শঙ্কর রায়
সাংবাদিক, প্রাবন্ধিক
এবারের অর্থাৎ সপ্তদশ বিধানসভা নির্বাচনে যেমন সাম্প্রদায়িতার কলুষ ছড়িয়ে পড়ছে, স্বাধীনতার পরে কোনও নির্বাচনে এমনটা ঘটেনি। একদিকে ‘জয় শ্রীরাম’ স্লোগানের শীৎকার ডেসিবেলের সীমা ছাড়িয়ে ছড়িয়ে পড়েছে। জেতার আশায় উদ্বেল ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) ও তার নিয়ন্ত্রক রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ (আরএসএস), যারা সংখ্যালঘুদের অধিকার ক্রমশ সঙ্কুচিত ও খর্ব করছে, নারকীয় ও পাশবিক নিপীড়ন করছে উল্বন উল্লাসে। অন্যদিকে এর প্রতিক্রিয়ায় দেশের প্রধানতম সংখ্যালঘু মানুষের আগুয়ান অংশ রাজনৈতিকভাবে সংগঠিত হচ্ছে। তাই সারা দেশে ক্রমশ প্রসারিত হচ্ছে এক নতুন রাজনৈতিক দল অল ইন্ডিয়া মজলিশ-এ- ইত্তেহাদ-উল-মুস্লিমিন (এআইএমআইএম, সংক্ষেপে মিম)। বলা বাহুল্য, এদের উদ্দেশ্য ভারতে মুসলমান, দলিত এবং অন্যান্য সংখ্যালঘু ও অন্যান্য সুবিধাবঞ্চিত সম্প্রদায়ের সামাজিক, অর্থনৈতিক, শিক্ষামূলক উন্নয়ন এবং রাষ্ট্র ও প্রশাসনে কার্যকর প্রতিনিধিত্ব অর্জনের আন্দোলন। মিম-এর প্রধান নেতা আসাদুদ্দিন ওয়েইসি সাংসদ সদস্য ও বাগ্মী। অযোধ্যার রামমন্দির রায়ের সমালোচনায় লোকসভায় ও অন্যত্র তাঁর প্রদত্ত ভাষণগুলি স্মরণীয়। বিহারে বিধানসভা নির্বাচনে তাঁর এনআরসি ও সিএএ-বিরোধী ভাষণগুলি মিম-এর পাঁচটি আসন জেতায় অনুঘটকের কাজ করেছিল। তাঁর দল ২০টি আসন দিয়েছিল। অভিযোগ হচ্ছে— এবিপি আনন্দ অভিযোগ করছে— যে মিম বিহারে বিজেপি-জেডিইউ জোটকে সাহায্য করেছে। এটা কুৎসা ছাড়া আর কিছু নয়। নির্বাচন কমিশনের ওয়েবসাইট দেখলে প্রতীয়মান হবে যে মিম একটি আসনও ভোট কেটে ঐ জোটকে জেতাননি। কেউ ভাববেন না যে এই প্রতিবেদক মিম-এর প্রতি সহানুভূতিশীল। তবে এখন দলটির নেতৃত্ব সঙ্ঘ পরিবারের শুধু বিরোধী নয়, কেন্দ্রে ও যে সব রাজ্যে বিজেপি সরকার রয়েছে তাদের মুখোশ খুলে দিচ্ছে, যা সিদ্দিকি ও অন্যান্য মুসলিম দল/গোষ্ঠীর প্রচারে উচ্চকিত নয়। আঞ্চলিক স্তরেও এরকম সংখ্যালঘু ও পিছিয়ে পড়া শ্রেণিগোষ্ঠী সঙ্ঘবদ্ধ হওয়ার প্রয়াস নিচ্ছে। পশ্চিমবঙ্গে এইরকম দাবিদার নব্য সংগঠন ইন্ডিয়ান সেকুলার ফ্রন্ট (আইএসএফ), যার প্রধান মুখ হুগলি জেলার ফুরফুরা শরিফের ৩৫-বৎসর বর্ষীয় যুবক পীরজাদা আব্বাস সিদ্দিকি।
