Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

ভোট এল নির্বাসিতা বাংলায়

সঞ্জীব দেবলস্কর

 



প্রাবন্ধিক, ভাষাতাত্ত্বিক, গল্পকার, কলামনিস্ট

 

 

ভারতীয় উপমহাদেশে বাঙালির চারটি ভুবনের মধ্যেকার এই তৃতীয় ভুবনকে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, ‘সুন্দরী শ্রীভূমি’। এই সুন্দরী শ্রীভূমির একটি-অংশ ‘বাংলার রাষ্ট্রসীমা হতে নির্বাসিতা’ হয়ে ‘মমতাবিহীন কালস্রোতে’ আজ ভিন্ন রাষ্ট্রের অন্তর্গত। এপারের এ অংশটি যে-রাজ্যের সঙ্গে জুড়ে রয়েছে, সেই অসম রাজ্যের ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক শক্তির কাছে অসমকে একভাষী হিসেবে গড়ে তোলার প্রকল্পে এ খণ্ডিত অংশটি কেমন যেন অসুবিধাজনক। সাম্প্রতিক অতীতের কথা বললে বিগত পাঁচটি বছর গেরুয়া ব্রিগেডের শাসনে এই অত্যাচারিত, নিপীড়িত বাঙালি জনগোষ্ঠীকে এটাই বোঝানোর একটা প্রয়াস ছিল যে, এরা যদি স্বেচ্ছায় ‘বৃহত্তর অসমিয়া’ জাতিগঠন প্রক্রিয়ায় সামিল হয়ে যায়, তবে সংশয়ের দোলাচলে বিপন্ন এ ভাষিকগোষ্ঠী বুঝি নাগরিকত্ব আইনের মাধ্যমে ভারতীয় নাগরিক হিসেবে স্বীকৃতি পেয়ে যাবে। এ ধারণাটা অবশ্য এদের কল্যাণে মোটামুটি প্রতিষ্ঠিত যে, অসমে বাঙালিদের ভারতীয়ত্বের বিষয়টি প্রমাণসাপেক্ষ। সর্বভারতীয় নেতৃত্বের মুখে রাজ্যের বাঙালিদের সম্বন্ধে ‘অবৈধ অনুপ্রবেশকারী, ঘুসপেটিয়া, উইপোকা’ ইত্যাকার বিশেষণে বাঙালির আজ আর তেমন প্রতিক্রিয়া হয় না, কেউ কেউ আবার বিগলিতও হন, কারণ এরা আপাতত ভিন্নতর আস্থায় স্থিত আছেন।

দিনকতক রাজ্যের নেতাদের মুখে ‘বরাক-ব্রহ্মপুত্র’, ‘পাহাড় ভৈয়াম’ সম্প্রীতির কথা কথঞ্চিত উচ্চগ্রামেই শোনা গেল। সমতলের মানুষের মনেও ধারণাটি স্পষ্ট হল, রাজ্যের পাহাড় এবং  সমভূমি (‘ভৈয়াম’) বুঝি সমতা ও সহাবস্থানের আদর্শে সরকারের সমান কৃপাদৃষ্টি লাভ করছে। ওই কেবল বরাক উপত্যকার কতিপয় বুদ্ধিজীবী অহেতুক সন্দেহ প্রকাশ করছেন, দুই উপত্যকার এবং দুই জাতিগোষ্ঠীর মিলনে বাধা সৃষ্টি করছেন। এদের মুখের আছে ‘উনিশের চেতনা’, ‘একুশ জুলাই’য়ের শহিদের ডাক, আর সে সঙ্গে রাষ্ট্রীয় সীমানা পেরিয়ে ‘একুশে ফেব্রুয়ারি’র চক্রান্ত, অখণ্ড বাঙালি চেতনা। এসবের পেছনে যে আন্তর্জাতিক চক্রান্ত রয়েছে এ নিয়ে সোস্যাল মিডিয়াতে যথাসময়েই সাবধানবাণী শোনানো হয়েছিল, কিন্তু সেরকম কাজ হচ্ছে না। বোধহয় সাবজেক্টটি রিপিট প্রচারের জন্য আইটি সেলকে জানাতে হবে। তবে মূল টেক্সটে সামান্য অদলবদলও করতে হবে, কারণ এবার ২১ ফেব্রুয়ারি উদ্‌যাপনে এবার রাজ্য সরকারেরও অংশগ্রহণ ছিল। সমস্যা হল যেখান থেকে এসব টেক্সট আমদানি হয়, সেই কলিকাতায় হাওয়া যে উত্তপ্ত, লেখকরা যে ভিন্নতর অ্যাসাইনমেন্ট নিয়ে ব্যস্ত। আর হায়, আমাদের এদিকে এত ট্রেনিং দিয়ে, কর্মশালা আয়োজন করেও তেমন রিসোর্স তৈরি করা যাচ্ছে না। হতচ্ছাড়া বুদ্ধিজীবীরা পুরষ্কার, নগদ অর্থ, সরকারি সংবর্ধনার প্রলোভনেও পথে আসছেন না। মাসে পনেরো কুড়ি হাজার দিয়ে যদি কেবল অন্যের লেখা ফরোয়ার্ড করা ছাড়া একটু অরিজিন্যাল বাংলা টেক্সট-লিখিয়ে তৈরি করা না যায় তবে তো মুশকিল।

