Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

কালো টাকার গল্প: ফিরে দেখা বিমুদ্রাকরণ

কালো টাকার গল্প: ফিরে দেখা বিমুদ্রাকরণ -- নারায়ণ শূর

নারায়ণ শূর

 



কবি, প্রাবন্ধিক, সম্পাদক

 

 

 

প্রথমেই বলে রাখি প্রায় সাড়ে চার বছর আগেকার ‘নোটবন্দি’ বা বিমুদ্রাকরণের কাসুন্দি এতদিন পরে কেন ঘাঁটতে বসলাম। কারণ এটাই যে সেই সময় যে নাটকীয় পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে এই ঘোষণা হয়েছিল সাধারণ মানুষ সেটা বেশিরভাগই বিশ্বাস করেছিল। আর আমাদের কাছেও তাৎক্ষণিক তেমন তথ্য ছিল না যে বুঝতে পারি এই ঘোষণার পিছনের রহস্যটা কী এবং কবে, কোথা থেকে এর উৎপত্তি। আর কোনও ঘটনাকে সামান্য সময় পরে একটু দূর থেকে দেখে যে স্বচ্ছতার সঙ্গে ইতিহাসের প্রেক্ষিতে স্থাপন করা যায়, ঘটনার অব্যবহিত পরে তথ্যের স্বল্পতার কারণে তা সম্ভব হয় না। এবার বিস্তারিত সেই আলোচনায় যেতে চাই।

৮ নভেম্বর, ২০১৬ সাল রাত আটটায় সমস্ত মিডিয়ায় দেশের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির এক আচমকা ঘোষণায় গোটা ভারতবর্ষ চমকে উঠেছিল। বলা হয়েছিল, পাঁচশো টাকার ও হাজার টাকার কারেন্সি নোট বাতিল করা হল। প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য অনুসারে এর কারণ ছিল তিনটি—

  1. কালো টাকা উদ্ধার।
  2. জাল নোটের কারবার বন্ধ করা।
  3. সন্ত্রাসবাদীদের হাতের ক্যাশ টাকা অকেজো করে তাদের দুষ্কর্ম বন্ধ করা।

মোদিজির ভক্তবৃন্দ বললেন, “এ তিন শত্রুর বিরুদ্ধে সার্জিকাল স্ট্রাইক।” মহৎ উদ্দেশ্য তাই আমজনতা তাঁকে দুহাত তুলে সমর্থন করলেন। সামান্য কিছু (প্রায় ১৫০ জন মানুষের ব্যাঙ্কের লাইনে দাঁড়িয়ে মৃত্যু হয়েছিল; এছাড়া ছোট, বড়, মাঝারি ব্যবসায়ী দোকানদারদের ব্যবসার ঝাপ ফেলে দিতে হয়েছিল) ভোগান্তি হয়েছিল এবং মহৎ কাজে এই কোল্যাটেরাল ড্যামেজকে হাসিমুখে মেনে নিয়েছিলেন সাধারণ মানুষ। এর কিছুদিনের মধ্যে মোদিজির কান্নাভেজা অতিনাটকীয় সংলাপও সাধারণ মানুষ বিশ্বাস করেছিলেন বা খেয়েছিলেন।

আসলে এই কারণ তিনটিও তৈরি করে দেওয়া হয়েছিল মূল পরিকল্পনাকারীদের তরফে। যারা আমেরিকায় বসে মূল কর্মকাণ্ডটি সুচারুভাবে পরিচালনা করছিলেন। সেই মূল চক্রান্তের কথায় পরে আসব। এখন এই তিনটি উদ্দেশ্যকে একটু বিচার বিশ্লেষণ করা যাক।

