জিনাত রেহেনা ইসলাম
প্রাবন্ধিক, সমাজকর্মী
দেড়শো বছর আগে দেশে প্রথম মেয়েদের ফাঁসির কালকুঠুরি তৈরি হয়। মথুরায়। তখন কি কেউ জানত স্বাধীন ভারতে এই এই রাজ্যটিই একদিন আসলে মেয়েদের বধ্যভূমিতে পরিণত হবে! মেয়েরা বেশি অত্যাচারিত হচ্ছে এমনটা শুধু নয়। মৃতদেহের স্বাভাবিক মর্যাদা ও সম্মানটুকুও পেতে ব্যর্থ হচ্ছে পরিবার। সাম্প্রতিক কালের তিনটি ঘটনা নিয়ে চর্চা বেড়েছে চূড়ান্ত। প্রশাসনিক ব্যর্থতা ও পুলিশের ভূমিকা অবাক করেছে মানুষকে। এবং সত্য গোপনের মরিয়া প্রয়াস সামগ্রিকভাবে ভেঙে পড়া প্রশাসন তথা বিচারব্যবস্থার দিকেই আঙুল তুলেছে। হাথরাসের মেয়ের মৃতদেহ পুড়িয়ে দেওয়া এবং ক্ষমতার অপব্যবহার করে পরিবারকে হেনস্থা করা থেকে শুরু করে মাঠে পড়ে থাকা তিন নাবালিকার দেহ উদ্ধার। দুইজন মৃত। একজন গুরুতর অবস্থায় হাসপাতালে পৌঁছায়। রেপ এবং বিষক্রিয়া নিয়ে তরজা চলতেই থাকে।
নাবালিকার পক্ষে পকসো আইনে বিচারের অধিকার এক ভাগ্যের পরিহাসে পরিণত হয়েছে। ছলে-বলে-কৌশলে নির্যাতনকারী বিচার থেকে নিষ্কৃতি পেয়ে যাচ্ছে। যদিও এই আইনের চূড়ান্ত অপব্যাখার (ত্বকের সঙ্গে সরাসরি ত্বকের স্পর্শ না ঘটলে পকসো অভিযোগ আনা যাবে না) জন্য বোম্বে হাইকোর্টের বিচারপতি পুষ্পা গনেরিওয়ালা হতে পারলেন না স্থায়ী বিচারপতি। আবার আট ও সতেরো নম্বর ধারাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে ‘হাত ধরলেই পকসো নয়’ বলে নিদান দিয়েছিল বোম্বে হাইকোর্ট। যদিও শেষরক্ষা হয়নি। অভিযুক্ত জামিন পায়নি। এনসিআরবি-র ২০১৮ থেকে স্পষ্ট ভিক্টিমের কেস নথিভুক্তকরণ বাড়লেও সাজাপ্রাপ্তের সংখ্যা স্থির আছে।
প্রশ্ন এখানেই এসে থমকে যায়। পকসোর মত শক্তিশালী আইন থাকা সত্ত্বেও শিশুরা কেন নির্যাতনের শিকার হওয়া থেকে রেহাই পাচ্ছে না। এখানে দুটি বিষয় খুব গুরুত্বপূর্ণ। অত্যাচারিত ও অত্যাচারী এই দুই পরিবারের আর্থিক ও সামাজিক অবস্থান। অভিযোগের বয়ান। পুলিশের ভূমিকা। আদালতের ভূমিকা। আসলে বিচার পাওয়ার জন্য কয়েকটি আইনি ও প্রশাসনিক ধাপ রয়েছে। সেখানে একটির সঙ্গে আরেকটি গভীরভাবে জড়িত। একাধিক শিশু নির্যাতনের কেসে দেখা গেছে, দুই পরিবার আর্থিক লেনদেনের মাধ্যমে মীমাংসা করে ফেলেছে দ্রুত। মেয়ের পরিবার মেয়ের সম্মানহানি ও জানাজানি থেকে রেহাই পেতে চেয়েছে। আর ছেলেপক্ষ বাঁচতে চেয়েছে। সেখানে নির্যাতনের রকমফের অনুযায়ী ক্ষতিপূরণের বিষয়টি সাত নম্বর (৪,৫) ধারা মেনে হয় না। স্পেশাল কোর্টের অর্ডার মেনে ৩০ দিনের মধ্যে তা ভিক্টিমকে দেওয়াও হয় না। কোর্টের বাইরে এমন সমঝোতায় অনেক ক্ষেত্রে পুলিশের ভূমিকা প্রকাশ্যে এসে পড়েছে। যদিও তথ্য বলছে ভিক্টিম হস্টাইল হয়েছে ৬৭.৫ শতাংশ এবং অভিযুক্তের বিরুদ্ধে টেস্টিফাইড হয়েছে ২৬.৭ শতাংশ।
সামাজিকভাবে মেয়েদের সঙ্গে কিছু ঘটলে তা গোপন করার মানসিকতা লালন করা হয়ে থাকে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বাচ্চার বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে শোনা হয় সব না। আবার শুনলেও পদক্ষেপ দেরিতে করা হয়। বিচার চাওয়ার চেয়ে সামাজিকভাবে কাঠগড়ায় মেয়ের পরিবার হিসেবে দাঁড়াতে ভয় পায়। কেন না অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বিচারপদ্ধতিতেই বাচ্চা মেয়ের ডিগনিটি আর অটোনমির উপর