সুজন ভট্টাচার্য
প্রাবন্ধিক, গদ্যকার, ঔপন্যাসিক, অনুবাদক
১ নভেম্বর, ২০২০। কলকাতায় ভর্তুকিযুক্ত এলপিজি সিলিন্ডারের দাম ছিল ৬২০ টাকা ৫০ পয়সা। একই সময়ে দিল্লি, মুম্বাই আর চেন্নাইতে সেই দাম ছিল যথাক্রমে ৫৯৪ টাকা, ৫৯৪ টাকা ও ৬১০ টাকা। আর তারপর থেকেই এলপিজি সিলিন্ডারের দাম যেন অশ্বমেধের ঘোড়ার মত ছুটতে আরম্ভ করেছে। চার মাসের মধ্যে দাম বাড়ল পাঁচবার। কতটা করে বাড়ল? তাহলে দেখাই যাক।
তারিখ | দামের বৃদ্ধি |
১.১২.২০ | ৫০ টাকা |
১৫.১২.২০ | ৫০ টাকা |
০৪.০২.২১ | ২৫ টাকা |
১৫.০২.২১ | ৫০ টাকা |
২৫.০২.২১ | ২৫ টাকা |
অর্থাৎ মাত্র ৮৭ দিনের মধ্যে সিলিন্ডারের দাম বাড়ল ২০০ টাকা, গড়ে দৈনিক ২.৩০ টাকা। আবার চার মহানগরীর ক্ষেত্রে দাম বৃদ্ধির শতাংশটাও একবার দেখে নেওয়া যাক—
দিল্লি/মুম্বাই | ৩৩.৬৭% |
চেন্নাই | ৩২.৭৬% |
কলকাতা | ৩২.২৩% |
এল পি জি-র দাম সবথেকে কম হয়েছিল ১ সেপ্টেম্বর, ২০১৬য়। সেদিন চার মহানগরীতে দাম ছিল এইরকম—
দিল্লি | ৪৬৬ টাকা ৫০ পয়সা |
কলকাতা | ৪৯১ টাকা |
মুম্বাই | ৪৬৮ টাকা |
চেন্নাই | ৪৭৭ টাকা ৫০ পয়সা |
সেই হিসাবে পরবর্তী ৬৭ মাসে দাম বেড়েছে—
দিল্লি | ৩২৭.৫০ টাকা |
কলকাতা | ৩২৯.৫০ টাকা |
মুম্বাই | ৩২৬ টাকা |
চেন্নাই | ৩৩২.৫০ টাকা |
শতাংশের বিচারে বৃদ্ধি হল
দিল্লি | ৭০% |
কলকাতা | ৬৭.১১% |
মুম্বাই | ৬৯.৬৬% |
চেন্নাই | ৬৯.৬৩% |
একই ঘটনা দেখা গেল পেট্রোল আর ডিজেলের ক্ষেত্রেও। জুলাই, ২০১৬-য় লিটারপ্রতি পেট্রোল ও ডিজেলের দাম ছিল—
দিল্লি | ৬২.৫১/৫৪.২৮ টাকা |
কলকাতা | ৬৬.০৩/৫৬.৪৮ টাকা |
মুম্বাই | ৬৭.১১/৫৯.৬০ টাকা |
চেন্নাই | ৬২.০০/৫৫.৮২ টাকা |
আর সেই দাম বর্তমানে হয়েছে—
দিল্লি | ৯১.১৭/৮১.৪৭ টাকা |
কলকাতা | ৯১.৩৫/৮৪.৩৫ টাকা |
মুম্বাই | ৯৭.৫৭/৮৮.৬০ টাকা |
চেন্নাই | ৯৩.১১/৮৬.৪৫ টাকা |
এক্ষেত্রে মধ্যবর্তী সময়ে দাম বেড়েছে—
দিল্লি | ২৮.৬৬/৩০.৪৭ টাকা |
কলকাতা | ২৫.৩২/২৭.৯৫ টাকা |
মুম্বাই | ৩০.৪৬/২৯.০০ টাকা |
চেন্নাই | ৩১.১১/৩০.৬৩ টাকা |
বৃদ্ধির শতাংশ কী হবে তাহলে? দেখাই যাক—
দিল্লি | ৪৫.৮৫/৫৬.১৩% |
কলকাতা | ৩৮.৪৫/৪৯.৪৯% |
মুম্বাই | ৪৫.৩৯/৪৮.৬৬% |
চেন্নাই | ৫০.১৮/৫৪.৮৭% |
প্রশ্ন হল, দাম বাড়ছে কেন। আমরা জানি, ভারতের প্রয়োজনীয় জ্বালানি তেলের অনেকটাই আমদানি করতে হয়। ফলে ভারতে পেট্রোল, ডিজেল বা এলপিজি-র দাম আন্তর্জাতিক বাজারে পেট্রোলিয়ামের দামের উপর নির্ভরশীল। তাহলে এবার আন্তর্জাতিক বাজারে পেট্রোলিয়ামের দামের ওঠাপড়াটা একবার দেখে নেওয়া যাক। ২০১১ থেকে ২০১৪ পর্যন্ত আন্তর্জাতিক বাজারে খনিজ তেলের ব্যারেল প্রতি দাম ৯০ ডলারের উপরেই ছিল। প্রতিটি বছরেই সর্বোচ্চ দাম ১০০ ডলার ছাপিয়ে যায়। এই সময়ে স্বাভাবিক কারণেই ভারতে পেট্রোপণ্যের দামও মাত্রাছাড়া হয়েছিল। এবং সেটাকে পুঁজি করেই ক্ষমতায় এসেছিল বিজেপি। ২০১৬ সালে পেট্রোলিয়ামের দাম সর্বনিম্নে পৌঁছয়, গড়ে ব্যারেল প্রতি ৪৩.২৯ ডলার। এই সময়েই ভারতে পেট্রোল, ডিজেল ও এলপিজি-র দামও কমেছিল, যা আমরা আগেই দেখেছি।
