Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

তোর্সা চরের গল্প

তোর্সা চরের গল্প -- সাত্যকি হালদার

সাত্যকি হালদার

 

গোপালপুর হাট থেকে পথ বেঁকে চলে গেছে পুন্ডিবাড়ির দিকে। ইদানীং সে পথ পিচ-ঢালা। খাগড়াবাড়ি কোচবিহার না হয়ে যদি কেউ পুন্ডিবাড়ি বা তোর্সার চরে যায়, তার জন্য এই পথ। বাস নেই, অটোরিকশাও নেই। যাওয়া বলতে হাঁটা বা সাইকেল। সেভাবেই এদিকের অনেকে যায় আসে।

তোর্সার ভিতর চর জাগে। বর্ষায় ডুবে যায় আবার। এক জায়গায় ডোবা চর বর্ষা শেষের পর কাছাকাছি কোথাও মুখ তোলে। কখনও জায়গা পাল্টে খানিক ভাঁটিতে গিয়ে ক্রমশ পিঠ দেখায়। পাঁচ কি সাত বছরের ভাসা-ডোবায় যে চর শেষ পর্যন্ত টিঁকে যায়, সেখানে গাঙ-শালিক আসে। কোঁচ-বক আসে। তাদের পিছন পিছন এসে হাজির হয় মানুষ। টিন আর বাঁশ মাথায় ফেলে দূর থেকে হেঁটে আসা মানুষ। সেই মানুষ, যারা চরের মতো ডোবে আর ভাসে।

তারা এসে মাছ ধরে, জমি চষে। তারা আসে শীতলকুচি ময়নাগুড়ির গ্রাম থেকে, বক্সিরহাট থেকে। এমনকি কাঁটাতারের ওদিকে যে কুড়িগ্রাম আর লালমনির হাট, যেখানে তোর্সা-ধরলা-কালজানি আরেক বাংলায় ঢুকেছে, সে-সব গাঁ গঞ্জ থেকেও আসে তারা। এসে চরের মানুষ হয়ে যায়।

তেমনই চর থেকে আসা একটি মানুষ এক দিন হাজির হয়েছিল এ দিকে। এ দিকের এই বাণেশ্বর গোপালপুর লাগোয়া জিরানগুড়ি বাজারে।

জিরানগুড়িতে বিষ্যুদবার হাট। সেখানে এক মাত্র চায়ের দোকানটিতে চা আর গোল বিস্কুট খেতে খেতে লোকটি জানিয়েছিল, স্বপ্নের ভিতর তার মেয়ের সঙ্গে নাকি মাসান ঠাকুরের কথা হয় আজকাল।

স্বপ্নের ভিতর ঠাকুরের যাতায়াত এখনও এ দিকে তেমন আশ্চর্যের নয়। আগেও কেউ কেউ ঘুমের মধ্যে মাসান ঠাকুরকে দেখেছে। অন্য ঠাকুরকেও দেখে। তবে গ্রামের ভেতর অবণী রায়ের মতো কারও কারও বাড়িতে টিনের চাল পাল্টে কংক্রিটের ছাদ হচ্ছে। বাজারের ও দিকটায় মাঠের কোণে উঁচু এক টাওয়ার বসছে। সে সব শুরু হওয়ার পর মাসান ঠাকুর খানিক যেন চুপচাপ। স্বপ্নের ভেতরে উঁকি দিচ্ছে না কিছু দিন।

আকাশে ক্রমশ মাথা তোলা টাওয়ারটা রাস্তার ধারে। কেউ বলছে মোবাইলের টাওয়ার। কারা গুজব শুনেছে অন্য। বলছে, খবর নেওয়ার টাওয়ার। ওর ভেতর দিয়ে নাকি গ্রাম আর মানুষের মনেও নজরদারি চলবে। তবে গুজব যাই হোক মাসান ঠাকুর ইদানীং আর স্বপ্নের ভেতর নেই।

কিন্তু তোর্সার চরে থাকা লোকটি বা তার মেয়ে ঠাকুরের কথা জানল কীভাবে! জিরানগুড়ি ভেটাগুড়ি পুন্ডিবাড়ি, এ সব এলাকা ছাড়িয়ে মাসান ঠাকুরকে তেমন তো কেউ চেনে না। তোর্সা আর কালজানি নদীতে ঘেরা গ্রামের বাইরে মাথাভাঙাতেও তার নাম নেই। স্বপ্নে ঠাকুরকে তারা চিনেছে তো ঠিক! যদিও শেষ বিকেলে চায়ের দোকানে বসে লোকটিকে কেউ অবিশ্বাসও করল না।

