Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

পুনর্মূষিকো ভব

পুনর্মূষিকো ভব: সতীশ বলরাম অগ্নিহোত্রী | অনুবাদ: অনিতা অগ্নিহোত্রী

সতীশ বলরাম অগ্নিহোত্রী

 

আইআইটি বম্বের কৃতী ছাত্র সতীশ বলরাম অগ্নিহোত্রী ডক্টরেট করেছেন জেন্ডার স্টাডিস-এ। গ্রামীণ কারিগরী, কন্যা শিশুর ক্ষমতায়ন, অপ্রচলিত শক্তির ক্ষেত্রে ফলিত গবেষণায় নিজেকে নিয়োজিত রেখেছেন চার দশক, আইএএস-এর দায়িত্বের পাশাপাশি। হিন্দি ও মারাঠিতে রাজনৈতিক ব্যঙ্গকাহিনি লেখা তাঁর অবসরের নেশা। দুটি গল্পগ্রন্থের প্রণেতা। এখন আইআইটি বম্বের এমিরিটাস ফেলো। 

মূল রচনাটি হিন্দিতে লিখিত। অনুবাদ করলেন অনিতা অগ্নিহোত্রী।

  
ছোটবেলায় পড়া বেতাল পঞ্চবিংশতির কাহিনি মনে আছে নিশ্চয়ই? বেতাল নিজের শব বারবার বইতে বাধ্য করে বিক্রমাদিত্যকে। বওয়ার সময় মৌন ভাঙা চলবে না। ভাঙলে আবার প্রথম থেকে যাত্রা আরম্ভ। আবার ইচ্ছে করে প্রশ্নের উত্তর না দিলে, বিক্রমের মস্তক চুরমার। সেই কাহিনির ধাঁচে লেখা বর্তমান গল্পটির বিক্রমাদিত্য আর কেউ নন, আমাদেরই জনতা জনার্দন বা আমআদমি। গণতন্ত্র বাঁচাতে ভোট দেওয়া যাঁর পবিত্র কাজ। এরই মধ্য এসে পড়ে বেতাল, তার গল্প নিয়ে। আড়াই দশক আগে লেখা গল্পটি পড়লে বোঝা যায়, এখনকার নির্বাচনের প্রাক্কালেও এগুলি কীভাবে একই রকম সত্যি।

 

আম আদমি একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে ভোটকেন্দ্রর ছাদের ওপর পড়ে থাকা বেতালের শব নিজের কাঁধের উপর ওঠাল, তারপর বাড়ির দিকে হাঁটা দিল। বেতাল মনে মনে ওর নিষ্ঠা আর ধৈর্যের তারিফ করল। মুখে বলল, হে আমআদমি। জানি না, বারবার আমার কাছে কি পাওয়ার জন্য তুমি আসো? কোন সে ধ্যানের ধন যা তুমি পেতে চাও! তোমার চেষ্টা দেখে আমার মনে পড়ছে মহর্ষি ভোটারের কথা, যাকে সন্তুষ্ট করার জন্য এক ইঁদুর বারবার চলে আসত। পথ চলার শ্রান্তি দূর করতে এসো তোমাকে ঐ গল্পটা শোনাই।

মরেছে রে! আবার একটা গল্প। মনে মনে বলল আম আদমি। কিন্তু নিজের মৌন ভাঙতে পারবে না, তাই চুপ করে রইল। ওকে চুপ করে থাকতে দেখে বেতাল গল্প বলতে শুরু করে দিল। “গণতন্ত্রের অরণ্যে মহর্ষি ভোটারের দারুণ সমাদর। বড় বড় রাজর্ষি, ব্রহ্মর্ষিরা ওঁর সামনে মাথা নীচু করতে বাধ্য হতেন। কারণ একটাই— মেটামরফসিস বা কায়া পরিবর্তন যজ্ঞ। পাঁচ বছর অন্তর মহর্ষির আবাহন হয় এই যজ্ঞ করার জন্য। কেউ বলতে পারে না, কার পরিবর্তন কীভাবে হবে। মহর্ষি যদি ভ্রূকুটি করেন, প্রার্থী রাজা থেকে পথের ভিখারি হয়ে যাবে, আর ঠোঁটে যদি আসে স্মিতহাস্য, তবে ভিখারি হবে রাজা। মহর্ষি আবার শিবের ভক্ত। শিবেরই মতো তিনি ভোলা আর আশুতোষ। এই জন্য কখনও সখনও রাজা আর তাদের পারিষদরা মহর্ষির ভোলা স্বভাবের অন্যায় সুবিধে নিয়ে থাকেন, কিন্তু দেরি হলেও পাঁচ বছর পর যজ্ঞের সময় মহর্ষি এইসব লোকেদের শায়েস্তা করে দেন।