ইতিমধ্যে বিধানসভায় সর্বসম্মতভাবে রাজ্যের দ্বিতীয় ভাষা হিসেবে ‘বড়ো ভাষা’র স্বীকৃতি এসেছে (সরকারি বার্তায় বড়ো ভাষা declared as an Associate Official Language in Assam, February 15, 2021, Guwahati)। এ নিয়ে বেশ শোরগোল উঠেছে। অবশ্য বাঙালি বিধায়ক এবং সাংসদরা নীরবতাই বজায় রেখেছেন। কতিপয় মোড়ল অবশ্য বোঝানোর চেষ্টাও করেছেন, সংখ্যালঘু একটি ভাষিকগোষ্ঠীকে না হয় একটা স্বীকৃতি দেওয়াই হল, বাংলা ভাষা তো আর বিদেয় হয়ে যাচ্ছে না। কিন্তু করিমগঞ্জের বিধায়ককে তাঁর দল একটু বেশি আশকারা দিচ্ছে। তাই তিনি প্রয়োজনের অতিরিক্ত চেঁচামেচি করছেন। এসব পরশ্রীকাতরতার জন্যই নাকি অসমের বাঙালিরা গরিষ্ঠসংখ্যক রাজ্যবাসীর আস্থা হারিয়েছে, এরকম কথাও বলেছেন সরকারি মদতপুষ্ট বুদ্ধিজীবীরা। ঘটনাপ্রবাহ অবশ্য একটু বেশি দ্রুতগতিতে চলছে। এরই মধ্যে অসমিয়া-বড়ো-আহোম-তাই-রাভা-কার্বি-নেপালি-মিসিং-গারো-মোরান-রাজবংশি-ডিমাসা-মণিপুরি দেউড়ি সহ ২২টি ভাষিকগোষ্ঠীর জন্য ৭৫ কোটির একটি বিশেষ সাংস্কৃতিক তহবিল, কর্পাস ফান্ডের (corpus fund) সংস্থান করে সদাশয় সরকার বাহাদুর জনসংখ্যার অনুপাতে ১০ থেকে ৩ কোটি টাকার অনুদানও রেখেছেন (২৯ ডিসেম্বর, ২০২০)। অসম সাহিত্য সভার জন্য ১০ কোটি আর বড়ো সাহিত্য সভার জন্য ৫ কোটি এবং অন্যান্য ভাষার সাহিত্যসভার জন্য ৩ কোটি টাকা ধার্য করা হয়েছে।  মুখ্যমন্ত্রীর দপ্তর থেকে জানানো হয়েছে, অসম সাহিত্যসভা এই তহবিল থেকে সুদ হিসেবে বৎসরে ৮০ লক্ষ, বড়ো সাহিত্য সভা ৪০ লক্ষ আর অন্যান্যরা বৎসরে ২৪ লক্ষ টাকা পর্যন্ত ওঠাতে পারবে। এ পর্যন্ত সবই ঠিক আছে। কিন্তু রাজ্যের দ্বিতীয় বৃহত্তম বাঙালি জনগোষ্ঠীর জন্য কি একটি টাকা দেওয়া যেত না?

