Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

প্রশ্ন করতে শেখাল জাতীয় বিজ্ঞান দিবস: একটি প্রতিবেদন

সাবির আহমেদ 

 


প্রতীচী (ইন্ডিয়া) ট্রাস্টের ন্যাশনাল রিসার্চ কো-অর্ডিনেটর

 

 

 

কয়েক দিন আগে পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা নির্বাচনের দিনক্ষণ ঘোষণা হয়েছে। রাজনীতির কারবারিরা যখন লম্বা সময় ধরে নির্বচনের যুক্তি নিয়ে কচকচানি শুরু করেছেন, সেই সময় এই শব্দদূষণ থেকে শত মাইল দূরে সুন্দরবনের জঙ্গলঘেঁষা সামশেরনগর গ্রামের শতাধিক ছাত্রছাত্রী ২৮ ফেব্রুয়ারি ‘জাতীয় বিজ্ঞান দিবস’ উপলক্ষে দু দিনের আবাসিক এক কর্মশালায় অংশগ্রহণ করে। নোবেলজয়ী বিজ্ঞানী সি ভি রামনের জন্মদিনকে কেন্দ্র করে এই ‘জাতীয় বিজ্ঞান দিবস’।

বিশ্ব জুড়ে একদিকে বিজ্ঞানের অভূতপূর্ব বিকাশ ঘটছে। মাত্র এক বছরের মধ্যে করোনা টিকা আবিষ্কার তার অন্যতম একটি উদাহরণ। অন্যদিকে আজকে ভোট রাজনীতির কারণে নানা দিবস পালনের ধূম দেশে এবং এ রাজ্যে, অথচ ‘জাতীয় বিজ্ঞান দিবস’ নিয়ে কোনও উচ্চবাচ্য নেই। এ দেশে কেন্দ্রীয় সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় ‘জড়িবুটি’ থেকে করোনা মোকাবিলার ওষুধ আবিষ্কারের ঘোষণা হয়ে যায়। খোদ কলকাতা শহরে করোনার হাত থেকে বাঁচতে গোমূত্র পানের হিড়িক পড়ে যায়। গরুর দুধে সোনা আছে এই কথা এক রাজনৈতিক নেতার মুখ থেকে বারবার শোনা যায়। সামাজিক মাধ্যমের কারণে ক্ষুদেদের কানেও এইসব কুশিক্ষার কথা পৌঁছে গেছে। শাসকের রাজনৈতিক দর্শনের কারণে উচ্চশিক্ষা খাতে বরাদ্দ টাকা বিজ্ঞানচর্চায় খরচ না হয়ে, ‘গরুর বিজ্ঞান’ নামক এক নতুন পাঠচর্চার গবেষণায় উৎসাহ দান করা হচ্ছে।

দীর্ঘকাল শিক্ষা, অর্থনৈতিক ও সামাজিক পশ্চাদপরতার কারণে সমাজে নানা কুসংস্কার জগদ্দল পাথরের মত গেঁথে আছে। সুন্দরবনের এই প্রান্তিক গ্রামগুলিতে তাবিজ, কবচ ও নানা করসাজি দেখিয়ে, মানুষের মনে ভয় ঢুকিয়ে এক দল মানুষ অসৎ উপায়ে অর্থ উপার্জন করে। ‘প্রিজম’ ও ‘সুন্দরবন সয়েল’-এর যৌথ উদ্যোগে আয়োজিত এই কর্মশালার মূল উদ্দেশ্য ছিল ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে বিজ্ঞানমনস্কতা ও পরিবেশ-সচেতনা বাড়ানো। দু দিনের এই আবাসিক কর্মশলায় ছাত্রছাত্রীরা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে সমাজে ও পরিবারের মধ্যে প্রচলিত যে নানা সংস্কার ও কুসংস্কার আছে তার একটা তালিকা করল। যেমন কিশোরী মেয়েদের আলোচনায় বেরিয়ে এল বাড়িতে শেখানো হয় ঋতুকালীন সময়ে তিন দিন ছেলেদের মুখ দেখতে নেই। এবং এ কটা দিন এখনও তাদের সেদ্ধ খাবার খেতে হয়। কর্মশালায় অংশগ্রহণকারী মেয়েরা নীতাদিদির কাছে জেনে নিল ঋতুকালীন সময় মেয়েদের জীবনের একটা স্বাভাবিক বৃত্ত এবং এর সঙ্গে জড়িয়ে থাকা নানা সামাজিক ট্যাবুকে দূর করতে ছাত্রছাত্রীদেরই এগিয়ে আসতে হবে এবং এই সময় বেশি করে পুষ্টিকর খাবার খেতে হবে। ছাত্রছাত্রীরা জানাল নানা সামাজিক বাধানিষেধের কারণে গর্ভবতী মেয়েদেরও পুষ্টিকর খাবার থেকে বঞ্চিত হতে হয়। এর ফলে মা অপুষ্ট সন্তানের জন্ম দেয় বা জন্মের আগে শিশুর মৃত্যুও হয়। পরিবারের লোকজন ‘বাণ মেরেছে’ সন্দেহে গুণিনের কাছে নিয়ে যায়। গুণিন হাত গুণে কোনও বুড়িকে ডাইনি বলে ঘোষণা করে। ডাইনি অপবাদে বুড়ির ওপর অত্যাচার করা হয়। এ আদতে বুড়ির সম্পত্তি হাতিয়ে নেওয়ার এক কৌশল। ‘জন্ডিস ঝাড়া’ এখনও বেশ রমরমা ব্যবসা। বারাসাত নবপল্লী বয়েজ স্কুলের শিক্ষক অরিন্দম দে ছলচাতুরির রহস্য একেবারে হাতেকলমে দেখিয়ে দিয়েছেন। খাদ্যদ্রব্যে কীভাবে বিষ রং ঢেলে সতেজ রাখা হচ্ছে, ছোট পোলট্রি ডিম কীভাবে রাসায়নিকে ডুবিয়ে দেশি ডিম হিসাবে চালিয়ে দেওয়া হচ্ছে বা জন্ডিস ঝাড়া আসলে কীরকম এক চাতুরি। মাত্র কয়েক দিনের প্রস্তুতিতে ছেলেমেয়েরা বিজ্ঞানের প্রদর্শনীর আয়োজন করে। প্রদর্শনীর মাধ্যমে বিজ্ঞানের বুনিয়াদি ধারণাগুলি ও সুন্দরবন অঞ্চলের বৈচিত্র্যময় পরিবেশের নানা দিক তুলে ধরা হয়।