একবারের কথা। মহর্ষি একটা ছোটখাট যজ্ঞ শেষ করছিলেন, এমন সময় এক ইঁদুর ওঁর পায়ে এসে পড়ল। মহর্ষি কিছুটা আশ্চর্য হয়েই ইঁদুরের দিকে তাকালেন। লম্বা লেজ ধারালো দাঁতের মধ্যে কামড়ে ধরে বিনীত হয়ে ওঁর পায়ে পড়ে আছে ইঁদুর। ‘কী ব্যপার, বাছা মূষিক?’ ‘মহর্ষি, আমি এক তুচ্ছাতিতুচ্ছ ইঁদুর। এই জঙ্গলে আমার কোনও সম্মান নেই। আপনার কায়া পরিবর্তন যজ্ঞের নাম শুনেছি। অনেক আশা নিয়ে আপনার পায়ে এসে শরণ নিলাম। হয় আমাকে বাঁচান নয় মেরে ফেলুন।’

‘আরে, তুই চাস কী?’ মহর্ষি জানতে চাইলেন।

‘কায়া বদল।’ বিনীত হয়ে বলল ইঁদুর। মহর্ষির হাসিই পেল শুনে। মেটামরফসিস। কিন্তু কেমন?

‘বিড়ালদের স্বেচ্ছাচারিতা, অত্যাচারে আমার জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে, মুনিবর। আমাকে আপনি বিড়াল বানিয়ে দিন। বিড়াল হয়ে আমি আমার দলের ইঁদুরদের ভয় আর সন্ত্রাস থেকে মুক্ত করতে পারব।’

মহর্ষির মনে দয়া হল। আহা, ছোট প্রাণী, তার ছোটখাট ইচ্ছে। আচ্ছা, ঠিক আছে এবারকার যজ্ঞে তোমাকে আমি বিড়াল বানিয়ে দিলাম। ইঁদুরদের দল চোখ বড় বড় করে মুনির আশ্চর্য কাণ্ড দেখল। আনন্দে কেউ কেউ বিহ্বল। ‘আমাদের নিজেদের ইঁদুর বিড়াল হয়ে গেছে। বাহ, ভালো দিনের তাহলে আর দেরি নেই।’

কিন্তু বিড়াল হয়েই ইঁদুর মনের আনন্দে কিছুক্ষণ এদিকওদিক দৌড়ে নিল। তারপর নিজের দু-চারজন বন্ধুকে চেটেপুটে খেয়ে নতুন কায়া উপলব্ধি করে ফেলল। কিন্তু এই আনন্দ বেশিদিন স্থায়ী হল না। কিছুদিন পরেই কিন্তু ইঁদুর নিজের অবস্থা নিয়ে অসন্তুষ্ট হয়ে পড়ল। বিড়ালদের দলে অবশ্য ইতিমধ্যে সামিল হতে পেরেছে, কিন্তু ক্ষমতার সমীকরণে কুকুরদের রোয়াব দেখে তার লোভ বেড়ে গেল। আর কতদিন এইভাবে বিড়াল হয়ে থাকা? ভাবতে লাগল ইঁদুর। তারপর আবার এক যজ্ঞের দিন গিয়ে হাজির হল মহর্ষির কাছে।

মহর্ষি প্রথম নজরেই ওকে চিনে গেলেন। ইঁদুর অবশ্য তা বুঝতে পারল না। ভক্তিভরে সাষ্টাঙ্গ নমস্কার করল মুনিকে। মহর্ষি হেসে বললেন, ‘আবার কী সমস্যা হল, ইঁদুর?’ ইঁদুর সম্বোধন ওর ভালো লাগল না। কিন্তু সেদিকে মন না দিয়ে ও মুনির পায়ে লুটিয়ে পড়ে মিনতি করতে থাকল, ‘হে মহর্ষি, আমি বিড়ালের জীবন তো কাটালাম। কিন্তু এখনও কুকুরদের দেখলেই পালাতে হয়। ভালো লাগে না। আমি আরও ওপরে উঠতে চাই, যাতে আমার শোষিত বঞ্চিত অনুগামীদের জন্য আরও বেশি কাজ করতে পারি, ওদের ভয় থেকে মুক্ত করতে পারি।’ মহর্ষির মন ভালো ছিল। হাসলেন। বিশেষ কিছু না ভেবেই ইঁদুরকে বিড়াল থেকে কুকুর বানিয়ে দিলেন। এবার বিপদ নেমে এল কেবল ইঁদুরদের মধ্যেই নয়, বিড়ালদের মধ্যেও। আমাদের ইঁদুরের জানা ছিল এদের আত্মরক্ষার উপায়ের নাড়ীনক্ষত্র। কাজেই অন্য ইঁদুর আর বিড়ালদের অবস্থা আরও অসহায়।