দেখুন, প্রথমে এদের ভাষাকে করে দেওয়া হল গুরুত্বহীন, এবার মচ্ছব আয়োজন করে হরির লুঠের একটি বাতাসাও কুড়িয়ে নেওয়ার সুযোগ থেকেও এদের বঞ্চিত করা হল। যারা দাবি করতে এগিয়ে গেলেন এদের উপর বর্ষিত হল কঠোর ভর্ৎসনা বাক্য। বিধানসভায় একমাত্র যে দুর্জন ব্যক্তিটি কণ্ঠস্বর তুললেন তাকে কটাক্ষ করলেন তাঁর স্বভাষী বিধায়করাই— কমলাক্ষ পুরকায়স্থ নাকি সাম্প্রদায়িক-রাজনীতি করছেন। (এ স্থলে এটা বলা প্রয়োজন অসমিয়া বিধায়করা কিন্তু বাঙালিদের দাবির বিরোধিতা করেননি, এটুকু সৌজন্য ওঁরা দেখিয়েছেন)। বিধানসভায় প্রশ্নোত্তরের সময় মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী মহোদয় শিলচরের বিধায়ক, যিনি আবার স্বল্পকালীন সময়ের জন্য বিধানসভার ডেপুটি-স্পিকারও ছিলেন, তাঁকে এ বিষয়ে কিছু বলতে অনুরোধ করলে তিনি নীরব হয়ে চেয়ার আঁকড়ে বসে রইলেন। স্পিকার ডাজ ন’ট স্পিক্‌ (যদিও তিনি প্রাক্তন স্পিকার)। বলা বাহুল্য এই বিধায়ক একেবারে খাঁটি বাঙালি। (তাঁর সহধর্মিনীর নাম এনআরসিতে ওঠেনি, এটাই তো তাঁর বাঙালিত্বের বড় প্রমাণ। এক্ষণে কানে কানে কথাটি বলি, বর্তমান লেখকের সহধর্মিনীও বিদেশি বলে অভিযুক্ত হয়ে কোর্টকাছারি করে অবশেষে ভারতীয় হয়েছেন)। তবে মজার কথা হল এত আঁকড়ে ধরে বসে থাকলে প্রাক্তন এ সহ-সভাধ্যক্ষের এ চেয়ারটি যে তাঁর হাতছাড়া হবার জোগাড়। এবারের নির্বাচনে দলীয় টিকিটটি তাঁকে দেওয়াই হল না। নিস্ফল গেল তাঁর ওই নীরব ভূমিকা। ঠিক অনুরূপ ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার হোজাই কেন্দ্রের অপর বাঙালি বিধায়কও (তিনি অবশ্য নিজেকে ‘বঙ্গভাষী-অসমিয়া’ নামক একটা উদ্ভট পরিচিতির আড়ালে রাখতেই ভালবাসেন) তাঁর মাতৃভাষার প্রতি অবজ্ঞার স্বীকৃতিটুকু থেকে বঞ্চিত হয়ে এখন ফুসফাঁস করছেন। মনে এল স্কুলজীবনে আমরা নাটক করেছিলাম, ‘সিরাজদ্দৌল্লা’। এতে একটা দৃশ্য ছিল লর্ড ক্লাইভ তাঁর একান্ত বিশ্বস্ত অনুচরকে মিরজাফর সম্পর্কে বলেছিলেন,”ইহাকে বিশ্বাস করিও না, হি হ্যাজ বিট্রেড হিজ ওন কানট্রি, এন্ড ক্যান বিট্রে ইউ টু।” যে নেতা জাতীয়তাবাদের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করতে গিয়ে বাঙালির সাংস্কৃতিক প্রতীক, উত্তরীয় এবং অভিজ্ঞান সমূহকে নস্যাৎ করে অসমিয়া ‘গামোছা’,‘সরা’ ইত্যাদি, এমনকী সরকারি ব্যানারে (শিলচর শহরেই) বাংলা হরফ ব্যবহারের বিপক্ষে মতামত দেন, এ হেন ব্যক্তিকে জাতীয়তাবাদী শিবির ঠিকই বুঝতে পেরেছেন। সম্বিৎ ফিরে পেয়ে এখন তিনি বাঙালির অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে নির্দল প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন জমা দিলেন।

