Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

বাংলার ভোট, ভোটের বাংলা: চতুর্থ বর্ষ, একাদশতম যাত্রা

স্টেশন মাস্টার

 

কবি বলিয়াছেন, “মানুষের হাতে তৈরি যেখানে যা যতদূর পোড়ে, ততদূর মৃত্যু মানুষের।” যত দিন যাইতেছে, রাজ্যে আসন্ন বিধানসভা নির্বাচনের প্রেক্ষিতে আপাত-সামান্য এই বাক্যটি প্রতিনিয়ত নূতন অর্থময়তায় প্রতিভাত হইয়া উঠিতেছে। এমন নহে যে, নির্বাচন একেবারে ঘাড়ের উপর আসিয়া পড়িয়াছে, এমনও নহে যে প্রাক্‌-নির্বাচনী উপদ্রবে রাজ্যবাসী ইতোমধ্যেই বিরক্তির শেষ সীমায়, তথাপি, নির্বাচন কমিশন ভোটের দিনক্ষণ ঘোষণা করিতে না-করিতেই নির্বাচকমণ্ডলীর একটি বড় অংশ আতঙ্কের প্রহর গণনা শুরু করিয়াছেন— ভোটের নামে যে তাণ্ডব গত বহু বৎসর ধরিয়া তাঁহারা প্রত্যক্ষ করিয়া আসিতেছেন, সেই অভিজ্ঞতার নিরিখেই, বলা বাহুল্য, এই দুঃস্বপ্নযাপন।

এবারের বিধানসভা নির্বাচনটি একাধিক কারণেই বিশেষ— শুধু পশ্চিমবঙ্গবাসীর পক্ষেই নহে, বস্তুত সারা দেশের পক্ষেই। ভারতীয় জনতা পার্টি এই নির্বাচনকে প্রায় ঘোষিতভাবেই ‘দ্য লাস্ট ফ্রন্টিয়ার’ ধরিয়া যুদ্ধে নামিয়াছে— বহুদিন হইতে এই রাজ্যটিকে কবজা করিবার জন্য তাহাদের আগ্রহ ও দুশ্চিন্তার অবধি নাই। পশ্চিমবঙ্গ জয়ের লক্ষ্যে তাহারা কতদূর মরিয়া, তাহা তাহাদের শীর্ষ নেতৃত্বের রাজ্যে ঘনঘন প্রচারে আসা-যাওয়া হইতেই সম্যক প্রতীয়মান। শুধু কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব নহে, স্বয়ং দেশের প্রধানমন্ত্রী একটি অঙ্গরাজ্যের ভোট লইয়া এতদূর অগ্রহী হইয়া উঠিয়াছেন যে, প্রায় প্রতিদিনই কারণে-অকারণে রবীন্দ্রনাথ-বিবেকানন্দকে টানিয়া আনিতেছেন— বুঝিতে অসুবিধা হইতেছে না যে, পশ্চিমবঙ্গের জন্য দুশ্চিন্তায় এবং রাজ্যবাসীর উন্নতিবিধায় তাঁহার আহার-নিদ্রা শিকায় উঠিয়াছে— দিল্লি হইতে খবর আসিতেছে, রাজ্যের প্রার্থীতালিকা তৈয়ারির বৈঠকেও প্রধানমন্ত্রী, কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও দলের সর্বভারতীয় সভাপতি আপনাপন মহিমায় উপস্থিত। স্মরণকালের মধ্যে আর কোনও রাজ্যের নির্বাচনে বিজেপি-র কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব এইভাবে আদাজল খাইয়া লাগিয়াছেন, এমন নজির নাই। ইহা পশ্চিমবঙ্গের পক্ষে কতখানি সম্মানের আর কতখানি উদ্বেগজনক, সে তর্কে প্রবেশ না-করিয়াও বলা যায়, ইহা অভূতপূর্ব।

অপরদিকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে তৃণমূল কংগ্রেসের পক্ষে এবারের নির্বাচন কার্যত অস্তিত্বরক্ষার প্রশ্ন। ইতোমধ্যেই দলবদলের কুনাট্যরঙ্গে একের পর এক বড়-মেজ-সেজ নেতামন্ত্রীরা বিজেপি-র কমলকূহকে প্রলুব্ধ হইয়া দল ছাড়িয়াছেন। দলে সম্মান নাই, জনসেবামূলক কার্য করিবার পরিবেশ নাই ইত্যাদি বলিলেই চলিত, কিন্তু শুধু সেইটুকুতেই সীমাবদ্ধ না-থাকিয়া তাঁহারা মুহূর্মুহূ দলীয় দুর্নীতির পর্দাফাঁস করিবার হুঙ্কার দিতেছেন। এত বৎসর এই পাহাড়প্রমাণ দুর্নীতির সহিত আপস করিয়া তাঁহারা দলে রহিলেন কী উপায়ে তাহা যেমন সঙ্গত প্রশ্ন, তেমনই, অকস্মাৎ এই বোধোদয়ের পশ্চাতে কেবলই বিবেকের তাড়না নাকি রৌপ্যমুদ্রার ঝনঝনাও কিয়ৎপরিমাণ বর্তমান, সে প্রশ্নও উঠিয়াছে। রবার্ট ব্রাউনিং-এর কাব্য অনুসরণে “ফর আ হ্যান্ডফুল অব সিলভার হি লেফট আস” বলিয়া তৃণমূল দায় সারিয়াছে বটে— তাহা প্রত্যাশিতই ছিল— কিন্তু ইহাতেই সব সমস্যার নিরসন হইতেছে না— বস্তুত গরু-কয়লা-পিতৃশ্বসা-ভাতুষ্পুত্র-সিন্ডিকেট-তোলাবাজি ইত্যাকার বিচিত্র ও বহুমুখী বিষয়ে অস্বস্তিকর প্রশ্নমালা ক্রমশ দীর্ঘায়িত হইতেছে। এমত পরিস্থিতিতে নিজের গড় রক্ষা করিতে পারিলে মমতা নিঃসন্দেহে সারা দেশে বিজেপি-বিরোধিতার কেন্দ্রীয় চরিত্র হিসাবে নিজেকে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করিতে পারিবেন, তাহাতে সংশয় নাই। ইতোমধ্যেই অখিলেশ-তেজস্বী-উদ্ধবেরা মমতার এই লড়াইয়ে যে প্রকারে আপনাপন দলের সমর্থন ব্যক্ত করিয়াছেন, তাহাতেই প্রমাণ— এই নির্বাচন বহিরঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের হইলেও, আদতে ইহার এক সুদূরপ্রসারী সর্বভারতীয় প্রাসঙ্গিকতা রহিয়াছে।

ইত্যবসরে বাম-কংগ্রেস জোটে ফুরফুরার পিরজাদার অংশগ্রহণ এই নির্বাচনে এক ভিন্নতর মাত্রা যোগ করিয়াছে। গত এক দশকে বাম ও কংগ্রেস ক্রমশ রাজ্য-রাজনীতি হইতে হারাইয়া যাইতে বসিয়াছিল, দুরবস্থা এতদূর গিয়াছিল যে, তাহাদের আসনপ্রাপ্তি বা ভোট-শতাংশের বৃদ্ধি লইয়া বাজি ধরিবারও লোক মিলিতেছিল না। আব্বাস সিদ্দিকি আসিয়া সেই রক্তহীনতার পালে পুনরায় বাতাস বহাইয়া দিয়াছেন। তিনি আসায় জোটের শক্তি কতদূর বাড়িবে তাহার উত্তর ভবিষ্যতের গর্ভে নিহিত, কিন্তু ধর্মনিরপেক্ষ জোটে ফুরফুরার অংশগ্রহণ কতদূর শাস্ত্রসম্মত তাহা লইয়া বঙ্গীয় বিদ্বৎসমাজ বহুদিন পর সবিস্তার আলোচনার সুযোগ পাইয়াছেন। যাঁহাদের বিরুদ্ধে কদাচ বামেদের ভোট দিবার অভিযোগ নাই, এমনকী তাঁহারাও সোশ্যাল মিডিয়ায় সবিস্তার মতামত দাখিল করিয়া জানাইতেছেন, এই ধর্মহানি, এই অশুচিতা, এই শাস্ত্রবিধিলঙ্ঘন বামেদের নিকট কেন কদাপি প্রত্যাশিত ছিল না।