কালো টাকা উদ্ধার: একেবারে সাধারণ স্তরের মানুষ যাদের সারাদিন পরিশ্রম করার পরেও নুন আনতে পান্তা ফুরায় তারা কালো টাকা বলতে কী বোঝে? তারা কালো টাকার মালিক বলতে তাদের তুলনায় বড়লোক যারা অনেক টাকা উপার্জন করেন (সৎ উপায়ে) তাদের কথা ভাবেন। মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণে বোঝা যায়— এই শ্রেণির মানুষেরা এই তথাকথিত বড়লোক শ্রেণি অর্থাৎ ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, বড় ব্যবসায়ী প্র্ভৃতি হাতের কাছে থাকা বিত্তবানদেরই কালো টাকার মালিক ভাবতেন (এটা শ্রেণিবৈষম্যের কারণে হয়ে থাকে)। তাই এই তথাকথিত বড়লোকদের উপর কোপ পড়বে এই আনন্দেই না বুঝে তারা এই ‘উদ্দেশ্য’কে ভালো বলে মনে করেছিলেন, সে সময় তাদের অনেককেই বলতে শুনেছি এবার টের পাবে ব্যাটারা। তারা তো ব্ল্যাকমানি বা প্যারালাল ইকোনমি-র কথা জানে না তাই এই শ্রেণির প্রচুর মানুষ দুহাত ভরে মোদিজিকে আশীর্বাদ করেছিলেন। কালো টাকা আসলে হিসাববহির্ভূত টাকা যেটা রাষ্ট্রের হিসাবে আসে না তাই করও দিতে হয় না। ঘুষ, বেআইনি লেনদেন, বহু টাকার সরকারি কেনাকাটায় কমিশন, রাজনৈতিক দলের এমএলএ, এমপি কেনাবেচা বা হুন্ডির মতো কাজে এই কালাধন ব্যবহৃত হয়। এটা একটা সাধারণ কথা। কালো টাকা যাকে বলা হয় অর্থনীতিকদের বিচারে তার অঙ্ক বিপুল, যা দিয়ে ভারতবর্ষের মতো একটি দেশের বহু বছরের জন্য ঘাটতিশূন্য বাজেট করা সম্ভব। তাদের হিসাবে মোট কালো টাকার ৫-৬ শতাংশ থাকে নগদে, বাকি টাকা থাকে মূল্যবান ধাতু, সম্পত্তি ও বিদেশের ব্যাঙ্কে পাচার করা টাকা। কারণ বুদ্ধিমান মানুষেরা কালো টাকা ঘরে রাখে না৷ ব্যাঙ্কের লকারেও রাখে না। টাকার মূলত অবমূল্যায়ন হতে থাকে, তার ক্রয়ক্ষমতা কমে যায়, তাই বিভিন্নভাবে তার মূল্যমান বাড়িয়ে রাখার জন্য ব্যবস্থা করেন। সুইস ব্যাঙ্কের কথা বেশিরভাগ মানুষ জানেন কিন্তু সারা দুনিয়াতে আরও অন্তত ৭০টি ট্যাক্স-হেভেন নামক জায়গা আছে, যেখানে এই হিসাব-বহির্ভূত কালো টাকা গচ্ছিত রাখা যায়। এই প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যেতে পারে যে মোদিজির কথা অনুযায়ী ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বর মাস থেকে সুইস ব্যাঙ্কের তথ্য ভারতবর্ষ পাবে বলে চুক্তি হয়েছিল। কিন্তু এই ২০২১ সালে দাঁড়িয়েও আমরা কোনও কালো টাকা উদ্ধার করতে পারিনি। হয়তো এর মধ্যেই সেই কালো টাকা সাইপ্রাস বা অন্য কোনও ট্যাক্স হেভেনে পৌঁছে গিয়েছে।

জাল নোটের কারবার বন্ধ করা: বিমুদ্রাকরণের পর এই দীর্ঘ সাড়ে চার বছরে কি ভারতবর্ষে জাল নোটের কারবার কমে গেছে বা বন্ধ হয়েছে? না, হয়নি বরং বেড়ে গিয়েছে। সাধারণ একটা কারণ এর পিছনে আছে যে আগে সর্বোচ্চ মূল্যের কারেন্সি নোট ছিল হাজার টাকায়। সেটা যদি দু হাজার টাকা করা হয় তাহলে জাল নোটের পরিমাণ বাড়বেই। উন্নত দেশগুলিতে যেখানে বড় মূল্যের নোট কমিয়ে দেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে সেখানে কেন হাজারের বদলে দু হাজারের নোট চালু করা হল তার কোনও সদুত্তর কি আপনারা পেয়েছেন?