তবে গেরুয়া দলের একমাত্র বাঙালি মন্ত্রী, ব্যক্তিগতভাবে অতিশয় সজ্জন, কদাচিৎ তাঁর মুখে সাম্প্রদায়িক বাক্য উচ্চারিত হয়। এ হেন ব্যক্তিকেও দেখা গেল জেলাসদরে মনোনয়নপত্র জমা দিয়ে স্থানীয় টিভি ক্যামেরার সামনে মাতৃভাষাকে উপেক্ষা করে অসমিয়া ভাষায় কথা বলা শুরু করলেন। তিনি ভুলেই গেলেন যে তিনি দাঁড়িয়ে আছেন ভাষাশহিদের পুণ্যভূমিতে। এরকম তো কেউ কোনওদিন করেনি। বাঙালিরা কেবল বরাক উপত্যকায় নয়, গৌহাটিতে বিধানসভায়ও বাংলায়ই বলেছেন, শিলচরে এসে অসমিয়ারা তাঁদের ভাষায় বললে বাঙালিরা কোনওদিনই তা প্রত্যাখ্যান করেনি। কিন্তু এখানে চারিদিকে বাঙালির ভিড়ে এ যে ভাষিক সম্প্রসারণবাদের প্রতি নির্লজ্জ আনুগত্য প্রদর্শন! আশা করি ক্লাইভের পরামর্শের কথা জাতীয়তাবাদী শিবিরে আজানা নয়।

তবে দোষ কেবল এদেরই নয়। বরাক উপত্যকার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ জেলা হাইলাকান্দির তিনজন বিধায়ক অবশ্য জাতীয়তাবাদী দলের প্রতিনিধিত্ব করেন না, বলা উচিত করেননি। কিন্তু গণমাধ্যম এবং বিধানসভা কক্ষে এরা যখনই মুখ খোলেন (কদাচিৎই এ কর্মটি করতে হয় তাঁদের) এরা মাতৃভাষাকে দূরে সরিয়ে রেখে বিদঘুটে শ্রুতিকটু ভুল অসমিয়া বলেন। তাছাড়াও চাটুকারিতা বজায় রাখার উদ্দেশ্যে যে-কিছু অসমিয়া বাক্য, পরিভাষা এরা আয়ত্ব করেছেন, নিজ অঞ্চলে এসে সংবর্ধনা নিতে বা ফিতা কাটা অনুষ্ঠানে এসবেরই ভ্রান্ত, বিকৃত প্রয়োগ করে বিস্তর লোক হাসান। এর দু একটা নমুনা না দিলে বাংলা ভাষার ভিন্নতর অঞ্চলের পাঠক ঠিক বিষয়টি অনুধাবন করতে পারবেন না।

অসমিয়া ভাষার অনুকরণে এরা ‘আগামী দিন’ বলতে বলেন ‘আগন্তুক দিন’। এদের এ বোধই নেই বাংলায় আগন্তুক বলতে বোঝায় নবাগত, ইংরেজিতে যাকে বলে stranger। ‘প্রতিষ্ঠান’ আর ‘অনুষ্ঠান’ শব্দ দুটো নিয়ে এদের বিভ্রান্তি এখন চরমে। অসমিয়াতে ‘অনুষ্ঠান’ বলতে বোঝায় প্রতিষ্ঠান (institution) যা বাংলায় হল event। কিন্তু এরা এবং কতিপয় বাঙালি আমলাদের মুখেও শোনা যায় এ ধরনের বাক্য— ‘আসাম বিশ্ববিদ্যালয় আমাদের গৌরবের অনুষ্ঠান (পড়ুন প্রতিষ্ঠান)’। এরা সাহিত্য সম্মেলনেও গিয়ে কখনও নতুন ‘আলোচনী’টি (পড়ুন প্রত্রিকাটি), বা ‘স্মৃতিগ্রন্থ’টি (পড়ুন আত্মজীবনী) পাঠকের হাতে তুলে দিয়ে আনন্দ প্রকাশ করেন; সরকারি প্রকল্প উদ্বোধন অনুষ্ঠানে ঘোষণা করেন, ‘আগামীকাল থেকে ‘অনাময়’ (পরিচ্ছন্নতা) সপ্তাহ পালনে সরকার বিশেষ ‘আচনি’ (প্রকল্প) গ্রহণ করছেন’। বিশেষ জনসচেতনতা মূলক সরকারি অনুষ্ঠানে এরা ভাষণে বলেন বৃদ্ধ ‘মাতৃ এবং পিতৃর’(পড়ুন মা-বাবা) প্রতি সরকারি কর্মীদের যত্নবান হওয়া বাঞ্ছা করি।