ইদানিং নিয়ম হইয়াছে, বিজেপি-তে থাকিলে জ্বালানির ক্রমবর্ধমান মূল্য বা কৃষি-আন্দোলন লইয়া শঙ্কিত হওয়া চলিবে না, তৃণমূল-এ থাকিলে কয়লাপাচার বা অপরাপর দুর্নীতি লইয়া প্রশ্ন করা চলিবে না, বাম-এর সঙ্গে থাকিলে গত চতুর্ত্রিংশ বৎসরের উত্তরাধিকার লইয়া মাথা ঘামানো চলিবে না। ফল দাঁড়াইয়াছে, সাধারণ মনুষ্যের প্রশ্ন করিবার পরিসরটি ক্রমক্ষীয়মাণ— হয় বিশেষ কোনও দলের প্রতি মুণ্ডিতমস্তক আনুগত্য-প্রদর্শনে সামিল হও, নতুবা বিনাবাক্যব্যয়ে মরো।

 

কিন্তু, যে কোনও দেশের মতোই এই রাজ্যেও, বিদ্বৎসমাজ একটি অতি ক্ষীণকলেবর সত্তা— তাঁহাদিগের কথা তাঁহাদিগের আপনার পরিমণ্ডলের বাহিরে আর কেহই কানে নেয় না। বাকি যে নাদান, আনপঢ় জনগোষ্ঠী, যাঁহাদিগের হস্তে নির্বাচনী ফলাফলের মূল চাবিকাঠি, তার একটি অংশ আপন অস্তিত্বরক্ষার নিমিত্ত— ভয়ে হউক, ভালোবাসায় হউক— কোনও না-কোনও দলের প্রতি গলবস্ত্র, আর বাকি অংশ বস্তুতই বিভ্রান্ত, পথহারা। ইদানিং নিয়ম হইয়াছে, বিজেপি-তে থাকিলে জ্বালানির ক্রমবর্ধমান মূল্য বা কৃষি-আন্দোলন লইয়া শঙ্কিত হওয়া চলিবে না, তৃণমূল-এ থাকিলে কয়লাপাচার বা অপরাপর দুর্নীতি লইয়া প্রশ্ন করা চলিবে না, বাম-এর সঙ্গে থাকিলে গত চতুর্ত্রিংশ বৎসরের উত্তরাধিকার লইয়া মাথা ঘামানো চলিবে না। ফল দাঁড়াইয়াছে, সাধারণ মনুষ্যের প্রশ্ন করিবার পরিসরটি ক্রমক্ষীয়মাণ— হয় বিশেষ কোনও দলের প্রতি মুণ্ডিতমস্তক আনুগত্য-প্রদর্শনে সামিল হও, নতুবা বিনাবাক্যব্যয়ে মরো।

ফল আরও যাহা দাঁড়াইয়াছে— মাঝখান হইতে ভোটের মূল ইস্যুগুলি লইয়া কাহারও কথা বলিবার সময় নাই, সকলেই কেবল অপরকে দুষিয়া চলিয়াছে— যেন অপরকে ক্ষুদ্র প্রতিপন্ন করার মধ্যেই আপনাকে মহৎ প্রমাণ করিবার সুযোগ। কেহ দরিদ্রের ঘরে অন্ন গ্রহণ করিয়া আপনাকে জনদরদি প্রমাণ করিতেছেন, কেহ চার্টার্ড বিমানে উড়িয়া আসিয়া রাজ্যবাসীকে লভ জিহাদের তত্ত্ব শিখাইয়া যাইতেছেন, কেহ পিসি-ভাইপোকে উদ্দেশ করিয়া অবিমিশ্র গাল পাড়িতেছেন, কেহ বা বিপক্ষকে হোদলকুতকুত বলিয়া আত্মপ্রসাদ লাভ করিতেছেন। আর এইপ্রকারে নির্বাচনী গণতন্ত্রের আদ্যশ্রাদ্ধ সংঘটিত হইতেছে— যে পারস্পরিক সৌজন্য প্রদর্শন ও সুশ্রুষা গণতন্ত্রের প্রধানতম লক্ষণ, তাহার মর্মান্তিক অপমৃত্যু ঘটিতেছে।

