Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

আপ্যায়নের অত্যাচার

আপ্যায়নের অত্যাচার: নানক সিং | ভাষান্তর: নাহার তৃণা

নানক সিং

 

ভাষান্তর: নাহার তৃণা

ভারতীয় লেখক নানক সিং পাঞ্জাবি ভাষার অন্যতম প্রধান সাহিত্যিক। তাঁর জন্ম ৪ জুলাই ১৮৯৭ পাঞ্জাবের ঝিলম জেলায় (বর্তমানে পাকিস্তানে) এক হিন্দু পরিবারে। জন্মের সময় তাঁর নাম ছিল হানস রাজ। পরবর্তীকালে তিনি শিখ ধর্মে দীক্ষা নিলে নানক সিং নামে পরিচিত হন। ব্রিটিশ আমলে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের পক্ষে সাহিত্যকর্মের কারণে তাঁকে কারাবরণ করতে হয়েছিল। নানক সিংয়ের প্রাতিষ্ঠানিক কোনও শিক্ষা না থাকলেও তাঁর রচনাগুলি খুবই উপভোগ্য এবং সাহিত্যগুণসমৃদ্ধ। তাঁর প্রকাশিত ছোটগল্প এবং উপন্যাস পাঠক মহলে যথেষ্ট সুখ্যাতি লাভ করেছিল। তাঁর সবচেয়ে জনপ্রিয় উপন্যাস ‘পবিত্র পাপী’ একাধিক ভাষায় অনুদিত এবং চলচ্চিত্রায়িত হয়েছিল।

বাবার সবচেয়ে ছোট বোন, মানে আমার ছোট ফুপু, তাঁর সঙ্গে আমার এক দশকেরও বেশি সময় দেখাসাক্ষাৎ ঘটেনি। এই ফুপুই বর্তমানে আমাদের পরিবারের একমাত্র জীবিত বয়োজ্যেষ্ঠ। স্বপ্নের মতো স্মৃতিপটে এখনও ভাসে শৈশবে ফুপু আমার হাত ধরে স্কুলে পৌঁছে দিতেন। টিফিন ব্রেকে আমার জন্য প্রায় বাটিভর্তি ঘন দুধের পায়েস নিয়ে আসতেন। এটা প্রায় ত্রিশ বছর আগের কথা বলছি। যাঁরা আমায় ‘খোকা’ বা ‘বাবা’ বলে সম্বোধন করতেন তাঁদের কেউই আজ আর বেঁচে নেই, তাঁদের একমাত্র প্রতিনিধি হিসেবে থেকে গেছেন ফুপু।

তাই এবার যখন আমি এক আত্মীয়ের ছেলের বিয়েতে গ্রামে গিয়েছিলাম তখন ফুপুর সঙ্গে দেখা করার সুযোগ থেকে নিজেকে কিছুতেই বঞ্চিত করতে ইচ্ছে করেনি। যদিও বিয়েবাড়ি থেকে ফুপুর বাড়ি প্রায় দশ মাইলের হাঁটা পথ, এবং সে পথও ধুলোবালিময়। গরমকালে শহুরে মানুষের পক্ষে গ্রামে নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে যাওয়া ব্যাপক ঝক্কির। বিয়েবাড়ির খাবারদাবার এত বেশি তেল-মশলাদার হয় যে সেসব হজমের পেছনে হজমি বড়ির পুরো এক বোতলই খালি হয়ে যায়। মাত্র দুদিনেই অগুনতি পুরি আর প্রচুর মশলাদার খাবার আমাকে গলঃধরণ করতে হয়েছে। মনেপ্রাণে চেয়েছিলাম অন্তত একবেলায় যেন সাদামাটা রুটি আর ডাল খেতে দেওয়া হয়। কিন্তু বিয়েবাড়ির অতিথিদের ওরকম আড়ম্বরহীন খাবার পরিবেশনের প্রশ্নই ওঠে না।

