিয়ে এসে বিবাহের কথা বলেন, তখন মেয়েদের প্রতি সঙ্ঘীয় দৃষ্টিভঙ্গি স্পষ্টভাবে ফুটে ওঠে। সুপ্রিম কোর্টের রায়ের বিরোধিতা করে শবরীমালায় ঋতুবতী নারীদের প্রবেশাধিকার রুখতেও সঙ্ঘ ব্যাপক সক্রিয়তা দেখিয়েছিল। ‘লাভ জেহাদ’-এর তত্ত্ব প্রচার বা ধর্ষকের সমর্থনে মিছিল বার করা— এসবও নিশ্চয়ই নারীদের প্রতি মর্যাদাসূচক নয়। বিজেপি নেত্রী বিজয় রাজে সিন্ধিয়া তো অতি উৎসাহে সতীপ্রথাকেই সমর্থন করে বসেন। কাজেই, পানসারে যখন অসবর্ণ বিবাহে মদত দেন কিংবা পুত্রসন্তান কামনায় আহুত যজ্ঞের আগুনে ‘ঠান্ডা জল’ ঢেলে দেন, তখন হিন্দু মৌলবাদের খুশি হওয়ার কথা নয়। গৌরী লঙ্কেশ যেভাবে লিঙ্গায়ত সম্প্রদায়কে হিন্দুধর্মের অংশ বলে মানতেন না, পৃথক ধর্মমত বলে মনে করতেন, তাও সঙ্ঘের ধর্মীয় আগ্রাসনের তত্ত্বের সঙ্গে নেহাতই বেমানান। শিখ, জৈন, বৌদ্ধ নির্বিশেষে ‘হিন্দু’ ছাতার নিচে ঢুকিয়ে নেবার মৌলবাদী মতাদর্শের পক্ষে গৌরীর ঔদ্ধত্যকে মেনে নেওয়া কঠিন। কাজেই, আধুনিক পৃথিবীতে মৌলবাদী হুঙ্কারের সামনে বুক চিতিয়ে দাঁড়ানো মুক্তচিন্তক ও যুক্তিবাদীদের দিকে নির্মম হত্যাকাণ্ড নামিয়ে আনতে ধর্মধ্বজীরা কোনও দ্বিধা করেনি। এ ছিল যুযুধান দুই মতাদর্শের লড়াই। এক অর্থে, এই সংঘাত অনিবার্যই ছিল।
সুবিচারের আশাভরসা এবং আমাদের ইতিকর্তব্য
দাভোলকরের মৃত্যুর পর প্রথম পাঁচ বছরে অন্ধশ্রদ্ধা নির্মূলন সমিতির সদস্যরা সুবিচার চেয়ে ২৫ বার রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন। লিখিত অনুরোধ জানিয়েছে অন্তত ১০০ বার, যার মধ্যে রক্ত দিয়ে লেখা চিঠিও আছে। তাঁরা বিভিন্ন স্থানে অবস্থান বিক্ষোভ সংঘটিত করেছেন, আইনজ্ঞদের কাছে দরবারও করেছেন। কিন্তু কাজের কাজ কিছু হয়নি। কিন্তু আশার কথা, মান্স্ ভয়ে কুঁকড়ে না গিয়ে তাদের কাজকর্মের ধারা অব্যাহত রেখেছে। এই মুহূর্তে গোটা মহারাষ্ট্র জুড়ে তাদের সাড়ে তিনশোরও অধিক শাখা কাজ করে চলেছে। সক্রিয় সদস্যের সংখ্যা দশ হাজার পেরিয়েছে। পাশাপাশি মান্স্-এর কর্মকাণ্ড নিয়ে সনাতন সংস্থার বিষোদ্গারও অব্যাহত আছে। কেন্দ্রে আসীন বর্তমান শাসক দলের ঢঙে তারা মহারাষ্ট্রের যুক্তিবাদী কর্মীদের গায়ে নকশালপন্থার ছাপ্পা মেরেছে।
ভারতে যুক্তিবাদী নিগ্রহ ও নিধনের এই পর্বটি হয়তো এখনও শেষ হয়নি। হয়তো যুক্তিবাদী সৈনিকদের আরও মূল্য চোকাতে হবে। মনে রাখতে হবে যে, যুক্তিবাদ, মানবাধিকার ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের সমর্থনে যাঁরা প্রাণ হারিয়েছেন, তাঁরা প্রত্যেকেই স্বনামধন্য ব্যক্তি ছিলেন। প্রত্যেকটি মৃত্যুর জোরালো প্রতিবাদ হয়েছে ভারতের কোণায় কোণায়। দেশের বাইরেও আলোড়ন কম হয়নি। এঁদের প্রাণ কেড়ে যুক্তিবাদী কর্মীদের মনোবল গুঁড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছে মৌলবাদীরা। কিন্তু অন্য দিক থেকে দেখলে, মৌলবাদকে রুখতে যুক্তিবাদের এক দুর্দান্ত ভূমিকা এভাবে উঠে আসে। উঠে আসে যুক্তিবাদী আন্দোলনকে আরও তীব্র করে তোলার সময়ের দাবিটিও। আধুনিকতার অভিঘাতে বিপন্ন ধর্মের মরণকামড় হয়তো বা আরও কিছুকাল সমাজের উপর পড়বে, কিন্তু তা কখনই চিরস্থায়ী হতে পারে না। মানবসভ্যতার অগ্রগতির রৈখিক পথরেখায় এ এক সাময়িক ‘ফ্ল্যাকচ্যুয়েশন’ বা বিচলন মাত্র, আধুনিকতার চাকাকে কখনও পেছনে ফেরানো যায় না। তবে ঊর্ধ্বমুখী লেখচিত্রের এই উঁচুনিচু বাঁকগুলোকে আমরাই পারি দ্রুত সরলরেখায় এনে ফেলতে। সুবিচারের দাবিতে বিচারব্যবস্থাকে অবশ্যই প্রভাবিত করতে হবে। একই সঙ্গে, আমাদের ইতিকর্তব্য থেকেও আমরা যেন বিচ্যুত না হই।
_____
যে রচনাগুলির সাহায্য নিয়েছি:
- Haygunde, C. and Kulkarni, S. (2020) ‘Explained: The Narendra Dabholkar murder case, seven years on’, The Indian Express, 23 August.
- Koppikar, S. (2020) ‘Seven years after his killing, justice for Narendra Dabholkar nowhere in sight’, The Wire, 20 August.
- ‘Narendra Dabholkar murder case: Pune court grants bail to accused Sanatan Sanstha lawyer’ (2019) Scroll.in, 5 July.
- PTI (2020) ‘HC raps CBI, CID over trial delay in Narendra Dabholkar, Govind Pansare murder cases’, The New Indian Express, 13 February.
- Deshmane, A. (2019) ‘No political will to investigate conspiracy behind narendra dabholkar’s murder, says his successor’, HuffPost, 21 July.
- ‘Narendra Dabholkar murder case: Pune court grants bail to accused Sanatan Sanstha lawyer’ (2019) Scroll.in, 1 August.
- Tare, K. (2018) ‘How investigation into Dabholkar murder case has been marred by contradictions’, 23 August.
- Vijayan, M. J. (2018) ‘The ascent of conservative civil society in india – the mobilization of conservative civil society’, Carnegie Europe, 4 October.
- Ruthven, M. (2007) Fundamentalism: a very short introduction. Oxford; New York: Oxford University Press.
- ‘অভিজিৎ রায়ের হত্যাকাণ্ডে ৫ জনকে মৃত্যুদণ্ড বাংলাদেশে’ (২০২১) আনন্দবাজার পত্রিকা, ১৭ ফেব্রুয়ারি
- ‘দীপন হত্যায় ৮ আসামির মৃত্যুদণ্ড’ (2021) The Daily Star Bangla.
- আপডেট স্টাডি গ্রুপ (২০২০) সঙ্ঘ পরিবার ও হিন্দুত্ববাদ: ভিত্তি উদ্ভব বিকাশ, কলকাতা: সেতু প্রকাশনী
- ভট্টাচার্য, দেবাশিস্ (২০১৯) যুক্তিবাদীর মর্মকথা, কলকাতা: ঋতাক্ষর প্রকাশন
- Patwardhan, A. (2018) Vivek-Reason (Documentary Film).
- উইকিপিডিয়া (আন্তর্জাল বিশ্বকোষ), বিভিন্ন প্রবন্ধ