অরুণপ্রকাশ রায়
পূর্ব প্রকাশিতের পর
চতুর্থ পর্ব
আমার দিল্লির বন্ধু সুমন মিশ্রর সঙ্গে যখনই দেখা হয়, মনে হয়, গঙ্গা যমুনি তেহজিব ব্যাপারটার যদি একটা হিউম্যান ফর্ম থাকত, মানে, ধরা যাক সেটা যদি মানুষের চেহারায় সামনে এসে দাঁড়াত, তবে তাকে দেখতে হত অবিকল সুমনের মতো। একগাল হালকা দাড়ি, কাঁধে ঝোলা— সুমন একবার আমার সঙ্গে গুরগাওঁ-এর এক হোটেলে দেখা করতে এসেছিল। সেটা ২০১৯-এর শেষদিক। আড্ডার ঝোঁকে কখন যে মাঝরাত্তির পার হয়ে গিয়েছিল, হুঁশই ছিল না কারও। পরদিন সকালে ফোন এল, “স্যার, হামারি সেলফি রহ্ গয়ি হ্যায়”। সত্যিই তো! আজকালকার দিনে সেলফি বিনা মিটিং, ভাবা যায়? সুমন ভারী চমৎকার ছেলে— প্রাণবন্ত, হাসিখুশি। ‘গুলদস্তা এ কাওয়ালি’ নামে একটা চমৎকার বই লিখেছে, হিন্দিতে। আমার মতে, এই বইখানা রেগুলা বুখার্ড কুরেশি-র বিখ্যাত ‘সুফি মিউজিক অফ ইন্ডিয়া অ্যান্ড পাকিস্তান’-এর চেয়ে কোনও অংশে কম নয়। সুমনের বইয়ে উল্লেখ আছে কাওয়ালির গোটা কুড়ি প্রকারের। তার কয়েকটার সঙ্গে আপনাদের পরিচয় করিয়ে দেওয়ার লোভ সামলাতে পারছি না।
হাম্দ–কাওয়ালির শুরুতে ঈশ্বর স্তুতি—
বেদম শাহ ওয়ার্সি (১৮৭৬-১৯৩৬)
তা-কেয়ামত যুঁহি জারি রহে পয়মানা তারা রহে ম্যায়খানা তেরা।
তেরে দরওয়াজে পে হাজির হ্যায় তেরে দ্বার কা ফকির এ আমিরোঁ কে আমির
এই হাম্দ-এর কোনও রেকর্ডিং পেলাম না, তাই অন্য একটি উদাহরণ দিলাম।
নাত
হজরত মোহাম্মদের উদ্দেশ্যে ও প্রশংসায় গাওয়া এই নাতটি— “বারো ঘি কে দিয়ে না ভৈলে আমনা কে লালনা” ইউটিউবে টাইপ করলে ফরিদসাব, বাহাউদ্দিন সাব, জাফর বদায়ুনি সাব অবধি সকলের রেকর্ডিং পাওয়া যাবে। বড়ই চমৎকার এই নাত-শরিফ।
কাউল
খুসরোর ‘মন কুনতো মৌলা’ সব শিল্পীই গেয়েছেন, তবে নীচের ক্লিপটি আমার মতে সেরা।
মানকবাত, রং, সেহরা, গাগর, সাওন, সালাম, হোলি, চাদর, মুবারক, গুসল, কমলি, জোড়া, সন্দল, ফুল, বসন্ত, ভজন— উদাহরণ দিতে বসলে আস্ত একখানা বই হয়ে যাবে। তবে কোনও উৎসাহী পাঠক যদি বিস্তারে পড়তে চান, নিচের ছবিতে ক্লিক করতে পারেন।
আজ সকালে লিখতে বসার আগে হোয়াটস্যাপ-এ ফোন করেছিলাম ফরিদসাবকে। গত দু হপ্তা শরীর ভাল ছিল না ওঁর। কয়েকদিন হাসপাতালে কাটিয়ে ফিরে এসে পরশু থেকে লাহোর-এ লাগাতার প্রোগ্রাম করে চলেছেন, অক্লান্তভাবে। যেহেতু ভেবে রেখেছি এই সংখ্যায় সুভান নিজামির কথা লিখব, তাই ভাবলাম, ফরিদসাব-কে একবার জিগ্যেস করে দেখি, ওঁর সম্পর্কে নতুন কিছু তথ্য পাই কি না। ফোনে কুশল জিজ্ঞাসার পর কথায় কথায় বললাম, “সুভান নিজামিকে চেনেন?” চমকে উঠলেন একটু, বললেন, “বহত হি প্যায়ারা বাচ্চা, আমার দূরসম্পর্কের জেঠতুতো ভাইয়ের ছেলে।” শুনে আমারই অবাক হওয়ার পালা। এতদিন ধরে সুভানকে চিনি, এতদিন ধরে ফরিদসাবের সঙ্গ করছি, কিন্তু এই তথ্যটা জানা ছিল না!
