আবুল আহসান চৌধুরী
লোকসংস্কৃতি গবেষক, প্রাবন্ধিক, প্রাক্তন অধ্যাপক
বাঙালি জনজাতির স্বাধীনতার আকাঙ্খা যথেষ্ট প্রাচীন। এই স্বাধীনচেতা জাতি বহিরাগত শক্তি কিংবা কেন্দ্রীয় শাসকদের বশ্যতা স্বীকারে স্বভাবতই নারাজ ছিল। তাই ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়— মুক্তির উন্মাদনায় তারা বারবার বিদ্রোহী হয়ে উঠেছে। প্রবল প্রতাপশালী শাসকশ্রেণির বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করেছে। তবে মূলত এই ধরনের প্রয়াস ছিল আঞ্চলিক পর্যায়েই সীমিত। তা কখনও গোটা বাঙালি জাতিকে ঐক্যবদ্ধ কিংবা সমন্বিত স্বার্থে সংগ্রাম-লড়াই-যুদ্ধে অবতীর্ণ করাতে পারেনি। এর কারণ বাঙালির রাষ্ট্রীয় ঐক্য কিংবা জনগণের সংহতি অভিন্ন আদর্শ চেতনায় কখনও গড়ে ওঠেনি যোগ্য নেতৃত্বের অভাবে।
তাই বাঙালির হাজার বছরের ইতিহাসে কখনও সার্বভৌম স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনের আকাঙ্খা ফলপ্রসু হয়ে ওঠেনি। বহু যুগ পরে সেই স্বপ্ন পূরণ হয়েছে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মাধ্যমে। তাঁর রাজনৈতিক প্রজ্ঞা, দূরদৃষ্টি, নির্ভীকতা, অসামান্য সাংগঠনিক ক্ষমতা, জাতির প্রাণস্পন্দনকে অনুভব করার শক্তি, অনন্য দেশপ্রেম— এ সব কিছুই তাঁকে বাঙালির জাতীয় জীবনে মহানায়কে পরিণত করেছে। কোনও জাতি যেমন তিল তিল করে গড়ে তোলে তার জাতীয় মহাকাব্য, বঙ্গবন্ধু ছিলেন এমনই একজন রাজনীতির মহাকবি যিনি তাঁর মেধা-শ্রম-প্রজ্ঞা-সাহস দিয়ে বহু মণীষীর— বহু মানুষের বহুকালের আকাঙ্খার রূপ দিয়েছেন— বাঙালির স্বাধীনতার স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করেছেন ‘বাংলাদেশ’ নামক রাষ্ট্রের জন্ম দিয়ে।
বাঙালির ইতিহাসের আধুনিক পর্বে তার স্বাধীনতার আকাঙ্খা তীব্র ও প্রবল হয়ে উঠেছিল। কিন্তু ব্রিটিশের ভেদনীতি এবং জাতিগত স্বাতন্ত্র ও বৈর মনোভাব বাঙালি জাতিগোষ্ঠীকে সবসময় বিভেদ-অনৈক্য-বিরোধে জর্জরিত করে রেখেছে। দ্বিজাতিতত্ত্বের অহিফেন ও সাম্প্রদায়িকতার বিষবৃক্ষ বাঙালির ঐক্যের পথে বড় ধরনের বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। এই চেতনা নিয়েই সাতচল্লিশের দেশভাগ আর ‘পাকিস্তান’ নামক এক অবাস্তব রাষ্ট্রের জন্ম। কিন্তু পূর্ববঙ্গের সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালি জনগোষ্ঠীর মোহভঙ্গ হতে বিলম্ব হয়নি। এই রাষ্ট্রের জন্মলগ্ন থেকেই পূর্ববঙ্গের বাঙালি জনগোষ্ঠী যে বিরূপ অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয় তাতে তথাকথিত স্বাধীনতার স্বাদ হয়ে ওঠে তিক্ত। জাতিগত নিপীড়ন, রাজনৈতিক বঞ্চনা, অর্থনৈতিক শোষণ, সাংস্কৃতিক দলন— নতুন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্মলগ্ন থেকেই বাঙালিকে করে তোলে হতাশ, ক্ষুব্ধ, প্রতিবাদী ও দ্রোহী। তার প্রকাশ ঘটে আটচল্লিশ ও বাহান্নর ভাষা আন্দোলনে, চুয়ান্নর যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে, বাষট্টির শিক্ষা কমিশন রিপোর্ট বাতিলের আন্দোলনে, তেষট্টি-চৌষট্টি