এ নিয়ে আপাতত হাসিঠাট্টা হলেও ব্যাপারটি হাসির নয় মোটেই, বাংলা ভাষার জন্য একটা অশনিসঙ্কেত। দুটো ভগ্নীপ্রতিম ভাষা পাশাপাশি থাকলে এ বিভ্রাট হবে, আর যদি এর পেছন এক পক্ষের কোন গোপন এজেন্ডা থাকে (সঙ্গে এ পক্ষের থাকে চাটুকারিতা) তবে তো সোনায় সুহাগা। বরাক উপত্যকার রেশন দোকানে সরকারি নির্দেশে এখন লেখা হয় ‘আমার দোকান’ (পড়ুন আমাদের দোকান)। অসমিয়া ভাষায় ‘আমার’ শব্দটি যে plural (মানে ‘আমাদের’)। এটা নিছক মাস্টারমশাইদের চর্চার বিষয় নয়, আমাদের ভবিষ্যৎ ভাষাবিভ্রাটের সূচনা। কারণ চারটি দশক আগেই বিপুল আড়ম্বরে অসমে রচিত বাংলা পাঠ্যপুস্তকের মাধ্যমে একটা ভিন্নতর বাংলাভাষা তৈরি করার পরিকল্পনা ঘোষণা করা হয়েছিল এই বরাকের মাটিতেই (৩৬ তম অসম সাহিত্য সম্মেলন, হাইলাকান্দি অধিবেশন, ১৯৮৮), যে ভাষাটি হবে বাংলার মতো তবে বাংলা নয়, অসমিয়ার মতো তবে অসমিয়াও নয়। যে দুর্বিনীত বাঙালিরা মাত্রাতিরিক্ত ভাষাপ্রেমে উদ্বেল, এদের নতুন প্রজন্মকে এমনি করে ‘ট্যাঁশগরু’ বানানোর এই চক্রান্ত বাস্তবায়নের এ হল একটা পদক্ষেপ। রাজনৈতিক মদতপুষ্ঠ (এতে শাসক, বিরোধী সবই এক) চক্রের প্রয়াসে এক নতুন বাংলা নিয়ে বাঙালির সামনে এ মুহূর্তে আরেকটি সংকট ঘনীভূত। এ ধারণাটা প্রতিষ্ঠা পেয়ে যাচ্ছে, কী জানি শুদ্ধ বাংলা ছেড়ে এই কিম্ভুতকিমাকার ভাষায় কথা বললে বুঝি ডি-ভোটার, নাগরিকপঞ্জির ঝামেলা, বাংলাদেশি বহিরাগত আখ্যায় ভূষিত হওয়ার সম্ভাবনা কমবে, আর নেতাদের ক্ষেত্রে নির্বাচনে দলীয় মনোনয়নও হবে নিশ্চিত। কিন্তু ‘ট্যাঁশগরু’ হচ্ছে সস্তায় হাটে বিকোবার জিনিস- ‘লটখটে হাড়গোড় খটখট ন’ড়ে যায়/ধমকালে ল্যাগব্যাগ চমকিয়ে পড়ে যায়’, যেমন শুনিয়েছেন সুকুমার রায় মশাই। ভাষাহারা এই ট্যাঁশগরু উৎপাদন হচ্ছে এখন বাংলা ভাষার তৃতীয় ভুবনে। আর, এ ভূমির কতিপয় সুসন্তানরাই আজ এ মহাযজ্ঞের পুরোহিত।

এ ভূমির কিছু সুসন্তানরা উপরতলার কৃপা লভ্যার্থে ইদানীং নতুন শ্লোগান দিচ্ছেন ‘ভাষার চেয়ে ধর্ম বড়’ (বুঝতে পারলেন না? ওঁরা বলছেন হিন্দুরা হিন্দু, মুসলিমরা মুসলিম, সবাইকে ‘বাঙালি’ শব্দের আওতায় আনা যাচ্ছে না)। কেউ কেউ আরও এককাঠি সরেস, এরা বলছেন ভাষাশহিদ নিয়ে আবেগ এখন অতীতের ব্যাপার, অর্থাৎ একটু ভাঙিয়ে বললে, শিলচরের রেল স্টেশনের সরকার-ঘোষিত নামকরণ ‘ভাষাশহিদ স্টেশন’- এ প্রস্তাবটি বাস্তবায়নের জন্য এত চাপ দেওয়ার কী প্রয়োজন! সরকারের আরও কিছু কাজ যে রয়েছে, শুনছেন না উন্নয়নের জোয়ারের কথা?