সংখ্যাগরিষ্ঠদের মধ্যে সংখ্যালঘু-দলিত-নিম্নবর্গীয়দের বিরুদ্ধে কায়েমি স্বার্থবাদীদের এই নিপীড়নের প্রতিবাদে পিছিয়ে পড়া শ্রেণিগোষ্ঠীদের এই সঙ্ঘবদ্ধ হওয়া স্বাভাবিক ও অনিবার্য। টাইমস অফ ইন্ডিয়ার প্রাক্তন সম্পাদক ও সাপ্তাহিক কলাম-লিখিয়ে স্বামীনাথন এস আঙ্কলেসারিয়া আইয়ার মাস দেড়েক আগে সাফ সাফ লেখেন, আজ মুসলমানদের স্বার্থরক্ষার জন্য একটি শক্তিশালী সর্বভারতীয় একটি দলের প্রয়োজন। আমিও কনে করি যে সঙ্ঘীদের গণতন্ত্রনিধন ও সংখ্যালঘুদের মতপ্রকাশের অধিকার হননের সন্ত্রাসী অপপ্রয়াস রুখতে এটাই এক সামাজিক ও দ্বান্দ্বিক প্রতিঘাত। পশ্চিমবঙ্গে নির্বাচন ফলাফল অনেকটাই প্রধান সংখ্যালঘু তথা মুসলমান ভোটারদের উপর নির্ভরশীল। রাজ্যের জনসংখ্যার ২৭ শতাংশ মুসলমান।
এ নিয়ে প্রতিবেদনের আগে দুটি অতীতের ঘটনার উল্লেখ করছি, যা ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ কাঠামোর মধ্যে নিহিত দুর্বলতা ও স্ববিরোধিতার দিকে ইঙ্গিত করে।
এক, ১৯৬০ দশকের শেষের দিকের সালের একটি সন্ধেবেলার কথা। পশ্চিমবঙ্গে শাসনক্ষমতায় তখন যুক্তফ্রন্ট সরকার। স্থান ৮৯ মহাত্মা গান্ধি রোডের স্বিতলে ‘পরিচয়’ পত্রিকা দপ্তর। বসে আছেন দীপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, তরূণ সান্যাল ও আরও কয়েকজন। হঠাৎ এলেন গোলাম কুদ্দুস। একটু বসেই দীপেনদাকে বললেন, ‘আকাশবাণী’তে একটি ‘টক’এর রেকর্ডিং করে ফিরছি। জানেন দীপেন, স্বাধীন ভারতে এই প্রথম রেডিও থেকে আমন্ত্রণ পেলাম। পরাধীন ভারতে বেশ কয়েকবার অল ইন্ডিয়া রেডিও-র কলকাতা স্টেশ্যন থেকে আমন্ত্রণ পেয়েছি, প্রোগ্রাম করেছি।’ স্বাধীনতোত্তর ভারত এক ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট, কিন্তু সেদিন কুদ্দুসদার কথায় নিজের ভেতরেই ধিক্কার অনুভব করেছিলাম, ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের বাহ্যিক আবরণের তলায় আছে মুসলমান-বিদ্বেষী ধর্মান্ধতার কদর্য মানসিকতা জিইয়ে রাখা হয়েছে। অথচ কুদ্দুসদা ছিলেন সমন্বয়। তাঁর স্ত্রী হেনা চৌধুরী জন্মসূত্রে হিন্দু। কুদ্দুসদাকে সর্বদাই দেখেছি শাদা সুতির পাঞ্জাবী ও ধুতিতে। সেদিন তাঁর কথায় ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের প্রতি প্রচ্ছন্ন বিদ্রূপের আঁচ পেয়েছিলাম। গনগনে আঁচে তাঁর লেখা ‘ইলা মিত্র স্তালিন নন্দিনী/ইলা মিত্র ফুচিকের বোন’, ‘বাঁদী’ বা ‘লেখা নেই স্বর্ণাক্ষরে’ অত্যন্ত বলিষ্ঠ রচনা হলেও কুদ্দুসদাকে কখনও জোরে কথা বলতে শুনিনি। তাই তাঁর সুপ্ত ক্ষোভ অনুধাবন করতে পেরেছিলাম— মুসলমান বলে না, তাঁর ক্ষোভ ছিল ধর্মনিরপেক্ষতা নীতির উপর চোরাগোপ্তা আঘাতের বিরুদ্ধে।