ষাটের কাছে বয়স হবে তার। পায়ে টায়ারের চটি, পরনে ফ্যাকাসে লুঙ্গি, লম্বা ডাঁটির কাঠের ছাতাখানা সঙ্গে। খাটো চেহারার তুলনায় ঢোলা একটা ফতুয়া গায়ে। মাথায় উশকো চুল। সকালের হাটে দেড় মণ ভুট্টা বেচে দেওয়া বয়স্ক ফটিক রায় তাকে বলল, আপনারে তো আগে দেখি নাই। রাত্রে থাকবেন কোথায়!

লোকটির গলার স্বরটিও খাটো গোছের। বলল, হাটে বা মন্দিরের চাতালে শুয়ে যাবখন।

জিরানগুড়ি বাজার বা গ্রামে বিদ্যুৎ আসেনি। বছর দশ আগে ভোটের মুখে সিমেন্টের পোল পড়েছিল চার পাঁচটি। ন্যাড়া সেই ক-টি পোল দশ বছর ধরেই এখানে ওখানে দাঁড়ানো। পোলের সঙ্গে তারের যোগ নেই।

তবে পঞ্চায়েতের তরফে হাট আর বাজারে সোলার বসেছে দুটি। তার হালকা ফ্যাকাশে আলো সন্ধের পর ঘন্টা দুই জ্বলে থাকে। সেই আলো চা দোকানেও পড়েছে। বুড়ো ফটিক রায় লোকটিকে বলল, মাসান ঠাকুরের মন্দির বলে তো কিছু নাই। খোলা আকাশের তলে গাছের নীচেই তারে রাখা। বাজারের ওই দিকে দুর্গামণ্ডপ, আপনি ওইখানে শুইতে পারেন।

সোলারের আলো কমে আসার পরও লোকটি খানিকক্ষণ থাকে। চারপাশে ছড়িয়ে আরও ক-জন। হাটে আসা লোকেরা একা বা দল বেঁধে গ্রামে ফিরে যায়। কথায় কথায় লোকটি জানায় তার মেয়ে নমিতার কথা। নমিতার বয়স বছর পঁচিশেক। চরের আরও কজন মেয়েবউয়ের সঙ্গে দু বছর হল সে কেরালায় কাজে গেছে। কাপড়ে জরি বসানো আর বর্ষায় পাপোষের কারখানায় কাজ।

জিরানগুড়ি ভেটাগুড়ির এ দিক থেকে এখনও তেমন বাইরে যায়নি লোকজন। তাদের কাছে দূরের জায়গা বলতে কোচবিহার আলিপুরদুয়ারের মতো শহর বা মাথাভাঙার মতো গঞ্জ। সে-সব জায়গায় ডাক্তার দেখানো বা তেমন কোনও ঠেকায় পড়লে যাওয়া, আবার দিনেদিনেই ফেরা। কেরালা মহারাষ্ট্র কলকাতা, এই সব জায়াগায় মানুষ কাজ করতে যায় তারা শুনেছে। তবে কোনটা কত দূর, কলকাতা ছাড়া বাকি জায়গাগুলো দেশ না বিদেশ তা তাদের কাছে স্পষ্ট নয়। ফলে চুপ হয়ে তারা চর থেকে হেঁটে আসা লোকটির মুখে তার মেয়ের কথা শোনে।

কাছের উনুনের ওপর ছোট ডেকচিতে শেষবারের চা-টুকু গরম হয়। তখন ফটিক রায় বলে, আপনার মেয়ে এত দূরের কথা জানল কীভাবে! আগে কি আপনারা এই দিকে ছিলেন?