সন্ত্রাসবাদীদের হাতের ক্যাশ টাকা অকেজো করে দেওয়া: বিমুদ্রাকরণের ঠিক কিছুদিনের মধ্যেই দেখা গেল সন্ত্রাসবাদীদের হাতে নতুন কারেন্সির দুহাজার টাকার নোটের পাহাড়।

তাহলে দেখা যাচ্ছে যে তিনটি উদ্দেশ্যই আসলে ছেলেভুলোনো কথা। আসল উদ্দেশ্য ছিল অন্য, যেটা পরে ঝুলি থেকে বেড়াল বেরোবার মতো সামনে চলে এল।

৮ নভেম্বর ২০১৬, যেদিন ৫০০ ও ১০০০ টাকার নোট বাতিল হল তখন তার পরিমাণ ছিল ১৫.৪৪ লাখ কোটি টাকা, ফেরত এল কত? ১৪.৯৭ লাখ কোটি টাকা, অর্থাৎ প্রায় ৯৭ শতাংশ। তাহলে দেখা যাচ্ছে এই সুযোগে দেশের ভিতর ক্যাশে থাকা ৬ শতাংশ কালো টাকাও এভাবে বৈধ হয়ে গেল। বলা হয়েছিল, যে দেশের প্রধানমন্ত্রীসহ দেশের দু-একজনই এই ঘোষণার কথা আগে জানতেন। এখন দেখা গেল বিজেপির শীর্ষ নেতৃত্বের সবাই এমনকি সাংবাদিক অর্ণব গোস্বামীও জানতেন। তাই এই সুযোগ করে দেওয়ার ফলে ৬ শতাংশ কালো টাকা রাতারাতি সাদায় পরিণত হল। কয়েকটা উদাহরণ দিলে ঘটনাগুলোকে সাজাতে অসুবিধা হবে না।

সুতরাং বোঝা যায় এই সময়েই প্রধানমন্ত্রীর বন্ধুরা আগাম খবর পেয়ে কালো টাকা সাদা করে ফেলেছিল। এই কেলেঙ্কারির সময় আয়কর দপ্তর চিহ্নিত চার লাখ কোটি টাকার ওপর নজরদারি করে বাজেয়াপ্ত করা বা পেনাল্টি আদায়ের যে ঘটনা ঘটা করে করা হয়েছিল, তার পরিণতি কী হয়েছিল? জনগণ আমরা সবাই সেটা ভুলেই গেছি।

এছাড়াও অত কম সময়ের মধ্যে নতুন নোট ছাপানো এবং দেশের সর্বত্র তাকে পৌঁছে দেবার লজিস্টিক (চার্টার্ড প্লেন ভাড়া, ছাপার সঙ্গে যুক্ত কর্মীদের ওভারটাইম দেওয়া)-এর জন্য কয়েক হাজার কোটি টাকা খরচ হয়েছিল, এই তথাকথিত সার্জিকাল স্ট্রাইক করে কয়েকশো লোকের মৃত্যু ও নানা আনুষঙ্গিক ক্ষয়ক্ষতিকে ধরলে দেশের অর্থনীতিকে পঙ্গু করে দেওয়া হয়েছিল শুধুমাত্র কিছু স্বার্থান্বেষী মানুষকে সাহায্য করার জন্য। সবচেয়ে বড় আঘাত এসেছিল খুচরো ব্যবসা, অসংগঠিত ক্ষেত্র ও কৃষিক্ষেত্রে। কর্মসঙ্কোচন ও ঋণাত্মক বৃদ্ধি দেশের সর্বস্তরের মানুষকে সবচেয়ে বেশি আঘাত করেছিল। ৫৬ ইঞ্চি বুকের ছাতির সাহস হয়নি ব্যাঙ্কের টাকা মেরে দেওয়া তার বন্ধু লোকেদের সম্পত্তি উদ্ধার করে দেশের কাজে লাগাতে। এখন অবশ্য স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে যে উনি তাঁর বন্ধুদের কাছে দেশকে বিক্রি করে দিতেই প্রধানমন্ত্রীর আসনে বসেছেন৷