বিয়েবাড়ির চূড়ান্ত অতিথি আপ্যায়নের অত্যাচার সয়ে দুটো রাত সেখানে কাটাই। এরপর ফুপুর সঙ্গে দেখা করার উদ্দেশ্যে গ্রামের বাড়ির দিকে রওনা দেই। ফুপুর সঙ্গে দেখা হওয়ার ভাবনায় বেশ নস্টালজিক হয়ে পড়ি। মনে পড়ে, যখন ছোট ছিলাম তখন দেখতাম মাটির চুলাতে ফুপু কী যত্নের সঙ্গে হালকা ফুলকা রুটি বানাত। গন্তব্যে পৌঁছানোর জন্য কোনও যানবাহন পাওয়া গেল না। গরমে ঘেমেনেয়ে ধুলোবালি মেখে, কখনও জমির আল ধরে, কখনও জমির উপর দিয়ে পথ ভাঙতে ভাঙতে হেঁটেই এগোতে হল। গ্রামে পৌঁছাতে পৌঁছাতে সন্ধ্যা হয়ে গেল। শেষমেশ ক্লান্তিকর পদযাত্রার ইতি।

বাড়িতে ঢুকে আমি সাগ্রহে ফুপুর পা ছুঁয়ে নিজের উপস্থিতি জানান দিই। প্রথা মেনে ফুপু আমাকে চুমু খেয়ে আশীর্বাদে সিক্ত করেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও যেন ফুপুর আগের ভালোবাসাময় স্পর্শের ওমটুকু খুঁজে পেলাম না। আসলে দীর্ঘ অদর্শনে ফুপু আমাকে মোটেও চিনতে পারেননি। আর তাছাড়া তিনি রাতকানা রোগেও আক্রান্ত।

তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘বাবা তুমি কোত্থেকে এসেছ?’ আমি যখন আমার নাম বললাম তখন তিনি আমাকে ছেলেবেলার মতোই সস্নেহে জড়িয়ে ধরলেন। আমার গালে কপালে চুমুতে চুমুতে ভরিয়ে দিলেন। রীতিমত হাঁকডাক শুরু করে দিলেন। চেঁচিয়ে ডাকলেন ‘চানন কৌর, দৌড়ে এসো! ভগবানের দয়ায় কতদিন বাদে আমার বীরপুত্তর বাড়ি এসেছে। ছেলেপুলেরা কই রে তোরা জলদি আয়, দেখ তোদের চাচা এসেছে।’

ফুপুর ছেলের বউ আক্ষরিকভাবেই পড়িমরি করে দৌড়ে আসে। নাতিনাতনিরা সবাই আমাকে ঘিরে ধরে।

যদিও তারা কেউই এর আগে আমাকে দেখেনি পর্যন্ত। সম্পর্কে তাদের চাচা হই, আমার এই পরিচয়টাই যেন তাদের কাছে যথেষ্ট ছিল। ফুপুর ছেলের বউটি মুখের উপর থেকে ঘোমটা সরায়নি, কোনও কথাও বলেনি, যদিও সে আমার ফুপাতো ভাইয়ের বউ তা সত্ত্বেও গ্রামের রীতি অনুযায়ী স্বামীর বয়োজ্যেষ্ঠ আত্মীয়ের সঙ্গে কথা বলাটা শোভন নয়।

আমি ফুপুর পাশে একটা পিড়িতে বসি, তিনি আমার গায়ে মুখে সস্নেহে হাত বুলাতে বুলাতে আমার ঘর-বাড়ি, ছেলেপুলে, স্ত্রী— যাবতীয় বিষয়ে খোঁজ খবর নিতে শুরু করেন। একই প্রশ্ন কতবার যে জিজ্ঞেস করেন। আমিও বারংবার উত্তরে একই কথা বলি, ‘হ্যাঁ, সব ঠিকঠাক আছে।’ গুম্ফবান হওয়া সত্ত্বেও নিজেকে আমার তখন ছোট্ট বালক মনে হচ্ছিল। ফুপুর স্নেহ মেখে আমি যেন শৈশবে ফিরে গেছি।

ফুপু বউমার উদ্দেশ্যে বললেন, ‘মা রে ওঠো, ওঠো! ভাইজানের জন্য কিছু খাবার তৈরি করো। সকাল থেকে আমার ছেলেটা না খেয়ে আছে। মুখটা কেমন শুকিয়ে গেছে!’ ফুপু, বউমাকে একরকম তাড়া দিয়ে রান্না ঘরে পাঠালেন। আমার মোটেও খিদে নেই, একথা বলা সত্ত্বেও তিনি তাতে কান দেওয়ার প্রয়োজন দেখালেন না।

আদতে আমার একটুও খিদে ছিল না। কনের বাড়ি থেকে বরযাত্রীদের বিদায়ের আগে প্রচুর পরিমাণ খাবার ও মিষ্টি খেতে হয়েছিল। সেকারণে আমার একদমই খিদেবোধ ছিল না। মনে মনে ঠিক করেছিলাম রাতে কিছু খাব না। বিয়েবাড়ির মাত্রাতিরিক্ত খাওয়ার হ্যাপায় আমি তখনও ঢেকুর তুলছিলাম।