যা হোক, এবার আসি সুভান নিজামির গল্পে। ফরিদসাবের জেঠামশাই ইফতিকার আহমেদ নিজামি পরিবারের সবচেয়ে বড় ছেলে ছিলেন। মুনশি রাজিউদ্দিন (ফরিদসাবের বাবা), বাহাউদ্দিন ও মনজুর নিয়াজির সঙ্গে মিলে ইফতিকার সাহেব ‘বড়ি পার্টি’ শুরু করেছিলেন। কালে কালে সেই পার্টির সদস্যদের সংখ্যা ৫০ পেরিয়ে গেলে তা চারভাগে ভাগ হয়ে যায়। ইফতিকার সাব মারা যান, সম্ভবত ১৯৭২ বা ৭৩-এ। সুভান-এর বাবা আফাক আহমেদ নিজামির এন্তেকাল হয় ১৯৯৯ সালে। মাত্র ১৮ বছর বয়সে সুভান নিজের কাওয়ালির পার্টি শুরু করে দ্যায়। ‘পার্টি’ শব্দটা হয়তো আমাদের অনভ্যস্ত কানে লাগলেও লাগতে পারে, কিন্তু পুরনো অ্যালবাম বা ক্যাসেটের প্রচ্ছদে আজও পাওয়া যায়, ‘নুসরাত ফতেহ্ আলি খান কাওয়াল অ্যান্ড পার্টি’।
সুভান অত্যন্ত বিনয়ী, কথা বলে বোঝার জো নেই যে, মাত্র ৪০ বছর বয়সেই তিনি ইউরোপ ও অন্যান্য মহাদেশে অগুনতি মাস্টারক্লাস করিয়েছেন কাওয়ালির ওপরে, দেশে-বিদেশে, বিশেষত ফরাসি মুলুকে হাজার-হাজার গুণমুগ্ধ ছাত্র ছড়িয়ে রয়েছে তাঁর। এই প্রসঙ্গে একটা অদ্ভুত পরিসংখ্যান মনে পড়ে গেল। কোথাও একটা পড়েছিলাম বছর পাঁচেক আগে, ফরাসিরা আশ্চর্য কাওয়ালি-প্রিয় জাতি— ভারত বা পাকিস্তানে যত মানুষ কাওয়ালি শোনেন, ফ্রান্সে নাকি কাওয়ালির শ্রোতা তার তুলনায় অনেক বেশি!
সে যা-ই হোক, এই সুভানকে প্রচারের আলোয় নিয়ে আসার পেছনে সাবিনে মাহমুদের সাহায্যের হাত অনস্বীকার্য। সাবিনের সঙ্গে আমার একসময় বেশ আলাপ ছিল। অসম্ভব খোলামেলা মনের মেয়ে, করাচিতে T2F বা ‘টি সেকেন্ড ফ্লোর’ নামে একটা ইভেন্ট স্পেস ও ক্যাফে চালাত, নিতান্তই শখে আর ভালবাসায়। ২০১৫-র এপ্রিলে, বালোচিস্তানের নিরুদ্দেশ হয়ে যাওয়া মানুষদের বিষয়ে একটা আলোচনায় বক্তব্য রাখা শেষ করে, ক্যাফের ঝাঁপ বন্ধ করে যখন নিজের গাড়িতে বসতে যাচ্ছিল সাবিনে, অজ্ঞাতপরিচয় আততায়ীর গুলি তাকে এফোঁড়-ওফোঁড় করে দেয়। বেচারি আততায়ী। সাবিনের শরীরে দানা ভরে দেওয়ার সময় সে যদি জানত, সুফি সংস্কৃতি ও মুক্তমনা মানসিকতার কতটা ক্ষতি করতে যাচ্ছে সে। আজও T2F-এর দরজা সবসময় খোলা তাদের জন্য, যারা উঠতি প্রতিভাদের তুলে ধরতে চায় এক বৃহত্তর দর্শক ও শ্রোতৃমণ্ডলীর সামনে। সাবিনে এবং T2F-এর কাজ সম্পর্কে জানতে হলে নিচের ছবি দুটিতে ক্লিক করে নেবেন।
কথা ছিল, T2F-এর মেঝেয় জুট কার্পেটে পা ছড়িয়ে বসে মাটির ভাঁড়ে চা খেতে খেতে আড্ডা দেব সাবিনের সঙ্গে। আমাকে দেওয়া সে কথা সাবিনে রাখতে পারেনি।