তাহলে এটা কি নরেন্দ্র মোদির অপদার্থতা বা কাণ্ডজ্ঞানহীনতা? না, আসলে পুরো কাজটিই করা হয়েছে ভালোরকম হোমওয়ার্ক করেই? কালো টাকা উদ্ধার, জাল নোট বাজেয়াপ্ত বা সন্ত্রাসবাদীদের জব্দ করা— কোনওটাই এর প্রধান উদ্দেশ্য নয়। ২৭ নভেম্বর ২০১৬ সালে প্রধানমন্ত্রী তাঁর ‘মন কি বাত’ অনুষ্ঠানে সেটা প্রকাশ করে দিলেন। তিনি ভারতবর্ষকে ডিজিটাল লেনদেনের দিকে নিয়ে যেতে চাইছেন। চাপটা সবচেয়ে বেশি আসছিল লগ্নিপুঁজির বাজার থেকে। দেশের মধ্যে মোদির জয়ধ্বনি ও বিরোধীদের তীব্র সমালোচনার মধ্যে চাপা পড়ে গেল এর পিছনের আসল উদ্দেশ্য ও পর্দার আড়ালে থাকা শক্তিগুলি।

বাবাক ওবামা মার্কিন রাষ্ট্রপতি থাকাকালীন বিদেশনীতির অগ্রাধিকারের জায়গায় ভারতের সঙ্গে স্ট্র্যাটেজিক পার্টনারশিপ চালু করার প্র‍য়াস নেন৷ এই পার্টনারশিপের অঙ্গ হিসেবে আমেরিকার উন্নয়ন এজেন্সি ইউএসএআইডি (USAID— United States Agency for International Development) ভারতের অর্থমন্ত্রকের সঙ্গে সহযোগিতার চুক্তি স্বাক্ষর করে। এই চুক্তিগুলির অন্যতম ছিল ভারতের অভ্যন্তরে এবং সারা বিশ্বে ক্যাশের বদলে ডিজিটাল লেনদেন ব্যবস্থা চালু করা। এই মার্কিন সংস্থা, বিভিন্ন ফাউন্ডেশন ও অন্য অনেকেই এই নোট বাতিলের প্রক্রিয়ায় যুক্ত ছিলেন।

২০১৫ সালে ভারতে ক্যাশলেস লেনদেনের সমস্যা নিয়ে ইউএসএআইডি-র পক্ষ থেকে একটা সমীক্ষা চালানো হয় যার নাম ‘বেয়ন্ড ক্যাশ’। ২০১৬ সালের জানুয়ারি মাসে এই সমীক্ষার রিপোর্ট প্রকাশিত হয়। রিপোর্টে বলা হয় ব্যবসায়ী, ক্রেতা বা বিক্রেতা কেউই নগদহীন লেনদেনে উৎসাহী নয়। ব্যাঙ্ক বা অন্যান্য সংস্থা যারা এই পরিষেবা প্রদান করে, তারাও প্রতিটি পরিষেবার ক্ষেত্রে শুল্ক ধার্য করে। ফলে মানুষও আরও বেশি করে উৎসাহ হারিয়ে ফেলেছেন। একটা আকস্মিক ও জোরালো ধাক্কা না দিলে মানুষকে ক্যাশলেস লেনদেনে আগ্রহী করে তোলা যাবে না এবং এর প্রকৃষ্ট উপায় বাজারে নগদের জোগান কমিয়ে দেওয়া। ভারতের কিছু অঞ্চলে ব্যাঙ্কগুলির দৈনন্দিন চাহিদার মতো নগদের জোগান কমিয়ে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক চেষ্টা চলিয়েছিল কিন্তু সাফল্যের হার খুব বেশি না হওয়ায় আগের সিদ্ধান্ত বদলে গোটা দেশে এই বিমুদ্রাকরণের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