থেকে স্বৈর-সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে সংগ্রামে, ছেষট্টির বাঙালির মুক্তিসনদ ছয় দফা দাবি পেশে, আটষট্টির কথিত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায়, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানে, সত্তরের সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভে এবং চূড়ান্ত পর্যায়ে একাত্তরে বাঙালি সার্বিক মুক্তির লড়াইয়ে। এই যে বাঙালির জাগরণ— জাতিসত্তার উদ্বোধন— ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদের জন্ম— মুক্তির আকাঙ্খাকে বাস্তব রূপদানের প্রক্রিয়া— পরোক্ষ-প্রত্যক্ষভাবে— এই ধারাবাহিক লড়াই-আন্দোলন-সংগ্রামের কেন্দ্রীয় চরিত্র হয়ে উঠেছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
দুই
উনিশশো একাত্তর— বাঙালির ইতিহাসে এই সালটির গুরুত্ব ও তাৎপর্য অপরিসীম। নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভের পরেও পাক সামরিক জান্তার নেপথ্য চক্রান্ত ও ক্ষমতালোভী রাজনীতিকদের প্রাসাদ-ষড়যন্ত্রের কারণে আওয়ামী লীগকে শাসনক্ষমতায় যেতে দেওয়া হয়নি। এর বিরুদ্ধে বাংলার আপামর মানুষ বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। ধীরে ধীরে তারা এগিয়ে যায় চূড়ান্ত পরিণতির দিকে— এক দফা অর্থাৎ স্বাধীনতার দাবির লক্ষ্যে। শুধু অপেক্ষায় থাকতে হয় একটি কণ্ঠস্বরের উচ্চারণ ও নির্দেশনার। ৭ মার্চ বাঙালি জাতির জীবনের সেই বহু প্রতীক্ষিত মাহেন্দ্রক্ষণ। বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে লক্ষ জনতার সম্মুখে পেশ করলেন তাঁর ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ— বঙ্গবন্ধুর জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ ভাষণ— এবং বিশ্বের শোষিত মুক্তিকামী মানুষের জন্যে প্রেরণাদীপ্ত এক ধ্রুপদী ভাষণ।
বাঙালির ইতিহাসের এক সন্ধিক্ষণে— এক ক্রান্তিলগ্নে বঙ্গবন্ধু তাঁর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ দান করেছিলেন। সমগ্র জাতি সেদিন উৎকণ্ঠা ও প্রত্যাশা নিয়ে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শোনার জন্য উৎকর্ণ হয়েছিল। এক নতুন দিশালাভের প্রত্যাশায় উন্মুখ হয়েছিল। বাংলা আর বাঙালির ভাগ্য যেন নির্ভর করছিল একজন মানুষের বক্তব্যের ওপরে। কখনও কখনও কোনও বাক্য হয়ে ওঠে বাণী— কোনও মন্তব্য পায় প্রবচন বা সুভাষণের মর্যাদা। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ বিশ্লেষণ করলে আমরা সেইরকম এক অসামান্য অমৃত বাক্যবাণীর সন্ধান পেয়ে যাই।
তিন
‘রাজনীতির কবি’র ৭ মার্চের ভাষণকে একালের এক কবি, নির্মলেন্দু গুণ, ভাষণ বা বক্তৃতা না বলে বলেছেন ‘কবিতা’। কবির স্মৃতি-বর্ণনার সেই পঙক্তিমালায় ধরা পড়ে দীর্ঘ প্রহর অপেক্ষমান ‘বিদ্রোহী শ্রোতা’র আগ্রহ-উদ্বেগ-অনুরাগের কথা:
একটি কবিতা লেখা হবে তার জন্য অপেক্ষার উত্তেজনা নিয়ে
লক্ষ লক্ষ উন্মত্ত অধীর ব্যাকুল বিদ্রোহী শ্রোতা বসে আছে
ভোর থেকে জনসমুদ্রের উদ্যান সৈকতে—
‘কখন আসবে কবি?’
