Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

হীরালাল সেন ও বাঙালির আত্মম্ভরিতা

সত্যব্রত ঘোষ

 


প্রাবন্ধিক, চলচ্চিত্র সমালোচক

 

 

 

ইতিহাসবিমুখ বাঙালি যে হীরালাল সেন সংক্রান্ত কোনও প্রামাণ্য নথি রক্ষা করেনি, তাতে অবাক হবার কিছু নেই। তবে ইতিহাস থেকে তাঁকে মুছে দেওয়ার জন্যে চলচ্চিত্র বিতরক ও প্রদর্শক জামসেদজী ফ্রামজী ম্যাডানের ষড়যন্ত্রে স্বয়ং তাঁর ভাই মতিলাল সেন শরিক ছিলেন, এই তথ্য ও তত্ত্ব কিঞ্চিৎ চমকপ্রদ বইকি!

অরুণ রায় পরিচালিত সম্প্রতি মুক্তিপ্রাপ্ত ‘হীরালাল’-কে নিছক একটি কাহিনিচিত্র হিসেবে যদি দেখা যেত, তাহলে মনে সম্ভবত খেদ বা চমক কিছুই থাকত না। নায়কের ব্যতিক্রমী কিছু হয়ে ওঠার প্রয়াস— তার ক্রমিক সাফল্য— পারিবারিক অসন্তোষ— বন্ধুত্ব ও বিচ্ছেদ— দ্বিতীয় নারী— প্রতিদ্বন্দ্বীর ষড়যন্ত্র ইত্যাদি ইত্যাদি। অর্থাৎ, প্রচলিত উপাদানগুলির সাহায্যে সিরিয়ালপ্রেমী রুচিসম্পন্ন বাঙালির পছন্দসই আরেকটি ছবি হয়েই উঠতে পারত ‘হীরালাল’। কিন্তু হীরালাল সেন-এর জীবনীচিত্র হয়ে ওঠার দাবি নিয়ে যখন তা দর্শকদের সামনে উন্মোচিত, তখন তা নিয়ে কিছু কথা বলবার অবকাশ রয়েই যায়।

ভারতীয় চলচ্চিত্রের ইতিহাসটাই হয়তো অন্যভাবে লেখা হত, যদি না আজ থেকে ১০৪ বছর আগে, ১৯১৭ সালে এই শহর কলকাতায় মর্মান্তিক এক অগ্নিকাণ্ডে দাউদাউ করে জ্বলে যেত ভারতীয় চলচ্চিত্রের এক পথিকৃতের সারা জীবনের সাধনা। সেই ক্ষতি কেন অপূরণীয়, তা বুঝতে হলে চলচ্চিত্রের সচল হয়ে ওঠার বিবর্তনটির দিকে আর একবার নজর দেওয়া প্রয়োজন।

চলচ্চিত্র প্রযুক্তি গড়ে উঠেছিল ফিল্ম নেগেটিভের ব্যবহার করে। সেই নেগেটিভ থেকেই তৈরি হয়েছিল ফিল্ম পজিটিভের রাশি রাশি রোল। ক্যামেরায় ছবি তোলার পর রসায়নাগারে পরিস্ফুটনের পর যে পরিমাণ নেগেটিভ ও পজিটিভ প্রিন্ট জমা হয়, তা সংরক্ষণের জন্য বিশাল স্থানের প্রয়োজন ছিল। এবং সেই গুদামগুলিতে মালিকানা যাদের, জনসংখ্যার নিরন্তর বিস্ফোরণ এবং নগরায়নের বিস্তৃতির কারণে তাদের ব্যবসায়িক অগ্রাধিকার পাল্টাতে থাকে। তাই ম্যাডান-এর ষড়যন্ত্র ব্যতিরেকেও স্রেফ অবহেলা আর অযত্নে সিনেমার প্রিন্টগুলি নষ্ট হয়েছে। তাছাড়াও, দাহ্য পদার্থ হিসেবে নাইট্রাইট-বেসড নেগেটিভের দুর্নাম প্রথম থেকেই ছিল।

প্রেক্ষণ যন্ত্রের জোরালো আলোর জন্যে অতিরিক্ত তাপমাত্রার সংস্পর্শে প্রেক্ষাগৃহ অবধি ভস্মীভূত হয়েছে, এমন নজির কম নেই বিশ্বে। বস্তুত, তৎকালীন ব্রিটিশ সরকার প্রবর্তিত ইণ্ডিয়ান সিনেমাটোগ্রাফিক অ্যাক্ট মূলত দর্শকদের সুরক্ষার কারণেই প্রবর্তিত হয়। সরকার-বিমুখতার অভিযোগে সিনেমা প্রদর্শন বন্ধ করবার জন্যেও সময়ে সময়ে আইনটির দুর্ব্যবহার করা হয়। সে অবশ্য অন্য প্রসঙ্গ।