ভারতে নোট বাতিলের সিদ্ধান্তের পিছনে কারা ছিল? ইউএসএআইডি-র রিপোর্ট বলছে ৩৫টি ভারতীয়, মার্কিন ও আন্তর্জাতিক সংস্থা একযোগে এই সিদ্ধান্ত নেয়। বেয়ন্ড ক্যাশ রিপোর্ট পেশ করার সময় এদের তালিকা তৈরি করা হয়। এরা পেমেন্ট সার্ভিসের সঙ্গে যুক্ত, এরা ডিজিটাল পেমেন্টের মাধ্যমে যে তথ্য তৈরি হয় তা থেকে রোজগার করে। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল:

১৩০ কোটি জনসংখ্যার দেশ ভারতবর্ষ। স্বাভাবিকভাবেই ডিজিটাল লেনদেনের কারবারীরা এই দেশকে টার্গেট করবে। কিন্তু দেশের মাত্র ৩০ কোটি মানুষের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট ছিল ২০১৪ সালে। আরও বেশি সংখ্যক মানুষকে ব্যাঙ্কিং-এর আওতায় আনার জন্য আমেরিকার ‘বেটার দ্যান ক্যাশ অ্যালায়েন্স’-এর সঙ্গে যোগ দিয়ে প্রধানমন্ত্রীর ‘জন-ধন যোজনা’ আসলে ছিল আমজনতাকে ক্যাশলেস সিস্টেমে নিয়ে আসার প্রাথমিক পদক্ষেপ। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে প্রত্যেক ব্যাঙ্ক সার্কুলার জারি করে জিরো ব্যালান্সে অ্যাকাউন্ট খোলার টার্গেট ঠিক করে দেয় এবং কিছুদিনের মধ্যেই তার সংখ্যা ২৫ কোটিতে পৌঁছয়। অর্থাৎ আরও ২৫ কোটি মানুষ ব্যাঙ্কিংয়ের আওতাভুক্ত হলেন। পরিসংখ্যান বলছে এক বছর পর এই জনধন যোজনার অ্যাকাউন্টগুলোতে আমানতের পরিমাণ ছিল ২২৯,৫৫৫ কোটি টাকা (বিভিন্ন ভর্তুকি ও সাধারণ জমার কারণে)। তখন হিসাব করে দেখা গেল অন্তত ২০ কোটি মানুষকে ডিজিটাল লেনদেনে আনা সম্ভব। তাই চালু হল বিমুদ্রাকরণের দাওয়াই।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কখনওই থেমে থাকতে রাজি নয়। ভারতের উপর পরীক্ষাটা সফল হলে এই পদ্ধতি তারা বিশ্বের অন্য দেশেও প্রয়োগ করবে। মার্কিন কোম্পানিগুলির যারা আইটি বাণিজ্য এবং পেমেন্ট ব্যবস্থার মাথায় বসে আছে, তাদের ব্যবসায়িক স্বার্থ এর গভীরে আছে। তবু ক্যাশ লেনদেন কমানোর জেদের পেছনে এটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কারণ নয়। ডিজিটাল পেমেন্ট বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে মার্কিন ইন্টেলিজেন্স এজেন্সি ও আইটি কোম্পানিগুলির নজরদারির বাড়তি ক্ষমতা ত্তৈরি হয়, কারণ সমস্ত পেমেন্ট ডিজিটাল ব্যাঙ্কিং-এর মাধ্যমে হলে ক্রেতা ও বিক্রেতার প্রচুর তথ্যের হদিশ পাওয়া যায়, এই সমস্ত অর্থনৈতিক তথ্যগুলো ভবিষ্যতের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