হয়তো ভবিষ্যতে কোনওদিন সাবিনের মায়ের সঙ্গে দেখা করে, সুভানের বাড়ির দরজায় দস্তক দেব কলিং বেল না-বাজিয়ে। সুভানের বৌ দিল্লির মেয়ে, বিরিয়ানির হাত দুর্দান্ত। ওদের হেঁসেলে কোর্মা রাঁধার দায়িত্ব নিয়ে নেব নিজে থেকেই— দু কিলো মাংস কিনে নিয়ে যাব, মিষ্টির বাক্সের বদলে। হেঁসেল থেকেই শুনতে পাব সুভান তানপুরা মেলাচ্ছে, তারপর মাংস দমে চড়িয়ে দিয়ে বসতে না-বসতেই শুরু হয়ে যাবে একের পর এক গান। গানের ফাঁকে-ফাঁকে হয়তো সাবিনের প্রসঙ্গ আসবে, একটু অমনিই একটু উদাস হয়ে যাবে সুভান। নিজের গান থামিয়ে হয়তো আশা ভোঁসলের গান ধরবে হঠাৎই। “এ কী, এর মধ্যে আবার হঠাৎ আশা জি-র গান কেন?” আমি অবাক হয়ে প্রশ্ন করলে উত্তর দেবে, “কী জানি! মনখারাপ হয়ে গেলে কখনও-কখনও আমার আশাজির গান ভাল লাগে…”
এ-দেশে আড্ডা আর আড্ডার প্ল্যানিং এখনও ভিসা-ফ্রি। তাই ইদানিং মাঝেমধ্যেই ফোনে আড্ডা হয়। সেরকম এক আড্ডাতেই সুভান একদিন জানাল, কীভাবে যেন ও আবিষ্কার করেছিল যে, ওর গলা একদম ওর ঠাকুরদার মতো। প্রচুর চেষ্টাচরিত্র করে করাচির লুৎফুল্লাহ্ খান ও জাহির আলম কিদোয়াই (জাহিরসাবকে আমি সামান্য চিনি, খুবই পণ্ডিত ও রসিক মানুষ)— এই দুজনের আর্কাইভ থেকে কিছু দুষ্প্রাপ্য রেকর্ডিং পেয়ে যায় ও, ঠাকুরদার গানের। ইফতিকারসাবের একটা ঠুমরির ক্লিপ রাখলাম, আমার ভাল লাগা গানের অন্যতম, স্পুল ঘষটানোর ঘটঘট আওয়াজ সমেত।
একটু আগে মাংস কেনার কথা বলছিলাম। এখানে তা নিয়ে একটু অপ্রাসঙ্গিক একটা ঘটনার উল্লেখ করি। এই মাংস কেনাটা আমার একটা ‘লাকি চার্ম’ গোছের ব্যাপার। বছরকয়েক আগে তুরস্কের কোনিয়া-তে পৌঁছে গিয়েছিলাম ইস্তানবুল হয়ে, দিনসাতেকের জন্যে। উঠেছিলাম মৌলানা রুমি-র মসোলিয়ামের খুব কাছেই একটা ছোটমতো খানকাহ্তে। তা সেখানে উজের ওজিয়ারত তার নিজের সব কাজকম্ম শিকেয় তুলে আমাকে নিয়ে টো টো করে ঘুরে বেড়াচ্ছে— নিয়ে যাচ্ছে যেখানে যেতে চাইছি সেখানেই। টার্কিশ কফি, সিঙ্গল অরিজিন চকলেট, পিজ্জা— যা-ই খাচ্ছি, কিছুরই দাম দিতে দিচ্ছে না। আমি শেষকালে রেগেমেগে এক লোকাল ‘কসাব’-এর দোকান থেকে দু কিলো হাড়হীন বড়া গোশ্ত (সে দোকানদার বেচারি কিছুতেই হিন্দি মুসাফিরকে কাউ মিট বেচবে না), সঙ্গে প্লাস্টিকের ছোট-ছোট পুঁটুলিতে বাঁধা রংবেরঙের মশলা, এক ক্যান টম্যাটো পেস্ট আর এক প্যাকেট আইরন (ঘোলের তুর্কি সংস্করণ) কিনে তা দিয়ে এমন কোর্মা রেঁধেছিলাম যে, উজিরের বন্ধু গোটাকয় হোয়ারলিং দরবেশ পাউরুটি দিয়ে রান্নার পাত্রের কোণায় লেগে থাকা ঝোলের শেষ বিন্দু পর্যন্ত চেঁছেপুঁছে সাফ করে দিয়েছিল। তাদের মতে, আমার রান্না