‘এই সেরেছে!’ আমার সামনে রাখা থালা ভর্তি খাবার দেখে মুখ ফস্কেই বাক্যটা বেরিয়ে গেল। থালার উপর  বিশাল সাইজের ঘিয়ে চপচপে দুটো পরোটা আর একডাঁই মিষ্টি সেমাই আয়েশি ভঙ্গিতে আমার দিকে চেয়ে আছে, দেখে আমার পিলে সত্যিই চমকে যায়। আতঙ্ক নিয়ে আমি খাবারের থালাটার দিকে চেয়ে থাকলাম। আমার অবস্থা তখন বাস্তবিকই জলন্ত কড়াই থেকে আগুনে ঝাঁপ দেওয়ার মতো।

এ বিষয়ে ফুপাতো ভাইয়ের স্ত্রীকে কিছু বলতে সঙ্কোচ বোধ হচ্ছিল, আর ফুপুকে কিছু বলার কোনও মানেই হয় না। তবুও মরিয়া হয়ে আমি প্রায় মিনতি করি, ‘ফুপুজান, সত্যি বলছি এক টুকরোও আমার পক্ষে খাওয়া সম্ভব না। বিয়েবাড়ির খাওয়া এখনও হজম হয়নি। খুব কষ্ট হবে আমার।’ কিন্তু ফুপু ওসবে কান না দিয়ে বার বার বলতে থাকলেন, ‘বাবারে, তোমাকে কী এমন দেওয়া হয়েছে, দুটো রুটি বৈ তো আর তেমন কিছু না। খেয়ে নাও মানিক আমার।’

‘ফুপুজান, এই একগাদা সেমাইয়ের পাহাড় সরানো কি আমার পক্ষে সম্ভব? এত আমি কীভাবে খাব?’

মরিয়া হয়ে আত্মপক্ষ সমর্থনের চেষ্টা চালালাম, কিন্তু যথারীতি সেটা ব্যর্থ হল।

“কথা না বাড়িয়ে খেয়ে নাও সোনা। সেমাইটুকু খেলে তোমার ভালো লাগবে, মুখটা মিষ্টি হবে। গ্রামেগঞ্জে থাকি রে বাবা, এসব ছাড়া আর কী দিয়েই বা আপ্যায়ন করি বলো! এ তো আর তোমাদের শহর নয়, বা নিদেনপক্ষে মফস্বলও না যে মুখরোচক রকমারি খানাখাদ্য পাওয়া যাবে। হাতে বানানো রুটি মিষ্টিই আমাদের ভরসা। কে যেন বলেছে, কথাটা কিন্তু ভুল বলেনি যে, ‘দেবতারা শহরে বাস করেন, আর ভূতের বাস গ্রামে।’ শহরের সঙ্গে আমাদের সেভাবে যোগাযোগ আর কোথায়! এ জীবনে শহরে যাওয়ার সৌভাগ্য আমার একবারই হয়েছিল। তোমার ফুপা অমৃতসরে নিয়ে গিয়েছিলেন একবার, গুরুজির কৃপায় অমৃতসর আর দরবার সাহেবকে দেখবার ভাগ্য হয়েছিল তখন। না হলে বাড়ি ছেড়ে দূরে কারওই কোথাও যাওয়া হয় না। হ্যাঁ একবার অবশ্য তোমার ফুপার বড় বোনের মৃতদেহ গঙ্গায় সৎকারের জন্য হরিদ্বারে নেওয়া হয়েছিল। সেসময় আমাকেও তাদের সঙ্গে যেতে বলেছিল। গঙ্গার পবিত্র জলে আরও একবার স্নানের আকাঙ্ক্ষা থাকলেও সেটি মনে হয় হবার নয় বাছা। সেকথা আমি আমার ছেলে মানে তোমার ভাই শাইকারকে কতবার বলেছি, কিন্তু সে শুনেও শোনে না।’

ফুপুজান তাঁর নানা স্মৃতির পাঁচালি এলোমেলোভাবে বলেই চলেছেন, আর আমি ভাবছি, ’ফুপুজান, শেষবার আপনি আপনার ননাসের সৎকারের জন্য হরিদ্বার গিয়েছিলেন, আর এবার হয়ত যাবেন আপনার ভাইপোর মৃতদেহ সৎকারের জন্য, কেননা খাবারের এই পাহাড় গিলতে হলে আমার মৃত্যু প্রায় নিশ্চিত।’