তারপর একসময় লক্ষ মানুষের ‘ব্যাকুল প্রতীক্ষা’র অবসান ঘটিয়ে অবশেষে কবি এলেন:
শত বছরের শত সংগ্রাম শেষে রবীন্দ্রনাথের মতো দৃপ্ত পায়ে হেঁটে
অতঃপর কবি এসে জনতার মঞ্চে দাঁড়ালেন।
তখন পলকে দারুণ ঝলকে তরীতে উঠিল জল,
হৃদয়ে লাগিল দোলা
জনসমুদ্রে জাগিল জোয়ার সকল দুয়ার খোলা—
কে রোধে তাঁহার বজ্রকণ্ঠ বাণী?
গণসূর্যের মঞ্চ কাঁপিয়ে কবি শোনালেন তাঁর অমর কবিতাখানি:
‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম,
এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’
সেই থেকে ‘স্বাধীনতা’ শব্দটি আমাদের।
বঙ্গবন্ধুর মাত্র ১৯ মিনিটের এই ভাষণ যেন ছোটগল্পের সংজ্ঞার মত— ‘বিন্দুর মধ্যে সিন্ধুর গভীরতা’। ভাষণটি পর্বে পর্বে বিশ্লেষণ-বিন্যাস করলে পাওয়া যায়: শোক-বেদনা, আশাভঙ্গের ক্ষোভ-আক্ষেপ, বৈষম্য-বঞ্চনার খতিয়ান, সামরিক শাসনচক্রের কুটিল-কপটতা, সমদর্শীর মহানুভবতা, মানবিক-অসাম্প্রদায়িক দৃষ্টি, প্রশাসনিক নির্দেশনা, প্রতিরোধের আহ্বান, মুক্তির স্বপ্ন, স্বাধীনতার আকাঙ্খা। বঙ্গবন্ধুর দিক-নির্দেশী ঘোষণার মধ্যে দিয়ে নিস্তরঙ্গ জনসমুদ্র যেন মুহূর্তে ‘জয় বাংলা’ ধ্বনিতে উত্তাল-মুখরিত হয়ে উঠল। পরাধীনতার শেকল ছেঁড়ার মন্ত্রে উদ্বুদ্ধ হয়ে উঠল জনগণ— সেই মুহূর্ত থেকেই যথার্থ অর্থেই ‘স্বাধীনতা’ শব্দটির অধিকার অর্জন করল বাঙালি। তাই বলা যায়, ৭ মার্চের ভাষণই এক অর্থে স্বাধীনতার ঘোষণা— এরপর ২৫ মার্চ মধ্যরাতে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা অনেকটাই আনুষ্ঠানিকতা মাত্র।
চার
বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণে সারা দেশের মানুষ অভিভূত-উদ্বেলিত-উজ্জীবিত-সম্মোহিত হয়েছিল। এ-এক অনির্বচনীয় অভিজ্ঞতা— এ-এক ঘোর লাগা বিস্ময়ের অপরাহ্ন। কলকাতায় নির্বাসিত অযোধ্যার শেষ নবাব ওয়াজিদ আলী শাহের দু পংক্তির একটি শের-শায়রি দিয়ে জনমানুষের উপলব্ধি-অভিব্যক্তি অনেকখানি প্রকাশ করা যায়: ‘খোয়াব থা জো কুছ ভি দেখা, জো শুনা আফসানা থা।’ অর্থাৎ ‘যা কিছু দেখেছি, সবই স্বপ্ন— যা কিছু শুনেছি, সবই কাহিনি’। বঙ্গবন্ধুর নাটকীয় বিন্যাসে রচিত ভাষণ— বজ্রকণ্ঠের উদাত্ত আহ্বান— উপস্থিত জনতাকে এতটাই অভিভূত-সম্মোহিত করেছিল তাদের উপলব্ধিতে বাস্তবও যেন স্বপ্ন আর কাহিনির রূপ নিয়ে উপস্থিত হয়েছিল। এই ভাষণে বঙ্গবন্ধু জনগণকে স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন— সে স্বপ্ন স্বাধীনতার। আখ্যান শুনিয়েছিলেন— সে কাহিনি বঞ্চিতের, শোষিতের। ৭ মার্চের ভাষণ তাই হয়ে উঠেছিল স্বপ্ন থেকে জাগরণের— কাহিনি থেকে বাস্তবে অবতরণের মন্ত্র।