সুপার সাইক্লোন আমফানে আক্রান্ত গ্রামবাসী যখন প্রাণ বাঁচাতে ব্যস্ত, তখন এক দল আমফান আসলে ‘দানো’র অর্থাৎ দানবের কাজ এই বিশ্বাসে অবিচল থাকে। পরিবেশের ওপর মানুষের অত্যাচারে প্রকৃতিও গা ঝাড়া দিয়ে ভয়ঙ্কর আকার ধারণ করছে। পরিবেশের প্রতি আমাদের অবহেলার ফলে এক কালের প্রাণবন্ত নদী কেমন একটা নিরীহ খালে পরিণত হয়েছে। নদীর বুকে গড়ে উঠেছে স্থায়ী ইমারত, নদীর স্বাভাবিক গতিপথ রুদ্ধ। নদীর রূপবদল নিয়ে নদীর পাড় ধরে এক ঘন্টার ‘নদীকে চেনার গল্প’ শোনালেন ভূগোলের অধ্যাপক অসীম গোস্বামী। এই নদীর স্থানীয় নাম কুলেখালি, কোথাও আবার কমলাখালি, কাপড়ে রিফুর মতো এঁকেবেঁকে নদী গতিপথ পরিবর্তন করেছে। কোথাও নমনীয় ভাব আবার কোথাও ভয়ঙ্কর আকার ধারণ করেছে।

করোনার কারণে প্রায় এক বছর ধরে বিদ্যালয়ে শিক্ষা বন্ধ, তবে শিক্ষা থেমে থাকেনি। স্বেচ্ছাসেবী প্রশান্তমাস্টারের নেতৃত্বে পড়াশুনার পাশাপাশি চলেছে কুসংস্কারের বিরুদ্ধে ছাত্রছাত্রীদের লড়াই, পরিবেশ বাঁচাতে টুরিস্টদের ফেলে যাওয়া বোতল থেকে বন্যা ও বিপদকালে ভেসে থাকার জন্য ফ্লোটার তৈরি করে তারা চমক লাগিয়েছে।

প্রায় একবছর পর একসঙ্গে ক্লাস করার আনন্দে ছাত্রছাত্রীরা খানিক দিশেহারা, তবে সকলেই বেশ সংযত। আদিবাসী পাড়ার যে ছেলেমেয়েরা এমনকি স্কুলে যাওয়ার কথা ভাবতও না, আজকে তারা মাধ্যমিক বা উচ্চমাধ্যমিক দেবে। তবে এই দিনের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি যখন বছর পনেরোর রাধারানি বলে, “যা সাদা চোখে দেখছি তা সব ঠিক নয়। এবার থেকে প্রশ্ন করতে শিখলাম।” রাধারানি রাজ্যের ভবিষ্যৎ, যখন নাকি এ রাজ্যে দুধে সোনা ফলানোর চেষ্টা চলছে!