লোকটি মাথা নামিয়ে শোনে। তারপর জানায় তোর্সার চরের আগে তারা দক্ষিণের আর কোনও চরে ছিল। সেই চরটি ভাঙনে চলে যাওয়ার পর তারা নতুন জায়গায় উঠেছে। নতুন চর থেকেই কেরালায় কাজে গেছে নমিতা। লোকটি বলে, নমিতা গত হপ্তায় সকালে আমারে এক দিন মোবাইল করল। তখন জানাল পুন্ডিবাড়ি ছাড়িয়ে এই দিকে মাসান ঠাকুরের কথা। মাসান ঠাকুর স্বপ্নের ভিতর তারে মিচ কল দেয় আর কথা বলে।

চা দোকানের কাঠের আগুন জ্বলতে থাকে ধিকিধিকি। ডেকচির জলে চায়ের শুকনো পাতার ঘুরপাক। যে যেমন ছিল, বসে রইল তেমনই। যেন মাসান ঠাকুরের মিস-কল তেমন আশ্চর্যের কিছু নয়। অন্তত ওই সন্ধ্যায়, ওই আধো-অন্ধকার চায়ের দোকানে তো নয়ই। তখনের ভাঙা হাটখোলায় লোকই বা ক-জন।

ফটিক রায়ের পাশে বসা অল্প বয়সে টাক পড়া নরেন সরকার। সে বলল, আপনার মেয়ে আর কিছু বলে নাই! খালি মিস কল। আপনার মেয়ের কি সেই ফোন যাতে ছবি দেখা যায়?

টায়ারের চটি পরা লোকটি এত মনে হয় বোঝে না। কাঠের লম্বা ছাতাটি পাশে কাত করে রাখা। চারপাশে জড়ো হওয়া পাঁচ-ছ জনের মাঝে লোকটি চুপ হয়ে দেখে। নরেন সরকারের কথার পর সে বলে, মাসান ঠাকুরের কি এলোমেল চুল, আর বড় চোখ! সে কি ছোট গদা হাতে একা ঘুরে গ্রাম পাহারা দেয়?

নরেন সরকার বলে, এত কিছু কি আপনার মেয়ে ফোনের ভিতর দেখেছে?

লোকটি আবার একটু থামে। তার পর বলে, নমিতা আমারে বলে এইদিকের আরও যারা কাজে গেছে, ঠাকুর নাকি তাদেরও কাউরে কল দেয়। বলে, কাউরেই নাকি আর কাজের জন্য বাইরে থাকতে হবে না। আবার কখনও মাসান ঠাকুর বলে, নিজেই সে ভিন দেশে চলে যাবে…।

মাসান ঠাকুরের কথা এদিকে সবার জানা। কখনও স্বপ্নের ভেতর দেখাও। কিন্তু তাকে চলে-ফিরে বেড়াতে দেখার লোক এখন আর নেই। মোড়ের খানিক আগে রাস্তার ধারে বাঁশে ঘেরা ছোট একটু চালা। সেখানে মাসান ঠাকুরের বসে থাকা নীল রঙা মূর্তি।

মাসান ঠাকুরের পুজোর নির্দিষ্ট কোনও তিথি নেই। তবে বর্ষার পর কখনও তার মূর্তি বদলানো হয়। কিন্তু গদা হাতে চেহারার আদলটি এক থাকে। বড় মুখে গোল চোখ, মাথায় উসকো চুল, নাদুস পেট। তার জন্য তৈরি করা বাঁশের চালাটি নড়বড়ে, অন্তত গোপালপুর বাজারে যে দুর্গা মণ্ডপ উঠছে সে তুলনায় তো কিছু নয়। বর্ষা শেষের আগেই চাল উড়ে যায়। মন্দির হেলে পড়ে। বৃষ্টির জলে মাসান ঠাকুরের মূর্তি রং-চটা হয়ে বসে থাকে।

কিন্তু কাছাকাছির এক অতীতে মাসান ঠাকুর তো ছিলই। বুড়ো অসুরের মতো চেহারার গড়নটি হলেও সে-ই তো গ্রাম পাহারা দিত। শামুকতলা দমনপুরের ওদিকে জঙ্গল শেষ হওয়ার পর তোর্সা আর কালজানির মাঝে ছড়ানো চাষের জমি। রাতে আর দুপুরে মাসান ঠাকুর ঘুরে বেড়াত সেখানে। ঘোড়ায় চড়ে যখন চিলা রায় রাজ্য দেখতে বেরোত, সেই আমলের দেবতা মাসান ঠাকুর। তার পাহারায় জঙ্গল কেটে বসত গড়েছিল মানুষ। টিনে ছাওয়া বাড়িটুকু ঘিরতে পেরেছিল সুপুরি আর বাঁশঝাড় দিয়ে।