এক হাজার একশো সাতটি শব্দে গাঁথা উনিশ মিনিটের এই অলিখিত ভাষণে একটি শোষিত জনজাতির স্বাধীনতার স্বপ্ন-শতদল ধীরে ধীরে পাপড়ি মেলেছে। কেন মুক্তি কাম্য বাঙালি জাতির, তার পূর্ব-প্রেক্ষাপট ও কার্য-কারণ ইতিহাসের সিঁড়ির ধাপ বেয়ে প্রকাশ পেয়েছে। আবেগ ও যুক্তি হাত ধরাধরি করে এখানে পথ চলেছে। ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাজপথ রঞ্জিত হয়েছে’, তাই ইতিহাসের মহানায়ক ‘দুঃখভারাক্রান্ত মন নিয়ে’ মুক্তিপাগল জনতার মুখোমুখি হন। তারপর তিনি সেই অমোঘ সত্যের ঝর্নার মুখ দেন খুলে— মুজিবকণ্ঠ লক্ষ কণ্ঠের স্বর নিয়ে জেগে ওঠে: “আজ বাংলার মানুষ মুক্তি চায়, বাংলার মানুষ বাঁচতে চায়, বাংলার মানুষ তার অধিকার চায়।” এই আকাঙ্খার কথা— এই অসন্তোষের কথা— এই দাবির কথা উঠে আসে বঞ্চনা-অবহেলা-নিগ্রহ-শোষণ-অত্যাচারের অভিজ্ঞতার আলোকে। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় নির্বাচনে জয়লাভ করেও শাসনক্ষমতায় আসতে না দেওয়ার পাকিস্তানি ঐতিহ্যের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে বর্তমান ঘটনাবলির গতিপ্রকৃতি বিশ্লেষণ করে সেই একই আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন।
পাঁচ
বাঙালির মুক্তি-আন্দোলনে বঙ্গবন্ধু পর্যায়ক্রমে দুটি রাজনৈতিক কৌশল গ্রহণ করেছিলেন: প্রথমে অহিংস-অসহযোগ পন্থা এবং চূড়ান্ত পর্যায় সশস্ত্র লড়াই। তিনি সবসময়েই শান্তিপূর্ণ আলোচনার মাধ্যমে ক্ষমতা হস্তান্তরের পক্ষে ছিলেন। গণতান্ত্রিক রীতিনীতিকে শ্রদ্ধা করতেন বলেই তিনি প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন: “আমি শুধু বাংলার নয়, পাকিস্তানের মেজরিটি পার্টির নেতা হিসেবে তাঁকে অনুরোধ করলাম ১৫ই ফেব্রুয়ারি তারিখে আপনি জাতীয় পরিষদের অধিবেশন দেন। তিনি আমার কথা রাখলেন না। তিনি রাখলেন ভুট্টোসাহেবের কথা। তিনি বললেন প্রথম সপ্তাহে মার্চ মাসে হবে। আমরা বললাম, ঠিক আছে আমরা অ্যাসেম্বলিতে বসব।” ইয়াহিয়ার পক্ষপাতিত্ব ও ভুট্টোর চক্রান্ত-ষড়যন্ত্রের পাশাপাশি বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক সততা ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের পরিচয় মেলে এই কথায়: “অ্যাসেম্বলির