আর্থিক লেনদেনে ইলেকট্রনিক্সের ভূমিকা বহুবিধ। কার্ড পেমেন্ট, ই-ওয়ালেট ইত্যাদি বিভিন্ন মাধ্যমে এই লেনদেন চলে। এই ব্যবসার মূল রহস্যটা কোথায় তার সামান্য একটি উদাহরণ দিচ্ছি। ধরে নেই ‘পেটিএম’-কে। বর্তমানে ভারতের ১০ কোটি গ্রাহক পেটিএম ব্যবহার করে, এবং এদের মাসিক বিনিময় যদি ধরি দশ হাজার টাকা তার অর্থ এরা ক্রেতা হিসেবে দশ হাজার টাকা পেটিএম-এর মাধ্যমে বিক্রেতা পাঠিয়ে থাকে। আবার বিক্রেতারাও ডিস্ট্রিবিউটারের থেকে মাল কেনে ও পেটিএম মারফত পেমেন্ট দেয়। তাহলে শুধু পেটিএম অ্যাপের মাধ্যমে কেনাবেচা বা কাউকে টাকা পাঠানোর ফলে পুরো লেনদেনই পেটিএম-এর ঘরে থাকছে। তাহলে ব্যবসা দাঁড়াল ১০ কোটি x ১০ হাজার টাকা যেটা সবসময়ই পেটিএম-এর কাছেই থাকছে। যার জন্য ব্যবহারকারীকে কোনও সুদ দিতে হয় না। এই বিপুল টাকা বাজারে ঋণ বা শেয়ারে বা অন্যান্যভাবে বিনিয়োগ করেও লাভ করা যেতে পারে। অথবা ব্যাঙ্কের এসক্রিউ অ্যাকাউন্টে রেখে চুক্তিমতো সুদও পাওয়া যেতে পারে।

 

মেক ইন ইন্ডিয়া

২০১৪ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর মোদি সরকার ঘোষণা করল মেক ইন ইন্ডিয়া। ভারতের অর্থনীতিতে বিভিন্ন অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে বিদেশি বিনিয়োগের রাস্তা প্রশস্ত করে একশো শতাংশ বিদেশি বিনিয়োগের ছাড়পত্র দেওয়া হল। ২৫টি অর্থনৈতিক ক্ষেত্রকে বেছে নেওয়া হল বিদেশি বিনিয়োগের মাধ্যমে উন্নয়ন করার জন্য। এর ফলে বহুজাতিক ও বিশ্ববাণিজ্যের দৈত্যরা এই ক্ষেত্রগুলিতে বিনিয়োগ করে তাদের সম্পদ ও পুঁজিকে সমৃদ্ধ করার প্র‍য়াস পেল। প্রথমে নোট বাতিল, তারপর নগদে রাশ টানা ও ক্যাশলেস অর্থনীতি ছোট পুঁজির উৎপাদন এবং খুচরো ব্যবসাকে ধ্বংস করে রাঘব বোয়ালদের মৃগয়াক্ষেত্র হয়ে উঠেছে৷ ই-কমার্সের মাধ্যমে ফিনান্স পুঁজি ভারতে তাদের ব্যবসা বাড়িয়েই চলেছে। আমাজন, ই-বে, ফ্লিপকার্ট, স্ন্যাপডিল, জোম্যাটো ইত্যাদির মাধ্যমে ডিজিটাল মানির বাজার পুরোপুরি লগ্নিপুঁজির হাতে চলে গিয়েছে।

আমেরিকা তার ব্যবসায়িক স্বার্থে ভারতে নোটবাতিল করতে চেয়েছিল এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী এবং এর সঙ্গে যুক্ত ভারতীয় সংস্থারা তাদের নিজস্ব স্বার্থের কথা ভেবেই আপামর মানুষের দুর্দশার কারণ হয়ে দাঁড়াল। এর ফলে প্রধানমন্ত্রী ও তাঁর সঙ্গে যুক্ত ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর কী কী স্বার্থ রক্ষিত হয়েছে তা আলোচনা করা যাক।