শেষমেশ নিরুপায় হয়ে, ভাগ্যে যা আছে তাই হবে ভেবে নিয়ে আমি খাওয়া শুরু করলাম। পরোটা ছিঁড়ে এক দু টুকরো খেয়েছি কী খাইনি, ভাইয়ের বউ এক বাটি ফুটন্ত ঘি এনে সেমাইয়ের উপর উপুড় করে দিল। আমি অনবরত নিষেধ করেই যাচ্ছিলাম, কিন্তু কে শোনে কার কথা!

যেচেই আমি বিপদে নিজেকে সঁপে ছিলাম, এখন এর থেকে পরিত্রাণেরও কোনও পথ আমার সামনে খোলা ছিল না। কোনওভাবে পেটে একটা পরোটা চালান করেছি, কিন্তু সেমাইয়ের স্তূপ আমার পক্ষে কীভাবে হজম করা সম্ভব! বুদ্ধি পাকিয়েছিলাম, ফুপুজান তো রাতে চোখে তেমন দেখেন না,  সুযোগ বুঝে বাইরে খাবারগুলো ফেলে দিতে পারব। কিন্তু সেটাও সম্ভব না, কারণ ফুপাতো ভাইয়ের বউ এখন আমাদের সঙ্গে এসে বসেছে।

অগত্যা চড়ুইয়ের মতো সেমাই খুটে খাওয়া শুরু করলাম। ঠিক তখন ছোটভাইয়ের বউটা উঠে ভেতরে চলে গেল দেখে মনে মনে ভাগ্যকে ধন্যবাদ দিলাম। চারপাশে ভালো করে চোখ বুলিয়ে নিলাম, দেখলাম, আমার ঠিক পেছনে একটা মাটির চুলো। চট্ করে ভেবে নিলাম আপাতত সেমাইয়ের স্তূপ চালানের ওটাই মোক্ষম জায়গা, রাতে সুযোগ বুঝে বেরিয়ে ছাইয়ের তলায় গুঁজে দিলেই কেল্লা ফতে— কেউ জানবেই না। এক থাবা সেমাই নিয়ে ছুঁড়ে ফেলার জন্য যেই হাতটা তুলেছি, ভুড়ুক করে ভাইয়ের বউটা ফিরে এল, এবং আমাকে কিছু জিজ্ঞেস না করে দ্রুতহাতে আরও একটা পরোটা থালায় দিয়ে আমার পাশেই বসে পড়ল।

যাহোক কোনওভাবে থালার খাবার যতটা সম্ভব পেটে চালান করলাম, এবং ভাইয়ের বউটা খাবারের থালা সামনে থেকে সরিয়ে নিয়ে গেল। ততক্ষণে আমার প্রায় মরণদশা! হেঁটে বিছানায় যাওয়াটাও আমার জন্য ভীষণ কষ্টের হয়ে দাঁড়ায়। মনে হচ্ছিল পেটটা যে কোনও সময় বুঝি ফেটে যাবে, কোনওভাবে নিঃশ্বাস নিচ্ছিলাম।

উঠোনে আমার জন্য খাটিয়ায় বিছানা পাতা হয়েছিল, তাতে কোনওভাবে নিজেকে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে ফেললাম। শহরে নিজের বাড়ি ফিরে না গিয়ে এখানে আসবার চিন্তাটা যে মহা ভুল ছিল, সেটা ভেবে নিজেকে ধিক্কার দেওয়া শুরু করলাম। কপালে না জানি আরও কত অত্যাচার আছে! চিৎ হয়ে শুয়েও অস্বস্তি যাচ্ছিল না। এপাশ-ওপাশ করেও আরামবোধকে কাছে টানতে ব্যর্থ হলাম। আমার পেট ক্রমশ ফুলেফেঁপে উঠতে শুরু করে এবং প্রচণ্ড ব্যথায় কুঁকড়ে যাচ্ছিলাম। পুরো শরীর ঘামে প্রায় ভিজে উঠল।

যদিও পাশেই একটা হাত পাখা রাখা ছিল, কিন্তু সেটা টেনে নিয়ে নিজেকে বাতাস করার বিন্দুমাত্র শক্তি তখন আর আমাতে অবশিষ্ট ছিল না।