মধ্যে আলোচনা করব, এমনকি আমি এও পর্যন্ত বললাম, যদি কেউ ন্যায্য কথা বলে, আমরা সংখ্যায় বেশি হলেও একজনও যদি হয় সে, তার ন্যায্য কথা আমরা মেনে নেব।” বঙ্গবন্ধু তাঁর স্বভাবসুলভ রাজনৈতিক উদারতা দেখিয়ে অন্য দলগুলোকে বলেছিলেন: “আপনারা আসুন, বসুন, আমরা আলাপ করে শাসনতন্ত্র তৈয়ার করি।” কিন্তু পাকিস্তানি রাজনীতির গোপন চক্রান্তে অ্যাসেম্বলির আহুত অধিবেশন স্থগিত ঘোষিত হয়। বঙ্গবন্ধুর কাছে ধীরে ধীরে এদের শঠতার ও ক্রূরতার মুখোশ উন্মোচিত হতে লাগল। ফলে ‘এদেশের মানুষ প্রতিবাদমুখর হয়ে উঠল’। বঙ্গবন্ধু হরতাল-অসহযোগ সহ ‘শান্তিপূর্ণ সংগ্রাম’ পরিচালনা আহ্বান জানালেন জনগণের কাছে।
দেশের পরিস্থিতি দ্রুত পাল্টে যেতে শুরু করল। বাস্তবতা বঙ্গবন্ধুকে ক্রমশ কঠোর সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য করল। ১০ মার্চ গোলটেবিল বৈঠকের দিন ধার্য করে পাক সামরিক সরকার। বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চের ভাষণে স্পষ্ট উচ্চারণ করেন: “রক্তের দাগ শুকায় নাই।… ওই শহীদদের রক্তের উপর দিয়ে… আরটিসিতে মুজিবুর রহমান যোগদান করতে পারে না।” ২৫ মার্চ অ্যাসেমব্লির বৈঠক ডাকা হয়। বঙ্গবন্ধু দেওয়ালের লিখন পড়তে জানতেন— জনগণের নাড়ীর খবর রাখতেন। তাই তিনি কঠিন শর্ত জুড়ে দিলেন অধিবেশনে যোগদানের জন্য: “সামরিক আইন মার্শাল ল উইথড্র করতে হবে। সমস্ত সামরিক বাহিনির লোকদের ফেরত নিতে হবে। যেভাবে হত্যা করা হয়েছে তার তদন্ত করতে হবে। আর জনগণের প্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে। তারপর বিবেচনা করে দেখব আমরা অ্যাসেম্বলিতে বসতে পারব কি পারব না। এর পূর্বে অ্যাসেম্বলিতে বসতে আমরা পারি না।” জনগণই ছিল বঙ্গবন্ধুর আরাধ্য— তাঁর শক্তির উৎস— তাঁর আশা-আকাঙ্খার প্রতীক। তাই ক্ষমতার সিঁড়িতে পা দিয়েও তুচ্ছ-অগ্রাহ্য করতে পারেন ক্ষমতাকে— নির্লোভ জননায়কের মতো বলতে পারেন: “আমি প্রধানমন্ত্রিত্ব চাই না। আমি এদেশের মানুষের অধিকার চাই।”
যত দিন এগোচ্ছিল, বঙ্গবন্ধু ঝড়ের পূর্বাভাস পাচ্ছিলেন। তাই তিনি নির্দেশ দিয়ে রাখলেন: “প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো। তোমাদের যা কিছু আছে তাই দিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করতে হবে।” তাঁর নিজের জীবন যে-কোনও মুহূর্তে বিপন্ন হতে পারে, এমন আশঙ্কায় তিনি— “আমি যদি হুকুম দেবার না পারি”— এই কথা বলে