নাকি রুমির প্রবাদপ্রতিম শেফ আতিশ বাজ-এর মতো। বুঝুন অবস্থা! যা হোক, সৌভাগ্য হয়েছিল সেদিনই, আতিশ বাজের কবরে গোটাকয়েক গোলাপফুল রেখে আসার। কখনও সময় পেলে আতিশ বাজ সম্পর্কে অনেক গল্পও শোনাব আপনাদের। আর খুব ইচ্ছে আছে, করাচিতে একবার পৌঁছে কোনওক্রমে একটা রান্নাঘর ম্যানেজ করার। সেটা পেয়ে গেলে, আমাকে আর ঠেকায় কে? কাওয়াল বাচ্চোঁ কা ঘরানার অধুনালুপ্ত নানা মণিমুক্তোর সন্ধান অবশ্যই পেয়ে যাব।
সে যা-ই হোক, ফিরে আসি সুভানের গল্পে। নীচে একটা ক্লিপ রাখলাম আমির খুসরোর বিখ্যাত ফার্সি কালাম ‘খবরম রাসিদা ইমসাব’-এর।
আর বলি ‘দ্য ড্রিম জার্নি’ নামে একটি ইউটিউব চ্যানেলের কথা। গত কয়েকবছরের অক্লান্ত পরিশ্রমের ফল এটি, আরিফ আলি খান, আসিফ হাসনাইন, মাহেরা ওমর, মুসাব বিন নূর প্রমুখরা মিলে পাকিস্তানের প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে প্রতিটি শহর ঘুরে লাইভ মেহফিলের যে সিরিজটি বানিয়েছেন, তার জবাব নেই। আরিফসাব কানাডায় থাকেন, ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের অথরিটি বললেও কম বলা হয়। যখন ইসলামাবাদে আসেন, তখন বন্ধুরা মিলে দু পাত্তর স্কচের সঙ্গে বেসুরে কিশোরকুমারের গান গেয়ে থাকেন। প্রায় সাত ফুট লম্বা আসিফ হাসনাইন তাঁর ব্যাঙ্ককি বান্ধবীর সঙ্গে এক সুদূর দ্বীপে লিভ-ইন করেন (ফরিদসাব একবার বলেছিলেন, “আরে আসিফ তো উসকি গার্লফ্রেন্ড কো লে কর কিসি জাজিরে মে যা কে বৈঠা হুয়া হ্যায় ইন দিনো”)। ‘দ্য ড্রিম জার্নি’-তে ফরিদসাব ও ওঁর পরিবারের সকলের অসাধারণ কিছু সুফি কালাম, গজল ও বন্দিশের রেকর্ডিং রয়েছে। আমার উদ্দেশ্য অবশ্য আলাদা, কেবল তক্কে-তক্কে আছি, সুযোগ পেলেই টুক করে ওয়াঘা সীমান্ত টপকে চলে যাব লাহোরে, তারপর বাবা ফরিদের দরগা, লাহোর থেকে দুশো কিলোমিটার দূরে— যেখানে সন্ধে হলে কাওয়ালরা সমস্বরে গেয়ে ওঠেন “নাগরি বসে শালা, যিথে মেরে বাবা দা ডেরা”। তারপর সে আরও অনেক প্ল্যান। করাচিতে ফরিদসাবের বাড়িতে ঝোলাটা নামিয়ে চলে যাব সাবিনের মায়ের সঙ্গে দেখা করতে, আর সেদিনের অভিজ্ঞতাটা শুনতে, যেদিন মেয়ের পাশাপাশি আততায়ীর একটা বুলেট ওঁর শরীরেও ঢুকেছিল। সেটা এখনও ওঁর শরীরেই রয়ে গিয়েছে, সম্ভবত মেয়ের স্মৃতিতে। ২০১৫-র এপ্রিল।
‘দ্য ড্রিম জার্নি’ থেকে গোটাকতক দুর্দান্ত ক্লিপ শেয়ার করলাম নীচে। সময়সুযোগ মতো ঘর অন্ধকার করে, একটু স্পিকার লাগিয়ে, ভলিউম জোরে করে শোনার জন্য। মেহফিল এ সমা, তকরার, ঢোলক ও জোরদার তালি-সমেত কাওয়ালি মিনমিন করে শোনার বস্তু একেবারেই নয়।
(ক্রমশ)