ইঁদুরের লোভ বাড়তেই থাকল। কিন্তু বাস্তবিক ধাক্কা সেদিন খেল যেদিন নেকড়েদের দলের সামনে পড়তে হল ওকে। নিজের দলের কুকুর আর বিড়ালদের ওপর মাস্তানি করা ইঁদুরের মনে নেকড়েকে দেখে ভীষণ ভয় হল, বিড়ালকে দেখে ইঁদুরের মনে যেমন হয়ে থাকে। কিন্তু একদিন রাস্তায় ও একটা বড়সড় নেকড়ের সামনেই পড়ে গেল। ল্যাজ গুটিয়ে পালানো ছাড়া ইঁদুরের কাছে আর কোনও উপায় ছিল না। ক্ষমতার সমীকরণের ব্যাপারটা আর একবার ও বোঝার চেষ্টা করল। নেকড়েদের স্তর এবং অবস্থান দুটোই ওর উচ্চাকাঙ্খা আর লোভকে বাড়িয়ে তুলেছে। ভোটারের আশ্রমে আর একবার গিয়ে উপস্থিত হল আমাদের ইঁদুর। এবার যজ্ঞের বেশ আগেই পৌঁছে গেল আর মহর্ষির সেবাযত্ন আরম্ভ করে দিল। ওঁকে আগলে হাঁটা, রাত জেগে পাহারাদারি, খবর কাগজ এনে দেওয়া আর আরও অনেক কিছু। মহর্ষি ওর কাজ আর বিশ্বস্ততায় খুশি হয়ে উঠেছেন। যজ্ঞের দিন ইঁদুরের সেবাপরায়ণতা একেবারে তুমুল হয়ে উঠল। মহর্ষির ভাবতে লাগলেন, ব্যাপারটা কী, কোথাও কোনও গণ্ডগোল নেই তো? জিজ্ঞেস করেই ফেললেন, ‘কি বাছা ইঁদুর, আবার কিছু…’ এক লহমার জন্য বিরক্তিতে গরগরিয়ে উঠল ইঁদুর। ঠিক আছে, সত্যি হয়তো ও ইঁদুর, তবু বারবার— তবু সময়ের এই মোড়টা খুব সংবেদনশীল। তা আন্দাজ করে কান নাড়াল ও, ল্যাজ নাড়াল আর মিনমিন করে বলল, ‘আমাকে বারবার ইঁদুর বলবেন না মহর্ষি।’

‘ঠিক আছে। কী ব্যাপার বলো।’

‘মহর্ষি, আমাকে আরও ওপরে উঠতে হবে। আমি নেকড়েদের দেখেছি। আমার মনে হচ্ছে সত্যিই যেন কুকুরের জীবন কাটাচ্ছি। যদি কোনও দিন হিংস্র নেকড়ের সামনে পড়ি, তো কুকুরের মরণই মরতে হবে!’

বলতে বলতে ইঁদুরের চোখে জল এসে গেল।

মহর্ষির কেন কে জানে কুমিরের চোখে জল মনে পড়ে গেল। তবুও সহানুভূতির ঢেউ ওঁকে দোলা দিল। কুকুর থেকে নেকড়ে হয়ে গেল ইঁদুর। এখন তো ইঁদুরের দাপট দেখার মত। নেকড়ের চেহারা পাওয়ার পর ওর খ্যাতি সারা জঙ্গলে ছড়িয়ে পড়েছে। এবার খালি ইঁদুর, বিড়াল, কুকুরের মতো জানোয়ারদের মধ্যে সন্ত্রাস তৈরি নয়, নেকড়েরাও ওকে “রাজা নেকড়ে” বলে ডাকতে লেগেছে। কিন্তু বাবারও বাবা আছে। একদিন বাঘের সামনাসামনি হয়ে আমাদের নেকড়েকে পালাতে হল। বাঘের সঙ্গে লড়াই করা কী সম্ভব! বাঘ তো বাঘই। ইঁদুর বুঝতে পারল জঙ্গলের রাজত্বে ক্ষমতার শীর্ষে হল বাঘ। এবার ওকে বাঘ হওয়ার চেষ্টা করতে হবে।