তবে ওই। মাসান ঠাকুরের এখন শুধু স্বপ্নেই যাতায়াত। তাও সবার স্বপ্নে নয়। যাদের কাছে আসে তারা দেখে বুড়ো বাপের মতো চেহারার ঠাকুর, বাইরের দরজার কাছে অন্ধকারে বসে আছে।

দোকানে বসা ফটিক রায় চর থেকে আসা লোকটিকে বলে, আপনার মেয়ে কি যেখানে কাজ করে, সেখান থেকে আসবে? সেই জন্য সে আপনারে এই দেশ দেখতে পাঠাল!

কাঠের উনুনে জলের ছিটা দিয়ে দোকানি শেষ চা-টুকু সবার সামনে রেখে যায়। ঝাঁপের এক দিকের অর্ধেকটা খুলে রাখা। পোস্টের মাথায় সোলারের আলো নিভুনিভু। চা হাতে নিয়ে চরের লোকটি বলে, নমিতা আমারে বলেছে, বাবা তুমি যাবা। দেখে আসবা জায়গা আর ঠাকুরের চেহারা স্বপ্নের মতো কিনা। আর বলেছে পরে যখন ও বাড়ি আসবে তখন পারলে ঠাকুরের এই দেশ থেকে ঘুরে যাবে।

সেদিন বাজারের চাতালে শুতে দেওয়া হয় লোকটিকে। মাদুর আসে, দলা করা মশারি, গায়ে দেওয়ার চাদর। তার আগে ফটিক রায়ের বারান্দায় বসে খেয়ে আসে সে। রাতের দিকে বৃষ্টি নামলে কাঠের ছাতাটি মেলে বিছানা গুটিয়ে বসে রাত কাটায়।

বর্ষাকাল তখন এসে গেছে প্রায়। বর্ষার আগে ভুট্টা পাকে। ফসল তোলার পর সে-সব মাঠ তখন ফাঁকা। তবে ধানের মাঠ গাঢ় সবুজ। এ ছাড়া সুপুরি বাগান, কাঁঠাল গাছ, শিরীষ আর কাঠবাদাম গাছের গ্রামে বর্ষা সবুজ হয়েই বসতে শুরু করে। গোপালপুর হাটখোলার পুরনো বুড়ো শিরীষ গাছটার গা ভরে ওঠে শ্যাওলা আর লম্বা পাতার চারা গাছে। বর্ষাকাল এলে তোর্সা আর কালজানি অনেকখানি বেড়ে যায়। কাছের গ্রামেরা দূরে সরে। মাথাভাঙার লোকের সংক্ষেপে কোচবিহার পৌঁছনোর টাপুরঘাটের খেয়া বন্ধ থাকে ক-দিন।

এত দিন মাসান ঠাকুরকে খানিকটা ভুলে ছিল গ্রামের লোকজন। বছরে কয়েকটা মানত ছাড়া তার কথা এখন কে বা মনে রাখে! বছর দশ আগে যখন গাঁয়ে বিদ্যুতের খুঁটি আসেনি, সোলার আসেনি, সেই সময় শেষ দেখা গিয়েছিল তাকে। সে-ও ছিল এক বর্ষাকাল। সারা দিন বৃষ্টির পর সন্ধেয় একটু বিরতি, আকাশে চাঁদের ঝাপসা আলো, মাসান ঠাকুর বুড়ো শিরীষের গোড়ায় ঠেস দিয়ে এসে বসেছিল। গোল পেট, খালি গা, ছোট গদাটি মাটিতে নামানো। মাসান ঠাকুর গাছে হেলান দিয়ে অল্প অল্প ঢুলছিল তখন।