  1. প্রধানমন্ত্রীর কাছের (৯০ শতাংশ গুজরাতের) ব্যক্তিদের অনাদায়ী ঋণের বোঝায় ধুঁকতে থাকা সরকারি ব্যাঙ্কগুলির পুঁজি বাড়ানো, ৬৩টি কর্পোরেট সংস্থার (আদানি, আম্বানিসহ) ঋণ মুকুব করা, ব্যাঙ্কের পুঁজি বাড়ার ফলে ঋণের সুদের হার কমিয়ে আবার সেই কর্পোরেটদের সুবিধা করে দেওয়া।
  2. জনগণকে ক্যাশলেস ব্যবস্থার মধ্যে ঠেলে দিয়ে দেশীয় বৃহৎ উদ্যোগপতিদের সুবিধা করে দেওয়া (আম্বানির জিও মানি নামের পেমেন্ট প্ল্যাটফর্ম ইত্যাদি নোট বাতিলের ফলে সরাসরি সুবিধা পেয়েছিল), এছাড়াও জনগণের কার্যকলাপ নিয়ন্ত্রণ করতে এবং ভিন্নমত পোষণকারীদের দমন করতে আধার কার্ড ও ক্যাশলেস লেনদেন যৌথভাবে সুবিধে করে দেওয়া।
  3. সাধারণ গরিব মানুষদের ক্যাশনির্ভর অর্থনীতিকে গুঁড়িয়ে ক্যাশলেস লেনদেনের আওতায় আনা।
  4. কৃষিক্ষেত্রকে বিপুল ধাক্কা দিয়ে কৃষিপণ্যের বাজারকে শিল্পপতিদের আওতায় এনে ফেলা। তার পারম্পর্য মেনেই এই সময়ে আনা হল ওই কালো কৃষি আইন।
  5. প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক দলগুলির ধনভাণ্ডারে আঘাত দেওয়া ও ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলকে সুবিধা পাইয়ে দেওয়া।
  6. মোদিকে বিপুল সাহসী ও উদ্ভাবক প্রতিপন্ন করে তাঁর সহযোগী ও পেছনে থাকা বেনিয়াগোষ্ঠীকে ফায়দা দেওয়ার চেষ্টা। মোদির নাটকীয় ভঙ্গিমা ও দুর্দান্ত অভিনয়ক্ষমতাকে সামনে রেখে তাঁর দুর্নীতির বিরুদ্ধে রণং দেহি অবতারসুলভ ইমেজ সৃষ্টি করে এক কুশলী খেলা শুরু করা।

আজ সাড়ে চার বছর পরে ২০২১-এ দাঁড়িয়ে কর্পোরেট-রাজটা ঠিক কী জিনিস সেটা আপনারা উপলব্ধি করতে পারছেন। দেশের জল, স্থল, অন্তরীক্ষ আজ এই মুষ্টিমেয় কয়েকজন প্রধানমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ীদের হাতে। কৃষি থেকে সমুদ্রবন্দর, এয়ারপোর্ট থেকে রেল, ব্যাঙ্ক, এলআইসি সহ সমস্ত রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা এদের হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছে বা তুলে দেওয়ার নীল নকশা তৈরি হয়ে আছে। যারা এতদিন এসব কিছু জানতেন না তারা জানুন, ভাবুন, ভাবা প্র‍্যাকটিস করুন। যে দেশের রাষ্ট্রপতি প্রধানমন্ত্রীর সামনে মাথা নত করে সম্মান দেখান এবং প্রধানমন্ত্রী গৌতম আদানি ও তাঁর স্ত্রীর সামনে মাথা নত করে অভিবাদন করেন, সেই দেশের ভবিষ্যৎ কী হতে চলেছে সেটা একটু বিবেচনার জন্য খানিক পুরোনো হয়ে যাওয়া ঘটনার নেপথ্য কাহিনি তুলে ধরার চেষ্টা করলাম। সবশেষে বলব—

বিরুদ্ধতার চাবুক ওঠাও হাতে
তোমার স্বদেশ লুঠ হয়ে যায়
প্রতিদিন প্রতিরাতে

 

তথ্যসূত্র

  1. অধ্যাপক রতন খাসনবিশ
  2. Abolishing Cash and the Consequences— More evidence of US involvement in Indian demonetisation— Norbert Haring