সাংবাদিকতায় আমি এসেছিলাম অনেক পরে। আসলে সাংবাদিকতাকে জীবিকা নিয়ে ভাবনাই ছিল না, সংবাদ বা সাংবাদিকতা সম্পর্কে কোনও ধারণা বা উৎসাহ কোনওটাই ছিল না। নচেৎ তখন মনে হত কুদ্দুসদার সেই অভিজ্ঞতা প্রথম পৃষ্ঠার খবর। কুদ্দুসদা যখন বলছিলেন সে কথা, তখন ইন্দিরা গান্ধি ভারতের প্রধানমন্ত্রী। জানলে তিনি মাথা নোয়াতেন, খোদ নেহরুর আমলে (যখন কেন্দ্রীয় তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রী বালকৃষ্ণ বিশ্বনাথ কেসকার) এমন অকল্পনীয় ব্রাহ্মণ্যবাদ। সাধে ১৯৫৪ সালে পেইপিং (তখন পেইচিং এই নামে পরিচিত, অবশ্য সংবাদপত্রের পণ্ডিতদের কাছে পাঠক সাধারণ্যে পেইচিং-কে বেজিং বলা হয়)-এ ব্রিটিশ মার্ক্সবাদী, গ্রেট ব্রিটেনের কমিউনিস্ট পার্টি-ঘনিষ্ঠ ও প্রখ্যাত বিজ্ঞানী জন ডেসমন্ড বার্নালকে বলেছিলেন, ‘মোস্ট অফ মাই মিনিস্টার্স আর স্কাউন্ড্রেলস অ্যান্ড রিঅ্যাকশ্যনারি।’ আসলে নেহরু তো মন্ত্রিসভায় সংখ্যাগরিষ্ঠের সমর্থন পাননি, সেকারণে তাঁর আমলে এস নিজলিঙ্গাপ্পা, কামরাজ নাদার, অতুল্য ঘোষ ও এস কে পাতিল-দের ‘সিন্ডিকেট’ গড়ে ওঠে, যা ছিল প্রগতিবিরোধী ও মুক্ত শিল্পলগ্নী-বাণিজ্য নীতির প্রস্তাবক।
দুই, শুধু কংগ্রেসিদের দুষে ঠিক হবে না। অবিভক্ত ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিআই)ও ধর্মনিরপেক্ষতার পেছনে ছুরি মেরেছে, এমন নজির আছে। আমি বলছি ১৯৫০-দশকের শেষের দিকের কথা। সেই সময় বৃহত্তর কলকাতা (‘গ্রেটার ক্যালকাটা’) ও তৎকেন্দ্রিক নগরোন্নয়নের জন্য ক্যালকাটা মেট্রোপলিটান প্ল্যানিং অর্গানাইজেশ্যন (সিএমপিও) গঠিত হয়েছিল। ফোর্ড ফাউন্ডেশ্যন-এর অর্থানুমোদনে ‘স্লাম ইম্প্রুভমেন্ট স্কিম’ রূপায়ণের সিদ্ধান্ত হয়েছিল। ঘিঞ্জি ও অস্বাস্থ্যকর বস্তিগুলি ভেঙে বস্তিবাসীদের অন্যত্র বিকল্প পাকা বাসস্থান সেই পরিকল্পের মূল কথা ছিল। অবিভক্ত সিপিআই-র প্রভাবিত বস্তিগুলি ছিল রাজাবাজার, পার্ক সার্কাস, শেয়ালদা, কাশিয়াবাগান, তোপসিয়া প্রভৃতি মুসলমান-অধ্যুষিত এলাকায়। তখন পার্টির কলকাতা জেলা পরিষদের সম্পাদক জলি মোহন কল। জাতীয় পরিষদ সদস্যও ছিলেন। জলিদার কাছেই শুনেছিলাম, এতে প্রমাদ গোনে রাজ্য পার্টি নেতৃত্বের নিয়ামক উপদল (শীর্ষে ছিলেন প্রমোদ দাশগুপ্ত, কার্যত রাজ্য সম্পাদক, কারণ জ্যোতি বসু তখন নাম-কা-ওয়াস্তে রাজ্য সম্পাদক। তিনি বেশ কিছুদিন ধরেই ঐ পদ থেকে অব্যাহতি চাইছিলেন। প্রমোদবাবুকে মদত দিচ্ছিলেন সিপিআই-এর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা মুজফফর আহমদ)। স্লাম ইম্প্রুভমেন্ট স্কিম-এর বিরুদ্ধে পার্টি প্রতিবাদ আন্দোলনে নামল। সেই প্রতিবাদের মূল আওয়াজ, এটা বস্তি উন্নয়নের নামে বস্তি উচ্ছেদ পরিকল্প। মুসলমান এলাকার প্রচার অভিযানে অন্যতম প্রধান বক্তা ছিলেন এম এ সৈয়দ; প্রমোদবাবু-নেতৃত্বাধীন উপদলভুক্ত। জলিদার মুখে শুনেছি, এম এ সৈয়দ বলতেন, ‘এটা বস্তি উচ্ছেদ নয়, ইসলামের উচ্ছেদ।’ তিনি বামফ্রন্ট আমলে সিপি আই(এম) বিধায়কও ছিলেন।