তবে এদিকের স্বপ্নেও সে এখন খুব কম আসে। এলেও ওই দরজার বাইরে বসে থাকে। বাণেশ্বর বাজারের যোগেন ময়রার কাছে ক্ষীর-দই খেতে চেয়েছিল। সেই থেকে ময়রার দোকানে ক্ষীর-দই। কিন্তু ঠাকুর কখনও আর খাওয়ার জন্য আসেনি। আরও অনেককে আসব বলে আসা হয়নি তার। তা ছাড়া তার পর থেকে বদলাতেও শুরু করেছে দেশকাল। কাঠের ব্রিজ পাল্টে বাঁধানো ব্রিজ হয়েছে কালজানি নদীতে। ডুয়ার্সের জঙ্গল হাঁটতে হাঁটতে পাহাড়ের দিকে চলে গেছে। নজরদারির উঁচু টাওয়ার প্রতি দিন একটু একটু করে বেড়ে উঠছে গ্রামের মাঝখানে। ঠাকুর এখন স্বপ্নে দূরের লোকদের শুধু খোঁজ নেয়।

বর্ষার মুখে নমিতার বাবা প্রথম এসেছিল। তার পর আর খবর ছিল না। শেষে মাস দুই পর আবার এল এক দিন। এ বার ময়লাটে ধুতি, ফতুয়া, টায়ারের চপ্পল। বড় ছাতাটি খুলে কাঁধে কাত করে রাখা। বলল, পুণ্ডিবাড়ির দিকে রাস্তা জলের তলায়। মাঠঘাট ভেঙে তাই ঘুরে আসতে হয়েছে।

শুনে বাজারের ফটিক রায় বলল, সে না হয় এ দিকের রাস্তা জলের তলায়। কিন্তু কেরালার খবর কিছু নাই! মেয়ে আর কিছু জানায় না?

এবারেও সেই চায়ের দোকান। সন্ধেবেলা সোলারের কমে আসা আলো। চরের দেশ থেকে উঠে আসা লোকটিকে এদিন খানিক ক্লান্ত দেখায়। কাঠের কমে আসা উনুনে চোখ রেখে বলে, মাসান ঠাকুর এখন আরও ঘনঘন মিচ কল দেয়। ঘুমের ভিতর নমিতা মোবাইল কানের উপর ধরে রাখে। ঠাকুর থেমে থেমে জানায় এইদিকে কষ্ট হচ্ছে তার। সারাদিন নাকি ঠাকুরের মাথার ভিতর ঝিমঝিম…

টাক পড়ে যাওয়া নরেন সরকার শুনছিল কথা। বলল, মাসান ঠাকুর তো বাঁশের ঘরে যেমন থাকার তেমনই রয়েছে। তার কষ্ট কী!

ফটিক রায় বলে, পুজোর সময় আপনার মেয়ে কি তবে আসছে?

লোকটির এক পাশে ঠেস দেওয়া ভাঁজ করা লম্বা ছাতা। সারাদিন বৃষ্টি হয়েছে থেমে থেমে। বিকেলের পর থেকে খানিক বিরতি। যদিও বৃষ্টিভেজা হাওয়া বয় মাঝেমাঝে। লোকটি বলল, নমিতা বলে এইসব দিকের আর যারা বাইরে কাজে গেছে মাসান ঠাকুর এখন তাদেরও মিচ কল দেয়। কেরালা নাসিক বা পুনায় যারা লেবারের কাজ করে, সবার খোঁজ নেয়। পুজোর সময় তারা আসতে পারে, নাও পারে।

নরেন সরকার বলে, আপনার মেয়ে নমিতারে তো ঠাকুর সবার আগে ডেকেছিল। তারে নতুন কিছু বলে না?

লোকটি চায়ের ছোট গ্লাস হাতের ভেতর ধরে রাখে। সোলারের আলো পুরোপুরি হালকা হয়ে আসেনি। টানা বর্ষায় রাস্তাঘাটে জল, বাজারের এখানেওখানে কাদা। সেই কাদা আর জল টপকে সন্ধের মুখে ঘরে ফিরছে এক দুটি লোক। নমিতার বাবা সে-সবে তাকিয়ে বলে, মেয়ের সঙ্গে মাসান ঠাকুরের এখন প্রায়-রাতেই কথা হয়। মেয়ে যেইখানে ভাড়া থাকে বুড়ো ঠাকুর একেক দিন সেইখানে চলে যায়। অন্ধকারে বারান্দার এক কোণে মাথা নামিয়ে বসে থাকে। মেয়েরে স্বপ্নের ভিতর বলে, নমিতা, এইদিকে আমার কি কোনও কাজ হয়?