এবার কিন্তু ইঁদুরকে দেখে মহর্ষির ভুরু কুঁচকে উঠল। ওঁর কাছে ইঁদুরের আগেকার সব কারসাজির খবর চলে এসেছে। প্রথম প্রথম তো উনি বিশ্বাস করেননি, তারপর ওঁর কাছে নিশ্ছিদ্র প্রমাণ আর নতুন কার্যকলাপের খবরও আসতে লেগেছে। ইঁদুরও তা আন্দাজ করতে পেরেছিল। কিন্তু এবার ও এমন বাক্যবিস্তার করতে থাকল যে মহর্ষি আর একবার কথায় ভুলে গেলেন। সত্যিই তো, সেভাবে দেখলে উনি নিজেই তো ওকে এই পর্যন্ত এনেছেন, আর ইঁদুর যখন নেকড়েবাঘ হয়েছে নেকড়ের কিছু ধর্ম তো ওকে পালন করতেই হবে। আর কোন্ প্রাণী ভুল করে না? মহর্ষির ওপর তো ইঁদুর ভুলেও উৎপাত করেনি। শেষবারের মত একটা সুযোগই তো চাইছে। সারাজীবন ঋণী থাকবে। মুনি একবার ওকে বাঘ বানিয়ে দিন।

তাই হল। এবার কায়াবদল যজ্ঞে মুনি ইঁদুরকে বাঘ বানিয়ে দিলেন। ইঁদুরের মাথা গিয়ে আকাশে ঠেকল। এখন ও সারা জঙ্গলে নিজের শাসন চালানোর জন্য স্বাধীন। শাসনও যেমনতেমন নয়, নিরঙ্কুশ শাসন। সেটাই নিয়মে দাঁড়াল। এবার কারও রক্ষা নেই। ইঁদুরের ক্ষমতা আর স্বৈরাচার বেড়েই চলেছে। শীগগিরই এমন দিনও এসে গেল যখন ভোটার মুনির আশ্রমকেও নিজের হাতের বাইরে মনে করল না ইঁদুর। আশ্রমের এক হরিণের পিছু ধাওয়া করতে করতে ও আশ্রমের সীমার ভিতরে ঢুকে পড়ল। ভীত হরিণ গিয়ে আশ্রয় নিল মুনির ঘরের ভিতর। সাতপাঁচ ভেবে দরজার কাছেই দাঁড়িয়ে রইল বাঘ। আর সেখান থেকেই হুঙ্কার দিতে লাগল।

ভোটারের ধ্যান ভেঙে গেল। চোখ খুলে দেখলেন, সামনেই গর্জন করছে বাঘ। কিন্তু ওঁর অনুসন্ধানী চোখ ইঁদুরকে চিনতে ভুল করল না। বাইরে হেসে, সংযত কণ্ঠে বললেন, ‘কী ব্যাপার, ইঁদুর?’

ইঁদুর গরগর করে উঠল। ‘আমাকে ইঁদুর বলবেন না। আমি বাঘ, জঙ্গলের রাজা। এই হরিণ আমার শিকার।’

‘আচ্ছা, ব্যাপার এতদূর গড়িয়েছে।’ মহর্ষি গম্ভীর হয়ে বললেন। ‘তুমি জানো, এ আমার আশ্রমের হরিণ।’

‘আশ্রমের হরিণের ওপরও আমার অধিকার আছে।’

ইঁদুর গর্জাল। ‘আমি এখন গণতন্ত্র-জঙ্গলের রাজা।’

‘নিজের অতীত তুমি ভুলে গেছ? বেড়াল, কুকুর, নেকড়েদের ওপর আতঙ্ক, অত্যাচার আর কুশাসনের শেষ করবে এই প্রতিজ্ঞা করে নিজের রূপ বদল করিয়েছিলে। আজ তুমি নিজেই হয়ে দাঁড়িয়েছ অনাচারের প্রতিমূর্তি। এখনও সময় আছে। ভেবে দেখো, কী করছ!’

‘আমার উপদেশ চাই না, হরিণ চাই।’ ইঁদুর গর্জন করল।

‘যদি না দিই?’