ফ্রান্সে যখন ল্যুমিয়ের ভ্রাতৃদ্বয় ক্যামেরায় সচল ছবি গ্রন্থন এবং পর্দায় তা প্রেক্ষণের জন্যে বিভিন্ন ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষায় ব্যস্ত, হীরালাল সেন তখন সযত্নে ফটোগ্রাফি চর্চায় রত আছেন। চলচ্চিত্র, যা তখন বায়স্কোপ নামে জনপ্রিয়, তার সঙ্গে হীরালাল সেন-এর পরিচয় অন্তত এক বছর পরে। যখন স্টার থিয়েটারে নাটকের মধ্যান্তরে জনৈক প্রফেসর জনসন এবং সম্ভবত জে এফ ম্যাডানের উদ্যোগে দর্শকদের নাটকটির নির্বাক চলচ্চিত্ররূপেরও অংশবিশেষ দেখানো হয়। হীরালাল সেন সেই প্রেক্ষণে এতটাই প্রভাবিত হন যে সচলচিত্র সম্পর্কে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক জার্নাল এবং পত্রপত্রিকা অধ্যয়ন শুরু করেন তিনি। তাঁর আগ্রহ দেখে প্রফেসর জনসনও তাঁকে চলচ্চিত্রের প্রযুক্তির ব্যবহারিক দিকগুলি বিষয়ে আলোকিত করেন। এবং কিছুদিনের মধ্যেই লণ্ডনের ওয়্যারউইক ট্রেডিং কোম্পানির সঙ্গে যোগাযোগ করে পাঁচ হাজার টাকার বিনিময়ে ‘আরবান বায়স্কোপ’ নামে যন্ত্রটি কিনে ভাই মতিলাল সেন-এর সঙ্গে যৌথভাবে ‘রয়্যাল বায়োস্কোপ কোম্পানি’ নামে এক সংস্থা প্রতিষ্ঠা করেন। কিন্তু বায়স্কোপগুলির নির্মাণ এবং তা জনসমক্ষে আনবার জন্যে তাঁকে কম ঝক্কি পোয়াতে হয়নি।

যেমন, ছবি তোলবার জন্যে তখন আর্ক ল্যাম্প ছিল অতি প্রয়োজনীয় এক সামগ্রী। কিন্তু বিদ্যুৎহীন এই শহরের রাস্তাঘাটে তিনি আর্ক ল্যাম্প নিয়ে করবেন কী? তাই তিনি সঙ্গে নিতেন বস্তা ভর্তি চুন আর রাবারের থলিতে সঞ্চিত অক্সিজেন গ্যাস। পর্দায় চুন লাগিয়ে অক্সিজেনের সংযোগে তাঁকে যে আলোকব্যবস্থা করতে হতো, তাকে ‘লাইমলাইট’ বলা হয়। শব্দটি এখন সুপরিচিত। কিন্তু রসায়ন সম্পর্কে যাদের জ্ঞান আছে, তাঁরা বুঝতে পারবেন সচল ছবি তোলবার জন্যে হীরালাল সেনকে কতটা ঝুঁকি নিতে হত। কারণ ‘লাইমলাইট’ বানাবার উপাদানে যে চুন আর অক্সিজেন, তা যে কোনও সময় বিস্ফোরণ ঘটিয়ে এলাকাতে বড় ধরনের অগ্নিকাণ্ড ঘটাতে সক্ষম।

অবশ্য, এই সব উদ্ভাবনের ক্ষেত্রে আর এক প্রাজ্ঞ মানুষ হীরালাল সেনের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। তিনি হলেন ফাদার ই জে লাফোঁ নামে সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজের প্রাতঃস্মরণীয় এক শিক্ষক। ফাদার লাফোঁ নিজে ক্লাসে পড়ানোর সময়ে লাইমলাইট এবং ফোনোগ্রাফ যন্ত্রদুটি ব্যবহার করতেন। বায়স্কোপ যন্ত্রটি চালানোর বিষয়েও তিনি হীরালাল সেনকে যথেষ্ট সাহায্য করেন।