চা দোকানের সবাই থেমে থাকে। কাঠের উনুনে কমে আসা আগুন। সোলার ঘিরে বৃষ্টির ছাঁট আবার শুরু হয় বুঝি। লোকটি একইরকম টানা গলায় বলে, মাসান ঠাকুর বলেছে, নমিতা তুই কোম্পানিতে খোঁজ নে। আরও এদিকওদিক দেখ। আমারে দেখ কেউ সিকিউরিটির কাজে নেয় কি না।

নরেন সরকারের নিচু গলায় বিস্ময়। সিকিউরিটির কাজ?

…ঠাকুর বলেছে তারে অল্প খাওয়া আর ঘুমের জায়গা দিলেই হবে। নমিতারে বলেছে, নমিতা তুই বলবি বছরের পর বছর আমি পাহারার কাজ করেছি জঙ্গলে আর চিলাপাতার দেশে। তোর্সা ধরলা কালজানির ভিতর রাত জেগে ঘুরেছি।

লোকটির কথায় সবার যেন খেই হারিয়ে যায়। বর্ষার একটি শেষ বিকেল দোকানের বাইরে। যেন নমিতার বাবা নয়, বুড়ো মাসান ঠাকুরই এসে হাজির হয়েছে স্যাঁতসেঁতে চা দোকানটিতে। তার কথা এগোচ্ছে একটু একটু করে।

চুপ থাকা ভেঙে নরেন সরকার বলে, আপনার মেয়ে তবে এইবার আসতেছে না?

লোকটি কথা শুনে তাকিয়েই থাকে। নামানো ঘাড়। তারপর হাত উল্টে দেয়। বলে, আমি বলার কে! নমিতা আসে না-কি মাসান ঠাকুর যায়, সেই নিয়ে এখন ফোনাফুনি হয় সারা রাত। নমিতা আমারে যেইটুক বলে আমি আপনাদের শুনাই।

সন্ধের পর থেকে ফের ঝেঁপে বৃষ্টি আসে সেদিন। শেষবারের চা খাওয়ার পরও দলা হয়ে বসে থাকে সবাই। দূর থেকে আসা নমিতার বাপ বেঞ্চের এক কোণায়। পোলের মাথায় সোলারের সাদা আলো ঘিরে কয়েকটি বুনো পোকা বৃষ্টিতেও ওড়ে। এক পাশে তুলে রাখা দোকানের ঝাঁপ। সেখান থেকে বাইরের অল্পই দেখা যায়।

তবে যেটুকু দেখা যায় তাতে খানিক দূরে আকাশের দিকে উঠে যাওয়া শিরীষ গাছ। গাছের ওদিকে আবছা সেই টাওয়ার। রাস্তার ধারে টাওয়ারটি চার পা ছড়িয়ে দাঁড়ানো। সেটিও টানা বৃষ্টিতে ভিজছে।

প্রায় ভুলে থাকা মাসান ঠাকুরকে নিয়ে সে বার জিরানগুড়ি আর আশপাশে আবার কিছু কথা আসে। কেরালায় দেখা নমিতার স্বপ্ন আর তার বাপের হেঁটে আসায় বুড়ো ঠাকুর আবার যেন গ্রামের মনে ফেরে। শেষ তাকে দেখা গিয়েছিল অনেক বছর আগে। অনেক বছর যেন অনেক কাল। এমন বর্ষায় সে কখনও মোষের পিঠে চড়ে ঘুরত। ভিজতে ভিজতে এসে হাজির হত এর-ওর উঠোনে। কিছু চাইত না বুড়ো ঠাকুর। শুধু জলের ভেতর দাঁড়িয়ে চুপ হয়ে দেখত। শেষবার সে গাছে হেলান দিয়ে ঢুলছিল। নমিতার স্বপ্ন হয়ে ফেরা ঠাকুর যেন আবার দেখা দেবে।

ফটিক রায় একদিন বাজারে দাঁড়িয়ে বলে, দুর্গামণ্ডপ পাকা করার কাজ প্রায় শেষ। পরের বছর মাসান ঠাকুরের মন্দিরে হাত দেওয়া লাগবে। সামনেটা অন্তত মেজে দি, পরে চালাটা দেখব।

নরেন সরকার থামিয়ে দিয়ে বলে, নমিতা যদি আসে তো ওর কাছেও কিছু চাওয়া যায়। সে নিজেই হয়ত যা করার করবে।