বরাক উপত্যকা থেকে প্রকাশিত বাংলা কাগজগুলোতে এখন থেকে সরকারি বিজ্ঞাপনগুলোকে আর বাংলায় অনুবাদ করে দেওয়া চলবে না এ মর্মে একেবারে সুস্পষ্ট নির্দেশিকা দেওয়া হয়েছে। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন, আসামে বড়ো জনসংখ্যা হল ৪.৫৪ আর বাঙালি হল ২৮.৯২। এ ভাষার কাগজে অসমিয়া বিজ্ঞাপন ছাপানো বাধ্য করার আর কী অভিসন্ধি থাকতে পারে? যে রাজ্যে ৩.১ কোটি জনসংখ্যার মধ্যে ৪৮.৩৮% অসমিয়ারা প্রথম, এবং ৯০.২৪ লক্ষ জনসংখ্যা নিয়ে ২৮.৯২ শতাংশ বাঙালিরা দ্বিতীয় স্থানে, তাঁদের ভাষাকে এমনি করে কোণঠাসা করার এ পরিকল্পনা সত্যিই আশঙ্কার ব্যাপার।

এদিকে প্রতিবেশী রাজ্য মণিপুরের বাঙালি অধ্যুষিত জিরিবাম জেলায় (যা একসময় ছিল স্বাধীন সার্বভৌম কাছাড় রাজ্যের অন্তর্গত ভূমি) ডজনখানেক গ্রামের নামে (যেগুলো আসলে সংস্কৃত তৎসম শব্দ, যেমন লক্ষ্মীনগর, দুর্গাপুর, কালীনগর ইত্যাদি) বাংলা ভাষার সংশ্রব ঘুচিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হলেও এ দিকের বাঙালির কিছু বলা চলবে না। এসব নাকি বাঙালিদের অতিরিক্ত ভাবালুতা।

আপাতত ভাবলেশবিহীন এ ভুবনের বাঙালিদের দুশ্চিন্তার ক্ষেত্রটি অন্যত্র সরিয়ে দেওয়া প্রয়োজন। এখন মাথায় রাখতে হবে ‘ভোট আসছে’, ‘খেলা হবে’, এবং  এই ‘খেল খতম’ও হতে হবে। বরাকবাসীর সামনে কোন স্বচ্ছ এজেন্ডা নেই। থাকবেই বা কী করে? ইতিপূর্বে ৪ জন ইউডিএফ, ৩ জন কংগ্রেস এবং ৮ জন শাসকদলের মূকবধির প্রতিনিধি নিয়ে বরাক উপত্যকা এক অলীক স্বপ্নে ডুবে ছিল। এদের এই ঘুম আরও গাঢ় হবে যখনই জাত-পাত-ধর্মের দ্বিতীয় খোরাক এদের রক্তে ঢেলে দিতে আসবেন ঈশ্বরপ্রতীম মহানায়কেরা। আর এরপর, কথাটি অনেক আগেই লিখেছিলেন বরাকের কবি শক্তিপদ ব্রহ্মচারী—

রক্তে সংঘশক্তি বাড়ে, সকল ভাষার জন্য মমতা দ্বিগুণ বেড়ে যায়
ছোয়ালি ও মেয়েছেলে জড়াজড়ি পড়ে আছে ঘাসের কার্পেটে
কামরূপ কামিখ্যে  থেকে পারমিটের  বাবুরাও আসে,
এই ভাবে আমাদের ভালোবাসা বেড়ে চলে

ভারত-আত্মার কাছাকাছি-

. . .                    . . .

শাড়ি ও মেখলা আজ পাশাপাশি হেঁটে যায় সালোয়ার পাঞ্জাবির দিকে
বিহু ও বসন্তমেলা হোরির উৎসব থেকে আঙুরের রস চেখে আসে
ব্রতচারী নৃত্য হয়, ভাংড়া হয়  খুব ভাব ভালোবাসা হয়,
শরীরে আনন্দ হয়, তলে তলে বগলেরও দুর্গন্ধ হয়
বাড়াবাড়ি বেড়ে গেলে হাতুড়ে চিকিচ্ছা নেমে আসে
দিল্লি ও দিসপুর থেকে পারমিটের বাবুরা অবধি

সংহতির দাওয়াই বাতলায়–।।