জনগণের কাছে তাঁর নির্দেশ জারি করেছিলেন। শত্রুপক্ষকে হুঁশিয়ার করে দিয়ে বলেছিলেন: “আমরা ভাতে মারব। আমরা পানিতে মারব।” যে-জাতি রক্ত দিতে জানে, সে-জাতির উত্থান কেউ কখনও রোধ করতে পারে না— এ-সত্য বঙ্গবন্ধু জেনেছিলেন ইতিহাসের আলোকে— নিজের জীবন-অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে। তাই প্রত্যয়ের অহঙ্কারে বলতে পেরেছিলেন: “সাত কোটি মানুষকে দাবায়ে রাখতে পারবা না। আমরা যখন মরতে শিখেছি, তখন কেউ আমাদের দাবাতে পারবা না।” যত সমাপ্তির দিকে তাঁর বক্তব্য ধাবিত হয়েছে— ততই তার অর্থ-ব্যঞ্জনা স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হয়েছে। যেমন: “মনে রাখবা, রক্ত যখন দিতে শিখেছি, রক্ত আরও দেব— এদেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাআল্লাহ।” ভাষণ সমাপ্ত করলেন মুক্তির মূল মন্ত্র উচ্চারণ করে: “এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম— এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।”
ছয়
বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ মাত্রা-আয়তন-বৈশিষ্ট্যে মানবিকীবিদ্যার অনেক শাখাকে স্পর্শ করেছে। এই ভাষণের রাজনীতি-সমাজ-ইতিহাস-দর্শন-মনস্তত্ত্ব-লোকতত্ত্ব-ভাষাতত্ত্ব-যোগাযোগ বিজ্ঞান-শিল্পতত্ত্ব— নানা আঙ্গিকে বিশ্লেষণ সম্ভব। লোকবিজ্ঞানী শামসুজ্জামান খান বঙ্গবন্ধুর এই ভাষণকে ‘লৌকিক ভাষাভঙ্গি ও বাকপ্রতিমা’র আলোকে বিশ্লেষণ করেছেন। অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক এই ভাষণে ‘যোগাযোগ বিজ্ঞানের তাত্ত্বিক প্রয়োগ’ সম্পর্কে আলোকপাত করেছেন। অধ্যাপক খন্দকার আশরাফ হোসেন বঙ্গবন্ধুর ভাষণের সঙ্গে ইতিহাস ও শৈল্পিক-সংশ্লেষের আভাস দিয়েছেন। আরও নানা কৌণিকে এর বিশ্লেষণ-মূল্যায়ন হতে পারে— হওয়া উচিত।
৭ মার্চের এই ভাষণে যে প্রবচনতুল্য পঙক্তিগুলি বক্তব্যকে সংহত ও শাণিত ও শিল্পিত করে তুলেছে তার কিছু নমুনা এখানে উল্লেখ করা চলে। যেমন— ‘আজ বাংলার মানুষ মুক্তি চায়, বাংলার মানুষ বাঁচতে চায়, বাংলার মানুষ তার অধিকার চায়’, কিংবা— ‘মুমূর্ষু নর-নারীর আর্তনাদের ইতিহাস’, আবার— ‘আমরা ভাতে মারব। আমরা পানিতে মারব।’ শব্দের ব্যঞ্জনা বক্তব্যকে গভীরতা দান করেছে, এমন উদাহরণ: ক. ‘আজ দুঃখভারাক্রান্ত মন নিয়ে আপনাদের সামনে হাজির হয়েছি’, খ. ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাজপথ রঞ্জিত হয়েছে’, গ. ‘রক্তের দাগ শুকায় নাই।’ আবার ‘দাবায়ে’, ‘দাবাতে’, ‘পারবা’, ‘রাখবা’, ‘দেবার’— এইসব আঞ্চলিক বুলি চমৎকার মানিয়ে গেছে তাঁর বক্তব্যের সঙ্গে। সম্বোধনে মানুষকে কাছে টানা— আপন করে নেওয়া— এ-ছিল বঙ্গবন্ধুর স্বভাবসুলভ বৈশিষ্ট্য। আনুষ্ঠানিক বক্তৃতাতেও তার ব্যত্যয় হয়নি। ৭ মার্চের ভাষণ শুরু করেছিলেন ‘আপনাদের’, ‘আপনারা’ বলে— ভাষণের নির্দেশনা-পর্যায়ে সেই সম্বোধন পরিবর্তিত হয়ে গেল ‘তোমাদের’, ‘তোমরা’-তে। অবশ্য শ্রেণীবিশেষে পূর্বের সম্বোধন অপরিবর্তিত থেকেছে। বঙ্গবন্ধু ছিলেন বিশাল হৃদয়ের মানুষ— সমদর্শী, অসাম্প্রদায়িক। ধর্ম বা ভাষার ভিন্নতাকে তিনি কখনওই মিলন বা ঐক্যের অন্তরায় ভাবেননি। মানবিক বোধে উদ্বুদ্ধ হয়ে তাই তাঁর ভাষণে বলেছেন: “এই বাংলায় হিন্দু-মুসলমান, বাঙালি-নন বাঙালি যারা আছে তারা আমাদের ভাই। তাদের রক্ষার দায়িত্ব আপনাদের উপরে, আমাদের যেন বদনাম না হয়।” উদার মানবিক চেতনা মানুষ ও রাজনীতিক মুজিবের মধ্যে কী পরিমাণে ছিল, সেই দৃষ্টান্তও মেলে এই উক্তি থেকে।
সাত
বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ বাংলার মানুষের মনে যে কী বিপুল সাহস, উৎসাহ, উদ্দীপনা জুগিয়েছিল সে-কথা আজ ইতিহাসের অন্তর্গত। এই ভাষণের প্রেরণায় বাঙালির যে অটুট ঐক্য গড়ে উঠেছিল তা তুলনাহীন— আগে-পরে আর কখনও হয়নি। মানুষের মনে যে গভীর দাগ কেটেছিল তা মানুষকে মুক্তির আকাঙ্খায় উদ্বুদ্ধ করেছিল। মুক্তির চেতনায় কত কবিতা-গল্প লেখা হল, বাঁধা হল গান— ঘুচে গেল শহর আর গ্রামের ব্যবধান— উচ্চ আর নিম্নবর্গের ফারাক। শহুরে কবির মতো গ্রামের কবিও— নিরক্ষর, কবিতার প্রসাধন-প্রয়োগে নিরুপায় কবিও— গান বাঁধলেন, কবিতা লিখলেন। এমন একজন লোককবির সন্ধান পাওয়া যায়, তাঁর নাম রওশন আলি, সাকিন পুরাতন কুষ্টিয়া, পোস্ট হাটশ হরিপুর, জেলা কুষ্টিয়া। তিনি লিখতেন হেটো কবিতা-পথুয়া কবিতা। আট পাতার ছাপা কবিতা হাটে-বাজারে-গঞ্জে-মেলায় সুর করে গেয়ে শোনাতেন। তিনি লিখেছিলেন— ‘নব যুগ— নব লীলা বাঙলাদেশের ইতিহাস’ নামে হেটো কবিতা। আট পাতায় বাংলাদেশের জন্মের কাহিনি। আমরা সেই নিরক্ষর গ্রাম্যকবির ভাব-ভাষা-ছন্দলালিত্যহীন কবিতার কয়েকটি পংক্তি এখানে তুলে ধরি, যার মধ্যে ৭ মার্চের ভাষণের কথা আছে— আছে ইয়াহিয়ার শঠতা আর পাকবাহিনির অত্যাচারের কাহিনি:
১৯৭১ সাল ৩রা মার্চ বুধবার দিনে
ঢাকার হলে মিটিং কল করলেন রাজ আইনে