বর্ষায় গাছ সবুজ হয় যেমন, পুকুর ছাপিয়ে রাস্তার কাছে জল আসে, মাসান ঠাকুরের মূর্তিও তেমনি গলে যায়। রং উঠে যায় প্রতিবারের মতো। নীল পোঁচ সরে গিয়ে মাটি আর খড় বেরোয়। বসা মূর্তিতে কেবল মাথা আর পেটের আদলটি থাকে। বাঁশের চালটিও এক পাশে নিচু হয়ে পড়ে।

তারপর বর্ষার শেষ দিকে আবার এক দিন আসে সেই লোক। সেই টায়ারের চটি, ছাতা, নমিতার বাবা। মাঠঘাট পেরিয়ে সকালের দিকে আসে। অনেক এলাকা তখন থৈথৈ, তবু বর্ষার মেঘ আকাশকে একটু জায়গা ছাড়তে শুরু করে দিয়েছে। সেবার এসে সে চা দোকানে বসে না। চেনা লোকের সঙ্গে দেখা হলে নমিতা আর নমিতার স্বপ্নের কথা বলে, কিন্তু সেই স্বপ্ন যেন আদিকালের কথা। স্বপ্নের যেন মাথামুণ্ডু নেই।

স্বপ্নে মাসান ঠাকুর নাকি কখনও বড় ডানার পাখি হয়। গ্রামের মাথায় মাথায় ওড়ে। কখনও জলের তলে ভেসে বেড়ানো শুঁড়ওয়ালা শামুক। আবার নাকি কোনও দিন জঙ্গলের ভেতরের পুরনো গাছ হয়ে বছরের শেষে সমস্ত পাতা ফেলে দেয়। নমিতা আসবে কি আসছে না তার উত্তর নমিতার বাবার আর জানা নেই।

লোকটি বড় ছাতা মাথায় গ্রামে আর বাজারে ঘোরে। শেষ হয়ে যাওয়া দুর্গামণ্ডপটি দেখে। রাস্তার ধারে টাওয়ারের তলে দাঁড়িয়ে হাঁ হয়ে চেয়ে থাকে। শহর থেকে যারা টাওয়ার বানাতে আসত কাজ শেষ করে তারা পাকাপাকি ফিরে গেছে। টাওয়ারের উঁচু মাথায় রাতে লাল আলো জ্বলে আর নেভে। কিন্তু কেন মাঠের মাঝে লোহার অত বড় খাঁচা গ্রামের কেউ তা ঠিকঠাক জানে না।

সারা দিন ঘুরে লোকটি বাজারের ফাঁকা চাতালে শুয়ে যায়। সেই রাতে প্রথম কুয়াশা জমে, বাতাস খানিক ভার ভার। টিনের চাল আর সুপুরি পাতায় অনেক রাতে হিম পড়ে। কোথাও পাতার ভেতর খসখস শব্দ হয়। গ্রামে যাদের ঘুম কম তারা সে দিন কান্নার শব্দ শোনে বাতাসে। দূরে কোথাও গুমরে ওঠা কান্না। সেই শব্দ কাছ থেকে দূরে যায়। যেন বনের ভেতর বুড়ো কোনও গাছ কাঁদে। বড় ডানার পাখি কাঁদে। কিংবা তোর্সার জলের তলায় আদিম কোনও শামুক শুঁড় তুলে একটু একটু ফোঁপায়।

যাদের গভীর ঘুম তারা স্বপ্ন দেখে নমিতার বাবার। নমিতার বাবার বগলে বা মাথায় বড় লম্বা ছাতা। ঢোলা মাপের ফতুয়া গায়ে। কুয়াশা আর হিমে গ্রাম ছেড়ে বার হয়ে যাচ্ছে সে। নমিতার বাবার পেছনে অল্প দূরে পা টেনে টেনে মাসান ঠাকুর। ঠাকুর ক্লান্তিতে দাঁড়ালে নমিতার বাবা দাঁড়িয়ে যাচ্ছে একটু।

মাসান ঠাকুরের চুল এলোমেলো, হাতে ছোট গদা। তবে চেনা মূর্তির মতো তার গা খালি নয়। মাসান ঠাকুরের গায়ে সিকিউরিটি গার্ডের রং-চটা জামা। সঙ্গে বেমানান হাফ-প্যান্ট।