খাঁড়া ঝুলিয়ে দেওয়া হয়। আদালত কখনওই ওম্যান ফ্রেন্ডলি হয়ে ওঠে না এই বিশেষ নির্যাতনের ক্ষেত্রে। তাই পরিবারের সচেতনতা ও বিচার পাওয়ার আর্জির উপর নির্ভর করে জাস্টিস। সেটা যাতে ডিলেইড হলেও ডিনায়েড না হয় সেই ধৈর্যেরও পরীক্ষা চলে একরকম। কিন্তু পুনর্বাসন ও সামাজিক একীকরণের কাজটা অধরা থেকে যায় তার অনেকগুলি কারণ আছে। দিল্লির একটা স্টাডিতে দেখা গেছে— ৪২ শতাংশ নির্যাতিত বাচ্চা বিদ্যালয় থেকে ড্রপ আউট হয়েছে। ৫০ শতাংশ অন্য অসুখে ভুগতে শুরু করেছে। ক্ষতিপূরণ ৪-৭ লক্ষের বদলে জুটেছে মাত্র ৫০ হাজার। তাও ১০০ জনের মধ্যে একজন। মোট ৮৫ শতাংশ ভিক্টিম ক্ষতিপূরণ পায়নি। ৩৮ শতাংশ পায়নি লিগ্যাল এইড।
উত্তরপ্রদেশ শিশু নির্যাতনের আঁতুড়ঘর। দেশের মোট নথিভুক্ত কেসের ১৫ শতাংশ কেস এই রাজ্যের। কিন্তু এর ফলাফল চূড়ান্তভাবে ভয়ানক। বাচ্চার ব্রেন ও নার্ভাস সিস্টেম বিকল হওয়া থেকে নানারকম হেলথ রিস্ক বাসা বাঁধে দেহে। ব্যক্তিগত জীবনে নানা চ্যালেঞ্জ এসে পড়ে। শিক্ষা ও উপার্জনের ক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়তে দেখা যায়। মেন্টাল হেলথ বিঘ্নিত ও নেশাগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনা থেকে যায়। সম্পর্ক নির্মাণের ক্ষেত্রেও ফ্যামিলি ডিসফাংসন ও বিচ্ছেদের সম্ভাবনা বাড়ে। সামাজিক ক্ষেত্রে নির্যাতনের শিকারদের মধ্যে ঘটনা পরবর্তী দ্বন্দ্ব ও নিরাপত্তার অভাববোধ এক জটিল পরিস্থিতির সৃষ্টি করে। হু-এর পরামর্শ মত একটি ইলেক্ট্রনিক ইনফর্মেশন সিস্টেমের মধ্যে দিয়ে নির্যাতনের শিকারের সাইন্টিফিক ডেটা সংরক্ষিত থাকলে তাকে এসবের ঝুঁকি থেকে বাঁচানো সহজ হত।
শাস্তি সবসময় সংশোধনের কথা বলে। তাই অভিযুক্তের শাস্তি খুব জরুরি। শিশু নির্যাতকের বিচারের মধ্যে দিয়ে সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি বদলের কাজ শুরু হয়। শিশুর স্বর নেই। তাই তার পক্ষে আইনের রক্ষাকবচ পকসো। সেটার যথাযথ প্রয়োগের জন্য দরকার এক স্বচ্ছ প্রশাসন ও গণতান্ত্রিক পরিবেশ। বাচ্চাটি নির্যাতিত হয়ে সুরক্ষা পেতে ব্যর্থ হলেও তার পুনর্বাসন ও ক্ষতিপুরণের অধিকার থেকে দ্বিতীয়বার যেন সে বঞ্চিত না হয় সেইটি নিশ্চিত করা পারিবারিক, সামাজিক ও বিচারবিভাগীয় দায়িত্ব। এবং পকসো নিয়ে যাবতীয় অপব্যাখ্যা ও শিথিলতা অপরাধযোগ্য বলে বিবেচিত হওয়া জরুরি। জীবন থাকলে শৈশব থাকবেই। তাই শৈশবের দিন সোনালি করে তোলার দায় সরকার ও প্রশাসনের। সেজন্যই নির্যাতকের প্রতি কড়া দৃষ্টিই নয়, ভিক্টিমের প্রতিটি পদক্ষেপে সুবিচার ও ন্যায়ের শর্তপূরণে সতর্ক দৃষ্টি দরকার। পরিবারের ঘাড়ে এই দায় তুলে দিলে হবে না। আইনের দরজায় কড়া নেড়ে পরিবারের ব্যর্থ হওয়ার অভিজ্ঞতায় রাষ্ট্রের দায়িত্ব থেকেই যায়। সভ্য সমাজ সুশাসন দাবি করে। সুশাসন আইনি অধিকার সুনিশ্চিত করে চটজলদি। সিস্টেমের বেড়া ভাঙার দায় পরিবারের নয়। সরকারের। তাই বিচারের দীর্ঘসূত্রিতা বা জটিলতার অজুহাতে ভিক্টিমের বিচারের অপেক্ষা করা নির্যাতকের হাতকেই শক্ত করে। তাই পকসো আইনের সুবিচার না পাওয়ার সমাজে দ্বিমুখী ক্ষতির সম্ভাবনা। একদিকে অপরাধীর সাহস সঞ্চয় ও অন্যদিকে শিশুর মন ও মস্তিষ্কের ঝুঁকি বাড়তে থাকা। টুমরোজ সিটিজেনদের সবুজ মনটাকে বাঁচিয়ে না রাখতে পারা এক ক্ষমাহীন সামাজিক অপরাধ।