প্রায় আধাঘন্টার মতো একা একা ভোগান্তির পর, চিন্তা করলাম, যথেষ্ট হয়েছে! বাচ্চাদের কাউকে ডেকে হজমির বড়ি দিতে বলি। আর ঠিক তখন কফিনের শেষ পেরেকটা ঠুকে দেওয়ার জন্যেই বুঝি ভাইয়ের বউটা বিশাল এক গ্লাস ভর্তি দুধ নিয়ে সামনে এসে দাঁড়াল।

এই মেয়েটি যদি ফুপাতো ভাইয়ের বউ না হয়ে আমার বউ হত, তৎক্ষণাৎ ধোঁয়া ওঠা দুধের গ্লাসটা তার মুখবরাবর ছুড়ে মারতে দ্বিধা করতাম না। কিন্তু আমার অবস্থা এখন ফাঁদে পড়া ইঁদুরের মতো— আহা কী অসহায় আমি! দুধের গ্লাসটা নিতে বারবার অসম্মতি জানালাম, কিন্তু ভাইয়ের বউ নাছোড়বান্দা, গ্লাস হাতে ঠায় দাঁড়িয়ে রইল। একেই শরীরের অস্বস্তি, তার উপর ভূতের মতো ঘোমটা টানা বউটার দাঁড়িয়ে থাকা, সবটাই অসহ্য লাগছিল। বাধ্য হয়ে তার হাত থেকে গ্লাসটা নিয়ে খাটিয়ার এক পাশে রেখে বললাম, ‘ঠান্ডা হলে খেয়ে নেব।’

আমার কথাগুলো শোনামাত্রই বউটা ছুট্টে ঘরে চলে গেল, ফিরে এল একটা গাম্বু বাটি নিয়ে। গরম দুধ ঠান্ডার কসরত শুরু হলো তারপর। বাটি থেকে গ্লাসে, গ্লাস থেকে বাটিতে দুধ ঢেলে ঠান্ডার মহড়া বোবা হয়ে দেখা ছাড়া আর কী করার আছে ভেবে পেলাম না। বুঝতে পারছি ভাইয়ের বউটা আমার যত্ন-আত্তিতে কোনও ত্রুটি রাখতে চাইছিল না। বেচারি তো জানে না মনে মনে আমি তখন ত্রাহি মধুসূদন বলে হাহাকার করে চলেছি।

দুধ ঠান্ডা হয়ে আবার আমার হাতে এল, ভাইয়ের বউ যথারীতি সামনে দণ্ডায়মান। মনেপ্রাণে চাইছিলাম, যা না রে বাবা! কিন্তু শাশুড়ির আদেশ পালনে নিষ্ঠাবতী বউ দুধের গ্লাস খালি না হওয়া পর্যন্ত নড়বে না সেটা তার অনড় ভঙ্গিটি বুঝিয়ে দিল।

সেই মুহূর্তে আমার মনে হল দুধের বদলে কেউ যদি একটা বিষের বড়ি দিত আমি সোনামুখ করে সেটা টুপ করে গিলে নিতাম। পাকে পড়ে কয়েক চুমুক দিলাম, কিন্তু যেই আজদাহা গ্লাস, এত সহজে দুধ নিঃশেষ হওয়ার নয়। আমার পক্ষে আর সম্ভব না, বলে গ্লাসটা ভাইয়ের বউকে ফিরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করতেই সে কয়েক পা পিছিয়ে গ্লাস ফিরিয়ে নিতে অসম্মতি জানাল। নীরবেই বুঝিয়ে দিল, ভাইজান খালি গ্লাস ছাড়া আমি ঘরে ঢুকব না। রসো তবে। মাথায় চট করে আসা বুদ্ধিমতো আমি ভাইয়ের বউকে বললাম, ঠিক আছে বাকিটুকু পরে খেয়ে নেব, তুমি এখন এসো। বলে খাটিয়ার পায়ের কাছে গ্লাস রাখতে গিয়ে গ্লাস উল্টে দুধ মাটিতে গড়িয়ে পড়ল। আমি খালি গ্লাসটা তুলে তার হাতে দিলাম। এবার সে গ্লাস নিতে আপত্তি করল না।

গ্লাস পড়ার আওয়াজ শুনে ফুপুজান ভেতর থেকে হাঁক ছাড়লেন, ‘কী হয়েছে? শব্দটা কীসের?’