আব্বাস সিদ্দিকি-র ধর্মনিরপেক্ষতা নিয়ে রাজনৈতিক মহল বিভ্রান্ত, দ্বিধাবিভক্ত। গত ১৩ মার্চ এবিপি আনন্দ সংবাদ চ্যানেলে ‘মুখোমুখি’ কর্মসূচিতে তাঁর ২০২০ সালে প্রদত্ত কয়েকটি উস্কানিমূলক ও অ-ইসলামবিদ্বেষী ভাষণ তাঁর ধর্মনিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। দুটি ভাষণই উত্তর ২৪ পরগণায়। শাসনে তিনি কলকাতার মেয়র ও নগরোন্নয়ন মন্ত্রী ফিরহাদ (ববি) হাকিমকে ‘কাফের’ আখ্যা দেন, কারণ তাঁর স্ত্রী (জন্মসূত্রে হিন্দু) মন্ত্রীর বাড়িতে শিবরাত্রির দিন শিবলিঙ্গে জল দেন। আর কদম্বগাছিতে তৃণমূল কংগ্রেস সাংসদ নুসরত জাহান মন্দিরে গিয়েছিলেন। নুসরত জাহানকে তিনি দেহপোজীবী আখ্যা দেন। ‘যে দেহ বিক্রি করতে পারে, সে দেশকেও বেচে দিতে পারে।’ ঐ ভিডিও ক্লিপিং দেখালে তিনি বলতে চান, এগুলো বানানো ভিডিও। প্রশ্নকর্তা যেই বলেন স্থান ও তারিখ সহ দেখাতে পারেন, সিদ্দিকি তখন পিছু হঠেন।
সিদ্দিকির প্রধান মুরুব্বি সিপিআই(এম) এর পলিটব্যুরো সদস্য মহম্মদ সেলিম বলেছেন, “Spreading misinformation about the ISF is part of a well-thought-out conspiracy being played out over the past four months. The hand-outs to the media came from the office of the RSS (Rashtriya Swayamsevak Sangh). The party is named Indian Secular Front. Its president is Simal Soren. We have agreed to leave some seats for them, we have asked our partners to give some seats to this new political force. We have also asked ISF to come to an understanding with the Congress. A section of the media is playing a deliberate role to ensure the alliance does not take shape।” কে এই শিমুল সোরেন? তাঁর কী অতীত? কোন আদিবাসী সংগঠনের প্রতিনিধি? সেলিম সাহেব কি বোকা বানাতে চাইছেন নিরীহ ভোটারদের?
ফুরফুরা শরিফ সুফি ইসলাম আদর্শের বাহক ও প্রচারক। কিন্তু আব্বাস সিদ্দিকির ভাষা কি আদৌ সুফি-গন্ধী (বরং শাসন, কদম্বগাছি ও অন্যত্র তাঁর ভাষণের ভিডিও ক্লিপগুলো শুনে মনে হয় যেন বাংলাদেশের কোনও ইসলামিক মৌলবাদীর কণ্ঠ। তথাকথিত ইন্ডিয়ান সেকুলার ফ্রন্টকে সাধারণ খেটে-খাওয়া মুসলমান জনতা কি মেনে নেবে? বিশেষত মুর্শিদাবাদ জেলা (২২টি বিধানসভা আসন ও জনসংখ্যার ৭০ শতাংশ মুসলমান) ও মালদা জেলায় (১২টি বিধানসভা আসন ও জনসংখ্যার ৫৭ শতাংশ মুসলমান)?
সাচার কমিটির রিপোর্ট থেকে একথা স্পষ্ট যে পশ্চিমবঙ্গে মুসলমান সমাজের প্রতি অবহেলার অতিনিন্দনীয় অতীত বামফ্রন্ট আমলেও বহন করা হয়েছে। কাজেই সরকারি বামেরা তথা সরকারি মার্ক্সবাদীরা (পড়ুন লেনিনবাদী) মুসলমান সমাজের হয়ে কথা বলার নৈতিক অধিকার হারিয়েছেন। নির্বাচনী বৈতরণী পেরনোর জন্য সিদ্দিকির বা আইএসএফ-এর সঙ্গে জোট সেই অপরাধ নিবারণ করতে পারে না।