এহেন পরিস্থিতিতে, চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম-এর মার্চ মাসের সংখ্যাটিতে আমরা আসন্ন নির্বাচনের কয়েকটি দিক আলাদা আলাদা করিয়া বুঝিবার প্রয়াস করিয়াছি। সত্যই কি এবারের নির্বাচনের অন্যতম প্রধান বিষয় আত্মপরিচয়ের রাজনীতি, নাকি তাহাকে স্বীয় উদ্দেশ্যসাধনের লক্ষ্যে উস্কাইয়া দিতেছে স্বার্থপর দলীয় রাজনীতি; সত্যই কি প্রশাসনে ও দলের বিভিন্ন স্তরে ক্রমবর্ধমান দুর্নীতি এবারের নির্বাচনের অন্যতম প্রধান উপজীব্য, নাকি অন্যতর কোনও উদ্দেশ্য হাসিল করিতে দুর্নীতির বিষয়টিকে অঙ্ক কষিয়া সামনে আনা হইতেছে; সত্যই কি শিক্ষা-স্বাস্থ্য-সুরক্ষা ও সামাজিক উন্নয়নের অন্যান্য সূচকগুলির এই নির্বাচনে প্রাসঙ্গিকতা নাই; সত্যই কি আপাত-ইস্যুহীনতার অন্তরালে এইবারের ভোটে রাজ্য এক ক্রান্তিমুহূর্তের সাক্ষী হইতে চলিয়াছে— ইত্যাদি অনেকানেক বিষয়কে তলাইয়া বুঝিতে চাওয়াই আমাদের উদ্দেশ্য। প্রচ্ছদকাহিনি বাংলার ভোট, ভোটের বাংলা-তে এই বিষয়গুলি লইয়া সবিস্তার আলোচনা করিয়াছেন শুভাশিস মৈত্র, প্রতিভা সরকার, বিষাণ বসু প্রতীক

এই প্রসঙ্গে উল্লেখ্য, ইতোমধ্যেই আমাদের সাপ্তাহিক সংখ্যাগুলিতে নির্বাচন-বিষক একাধিক নিবন্ধ আমরা প্রকাশ করিয়াছি, এবং আগামী দুই মাসাধিক কাল ধরিয়া আরও নানা নিবন্ধ প্রকাশ করিয়া চলিব। এই বিষয়ে সকল রচনা যাহাতে আপনারা একত্রে পড়িতে পারেন, সেই বিধায় যথাসময়ে একটি পৃথক বিভাগে আমরা সেগুলিকে সন্নিবেশিত করিবার ইচ্ছা রাখি।

প্রচ্ছদকাহিনি অর্থাৎ রিজার্ভড বগি ব্যতীত বিশেষ নিবন্ধ, প্রবন্ধ, গল্প, অণুগল্প, কবিতা, ধারাবাহিক, অন্যগদ্য, ফটোফিচার, অনুবাদ সাহিত্য সহ সকল নিয়মিত বিভাগ এবং স্টিম ইঞ্জিন, সবুজ স্লিপার, হুইলার্স স্টল, ডিসটান্ট সিগনাল এবং ভালো খবর-এর ন্যায় সকল বিশেষ বিভাগগুলিও যথাযথ প্রকাশিত হইল।

ভালো থাকিবেন। আপনাদের মতামত প্রার্থনীয়।