‘তেমন কিছু না, গ্লাস উল্টে সবটুকু দুধ পড়ে গেছে’— শাশুড়ির উদ্দেশ্যে মৃদু গলায় ভাইয়ের বউ জানাল।

‘তাতে কী! দুধের তো অভাব নেই। আরেক গ্লাস ভর্তি করে দুধ নিয়ে এসো।’ বলতে বলতে ফুপুজান ভেতর থেকে বাইরে এসে আমার পাশে বসে বললেন— ‘তোমার সঙ্গে তো বাছা কথাই হল না, এতটা পথ ভেঙে এসেছ, ক্লান্ত ছিলে তাই ভাবলাম কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে নাও। এখন খানিক গপ্পোসপ্পো করি এসো।’

আমার মনে হল ফুপুজান হরিদ্বারের গঙ্গাস্নানের ব্যবস্থা পাকাপোক্তে কোনও খামতি রাখতে নারাজ। আর সেটার জন্য আমার মৃত্যুটা নিশ্চিত হওয়া দরকার। দুধের গ্লাস এলে সে কার্য সমাধা হওয়াটা সময়ের ব্যাপার মাত্র।

ভাইয়ের বউটা কিছুক্ষণ পর ফিরে এসে ফুপুজানের কানে কানে ফিসফিসিয়ে কী জানি বলল। ‘সব দুধ দিয়ে দৈ বসিয়েছ? এখন আমার বাছাটা কী খাবে! এমনিতেই এখানে আসার কারণে গোটা দিনটাই না খেয়ে কেটেছে ছেলেটার। এখানে এসেই বা কী এমন খেয়েছে— দুটো মাত্র রুটি। বাছা আমার আবার কবে এই ফুপুর বাড়ি আসে না আসে। জলদি গিয়ে পাশের বাড়ি থেকে গ্লাস ভরে দুধ নিয়ে এসো।’

মিনতিভরা গলায় আমি কঁকিয়ে উঠলাম, ‘ফুপুজান, দুধ খেলে এখন আমার মরা ছাড়া গতি থাকবে না। আপনি আমার মরা মুখ দেখতে না চাইলে দয়া করে বউকে প্রতিবেশীর বাড়ি যেতে বারণ করুন।’

‘বালাই ষাট্! একি কথা বাছা। সারাদিন তোমার কিছু খাওয়া হয়নি। মরণ এত সস্তা নাকি। তুমি দীর্ঘায়ু হও বাবা। দশটা না পাঁচটা না একটা মাত্র ছেলে ভাইয়ের, বংশ রক্ষার বাতি। বংশের প্রদীপটা জ্বালিয়ে রেখো বাবা। অনেক তপস্যা আর প্রার্থনার ফল হিসেবে তোমার জন্ম। আমার তিন ভাইয়ের ঘরে জন্ম নেওয়া একমাত্র পুত্রসন্তান তুমি। লজ্জা পেলে চলে! এটা তোমারও বাড়ি বাছা।’ এক নাগাড়ে ফুপুজান বলেই চলেছেন।

ফুপুজানের কথা কান দিয়ে শুনলেও দুচোখ আমার আঠার মতো দরজার দিকেই আটকে ছিল। যে দরজা পেরিয়ে ছোট ভাইয়ের বউটা প্রতিবেশীর কাছ থেকে গ্লাস ভর্তি দুধ নিয়ে কখন ফিরে আসে সেই আতঙ্কে জমে আছি আমি। সৌভাগ্যের কথা ভাইয়ের বউ খালি গ্লাস নিয়ে ফিরে এল। প্রতিবেশীর বাছুরটা নাকি সবটা দুধ খেয়ে ফেলেছে।

ফুপুজান বেশ বিব্রত হয়ে আমার দিকে করুণভাবে তাকালেন। ‘কপাল! আমার সোনামানিককে এখন পেটে খিদে নিয়েই ঘুমোতে হবে। একদিনে চেহারা কেমন শুকিয়ে আমসি হয়ে গেছে দেখো! কেন যে গ্লাসের সব দুধ পড়ে গেল?’

তবে এ কথা বলতে হয়, সেটা ছিল এমন এক রাত, দুধের বাটি উল্টে যাবার প্রবাদীয় অঘটনটি আমার জন্য আশীর্বাদ হয়ে এসেছিল। আর সেজন্যে আমি গোপনে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলেছিলাম।


মূলগল্প: Spilt Milk (Bhua) by Nanak Singh. Translated from Punjabi by Nirupama Dutt