২০১৭ ও ২০১৮-তে দাম খানিকটা বাড়লেও ২০১৯-এ আবার দাম কমে গেল। পরের বছর দাম আবার ব্যাপকহারে কমল। ২০২০ সালের গড় দাম হল ৩৯.২৯ ডলার। ১ জানুয়ারি দাম ছিল ৬১.১৭ ডলার, যা ৩১ ডিসেম্বরে হয় ৪৮.৫২ ডলার। আর এই ডিসেম্বর মাস থেকেই ভারতে পেট্রোপণ্যের দাম বাড়া শুরু হল। ২০২১-এ ১ জানুয়ারি আন্তর্জাতিক বাজারে খনিজ তেলের দাম ছিল ব্যারেল প্রতি ৪৭.৬২ ডলার। ফেব্রুয়ারিতে বেড়ে হল ৬৬.০৯ ডলার। আবার মার্চের ১৯ তারিখে নেমে হয়েছে ৬১.৪৩ ডলার। মার্চে পেট্রোল, ডিজেল বা গ্যাসের দাম কিন্তু কমল না। কেন? আলোচনাটা তাহলে আরেকটু এগোনো যাক।
সেপ্টেম্বর ২০১৬কে ভিত্তি করে খনিজ তেলের দামের ওঠানামার হিসাবটা একবার দেখা যাক—
ডিসেম্বর ২০১৬ | ৫৩.৭৫ ডলার | |
ডিসেম্বর ২০১৮ | ৪৫.১৫ ডলার | হ্রাস ১৬% |
ডিসেম্বর ২০২০ | ৪৮.৫২ ডলার | বৃদ্ধি ৭.৪৬% |
ফেব্রুয়ারি ২০২১ | ৬৬.০৯ ডলার | বৃদ্ধি ৩৬.২১% |
খনিজ তেলের দাম বাড়লে পেট্রোল, ডিজেল বা গ্যাসের দাম বাড়বে, এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। কিন্তু আন্তর্জাতিক দাম যখন অনেকটাই কমে যাচ্ছে, তখন দেশে জ্বালানির দাম কমছে না কেন? কিংবা ২০১৬-র ডিসেম্বরের মাপকাঠিতে বর্তমানে খনিজ তেলের দাম বেড়েছে ২২.৯৯ শতাংশ। তাহলে সেই ভিত্তির সাপেক্ষে পেট্রোলের দাম কেন ৪০ শতাংশ বা ডিজেলের দাম কেন ৫০ শতাংশ বাড়ল? কেন গ্যাসের দাম বাড়ল ৭০ শতাংশ? অর্থনীতি বাদ দিন, সহজ অঙ্কের নিয়মেও কোনও উত্তর পাওয়া যাবে না। অথচ সরকারের নিজেরই ঘোষণা ছিল জ্বালানির দাম খনিজ তেলের দামের ওঠানামার সঙ্গে বাড়বে কমবে। সেটা হচ্ছে কোথায়?
গ্যাসের দাম বাড়লে সাধারণ মানুষের সমস্যা বাড়বেই। কিন্তু এখানে আরেকটা বাড়তি সমস্যাও রয়েছে। ২০১৬ সালে প্রধানমন্ত্রী উজ্জ্বলা যোজনা নামে একটি প্রকল্পের ঘোষণা করা হয়। দারিদ্রসীমার নিচে মহিলাদের বিনামূল্যে গ্যাস সংযোগ দেওয়ার কথা এই প্রকল্পে। এখনও পর্যন্ত ৪ কোটি পরিবার এই প্রকল্পের আওতায় এসেছেন। এঁরা সকলেই বিনামূল্যে গ্যাস সংযোগ মানে একটি সিলিন্ডার, রেগুলেটর, পাইপ ও একটি ওভেন পেয়েছেন। পরবর্তী সিলিন্ডার এদের ভর্তুকিযুক্ত দামেই কেনবার কথা। দাম ক্রমাগত বাড়িয়ে যাওয়ার পরেও এঁদের জন্য আলাদা কোনও ভর্তুকির ব্যবস্থা কিন্তু রাখা হয়নি। আবার এঁদের বিকল্প জ্বালানি অর্থাৎ কেরোসিনের উপর সমস্ত ভর্তুকি বাতিল করা হয়েছে। তার মানে বিকল্প সরিয়ে এদের বাধ্য করা হল বাড়তি দামের সিলিন্ডার কিনতে। এ সেই জনধন অ্যাকাউন্টের কাহিনি। সরকার গরিব মানুষকে বাধ্য করল জিরো ব্যালেন্স অ্যাকাউন্ট খুলতে। না হলে বিভিন্ন খাতের ভর্তুকি পাওয়া যাবে না। তারপর মিনিমাম ব্যালেন্স না থাকার অজুহাতে সমস্ত ব্যাঙ্ক সেইসব অ্যাকাউন্ট থেকে ফাইন হিসাবে টাকা কেটে নিল। একটা দেশের নির্বাচিত সরকার গরিব মানুষের সঙ্গে এমন স্কিমবাজি করে, এমন উদাহরণ পাওয়া সত্যিই খুব মুশকিল। সেই হিসাবে নরেন্দ্র মোদি নিঃসন্দেহে গোটা দুনিয়াকে টেক্কা মারতে পারে।