তৎকালীন ভারতের এই ঐতিহাসিক বাস্তবতা কিন্তু ‘হীরালাল’ জীবনীচিত্রে অনুপস্থিত। ছবিটিতে আত্মম্ভরিতার অভাব নেই (“দেশে অনেক ফটোগ্রাফার আছে, কিন্তু হীরালাল সেন এই একটাই।”), অথচ সৃজনশীলতার নেপথ্যে ঝুঁকি নেওয়ার যে উত্তেজনা, ভাবনাকে যন্ত্রের মাধ্যমে রূপ দেওয়ার যে প্রাণপাত পরিশ্রমের উল্লেখটুকুও নেই। এমনটা যেন ধরে নিয়েই চিত্রনাট্য রচনা করা হয়েছে যে হীরালাল সেন-এর ব্যতিক্রমী প্রতিভার সামনে কারিগরি এই প্রতিকুলতাগুলি জয় করাটা যেন অতি তুচ্ছ ব্যাপার। পারিবারিক ও ব্যক্তিগত সংঘাত, ব্যবসায়িক বুদ্ধির অভাবই শুধুমাত্র তাঁর চলচ্চিত্রসাধনায় অকালে যতি টেনে দিল। ‘হীরালাল’-এর শেষ অংশে দর্শান ক্যানসার আক্রান্ত মানুষটির ক্ষয়ের প্রতি নির্মাতার গুরুত্ব দেখে আরেকবার ধারণা হল সমসাময়িক বাংলা চলচ্চিত্র গভীরতার পরিবর্তে তাৎক্ষনিক আবেগ সঞ্চারে বেশি উৎসাহী। প্রচলিত কাঠামো বজায় রেখে সংলাপমুখর নাটকীয়তার গ্রন্থণই যেন আত্মম্ভরী বাংলা কাহিনিচিত্রের স্বরূপ হয়ে উঠেছে।

তুলনা করতে না চাইলেও, দাদাসাহেব ফালকে-র জীবনী অবলম্বনে পরেশ মোকাসি-র মারাঠি ছবি ‘হরিশচন্দ্রাচি ফ্যাক্টরি’-র প্রসঙ্গ এসেই যায়। কারণ, দাদাসাহেব ফালকে নয়, হীরালাল সেনই যে ভারতীয় চলচ্চিত্রের পথিকৃৎ পুরুষ— এই ঐতিহাসিক তথ্যটিকে পুনর্প্রতিষ্ঠিত করাটা ইদানিং বাঙালি আত্মম্ভরিতার একটি অঙ্গ হয়ে উঠেছে। ২০১০ সালে মুক্তি পাওয়া ছবিটিতে নৈমিত্তিক উপায়ে চলচ্চিত্রের উদ্ভাবনী দিকগুলিকে সংকলিত করা হয়। আমরা দেখি ধুন্ধিরাজ গোবিন্দ ফালকে এবং তাঁর পরিবারের মানুষগুলির কাছে চলচ্চিত্র নির্মাণের প্রতিবন্ধকতাগুলি আরোপিত কোনও বাস্তবতা নয়। বরং সেই প্রতিবন্ধকতাগুলিকে নিবিড় পরিশ্রমে জয়ের মাধ্যমেই ব্যবসাবুদ্ধিসম্পন্ন এক প্রয়োগবিদের জন্ম হচ্ছে। অন্যদিকে, ‘হীরালাল’ যেন এক নষ্ট প্রতিভার ক্ষয়ের মর্মান্তিক বৃত্তান্ত বয়ানেই সীমাবদ্ধ।

মর্মান্তিকতার প্রসঙ্গই যখন এল, তখন মালয়ালাম চলচ্চিত্রের জনক হিসেবে যার নাম অনেক পরে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, সেই জে সি ড্যানিয়েলের জীবনী অবলম্বনে নির্মিত ‘সেলুলয়েড’ (২০১৩) ছবিটির কথা উল্লেখ থাক শেষে। কমল প্রযোজিত এবং নির্দেশিত এই মালয়ালাম ছবিটি আসলে ভারতের জাতপাত প্রথার অন্ধকারে ঢাকা পড়া এক সত্য প্রতিষ্ঠার বিবরণ। ব্রাহ্মন বিধবার ভুমিকায় এক ‘নিম্নজাতি’-র মহিলা অভিনয় করবার ‘দোষে’ জে সি ড্যানিয়েল নির্মিত ‘বিগতকুমারন’ ছবির প্রদর্শন আটকায় সমাজ। জে সি ড্যানিয়েলকে পদে পদে অপদস্থ করে কেরালার সমাজ। এবং অবহেলায় পড়ে থাকা নেগেটিভ খেলার ছলে জ্বালিয়ে দিয়ে ছবিটির অস্তিত্বটুকুও মুছে ফেলে তাঁর কিশোর পুত্র। ছবিটি শুরুও হয় সেই আগুন জ্বলা নেগেটিভের দৃশ্য দিয়ে। ‘হীরালাল’-এর ট্র্যাজেডিতেও অগ্নিকাণ্ড আছে। কিন্তু পথিকৃতের সাধনার সমাপনে সামাজিক বাস্তবতার নামে যে ব্যবসায়িক ঈর্ষা ও ষড়যন্ত্রের বিবরণ আছে, তা নাটকীয়তার স্বার্থে অনেকটাই আরোপিত। তাই, বাংলা সিনেমার ইতিহাস রচনায় ‘হীরালাল’ এক প্রশংসনীয় উদ্যোগ হিসেবে মেনে নিলেও, আত্মম্ভরিতা এবং বাংলার ক্ষয়িষ্ণু বাবুসমাজের প্রেক্ষিতের প্রতি অতিরিক্ত গুরুত্ব পথিকৃতের কৃতিত্ব উদযাপনে কিছুটা বিঘ্নই ঘটায়।