ভুট্ট বলেন কুমন্ত্রণে মিটিং এবার বন্ধ থাক
কালসাপেতে বাজায় কাশি ভালুক বাজায় ঢাক।
৮ই মার্চ সোমবার বেলা ৮টার সময়
সেখ মজিবর ভাষণ দিয়া জানাই রেডিয়ায়।
খাজনা ট্যাক্স বন্ধ কর দিবেন না কেহ কাহাক
কালসাপেতে বাজায় কাশি ভালুক বাজায় ঢাক।
স্কুলকলেজ কোটকাচারী বন্ধ সব রবে
যতদিন আমার পুনঃআদেশ নাহি পাবে
শুনে খুসি হয় সবে চৈত্রিক মাসে বিভ্রাট যাক
কালসাপেতে বাজায় কাশি ভালুক বাজায় ঢাক।
২৫শে মার্চ প্রেসিডেন্ট করিয়া চাতুরি
গভির নিশিযোগে মজিবরে বন্দি করি
উড়োজাহাজে উড়ান ছাড়ি রাওয়ালপিন্ডি লয়ে যায় তাহাক
কালসাপেতে বাজায় কাশি ভালুক বাজায় ঢাক।
সামরিক শাসনে কড়া আদেশ করলেন জারি
পূর্ব্ববঙ্গ শ্মশান কর কর না আর দেরী
আওয়ামি লীগে[র] নেতা ধরি খুলে দেও তার আঁখ
কালসাপেতে বাজায় কাশি ভালুক বাজায় ঢাক।
লুটতারাজ ঘর জ্বালান নারী নির্যাতন।
ম্যাসিন গান জুড়ে মারে ছাত্রছাত্রীগণ…
বঙ্গবন্ধু ছিলেন গ্রামীণ বাংলার মানুষ— তাই তাঁর সংগ্রামের কথা যখন সেই মাটির মানুষের মুখে উচ্চারিত হয়, তখন তা ভিন্ন ব্যঞ্জনা, ভিন্ন তাৎপর্য লাভ করে। এখানে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের আগে-পরের ঘটনা একজন গ্রাম্যকবির রচনায় যে আন্তরিক আবেগে ফুটে উঠেছে, রবীন্দ্রনাথের ভাষায় তা যেন— ‘অশিক্ষিত মাধুর্যে সরস’।
আট
আমার সংস্কৃতি— আমার ঐতিহ্য— আমার ভাষা— আমার সাহিত্য— যখন অন্তরে প্রবেশ করে গভীর আবেগ ও গৌরব সৃষ্টি করে, তখনই জাতিসত্তার উদ্বোধন হয়— জাতীয়তাবোধ জন্ম নেয়— জাতীয়তার অসংলগ্ন চেতনা জমাট বাঁধে। সেই আবেগ ও গৌরব আমরা পেয়েছি মুজিবের কাছ থেকে— বঙ্গবন্ধুর কাছ থেকে— জাতির জনকের কাছ থেকে। তাঁরই নেতৃত্বে— তাঁরই নামের মহিমায় আমরা একটি স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র পেয়েছি মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে। আর সেই মহান মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনা-প্রেরণা নিহিত ছিল বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের মধ্যে। এই ভাষণ তাই নিছক কোনও রাজনৈতিক বক্তব্য-বিবৃতি নয়— এ হল বাঙালি জাতির এক অবিনশ্বর… অবিস্মরণীয় দিকদর্শনের রূপরেখা— রাজনৈতিক অভিজ্ঞানের শাশ্বত দলিল— যার মধ্য দিয়ে প্রজন্ম-পরম্পরায় বাঙালি শক্তি ও প্রেরণা পাবে— সঙ্কটে-সংশয়ে পাবে ধ্রুবতারকার দিশা— অনুভব করবে প্রাণ-নাড়ির স্পন্দন।
জয় বাংলা— জয় বঙ্গবন্ধু!