‘তাহলে আপনি নিজেই নিজের শেষ ডেকে আনছেন।’

ইঁদুর পা গুটিয়ে মহর্ষির ওপর লাফ দিতে তৈরি হল। রেগে লাল মুনিবর। তাঁর হাত আগেই উঠেছিল। এবার মুখ থেকে শাপ বেরোল, “পুনর্মূষিকো ভব।”

এ কী! বাঘরূপী ইঁদুরের মুখ থেকে গর্জন, গরগর শব্দ কিছুই শোনা গেল না। কুকুরের ডাক, বিড়ালের ম্যাও কিছুই না। হাওয়ায় ভেসে থাকা ওর শরীর আবার সত্যিই এক ইঁদুরে বদলে গেছে। মহর্ষির পায়ে লুটিয়ে পড়তেই ওর মুখ দিয়ে চিঁ চিঁ আওয়াজ বেরোতে লাগল। চোখের সামনে নিজের অতীত যেন ছায়াছবির মতো ভেসে গেল। কোথা থেকে কোথায় পৌঁছেছিল, কোথায় ফিরে এসেছে আবার। মাথা ঠান্ডা হয়েছে। মহর্ষির দয়া ভিক্ষে করে হয়তো কিছু চাইত, তার আগেই চোখের কোণ দিয়ে দেখল এক পাটকিলে বিড়াল ওকে তাক করে লাফ দিতে উদ্যত। আপনি বাঁচলে বাপের নাম। এই ভেবে পালাবার চেষ্টা করল ইঁদুর। কিন্তু বিড়াল ওর চেয়েও চটপটে। দুই পা এগিয়ে এসে ইঁদুরের গলা চেপে ধরল। চোখ বন্ধ করে মৃত্যুর জন্য তৈরি হল ইঁদুর। কিন্তু এ কী হল? বিড়াল বার দুয়েক ওকে নিজের থাবার উপর উল্টেপাল্টে, শুঁকে দেখল, তারপর থাবার ঘায়ে আশ্রমের বাইরে পাঠিয়ে দিল। বেচারা ইঁদুর নিজের গর্তের কাছাকাছিই গিয়ে পড়েছিল। আর কিছু না ভেবে ও গর্তের মধ্যেই ঢুকে গেল।”

গল্প শেষ করে বেতাল আমআদমিকে জিজ্ঞেস করল, আমার আশ্চর্য লাগছে যে ইঁদুর কীভাবে বেঁচে গেল? পাটকিলে বিড়াল ওকে ধরার পরও ছেড়ে দিল কেন? যদি জেনেশুনে প্রশ্নের উত্তর না দাও, তা হলে তোমার মুণ্ডু টুকরো টুকরো হয়ে পোলিং বুথের মধ্যে ছড়িয়ে পড়বে। আমআদমি আর একবার দীর্ঘনিশ্বাস ফেলল। বলল, “বেতাল, আমি জানতাম তুমি এমন সহজ প্রশ্নই জিজ্ঞাসা করবে। পাটকিলে বিড়ালটা ছিল ইঁদুরেরই অনুগামীদের একজন। আমাদের ইঁদুরকে ওপরে উঠতে দেখে এও মহর্ষির কাছে গিয়েছিল। মহর্ষি গতবারের কায়াবদল যজ্ঞে একে বিড়াল বানিয়ে দিয়েছিলেন। বিড়াল ইঁদুরকে ধরার আগেই জেনে গিয়েছিল যে এ বাঘ থেকে ইঁদুর হয়েছে। তারপর ওর একথাও মনে পড়ে গেল যে, ইঁদুর থেকেই এ বাঘ হয়েছিল একদিন। এইজন্য বিড়ালের পরিকল্পনা বদলে গেল। বুঝতে পারল, যে কোনও দিন ওর নিজের অবস্থাও এমনি হতে পারে। হয়তো ও নিজেই কোনও কুকুরের হাতে পড়ল। বিড়ালের মনের ভিতর সহানুভূতি আর স্বার্থের এই সমাপতনই ইঁদুরের প্রাণ বাঁচিয়ে দিল। ভবিষ্যতে, হেরে যাওয়া অত্যাচারী বাঘেদের জীবনও এইভাবেই রক্ষা পাবে। ওদের জায়গা যারা নেবে, তারাই ওদের প্রাণ বাঁচাবে।”

“দারুণ! ওহে আমআদমি, তুমি গণতন্ত্রের অন্ধিসন্ধি ভালোই বোঝো দেখছি।” বেতাল বলে উঠল। কিন্তু আমআদমির মৌন ভঙ্গ হয়ে গেছিল, তাই বেতাল আবার উড়ে গিয়ে ভোটকেন্দ্রর ছাদে গিয়ে বসল। আমআদমি একবার ওর দিকে বিষণ্ণভাবে তাকিয়ে ভোটের লাইনে গিয়ে দাঁড়াল।